কোরবানি: বাইবেলে ও কোরানে
কোরআনের হিকমত ও প্রজ্ঞা অন্বেষণ সাধারণ কাজ না। তার জন্য সবার আগে দরকার আল্লার ওহি হিসাবে কোরআন ঠিক যেভাবে নাজিল হয়েছে ঠিক সেভাবেই তাকে পাঠ করা। কোরআন নিয়ে অতীতে অনেক তাফসির ও অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার ইহুদি- খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব এবং গ্রিকচিন্তার মিশ্রণে যে ধর্মতাত্ত্বিক, জ্ঞানগত, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে তার আধিপত্য থেকে আমরা মুক্ত হতে পারছি না। তাহলে প্রথম কাজ ইহুদি–খ্রিস্টিয় চিন্তার আধিপত্য থেকে আমাদের মুক্ত হওয়া।
সম্প্রতি ফরহাদ মজহার তাঁর একটি ফেইসবুক পোস্টে তার পথ কি হতে পারে সেই আলোচনা তুলেছেন (এখন চিন্তা পত্রিকায় দেখুন)। তিনি বলেছেন এই পথ খোলাসা জন্য খুব শুরুতেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে। সেই অতি প্রাথমিক কাজ হোল, কোরআনুল কারিম ঠিক যেভাবে আল্লার তরফ থেকে রাসুলে কারিম সা. এর কাছে নাজিল হয়েছে, ঠিক সেভাবে পড়ার রীতি ও অভ্যাস আমাদের গড়ে তোলা। কোন ভাবেই কোরআন ‘ওহি’ হিসাবে যা নাজিল হয়েছে ঠিক সেভাবে পড়বার ক্ষেত্রে তাফসিরকে আগেই সামনে আনা উচিত নয়।
বলা বাহুল্য ইসলামি ঐতিহ্যে তাফসির গুরুত্বপূর্ণ। ফরহাদ মজহার সেই গুরুত্বকে অস্বীকার করেন না। কিন্তু তাফসির বা মানুষের ব্যাখা-বিশ্লেষণের আগে সবচেয়ে বেশী জরুরী হোল ঐশী কালাম কোরআনুল কারিমের ওপর পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হওয়া এবং আস্থা রাখা। সেই আস্থা প্রমাণিত হয় যদি আল্লার ওহি যেভাবে নাজিল হয়েছে ঠিক সেভাবে আমরা পড়ি এবং আমাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে চিন্তার ভুল, ঘাটতি ও অভাব আমরা শোধরানো শুরু করি।
ফরহাদ মজহার নজির দিয়ে দেখিয়েছেন, কিভাবে সুরা আস সাফফাতের কোরবানি সংক্রান্ত আয়াতগুলোকে আমরা বাইবেলের কাহিনীতে পর্যবসিত করেছি।
"সেটা করেছি সালাফে সালেহীনের দোহাই দিয়ে খোদ কোরআনের আয়াতকে যেমন আছে তেমন পাঠে বাধা তৈরি করে বা আল্লার কালামের ওপর খোদকারি করে। ইহুদি-খ্রিস্টিয় চিন্তা ও ভাবধারার আধিপত্য বজায় রাখার এটাই হচ্ছে প্রধান অস্ত্র।"
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? ফরহাদ মজহার বলছেন কোরআন ঠিক যে ভাষায়, যেভাবে নাজিল হয়েছে, সেভাবেই কোন 'বিকৃতি' ছাড়া পড়তে হবে।
যেমন আল্লাহ যদি বলে থাকেন,
“অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতা! আপনি যে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাই করুন। ইনশাল্লাহ, আপনি আমাকে সবুরকারী পাবেন।" (দেখুন সুরা আস-সাফফাত।। ৩৭: ১০২)। -- তাহলে কোরআনে যা আছে সেটাই আমাদের মানতে হবে। বাইবেলের কেচ্ছা প্রতিস্থাপন করা যাবে না।
ফরহাদ মজহার সুরা আস সাফফাত উদ্ধৃত করে বলেছেন: “মক্কায় অবতীর্ণ ‘সূরা আস-সাফফাত’-এ আপন সন্তানকে হত্যা ও কাঠের চিতায় বলীদানের 'আদেশ' বা 'নির্দেশ' নাই। সবার আগে কি নাই সেই দিকটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনুল কারিমে ইসমাইল নাকি ইসহাক কাকে কোরবানি দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কেও কোন স্পষ্ট উল্লেখ নাই”। তবে বলা বাহুল্য ইসমাইলকেই ইব্রাহিম (আঃ) কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন, এই ক্ষেত্রে তাফসিরকারকদের গবেষণা ও সিদ্ধান্তে ফরহাদ মজহার একদমই একমত। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনা বর্ণনার পর ইসহাকের সুসংবাদ দেবার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে্ন যে, সেই সময় ইসহাকের জন্মই হয় নি।
ফরহাদ মজহার সুরা আস সাফফাত উদ্ধৃত করে বলেছেন: “মক্কায় অবতীর্ণ ‘সূরা আস-সাফফাত’-এ আপন সন্তানকে হত্যা ও কাঠের চিতায় বলীদানের 'আদেশ' বা 'নির্দেশ' নাই। সবার আগে কি নাই সেই দিকটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনুল কারিমে ইসমাইল নাকি ইসহাক কাকে কোরবানি দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কেও কোন স্পষ্ট উল্লেখ নাই”। তবে বলা বাহুল্য ইসমাইলকেই ইব্রাহিম (আঃ) কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন, এই ক্ষেত্রে তাফসিরকারকদের গবেষণা ও সিদ্ধান্তে ফরহাদ মজহার একদমই একমত। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনা বর্ণনার পর ইসহাকের সুসংবাদ দেবার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে্ন যে, সেই সময় ইসহাকের জন্মই হয় নি।
কিন্তু ইফতেখার জামিল এবং তার মতো আরো অনেকে আছেন যারা কোরআনকে আল্লার ওহি হিসাবে ঠিক যেমন নাজিল হয়েছে তেমন ভাবে পাঠের বিরোধী। তারা তাই ফরহাদ মজহারের পোস্টে আপত্তি করছেন। এতে প্রশ্ন উঠেছে তারা ইসলাম ও কোরআন ব্যাখ্যায় ইহুদি-খ্রিস্টিয় ধারা বহাল রাখতে চান কিনা? সন্দেহ নিরসনের জন্যই আমরা এই আলোচনায় ব্রতী হয়েছি। আশা করি আমরা সুন্দর মীমাংসায় পৌঁছাব।
সেই ক্ষেত্রে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক সততা। অর্থাৎ ফরহাদ মজহার কিম্বা ইফতেখার জামিল যা বলেন নি, তা আমরা বলব না। তাদের বক্তব্যকেও বিকৃত করে উপস্থাপন করব না। কোন অনুমান ভিত্তিক মনগড়া কথাও বলব না। আরও গুরুত্বপূর্ণ হোল, অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে নিজের কথা আড়াল কিম্বা পাঠককে বিভ্রান্ত করব না। কারো উদ্দেশ্য নিয়ে কটাক্ষও আমাদের কোত্থাও নেবে না।
প্রশ্ন উঠেছে, কোরআনকে অবিকৃত ভাবে পাঠে অসুবিধা কোথায়? ফরহাদ মজহার কোরআন ঠিক যেমন ঠিক তেমন পাঠের একটা পদ্ধতি প্রস্তাব করেছেন। তিনি আল্লার ‘ওহি’ এবং মানুষের দ্বারা সেই ওহির ব্যাখ্যাকে আলাদা রাখবার ওপর যারপরনাই গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ইফতেখার জামিল সেই প্রশ্ন মোকাবিলা করেন নাই। অথচ যা আমাদের কমবেশী জানা তিনি সেই সব অপ্রাঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়ে আসল সওয়ালকে আড়াল করবার চেষ্টা করেছেন। ফলে কোরআন ঠিক যেমন আছে তেমনি পড়ার বিরুদ্ধে তিনি কোন যুক্তি খাড়া করতে পারেন নি।অথচ এটাই হচ্ছে মূল তর্কের বিষয়।
প্রশ্ন উঠেছে, কোরআনকে অবিকৃত ভাবে পাঠে অসুবিধা কোথায়? ফরহাদ মজহার কোরআন ঠিক যেমন ঠিক তেমন পাঠের একটা পদ্ধতি প্রস্তাব করেছেন। তিনি আল্লার ‘ওহি’ এবং মানুষের দ্বারা সেই ওহির ব্যাখ্যাকে আলাদা রাখবার ওপর যারপরনাই গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ইফতেখার জামিল সেই প্রশ্ন মোকাবিলা করেন নাই। অথচ যা আমাদের কমবেশী জানা তিনি সেই সব অপ্রাঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়ে আসল সওয়ালকে আড়াল করবার চেষ্টা করেছেন। ফলে কোরআন ঠিক যেমন আছে তেমনি পড়ার বিরুদ্ধে তিনি কোন যুক্তি খাড়া করতে পারেন নি।অথচ এটাই হচ্ছে মূল তর্কের বিষয়।
তাফসিরকারকদের কাঁড়ি কাঁড়ি উদ্ধৃতি ফরহাদ মজহারের প্রধান সওয়ালের উত্তর হয় না। বোঝা গেলো, কোরআন ঠিক যেভাবে এসেছে সেভাবে আল্লার ওহি হিসাবে পাঠ করতে ইফতেখার জামিল একমত নন। তাহলে কিভাবে পড়বো? অপরিচ্ছন্ন ও এলোমেলো ভাবে তিনি যা বলতে চান সেটা হোল, তাঁর ব্যাখ্যা বা তাফসিরকে কোরআনের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। তিনি আল্লার কালাম কোরআনকে তাফসিরের অধীনে আনতে চান, তাফসিরকে কোরআনের অধীনে না। অর্থাৎ সবার আগে কোরআনুল কারিম সঠিক ভাবে পাঠ তাঁর কাছে অপ্রয়োজনীয় বা গৌণ।
ইফতেখার জামিল তার নিজের ব্যাখ্যা বা তাফসিরকেই কোরআনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ায় আফসোস হয়, কারণ অনেক তরুণ তাঁর এই কোরআন বিরোধী অবস্থান ধরতে না পেরে তার দ্বারা বিভ্রান্ত হবে। তিনি দাবি করেছেন, “সূরা সাফফাতের একশো দুই থেকে সাত নাম্বার আয়াতে স্পষ্ট যে, ইবরাহিম (আঃ) স্বপ্নযোগে সন্তান কুরবানির জন্য নির্দেশিত হয়েছেন”। কিন্তু কই? এটা তো ইফতেখার জামিলের ব্যাখ্যা। কোরআনে ঠিক যেমন আছে তেমন পাঠ তো এইটা না। সেই আসল কাজ না করে ইফতেখার জামিল নিজের ব্যাখ্যাকে ‘আল্লার ওহি’ দাবি করছেন।
ফরহাদ মজহার সুস্পষ্ট ভাবে দেখিয়েছেন ইফতেখার জামিল যে ‘স্পষ্টতা’র দাবি করছেন, কোরআনে সূরা সাফফাতের একশো দুই থেকে সাত নাম্বার আয়াতে ইবরাহিম (আঃ) স্বপ্নযোগে সন্তান কুরবানির জন্য নির্দেশিত হয়েছেন এমন কোন কথা নাই। এটা ঠিক অতীতে আমাদের সম্মানিত মুফাসসিরিনদের অনেকেই এই ‘অর্থ’ করেছেন। তাতে অসুবিধা নাই। কিন্তু তাঁরা ‘ওহি’কে আলাদা রেখেছেন। তাছাড়া এই প্রশ্ন আগে ওঠে নি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের ওপর ইহুদি ও খ্রিস্টান বিশ্বাস ও চিন্তার আধিপত্য প্রবল। সেই আধিপত্য থেকে মুক্ত হবার জন্যই ফরহাদ মজহার এই প্রশ্ন নতুন ভাবে তুলেছেন। কিন্তু ইফতেখার জামিল যে ব্যাখ্যা দিলেন সেখানে ওহিতে কি আছে সেই আলোচনায় গেলেন না। এখন আমাদের তার ব্যাখ্যাই ‘ওহি’ গণ্য করতে হবে। প্রশ্ন যখন উঠেছে তখন আমরা বলেতে পারি না যে আমরা যা ব্যাখ্যা দিচ্ছি সেটাই কোরআনে আছে। না, জামিলের ব্যাখ্যা কোরআনুল কারিমে নাই। ‘ওহি’ এবং ওহির ব্যাখ্যা এক কথা নয়।
আল্লাহ স্বয়ং যদি নিজের কালামে বলে থাকেন নিজ সন্তানকে কোরবানি দেওয়া ছিল 'ইব্রাহিমের স্বপ্ন', আর তা শুনে সন্তান যদি তার পিতার স্বপ্নকে 'স্বপ্নাদেশ' গণ্য করে সেটাও সন্তানেরই বুঝ। আল্লাহ সেটা ইব্রাহিমের সন্তানের বরাতেই বলেছেন। নিজের বরাতে বলেন নি। বলেন নি যে এই স্বপ্নাদেশ আমিই দিয়েছে। এইগুলো খুবই গুরুতর বিষয়।
ইফতেখার জামিল আল্লার ওহি যেমন রয়েছে তেমন আমাদের শেখাতে রাজি না। তার নিজের ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিতে চাইছেন। নিজের ব্যাখ্যায়, কে কিভাবে এর তাফসির করেছেন সেটা তাদের যার যার নিজস্ব ব্যাপার। আর যেসব আলেম মনে করেন তাদের ব্যাখ্যাই কোরআনের ব্যাখ্যা অতএব 'স্বপ্ন'কে আমাদের 'আদেশ' হিসাবে পড়তে হবে – ফরহাদ মজহার এই অহংকারের বিরোধিতা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। অনেকে বুঝতে পারেন না সেটা আল্লার সঙ্গে খোদকারি হয়ে যায়। বড় জোর বলা যেতে পারে কোরআনে এভাবে নাই ঠিক, কিন্তু আমরা একে কোরবানির ‘আদেশ’ হিসাবে ব্যাখ্যা করছি। তাতে অসুবিধা নাই। এই বিষয়টির মীমাংসা হলে আল্লাহ কেন সরাসরি আদেশ করেন নি তা নিয়ে আলোচনার পথ খোলাসা হয়। কিন্তু ইফতেখার জামিল এবং তার অনুসারীরা সেই দিকে যেতে নারাজ। আল্লাহ কোরবানি দিতে ‘আদেশ’ করেছেন এই ব্যাখ্যার অনুমান ও পরিণতি ইহুদি ও খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব মেনে নেওয়া।
ফরহাদ মজহারের বক্তব্য হচ্ছে আল্লার ওহি হিসাবে কোরআন যদি একে 'ইব্রাহিম স্বপ্ন' দেখেছেন বলে থাকেন, তাহলে যে কোন মোমিনের উচিত তাকে 'ইব্রাহিমের স্বপ্ন' হিসাবেই পাঠ করা। সরাসরি ‘আদেশ’ না বলার গূঢ় ও গভীর তাৎপর্য আছে সেই আলোচনায় প্রবেশ করাই ফরহাদ মজহারের উদ্দেশ্য। কারণ বাইবেলের গল্প কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যে বর্তমানে যে ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ধারা গড়ে উঠেছে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রুহানি অবস্থান থেকে তিনি তা মোকাবিলা করতে চান। যদি ইব্রাহিমের সন্তান একে স্বপ্নাদেশ বলে থাকে, তাহলে ইব্রাহিমের সন্তান তার বাবার স্বপ্নকে যেভাবে বুঝেছে সেভাবেই আমাদের পড়তে হবে। আল্লাহ এই স্বপ্ন ইব্রাহিমকে দেখিয়েছেন কিন্তু নিজে বলেন নি আমিই এই স্বপ্ন ইব্রাহিমকে দেখিয়েছি। ইব্রাহিমের সন্তান পিতার স্বপ্নকে যেভাবে স্বপ্নে আদিষ্ট হওয়া বলেছেন, ঠিক সেভাবেই ইসমাইলের জবানি হিসাবে পড়তে হবে। একে আল্লার 'আদেশ' বানানো যাবে না। আমাদের ব্যাখ্যাকে কোরআনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া ঠিক না। ইফতিখার জামিল সেই কাজটিই করেছেন।
কোরআনুল করিম যেভাবে নাজিল হয়েছে সেভাবেই কেন পড়া উচিত? আমরা জানি এবং মানি কোন কিছুই আল্লার ইচ্ছা ছাড়া হয়না বা ঘটে না। তাহলে তিনি কোরআনে নিজে কোরবানিকে তাঁর 'আদেশ' কেন বললেন না? ঠিক ভাবে পাঠ করলে এই গুরুতর জিজ্ঞাসার গভীরে আমরা যেতে পারি। কোরআনের প্রতিটি আয়াত নিয়ে গভীরে যাওয়া অতীব জরুরী। আল্লার ওপর খোদকারি না করে কুরআনে যা আছে তেমন ভাবে পাঠ করলে বাইবেল ও কোরআনের গুরুতর পার্থক্যগুলোও আমাদের চোখে ধরা পড়বে। পার্থক্য নিরূপন করতে পারলেই তৌরাত, জবুর ও ইঞ্জিলের পরে কোরআন কেন নাজিল হয়েছিল– সেটা আমরা বুঝব। ইহুদি ও খ্রিস্টিয় চিন্তার আধিপত্য থেকে নিজদের মুক্ত রাখবার দিশা সঠিক ভাবে কোরআন পাঠের মধ্যে নিহিত রয়েছে বলে ফরহাদ মজহার মনে করেন।
ইফতেখার জামিল যখন বলেন “ইবরাহিম (আঃ) স্বপ্নযোগে পুত্রকে কুরবানি করার আদেশ পেয়েছেন, ফরহাদ এই কথাকে অস্বীকার করতে চান” – তখন ইফতেখার জামিল মিথ্যা বলেন। এটা তর্ক ও যুক্তিগ্রাহ্য মীমাংসার চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রপাগান্ডা। আরেকটি হাস্যকর ব্যাপার হোল, ‘স্বপ্নযোগে পুত্রকে কুরবানি করার আদেশ’ – এভাবে কোন বাক্য কোরআনে নাই। অতএব একে স্বীকার বা অস্বীকারের প্রশ্নই আসে না। এটা একান্তই ইফতেখার জামিলের ব্যাখ্যা। কোরআনের 'ওহি’ না। ইফতেখার জামিল এই ভূয়া অনুমান ও মিথ্যা দিয়ে আলোচনার নানান অংশ সাজিয়েছেন। এই পর্যন্ত তিনি তিন কিস্তি লিখেছেন কিন্তু আসল তর্কের কোন খবর নাই। খামাখা নানান জনের উদ্ধৃতিও সে কারণে অর্থহীন।
ইফতেখার সাহেবের চরম অসততা এবং আরো মারাত্মক ধরনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তি হোল, তিনি বলছেন, ‘ফরহাদের মজহারের কথায় বুঝা যায়, তিনি বলতে যাচ্ছেন ইবরাহিম (আঃ) এর ভুল স্বপ্নে ভ্রম-ভুল ব্যাখ্যা ঢুকে গেছে ইহুদী-খৃস্টান-ইসলাম ধর্মে।' ভাষা খেয়াল করুন। তিনি কি বুঝেছেন কে জানে!
তিনি আদতে মজহার সাহেবের লেখাটাই পড়েন নাই। কিম্বা পড়লেও জেনেশুনে মিথ্যাচার করছেন। ফরহাদ মজহার বোঝাতে চান কুরআনে ‘স্বপ্ন' এবং বাইবেলে ‘উপরি আদেশ'– এই দুইয়ের পার্থক্য বোঝার ওপর ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে ইসলামের মৌলিক ফারাক ধরা পড়ে। কিন্তু ইফতেখার জামিল ইহুদি-খ্রিস্টানদের ব্যাখ্যাকেই কোরআনের ব্যাখ্যা ধরে নিয়েছেন। এখানেই ফরহাদ মজহার আলাদা হয়ে যান। ইফতেখার জামিল ইহুদি ও খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব ও চিন্তা চেতনা ধারণ করেন এবং একেই তিনি ইসলাম দাবি করতে চান। সেটা তিনি পরিষ্কার স্বীকারও করেছেন।
তিনি বলেন, "কুরআন এবং বাইবেলে মিল আছে।" ফলে তিনি যেন মনে করেন, কোরআন আর বাইবেলের উদ্দেশ্য এবং তাৎপর্য সব একরকম। কোরআনের বলার পদ্ধতি এবং শৈলী বুঝার দরকার নাই। তিনি এই চেষ্টাও করে দেখেন নাই বা দেখান নাই। সেই ক্ষেত্রে ইফতেখার জামিল ও তার সমর্থকদের সম্পর্কে ফরহাদ মজহারের মূল্যায়নই সঠিক। ইহুদি ও খ্রিস্টিয় চিন্তার আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী করাটাই তাদের লেখালিখির নীতি বা পরিণতি। যেন 'উসুলুত তাফসির' এর নিয়ম কানুন কুরআন ব্যাখ্যার সহীশুদ্ধ মানদণ্ড, এজাযুল কুরআন, ইলমুল বয়ান, ইলমুল বালাগাত, ইলমুল ফাসাহাত, ইলমুল হুরুফ এবং মানতেক ফালসাফা হিকমত লাগবে না।
এটা স্পষ্ট কোরআন ও বাইবেলের পার্থক্য বোঝার প্রতি ইফতেখার জামিল এবং তার সমর্থকদের কোনো আগ্রহ নাই। অথচ স্বপ্ন কথাটি স্বপ্ন আকারে বোঝার গুরুত্ব এবং তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। কোরআনের এইধরনের ইশারা-ইঙ্গিত অনুধাবন করার নজির আমাদের ঐতিহ্যে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই বিদ্যমান। ফরহাদ মজহার এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হাত দিয়েছেন বলে, শুকরিয়া জানাই। ইহুদি-খ্রিস্টানদের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস থেকে কোরআনের তাফসির এবং ইসলামের ব্যাখ্যাজোখা সংরক্ষণ এবং পরিষ্কার করা আমাদের কর্তব্য।
ফরহাদ মজহারের উদ্দেশ্য এই সমস্যার ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক পর্যালোচনার ভিত্তি তৈরি করা। দার্শনিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দিক থেকে, যা একেবারেই শূন্যের ঘরে পড়ে আছে। বাংলাদেশে এ নিয়ে ধর্মতাত্ত্বিক কিম্বা দার্শনিক কোন অনুসন্ধান নাই বললেই চলে। কিন্তু ইফতিখার জামিলের উদ্দেশ্য আলোচনাকে প্রচলিত তাফসির অনুযায়ী ইসলামকে ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় সংকীর্ণ করে ফেলা হয়। এটাও পরিষ্কার ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে সমৃদ্ধ ও যৌক্তিক আলোচনার কোনো নজির দেখাতেও তিনি অক্ষম।
বাইবেলের বর্ণনা এবং কোরআনের বর্ণনা একাকার করে দেখার চেষ্টা এর আগে অনেকেই করেছেন। আহলে কিতাবদের প্রতি সদয় হয়েছেন অনেকেই। তাদেরকে দাওয়াত দেয়ার জন্যে অনেকেই বাইবেলের সাথে কোরআনের গল্প মিলাবার চেষ্টা করেছেন। সেই প্রবণতা ইফতিখার জামিলের মধ্যেও বিদ্যমান।
ইফতিখার জামিল বলছেন, ‘মূলত ফরহাদ মজহার এই অপব্যাখ্যায় প্রণোদিত হয়েছেন বিশেষ প্রেক্ষিতে। সেটি হচ্ছে কুরবানির প্রচলিত তফসিরে সন্তান হত্যার অনৈতিকতা আরোপিত হয়। তাতে মানুষ ‘মানবহত্যার বৈধতায় প্রণোদিত হয়”। অথচ এটা তার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে খাটে ফরহাদ মজহারের না। এই ‘অপব্যাখ্যা' কি তা দুনিয়ার কেউই জানে না এখনও। ইফতেখার জামিলের কাছে সবিনয় নিবেদন এই যে, সেই ‘গুপ্ত অপব্যাখ্যা’ এর দর্শন দানে ধন্য করুন। এই ‘অপব্যাখ্যা' ধরণের শব্দচয়নের প্রবণতা তৈরি হয় ভীতি থেকে। কিম্বা কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাকে গোড়াতেই নস্যাৎ করে দেবার বাসনা থেকে। ফরহাদ মজহারের অপব্যাখ্যাটা কি সেটা ইফতেখার জামিলের তিন তিনটা লেখা পড়ে বুঝতে পারলাম না।
যেটা বুঝতে পেরেছি তাদের আক্রোশ হচ্ছে ইসলাম নিয়ে আর কেউ কথা বলতে পারবে না। আমি মনে করি, এই হীনমন্যতা থেকে অনেক দেশের মুসলিম পণ্ডিতেরা মুক্ত। নিজেদের মধ্যে কথা বলার পথ তৈরি করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। এই কর্তব্য অবহেলার পরিণতি ভালো না।
যেটা বুঝতে পেরেছি তাদের আক্রোশ হচ্ছে ইসলাম নিয়ে আর কেউ কথা বলতে পারবে না। আমি মনে করি, এই হীনমন্যতা থেকে অনেক দেশের মুসলিম পণ্ডিতেরা মুক্ত। নিজেদের মধ্যে কথা বলার পথ তৈরি করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। এই কর্তব্য অবহেলার পরিণতি ভালো না।
‘কুরবানির প্রচলিত তফসিরে সন্তান হত্যার অনৈতিকতা’ , স্বপ্নকে সরাসরি আদেশে পর্যবসিত করা এবং স্বপ্নের তাৎপর্য না বোঝার ফলেই খ্রিস্টীয় পাশ্চাত্যে এই তর্ক তৈরি হয়। এইটুক জুড়ে দিয়ে, বোঝার চেষ্টা করুন। বুদ্ধির দিশাহারা ভাব চলে যাবে। এই সমস্যা পাশ্চাত্যের। ইসলামে এই তর্ক নাই। এটা আমাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে। কারণ আল্লাহ ‘কথা' দিয়ে আদেশ করেন নাই, ‘স্বপ্ন' দিয়ে ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ) তা বোঝেন কিনা পরীক্ষা করেছেন। ইব্রাহিমও স্বপ্নের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন বলেও অনেক বর্ণনা তাফসিরের অসংখ্য বইপুস্তকে আছে। পরে আল্লার প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ প্রমাণের জন্য প্রিয় পুত্রকে কোরবানি দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর বোঝাবুঝি প্রমাণের পথ বেছে নিয়েছেন। আল্লাহ বোঝাতে চেয়েছেন আমার নবীরা ইব্রাহিম ও ইসমাইলের মতো। তারা আদেশের অধীন নির্বিচার জীব না, তারা সজ্ঞান ও সচেতন অথচ আল্লার প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পন কারী।
কাজেই স্বপ্ন যদি 'আদেশ' হোত, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহর ক্ষেত্রে তার প্রতি সন্দেহের কোন প্রশ্নই থাকতো না।
আশা করি, ইফতেখার জামিল ইহুদি ও খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব ও বিশ্বাস কিভাবে আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে সেটা বুঝবেন। দ্বীনের পথে ইসলামের পতাকা তলে তিনি ফিরে আসবেন। এবং সবাইকে সেই দিকে দাওয়াত দিবেন।