ক্লারা জেৎকিন ও আন্তর্জাতিক নারী দিবস


জার্মানির কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেৎকিনের  (৫ জুলাই ১৮৫৭ -- ২০ জুলাই ১৯৩৩) প্রস্তাবে মার্চের ৮ তারিখ 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস' হিসেবে ১৯১১ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে। এটির শুরু আদিতে 'আন্তর্জাতিক নারী শ্রমিক দিবস' হিশাবে। এর পেছনে রয়েছে শতাব্দি জুড়ে শ্রমিক আন্দোলন এবং নারীপুরুষ নির্বিশেষে পুঁজির শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবার অদম্য তাগিদ। তিনি প্রধানত নারীবাদী হিশাবে এখন অধিক পরিচিত, কিন্তু ক্লারা জেৎকিন ইউরোপে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন।  তিনি ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, রুশ বিপ্লবে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। লেনিনের সঙ্গে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের জন্য তিনি খ্যাত। কমিউনিস্ট আন্দোলনে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের কারণে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আদর্শ ও রাজনীতিতে ক্লারার অবদানকে উপেক্ষা করবার জন্য অনেক সময় তাঁর নারীবাদী চিন্তাকে বিশেষ ভাবে সামনে নিয়ে আসা হয়। শুধু তাই নয় হিটলার, ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ও শক্তিশালী অবস্থানকেও আজ খুব কমই নারীবাদীরা মনে রেখেছে। কিন্তু ক্লারা শিখিয়েছে ফ্যসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরোধিতা নারীর মুক্তির আন্দোলনের অন্তর্গত বিষয়। বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবং বিশেষ ভাবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভূমিকা এখন সবচেয়ে বেশী প্রাসঙ্গিক।


clara_internet

জনসভায়  ভাষণ দিচ্ছেন ক্লারা জেৎকিন


'আন্তর্জাতিক নারী শ্রমিক দিবস'  দিনটির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ১৯১০ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে। প্রায় ১১০ বছর পার করে এলেও ১৯১০ সালে ঘোষিত দিবসটির মূল যে বক্তব্য সেটা অর্জন সম্ভব হয় নি। মূল বক্তব্য ছিল শ্রমজীবি নারীদের অধিকার অর্জন করা এবং নারীর সার্বজনীন ভোটের অধিকার পাওয়া।

একথা পরিষ্কার থাকা দরকার যে কমিউনিস্ট পার্টির একজন গুরুত্বপুর্ণ নেত্রী হিশেবেই ক্লারা জেৎকিন 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস' ঘোষণা দিয়েছিলেন, কোন নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট অবস্থান থেকে নয়। এই ঘোষণা তিনি চেয়েছিলেন সুনির্দিষ্ট ভাবে শ্রমিক নারীর দাবী দাওয়া পুরণের জন্য। কারণ ক্লারা মনে করতেন সেই সময়ের ফেমিনিজম শ্রেণী চরিত্রের দিক থেকে শ্রমিক নারীর বিপরীতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের স্বার্থ রক্ষার মতাদর্শ। এখনও ফেমিনিজম বা নারীবাদ শহুরে মধ্যবিত্তদের গণ্ডি, তাদের চাওয়া-পাওয়া এবং নারীর অধিকারের প্রশ্নে তাদের নিজ শ্রেণীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যেই রয়ে গেছে, যা সাধারণ নারী -বিশেষ করে শ্রমিক নারীর জীবন ও জগতের যেমন প্রতিনিধিত্ব করে না, তেমনি তাদের স্বার্থের সাথেও অধিকাংশ সময় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাদের কাছে অভিজাত মতাদর্শ পৌঁছাতেও পারে না। ক্লারার আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলিট বা অভিজাত নারীদের জন্যে ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস ১৯০৯ সালে পালিত হয়েছে সেখানকার সোশালিস্ট পার্টি, বস্ত্র কারখানার শ্রমিকের দাবী আদায়ের প্রশ্নে।

১৯১৭ সাল অবধি ক্লারা জেৎকিন জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে সক্রিয় ছিলেন। তারপর তিনি জার্মানির ইন্ডিপেন্ডেন্ট সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (ইউএসপিডি) এবং আরও র‍্যাডিকাল 'স্পার্টাসিস্ট লীগ'- এ যোগ দিয়েছিলেন। পরে এটি জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টিতে (কেপিডি) রূপান্তরিত হয়।  তিনি ১৯২০ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ভাইমার রিপাবলিক চলাকালীন রাইখস্ট্যাগে পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

বৈপ্লবিক সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাংখা  ছাড়াও ক্লারা মেয়েদের জন্য সমান সুযোগ এবং নারীর ভোটাধিকারের লড়াইয়ে সবিশেষ সক্রিয় ছিলেন। তাই যুগপৎ কমিউনিস্ট ও নারীর মুক্তির প্রশ্নে তাঁর নাম ইতিহাসের সামনে চলে আসে। নারী প্রশ্নকে তিনি বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। জার্মানিতে সামাজিক-গণতান্ত্রিক মহিলা আন্দোলন বিকাশে তাঁর ভুমিকা সুবিদিত। ১৮৯১ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এসপিডি মহিলা সংবাদপত্র Die Gleichheit[a] (সমতা) সম্পাদনা করেছিলেন। ১৯০৭ সালে ক্লারা জর্মন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এসপিডিতে নতুন প্রতিষ্ঠিত ‘মহিলা অফিস’ এর নেতা হন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতির জন্য লড়াই ক্লারার সামগ্রিক রাজনৈতিক সংকল্প ও বিশ্বাস থেকে আলাদা কিছু না। ১৯১০ সালের আগস্টে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সমাজতান্ত্রিক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সাধারণ সভা হওয়ার আগে একটি আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। আমেরিকান সমাজতান্ত্রিকদের ক্রিয়াকলাপের অনুপ্রাণিত হয়ে ক্লারা জেৎকিন, কেট ডানকার এবং আরো অনেকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে সেই সম্মেলনে কোনও তারিখ নির্দিষ্ট করা না হলেও, বার্ষিক "একটি বিশেষ নারী দিবস" আয়োজন করা উচিত। সতেরোটি দেশ থেকে আসা নারী প্রতিনিধিরা নারীদের ভোটাধিকারসহ সম-অধিকারের দাবি প্রচারের কৌশল হিসাবে এই ধারণা সমর্থন করেছিলেন। পরের বছর ১৯ ই মার্চ ১৯১১-এ প্রথমবারের মতো অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডের দশ মিলিয়ন মানুষ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিশাবে একটি দিন চিহ্নিত করেছিলেন।

তবে ক্লারা জেৎকিন ঘোরতর ভাবে "বুর্জোয়া নারীবাদ" (bourgeois feminism) বিরোধী ছিলেন। যেসব শহুরে অভিজাত মহিলারা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মেহনতি নারীদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার সংগ্রাম আড়াল ও অদৃশ্য করে দিয়ে তাদের শ্রেণী স্বার্থে শুধু ধনী, অভিজাত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত নারীদের কামনা বাসনা আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা প্রধান করে তোলে, তাদের মতাদর্শই বুর্জোয়া ফ্যামিনিজম নামে পরিচিত। বিভিন্ন দেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর আবির্ভাবের এবং চিন্তাচেতনার রকম ফের আছে। ফলে বুর্জোয়া ফ্যামিনিজমের নানান রূপ আছে। নারীবাদ পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ক্ষমতার অবসান চায়। কিন্তু পুরুষতন্ত্র  স্রেফ বায়লজিকাল বা দৈহিক নয়, কারন পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা উৎপাদন বা আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে রূপ পরিগ্রহণ করে। অতএব শ্রমিক নারীর জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম থেকে পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ক্ষমতা উচ্ছেদের আন্দোলনকে আলাদা করা যায় না। নারীবাদের যে ধারা এই বিভক্তি ঘটায় তারা মূলত বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থ এবং পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কই টিকিয়ে রাখে। ক্লারা জেৎকিন মনে করতেন এতে শ্রমজীবী জনগণের লড়াই নারী পুরুষ বিভেদের নামে বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের সম্ভাবনা ব্যাহত হবে। কিন্তু তাই বলে নারীর প্রশ্নকে উপেক্ষা বা গৌণ করা যাবে না। নারীর স্বার্থ পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই অর্জন করতে হবে, শ্রমিক আন্দোলনকে বিভক্ত করে সেটা হবে না। করা হলে তার  কুফল ভোগ করবে শ্রমিক নারী। ১৮৯৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিককে দেওয়া একটি ভাষণে ক্লারা জেৎকিন বলেছিলেন:

“শ্রমজীবী মহিলারা, যারা সামাজিক সাম্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষা করেন, তারা বুর্জোয়া মহিলাদের আন্দোলন থেকে মুক্তির কিছুই প্রত্যাশা করেন না, যদিও তারা দাবি করে তারা নারীর অধিকারের পক্ষে লড়াই করে। তাদের বকোয়াজির প্রাসাদ বালির উপর তৈয়ারি এবং এর আসলে কোন ভিত্তিও নাই। শ্রমজীবী মহিলারা একদমই নিশ্চিত যে মহিলাদের মুক্তির প্রশ্ন মোটেও কোন একটি বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন নয়, যা স্বয়ং নিজের সমাধান নিজে দিতে সম্ভব।। বরং নারী প্রশ্ন আরও বৃহৎ পরিসরে তোলা সামাজিক জিজ্ঞাসার মধ্যে হাজির থাকে। মেহনতজীবী নারী সাফ সাফ বুঝতে পারে এই প্রশ্নটি সম্পূর্ণ সামাজিক রূপান্তর ছাড়া বর্তমানের বিদ্যমান সমাজে কখনই সমাধান করা যায় না"। [১]

নারীকে জাতপাত, শ্রেণী, বর্ণ, জাতি ইত্যাদি থেকে কৃত্রিম ভাবে আলাদা করে বিমূর্ত ‘নারী’ বর্গ দিয়ে বোঝার বিপদ ক্লারা জেৎকিন এবং আরও অনেক সংগ্রামী নারী পরিষ্কার বুঝেছিলেন। ক্লারা মনে করতেন একমাত্র সমাজতন্ত্রই – অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের উচ্ছেদ নারী মুক্তির আর্থ-সামাজিক শর্ত তৈরি করতে পারে। সমাজতন্ত্র এলেই পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্ক বা ক্ষমতার বিলয় ঘটবে, সেটা ক্লারা দাবি করেন নি। কিন্তু বিলয়ের জন্য যে আর্থ-সামাজিক শর্ত থাকা দরকার তা আদায় করা যাবে। নারী আন্দোলনের মধ্যে এই তর্কটা এখনও জারি রয়েছে।

নারীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের সকল কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারা, নিজের অবস্থার উন্নতি নিজে করতে পারা, ট্রেড ইউনিয়ন এবং অন্যান্য শ্রমিক অধিকার সংস্থায় অংশ নেওয়া ইত্যাদিকে ক্লারা জেৎকিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ক্ষমতা চর্চার উচ্ছেদ জরুরী। আন্দলনের অভ্যন্তর থেকেই সংস্কার অর্জনের জন্য লড়াই করা উচিত যা নারী নির্যাতন কমিয়ে দেবে।

জার্মান রিখস্ট্যাগের সদস্য হিশাবে ক্লারা জেৎকিনের সর্বশেষ প্রকাশ্য উপস্থিতি ছিল নাটকীয় এবং ফ্যাসিস্ট বিরোধী। উদ্বোধনের সময় হিটলার এবং তার নাৎসি পার্টি রাষ্ট্রপতি হিনডেনবার্গের সহায়তায় রিখস্ট্যাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের চেষ্টা করেছিল। ক্লারা ছিলেন রিখস্ট্যাগের সিনিয়র সদস্য। সিনিয়র সদস্য হিশাবে ঐতিহ্য অনুসাহিসাবে, ক্লারা জেৎকিন ৩০ আগস্ট, 1932 তারিখে প্রথম অধিবেশন খোলার অধিকারী ছিলেন। নাৎসি সন্ত্রাস ততোদিনে দেশটিকে ঘিরে রেখেছে। কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দকে তীব্র আক্রমণ করা হচ্ছে। তাঁদের পলাতক থাকতে হচ্ছে। কিন্তু ক্লারা জেৎকিন লুকানো অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নাটকীয়ভাবে রোস্ট্রামে উপস্তিত হয়ে এক ঘন্টা ধরে চলমান ভাষণে ফ্যাসিবাদকে তীব্র নিন্দা জানান এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানান।

১৯৩২ সালের আগস্টে, মস্কোতে ক্লারা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তারপরও রিখসস্ট্যাগের উদ্বোধনে সভাপতিত্ব করতে বার্লিন ফিরে এসেছিলেন। তার উদ্বোধনী বক্তব্য টি ছিল জ্বালাময়ী, ফ্যাসিবাদকে রুখবার জন্য ঐক্যফ্রন্টের প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি জোর দেন ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ক্লারা বলেনঃ

"সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাৎক্ষণিক কাজ হ'ল ফ্যাসিবাদকে রুখে দেবার জন্য সমস্ত শ্রমিকদের একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন... যেন জুলুম ও দাসত্বের অধীন থাকা সত্ত্বেও তাদের সংগঠনের শক্তি এবং  নিজেদের হিম্মত সংরক্ষণের পাশাপাশি নিজেরা জীব দেহে বেঁচে থাকতে পারে। এই অতি জরুরি এবং ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের উদ্যমহীন করে এবং বিভাজন প্রশ্রয় দেয় এমন কোন রাজনৈতিক, ট্রেড ইউনিয়ন, ধর্মীয় ও আদর্শিক মতামতকে অবশ্যই পিছনের আসন গিয়ে বসতে হবে। যারা নিজদের হুমকি্র মধ্যে আছেন মনে করেন, যারা ক্ষতিগ্রস্থ  এবং যারা মুক্তির জন্য আগ্রহী তাদের অবশ্যই ফ্যাসিবাদ এবং সরকারের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে"।

ক্লারা এবং তাঁর সমকালীন ফেমিনিস্টরা, ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজম (উনিশ এবং বিংশ শতাব্দি) নারী আন্দোলনের কাছে পরিচিত। নারীর লড়াই ইতিহাসের অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে। এখন শুধু শিল্প কারখনায় নয়, পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণের সংরক্ষণ ও বৈচিত্র রক্ষার লড়াইয়ে নারী আন্দোলন সামনের কাতারে চলে এসেছে। এছাড়া রয়েছে বিজ্ঞান ও টেকনলজির প্রশ্ন।

ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজম  মূলত নারীর ভোটের অধিকারের দাবী এবং নারী-পুরুষের অসম অবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন। রাজনীতি এবং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল; সেখানে নারীর কোন অংশগ্রহণ কল্পনাও করা হোত না। নারী কার্যত পুরুষের সম্পত্তির অধিক কিছু ছিল না। ভোটের অধিকারের দাবী ক্লারা এবং সমাজতান্ত্রিক নেত্রীদেরও ছিল। ক্লারার ঘোষণার পর সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে ৮ মার্চ নারীদের বিশেষ দিন হিশেবে পালিত হোত। দীর্ঘ  প্রায় ৫০ বছর পর ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ ফেমিনিস্টরা ১৯৬৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করতে শুরু করে। এই সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম (১৯৬০ থেকে ১৯৮০ এর দশক) নারীর প্রতি বৈষম্য, অসম মুজুরি, অসম আইনী অধিকার ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ধারণা তারাও গ্রহণ করেছিল নারীর প্রতি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দুর করা এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে।   

জাতিসংঘ দিবসটিকে ১৯৭৭ সালে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে বর্তমানে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। কিন্তু পুরানা ইতিহাস ও আন্দোলনের মর্ম থেকে অনেকটাই বিচ্যূত হয়ে। এই স্বীকৃতির পেছনে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর মূলধারার ফেমিনিস্টদের ভুমিকা আছে। দিবসটির সাথে ক্লারা জেৎকিনের ঘোষিত দিবসের যে কারণ ছিল, তার সাথে মিল রেখে করা হয় নি। বছরের এই তারিখটি নারীদের জন্যে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়ে গেছে, সেই ধারাবাহিকতাই শুধু রক্ষা করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ পালিত হয়েছিল, এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী দশক ঘোষিত হয়। তারই একটি অংশ হিশেবে ১৯৭৭ সালে নারী অধিকার এবং বিশ্ব শান্তির জন্যে মার্চের ৮ তারিখ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করার ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে পালিত হয়। নারীর অধিকার আদায়ের প্রশ্ন আন্দোলন-সংগ্রামের রাজপথ ছেড়ে সরকারী ভাবে সরকারি দিবস পালনে গিয়ে ঠেকেছে।

এখন জাতিসংঘ থেকেই নির্ধারণ করে দেয়া হয় কোন বছর কি বিষয় নিয়ে দিবসটি পালন করা হবে এবং সেভাবেই প্রতিটি সদস্য দেশের সরকার, এনজিও এবং নারী সংগঠন গুলো তাদের কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করেন।  কেউ উৎসব মুখর হয়ে ওঠেন, কেউ আলোচনা করেন, কেউ সংগ্রামের কথা বলেন। আগে বেগুনি সংগ্রামের রংটাই ব্যবহার হোত, এখন তার সাথে শান্তির রং সাদা জুড়ে দেয়া হয়েছে। নারীরা অবশ্যই শান্তি চায়, কিন্তু সংগ্রামের পথ সব সময় শান্তিময় নাও হতে পারে।

ক্লারা জেৎকিনের আন্তর্জাতিক নারী দিবস যে আদতে শ্রমিক নারীর অধিকার আদায়ের জন্য, একথা বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা দীর্ঘদিন জানতেনই না। নারী সংগঠনগুলোও  নারী শ্রমিকদের নিয়ে একত্রে কোন কাজও করে নি। তবে ১৯৯০ এর দিকে বিষয়টি নজরে আনা হয়; এর মধ্যে নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার কাজ উল্লেখযোগ্য। তারা গার্মেণ্ট শ্রমিক এবং শ্রমজীবি নারীদের বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করতে শুরু করে। গার্মেন্ট শ্রমিক সংগঠন গুলোও দিনটি পালন করে তাদের দাবী নিয়ে। এ ছাড়া বাম জোটের নারী সংগঠনগুলও এ বিষয়ে সোচ্চার হতে থাকে। তবে বেশি উৎসব মূখর হতে গিয়ে অনেক এনজিও এবং এলিট শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী নারী সংগঠন নারীবাদী ‘আধুনিক’ চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটানো শুরু করে, যার সাথে সাধারণ নারীদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের বিষয় বাদ পড়ে যায়। বাংলাদেশে নারীকে তার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তা হিশাবে না দেখে স্রেফ বায়লজি হিশাবে দেখার প্রবণতাও শুরু হয়।

বৈপ্লবিক সমাজতান্ত্রিকে রূপান্তরের আকাংখা ছাড়াও জেৎকিন মেয়েদের জন্য সমান সুযোগ এবং নারীর ভোটাধিকারের লড়াইয়ে সবিশেষ সক্রিয় ছিলেন। তাই যুগপৎ কমিউনিস্ট ও নারীর মুক্তির প্রশ্নে ইতিহাসে তাঁর নাম সামনে চলে আসে। নারী প্রশ্নকে তিনি বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। জার্মানিতে সামাজিক-গণতান্ত্রিক মহিলা আন্দোলন বিকাশে তাঁর ভুমিকা সুবিদিত। ১৮৯১ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এসপিডি মহিলা সংবাদপত্র Die Gleichheit[a] (সমতা) সম্পাদনা করেছিলেন। ১৯০৭ সালে তিনি জর্মন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এসপিডিতে নতুন প্রতিষ্ঠিত ‘মহিলা অফিস’ এর নেতা হন। আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসএর স্বীকৃতির জন্য লড়াই ক্লারার সামগ্রিক রাজনৈতিক সংকল্প ও বিশ্বাস থেকে আলাদা কিছু না। ১৯১০ সালের আগস্টে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সমাজতান্ত্রিক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সাধারণ সভা হওয়ার আগে একটি আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। আমেরিকান সমাজতান্ত্রিকদের ক্রিয়াকলাপের অনুপ্রাণিত হয়ে ক্লারা জেৎকিন, কেট ডানকার এবং আরো অনেকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে সেই সম্মেলনে কোনও তারিখ নির্দিষ্ট করা না হলেও, বার্ষিক "একটি বিশেষ মহিলা দিবস" আয়োজন করা উচিত। সতেরোটি দেশ থেকে আসা নারী প্রতিনিধিরা নারীদের ভোটাধিকারসহ সম-অধিকারের দাবি প্রচারের কৌশল হিসাবে এই ধারণা সমর্থন করেছিলেন। পরের বছর ১৯ ই মার্চ ১৯১১-এ  অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডের দশ মিলিয়ন মানুষ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস হিশাবে একটি দিনকে চিহ্নিত করেছিলেন।

ফেমিনিজমের থার্ড এবং ফোর্থ ওয়েভও আছে। তারা এখন বর্ণবাদ ও শ্রেণী শোষণ বিরোধিতা, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন তুলছেন। তারা স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দেয়ার পক্ষে নয়। তারা ইনক্লুসিভ, সাদা-কালো সব বর্ণের নারীদের অধিকারের কথা বলেন। সমস্যা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। যেমন এখন যৌন হয়রানী, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি আন্দোলন হচ্ছে।

কিন্তু ফেমিনিজমের ধারার বাইরে আরও কিছু ঘটনা ঘটছে। যেমন কর্পোরেশনগুলো বুঝেছে নারীদের মধ্যে তাদের বিশাল বাজার এবং মুনাফার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাদের “গোলাপী” বা হাল্কা বেগুনি কোম্পানি শুভেচ্ছায় পত্র-পত্রিকা ভরে যায়। তারা এলিট নারীদের বিশাল বেতনে চাকুরি দিয়ে নারীর উপকার করছেন, এমন কথা প্রমান করতে চায়, যদিও তাদের যে পণ্য তা নারীদের জন্যেই ক্ষতিকর হতে পারে। তারা প্রচার করে যে বিশেষ হরলিক্স খেলে নারীদের নেতৃত্ব  দেয়ার ক্ষমতা বাড়ে, বিশেষ ক্রিম মুখে মাখলে নারীর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে, ক্যারিয়ারে উন্নতি হবে। এগুলোকে 'কর্পোরেট ফেমিনিজম' হিশেবে আখ্যায়িত করা যায়। 


NGP

কৃষি, খাদ্য ব্যবস্থা এবং ক্ষতিকর টেকনলজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে একালে নারীর গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।


এটা মোটেও আশ্চর্য হবার বিষয় নয় যে ১৯১০ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত পরিবর্তন বিস্তর হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন অনেক ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নারীর সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের দিক থেকে দিবসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্ব বুঝতে হলে ক্লারা জেৎকিন কেন দিবসটিকে শ্রমিক নারীর দিবস হিশাবে পালন করতে চেয়েছেন সেটা ভালভাবে বুঝতে হবে। সেটা হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীকে সংগঠিত করা এবং নারীর স্বতন্ত্র সত্তার স্বীকৃতি আদায় করার পাশাপাশি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পুরুষদের লড়াইয়ে সমান্তরালে শামিল থাকা। প্রচলিত বামপন্থার মধ্যে যে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য কাজ করে তাকে নস্যাৎ করে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কে বিরুদ্ধে কার্যকর ও বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা।

সময় এসেছে ক্লারার নারী দিবসের তাৎপর্য নতুন ভাবে উপলব্ধি এবং নারী আন্দোলনের অন্তর্গত বিষয় হিশাবে শ্রমিক নারীর লড়াইকে কাজে খাটানো। শ্রমজীবি নারীর পরিপ্রেক্ষিত থেকে সাধারণ নারীদের স্বার্থ – অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে নারীর অধিকার আদায়ের লড়াইকে শক্তিশালী করা।

এটাই একালে আমাদের কাজ।

গ্রন্থসূত্র

[১] (Gaido, Daniel; Frencia, Cintia (2018). ""A Clean Break": Clara Zetkin, the Socialist Women's Movement, and Feminism". International Critical Thought. 8 (2): 277–303.

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।