'শাহাদাত বার্ষিকী'তে 'সাধুসঙ্গ'!
অগাস্ট মাসে শেখ মুজিবর রহমানের সপরিবার নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘মৃত্যুবার্ষিকী’ হিসাবেই পালন করা হোত। আজকাল ‘শাহাদাৎ বার্ষিকী’ হিসাবে উদযাপন করা হচ্ছে। এটা নতুন। এবারের নতুন আরেকটি দিক হোল ‘শাহাদাৎ বার্ষিকী’ উদযাপনের জন্য সারাদেশ থেকে বেশ কিছু বাউলদের নিয়ে এসে শিল্পকলা একাডেমি ‘সাধুসঙ্গ’ আয়োজন করেছে। খবরে তাই দেখেছি। ‘সাধুসঙ্গ’ ব্যাপারটা আসলে কি এটা অনেকেই জানেন না। বাউল গান নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি অনুষ্ঠান করতেই পারে। তবে শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের জন্য ‘সাধুসঙ্গ’ আয়োজন করবার দাবি বেশ কৌতুহলের জন্ম দেয়।
এতোকাল আওয়ামি লীগ অগাস্ট মাসকে শোকের মাস হিসাবেই পালন করে এসেছে।পনেরো অগাস্ট শেখ মুজিবর রহমানের সপরিবার হত্যা নানাস্তরে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। এতে ক্ষমতা থেকে ব্যাক্তি হিসাবে তাঁকে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে কিন্তু ইতিহাসের শেখ মুজিবকে মুজিবোত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায় নি। সেটা সম্ভবও নয়। অন্যদিকে ইতিহাসে শেখ মুজিবর রহমানের ভূমিকার নির্মোহ পর্যালোচনা এখনও সম্ভব নয়। রাজনীতিকে আমরা আবেগের আতিশয্য থেকে মুক্তি দিতে পারি না, অন্যদিকে জাতীয় ব্যক্তিত্বকে দলীয় ব্যাক্তিত্বে পরিণত করবার ক্ষেত্রেও আমাদের জুড়ি নাই। জিয়াউর রহমান সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। রাজনৈতিক ব্যাক্তি হিসাবে দলীয় প্রচার প্রপাগান্ডার বাইরে যতো তাড়াতাড়ি আমরা রাজনৈতিক নেতাদের নির্মোহ বিচারের অধীন করতে পারব, ততোই তাঁদের জাতীয় তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেটা খুব সহজ কাজ নয়। নইলে তাঁদের সম্পর্কে দলীয় প্রপাগান্ডা দলীয় ব্যাপার হয়েই থাকবে।
জিয়াউর রহমানও নিহত হয়েছিলেন। তাঁকে বিএনপি ‘শহিদ’ মনে করে, ফলে তাঁর নামের আগে শহিদ জিয়াউর রহমান বলতে তাদের অসুবিধা হয় নি। তবে নিহতদের নামে আগে ‘শহিদ’ জূড়ে দেওয়ার চল সেকুলারদের হাতেই ঘটেছে। একুশের শহিদ সালাম বরকত যেমন। তাঁদের স্মৃতিতে বানানো ‘শহিদ মিনার’ ইত্যাদি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ ওয়ালাদের কেন ধর্মীয় প্রতীকের প্রয়োজন হয় সেটা রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণার খুবই উর্বর জায়গা। ভাষা আন্দোলনের শহিদদের নিয়ে সেকুলারদের শহিদী রাজনীতি রাজনীতিতে ধর্মের সবচেয়ে সফল ব্যবহারের দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্ত ধর্মপন্থীরা স্থাপন করে নি। জাতিবাদী ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি যাঁরা করেন তাঁরাই করেছেন।
একুশের শহিদদের উদাহরণ আছে বলে বিএনপি সেকুলার দল হয়েও জিয়াউর রহমানকে ‘শহিদ’ বলতে অসুবিধা বোধ করে নি। জিয়াউর রহমানকে তাই ‘শহিদ জিয়াউর রহমান’ বলার চল হয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবর রহমানের ওপর এই ধর্মীয় খেতাব আরোপ কঠিন ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশ্রণের প্রবল বিরোধিতা করে, ফলে তাদের পক্ষে শেখ মুজিবকে ‘শহিদ মুজিব’ বলা আসলেই কঠিন। তবে গত কয়েক বছর ধরে দেখছি ১৫ অগাস্টকে শেখ মুজিবর রহমানের ‘শাহাদাৎ বার্ষিকী’ বলার চল বেড়েছে। তাঁকে ‘শহিদ’ বলার ক্ষেত্রে এক মাত্র বাধা হচ্ছে তাঁর নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবটি। এতেই তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
তবে এ বছরই মনে হচ্ছে ১৫ অগাস্টকে 'শাহাদাত বার্ষিকী' হিসাবে উদযাপন করবার সচেতন আওয়ামি প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। সংবাদপত্রে অগাস্টের শুরু থেকে যে সকল খবর পড়ছি তাতে প্রায়ই পনেরো অগাস্টকে মৃত্যুবার্ষিকী না বলে ‘শাহাদৎ বার্ষিকী’ বলা হচ্ছে। এটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তর। শুধু আওয়ামি লীগের নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিরও বটে। মূলত দুই হাজার তেরো সালের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির যে গুণগত রূপান্তর শুরু হয়েছে এটা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। এটা সেকুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির ইসলামিকরণ কিনা সেটা পুরাপুরি বলার সময় আসে নি। তবে আওয়ামি রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বদলাচ্ছে, এটা পরিষ্কার।
এটা অভিযোগ আকারে অবশ্য ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগার ও শাহবাগের সমর্থকরা অনেক আগেই আওয়ামি লীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে আসছিল। আওয়ামী লীগ ব্লগার হত্যার কোন কুলকিনারা আজও করতে পারে নি, উলটা তারা ধর্মপন্থিদের তোষণ করবার নীতি গ্রহণ করেছে। তাদের এই অভিযোগ খুব মিথ্যা নয়। কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক অজ্ঞতা হোল আওয়ামি মুসলিম লিগ থেকে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ ধর্ম তোষণ আজ করছে ব্যাপারটা এমন নয়। সত্তর দশকে শেখ মুজিবর রহমানকে বারবার বলতে হয়েছে আওয়ামি লীগ ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে, কিন্তু তারা ধর্ম বিদ্বেষী, কিম্বা ইসলাম বিদ্বেষী নয়। সত্তরের নির্বাচনে এই ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু ছিল। কোরান সুন্নাহর বিরোধী কোন আইন আওয়ামী লীগ সমর্থন করবে না, এই প্রতিশ্রুতি শেখ মুজিবকে যেমন দিতে হয়েছে, শেখ হাসিনাও নানা সময়ে বলেছেন।
আওয়ামি লীগ সাধারণ মানুষ নিয়ে রাজনীতি করে, ফলে মুখে যতোই লম্বাচওড়া কথা তারা বলুক রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আওয়ামি রাজনীতি সবসময়ই কুশলতার পরিচয় দিয়েছে। ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ – এটা জনপ্রিয় আওয়ামি শ্লোগান। ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার ও শাহবাগ সমর্থকদের প্রয়োজন ছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোটের বিনাশ সাধন করা, শেখ হাসিনা সেই কাজটিই নিপুন ভাবে করেছেন। প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে তাই উচ্ছিষ্টের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।
শাহবাগের সমর্থকরা ঠাণ্ডা মাথায় তাঁদের কৃতকর্মের বিচার করতে সক্ষম কিনা সেই সন্দেহ আমি করি। শাহবাগ শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলন ছিল, তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক এগারোর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শাহবাগের বিপুল ইতিবাচক সম্ভাবনা ছিল। যেমন, অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে বিপুল জনসমাগমের উপস্থিতির সঙ্গগঠিত করতে পারা। এটা চাট্টিখানি কথা নয়, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির নজির স্থাপন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধিদের বিচার নিশ্চিত করে ন্যায়বিচারের ঐতিহ্য কায়েম করা, ইত্যাদি অর্জনের সুযোগ ছিল। আরও বড় রূপান্তরের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা ঘটে নি। কিন্তু শাহবাগ ইসলাম বিদ্বেষ, হিংসা, বিভাজন ও বিভক্তির রাজনীতিকেই বেছে নিল। তদুপরি বোঝা গেল শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আরও নিখুঁত করে তুলতে পারে, কিন্তু রূপান্তরের কোন পথ দেখাতে পারে না। এটা নতুন কোন কথা নয়। শ্রমিক, কৃষক বা সাধারণ মানুষ যে আন্দোলনে জড়িত থাকে না তার পরিণতি ভিন্ন কিছু হয় না।
শাহবাগ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে কার্নিভালে পরিণত করেছে, এটাই ট্রজেডির জায়গা। ইসলাম বিদ্বেষ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে খেপিয়েছে। বেশ কয়েকটি কারণে এই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছে। এক. ব্লগারদের কুৎসিত ও প্রকট ইসলাম বিদ্বেষ, দুই. স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচার চাওয়ার পরিবর্তে অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবি এমনকি আদালতে রায়ের বিরোধিতা করে ফাঁসি দেবার জন্য আদালতের ওপর চাপ তৈরি করা, তিন. কূটনৈতিক নিয়মনীতি ভঙ্গ করে দিল্লীর সমর্থন দেওয়ার কারণে দিল্লীর স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে শাহবাগের দ্রুত পরিচিতি লাভ, ইত্যাদি। শাহবাগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক না হয়ে গণমানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি বিরোধী অগণতান্ত্রিক শক্তির প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ভারতের আগ্রাসী ভূমিকারও আরেকটি নজিরও হয়ে উঠেছিল এই আন্দোলন। শেষমেষ শাহবাগ শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গণ বিচ্ছিন্নতা ও গণ মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ চর্চার ক্ষেত্র হিসাবেই পরিচিতি লাভ করেছে। শাহবাগ নামক জায়গাটিতে এখন ভাল কিছু করলেও সাধারণ মানুষ তা সন্দেহের চোখেই দেখে। দেখছে। দেখবে।
দুই হাজার তেরো সাল থেকে আওয়ামি লীগ নিজেকে আগের চেয়েও আরও অধিক তৎপরতার সঙ্গে ইসলাম বিদ্বেষীদের কাছ থেকে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করছে। এর একটা কারণ ৫ই মে তারিখে শাপলা চত্বরের ঘটনার কারণে আলেম ওলামাদের আওয়ামীলীগ নির্বিচারে হত্যা করেছে বলে যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে আওয়ামি লীগ তা কাটিয়ে উঠতে চায়। এই ক্ষেত্রে আওয়ামি লীগ কিছুটা সফল হয়েছে বলতে হবে। এই তৎপরতার আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে ১৫ অগাস্টকে শেখ মুজিবর রহমানের ‘মৃত্যুবার্ষিকী’ হিসাবে পালন না করে একে ‘শাহাদাতবার্ষিকী’ হিসাবে পালন করা।
দুই
এই পরিপ্রেক্ষিতে কোন একটি সংবাদে পড়লাম শেখ মুজিবর রহমানের ‘শাহাদাৎ বার্ষিকী’ উদযাপনের জন্য শিল্পকলা একাডেমি ‘সাধুসঙ্গ’ আয়োজন করেছে। খবরে এটা জেনে একটু হকচকিয়ে গেলাম। লালনপন্থি ফকিরদের জন্য ‘সাধুসঙ্গ’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। একজন খেলাফত ধারী লালনপন্থি ফকিরই শুধু তাঁর আখড়ায় সাধুসঙ্গের আহ্বান জানাতে পারেন। তিনি তিরোধান করলে তাঁর শিষ্যশাবকরা একই দিনে তাঁর আখড়ায় একই তারিখে সেই অনুষ্ঠান সাধারণত চালিয়ে যান। যেমন গৌরপূর্ণি্মায় (বা দোলপূর্ণিমায়) ছেঁউড়িয়ায় লালন প্রবর্তিত বিখ্যাত সাধুসঙ্গ। সাধু নিজে সাধুসঙ্গের দিন তারিখ নির্ধারণ করবার অধিকারী নন। সেটা করেন তাঁর গুরু। অর্থাৎ গুরুর নির্দেশে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে গুরুর হাতে খেলাফত নেওয়া ভক্ত গুরুর নির্দেশে নিজের আখড়ায় সাধুদের নিয়ে যে সঙ্গ করেন তাকেই শুধু ‘সাধুসঙ্গ’ বলা হয়। সেখানে গুরু স্বয়ং হাজির থাকেন। শিষ্য তাঁর সেবার ‘পারস’ বা ভক্তির থালা গুরুকেই নিবেদন করেন। মনে আছে, এর আগে লালন প্রেমিক তরুণরা চারুকলায় কয়েকটি সাধুসঙ্গ করেছিলেন। তাঁরা বাউল ফকিরদের গান ভালবাসেন, অনেকে আমার স্নেহভাজন এবং লালনপন্থি ফকিরদের সঙ্গে তাঁরা আন্তরিক ভাবে নিয়মিত ওঠাবসা করেন। এর ফলে অনেকের ধারণ হয়েছিল, বাউল ফকিরদের নিয়ে একসঙ্গে গান করলেই সেটা বুঝি সাধুসঙ্গ হয়। এটা ভুল ধারণা।
সাধু-বাউল-ফকিরদের নিয়ে একসঙ্গে গানবাজনা করাকেই ‘সাধুসঙ্গ’ বলা হয় না, এটা বোঝা জরুরী। সাধুসঙ্গে লালন ও অন্যান্য সাধকদের গান গাওয়া হয় বটে, কিন্তু সাধুসঙ্গের মূল উদ্দেশ্য সঙ্গীত অনুষ্ঠান মোটেও নয়। তাই বাউলদের গানের অনুষ্ঠানকে ‘সাধুসঙ্গ’ বলা হলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সাধু – বিশেষত নদিয়ার লালনপন্থী ফকিরদের জীবন চর্চার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘সাধুসঙ্গ’। কে সাধুসঙ্গ আহ্বানের অধিকারী, সাধুসঙ্গের বিধিবিধান ও সেবা পদ্ধতি কি এবং তা পালনের শর্তগুলো পালিত হচ্ছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণের কারা অধিকারী ইত্যাদি নানান বিষয় রয়েছে যা লালনপন্থী ফকিরদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে ‘সাধুসঙ্গ’ ধারণাটির নির্বিচার ও যত্রতত্র ব্যবহার বাঞ্ছনীয় নয়। অজ্ঞতা উপেক্ষার সামিল এবং সেটা অবস্থা অনুসারে অপরাধের মধ্যেই পড়ে। শিল্পকলা একাডেমি এই সকল বিষয়ে সতর্ক থাকবেন এটাই আমরা আশা করি। সংবাদপত্রের কর্মীদের কাছেও আশা যে তারা বাউল গানের আসরকে বাউল গানের আসরই বলবেন, ‘সাধুসঙ্গ’ বলবেন না। দরকার কি? না বললেও এতে গানের মহিমা তিল পরিমান ম্লান হবে না।
এটা আশা করি বোঝাতে পেরেছি শিল্পকলা একাডেমি কোন সাধুর আখড়া নয়, যেখানে একজন আসনধারী ফকির আছেন যিনি গুরুর নির্দেশে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে সাধুসঙ্গ আহ্বান করেন। শিল্পকলা একাডেমির কর্তৃপক্ষ কোন সাধুসঙ্গ আহ্বান করতে পারেন না, কারন তাঁরা এর অধিকারী নন। ফলে খবরের কাগজওয়ালারা যদি ভুল বুঝে থাকেন সেটা তাদের সমস্যা, আশা করি শিল্পকলা একাডেমি এই ভুল করবেন না। তারা শেখ মুজিবর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে লালনের গানের আসর বসিয়েছেন। এটাই হচ্ছে কথা। এই ক্ষেত্রে একটি খবরে দেখছি বলা হয়েছে:
“সবলোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’, ‘তিন গর্ভে আছে রে এক ছেলে’, ‘তোমার মত দয়াল রাসূল আর পাব না’, ‘জাত গেল জাত গেল বলে, ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, বাড়ির কাছে আরশিনগর লালনের ইত্যাদি অমিয় বাণীর সুধা কণ্ঠে তুলে নিয়ে শিল্পীরা শুধু সুরের আবেশই ছড়ালেন না সাঁই ভক্তদের অবগাহন করালেন ভাবের জগতে। এমন চিত্রই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকীর মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে তিন দিনব্যাপী বাউল গানের আসরের প্রথম দিনে। গতকাল সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে শুরু হয় তিন দিনব্যাপী এই আয়োজন”। (দেখুন, বাংলাদেশ প্রতিদিন: ‘লালন বন্দনায় মুখরিত শিল্পকলা’ প্রতিদিন ১২ অগাস্ত ২০১৬)
‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৪১তম শাহাদাত বার্ষিকীর মাসব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসাবে তিন দিনের বাউল গানের আসর’ – বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন বোঝার জন্য এই বাক্যটি বেশ ভাল একটি ইঙ্গিত। আমরা এখন শেখ মুজিবর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকীই শুধু উদযাপন করছি না, শিল্পকলা একাডেমিতে তিন দিন ধরে বাউল গানের আসরও বসাচ্ছি। সাংস্কৃতিক জগতের মধ্য দিয়ে আওয়ামি লীগ কিভাবে বিশেষ রকমের শাহাদাত বার্ষিকী উদযাপনের মধ্য দিয়ে ইসলামি ভাবধারা আত্মস্থ করে নিতে চাইছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। অনেকের কাছে এটা ক্যারিকেচার মনে হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝার জন্য খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
তবে শিল্পকলা একাডেমি আশা করি জানে যে ‘তিন গর্ভে আছে রে এক ছেলে’ কিম্বা ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ ইত্যাদি লালন ফকিরের গান নয়। তবে অনেক বাউল একে লালনের গান বলে গেয়ে থাকেন। তাঁরা গাইতেই পারেন। শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব হচ্ছে সঠিক ভাবে এইসকল বিষয়ে গবেষণা করা।
আজকাল নতুন একটি পরিভাষাও শুনছি। সেটা হচ্ছে ‘ভাবশিষ্য’। প্রায় সব বাউলই লালনের গান গেয়ে থাকেন। বাউল গান করলেই তিনি ‘সাধু’ কিম্বা ‘ফকির’ নন। অনেকে নিজের নামের আগে বা পরেও ‘ফকির’ লাগান। আসলে কিন্তু তিনি স্রেফ গায়ক, ফকির’ নন। ভাল একজন গায়ককে ফকর বা সাধু হতে হবে এমন কোন কথা নাই। কারন সেটা বিশেষ ধরণের জীবনযাপন চর্চার বিষোয়, যার সঙ্গে গান গাওয়ার সম্পর্ক গৌণ। গায়ক বা বাউলেরা অনেকে সময় নিজেকে লালনের ‘ভাবশিষ্য’ বলে পরিচয় প্রকাশ করেন। এতে বোঝা যায় তিনি কোন গুরুর অধীন নন, তাঁর গুরু নাই। তবে এটা স্পষ্ট থাকা দরকার যে গুরু-শিষ্য পরম্পরা মেনে সাধন ভজনের যে ধারা সেখানে ‘ভাবশিষ্য’ নামক কোন বর্গ, ক্যাটাগরি বা পরিভাষা নাই। যাঁরা লালনকে ভালবাসেন, লালনের গান গেয়ে থাকেন কিম্বা আনন্দের সঙ্গে শোনেন তাঁদের জন্য কিছু কথা তাই বলে রাখা দরকার।
কোন গুরু-গোঁসাইয়ের অধীন না হয়ে নিজেকে ‘ভাবশিষ্য’ বলা অর্থহীন। জানা দরকার লালনপন্থা বা নদিয়ার ভাবচর্চায় ‘লালনের ভাবশিষ্য’ বলে কিছু নাই। শিষ্য হতে হয় জীবন্ত গুরুর, তথাকথিত ‘ভাব’ নামক কোন কিছুর নয়। গুরুশিষ্য সম্পর্ক জীবন্ত মানুষের সঙ্গে জীবন্ত মানুষের সম্পর্ক। এটা সম্পর্ক চর্চার বিষয়, বিমূর্ত ভাবের চর্চা নয়। সম্পর্ক চর্চাই মূলত ভাবচর্চা, কিম্বা ভাবচর্চা সম্পর্ক তৈয়ারির ভিত্তি। একা একা হাওয়ায়া ভাবচর্চা করলে সম্পর্ক তৈরি হয় না। নদিয়ার ভাবচর্চা সম্পর্ক চর্চার পরিমণ্ডলের বাইরের কিছু নয়। সম্পর্কের বাইরে এমনকি ‘লালনের শিষ্য’ বলেও কেউই এখন নাই। থাকতে পারে না। অর্থাৎ যদি কেউই এখন নিজেকে ‘লালনের শিষ্য’ বলে দাবি করতে পারেন না। কারণ লালন যেমন গত হয়েছেন বা তিরোধান করেছেন, তেমনি যাঁরা লালনের সরাসরি শিষ্য ছিলেন তাঁরাও সকলেই তিরোধান করেছেন। এখন আমি বা আপনি চাইলেও আর লালনের শিষ্য হতে পারবেন না। লালন নামে যিনি জীবিত ছইলেন তিনি আর বর্তমান নাই।
লালনপন্থায় শিষ্য মানেই হচ্ছে আপনি আপনার সময়কালে গুরু-পরম্পরার বিধি বিধান মেনে কোন না কোন লালনপন্থী সাধককে গুরু বলে মেনে নিয়েছেন। আপনি সেই জীবিত গুরুর শিষ্য, মৃত লালনের নন। কোন না কোন জীবিত মানুষকেই গুরু বলে মেনে নিতে হবে এবং লালনের ঘরের চর্চা অনুযায়ী জীবিত গুরুর ভজনা করতে হবে। লালনের ভাবচর্চার দাবি যদি আপনি করেন তাহলে আপনাকে এই পথেই যেতে হবে। বাঁকা পথে হেঁটে লাভ নাই বা ফাঁকিবাজি করাও ঠিক না। আমাদের সিধা সরল থাকা দরকার।
শিষ্য হবার দরকার বোধ না করলে শিষ্য হবেন না। গুরু নাই, অথচ নিজেকে ‘ভাবশিষ্য’ বলার কী দরকার! গুরু ভজনা করা সম্ভব না হলে শিষ্য হবেন না। অসুবিধা কি? আপনি জীবিত কোন মানুষের কাছে মাথা নোয়াবেন না, অথচ, নিজেকে লালনের ‘ভাবশিষ্য’ বলবেন, সেটা হবে না। গায়ের জোরে বা গোঁয়ার্তুমি করে অবশ্য অনেক কিছু দাবি করতে পারেন, সেটা ভিন্ন তর্ক।
শিল্পকলা একাডেমি লালনের গানের আসর বসাতে পারে, কিন্তু ‘সাধুসঙ্গ’ আহ্বানের অধিকারী তারা নয়, তাতে শিল্পকলা একাডেমির ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। কিন্তু যদি আমরা বিভ্রান্তি তৈরি করি তাহলে এতে ক্ষতি ছাড়া লাভ নাই। গুরুশিষ্য পরম্পরায় বাহিত হয়ে নদিয়ার ভাবচর্চার যে ধারা অব্যাহত রয়েছে তাকে আমরা খামাখা অপমান ও অস্বীকার করব কেন? আমরা যা না, সেটা হয়েছি বলে দাবি করবার মধ্যে কোন যুক্তি নাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, নদিয়ার ভাবচর্চার জন্য গুরুপরম্পরার বিধান মেনে গুরু ভজনা জরুরী কেন? এর প্রধান কারণ হচ্ছে ভাষার প্রতি নদিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি। নদিয়া মনে করে না ভাষার কোন সুনির্দিষ্ট বা অবস্থা নির্বিশেষে আগে থাকতেই তৈরি কোন স্থির অর্থ আছে। লালনের গানের আক্ষরিক অর্থ আছে, কিন্তু দেশকালপাত্র ভেদে সেই অর্থের হেরফের হতে পারে। তার মানে দুই জন শিষ্যের মধ্যেও অর্থের ভিন্নতা ঘটতে পারে, কিম্বা একই গুরু তাঁর দুই শিষ্যকে তাদের বোঝাবুঝির ক্ষমতা বুঝে দুই ভাবে অর্থ করতে পারেন।
ভাষার এই অর্থোৎপত্তির সম্ভাবনা সাধকের কাছে বাধা হিসাবে নয় বরং নতুন পরিস্থিতিতে লালনের গান বা কালামকে নতুন ভাবে বিবেচনা ও বিচারের সম্ভাবনাকেই জারি রাখে। কিন্তু এতে কি একই গানের নানান অর্থ তৈরির বিপদ সৃষ্টি হয় না? হ্যাঁ, হতে পারে। এই বিপদ ভাষার স্বভাবের মধ্যে নিহিত। ঠিক। কিন্তু অর্থ নির্ণয়ের অধিকারী শিষ্য নন, গুরু। শিষ্য চাইলেই গানের যে কোন অর্থ করতে পারেন না। অর্থের একটাঐতিহ্য আছে গুরুশিষ্য পরম্পরার মধ্য দিয়ে তা বিকশিত হয়। ফলে একদিকে ভাষার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখা -- বিশেষত আক্ষরিক অর্থের সীমা অতিক্রম করে যাবার সম্ভাবনা জারি রাখা -- অন্যদিকে গুরুশিষ্য পরম্পরার মধ্য দিয়ে যেমন ইচ্ছা অর্থ তৈরির স্বেচ্ছাচারিতা রোধ – এই দুইয়ের মধ্য দিয়ে নদিয়ার ভাবচর্চা বিকশিত হয়। এই কারণেই নদিয়ার ভাবচর্চা গুরুশিষ্য সম্পর্ক ছাড়া চর্চা অসম্ভব। এটা লালন নিয়ে গবেষণা, কিম্বা লালনের গান ভাল ভাবে গাইবার ব্যাপার নয়।
ভাষার চরিত্রের কথা মনে রাখলে, লালন পন্থায় ‘গুরু’ কথাটার অর্থ বোঝা যাবে না। ইনি প্রথাগত গুরু নন, বরং তিনিই যোগ্য গুরু যিনি ভাষা ও ভাবের সম্বন্ধ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তা নিয়মিত ও নিত্য আখড়ায় ও সাধুসঙ্গে চর্চা করেন। গুরুশিষ্য সম্পর্ককে দেহ বা দেহবাদ দিয়ে বুঝতে চাইলে কিছুই বোঝা যাবে না। এই সম্পর্ক একদিকে ভাষার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এবং পাশাপাশি জীবন্ত মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভাষাচর্চার সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত। এটা আমরা সহজে বুঝব যদি খেয়াল করি যে লিখিত বই, শাস্ত্রগ্রন্থ বা তত্ত্ব পড়ে বোঝা যায় না। কারন বই নিজের ব্যাখ্যা নিজে করতে পারে না, কোন না কোন জীবন্ত মানুষকেই করতে হয়। গুরু সেই কাজটিই করেন। শিষ্যদের কাছে লালনের বা অন্যান্য সাধকদের গান বা কালামের ব্যাখ্যা তিনি করেন। একই সঙ্গে শিষ্যের ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কেও গুরুর সজ্ঞান থাকতে হয়। কে কিভাবে কতটুকু বুঝবে বা কখন তাকে কোন বিষয়ে বলা যায়, কখন যায় না, এটা নির্ধারণ করেন গুরু। গুরুশিষ্যের সম্পর্ক একারণে নদিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বই পড়ে আমরা তো বুঝতে পারি, কিন্তু সেটা স্বয়ং বইয়ের অর্থ বইয়ের নিজের করা কিম্বা আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া নয়। জীবন্ত মানুষ হিসাবেই আমরা নিজের কাছে নিজে বইয়ের অর্থ করি। গুরু বা কোন শিক্ষকের কাছে না গিয়ে নিজে নিজে আমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারি। সেটা অসম্ভব কিছু না। ফলে গুরু ধরতে হবে এম কোন কথা নাই। অনেকটা শিক্ষিত হতে হলে স্কুল-কলেজে যাওয়ার দরকার নাই বলার মতো ব্যাপার। এই তুলনা মনে রাখলে গুরুর গুরুত্ব আমরা ধরতে পারব। তাছাড়া গুরুশিষ্যের সম্পর্কের গুরুত্ব হচ্ছে কথোপকথন। সেটা শুধু মুখের ভাষায় সীমাবদ্ধ তা নয়। মানুষ চিহ্নচর্চা করে। প্রতীকে, ইশারায়, ইঙ্গিতে কিম্বা স্রেফ সম্পর্কের ধরণের মধ্য দিয়ে যে ভাবচর্চা ও বিনিময় তা পরস্পরের চিত্তের বিকাশের জন্য জরুরী। গুরুশিষ্য সম্পর্ক তাই নদিয়ার ভাবচর্চার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। একে বাদ দিয়ে ‘ভাবশিষ্য’ হবার সুযোগ নাই।
ভাষার প্রসঙ্গে এলাম কারণ ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘মৃত্যুবার্ষিকী’ থেকে ‘শাহাদাৎ বার্ষিকী’ – এই পরিবর্তনকেও তাই হাল্কা ভাবে নেবার উপায় নাই। ভাষার এই রূপান্তর একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিরও গুণগত রূপান্তরের চিহ্ন নির্দেশ করে। আওয়ামি লীগ শেখ মুজিবকে এখন শহিদী মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে চায়। সেকুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতা দিয়ে এখন চলছে না। সেকুলারিজমের ইসলামিকরণ দরকার।
এই কথাটুকুই আপাতত আগামি দিনের রাজনীতি অনুধাবনের জন্য বলে রাখলাম।
১২ অগাস্ট ২০১৬। ২৮ শ্রাবন ১৪২৩। শ্যামলী।