সংকট কি আদৌ ফৌজদারি? আদৌ কি পুলিশী সমস্যা?


ছয়দফায় করা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মানুষ মরেছে। কতজন? সংখ্যা এখন খুব ধর্তব্য নয়। শুধু সংখ্যা রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত হতে পারে কিন্তু সংকটের পরিসর ও গভীরতার নির্দেশক না। তাছাড়া কয়জন মরেছে, কতজন পঙ্গু হয়েছে, কতজন নিখোঁজ আর কতজন পুলিশের ভয়ে গ্রাম ছাড়া সেইসব সুনির্দিষ্ট করে নির্ণয়ের উপায় নাই। দ্বিতীয়ত ব্যাপক প্রাণহানির যে ধারা তৈরি হোল তা গ্রামাঞ্চলকে মূলত আরও রক্তপাতের দিকেই ঠেলে দিল। দ্বন্দ্ব ও বিভাজন জাতীয় পর্যায়ে কমবেশী সীমাবদ্ধ ছিল; প্রবল দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে এখন তাকে গ্রামীন সামাজিক ও পারিবারিক সংঘাতে পরিণত করা হোল। বপন করা হোল দীর্ঘস্থায়ী সন্ত্রাসের বিষ । হিংসা ও হানাহানির এটা নতুন গুণগত পর্ব।

অল্পদিনের ব্যবধানে পুলিশ সুপারের স্ত্রীসহ খুন হয়েছেন খ্রিস্টান ব্যবসায়ী ও হিন্দু পুরোহিত। যারা শুধু সরকারী ও সুশীল ভাষ্য অনুযায়ী ‘সন্ত্রাস’ বোঝেন, অথচ সন্ত্রাস সম্পর্কে আসলে কোনই খোঁজ রাখেন না, তাঁরা পরপর হত্যাকাণ্ডে খুবই বিচলিত হয়ে উঠেছেন। আসলে মানুষ মারা তো চলছিল, নতুন কিছু তো না। কিন্তু অন্যান্য হত্যাকাণ্ড থেকে আলাদা করে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী, খ্রিস্টান আর হিন্দু হত্যা গণমাধ্যমে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। যারা গুরুত্ব বাড়াতে চেয়েছে তারা সফল। এতদিন সন্ত্রাস দমনের কথা বলে যারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা, আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম খুনের মেশিনের পক্ষে ক্রমাগত সাফাই গেয়ে যাচ্ছিলেন, এখন তারা উদ্বিগ্ন।

দেখা যাচ্ছে সন্ত্রাস কমে নি, বেড়েছে। তার বিশেষ প্যাটার্ন ও রূপও ক্রমশ পরিদৃশ্যমান হচ্ছে। সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস, কিম্বা হিংসা দিয়ে হিংসা বন্ধ করা যায় না। এগুলো পুরানা কথা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তদুপরি এই লেখা যেদিন লিখছি তার আগের তিনদিনে আইনশৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে সাতজন। এর মধ্যে গতকালই রাজধানীতে নিহত হয়েছেন তিনজন। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ চলছে। এই ধরনের হত্যাকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন উভয় দিক থেকেই অপরাধ বলে বারবার সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে লিখিত ভাবে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে কী বলবে কী লিখবে যেন তারা সতর্ক থাকে।  আইন শৃংখলা বাহিনী আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে এটা যেন তারা না বলে। বলতে হবে এটা স্রেফ ‘বন্ধুকযুদ্ধ’। মেনে নিতে হবে এই ধরণের খুনে আইন ও মানবাধিকারের কোন বাত্যয় ঘটে নি।

এই যখন অবস্থা পুলিশ তখন ঘোষণা করছে তারা সাতদিনের জঙ্গিবিরোধী ‘সাঁড়াশি অভিযান’ চালাবার জন্য নামছে। যদি আমরা আসলেই নীতি ও আইন সম্পর্কে সতর্ক থাকি তাহলে বুঝতে হবে এই প্রকার উচ্চমার্গীয় পুলিশী ভাষা ব্যবহার আগাম সতর্ক সংকেতের মতো। বিশেষত যখন আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আইন ও মানবাধিকারের দিক থেকে স্পষ্ট ভাবে আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলা জরুরী হলেও সেভাবে চিহ্নিত করা যাবে না। পুলিশী নিষেধ রয়েছে। একে মানবাধিকার কর্মীদের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ই বলতে হবে। তাহলে আমরা আন্দাজ করতে পারি বন্দুকযুদ্ধেরই প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। একজন পুলিশ অফিসার দেখেছি সরাসরি যুদ্ধেরই ডাক দিয়েছেন। ভেবে দেখুন আমরা এখন কোথায় এসে পড়েছি।

পুলিশ নাগরিকদের মনোবলে মলম দিতে চাইলে পালটা নাগরিকদের উৎকন্ঠার আগুনে ঘি পড়ছে। ভাষা হিসাবে সাঁড়াশী অভিযান’ সন্ত্রাসেরই পাল্টা পরিভাষা মাত্র। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে আমাদের সমস্যা বা সংকট কি আদৌ ফৌজদারি? আদৌ কি পুলিশী সমস্যা? আদতেই কি তা ব্যাক্তি বা বিচ্ছিন্ন দল বা গ্রুপের সন্ত্রাস? নাকি পুরাটাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরই এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। রাষ্ট্র, আইন শৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসন যখন চরম সন্ত্রাসী চরিত্র পরিগ্রহণ করে তখন তার পাল্টা প্রতিরোধ হিসাবে পাল্টা সন্ত্রাসই দানা বাঁধে। বাঁধবেই। এর অন্যথা হয় না। একে দমন করা যাবে কিনা তা নির্ভর করছে দুইপক্ষের রাজনৈতিক বয়ান ও কৌশলের ওপর। একপক্ষ হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকার নিজে এবং তার প্রতিনিধিরা; আর উল্টা দিকে আছে যারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সন্ত্রাস বলি কি সহিংসতা বলি -- বিশেষ কৌশল অবলম্বন করছে। আমরা তাদের অপছন্দ করতে পারি, ঘৃণা করতে পারি, নিন্দা জানাতে পারি – তাতে বাস্তবের কোন হেরফের হবে না। রাষ্ট্র যাদের নির্মূল করতে চায় বর্তমান পরিস্থিতিতে তারাই লাভবান হবে। বিশেষত যেখানে ক্ষমতাসীনদের বৈধতা ও ন্যায্যতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিদ্যমান রাষ্ট্র কোন অর্থেই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে না। সরকারের বয়ানের কোন গ্রহণযোগ্যতা নাই, সরকারের কৌশল আগেও অকার্যকর ছিল, আবাব্রও অকার্যকর বলে প্রমাণিত হবে এতে কোন সন্দেহ নাই।

অনেকেই তাই ধারণা করছেন আমরা খুব বড় ধরণের সংঘাতের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। অবশ্য বড় ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের সম্ভাবনার কথা আমি এর আগেও বলেছি। কিন্তু আমরা কেউই নিশ্চয়ই তা চাইব না। কিন্তু চাওয়া আর বাস্তবতার মধ্যে ফারাক বিস্তর। যদি আসলে না চাই তাহলে পরিস্থিতিকে ইতিহাস ও বাস্তবতার নিরিখেই আমাদের বুঝতে হবে। কোন পক্ষের প্রপাগাণ্ডা কিম্বা পূর্ব অনুমানের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে নয়। সমাজ এখন এতোই বিভক্ত ও খণ্ড খণ্ড হয়ে রয়েছে যে অনেকেরই ভাষা, দাবিদাওয়া ও কর্মকাণ্ড আমরা আর আগের মতো বুঝি না। আগে বুঝতাম সেটা দাবি করা যাবে না। কিন্তু এখন তা বুদ্ধির অগম্য হয়ে গিয়েছে।

পরিস্থিতি আসলে খুবই জটিল। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী, সেটা বোঝা কঠিন নয়। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের ভাল ও মন্দ কিম্বা স্বার্থ ও ঝুঁকির দিক নিয়ে ভাববে এতে অবাক হবার কিছু নাই। নিজেদের মূল্যায়ন অনুযায়ী তারা বাংলাদেশের মতো দুর্বল দেশে হস্তক্ষেপ করবেই। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারনে। সেটা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন সংকট। আমরা আদৌ ষোল কোটি মানুষকে একই সমাজের অন্তর্গত গণ্য করি না। সকলকে নিয়ে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত নই। কোন সমস্যা বা সংকট নিয়ে গভীর ও বাস্তবোচিত ভাবে ভাবতে পারা তো পরের ধাপ।

ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের অধিকাংশই যখন মনে করে যে-ছেলেটি ইসলামপন্থী রাজনীতি করে তাকে নির্মূল করলেই দেশে শান্তি আসবে, তাহলে তো নির্মূলের রাজনীতি পাল্টা রক্তপাত আর অশান্তি ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনবে না। এই প্রশ্ন আমরা করি না একজন মানুষ আমার মতাদর্শ গ্রহণ করে না কেন? নিজের চিন্তায় ভুল আছে কিনা তার পর্যালোচনা আমরা জরুরী মনে করি না। অপরকে দোষারোপ করাই তখন অভ্যাস হিসাবে গড়ে ওঠে। মানুষ ভুল করতেই পারে এবং সুযোগ পেলে তার ভুল বুঝতেও পারে। কিন্তু পুরা সমাজ যখন ভুলের ওপর দাঁড়ায় তখন কারুরই রক্ষা পাবার উপায় থাকে না।

প্রতিপক্ষকে নির্মূলের মানসিকতা ভয়ানক ব্যাধি, এই অসুখ থেকে আমাদের নিরাময় হবে কিভাবে? এই ধরণের নির্মূল করবার মানসিকতা ইসলামপন্থার পক্ষে যতো ক্ষুদ্রই হোক স্রেফ মানবিক কারণেই রাজনৈতিক সমর্থন গড়ে তুলবে। তার সঙ্গে আদর্শিক যুক্তি যোগ হলে সেটা রাজনৈতিক শক্তি হয়েই হাজির হবে। যে ইসলামপন্থী রাজনীতি সেকুলাররা প্রবল অপছন্দ করে তা গড়ে ওঠার কারন ধর্ম নিরপেক্ষবাদী নিজেরাই। গণমাধ্যমে সরকারের পক্ষের গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যকে যদি সঠিক মানি তাহলে দেখা যাচ্ছে জে এম বির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসী দিয়ে জে এমবির বিস্তার রোধ করা যায় নি। তারা বেড়েছে ও বাড়ছে। যাঁরা তাঁদের রাজনীতিকে সঠিক গণ্য করেছে তাদের কাছে তারা শহিদের মর্যাদাই পাচ্ছেন। তারা বাড়বে। রাজনৈতিক বাস্তবতাই তাদের সবেগে বৃদ্ধির শর্ত হয়ে হাজির হয়েছে।

যদি অন্যদিকে ইসলামপন্থিরা মনে করে বিধর্মী, নাস্তিক ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের হত্যা করলে বাংলাদেশে ইসলাম কায়েম হয়ে যাবে তাহলে ইসলাম কায়েম হওয়া দূরের কথা, ইসলামের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব বরং বাড়বে। তারা নিজেদের অজান্তে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের পরিস্থিতিকেই ত্বরান্বিত করছে। সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোকে এই আলোকে ভাববার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই অভাগা দেশটির আভ্যন্তরীণ রাজনীতি কিভাবে সার্বভৌ্মত্বের সংকট তৈরি করে চলেছে তা নিয়ে ভাববার কেউই আসলে নাই।

দুই

কথাবার্তা কিম্বা লেখালিখির দিক থেকে 'সন্ত্রাস', 'সন্ত্রাসবাদ' ইত্যাদির ব্যবহার উস্কানিমূলক ও বিতর্কিত। সন্ত্রাস ও সহিংসতার নানান মাত্রা ও স্তরভেদ আছে, কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্য কোন সংজ্ঞা নাই। আমাদের জন্য বিশেষ বিপদ হচ্ছে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনৈতিহাসিক এবং ঘোরতর অস্পষ্ট। 

ঔপনিবেশিক আমলে সুর্য সেন ( ১৮৯৪ - ১৯৩৪) অস্ত্রাগার লুন্ঠন করেছেন। ব্রিটিশদের চোখে তিনি ‘সন্ত্রাসী’। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শুধুমাত্র হিন্দু সদস্য নিয়ে গঠিত নিজের দলের নাম পরিবর্তন করে তিনি “ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ” করেছিলেন। বাংলায় নাম দিয়েছিলেন “ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী, চট্টগ্রাম শাখা”। বলাবাহুল্য ঔপনিবেশিক শাসকের কাছে সন্ত্রাসী হবার কারনে তিনি অপরাধ করেছেন। তাঁর শাস্তি হয়েছে। তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে  যুদ্ধের যে ছক এঁকেছিলেন তার মধ্যে ‘দলে দলে ইউরোপিয়ানদের হত্যা’ করাও অন্তর্ভূক্ত ছিল। ইউরোপীয়রা নির্দোষ কিনা সে বিচার সূর্য সেনের ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী করে নি। কিন্তু সূর্য সেন ঔপনিবেশিক ভারতের শাসিতদের কাছে বিপ্লবী। শুধুমাত্র হিন্দু সদস্য নিয়ে গঠিত হলেও তাঁর দল ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের চোখে ‘অসাম্প্রদায়িক’। এই তর্কটুকু বাদ দিলে এটা পরিষ্কার ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী এই দেশের জনগণ সুর্য সেনের ভূমিকাকে কখনই অস্বীকার করে নি। সুর্য সেনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে তারা তাদের নিজেদের মুক্তিই দেখেছিল। শুধু তাই নয়, শুধু মাত্র হিন্দু সদস্য নিয়ে পরিচালিত চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহের প্রতি মুসলমান সমাজের সহানুভূতি মোটেও কম ছিল না। বাঙালী জাতীয়তাবাদ সূর্য সেনকে বিপ্লবী হিসাবে স্বীকার করে নিতে আপত্তি করে না।

ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯ - ১৯০৮) রুশো কিম্বা কার্ল মার্কস পড়ে ঔপনিবেশিক ইংরেজের বিরুদ্ধে বোমা মারতে নামেন নি। তার শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বোসের কাছ থেকে পড়া শ্রীমদ্ভগবদগীতা ছিল তার অনুপ্রেরণা। আঠারো বছর বয়েসী যে ছেলেটি হাসতে হাসতে ফাঁসিতে প্রাণ দিতে দ্বিধা করে নি ধর্ম তার অনুপ্রেরণা ছিল, এই ইতিহাস আমরা আড়াল করি।। রাজনৈতিক দল যুগান্তরে তার যোগ দেবার পেছনের ইতিহাস খোঁজ করলে আঠারো থেকে ২৫ বছর বয়েসী কিশোর ও তরুণ কেন বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে তার কিছু হদিস আমরা করতে পারব। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ক্ষুদিরাম পুলিশ স্টেশনের কাছে বোমা পুঁতে রাখেন এবং ইংরেজ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করেন। একের পর এক বোমা হামলার দায়ে ৩ বছর পর তাকে আটক করা হয়। ৩০ এপ্রিল ১৯০৮-এ মুজাফফরপুর বিহারে রাতে সাড়ে আটটায় ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ক্ষুদিরামের বিচার শুরু হয়; তারিখ  ২১ মে ১৯০৮ । ক্ষুদিরামকে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছিলেন। অনেক গানও তখন রচিত হয়েছিল। যেমন এখনও জনপ্রিয় ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। পীতাম্বর দাসের রচনা ও সুর করা এই গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকার। আমরা শোকগ্রস্ত চিত্তে সেই গান শুনি। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ফাঁসিতে প্রাণ দেওয়া ক্ষুদিরামকে কে এখন ‘সন্ত্রাসী’ বলবে?

কিন্তু ইতিহাস ও স্মৃতিচর্চার বিচার যদি করি তাহলে দেখা যায় ইতিহাসের আরও অনেক গুরুত্বপুর্ণ তথ্যকে রাজনৈতিক কারণে আমরা ভুলে যাই, গৌণ করি, এমনকি মুছে ফেলার চেষ্টা করি। শুধু সূর্য সেন ও ক্ষুদিরাম নয় -- বৃটিশ বিরোধী ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, সন্দ্বীপের গণ বিদ্রোহ, সৈয়দ মীর নেসার আলী তিতুমীরের (১৭৮২-১৮৩১) সশস্ত্র সংগ্রাম, সৈয়দ আহমদ বেরেলভির নেতৃত্বে সংগ্রাম এবং হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) ও তার পুত্র পীর মুহসীনউদ্দীন দুদু মিয়ার (১৮১৯- ১৮৬২) নেতৃত্বে ফরায়জী আন্দোলন এবং ১৮৫৭ সালে সংঘটিত বিখ্যাত সিপাহি বিদ্রোহ ইত্যাদি সকল ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাঘটনের সঙ্গে এই দেশের জনগণের ভাগ্যের উত্থানপতন ঘটেছে। একই ভাবে তাদের চিন্তা চেতনার গঠন ও বিবর্তনও ঘটেছে। অথচ বাংলাদেশে আমরা নিজেদের যে আত্মপরিচয়ের বয়ান হাজির করি সেখানে ইতিহাসের এই সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং তার কারণে মোড় পরিবর্তনের দিক গুলো আজ অবধি চরম ভাবে উপেক্ষিত। এই দেশের জনগোষ্ঠির ইতিহাসকে আমরা স্রেফ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অধিক কিছু গণ্য করি না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের দৌলতে সেখানে সূর্য সেন ও ক্ষুদিরাম আছে, কিন্তু তীতুমীর, সৈয়দ আহমেদ বেরেলভি, হাজী শরিয়তুল্লাহরা নাই। সরকারী বয়ানের বাইরে জনগণের মধ্যে তাদের ইতিহাস এই উপেক্ষা কিম্বা সচেতন বিস্মৃতির কারণে অপসৃত হয় নি। বরং ঠিকই জারি রয়েছে। এই ঐতিহাসিক বিস্মৃতি ও অস্বীকারের পরিণতি নিয়ে আমরা আদৌ ভেবেছি কি? ভাবি নি। ভাবি না।

আঠারোশ সাতান্ন সালের সিপাহি বিদ্রোহ ছিল আসলেই ভারতের প্রথম সর্বাত্মক স্বাধীনতা যুদ্ধ। কিন্তু তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়া ওঠা বাংলাদেশের ইতিহাসের সম্পর্ক আমরা কতোটা বুঝি, কতোটা বোঝার জন্য আগ্রহী? প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের দমদমে (২২শে ফেব্রুয়ারি) তারপর বহরমপুর (২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি) সেনা ছাউনিতে শুরু হয়ে ক্রমে ব্যারাকপুর (২৯শে মার্চ), মীরাট (৯ই মে) ও দিল্লী (১১ই মে) হয়ে সারা ভারতবর্ষে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বৃটিশ সেই বিদ্রোহ খুবই কঠোর আর হিংস্র ভাবে দমন করে। সিপাহিরা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিল। বিদ্রোহের ব্যর্থতা্র কারনে বহু সৈনিককে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে। অনেককে জেলে দ্বীপান্তরে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে। সেই বছরের ১৮ই নভেম্বর রাতের প্রথম প্রহরে চট্টগ্রামের সিপাহিরা বিদ্রোহে যোগ দেয় এবং অস্ত্রাগার ও কোষাগার দখল করে, জেলের কয়েদীদের মুক্ত করে দেয়। সে রাত ও পরদিন গুলি বিনিময় হয়। চট্টগ্রাম শহর সিপাহিদের দখলে আসে। ভীত সন্ত্রস্ত সরকারি উচ্চ পদস্থ ইংরেজরা পরিবার-পরিজনসহ জাহাজে আশ্রয় নিয়ে জাহাজ দূরে নোঙ্গর করে রাখে।

ইতিহাসকে আমরা মুছে ফেলি, চাপা দিয়ে রাখি কিম্বা চোখের আড়ালে রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা করি কিন্তু সেই ইতিহাস ইতিহাসের নিজ গুণেই আবার প্রত্যাবর্তন করে। বাংলাদেশে একাত্তরের পর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা ইসলামপন্থী রাজনীতিকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসাবে বুঝতে চাওয়া মানে কার্পেটের তলে ঘরের ময়লা লুকিয়ে রাখার মতো। আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক সেকুলারদের একদেশদর্শী মানদণ্ড দিয়ে আমরা ইতিহাস বুঝব না। ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী জাতিবাদী রাজনীতিরই যে অনিবার্য পরিণতি আমরা এখন ভোগ করছি তাকে বোঝা, বিশ্লেষন করা এবং নিজেদের সম্ভাব্য বাস্তবোচিত অভিমুখ নির্ণয় করাই এখনকার কাজ। বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতি ভুঁইফোড় কিছু নয়। উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই সংগ্রাম থেকে এখনকার ইসলামপন্থী রাজনীতিকে আলাদা করা যায় না।

কিন্তু ইসলামপন্থি বলি কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষ বলি উভয়ের বয়ান ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড়ায়। তারা উভয়েই এই ইতিহাসের বিরুদ্ধে ও বিপরীতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বা আলাদা করার কাজটা করে। ইসলামপন্থিদের একাংশের ধারণা তাদের লড়াই একান্তই কোরান হাদিস সুন্নার ভিত্তিতে তৈরি নিজের আত্মপরিচয় তৈয়ার ও মুসলমান হিসাবে তার জাতিগত স্বার্থ রক্ষার লড়াই। তাদের অনেকের দাবি কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে তাদের মজহাবের অনুসারী না হলে তাদের সংগ্রামের মর্ম কেউ বুঝবে না। ‘বিশ্বাস’ এই ক্ষেত্রে সত্যকারের দিব্য অভিজ্ঞতা না হয়ে ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং নিজের অপরিণত চিন্তাকে পর্যালোচনার অধীনে আনবার করুণ অক্ষমতা হয়ে ওঠে। বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিপদ এই অক্ষমতার মধ্যে নিহিত। অথচ এখনকার কাজ হচ্ছে ইসলাম মানবেতিহাসের নতুন অভিমুখ নির্মাণে কোথায় কিভাবে অনিবার্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম সেটা তত্ত্বে ও কাজে প্রদর্শন করা। কিম্বা আদৌ রাখবে কিনা সেই প্রশ্ন মোকাবিলা এবং প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জের উত্তর দেওয়া।

অন্যদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা আজ অবধি সাম্প্রদায়িক হিন্দু ঐতিহাসিকদের ইতিহাসের বাইরে এই দেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজেদের যে আলাদা একটি ইতিহাস, বোঝাবুঝি ও উপলব্ধি আছে তাকে ক্রমাগত অস্বীকার করে এসেছে। ফলে তারা ইতিহাসের যে বয়ানটি গ্রহণ করে তা একান্তই ইসলাম বিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ। এর ইন্টারেস্টিং দিক হচ্ছে তাদের ইসলাম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক বয়ানের বাইরে যখন উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস কিম্বা সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার লড়াইয়ের তর্ক ওঠে, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা একে সাম্প্রদায়িক বয়ানের অধিক কিছু ভাবতে পারে না। ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ও হিন্দুত্ববাদী বয়ানের বিপরীতে এই দেশের গণমানুষের লড়াই-সংগ্রামের নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসে  হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে বর্ণ, শ্রেণি ও লিং ভেদে বিভিন্ন মাত্রায় অংশগ্রহণ করেছে। অনেকে বিরোধিতাও করেছে, আপোষ তো আছেই। সেই লড়াইয়ে মুসলমানদের অংশ গ্রহণের পেছনে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো তাদের নিজ নিজ যুক্তি, ঐতিহাসিক উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা কাজ করেছে। অথচ সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমানদের এই সকল ঐতিহাসিক উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস ক্রমাগত অস্বীকার করা হয়েছে। তারাই এখন বাংলাদেশের ইতিহাস হিসাবে সম্প্রদায়ের উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস হিসাবে হাজির হচ্ছে। এর অন্যথা অসম্ভব। ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা বাঙালির ইতিহাস লিখতে গিয়ে যদি উচ্চ বর্ণের হিন্দুর বয়ানকে ‘প্রামাণ্য’ মানে তাহলে তার পালটা আরেকটি ‘প্রামাণ্য’ বয়ান তৈরি হবে, সেটা সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমানদের বয়ানই হবে। সেই বয়ানের গর্ভে সূর্য সেন ও ক্ষুদিরামদের মতো বিপ্লবী জন্মগ্রহণ করবে। ধর্মগ্রন্থ যাদের অনুপ্রেরনা। যাদের ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া হয় তারাই ইতিহাসের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে আমরা এই পর্যায়ে আছি। একে কি আমরা ‘সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে সামরিক কায়দায় ‘নির্মূল’ করতে পারব? ‘বন্দুকযুদ্ধ’ চালিয়ে মানুষ হত্যা করে কি মোকাবিলা করা সম্ভব?

বলাবাহুল্য, যেখানে বাংলাদেশে ইতিহাস বিবেচনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ক্ষীণ সেখানে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের কোন তোয়াক্কা না করে পুলিশের ‘সন্ত্রাস দমন’ কিম্বা ‘সাঁড়াশি অভিযান’ মূলত ইসলাম ও ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য শক্তি ও দিল্লীর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের স্থানীয় সংস্করণের অধিক কিছুই হবে না। এর ফলে সংঘাত ও হানাহানি পরিস্থিতিকে আরও রক্তাক্ত করবে। পুরা উপ মহাদেশ ব্যাপী তা ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা। একে সামাল দেবার অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ বাংলাদেশের আদৌ আছে কিনা অভিজ্ঞরাই বলতে পারবেন। অতএব প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে আসলে আমরা কী ধরণের জটিল ও সংবেদনশীল ঐতিহাসিক সংকট মোকাবিলা করছি সে সম্পর্কে অবিলম্বে জাতীয় পর্যায়ে আলাপ আলোচনা করবার ক্ষেত্র তৈরি করা। সমাজ,ইতিহাস, ধর্ম বিশ্বাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকে একে বোঝার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করা। এর দায় সকলের। তবে পুলিশ বাহিনীর প্রতি অনুরোধ তাঁরা যেন একে তাদের যুদ্ধে পরিণত না করে। আইনশৃংখলা বাহিনী নিজেদের সচেতন করে তোলার জন্য এই দায় নিজেদেরই নেওয়া উচিত।

নিদেন পক্ষে তাঁদের বোঝা উচিত সমস্যাটা সামরিক বা পুলিশী নয়। রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক। সমস্যার সমাধানও একই সঙ্গে ঐতিহাসিক বিস্মৃতির মীমাংসা ও রাজনৈতিক হতে হবে।

২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩। ১০ জুন ২০১৬। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।