আত্মপরিচয়ের রাজনীতির বিপদ


সংঘাতের চরিত্র যাই হোক, দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রতিটি সমাজেই থাকে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চরিত্র বোঝা এবং সমাজ কিভাবে তা সমাধান করছে, কিম্বা করতে ব্যর্থ হচ্ছে তার দ্বারা একটি সমাজের টিকে থাকা না থাকা সম্পর্কে আগাম অনেক কিছু অনুমান করা যায়। সংঘাত আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের দ্বন্দ্ব বা বিরোধ থেকে হতে পারে; কিম্বা বোঝাবুঝি, চিন্তাচেতনার ফারাক অথবা সাংস্কৃতিক-আদর্শিক বিরোধ থেকেও হতে পারে। দ্বন্দ্ব-সংঘাত হতে পারে মীমাংসার অতীত, আবার নাও হতে পারে -- এই ধরনের তর্ক বাম মহলের প্রাচীন একটি তর্ক। যেমন বিরোধ কি এন্টাগনিস্টিক নাকি নন-এন্টাগনিস্টিক, ইত্যাদি।

তবে আর্থ-সামাজিক বিরোধের রাজনৈতিক প্রকাশ কিভাবে ঘটে সেটা নির্ণয়ের পদ্ধতি এবং তার সম্ভাব্য পরিণতি আগাম বলা যায় কিনা সেই সকল বিষয় নিয়ে তর্কের মীমাংসা হয় নি।  যেমন, পুঁজির সঙ্গে শ্রমের দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু দেশকালপাত্র ভেদে তার সাংস্কৃতিক কিম্বা রাজনৈতিক প্রকাশ  কিভাবে ঘটে সে ব্যাপারে প্রচলিত বামপন্থা সদুত্তর দিতে পারে না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি এবং ধর্ম নিরপেক্ষ বা ধর্ম বিদ্বেষী রাজনীতির মধ্যে যে বিরোধ তার সঙ্গে পুঁজি আর শ্রমের বিরোধাত্মক সম্পর্কের সম্পর্ক কোথায়? কিভাবে সেটা ঘটে? কিম্বা ধনি ও গরিবের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কেন সবসময় স্রেফ আর্থিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব হিসাবে হাজির হয় না? সমাজের আরও অনেক উপাদান আছে যাকে স্রেফ অর্থনৈতিক সম্পর্কে পর্যবসিত করে অনুধাবন বা বোঝা অসম্ভব। যেমন ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়, ধর্মবোধ, ধর্মীয় পরিচয়, সম্প্রদায় চেতনা, লিঙ্গ চেতনা কিম্বা নারীপুরুষ ভেদবোধ, ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে জটিল হচ্ছে আত্মপরিচয়। কিভাবে আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে? তার সঙ্গে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সম্পর্ক কোথায়?  কিভাবে আত্ম-পরিচয় রাজনৈতিক হয়ে ওঠে? 'আমরা' আর 'ওরা' হয়ে ওঠে? কিভাবে তা মীমাংসার অতীত রাজনৈতিক বিরোধে পরিণত হয়? কিভাবে আত্মপরিচয় ভিত্তিক রাজনৈতিক কর্তাসত্তা গঠিত হয় এবং রাজনীতি বা ইতিহাসে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করে? একালে এই সকল প্রশ্ন রাজনৈতিক বিচার বিশ্লেষণের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে

এই উপমহাদেশে আমরা ধর্মের প্রশ্ন মীমাংসা করতে পারি নি। ধর্ম পরিচয়  আত্মপরিচয় নির্মাণের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক কর্তাসত্তার জন্ম দেয় তাকে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের অধীনে আনতে আমরা ক্রমাগত অস্বীকার করেছি। তাকে সাম্প্রদায়িক বলে নির্মূল করবার রাজনীতি করেছি। উলটা বাঙালি জাতিবাদী আত্মপরিচয়কে ঐতিহাসিক ভাবে বিচার না করে তাকে চিরায়ত ও শাশ্বত দাবি করেছি। এর ফলে এখন জাতিবাদী ও ধর্ম ভিত্তিক আত্মপরিচয়ের মধ্যে যে রাজনৈতিক বিরোধ তৈরি হয়েছে তা ক্রমশ মীমাংসার অতীত হয়ে পড়ছে। এই অমীমাংসা আগামিতে আসন্ন বড়সড় রাজনৈতিক তুফানকে প্রলয়ংকরী করে তোলে কিনা সেটাই এখন বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধর্মের সঙ্গে ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক কি হতে পারে তাকে পর্যালোচনার অধীনে আনার গুরুত্ব আমরা কখনই স্বীকার করি নি। পাশ্চাত্য যে অর্থে 'রিলিজিয়ন' বোঝে, আমরা সেভাবেই 'ধর্ম' কথাটা বুঝেছি। ইসলাম যখন 'দ্বিন' কথাটা বলে, সেটা যে খ্রিস্টিয়  'রিলিজিয়ন' কিম্বা পাশ্চাত্যের খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাস দিয়ে বোঝা যায় না, এই অতি সাধারন সত্য আমল করি নি। সামন্তবাদ ও গির্জার হাতে কুক্ষিগত রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। প্রাচ্য ইউরোপীয় সামন্তবাদের ইতিহাস নয়। মন্দির, মসজিদ, মঠ বা আখড়ার হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল না। কিন্তু আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মানদণ্ড দিয়ে ধর্ম ও রাজনীতির ইউরোপীয় বিভাজনকেই আমরা শ্বাশ্বত ও সার্বজিনীন মেনে নিয়েছি। ধর্মকে পাশ্চাত্যের অনুকরণে প্রাইভেট ব্যাপার দাবি করে সংস্কৃতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্মকে নির্বাসিত করেছি। 'দ্বিন' কথাটির মধ্যে মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার ধারণা কিভাবে নিহিত তাকে পর্যালোচনার কোন দায় বোধ করি নি। কথাটাকে আদৌ আমলে নেই নি। কারণ ইতোমধ্যে আমরা 'রিলিজিয়ন''ই শুধু বুঝি, ভিন্ন কিছু বুঝবার ক্ষমতা হারিয়েছি। মানুষের জীবন যে নিছকই জীবের জীবন নয়, তার মধ্যে কিছু দিব্যগুণাবলী আছে যার চর্চার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও সামাজিক বিধি বিধান দরকার 'দ্বিন' ধারণার মধ্যে নিহিত এই 'ধর্ম নিরপেক্ষ' আহ্বান আমাদের কানে এসে পৌঁছায় নি। 'দ্বিন' শব্দটি আরবি বলে একে ইসলামি ধর্মতত্ত্বের বাইরে এর আলাদা তাৎপর্য থাকতে পারে সেটা বিবেচনা করে দেখি নি। একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং তার ইতিহাস হিসাবে পর্যালোচনার করবার হিম্মত আমরা গড়ে তুলতে পারি নি।

আমরা ইউরোপীয় হয়েছি। আধুনিক। কে ইসলামের পক্ষে আর কে বিপক্ষে সেটা এখন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে -- ইউরোপীয় মন নিয়েই আমরা ধর্ম বুঝি। ইউরোপীয় মনমানসিকতা নিয়েই  ইসলাম পড়ি, ইসলাম বুঝি।  ইসলামপন্থী হোক কিম্বা বিপরীতে হোক ধর্ম নিরপেক্ষ জাতিবাদী -- উভয়ের জগত একটাই। ভাববার কোন কারন নাই যে আমরা নিজেকে ইসলামপন্থি দাবি করি বলে -- যতোই ইউরোপীয় অর্থে 'র‍্যাডিক্যাল' হই না কেন -- ইউরোপীয় চিন্তার পরিমণ্ডলের মধ্যেই আমরা বাস করি। এর বাইরে বাস করবার শক্তি আমরা এখনও অর্জন করি নি। সেটা দীর্ঘ অধ্যবসায়, প্রজ্ঞার চর্চা কিম্বা ইসলামি অর্থে নিজের সঙ্গে নিজের  'জিহাদ' বা নিজেকে রূপান্তরের প্রশ্ন। যে দুটি পক্ষে আমরা বিভক্ত হয়ে পড়ছি সেই দুটি পক্ষই ইউরোপীয় মনমানসিকতা ও চিন্তার জগত থেকে উৎক্ষিপ্ত। দুইপক্ষ পরস্পরের মধ্যে পরস্পরকে আবিষ্কার করে, নিজের 'অপর' দ্বারা তাদের নিজ নিজ আত্মপরিচয় ও বিরোধের চরিত্র নির্ণয় করে। ধর্মের প্রশ্ন মীমাংসা না করা কথাটাকে তাই হাল্কা ভাবে নেবার উপায় নাই।  নাফসানিয়াত থেকে রূহানুয়াতের অভিমুখে নিজেকে উত্তরণের লড়াইকে যতোই স্রেফ ধর্মতত্ত্ব বলে নাকচ করি না কেন, মানবেতিহাসের এই ঐতিহাসিক কর্তব্যটুকু পালনের অভাব থেকেই যায়। এই উত্তরণের প্রশ্ন আসলে চিন্তার একটি বদ্ধ পরিমণ্ডল, একটি যুগ, মানবেতিহাসের একটি পর্ব, একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে যাবার প্রশ্ন।

দুই

আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক পুরা দক্ষিণ এশিয়াতেই অমীমাংসিত বিষয় হয়ে রয়েছে। রাষ্ট্রকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাখবার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র তার সমাধান করতে পেরেছে বলে যে দাবি আমরা এতোকাল শুনেছি, সম্প্রতিকালে ইউরোপে ও আমেরিকায় পরিচয়কেন্দ্রিক রাজনীতির শক্তি বৃদ্ধির ফলে তার মৃত্যুঘন্টা আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যে ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম আতংকের প্রাবল্য বৃদ্ধি সেই পুরানা থিসিসকেই সত্য প্রমাণ করছে যে পাশ্চাত্য নিজেকে ইসলামের ‘অপর’ হিসাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। এই ভাবনার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য তার খ্রিস্টিয় পরিচয়কেই প্রধান করে তুলছে, যেখানে ইসলাম বাইরের উপদ্রব। সাদা খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্য সভ্যতার দুষমন হিসাবেই ইসলামের পরিচিতি। ধর্মীয় পরিচয় রাজনীতির নির্ণায়ক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র সকল প্রকার আত্মপরিচয়ের বাইরে বা উর্ধে যে নিরপেক্ষ ‘রাজনৈতিক পরিসর’ রক্ষা করবার দায় নিতে পারে বলে এতকাল দাবি করে এসেছে, সেখানে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বলা হয়, আধুনিক রাষ্ট্র ধর্ম কিম্বা ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্নে উদাসীন বা নিরপেক্ষ। এই ঔদাসীন্য ও নিরপেক্ষতার মধ্যেই নাকি আধুনিক রাষ্ট্রের অগ্রসরতা ও শক্তি নিহিত। অথচ সাম্প্রতিক কালে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে আধুনিক রাষ্ট্রের ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ সোনার তৈরি পিতলের কলসির মতো স্ববিরোধী বাগাড়ম্বরের অধিক কিছু নয়।

ভাষা, জাতিচেতনা, সভ্যতা/অসভ্যতার ধারণা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র নিরপেক্ষ নয়। ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের অমীমাংসা প্রকট ভাবে ধরা পড়ে যখন রাষ্ট্রের নামে যুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ বা জাতির পরিচয় রক্ষার জন্য প্রতিপক্ষকে হত্যা বৈধ বলে গণ্য করা হয়। আধুনিকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতার কালে ধর্মের নামে যুদ্ধ বা ধর্মের কারণে হত্যাকে আমরা বৈধ মনে করি না, কিন্তু জাতি বা রাষ্ট্রের নামে হত্যা বৈধ গণ্য করি। কেন? তার কোন সদুত্তর নাই। দরকার ছিল অপরকে হত্যা করবার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা, অপরের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয়ের তরিকা আবিষ্কার করা। কিন্তু আধুনিকতা সেই ক্ষেত্রে আমাদের কোন পথ দেখাতে পারে না। ধর্মের নামে হত্যার অধিকারকেই জাতিবাদ ও আধুনিকতার যুগে জাতি বা রাষ্ট্রের নামে হত্যার অধিকারে পর্যবসিত করেছে। মানুষ কি আদৌ অগ্রসর হয়েছে?

ধর্মের নামে হত্যা অন্যায়, এই যুক্তি মানলে প্রশ্ন তোলা যায় তাহলে রাষ্ট্রের নামে কিম্বা জাতির নামে হত্যা বৈধ হবে কেন? হত্যার অধিকার চর্চার মধ্য দিয়ে ধর্ম, জাতি বা রাষ্ট্র যে সার্বভৌম ক্ষমতার চর্চা করে তাকে পর্যালোচনার অধীনে আনা একালে জরুরী। যদি ধর্মীয় পরিচয় থেকে মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর সমাজ ও রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি আমাদের কাছে আদরণীয় হয়, তাহলে জাতি বা রাষ্ট্রের পরিচয়ে পরিচিত হবার রাজনীতিকে আমরা অগ্রসর রাজনৈতিক চিন্তা বলব কেন? প্রশ্নগুলো সমস্যার গভীরতা বোঝার জন্য তুলছি। ঐতিহাসিক বিচারে দেখা যায় আধুনিক কালে ধর্ম পরিচয়ে পরিচিত হবার অধঃপতনের কথা বাদ দিলে আদতে ধর্ম মানুষকে গোষ্ঠি, নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়, জাতি, বর্ণ ইত্যাদির বন্ধন থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র জাতীয়তা ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের নামে মানুষকে খণ্ডিত রাখে। জাতিতে জাতিতে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধের শর্ত তৈরি করে। বর্ণবাদকে টিকিয়ে রাখে, চিরতরে উৎখাত করতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি আচরণের মধ্য দিয়ে আমরা তা বুঝতে পারি।

এটাও তাহলে আমাদের বুঝতে হবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা – অর্থাৎ ধর্মের পরিচয়ে আধুনিক কালে নিজের পরিচয় তৈয়ারির অসুখ ধর্মকে তার স্বাভাবিক গৌরব থেকে বিচ্যুত করেছে। মুসলমান আর ইসলাম এ কারণে সমার্থক নয়। ইসলাম বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের আত্ম পরিচয় নির্মানের হাতিয়ার মাত্র নয়। মানবেতিহাসে ইসলামের প্রস্তাবনা বিচারের কাজ যে কারণে জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুম মুসলমানের লড়াই সংগ্রাম থেকে ভিন্ন ভাবে বিচার করা জরুরী। বলা বাহুল্য যে কোন জালিমের মতো মুসলমানও জালিম হতে পারে। তার আত্মপরিচয় সেই ক্ষেত্রে কোন রক্ষা কবচ হতে পারে না। এই সকল পার্থক্য আধুনিক কালে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই।

বলা বাহুল্য ইত্যাদি প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর সম্ভব নয়। এখানে সে চেষ্টা করব না। তবে হোলি আর্টিসানের হত্যাকাণ্ডের পর যারা ধর্মকে আবার বিপুল উৎসাহ নিয়ে গালিগালাজ করতে ও নিন্দার বৃষ্টি ছড়াতে শুরু করেছেন, তাঁদের বলি, ধর্মের নামে হত্যা নিন্দনীয় হলে জাতি বা রাষ্ট্রের নামে হত্যা নিন্দনীয় নয় কেন? জাতি পরিচয়ের মহিমা কায়েমের জন্য যুদ্ধ অবশ্যই 'জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ'; মুসলমান যখন জাতি হিসাবে নিপীড়িত বোধ করে এবং লড়ে সেটাও তার কাছে একই যুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধ। তর্কটা তাহলে আত্মপরিচয় নির্মানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্তাসত্তা গড়ে ওঠে কিভাবে? তার সম্বাহব্য পরণিতি বিচাতের পদ্ধতি ক হবে? অন্যদিকে, ধর্মের মহিমা প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ নিন্দনীয় কোন বিচারে? সেটাও আসলে কি আত্মপরিচয়ের রাজনীতি মাত্র? এই প্রকার ধর্মবোধের সঙ্গে জাতিবোধের ফারাক তাহলে কোথায়? এই সকল প্রশ্ন আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।

তিন

আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়ে হাসাহাসি করতে পারি। কিন্তু তিনি তামাশার বস্তু নন, তিনি রিপাবলিকান দলের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগামি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী। তার জনপ্রিয়তার ভিত্তি ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষ। তিনি তাঁর খ্রিস্টিয় পরিচয়কে এর বিপরীতেই হাজির করেন। তিনি সবল মার্কিন জাতির সভ্যতা ও মহিমা প্রতিষ্ঠা করবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চান। ভাল কথা। তিনি আমেরিকায় কোন মুসলমান আর ঢুকতে দিতে নারাজ। ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষের মধ্য দিয়ে তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তার খ্রিস্টিয় পরিচয়কেই সামনে নিয়ে এসেছেন। ইউরোপ আমেরিকা সর্বত্রই আত্ম পরিচয়ের রাজনীতি প্রবল ভাবে ফিরে এসেছে।

দার্শনিক ব্রুনো লাতুর (Bruno Latour) একটি সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু পরিচয় নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ধর্ম পরিচয়ের রাজনীতি ভারতের একার সমস্যা নয়, তবে ধর্ম পরিচয়ের রাজনীতি ভারতে যে প্রকট রূপ নিয়ে তথাকথিত আধুনিক সেকুলার রাষ্ট্র ও পার্লামেন্টারি রাজনীতির পরিমণ্ডলে প্রকট ভাবে হাজির তার তুলনা একমাত্র ভারত নিজেই । বিজেপি ও তার দর্শন হিন্দুত্ববাদের মধ্য দিয়ে প্রকট ভাবে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত। তবে হিন্দুত্ববাদে বিজেপির একার একচেটিয়া নাই। এটা ভারতীয় রাজনীতির ধমনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, নইলে নরেন্দ্র মোদী প্রধান মন্ত্রী হতে পারতেন না।

একটি তথাকথিত আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র কিভাবে ধর্ম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় আধুনিক ভারত তার দুর্দান্ত উদাহরণ। বাংলাদেশ সংকটাপন্ন, কিন্তু তুলনায় অনেক অগ্রসর। আধুনিক রাষ্ট্রের সংকট আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি, হয়তো এর জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। কিন্তু সমস্যাকে খোলা মনে চিহ্নিত করতে পারলে উপমহাদেশকে পথ দেখাবার চাবিকাঠি আমরা পেয়ে যেতে পারি। ভারতের নজির থেকে আমরা বুঝতে পারি আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও রাজনীতির ধর্মীয় বা ‘মৌলবাদী’ রূপান্তর একালের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ঘটনা।

তবে ব্রুনো লাতুরের জিজ্ঞাসা অন্যত্র, যা আমাকে ভাবিয়েছে। হিন্দু কখনই পাশ্চাত্য অর্থে ‘রিলিজিয়ন’ ছিল না। যদিও খ্রিস্টিয় ধর্মকে ধর্মের সার্বজনীন রূপ গণ্য করে অন্যান্য জনগোষ্ঠির র্ধর্মকে আমরা বুঝে থাকি। অর্থাৎ খ্রিস্ট ধর্মের চরিত্র অনুযায়ী আমরা অন্য সকল ধর্মের চরিত্র বিচার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। লাতুর বলছেন, এটা বেশ অবাক কাণ্ড এহেন ‘হিন্দু’ ব্যাপারটা কিভাবে ইউরোপীয় রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের অংশ হয়ে গেল? যা কোন কালে ধর্ম ছিল না তা ইউরোপীয় খ্রিস্টিয় ঐতিহ্যের গহ্বরে পড়ে খ্রিস্টিয় ধর্ম ও ইসলামের মতো আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহ্যের মধ্যে হজম হয়ে গেল। আধুনিক রাষ্ট্রের সুবাদে যে রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা তার মধ্যে অন্যন্য ধর্মের মতো হিন্দুও সেঁধে গেলো! বিজেপি যতো বেশী হিন্দু ধর্ম বা হিন্দুত্বকে রাজনীতিতে টেনে আনবে ততোটাই সে আর 'হিন্দু' কিম্বা ভারতীয় থাকবে না। অথচ এই বিকৃতিই তার হিন্দুত্বের বড়াই হয়ে উঠবে। কারণ এই ‘হিন্দুত্ব’ বা ধর্মের ধারণা সিন্ধু নদীর তীরে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা  'হিন্দু' বা ভারতীয় ঐতিহ্যের বাইরের জিনিস, বাইরে থেকে আমদানি করা ব্যাপার। মোদি হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি কি? নাকি হিন্দুত্ববাদী আত্মপরিচয়ের বা আধুনিকতার প্রতিনিধি। যে পরিচয়ের নির্মাণ ঘটেছে নিউ লিবারেল বিশ্ব অর্থ নীতির গর্ভে ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ঔরসে। দুটোই আধুনিক জিনিস। ( দেখুন, Interview: Philosopher Bruno Latour on Challenges of Identity Politics in India, in the WIRE, 16-07-2016)

আধুনিক রাষ্ট্র কিভাবে ধর্মের চরিত্রে রূপান্তর ঘটায় সে বিষয়ে আমাদের হুঁশ নাই বললেই চলে। ধর্মের চরিত্রের মধ্যে আত্মপরিচয় তৈয়ারির সুযোগ কতোটা রয়েছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। ইসলাম ধর্ম পালন করা, আর মুসলিম পরিচয় নিয়ে নিজেকে একটি পৃথক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি আর ‘জাতি’ গণ্য করা দুটোই সম্পূর্ণ দুটো ভিন্ন ব্যাপার। মুসলামানদের অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভ রয়েছে। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী যুগে মুসলমান হিসাবে নিপীড়িত শোষিত হবার ইতিহাস এবং আধুনিক রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে তার সমাধান বা মীমাংসার চেষ্টাকে আমরা সেভাবেই বুঝব। কিন্তু ধর্ম হিসাবে মানবেতিহাসে ইসলামের প্রস্তাবনা ও সম্ভাবনাকে কি সেভাবে বোঝা যাবে? এটাই একালের গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা। সব ধর্ম এবং ধর্ম-পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতির ফারাকের মধ্যে মানুষের চিন্তার অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন দিকগুলো সম্প্রতি আগের চেয়ে অনেক বেশী দৃশ্যমান হচ্ছে। 

কথাগুলো বলছি কারণ ধর্মের রাজনীতি নিয়ে যে সকল আলাপ আলোচনা আমরা দেখি তার সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মের কোন সম্বন্ধ নাই। সেটা আসলে ধর্ম ভিত্তিক আত্মপরিচয় এবং আধুনিক সমাজ ও আধুনিক রাষ্ট্রের সমস্যা। অর্থাৎ আধুনিকতা ও আত্ম পরিচয়ের রাজনীতির প্রবলেম। এই দিকটি স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন করা গেলে হয়তো বাংলাদেশে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে যে সকল (কু)তর্ক চলে তার অবসান হবে; আমরা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আরও বিচক্ষণ ভাবে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে পারব। এটা সত্যি যে ধর্মের সঙ্গে সমাজ, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতি এবং সর্বোপরী ধর্মের সঙ্গে চিন্তার সম্পর্ক আমরা মীমাংসা করতে পারি নি। কিন্তু সেটা আমাদের অক্ষমতা নয়, বরং তা আধুনিকতা ও আধুনিক রাষ্ট্রের অক্ষমতা যা ক্রমশ প্রকট হয়ে বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আধুনিকতা ও আধুনিক রাষ্ট্রের পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই সেই মীমাংসার পথে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।

তবে শুরুতেই কিছু ফালতু তর্ক ও প্রপাগান্ডা পরিহার করা জরুরী। যেমন ধর্ম মাত্রই সহিংসতার জন্ম দেয়। হোলি আর্টিসানের হত্যাকাণ্ড এই কুতর্ককে উসকে দেবে এবং দিচ্ছে। এই ফালতু বক্তব্যের পক্ষে কোন বাস্তব তথ্য নাই। এই দাবির অসারতা প্রমাণের জন্য সেই পুরানা যুক্তিই যথেষ্ট যে দুই দূটো বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ পঙ্গু হয়েছে। কিন্তু এই দুটো যুদ্ধ ধর্ম যুদ্ধ ছিল না। দুটো যুদ্ধই ছিল আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আধুনিক বিশ্বযুদ্ধ। হত্যা করা হয়েছে জাতির নামে, রাষ্ট্রের নামে।

হোলি আর্টিসানের হত্যাকাণ্ড নির্মম ও নিন্দনীয় সন্দেহ নাই, কিন্তু এই ক্ষেত্রেও মৃতের সংখ্যা বাংলাদেশের পুলিশ, র‍্যাব, বিজেবি এবং সেনাবাহিনীর হাতে এযাবতাকালের সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বেশী নয়। নৃশংসতার তুলনা করলে পুলিশী নির্যা্তন, পুলিশী হেফাজতে মৃত্যু, গুম খুন, রিমাণ্ডের নির্দয় নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথাও ভেবে দেখতে হবে। আধুনিক গণমাধ্যম আধুনিক রাষ্ট্রের স্বার্থে আধুনিক রাষ্ট্রের নৃশংসতাকে নিয়মিত আড়াল করে। নজরের বাইরে নিয়ে যায়। গণমাধ্যম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সহযোগী হিসাবে ভূমিকা রাখে।

চার

রাজনীতির এই অমীমাংসিত উপত্যকা আপাতত আমরা কিভাবে মোকাবিলা করব? আমরা কেউ বিশ্বাসী হতে পারি, হতে পারি ঈমান-আকিদার ক্ষেত্রে কঠোর কিম্বা শিথিল, হতে পারি নাম কা ওয়াস্তে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিম্বা নাস্তিক, কিম্বা ধর্ম নিরপেক্ষ, ইত্যাদি। হয়তো এমনও আমরা আছি যাদের কাছে জীবনের কোন কিছুরই কোন মানে নাই। মানুষের মানে হারিয়ে ফেলার দুর্দশা পাশ্চাত্য দর্শনে ‘নিহিলজম’ নামে পরিচিত। তবে তার নানান রূপ আছে। জীবনের কোন মানে থাকতে হবে তারও বা কি কথা আছে? জীবনের কোন মানে খোঁজা বা অর্থ নির্ণয়ের পরিশ্রম বাদ দিয়ে ওরাং ওটাং হয়ে ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে নিশ্চিন্তে জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষের পক্ষে অসম্ভব নয় মোটেও। সত্যি যে নির্ভাবনায় মানুষ একটি ভোগী জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। ‘মানুষ’ নামক একাট্টা জীবের যে বিমূর্ত ধারণা আমরা মাথায় বহন করি হয়ত সেখানেই গোড়ার গলদ।

আমরা ধরে নিতে পারি এবং সেটা সঠিক যে মানুষ বিচিত্র। আর এই বৈচিত্র নিয়েই সমাজ। আগেই তৈয়ারি কোন একটি ছাঁচে ফেলে মানুষকে বিচার করতে গেলেই সমাজে বিভক্তি ও হানাহানির শর্ত তৈরি হয়। আমার বিশ্বাস অন্য সকলেরই বিশ্বাস হতে হবে, আমার উপলব্ধিই সকলেরই উপলব্ধি হতে হবে, আমার সত্যই একমাত্র সত্য বলে সকলকে মেনে নিতে হবে এই আধুনিক অহংকার সমাজে ও রাজনীতিতে হিংসা ও হানাহানির পরিস্থিতি তৈরি করে।

জীবসত্তার বিচার করলে জীবজন্তু ও প্রাণী জগত থেকে মানুষ আলাদা কিছু না। ফলে হিংস্রতা তার প্রকৃতিগত স্বভাবের ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু যখনই মানুষ তার জীবপ্রকৃতির সীমা অতিক্রম করবার চেষ্টা করে তখন তার মধ্যে কিছু অতিরিক্ত স্বভাব প্রকাশ পেতে থাকে এবং জীবজগতের সঙ্গে তার পার্থক্যের সূচনা ঘটাও শুরু হয়। এই অর্থেই দাবি করা যায়, মানুষের স্বভাব সে কারণে জীবের স্বভাব নয়, নিজের প্রবৃত্তিগত হিংস্রতাকে মোকাবিলার সুযোগ মানুষ গ্রহণ করতে পারে। এটা আমরা অনুমান করতে পারি। এই অনুমান থেকে 'জিহাদ' কথাটিকেও দার্শনিক বিচারের অধীনে এনে আরও বিশদ বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে।  নাফসানিয়াত থেকে রূহানিয়াতে রূপান্তর বা নিজের জৈবিক প্রবৃত্তি অতিক্রম করে মানুষের দিব্যস্বাভাব অর্জন করার হিম্মত মানুষের আছে। কিন্তু তার জন্য তাকে সচেতন ভাবে ও সজ্ঞানে চেষ্টা বা 'জিহাদ' করতে হয়। অতিরিক্ত স্বভাব অর্জনের ক্ষমতা আছে বলেই যা জৈবিক, প্রবৃত্তিগত, দৃশ্যমান কিম্বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ তার বাইরের বিষয় নিয়ে মানুষ ভাবে, চিন্তা করে এবং নিজের স্বভাবকে জীবপ্রকৃতি থেকে আলাদা করতে ও আলাদা ভাবতে ধীরে ধীরে সক্ষম হয়। তার নিজের সম্পর্কে যে কল্পনা, ধারণা বা অনুমান সে করে সেই মোতাবেক তার স্বভাবেও মানুষ পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

জীব প্রকৃতি লৌকিক, কিন্তু যাকে আমরা মানুষের প্রকৃতি বা মানুষের স্বভাব বলে বোঝার চেষ্টা করি তাকে লৌকিকতার সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট করা, শনাক্ত করা ও বিচার করা কঠিন । রহস্য মনে হলে এ কারণে বলা যায়, মানুষ অলৌকিক, কিন্তু সেটা শর্ত সাপেক্ষে। অর্থাৎ লৌকিকতা ও অলৌকিকতার সম্বন্ধ বিচারের মধ্য দিয়েই মানুষের গল্প খানিকটা বলা যায়। মানুষকে কিছুটা চেনাও হয়তো যায়। আর, মানুষ তার গল্প মানুষের ইতিহাস হিসাবে পৃথিবীতে লিখে যেতে পারে। মানুষ তার কল্পনা ও ইচ্ছা অনুযায়ী ইতিহাস হতে পারে।

তাহলে বিশ্বাস ও মতের পার্থক্য একটি সমাজ কিভাবে মীমাংসা করে তার ওপর মূলত একটি সমাজের শক্তি নির্ভর করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে ভাষা ও জাতিবোধের মধ্যে আমরা নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিশ্বাস, দৃষ্টি ও চিন্তার পার্থক্যের নিরাকরণ ঘটিয়ে দিতে পেরেছে এই অনুমান তখন যেমন মারাত্মক ও বিপজ্জনক ভুল ছিল সেটা এখন আরও ভয়াবহ ভুল হিসাবে হাজির হয়েছে। জাতিবোধ বা জাতীয়তাবাদকে শ্বাশ্বত গণ্য করার মধ্যেই ভুল ছিল।

অথচ একাত্তর ছিল একটা বড়সড় ঐতিহাসিক অর্জন। যার সম্ভাবনা ছিল অপরিসীম। কিন্তু রাজনৈতিক ঐক্যের উপলব্ধিতে অন্ধ হয়ে বিশ্বাস, দৃষ্টি এবং চিন্তার পার্থক্য ও বৈচিত্র্যেকে আমরা অস্বীকার করে ভুল করেছিলাম। দরকার ছিল আরও গভীর পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে বিশ্বাস, দৃষ্টি ও চিন্তার পার্থক্য নিরসনের ক্ষেত্রগুলো অন্বেষণ করা। কিন্তু সেই কঠিন কাজ আমরা করি নি। করা দরকার সেই উপলব্ধিও আমাদের ছিল বলে মনে হয় না। এখন কতোটা আছে সেটাও প্রশ্নের সম্মুখিন।

দ্বিতীয় ট্রাজেডি হচ্ছে ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিবোধের ঐক্যের জায়গা থেকে আমরা ইসলাম প্রশ্নের মোকাবিলা করি নি। কিন্তু এখন ভুলের মাশুল শোধরানোর বিপজ্জনক ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আমাদের ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলা করতে হচ্ছে। মোকাবিলা করবার সেই সামর্থ ও সক্ষমতা আমাদের আদৌ আছে কিনা এখন আমার ঘোরতর সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এখন ‘বঙ্গে জিহাদের পুনর্জাগরণ’-এর পরিপ্রেক্ষিতে ও আইসিসের হুমকির মুখে আমাদের ইসলাম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। খুব দেরী হয়ে গেল, তাই নয় কি?

একটা সময় ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর ইসলাম নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশে একদমই অপ্রাসঙ্গিক মনে করা হোত। দাবি করা হোত ইসলাম প্রশ্ন আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মীমাংসা করে ফেলেছি। আমরা বাঙালি। আমাদের জাতিসত্তা ও আত্মপরিচয়ের মধ্যে ইসলামের কোন ভূমিকা নাই। ইসলাম আমাদের ধর্ম হতে পারে, কিন্তু ধর্ম একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। ইসলামকে অতএব সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে বিদায় নিতে হবে। ইসলাম থাকতে পারে, তবে সেটা থাকবে একান্তই ব্যক্তিগত ধর্মচর্চার ক্ষেত্র হিসাবে। ব্যস। এটাই আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি হবার একমাত্র তরিকা।

কিন্তু ধর্ম নিছকই ব্যাক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার নয়। ধর্মের ইতিহাস আছে, তার সমাজতত্ত্ব আছে। ধর্ম সাড়ে ষোল আনা ইহলৌকিক ব্যাপার। ধর্ম মানুষের সমাজ ও ইতিহাসের বাইরে আসমানি কিছু নয়। ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ চিন্তা করেছে, অতএব ধর্মতত্ত্বের মধ্য দিয়ে মানুষের চিন্তারই বিবর্তন ও বিকাশ ঘটেছে। যে কোন ধর্মেরই কিছু মৌলিক দার্শনিক প্রস্তাবনা আছে। বিশ্বাসের নিশ্চিত নিশ্চয়বোধ থেকে ভিন্ন ভাবে সেই সকল প্রস্তাবনা নিয়ে দার্শনিক পর্যালোচনা সম্ভব। পাশ্চাত্যে ধর্ম আর দর্শনের ফারাক সাম্প্রতিক ব্যাপার। বুদ্ধি ও যুক্তির জায়গা থেকে নীতিবিদ্যার ভিত্তি হিসাবেও ধর্ম ভূমিকা রাখে। তাহলে নীতি-নৈতিকতার জায়গা থেকে ধর্মের বিচার দরকার। নানান দিক থেকে ধর্মের বিচার জরুরী। কিন্তু একাত্তরের পর আমরা ধরে নিয়েছি, এসবের দরকার নাই। এর মূল্য খুবই কঠিন ভাবে সুদে আসলে এখন আমরা দিতে শুরু করেছি।

কিন্তু মাশুল দিতে গিয়ে আধুনিকতা ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতির মধ্যে খাবি খেতে খেতে আমরা যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে না যাই, এটাই এখনকার একমাত্র কাতর প্রত্যাশা।

২২ জুলাই ২০১৬। ৭ শ্রাবন ১৪২৩। শ্যামলী।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।