৮. করোনাভাইরাস, জীবানু মারণাস্ত্র এবং বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ


ভাইরাস অজৈব ও জৈব জগতের মাঝখানে এক অদ্ভূত আমিষ পদার্থ। না জীব না বস্তু। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে এই আজব জগতের ওপর আধিপত্য বিস্তারের তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে। এই আজব চিজের ওপর বৈজ্ঞানিক, সামরিক ও কৃৎকৌশল্গত আধিপত্য অর্জনের ওপর আগামিতে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক কারা হতে যাচ্ছে তা নির্ভর করে। কোভিড-১৯ সম্পর্কে জৈব মারণাস্ত্রের তর্ক ভাইরাসের আজব বৈশিষ্ট্যের কারণেই রয়েছে। সংক্রমণের বিপর্যয় থেকে সুরক্ষার প্রশ্ন ছাড়াও শুরু থেকেই আমি তাই এর উপর জোর দিচ্ছি। আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা আমাদের নাই। কিন্তু কেন বারবার হাত ধোবার পরামর্শ দেওয়া হয় সেই বৈজ্ঞানিক কারণ নিদেন পক্ষে জানা কি আমাদের কর্তব্য নয়?

কোভিড-১৯ ছোঁয়াচে, ফলে ছোঁয়াচে রোগ থেকে দূরে থাকার ব্যাপারটা আমরা কিছুটা বুঝি। বসন্ত বা যক্ষায় যেন আমাদের আক্রান্ত হতে না হয় তার জন্য আমরা যথাসম্ভব রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলি। তাই ছোঁয়াচে রোগ এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও জানি। এমনকি ডায়রিয়া ও কলেরার সময় পানি ও খাদ্য সম্পর্কে সাবধান হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও আছে, সেটাও আমরা বুঝি।

কিন্তু কোভিড-১৯ একদমই নতুন ধরনের ছোঁয়াচে রোগ, মানুষকে সংক্রমিত করবার ধরণও এই রোগে একদমই অন্য রকম। আমরা শুধু শুনছি এটি ভয়ংকর ও ভয়াবহ। চিন, ইটালি, স্পেন, ইরান, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশের অবস্থা দেখে এই কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয়াবহতার মাত্রা কিছুটা আমরা টের পাচ্ছি। কিন্তু এ কেমন ছোঁয়াচে রোগ যার হাত থেকে নিস্তার পেতে হলে আমাদের ঘন্টায় ঘন্টায় কিম্বা সম্ভব হলে আরও কম বিরতিতে হাত ধুতে হবে? এটা কেউই আমাদের পুরাপুরি ব্যাখ্যা করে বলছেন না। কারন ব্যাখ্যা করতে হলে ‘ভাইরাস’ সম্পর্কে আমাদের কিছু সাধারন জ্ঞান দরকার। নইলে ব্যাপারটা আমরা সহজে বুঝব না। কিন্তু এখন হাত ধরার ম্যনুয়েল লিখতে বসিনি, বরং ভাইরাস কেন্দ্র করে যেসক সকল বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক তর্কবিতর্ক আছে সে ব্যাপারে আগ্রহ তৈরির জন্য কিছু কথা বলব। সামরিক দিক অন্যত্র আলোচনা করব।

কোভিড-১৯ ভাইরাসজাত ছোঁয়াচে রোগ। আমরা বারবার শুনছি মাস্ক বা মুখপর্দা কিম্বা মুখের আচ্ছাদন, হাতের দস্তানা এবং কোভিড-১৯ থেকে শরীর সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা চাই। তারপর আমাদের বারবারই উচ্চক্ষার বিশিষ্ট সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া দরকার। নিয়মিত হাত ধোয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য অবশ্যই ভাল। কিন্তু এই হাতধোয়া কি ‘জীবাণু’ মুক্ত করার জন্য? লাইফবয় সাবানের একটা বিজ্ঞাপন আছে, ‘একশ ভাগ পরিষ্কার গোছল’। তার জন্য? ভাইরাস কি আসলে ‘জীবাণু’? করোনাভাইরাস কি ব্যাকটেরিয়া? যদি ব্যাকটেরিয়া না হয় তাহলে ‘ভাইরাস’ কি? ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু হচ্ছে সপ্রাণ জীব। খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা যায় বলে এর নাম অণুজীব। অণুজীব মানেই আমাদের অসুখ বা ক্ষতি করবে এমন কোন কথা নাই। অণুজীব প্রকৃতিতে, আমাদের চামড়ায়, পেটে, মুখে, নাকে, কানে চোখে নানান জায়গায় কোটি কোটি পরিমাণে আছে। ক্ষতি দূরে থাক, অনেক অণুজীব না থাকলে আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকাও কঠিন হোত।

যেসব অণুজীব ক্ষতিকর অসুখ বাঁধায়, তাই তাদের স্বাভাবিক ও ভালোদের চেয়ে আলাদা করার জন্য ইংরেজিতে বলা হয় ‘প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া’। আমাদের চলতি বাংলা ভাষায় আমরা তাদের নাম দিয়েছি ‘জীবাণু’। জীবাণুও অণুজীব, আমাদের ক্ষতি করে বলে এদের আমরা বলতে পারি ক্ষতিকর অণুজীব। বাংলায় ভালো অণুজীব থেকে ক্ষতিকর অণুজীবকে আলাদা করার জন্য আমরা প্যাথজনিক ব্যাকটেরিয়াকে বলি, ‘জীবাণু’। ‘জীবাণু অণুজীব হিশাবে সবসময়ই আমাদের ক্ষতি করে, তাও নয়। বরং তারা ক্ষতি করে যদি আমরা তাদের ক্ষতি করি। প্রকৃতিতে তাদের আবাস, তাদের নিজেদের মতো করে যাপন, তাদের প্রাণের পরিমণ্ডলে জীবন রক্ষার যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ইত্যাদিকে যদি আমরা নষ্ট না করি, যদি আমরা তাদের সঙ্গে ভারসাম্য মেনে চলি, তাহলে অণুজীব আমাদের ক্ষতি করে না। আমাদের সঙ্গেই মিলে মিশে তারা বাস করে। কিন্তু যখনি আমরা ভারসাম্য মানি না, আমাদের নিজেদের ভোগ ও সুবিধার দিকে অতি মনোযোগ দিয়ে জীবকুলকে ধ্বংস করা শুরু করি, তারা আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়। তাই সমস্যাটা আসলে হানাদার মানুষ, অর্থাৎ হান্দার মানুষের সমাজ ও সভ্যপতার মধ্যে। মানুষের জীবনযাপন, সমাজ ব্যবস্থা এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ধরণই অসুখবিসুখের জন্য বিশেষ ভাবে দায়ী। এটা ভাইরাস সম্পর্কেও সত্য। তাই একালে প্রাণের আবাস (ecology), প্রাণের বিচিত্র সম্পর্ক (biodiversity) এবং মানুষ কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধ রচনা করবে সে সম্পর্কে জ্ঞানার্জন ছাড়া মানুষের পক্ষে নিরাপদ ও উন্নত জীবন যাপনের তরিকা বের করা অসম্ভব। প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে একালে মানুষের আগ্রহের প্রধান কারণও নিরাপদ, সুস্থ ও আনন্দময় জীবনের প্রয়োজনে। ভাইরাস যখন ভয়াবহ বিপর্যয় হিশাবে হাজিরর হয় তখন ভাইরাসকে দোষারোপ না করে আমাদের ভাবতে হবে কোথায় মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধ রচনায় মারাত্মক গলদ করে বসে আছে। সেই গলদ সামাল না দিলে একটার পর একটা মহামারী ঘটতেই থাকবে।

আমরা যখন নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু করি তখন ‘ভাইরাস’ ছিল আমাদের জন্য রীতিমতো একটা মিস্ট্রি, বিশাল এক রহস্য। আমরা প্রায় ৩৫ বচর আগে রসায়নিক সার বা কোন প্রকার কীটনাশক ছাড়া চাষাবাদ করা শুরু করি। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভয়ানক পরিশ্রম করতে হয়েছে । শুরুতে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের গরিব মানুষদের বিষমুক্ত রেখে রোগশোক থেকে মুক্তি দেওয়া। বিশেষত মেয়েদের। কারণ বিষ শুধু বিষক্রিয়া করেই ক্ষান্ত হয় না, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও নষ্ট করে। গ্রামের মেয়েদের দিক থেকে সেটা হয় ভয়ানক, কারন বিষে প্রজনন ব্যবস্থা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আমাদের অনেক বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু একটা পর্যায়ে আমরা যা অর্জন করতে চেয়েছি সেটাও পেরেছি। সার এবং কীটনাশক ছাড়া বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু অধিক ফলনের জন্য দারুন উপযোগী, আমাদের পূর্বপুরুষরা এটা জানতেন, তাই এই নদীমাতৃক পলিবাহিত ভূমিতে তাঁরা বসত গেড়েছিলেন। পূর্ব পুরুষদের অভিজ্ঞতা আমরা আমাদের কৃষকদের নিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছি। আমরা এখন নয়াকৃষির খাদ্যশস্য গ্রামে ও শহরে সরবরাহ করতে পারছি।

সরকারী নীতি কিন্তু কৃষকের বিরুদ্ধে। এই নীতির ভয়ংকর দিক হচ্ছে বিষ কোম্পানি ও সার কোম্পানির হাতে বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থা তুলে দেওয়া দেওয়া হয়েছে। এই নীতি গত কয়েক দশকে প্রবল হয়েছে। সরকারী নীতি আমাদের কৃষিকে দিনের পর দিন ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছে এবং নিয়ে যাচ্ছে। আমি কৃষি নিয়ে এখানে কথা বলব না। এইটুকু বলছি ভাইরাস নিয়ে নয়াকৃষির বিশেষত আমার আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিত বোঝানোর জন্য।

ভাইরাস নিয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা পাশ্চাত্য দেশের চেয়ে ভিন্ন ছিল না। এটা কি অণুজীব নাকি অণুজীব নয়। যদি ক্ষতিকর হয় তাহলে ভাইরাস কি জীবাণু নাকি জীবাণু নয়? আরও বড় পরিসরে প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি প্রাণ নাকি প্রাণ নয়? ক্ষতিকর নাকি উপকারি? বন্ধু নাকি দুষমণ? ইত্যাদি। ততোদিনে আমরা জেনে গিয়েছি প্রকৃতিতে ক্ষতিকর বলে কিছু নাই। প্রশ্ন হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধের চরিত্র কেমন? পোকা কীটপতঙ্গ জীব অণুজীব কিছুই ক্ষতিকর নয়। প্রকৃতিতে তাদের প্রত্যকেরই ভূমিকা আছে। সবই নয়াকৃষির প্রাণ ব্যবস্থায় প্রাণ সম্পদ। আমাদের কাজ হচ্ছে তাদের কাজ সুষ্ঠ ভাবে করতে দেওয়া। তাদের কাজে বাধা না হওয়া।

এই উপলব্ধির জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা বারবার বুঝতে চেয়েছি ভাইরাসকে তাহলে কি বলব? ভাইরাস কি জীব নাকি অণুজীব? জীব ও অণুজীবের ক্ষেত্রে মূল কথা হচ্ছে তাদের সকলকে আমরা নিরাপদ রাখছি কিনা। যদি ভাইরাস কি না জানি তাকে নিরাপদ রাখব কিভাবে, তার ক্ষতিকর হয়ে ওঠা ঠেকাব কিভাবে?

মূল প্রশ্ন হচ্ছে বিভিন্ন জাতি ও প্রজাতি এবং জীব ও অজৈব জগতের মধ্যে আমরা ভারসাম্য রক্ষা করতে শিখছি কিনা। নয়াকৃষি নতুন ধরণের কৃষি। আর তার চ্যালেঞ্জের জায়গাটা ঠিক এখানেই -- ভারসাম্য রক্ষায়। কৃষিকাজের মধ্য দিয়েই আমরা অনায়াসেই বুঝে গিয়েছি যে সকল প্রাণ – জীব কিম্বা অণুজীব -- দৃশ্যমান কিম্বা অদৃশ্য – সকলেই আমাদের বন্ধু। এই গ্রহে সকলকে নিয়েই মানুষকে বাস করতে হবে। সকলে মিলেই – জীব ও অজৈব জগত উভয়কে নিয়েই আমাদের এক নতুন গ্রহের স্বপ্ন দেখতে শিখতে হবে যে গ্রহ আমার আপনার বা যে কোন জীবের মতোই জীবন্ত। সপ্রাণ।

প্রাণ এক অসাধারণ ধারণা যাকে ইংরেজিতে ‘লাইফ’ কিম্বা গ্রিক ‘বায়স’(bios) দিয়ে বোঝা যায় না। কারন কোন জীবশরীর বা অণুজীব কাঁটাছেড়া করে কখনই প্রাণ কোথায় দেখানো যায় না। এনাটমি, বায়লজি দিয়ে ব্যাখ্যা করলেও ‘প্রাণ’ বোঝানো কঠিন। যে সম্পর্কের ভিত্তিতে আমরা সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকে সচল থাকি, পরস্পরের সঙ্গে কথা বলি -- যার কারণে আমরা নিরন্তর সজীব ও সক্রিয়, সেই কারণ-পদার্থ বা সম্পর্কই প্রাণ। জীবন আর প্রাণ এক কথা নয়। জীব অবশ্যই সপ্রাণ, কিন্তু সেই সপ্রাণতা তার জীব শরীর থেকে নয়, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে নানান জৈব ও অজৈব সম্পর্কে সে যেভাবে যুক্ত সেই সম্বন্ধ-সকল থেকেই তৈরি হয়। যখনি আমরা সেই সম্বন্ধ নষ্ট করি আমরা করোনাভারাস জাতীয় দানবের মুখোমুখি হই। প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়।

তাই ভাইরাসের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ বোঝার জন্য আমরা বারবারই বুঝতে চেয়েছি ভাইরাস কি? ভাইরাসের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ কি হবে?

বিগত এক শতাব্দিরও বেশী সময় ধরে ভাইরাস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক মহলের ধারণা বারবার বদলে গিয়েছে। প্রথমত মনে করা হোত ভাইরাস এক ধরনের বিষ । কিন্তু কিছুকালের মধ্যে এই ধারণার বদল হোল। উনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে বৈজ্ঞানিকরা দেখলেন কিছু কিছু রোগ এমন কিছু অদ্ভূত পদার্থের কারণে ঘটে যাদের আচরণ ব্যাকটেরিয়ার মতো কিন্তু তারা আকারে ব্যাকটেরিয়ারের চেয়েও ছোট। যেমন জলাতংক রোগ, কিম্বা গবাদিপশুর ক্ষুরা রোগ (foot and mouth disease) । বৈজ্ঞানিকরা তখন দাবি করতে শুরু করলেন ভাইরাস এক ধরনের ‘জীব-রূপ’(Life Form)। কারন এটা বোঝা যাচ্ছিল এই পদার্থগুলোর জৈবিক গুণাবলী রয়েছে, তারা একটি জীবকে আক্রান্ত করে জৈবিক সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এই কারণে এই সিদ্ধান্ত দানা বাঁধল ভাইরাস হচ্ছে জিন (gene) বা গঠন সংকেত ধারণকারী জীবজগতের সবচেয়ে সরল রূপ। নয়াকৃষির জন্য এগুলো ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক তর্ক।

কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের এ ধারণাও বেশীদিন টিঁকল না। এরপর তাঁরা দাবি করলেন এটা এক ধরণের জৈবিক রাসায়নিক পদার্থ। কিন্তু ‘জৈবিক রাসায়নিক পদার্থ’ মানে কি? এটা কি সপ্রাণ? জীবমূলক? বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, না এটা প্রাণ নয়, জীবও নয়। তাহলে কী?

তখন ১৯৩৫ সালের দিকে নিউ ইইয়র্কের রকফেলার ইউনিভার্সেটিতে ওয়েন্ডেল স্টেনলি (Wendell M. Stanley) প্রথম বারের মতো তামাকের ‘মোসাইক ভাইরাস’ (mosaic virus) স্ফটিকের মতো দানা পাকিয়ে ফেলতে পারলেন। তাঁরা দেখলেন সেটি একটি জটিল রাসায়নিক পদার্থ। কিন্তু জীবে যে জৈবিক বিপাক বা জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া (metabolism) দেখা যায়, এদের মধ্যে সেই ব্যবস্থা নাই। ওয়েন্ডেল স্টেনলি ১৯৪৬ সালে তাঁর কাজের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন, কিন্তু শরীরবৃত্ত বা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নয়, রসায়ন শাস্ত্রে।

এরপর স্টেনলি এবং আরও অনেকের গবেষণা দাবি করল যে ভাইরাস DNA বা RNA দিয়ে গঠিত। একপ্রকার আমিষ পদার্থের চাদর দিয়ে ঘেরা, যার মধ্যে ভাইরাসের যে জিনিস সংক্রমণ ঘটায় সেই আমিষবস্তুও রয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক তথ্য এটাই প্রতিষ্ঠা করল যে ভাইরাসকে জীব বা অণুজীব বলার চেয়ে একপ্রকার রাসায়নিক জৈবপদার্থ গণ্য করাই সঠিক। কিন্তু ভাইরাস যখন কোন সেল বা জীবকোষের আশ্রয় পায়, তখন তার চারপাশের চাদর বা আস্তরণ ভেদ করে তার মধ্যে লুকানো জিন বা গঠন সংকেত দিয়ে আশ্রয়দানকারী কোষের পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া সচল করে তোলে এবং ভাইরাসের গঠন সংকেত অনুযায়ী আরও ভাইরাস জাতীয় প্রোটিন তৈরি করে। ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষমতা এই বিশেষ চরিত্রের জন্য।

তাহলে ভাইরাস হচ্ছে, নতুন ভাষ্য অনুযায়ী, জীব নয়, কিন্তু এক ধরণের আমিষ পদার্থ। জীব না, কারণ তারা নিজেদের নিজেরা উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হোল কোন জ্যান্ত জীব বা অণুজীব পেলে ভাইরাস সেই আশ্রয়কে নিজের মতো ব্যবহার করতে পারে, তারা আশ্রয়ের জীবকোষে পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয় এবং নিজেদের পুনরুৎপাদনেও সক্ষম হয়ে ওঠে। ভাইরাস সম্পর্কে এই নতুন ধারনা জীব বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিবর্তন সংক্রান্ত তত্ত্বের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে দর্শনের জন্যও। কেন?

কারন অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন জায়গাটা কিন্তু আরও ঝাপ্সা হয়ে গেল। বিজ্ঞানীদের এখনকার ব্যাখ্যা অনুযায়ী ভাইরাস হচ্ছে অজৈব ও জৈব প্রকৃতির মাঝখানের এক প্রকার পদার্থ, যাকে জীব যেমন বলা যায় না, তেমনি বস্তু বা অজীবও বলা যাচ্ছে না। ভাইরাস এক প্রকার প্রোটিন, এক প্রকার আমিষ পদার্থ।

সে যাই হোক বিজ্ঞানীরা এখন মানতে বাধ্য যে জীবনের বিবর্তন কিম্বা জীবের ইতিহাসে ভাইরাস খুবই নির্ধারক ও গুরুত্বপূর্ণ একটি পদার্থ, যা জীব ও অজীবের সন্ধিস্থল কিম্বা জৈবিক ও অজৈবিক পরিমণ্ডলের মাঝখানে আরেকটি নতুন পরিমণ্ডল। আধুনিক কালে এই পরিমণ্ডল আরও দৃশ্যমান। একই সঙ্গে আধিপত্য বিস্তারের জন্য বৈজ্জানিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা।

তাহলে আমরা বুঝলাম ভাইরাস কোন জীব বা অণুজীব নয়। ভাইরাস একপ্রকার অতি ক্ষুদ্র আমিষ পদার্থ যা এক প্রকার চর্বি দিয়ে আবৃত। বৈজ্ঞানিকরা আমিষ পদার্থের নাম দিয়েছেন ডি-এন-এ (Deoxyribonucleic acid)। কিন্তু যখন ভাইরাস আমাদের চোখে, নাকে কিম্বা মুখের নরম ত্বকে ঢুকে পড়ে, তারা আমাদের আক্রান্ত জীবকোষের জেনেটিক কোড বা গঠন সংকেত বদলে ফেলে। একে বলা হয় গাঠনিক রূপান্তর (mutation)। এই বদলে ফেলা জীবকোষ তখন পরিণত হয় আক্রমণকারী হিশাবে এবং আরও জীবকোষ বানাবার কোষে পরিণত হয়।

এখন ভাবুন। ভাইরাস যেহেতু জীব না, তাই তার মৃত্যু নাই। কারণ জীব হলে মৃত্যু হয়, জীব না হলে ভাইরাস মরবে কেন? কিন্তু ভাইরাস নিজের মতোই বিলীন হয়। তার বিলীন হবার সময় নির্ভর করে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা আর যেখানে সে আশ্রয় নিয়েছে বা পেয়েছে সেই আশ্রয় স্থানের ওপর। তাই মানুষের দেহে একরকম, অন্যদিকে কার্ডবোর্ডে, লোহা, ইস্পাত, পাথর, কাঠ বা প্লাস্টিক ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রকম।

কিন্তু এই ভাইরাস আসলে খুবই ভঙ্গুর। এর চারদিকে হাল্কা চর্বির আস্তরণই একে রক্ষা করে। আস্তরণ শুকিয়ে গেলে বা নষ্ট হলে এই আমিষ পদার্থেরও বিনাশ ঘটে। এই জন্যই এর হাত থেকে মুক্ত থাকার জন্য ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে কমপক্ষে ভাল করে বিশ সেকেণ্ড ধরে দুই হাত কতক্ষণ পর পর আঙুলের ফাঁক ধরে ধরে ঘষে ঘষে ধোয়া কোভিড-১৯-এর হাত থেকে বাঁচবার প্রধান উপায়। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এর বাইরের চর্বির আস্তরন নষ্ট করে দেওয়া যাতে ভাইরাস নিজে নিজে দ্রুত বিলীন হয়ে যেতে পারে।

তাপমাত্রার দিক থেকে ভাবুন। ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে চর্বির আস্তরণ গলে যায়। এই জন্য বলা হয় গরম আসলে এই ভাইরাস থাকবে না। এই তথ্যের ভিত্তিতে অনেকে দাবি করছেন এপ্রিলের গরমে এই ভাইরাস থাকবে না। বৈজ্ঞানিক তথ্য হিশাবে ভাইরাসে গরমে চর্বি গললেও গরম এলেই করোনা-১৯ মহামারী শুকিয়ে মবে তার কোন ভিত্তি নাই। এর কারন হচ্ছে গরম সবজায়গায় সমান ভাবে পড়বে না। কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে ইতিমধ্যেই যারা আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু তাদের কোন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না, তারা কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়াতে থাকবেন। ঘনবসতির বাংলাদেশের জন্য এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর বিপদের জায়গা। এই জন্য শুরু থেকেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা দাবি করছিল যে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হছে টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট’ – অর্থাৎ সংক্রমন আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা, সংক্রমিতদের আলাদা করা। পস্পরের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলা এবং কঠোর ভাবে সঙ্গরোধ ছাড়া কোভিড-১৯ থেকে মুক্তির কোন উপায় নাই।

এলকোহল দিয়ে স্যানিটাইজার বানাবার কথাও এই চর্বি গলানোর জন্য ব্যবহারের জন্য বলা হচ্ছে। তবে এলকোহল কিম্বা যে কোন স্যানিটাইজার যেখানে শতকরা পরিমাণ ৬৫% এলকোহল আছে তা দিয়ে হাত ঘসলে ভাইরাসের বাইরের চর্বির আস্তরণ নষ্ট করা যায়। কোন তরল পদার্থে একভাগ ব্লিচের সঙ্গে ৫ ভাগ পানি মিশিয়ে তা দিয়ে ভাইরাসের চর্বির আস্তরণ গলিয়ে ফেলা যায়।

নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই সাধারণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানটুকু আমাদের অবশ্যই দরকার।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।