মত প্রকাশের স্বাধীনতা বনাম চিন্তার স্বাধীনতা: একটি তৎপর চিন্তার পত্রিকা দরকার


[এই লেখাটি ৮ অগাস্ট ১৯৯১ সালে চিন্তা প্রথম প্রস্তুতি সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশে 'পাক্ষিক চিন্তা'র মতো একটি পত্রিকা বের করার পেছনে কী ধরণের ইচ্ছা কাজ করেছিল তার কিছুটা হদিস এই লেখায় পাওয়া যাবে। সাপ্তাহিক  চিন্তা পাঠচক্রে সম্প্রতি গ্রুপের রাজনৈতিক অবস্থান গুছিয়ে হাজির করবার আলোচনা চলছে। সেই দিকে থেকে এই পুরানা লেখাটি সামনে আনা দরকার। গ্রুপ হিশাবে চিন্তা পাঠচক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হচ্ছে সক্রিয় ও সজীব চিন্তাকে 'মত' বা ছকে বাঁধা আদর্শ থেকে আলাদা গণ্য করা। একে আমরা পর্যালোচনা ও মতাদর্শিক বিশ্বাসের পার্থক্য হিশাবেও গণ্য করতে পারি। চিন্তা গ্রুপের স্বাতন্ত্র্য বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাংলাদেশে পর্যালোচনার  (Critique) সামর্থ্য গড়ে তোলা। বাংলা ভাষায় পর্যালোচনাকে আরও সহজ ভাষায় বলা হয় 'বিচার'। সজীব ও সক্রিয় 'চিন্তা'র সঙ্গে 'মত প্রকাশ'-এর  ভেদ নির্ণয়ের মধ্য দিয়ে চিন্তা এগোয়। আমরাও সেই ভাবেই অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছি। যাঁরা চিন্তা পাঠচক্রে নিয়মিত আসেন এবং যাঁরা আমাদের অনুসরণ করছেন তাঁরা লেখাটি পড়লে আমাদের সম্পর্কে একটি ধারণা আপনারা পাবেন -ফম]

পাক্ষিক চিন্তা প্রকাশ উপলক্ষে চিন্তা সম্পর্কে কিছু কথা মনে জেগেছে। বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ ও লড়াকু মনোভাবের একাট খ্যাতি আছে। যদিও গণতন্ত্র আসলে কি সেটা সম্পর্কে বাংলাদেশে আমরা খুব যে একটা ভাবনা চিন্তা করি তা নয়।পাক্ষিক চিন্তা গণতন্ত্রের পক্ষের একটি পত্রিকা হবে এটা আশা করা যায় নিশ্চয়ই। কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষের পত্রিকা বা গণতান্ত্রিক পত্রিকা কথাগুলোর মানে কি?একটা মানে হঠাৎ করে মনে আসে। সেটা হোল,বাংলাদেশে আমরা সবাই, যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়ছি, পাক্ষিক ‘চিন্তা’ তাদের সকলেরই পত্রিকা হয়ে উঠতে চায়।

‘সকলেরই পত্রিকা’ এই কথা কানে শুনতে যতো ভাল লাগে কথাটা পরখ করতে বসলে নানান খুঁত বের হয়। যেমন, ‘সকলের পত্রিকা’ কথাটার মানে কি? এর একটা মানে হতে পারে যে এটি সকল মতামতের পত্রিকা।তার মানে নানান মত ও চিন্তার জন্যে জায়গা করে দিতে হবে এই পত্রিকার। যদি তাই হয় তাহলে কেউ যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস না করে তাকেও কি জায়গা করে দিতে হবে?এই প্রশ্নটা মুখিয়ে উঠলেই মনে খচখচি শুরু হয়। আসলে গণতন্ত্র বলতে সকল মত ও পথের সহাবস্থান, পরমতসহিষ্ণুতা, প্রভৃতি বিষয়কে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যাতে গণতন্ত্র এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে গণতন্ত্র বিরোধীদের তৎপর ও সক্রিয় থাকার একটা চমৎকার কৌশল। যে ব্যক্তি গণতন্ত্র বিরোধী তাকেও গণতন্ত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে গণতন্ত্রের বিরোধিতা করার ও তার ধ্বংস সাধন করার সুযোগ করে দেয়।

অনেকে বলবেন,‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ ছাড়া গণতন্ত্র হয় কি করে? খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন।এই প্রশ্নের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বেসামাল হয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে গণতন্ত্রের শক্রদের গণতন্ত্র বিরোধী মত প্রকাশের জন্য অনেকে জায়গা না করে দিয়ে পারেন না।কারণ যুক্তিটা খুব সহজ: গণতন্ত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলের আছে, অতএব যারা গণতন্ত্র চায় না, গণতন্ত্রকে যারা ধ্বংস করতে চায়,তাদের মতটাও প্রকাশ করার অধিকার গণতন্ত্রে থাকা চাই। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবার এই নীতিটা ভাল করে খেয়াল না করলে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ নামক কথাটার পেছনে ধ্বংসাত্মক অগণতান্ত্রিকতা কি করে ঘাপটি মেরে থাকে সেটা সহজে বোঝা যায় না।

কিন্তু গণতন্ত্রে অবশ্যই চিন্তার বিতর্ক,মত ও পথের বিতণ্ডা ও দ্বন্দ থাকা চাই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে সেটা কিভাবে সম্ভব হবে? দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রে একটা অস্পষ্টতা বা গলদ থেকে যাচ্ছে। ফলে এ বিষয় কিছু কথা অতি সংক্ষেপে এখানে বলা দরকার।যদিও পাক্ষিক চিন্তায় এই সকল গভীরতর প্রশ্ন নিয়ে আরো দীর্ঘ আলোচনা হবে বলে আমরা আশা করি।

গলদটা শুরু হয় ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ আর ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ এই দুইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সম্পর্কে অস্পষ্টতার কারণে। কারো একটি মত থাকতে পারে যা সে ‘বিশ্বাস’ করে। সে বিশ্বাস সরাসরি গণতন্ত্রের বিরোধী হতে পারে। যেমন,নাৎসীরা বিশ্বাস করতো যে দুনিয়ায় তারাই শাসক জাতি।অন্যান্য জাতি তাদের মতো বিশুদ্ধ নয়। জর্মন জাতির রক্তে আর্য্য আভিজাত্যের যে ধারা প্রবাহমান সেটা অপরাপর নিম্ন জাতির মধ্যে নেই।অতএব পৃথিবীকে বাস যোগ্য করে তুলতে হলে অন্যান্য অশুদ্ধ ও নিম্ন স্তরের জাতিদের মেরে কেটে সাফ করে ফেরতে হবে। এই লক্ষেই তারা লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মেরেছিল। নাৎসীদের এই বীভৎস হত্যাযজ্ঞ যে ‘মত’–এর ওপর প্রতিষ্ঠিত সেটা প্রকাশ করার স্বাধীনতা কি তাহলে তাদের আছে?

বাংলাদেশ থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। যদি কোন রাজনৈতিক দল খুবই পরিষ্কার ভাষায় বলে যে তারা যদি ক্ষমতায় যায় তাহলে তারা গণতন্ত্র রাখবে না,বাংলাদেশকে তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র বানাবে।এই ধরণের রাষ্ট্রে শুধু ‘বিধর্মী’দের নাগরিক অধিকারই ক্ষূন্ন হবে না, সকল নাগরিকেরই নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হবে।এই ভাবে যারা পরিষ্কার ভাবে গণতন্ত্র ধ্বংস করার নীতি, মত ও পথের অনুসারী,তাদের মত প্রকাশের অধিকার কি গণতন্ত্রে থাকতে পারে?

অনেকে বলবেন এই ধরণের অগণতান্ত্রিক ধারাকে গণতন্ত্রে সক্রিয় থাকতে দেয়া যাবে না এ কারণে যে এগুলো হচ্ছে বিশ্বাস। কিন্তু ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। কারণ গণতন্ত্রও তো একটা বিশ্বাস। কমিউনিজমও একটা বিশ্বাস। যে মত আমার কাছে সত্য বলে মনে হয় তাকেই তো আমরা বিশ্বাস করি। যদি নাৎসীদের কিম্বা ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের পক্ষে মতপ্রকাশের অধিকারকে আমরা অধিকার হিসাবে স্বীকার না করি তাহলে গণতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের মত প্রকাশের অধিকারকে রক্ষা করা যায় না। এই মুশকিল তো সহজে নিরসন করবার নয়।

অতএব আরো গোড়ার দিকে তাকাতে হবে।

আমরা যখন কোন মতে পৌঁছি,কোন মতকে সত্য বা বিশ্বাস হিসাবে আঁকড়ে ধরি, সেটা আমরা দুই ভাবে পৌঁছাতে পারি।এক হতে পারে অন্যের কাছে আমরা শুনেছি, বা সেই মত বা বিশ্বাসের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমরা বড়ো হয়েছি। ফলে সেই মত বা বিশ্বাস আমাদের কাছে স্বাভাবিক বা স্বতঃস্ফুর্তভাবেই সত্য মনে হয়। দ্বিতীয় যে প্রকারে আমরা একটা মত বা বিশ্বাসে পৌঁছাই সেটা হচ্ছে কোন বিষয় নিয়ে ভাবা বা চিন্তা করা। অর্থাৎ সক্রিয় চিন্তার ফলাফল হিসাবে একটা মতে বা বিশ্বাসের একটা অবস্থানে আমরা পৌঁছাই, যে অবস্থান আমাদের সত্য বলে মনে হয়।এখন, এই যে দুই ভাবে সত্যে পৌঁছাবার পথ উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক আছে। কোন চিন্তা না করে প্রথম ধরণের সত্যে পৌঁছানোর পেছনে কোন চিন্তা নেই ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। যেমন,কার্ল মার্কসের চিন্তা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত না হয়েও, মার্কসের চিন্তা পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু না জেনে, কিম্বা মার্কস যে বিষয় নিয়ে ভেবেছেন সেই বিষয়ে নিজে সম্যক চিন্তাভাবনা না করে এবং মার্কসের মতো একই সিদ্ধান্তে না পৌঁছেও। অর্থাৎ মার্কস সম্পর্কে খুবই কম জেনে অনেকে ‘মার্কসবাদী’ হতে পারে। সেটা নানা কারনে হতে পারে। হতে পারে বন্ধুদের প্রভাবে, পুঁজিপতিদের পছন্দ করে না বলে বা যে সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তারা বড়ো হয়েছে তার বদৌলতে।

তাহলে নিজে সরাসরি কোন চিন্তা না করে কোন মতে বিশ্বাস স্থাপন করা মানে সেই মতের পেছনে কোন চিন্তা নেই এই কথা ঠিক নয়। যেমন, যে চিন্তা কার্ল মার্কস করে গেছেন,কেউ নিজে চিন্তা না করে কার্ল মার্কসের সেই চিন্তায় অনায়াসেই আস্থা স্থাপন করতে পারে। অর্থাৎ কেউ নিজে চিন্তা না করলেও অপরের চিন্তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতেই পারে। তাহলে যে মতে সে বিশ্বাস স্থাপন করলো সেটা আসলে চিন্তা ক্রিয়ারই একটা ফল, একটা অবস্থান। কিন্তু এটা আবার আমার চিন্তা নয় বা চিন্তা প্রক্রিয়া নয়। খোদ চিন্তা ক্রিয়াকে নয়,কিম্বা সজীব চিন্তাকেও নয়,চিন্তার ফলাফলকেই আমরা ‘মত’ বলে আখ্যায়িত করি। ধর্ম হোক বা মার্কসবাদ হোক, কিছু আসে যায় না। দুটোই সজীব চিন্তার প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের চিন্তাহীন সম্পর্ক ব্যক্ত করে। যাকে সাধারণত ‘বিশ্বাস’ বলা হয়।

বিশ্বাস হলেও মার্কসবাদের পেছনে যেমন চিন্তা আছে তেমনি ধর্মের পেছনেও চিন্তা আছে। কিন্তু বিশ্বাস মানে চিন্তা এখানে নিজের সম্পর্কে সচেতন নয়। ধর্ম মনে করে তার চিন্তাটা এসেছে চিন্তার বাইরে থেকে। মানুষের বাইরের অন্য কোন আধ্যাত্মিক বা ঐশ্বরিক উৎস থেকে তার জন্ম। মার্কসবাদীও মনে করতে পারে তার চিন্তা এসেছে মার্কসের কাছ থেকে। নিজের সক্রিয় চিন্তার মধ্য দিয়ে সে নিজে যদি স্বয়ং কমিউনিজমে না পৌঁছায়, যদি সেটা তার নিছকই ‘বিশ্বাস’ হয়, তাহলে ধর্মতত্ত্ব আর মার্কসবাদের মধ্যে ফারাক বিশেষ থাকে না। চিন্তার এই যে পর্যায়, যখন চিন্তা নিজের আপন প্রক্রিয়াকে নিজে বুঝতে পারে না, সদয় হয়ে বলা যেতে পারে সেটা চিন্তার শৈশবাবস্থা। নিজের মতকে নিজে বিচার বা পর্যালোচনার হিম্মত তখনও গড়ে ওঠে নি। বিশ্বাস, সেটা ধর্মীয় হোক কিম্বা সেকুলার, অতএব সরাসরি সক্রিয় ও সজীব চিন্তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। যে সত্য বা বাক্যে ধর্ম বা কোন মতবাদ ‘বিশ্বাস’ করে সেটা যে মানুষেরই ঐতিহাসিক বিকাশের একটা পর্যায়ের ভাবনা বা মূহূর্ত সেটা তখন বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। কোন একটি মতবাদ যখন নিজেকে চিরায়ত ও শ্বাশ্বত দাবি করে তখন সজীব চিন্তার ইতিহাসকেই মূলত অস্বীকার করা হয়। সেটা যে শুধু ধর্ম বুঝতে পারে না তা নয়, সকল ‘মতবাদ’ সম্পর্কেই একথা সত্য। তখন কোরান হাদিস তৌরাত ইঞ্জিল বাইবেল গীতা, মহাভারত, রামায়ন, ত্রিপিটক ইত্যাদিকে যেমন সত্যের দলিল হিশাবে হাজির করা হয়, তেমনি মার্কস, লেনিন, মাওজেদং প্রমুখের লেখালিখিও স্রেফ বিশ্বাসের দলিলে পরণত হয়। মানবেতিহাসের চিন্তার ইতিহাস বা সজীব চিন্তার প্রক্রিয়া থেকে উভয় প্রকার মতই নিজেকে নিজে খারিজ করে দেয়। এ কারণে সজীব চিন্তার সঙ্গে ধর্ম বা যে কোন নির্জীব মতের র বিরোধ খুবই গোড়ার একটা গোলমাল। আদি প্রাকরণিক দ্বন্দ্ব যা প্রতিটি মতবাদের ক্ষেত্রেই পুনরুৎপাদিত হয়।

এখন,যদি খোদ চিন্তা বা চিন্তা প্রক্রিয়াকে খেয়াল না করে কেবল চিন্তার ফলাফলের ওপরই আমাদের নজর থাকে তাহলে যে কোন যে কোন ‘মত’ বা চিন্তাজাত বিশ্বাসকেই আমরা চিন্তা বলে ভুল করব।মত, মতবাদ, মতাদর্শিক ধারণা বা চিন্তাজাত বিশ্বাস হচ্ছে চিন্তার বা চিন্তা প্রক্রিয়ার ফলাফল।এরা খোদ সজীব চিন্তা প্রক্রিয়া নয়,চিন্তা প্রক্রিয়ার ফসল মাত্র। তাহলে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ বলতে চিন্তার অর্থেৎ সক্রিয় চিন্তার স্বাধীনতা বোঝায় না, শুধু বোঝায় কোন একটা সময়ের কোন এক বিশেষ ঐতিহাসিক মূহূর্তে চিন্তা যে বিশেষ সিদ্ধান্তে এসেছিল সেই সিদ্ধান্ত বা ‘মত’ প্রকাশের স্বাধীনতা মাত্র। চিরায়ত কোন সত্য নয়। চিন্তা পরবর্তী বিকাশে,বা একই বিষয়ে চিন্তা আবার ভেবে আরো অগ্রসর অবস্থান নিতে পারে। সেই সম্ভাবনা চিন্তার অর্ন্তনিহিত স্বভাবেরই অন্তর্গত।

‘চিন্তার স্বাধীনতা’র দাবি যখন তোলা হয় তখন সেটা আর ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ থাকে না। কারণ, চিন্তার স্বাধীনতা মানে ভুল, অসম্পূর্ণ, অবিকশিত সকল ‘মত’কে নাকচ করে দেবার স্বাধীনতাও বটে। কিন্তু ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ দাবি করে যে, যেসব মত ও পথ, চিন্তা তার নিজস্ব বিকাশের কারণে নিজস্ব যুক্তিতে বাতিল ও ক্ষতিকর মনে করে তাদের টিকিয়ে রাখতে হবে, তাদের প্রচার ও প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। শুধু তাই নয়,এমন কি চিন্তা প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক বিকাশ ও তৎপরতার বিরুদ্ধে বাতিল ও ক্ষতিকর মতগুলোকে প্রতিবন্ধক হিসাবে খাড়া করবার অধিকারও চায় ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র দাবিদাররা।

তাহলে দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের সত্যিকারের মর্ম ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র মধ্যে নয় বরং স্বাধীন, সজীব ও সক্রিয় চিন্তার ‘স্বাধীন’ উপস্থিতি কায়েমের মধ্যে নিহিত। চিন্তার স্বাধীনতার অর্থ চিন্তা নিজের অধীন, বাইরে থেকে আমদানি হয়ে আসা কোন অনুমান, মতবাদ, নির্দেশ বা হুকুমের তাঁবেদারি থেকে চিন্তার মুক্তি। নিরন্তর চিন্তাকে সজীব ও সক্রিয় রাখাই গণতন্ত্রের কাজ। আমরা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, যে সত্যে পৌঁছাই, যে মতে অবস্থান নেই প্রভৃতি সবকিছুরই মূল উৎস বা ভিত্তি হচ্ছে সক্রিয় চিন্তা বা চিন্তার সক্রিয় প্রক্রিয়া।তাহলে আমাদের বিকশিত হবার, সামনে এগিয়ে যাবার পথ হচ্ছে সক্রিয় চিন্তাকে নিরন্তর বর্তমান রাখা। ভুল,অসম্পূর্ণ ও অবিকশিত মত ও পথকে পেছনে ফেলে সম্মুখে অগ্রসর হবার শর্ত হচ্ছে চিন্তাকে সক্রিয় করা, সর্বদা সক্রিয় রাখা। কোন মতের ওপর বা চিন্তার কোন ইতিহাস বা সুনিদিষ্ট বিশেষ ফলাফলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তাকেই চিন্তার শেষ গণ্য করা চিন্তার বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। দেশকালপাত্র ভেদে বিশেষ বিশেষ মত চিন্তার অগ্রগামী অবস্থান ব্যক্ত করতে পারে, কিন্তু তাকেই চিন্তার পরিসমাপ্ত গণ্য করা গণতন্ত্রের প্রাণশক্তির বিরুদ্ধে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা অনায়াসেই লক্ষ্য করব যে চিন্তার সজীব ও সক্রিয় তৎপরতার বিরুদ্ধে সবসময়ই কোন না কোন পুরাতন ‘মত’ বা ‘বিশ্বাস’কে খাড়া করা হয়েছে। একসময় ব্যবহার করা হতো ধর্মকে। চিন্তার স্বতঃস্ফুর্ত ভাবনা ও সিদ্ধান্তকে ধর্ম দিয়ে একসময় দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, এখনও করা হয়। তবে ধর্মের মতোই যুক্ত রয়েছে নানান কিসিমের মতাদর্শ বা ইডিওলজি। ধর্মতত্ত্বের পরিমণ্ডল আমরা যে কারণে অতিক্রম করতে পারছি না।

যদি চিন্তার সজীব ও সক্রিয় তৎপরতাই তা বিকাশের একমাত্র শর্ত হয় তাহলে চুড়ান্ত মত,পথ বা দর্শন বলে কিছু থাকতে পারে না, এই রকম একটা সিদ্ধান্তে ওপরের কথা থেকে অনেকেই পৌঁছাতে পারেন। সকল মত, পথ বা দর্শন তাহলে সাময়িক একটা ব্যাপার। কিন্তু চিন্তার সজীব ও সক্রিয় তৎপরতার মানে এই নয় যে একটি অবস্থান থেকে চিন্তা যখন আরো বিকশিত অবস্থানে পৌঁছায় তখন তার আগের অবস্থানটা নাকচ হয়ে যায় বা ভুল প্রমাণিত হয়। চিন্তার বিকাশ ঘটা আর ভুল চিন্তা করা এক কথা নয়। দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করে চার না লিখে কেউ পাঁচ লিখলে সেটা হবে ভুল।এটা সবসময়ই ভুল। কিন্তু কেউ যদি বলে সংখ্যা যোগ করবার সময় দশকে ভিত্তি করে যোগ না করে দুই সংখ্যার ভিত্তিতে বাইনারি পদ্ধতিতেও যোগ করা সম্ভব তাহলে সেটা ভুল হলো না। আধুনিক গণিত এই পদ্ধতি ব্যবহার করে। আরো নানা ভাবে সংখ্যা গণনা করা যেতে পারে। বাইনারি পদ্ধতি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে গণনা প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের চিন্তার বিকাশ সাধিত হবার পর কেউ যদি বলে দশকে ভিত্তি ধরে নিয়ে গণনার পদ্ধতিই হচ্ছে একমাত্র সঠিক পদ্ধিতি তখন সেই মতটা হবে ভুল ও পশ্চাতপদ একটা মত। নামতা বা দশকীয় গণনা পদ্ধতি আমরা ব্যবহার করতে পারি। তার দরকারও আছে। অর্থাৎ চিন্তার বিকাশ ঘটবার পরেও পুরানা পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য যদি বলা হয় বাইনারি লজিক চলবে না, পুরা গণিতই শুধু ছহি, তখন তা অবশ্যই ভুল। এই মতবাদ গণিত শাস্ত্রের বিকাশের টুঁটি চেপে ধরে। তাই দর্শনের জগত হাজির হবার পর ধর্মের জগতের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বা ধর্মীয় চিন্তা বাতিল হয়ে গিয়েছে এই দাবির কোন ভিত্তি নাই। ধর্মতত্ত্ব চিন্তারই একটা মূহূর্ত, দর্শনের সঙ্গে তার পার্থক্য রূপ বা ধরণে। বলা হয়ে থাকে চিন্তা যখন নিজেকে নিজের স্বরূপে অর্থাৎ নিজের আত্মসচেতন চিন্তা প্রক্রিয়া থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, সেটা ধর্মতত্ত্ব। দার্শনিক্রা বলবেন, ধর্মতত্ত্ব বুঝতে পারে না তার চিন্তা তার নিজেরই চিন্তা, তাই তাকে বাইরের বরাত দিতে হয়। ঈশ্বর, ধর্মগ্রন্থ, দৈবীবাণী কিম্বা অপৌরুষেয় শ্রুতি, কিন্তু দর্শনে এই আরামটুকু নাই। দর্শঙ্কে দেখাতে হয় সে যা চিন্তা করছে সেতা তার নিজেরই চিন্তা, আর সত্য বলে সে যা দাবি করে সেটা চিন্তা প্রক্রিয়ারই অনিবার্য ফল, তার চেষ্টা সদাই নিজগুণে সার্বজনীন অর্জনের সাধনায়। ধর্মের সঙ্গে রূপের পার্থক্য ছাড়া মর্মের দিক থেকে বিশেষ ভেদ নাই। কারন উভয়েরই আরাধ্য পরমার্থ।

একসময় ‘পুঁজি’ বলতে নানান কিছু বোঝানো হোত। পুঁজি আত্মস্ফীতি পরায়ন, এতে টাকা খাটানো হয় মুনাফার জন্য এবং টাকা নিজের পরিমাণগত বৃদ্ধি ঘটাবার জন্য বারবারই বিনিয়োগে ফিরে যায়। পুঁজির এই চরিত্র সব সময়ের জন্যই সঠিক। পুঁজি উৎপাদন করে মুনাফার জন্য, তার পুঞ্জিভবন বা পরিমাণগত বৃদ্ধির জন্য। আসলে কী পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে -- পুঁজি খাটিয়ে বিষ উৎপাদিত নাকি অমৃত -- সেটা নিয়ে পুঁজির মাথাব্যথা নেই। বিমূর্ত সংখ্যার হারে নিজের পরিমাণ গত বৃদ্ধি ছাড়া উৎপন্ন পণ্য কি বানানো হোল বা কি হোল না তাতে পুঁজির কিছুই আসে যায় না। এর ফলে মানুষের সত্যিকারের প্রয়োজন মেটাবার জন্য উৎপাদন হয় না, উৎপাদন সংগঠিত হয় পুঁজির স্ফীতি ঘটাবার জন্য। চিন্তা যখন পুঁজির এই চরিত্রটা বুঝতে পারে তখন সেটা আর সাময়িক সত্য থাকে না। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের বেঁচে থাকার ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে । পুঁজি সম্পর্কে অতীতের ধারণা থেকে চিন্তা আরো বিকশিত ধারণায় গিয়ে পৌঁছায়।

কিন্তু কার্ল মার্কস পুঁজি সম্পর্কে যে কথা বলে গেছেন সেটাই পুঁজি সম্পর্কে শেষ কথা নয়। মানুষের বৈষয়িক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন সম্পর্কে তাঁর আবিষ্কার যেখানে দাঁড়ানো সজীব-চিন্তার অন্বেষণ ও তৎপরতা সেই সিদ্ধান্তবিন্দু থেকে আরো বহুদূর এগিয়ে যাবে এবং যাচ্ছে। নিউটনের পদার্থতত্ত্বের পথ ধরে আলবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্বের যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন তাতে নিউটনের তত্ত্ব ভুল হয়ে যায় নি। প্রকৃতি জগৎ সম্পর্কে চিন্তার ধ্যানধারণার বিকাশ ঘটেছে মাত্র। কিন্তু চিন্তা যাকে ভুল বলে মনে করে তা সব সময়য়ের জন্যই ভুল।পদার্থ বিজ্ঞানের ঈথার তত্ত্ব একটি ভুল তত্ত্ব ওটা সব সময়ের জন্যই ভুল। পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের অধীনে মানুষ নিজের শ্রমশক্তি বিক্রি করে, শ্রমিক মানুষ এখানে দাসদের মতোই পুঁজির দাস। কেউ যদি দাবি করে এই পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কটাই একটা আদর্শ তাহলে সেটা হবে একটি ভুল তত্ত্ব, একটি ভুল অবস্থান। এই দাস সম্পর্ক ইতিহাসের এই পর্বে আমরা দেখছি। এটা চিরদিন থাকবে না,থাকতে পারে না্।

অতএব দেখা যাচ্ছে চিন্তার ভুল আর চিন্তা তার একটি অবস্থান থেকে অন্য একটি অবস্থানে বিকশিত হয়ে উঠছে এই দুটো সম্পুর্ণ আলাদা ব্যাপার। গণতন্ত্র যখন ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র কথা বলে তখন তার মধ্যে ভুল মত প্রকাশের স্বাধীনতাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতা মানে ভুল মত প্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না। ধর্মের মধ্য দিয়ে যে মত বা চিন্তা প্রকাশিত হয় তার উৎস ধর্মানুসারে বিভিন্ন। ধর্মের চিন্তাকে ঐশ্বরিক জ্ঞান করা হয়। বলা হয় ধর্মীয় চিন্তার যে অংশ নিছকই বিশ্বাস তার কর্তা চিন্তা নিজে নয়, অর্থাৎ মানুষ নয়। চিন্তা নিজের উৎস নিজে শনাক্ত করতে না পারাটা এক ধরণের অজ্ঞান স্তর। সেটা ভুল নয়। মানুষের মধ্যে আত্মসচেতন হবার সম্ভাবনা সবসময়ই বিরাজ করে, তাই অজ্ঞানতা বা জাহেলিয়াত চিন্তা অতিক্রম করে যেতে পারে। কিন্তু দর্শন, বিজ্ঞানের মতোই ধর্মের অনেক দাবিকে ভুল বলার অর্থ ধর্ম মানেই ভুল নয়। যেমন, ধর্মানুসারে পুরুষদের পাঁজর থেকে মেয়েদের পয়দা করা হয়েছে দাবি করা হয়। এটা কি প্রতীকী নাকি আক্ষরিক। এর নানান মানে হতে পারে। আক্ষরিক ভাবে আদম হাওয়া গল্প পাঠ করার মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক মতকে ধর্মীয় ন্যায্যতা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটা একটা মত। পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করাই এই মতের উদ্দেশ্য। কিন্তু বাস্তবে যখন আমরা দেখি বাস্তবে পুরুষের হাড় থেকে কেউই নয়, বরং নারীর গর্ভ থেকে নারীপুরুষ সকলেই ভূমিষ্ঠ হচ্ছে, তখন আমরা বুঝতে পারি পুরুষের হাড় থেকে নারীকে আল্লাহ তৈরি করেছেন কথাটা প্রতীকী, নারী ও পুরুষের সম্বন্ধ নিয়ে চিন্তাকে আরও ভাবনার রসদ দর্শন বা সজীব চিন্তা এখানে খুঁজবে। এই অর্থেও চিন্তা স্বাধীন। ভুল আর শুদ্ধের মধ্যবর্তী আরেকটি স্তর আছে, যেখানে কল্পনা, প্রতীক, ইঙ্গিত, ইশারা ইত্যাদি কাজ করে। সজীব চিন্তা সেকাহ্নে সোৎসাহে অংশগ্রহণ করে এবং ধর্মতত্ত্বের সীমা অতিক্রম করে যায়। চিন্তার স্বাধীনতার সঙ্গে ধর্মের বিরোধকে তাই মৌলিক গণ্য করার কারণ নাই। ভাষা, উপমা, প্রতীক, উৎপ্রেক্ষা, পুরাণ, কেচ্ছা, গল্প ইত্যাদি চিন্তার আরেক পরিমণ্ডল। তাকে সমৃদ্ধ করবার জন্যই চিন্তার স্বাধীনতা বর্তমান করা জরুরী।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসাবে গণতন্ত্রকে যখন ব্যাখ্যা করা হয় তখন ধর্ম চর্চা এবং ধর্মীয় মত প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতাও তার অন্তর্ভুক্ত। গণতন্ত্রের এই রূপ সাধারণত ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ হিশাবে পরিচিত। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও চর্চার ব্যাপার হিসাবে কবুল করা হয়, সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা ও ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত। ধর্ম চর্চা ও ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার ব্যক্তির অধিকার হলেও, ধর্মীয় অধিকার নয়। গণতন্ত্রের গোড়ায় রয়েছে সার্বভৌম ও স্বাধীন ব্যক্তির ধারণা যেখান থেকে সার্বভৌম জনগণের ক্ষমতার পরিগঠন হিশাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা স্বীকৃত। সার্বভৌম স্বাধীন ব্যাক্তি সমাজে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে যতক্ষণ না সে অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে বা অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতায় বাধা হয়ে উঠছে। ধর্মের সঙ্গে সার্বভৌম ব্যক্তি বা সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণা সাংঘর্ষিক। ধর্মের চোখে সার্বভৌম সত্তা হচ্ছে আল্লাহ। তাহলে ধর্মীয় সংগঠন যদি দাবি করে তারা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে ধর্মরাষ্ট্র স্থাপন করবে তাহলে কি গণতন্ত্রের উচিত এই ধরণের অগণতান্ত্রিক বা গণতন্ত্র বিরোধী মতবাদের স্বাধীনতা স্বীকার। গণতন্ত্রের গোড়ায় এই দোলাচল রয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে মতের দমন – এই স্ববিরোধিতা গণতন্ত্রের ধারণার মধ্যে নিহিত। মতের দমনকে আইনী ভাষায় বলা হয় ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ’ (বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১(২) অনুচ্ছেদ দেখুন। অর্থাৎ মতের স্বাধীনতা নিরংকুশ নয়। মত দমনের জন্য রাষ্ট্র আইন করতে পারবে। কিম্বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃংখলা, শালীনতা, নৈতিকতার স্বার্থে আইন, বিচার ব্যবস্থা ও পুলিশ দিয়ে রাষ্ট্র মত দমন কিম্বা বাধানিষেধ আরোপ করতে পারবে।

কিন্তু গণতন্ত্র শুধু বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সীমিত থাকবে সেটা আমরা আগাম নির্ধারণ করে দিতে পারি না। মানুষ ভবিষ্যতে কিভাবে আত্মসচেতন হয়ে উঠবে সেটা আগাম অনুমান করা মুশকিল। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং চিন্তার স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য বোঝা গণতন্ত্রের সুবিধা, সম্ভাবনা ও সীমা বিচারের জন্য জরুরী।

এবার আমরা প্রথম কথায় ফিরে আসি। একটি গণতন্ত্রের পক্ষের পত্রিকা বা গণতান্ত্রিক পত্রিকা সকলের পত্রিকা হতে পারে না। এটা হবে তাদের পত্রিকা যারা চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে।মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে সজীব চিন্তার সক্রিয়তা ও তৎপরতার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবন্ধকতা মেনে নেয়া যাবে না।এই পত্রিকায় নানান ‘মত’ প্রকাশিত ও প্রচারিত হবে, সজীব চিন্তার সক্রিয়তার একটা অবস্থান বা একেকটি মুহূর্ত হিসাবে। কিন্তু প্রত্যেকেই জানবে মতটা এখানে মুখ্য নয়,সজীব চিন্তা তার আপনকার তৎপরতার মধ্য দিয়ে যে বিকশিত অবস্থানে পৌঁছাবার চেষ্টা করছে সেই তৎপরতাটাই আসল । ফলাফলটা তৎপরতার প্রকাশ মাত্র। সেই তৎপরতার কারণে, কিম্বা অন্য কথায় চিন্তা সবসময় তার বর্তমান অবস্থান থেকে আরো বিকশিত অবস্থানে পৌছাবার তাগিদে তর্কে, বিতণ্ডতায়, পর্যালোচনায় অবশ্যই মাতবে। সজীব চিন্তার মুহূর্ত হিসাবে নানান মতামতের প্রতিফলন থাকবে সেখান। কিন্তু সেখানে এমন কোন চিন্তার জায়গা থাকবে না যে সকল চিন্তা ইতোমধ্যেই ভুল বা ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ চিন্তার স্বাধীনতাকে কখনোই মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসাবে গুলিয়ে ফেলা হবে না। দুনিয়ার ইতিহাসের যে পর্যায়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার সবচেয়ে বিকশিত ভাবনাগুলোকে অন্বেষণ করে বেড়াবে এই ধরণের পত্রিকা। সে সকল চিন্তাভাবনাকে পরখ করা হবে, পর্যালোচনা করে দেখা হবে যে সজীব চিন্তার তৎপর পরীক্ষার সামনে তারা টিকে থাকতে পারে কিনা।

বাংলাদেশে আজ ঠিক এধরণেরই একটি পত্রিকার দরকার। কিন্তু প্রয়োজনের কথা উপলব্ধি করা সহজ এবং দরকারের কতা গলাবাজি করে বলাও কঠিন নয়,করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। আসলে চিন্তাকে তৎপর করা যাবে কিভাবে? উত্তর হচ্ছে চিন্তা করতে শুরু করে দিয়ে।আর ঠিক এই কাজটাই-চিন্তা করার কাজটাই সব চেয়ে কঠিন কাজ।

চিন্তা করার কাজটা কঠিন বলার মানে এই নয় যে চিন্তা করা একটি কঠিন ব্যাপার। কঠিন এ কারণে যে আমরা সহজে চিন্তা করতে চাই না। চিন্তা করলেও চিন্তা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে যে সকল সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সেগুলো মেনে নেবার মতো আস্থা নিজের ওপর নিজে অর্জন করতে পারি না। সমাজের প্রচলিত অনুমান, ,অন্যের কাছে শোনা মত, নিজের দীর্ঘদিনের অভ্যাসগ্রস্ত ভাবনা ইত্যাদির আরাম থেকে বেরিয়ে মাথা খাটাতে আমরা খুবই ভয় পাই। সে কারণে চিন্তা করা আসলেই বেশ কঠিন একটা কাজ।

কিন্তু বাংলাদেশর পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তাকে সক্রিয় করে তোলার কাজটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। আস্তে আস্তে হলেও সেই কাজে আমাদের হাত দিতেই হবে। ঠিক সেকারণেই গণতন্ত্রের পত্রিকা বা চিন্তার বিকাশকে নিশ্চিত করে তুলতে পারে এমন পত্রিকার শ্লোগান হবে খুবই বিনয়ী। খুব বড়ো কিছু করবার হামবড়ামি এখন দরকার নেই। আমাদের চিন্তা করতে শিখতে হবে।এই সময়ের জন্যে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পত্রিকার শ্লোগান অতএব ঝাঁঝাঁলো কিছু হবে না।শ্লোগান হবে এই রকম যে পত্রিকাটির তৎপর চিন্তার আধার হয়ে উঠুক, আর কিছু না।

আসলেই,পাক্ষিক ‘চিন্তা’ হয়ে উঠুক তৎপর চিন্তার পত্রিকা-এর চেয়ে অধিক একটি গণতান্ত্রিক পত্রিকা আর কি হতে পারে।

 

প্রথম প্রকাশ ৮ অগাস্ট ১৯৯১/২৩ শ্রাবণ ১৩৯৮। ঢাকা।

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।