ফরহাদ মজহারের কুরবানি বিষয়ক প্রস্তাবনা: মুফাসসিরিনের সিদ্ধান্তের আলোকে


 প্রথম কিস্তি

সম্প্রতি শ্রদ্ধেয় ফরহাদ মজহার কুরবানি নিয়া একটি সিরিজ লেখা শুরু করছেন। কুরবানি নিয়া ফরহাদ মজহারের লেখাগুলা ধারাবাহিক; এখন পর্যন্ত দুইটা কিস্তি উনি লিখছেন। সেই দুই কিস্তিতে যা যা আসে নাই, তা সামনের কিস্তিগুলায় আনবেন— বলছেন সেকেন্ড কিস্তির শেষে। তাই কুরবানি নিয়া ফরহাদ মজহার যা যা বলতে চান, তা এখনো সম্পন্ন ও সম্পূর্ণ না। ফলে, মন্তব্য করা মুশকিল।

তবু, ওনার লেখা নিয়া নানা ধরনের বিতর্ক তৈয়ার হইছে। এই ধরনের বিতর্করে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখি। যদিও, বিতর্কের পাশাপাশি নানা ধরনের কুতর্ক ও ব্যক্তি আক্রমণও তার বিরুদ্ধে হইছে; সেগুলার ব্যাপারে নিন্দা জানানো ছাড়া আপাতত আর কিছু বলা সমীচীন মনে করি না। প্রত্যেকেই যার যার কর্মের বোঝা বহন করবেন।

আমার লেখার শিরোনামেই পষ্ট হয়ে আছে যে, আমি কী লিখতে চাই। অবশ্যই, ফরহাদ মজহারের লেখাগুলা এই লেখার মূল উদ্দীপক হিশেবে থাকবে। পাশাপাশি মুফাসসিরিনের টেক্সট বিশ্লেষণ করে, এই তর্কের বিভিন্ন অনুসিদ্ধান্ত, মুফাসসিরদের নিজস্ব পরিসরে এ নিয়া নানামুখী বাহাস ইত্যাদির দিকে আমি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করব এই লেখায়।

তর্কে ঢোকার আগে প্রথমেই আমাদের বুইঝা নেওয়া জরুরি যে, ফরহাদ মজহার কী বলছেন, আর কী বলেন নাই। প্রথমে বলা যাক, উনি কী বলছেন। আমি ওনার লেখার ২ টা কিস্তিই পড়ছি। প্রথম কিস্তির প্রস্তাবনাগুলা নিম্নরুপ:

১. পশু কোরবানি, এটি দুনিয়ার বিভিন্ন ধর্মেরই অন্তর্গত প্রাক্টিস।
২. 'মনের পশু' ফেনোমেনাটি ক্রিশ্চিয়ান থিওলজিজাত; এটিরে আধুনিককালে সেক্যুলারিজমের মোড়কে উপস্থাপন করা হয়।
৩. ইসলামে কোরবানির ধারণাটি বোঝার জন্য আমাদের বোঝা জরুরি যে, ইসলামে কোরবানির সূচনা-গল্পটির সাথে, বাইবেলের        গল্পটির অমিলগুলি কী কী।

এরপরে তিনি কোরবানি ও ভোগবাদিতা সংক্রান্ত আলাপ করছেন, তবে মোটাদাগে এই তিনটাই তার প্রধান টেক, ওই লেখায়৷ মজার ব্যাপার, এই লেখায় ফরহাদ মজহার লিখেছেন:

"এবার আসা যাক আখেরি নবি কেন হজরত ঈসার (আ) নজির থাকা সত্ত্বেও খ্রিস্টিয় চিন্তার বিপরীতে আবার কোরবানির প্রচলন করলেন। এর প্রধান কারন হজরত ইব্রাহিম। একত্ববাদের প্রধান পুরুষ হিসাবে হজরত ইব্রাহিমের মহিমা আবার কায়েম করাই ছিল আল্লার রসুলের প্রধান লক্ষ্য। আল্লার সন্তুষ্টি বিধান যদি রুহানিয়াতের পথ হয়ে থাকে তাহলে হজরত ইব্রাহিম স্বপ্নে সেই ইঙ্গিত পেয়ে তাঁর সন্তানকে কোরবানি করতে চেয়েছিলেন। কোরবানির এই নজির যেন আমরা ভুলে না যাই"। ('১.ইসলামের কোরবানি, 'মনের পশু'তত্ত্ব ও খ্রিস্ট ধর্ম', চিন্তা ওয়েবজিন)

একটু পরেই:

"আল্লার আদেশ পালন করতে গিয়ে হজরত ইব্রাহিম নিজের পুত্র সন্তানকে কোরবানি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। এই দিন হজরত ইব্রাহিম আলাইহে ওসাল্লামকে স্মরণ করবার দিন। একই ভাবে এই দিন মিল্লাতে ইব্রাহিমের প্রতি অঙ্গীকারেররও দিন।" (প্রাগুক্ত)

দেখা গেল যে, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহর স্বপ্নটি যে কোন সাধারণ স্বপ্ন ছিল না, সেটি একটি 'ইঙ্গিত' বা 'আল্লার আদেশ' ছিল, এ ব্যাপারে ফরহাদ মজহার তার পয়লা কিস্তিতেই বেশ সতর্ক আছেন।

লেখার ২য় কিস্তিতে ফরহাদ মজহার তুলনামূলক জটিল একটা আলাপে ঢুকতে চাইছেন। পশ্চিমা দর্শনে কোরবানির এই ঘটনাটি একটা ফিলোসফিক্যাল ডিবেটের প্রধান কাঁচামাল হিশাবে হাজির আছে। কিয়ের্কেগার্ড, জাক দেরিদা, লেভিনা, জিজেকসহ আরো অনেকেই এই ঘটনাটিরে কিছু ফিলোসফিক্যাল ডিবেটের কাঁচামাল হিশেবে ব্যবহার করছেন।

স্বাভাবিকভাবেই, উনাদের সামনে ছিল বাইবেলের গল্প। এবং সেই গল্পের ভিত্তিতেই, উনারা নিজেদের দার্শনিক মতামত দিছেন, দার্শনিক প্রত্যয় বা সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করছেন, যা আবার বিশ্বদর্শনের অংশ হয়ে উঠছে ক্রমশ, উঠতেছে। ফলে, ইসলাম গল্পটা কীভাবে বলে, এবং সেই বলার ভিতর দিয়া আমরা নতুন কিছু পাই কিনা, পাইতে পারি কিনা— সেই প্রশ্নও কালে কালে গুরুত্বের সাথেই উঠছে, এবং ওঠাটাই খুব স্বাভাবিক। বিখ্যাত তাত্ত্বিক আসমা বারলাস ও সৈয়দ হোসাইন নসরও এই তর্কে যুক্ত হইছেন, এবং মুসলিম ঐতিহ্যে গল্পটার যে ইউনিক ফারাক, সেগুলা চিহ্নিত করে দর্শনের নতুন ক্ষেত্র উন্মোচনের ট্রাই করছেন। আসমা বারলাসের বরাতে, লেখক ও চিন্তক পারভেজ আলম তার 'মদিনা' বইতে এই ডিবেটগুলা আনছেন।

লেখাটার সেকেন্ড কিস্তিতে ফরহাদ মজহারের প্রস্তাবনা ছিল এটাই যে: এই দার্শনিক ডিবেটে, অ্যাজ আ মুসলিম, আমরা কীভাবে যুক্ত হইতে পারি। দুনিয়ায় ভাবাভাবি ও বোঝাবুঝির যে ডোমিন্যান্ট তরিকা এখন হাজির আছে, যারে আমরা 'ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি' (এইভাবে বর্গায়ন করাকে অনেকেই সমস্যা হিশেবে চিহ্নিত করছেন; তবে আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত বর্গ হিশেবে শব্দটা ব্যবহার করা হইল) হিশেবে চিনি, সেখানে এই ঘটনাটারে যেভাবে পাঠ করা হইল, থ্রু বাইবেল, তারে ফিলোসফিকালি মোকাবেলার জন্য, এই ঘটনার কুরআনি ভার্শন, আমাদের কাজে আসে কিনা। এবং, এর তরিকা হিশাবে উনার পয়লা প্রস্তাবনা ছিল: কোরআনে বর্ণিত কোরবানির ঘটনার সাথে বাইবেলের ঘটনার কিছু ফারাক আছে। এই ফারাকগুলার বোঝাবুঝি করতে পারলে, হয়ত আমরা এইখানে নতুন কিছু পাব।

এ পর্যন্ত মজহার সাহেবের সিদ্ধান্তগুলার সাথে কারুরই তেমন দ্বিমত থাকার কথা না। দ্বিমত হইছে মূলত, যখন ফরহাদ মজহার বাইবেল থেকে কোরআনের কাহিনী আলাদা করতে গিয়ে বলছেন, আল্লাহ হযরত ইব্রাহিমকে কোরবানির আদেশ দেন নাই; এইরকম 'বিয়ন্ড ইথিকাল' আদেশ আল্লাহ দিতে পারেন না। এটা ইব্রাহিমের স্বপ্ন, কোরআন তাই বলে।

আচ্ছা। তাইলে, ফরহাদ মজহার কী বলছেন জানলাম। উনি কী কী বলেন নাই?

১. কোরবানি আল্লাহর বিধান না। এটা নৃশংসতা। বরং, প্রথম কিস্তিতে এর উল্টাটাই বলছেন উনি।
২. কোরবানি করা ক্রিশ্চিয়ান কালচার। এরও উল্টাটাই উনি বলছেন প্রথম লেখায়।
৩. কোরবানি হযরত ইব্রাহিমের সুন্নত না। এটাও উনি বলেন নাই; বরং এর উল্টাটাই বলছেন প্রথম লেখায়।

এটা ক্লিয়ার কইরা নিলাম, কারণ অনেকেই না বুঝে, আবার অনেকে প্রোপাগান্ডামূলকভাবে এই ধরনের দাবি করছেন, দেখলাম। তো, উনার কোন কথাটা নিয়া তাইলে তর্ক? উনি কোরবানির বিধান, এর ইব্রাহিমি সুন্নত হওয়ার এজেন্ডা, কোনটাই অস্বীকার করেন নাই। উনি বলছেন, কোরআনে বর্ণিত ইব্রাহিমের স্বপ্ন আর বাইবেলে বর্ণিত আল্লাহর আদেশ— দুইটা এক জিনিশ না। আমার ধারণা, উনি এটাই বলতে চাইছেন।

এ বাবদে আমার বক্তব্য এই যে, কোরআনে বর্ণিত গল্পটির সাথে বাইবেলের গল্পের খুব সিগনিফিকেন্ট কিছু ফারাক আছে; এসব ফারাক নিয়া ডিবেট ও মন্তব্য, এমনকি ইসলামি অ্যাকাডেমিয়ার সর্বজনস্বীকৃত মুফাসসিরিনও করছেন। সেই ফারাকগুলা অবশ্যই আমাদের জানা ও বোঝা দরকার। তাফসিরের কিতাবগুলাতে অনেক ইসরাইলি রেওয়ায়েত আছে এবং এসব বর্ণনা পর্যালোচনা ছাড়াই গ্রহণের বিরুদ্ধে মুফাসসিরিন মূলনীতিও নির্ধারণ করছেন— এটা তো মিথ্যা না। ড. মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ আবু শাহবাহ তার 'আল ইসরাইলিয়্যাত ওয়াল মাওদুয়াত ফি কুতুবিত তাফসির' বইয়ে এ নিয়া বিস্তারিত আলাপ করছেন। তাইলে, বাইবেলের গল্পের সাথে কোরআনের গল্পের যদি কোন সিগনিফিক্যান্ট ফারাক থাকে, সেইটা অ্যাকাউন্টে নেওয়াই উচিত, উসুল অনুযায়ী।

আলাপ হইল, ফরহাদ মজহার যে বলছেন, আল্লাহ ইব্রাহিমরে আদেশ দেন নাই কোরবানির, উনি স্বপ্নে দেখছেন— এর অর্থ কী? এর দুই অর্থ হইতে পারে। এক. হযরত ইব্রাহিমের স্বপ্নটির সাথে আল্লাহর ইচ্ছা বা আদেশের কোন যোগ নাই; এটা নিছকই একটা স্বপ্ন। দুই. অবশ্যই ইব্রাহিমের স্বপ্নটির সাথে আল্লাহর ইচ্ছার যোগ আছে, কিন্তু বাইবেলের ঘটনায় আল্লাহর আদেশ দেওয়ার ধরন ও পদ্ধতির সাথে কোরআনে বর্ণিত ঘটনায় আল্লাহর আদেশ দেওয়ার ধরন ও পদ্ধতির ফারাক আছে; এবং এই ফারাক সিগনিফিক্যান্ট।

ফরহাদ মজহার যদি প্রথম অর্থে কথাটা বলেন, তাইলে এর সাথে আমাদের দ্বিমত আছে। যদি উনি দ্বিতীয় অর্থে কথাটা বলেন, তাইলে আমরা মুফাসসিরিনের ব্যাখ্যার আলোকে দেখতে পারি, ব্যাপারটার স্বরুপ কী (যেহেতু প্রথম লেখায় উনি স্বপ্নটিকে 'আল্লার ইঙ্গিত' বা 'আল্লার আদেশ' বলছেন, ধইরা নেওয়া যায়, উনি দ্বিতীয় অর্থেই কথাটা ব্যবহার করছেন)। অর্থাৎ, ইব্রাহিমের স্বপ্নের সাথে আল্লাহর আদেশ বা অভিপ্রায়ের যোগ আছে, কোরআনের বাকরীতিও তাই বলে— এটাই আমাদের মন্তব্য। কিন্তু, সেই আদেশ বা অভিপ্রায়ের পদ্ধতিটা বাইবেলের চাইতে আলাদা কিনা, সেই আলাদা হওয়ার ভিতর দিয়া সিগনিফিক্যান্ট কোন ফিলোসফিক্যাল জাজমেন্ট আমরা দিতে পারি কিনা, সেটা অবশ্যই খুবই জরুরি ও গুরুতর প্রশ্ন, এবং এই প্রশ্ন নিয়া আলাপ হওয়াই উচিত।


দ্বিতীয় কিস্তি

বাইবেলে হযরত ইব্রাহিমের ঘটনাটা কীভাবে বর্ণিত আছে, অনেকেই জানেন। বাইবেলে আল্লাহর আদেশ বা ওহিটি সরাসরি, এবং সুনির্দিষ্ট; সেখানে ব্যক্তি, স্থান, আদেশ ও কাজের ধরন— সবই আগ থেকেই নির্ধারিত। এবং হযরত ইব্রাহিমই সেখানে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সজ্ঞানে খোদার এই আদেশ পালনে অংশগ্রহণ করতেছেন। কোরবানির ঘটনাটি সেখানে একান্তই হযরত ইব্রাহিমের; এতটাই একান্ত যে, যিনি কোরবানি হবেন, সেই ইসহাকও (বাইবেল অনুসারে) কিছুই জানতেন না। বাইবেলে খোদার আদেশ এতটাই একতরফা, বান্দার সাথে সেই আদেশের যোগসূত্র এতটাই অস্ফুট যে, কোন কোন বর্ণনায় আমরা দেখি, বিবি সারা হযরত ইব্রাহিমককে বলছেন: 'ইব্রাহিম, আমারে না জানিয়েই তুমি আমার ছেলেকে জবাই করতে চাইলা!' (তাবারি, তাফসিরে তাবারি, ১৩/৫৮০-৮১, দারে হিজর; সুয়ুতি, আদ দুররুল মানছুর, ৫/২৮২-৮৩; বাগাভি, তাফসিরে বাগাভি, ৭/৪৭-৪৯)

খোদার আদেশ পালনে ইব্রাহিমের এই অসহায় একাকীত্ব ও চরম গোপনীয়তা রক্ষারেই কিয়ের্কেগার্ড বলছেন 'ঈমানের পরম সাক্ষী'; দেরিদার ভাষায়, 'পরমের সাথে একজনমাত্র ব্যক্তির পরম সম্পর্ক'। কোরআনে বর্ণিত ঘটনাটা এভাবে ঘটে নাই।

কোরআনে সুরা সাফফাতের ১০১-১০৭ নম্বর আয়াতে এই ঘটনার বর্ণনা আছে। কোরআনে বর্ণিত ঘটনাটি বিশ্লেষণ করতে গিয়া, মুফাসসিরিন কোন কোন দিকগুলা নিয়া আলাপ করছেন, এবং এই ঘটনার সাথে বাইবেলের ঘটনার কী কী অমিল আছে, সেগুলা আমরা সামনে বলার চেষ্টা করব।

প্রথমত, কোরআনে বর্ণিত ঘটনাটিতে কোন ছেলেরে উৎসর্গ করা হইছিল, সেটা ডিরেক্ট বলা নাই। আলাপটা আলোচ্য তর্কের ক্ষেত্রে মাইনর ধইরা নিলেও, কোরআনের সাথে বাইবেলের বর্ণনার ফারাকের ক্ষেত্রে, মেজর; এই ফারাক থেকেও আমরা কোরআন ও বাইবেলের ন্যারেটিভ বা বর্ণনাভঙ্গির কিছু ইউনিকনেস আবিষ্কার করতে পারি। ফরহাদ মজহার তার লেখায় বলছেন, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর সকল মুফাসসির একমত যে, এই পুত্র ইসমাইল। তথ্যটা সঠিক না।

মোটাদাগে বলা যায়, মুতাকাদ্দিমিন বা পূর্বযুগের অনেক মুফাসসিরের মতে, এই পুত্র ইসহাক (বাইবেলের মতও তাই)। কিন্তু মুতাআখখিরিন বা উত্তরযুগের মুফাসসিরদের মতে, ইনি ইসমাইল।

১. আল্লামা তাবারি (২২৪-৩১০ হি.) তার তাফসিরে 'আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম'— এর ব্যাখ্যায়, বিখ্যাত মুফাসসির ও তাবেয়ি ইকরিমা ও কাতাদার বরাতে লিখছেন যে, এই পুত্র ইসহাক। এমনকি এ ব্যাপারে কোন ভিন্নমতের উল্লেখও উনি করেন নাই। (তাবারি, ১৩/৫৭৮)

২. আরেক বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা কুরতুবি (মৃ. ৬৭১ হি.) তার তাফসিরে ভিন্নমতের উল্লেখ করে বলছেন: 'বেশিরভাগ আলেমের মত এই যে, এই ছেলে ইসহাক'। এরপর তিনি এই মতের পক্ষে থাকা আলেমদের লিস্ট দিছেন, যা এরকম: (সাহাবিদের মধ্যে) হযরত আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত আলি, হযরত উমর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর। (তাবেয়ি ও অন্যান্যদের মধ্যে) আলকামা, শা'বি, মুজাহিদ, সাইদ ইবনে জুবাইর, কা'ব আল আহবার, কাতাদা, মাসরুক, ইকরিমা, কাসেম বিন আবু বাযযা, আতা, মুকাতিল, আব্দুর রহমান বিন সাবিত, যুহরি, সুদ্দি, আব্দুল্লাহ ইবনে আবু হুজাইল, ফকিহ মালেক ইবনে আনাস। অনেকের থেকে আবার দুই ধরনের বক্তব্য বর্ণিত আছে। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর।

যাহোক, কুরতুবির মতে, হযরত ইসহাকের দিকেই বেশিরভাগ আলেমের মতামত। কুরতুবি তার তাফসিরে ভিন্নমতাবলম্বীদের যুক্তিগুলা খণ্ডনও করছেন। (কুরতুবি, আল জামি' লি-আহকামিল কুরআন, ১৮/৬১-৬৫, মুআসসাসাতুর রিসালাহ)

৩. আরেক বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম বাগাভি (৪৩৩/৩৬-৫১৬ হি.) তার তাফসিরে দুইপক্ষের মতামত ও দলিল উল্লেখ কইরা, কোন পক্ষ না নিয়া শুধু এতটুকু বলছেন: 'রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দুই ধরনের বর্ণনাই পাওয়া যায়'। (বাগাভি, মাআলিমুত তানযিল, ৪/৩৬, দারু ইহইয়া আত তুরাসিল আরাবি)

৪. আরেক বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনুল জাওযি (৫১০-৫৯৭ হি.) তার তাফসিরে দুইটি মত, দুইপক্ষে থাকা আলেমদের নাম ইত্যাদি উল্লেখ করার পর লিখেছেন: 'আমাদের সাথীরা প্রথম মতরেই (ইসহাক) প্রাধান্য দেন।' (ইবনুল জাওযি, যাদুল মাসির, ১১৯১-৯২, দারু ইবনে হাযম)।

৫. আল্লামা ইবনে কাসিরই (৭০১-৭৭৪ হি.) সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ মুফাসসিরদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি খুব দৃঢ়ভাবে হযরত ইসমাইলের পক্ষে মতামত দিছেন, এবং হযরত ইসহাকের পক্ষের মতগুলারে 'ইহুদি-খ্রিস্টান পাদ্রিদের থেকে অনুপ্রবেশকৃত মতামত, কোরআন-সুন্নাহয় যার কোন প্রমাণ নাই' বলে শক্তভাবে নাকচ ও বাতিল করছেন। উনার মতে, আহলে কিতাব আলেমরা সব জানার পরেও, হযরত ইসমাইলের প্রতি হিংসাবশত (যেহেতু উনি আরবদের নেতা) হযরত ইসহাকের নাম ঢুকায়ে দিছেন তাদের কিতাবে। ইবনে কাসির কা'বুল আহবার নামের একজন মুফাসসির তাবেয়িরে এইসব বর্ণনার জন্য দায়ী করছেন। উনার মতে, কা'বের মাধ্যমেই এসব বর্ণনা তাফসিরের কিতাবে অনুপ্রবেশ করছে, কারণ কা'ব অনেক বেশি আহলে কিতাবদের ঘটনা বয়ান করতেন। এবং এসব করার জন্য ইবনে কাসির ওনার সমালোচনাও করছেন। (ইবনে কাসির, ৭/২৭; দারে তায়্যেবা; তাফহিম, ১৩/৬৫-৬৬)

মুতাআখখেরিন এবং মডার্ন স্কলারদের অধিকাংশই ইবনে কাসিরের এই ফয়সালা মেনে নিছেন। মাওলানা মওদুদি তার তাফহিমে দুইপক্ষের মত বয়ান কইরা, হযরত ইসমাইলের পক্ষে যুক্তি প্রমাণ দিছেন এবং এ ব্যাপারে ইবনে কাসিরের ব্যাখ্যারেই চূড়ান্ত হিশেবে মেনে নিছেন। উনার মতে, কা'বুল আহবারের অসতর্কতা, ইহুদিদের অপপ্রচার ও মুসলিম স্কলারদের সরলমনই এসব বর্ণনা তাফসিরের কিতাবে ঢোকার জন্য দায়ী (তাফহিম, ১৩/৬৫-৬৬)। মুফাসসিরদের মধ্যে ইসরাইলি রেওয়ায়েতের সমালোচনা এবং সেসব গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের ধারা চালু থাকার একটা নজির হিশাবে, এই মতামতটিরে পড়া যাইতে পারে।

তবে, অনেকেই আবার দৃঢ়ভাবে এসব মতামতের কোন একটাকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটারে বিপজ্জনক ভাবছেন, এবং 'কাকে জবাই করার আদেশ দেওয়া হইছিল', এ ব্যাপারে আল্লাহর এলেমরেই বড় মনে করছেন। যেমন:

বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ ও স্কলার আবু ইসহাক যাজ্জাজের (২৪১-৩১১ হি.) মতে: 'এটা আল্লাহই ভাল জানেন।' (মাআনিল কুরআন, ৪/৩১১)

উপমহাদেশের বিখ্যাত স্কলার, অনেক দেওবন্দী আলেমের উস্তাদ ও আহলে হাদিস আন্দোলনের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক নওয়াব সিদ্দিক হাসান খানের (১৮৩২-১৮৯০) মতও এমনই। উনি ওনার তাফসিরে এ ব্যাপারে যা লিখছেন, তার সারকথা এই যে: এ ব্যাপারে দুই দলের মতামতই অনুমাননির্ভর, এবং তাদের দলিলগুলা এমন না, যার দ্বারা দৃঢ়ভাবে কোন একটা মত বিশ্বাস করা বা প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সূত্রে এ প্রসঙ্গে যেসব বর্ণনা আছে, সেগুলা হয় বানোয়াট বা খুবই দুর্বল। আর, কোরআনের যেসব ইশারা ইঙ্গিত এ ব্যাপারে দলিল হিশাবে আনা হয়, সেগুলা অকাট্য না, এহতেমালি। এ ধরনের দলিল দিয়া কোনকিছু অকাট্যভাবে সাব্যস্ত হয় না। তাই এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকাই জরুরি। (ফাতহুল বায়ান, ১১/৪০৭-১০, আল মাকতাবাতুল আসরিয়্যা)

উপরের আলাপ থেকে এটাই বোঝা গেল যে, কাকে কোরবানি করার কথা কোরআনে বলা হইছে, এ ব্যাপারে স্কলারদের মধ্যে বেশ বড়সড় এখতেলাফ আছে। যারা হযরত ইসমাইলের পক্ষে দলিল দিছেন, তারা ইহুদিদের জাতপ্রীতিমূলক চক্রান্তের আলাপ আনছেন বটে; কিন্তু ভিন্নমতের মুসলিম স্কলাররা কেন সেসব মত গ্রহণ করলেন, তার কোন শক্তিশালী জবাব দিতে পারেন নাই। ইসরায়েলি রেওয়ায়েত হিশেবেই এই মতটারে তারা বাতিল করতে চাইছেন। কিন্তু, কেন খোদ কোরআনে এ ব্যাপারে পষ্ট কিছু বলা হয় নাই, তা নিয়ে কোন মুফাসসিরেরই বিশেষ কোন আলাপ আমার চোখে পড়ে নাই।

আমরা দেখছি, ছেলের নাম বিষয়ক ডিবেটে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের আলাপগুলাই প্রমিন্যান্ট হয়ে উঠছে, দুইপক্ষেই। ফলে আমার ধারণা, হযরত ইসহাক ও ইসমাইলরে কেন্দ্র করে যে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও বিদ্বেষের পরিবেশ তৈয়ার করছিল আহলে কিতাবরা, যে কারণে আরবদের মধ্যে, ইসমাইলের বংশে রাসুল আসায় তারা মাইনা নিতে চায় নাই, সেই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটারে কম গুরুত্ব দিতে চাওয়া এর একটা কারণ হইতে পারে।

ফিলিস্তিনি স্কলার শায়খ বাসসাম জাররার এক্ষেত্রে আরেকটা কারণ বয়ান করছেন। উনার মতে, কারে জবাই করার জন্য নেওয়া হইছিল, কোরআনের বয়ানে এইটা গুরুতর কোন বিষয় না। যারেই নেওয়া হোক, কোরআনে এই ঘটনা বয়ানের মাকসাদ তাতে ছুটে যায় না। কিন্তু, বাইবেলে এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে; এতটাই যে, বাইবেলে পুত্রের নাম তো বলাই হইছে, সাথে 'একমাত্র পুত্র' শব্দটাও আছে, তাও তিন তিনবার; যা যৌক্তিক না। কারণ ঘটনার সময় ইসহাক ইব্রাহিমের একমাত্র পুত্র ছিলেন না। শায়খ বাসসামের মতে, পুত্রের নাম নির্দিষ্টকরণে বাইবেলের এই অহেতু জোরারোপ, তাও ঐতিহাসিক ফ্যাক্টের বিপরীতে গিয়া, বেশ সন্দেহজনক। কোরআন ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে এই ধরনের ডিটেইলিংয়ে যায় নাই কখনোই। এছাড়া আরো কারণ থাকতে পারে অবশ্য। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।

তৃতীয় কিস্তি

১.

বাইবেলে এই ঘটনাটির বর্ণনায় আমরা দেখি যে, পুত্রকে 'আগুনে পোড়ানো কোরবানি' হিশেবে পেশ করার সুস্পষ্ট আদেশ আল্লাহর তরফ থেকে দেওয়া হইছে হযরত ইব্রাহিমকে। অর্থাৎ এই আদেশ, বাইবেল মোতাবেক, হযরত ইব্রাহিমের উপর একটি সুস্পষ্ট শরয়ী নির্দেশনা।

কোরআনে ঘটনাটা শুরু হইছে ইব্রাহিমের স্বপ্নের মাধ্যমে। নবি-রাসুলদের স্বপ্নও ঐশী ইঙ্গিত বা ওহি, এ ব্যাপারে ইসলামের আলেমরা প্রায় সর্বসম্মত রায় দিছেন। কিন্তু, যেহেতু স্বপ্ন, ফলে এই নির্দেশনাটি কেমন, তা নিয়া নানাবিধ আলাপের অবকাশ রয়ে গেছে৷ ফলে, ইব্রাহিমের স্বপ্নাদিষ্ট বিধানটির স্বরুপ কী, এই নিয়া মুফাসসির ও ফকিহগণ, বেশ গুরুতর কিছু তর্কের অবতারণা করছেন।

প্রথম প্রশ্ন এই যে, নবীদের স্বপ্ন ঐশী ইঙ্গিত বটে। কিন্তু এইটি কি শরয়ী নির্দেশনা? এটি কি বিধান বা শরিয়ত? ইব্রাহিমের স্বপ্নাদিষ্ট আদেশকে শরয়ী হুকুম ধইরা নেওয়ার বিপদগুলা সামনে আরো বিস্তারিত জানা যাবে৷ আপাতত এ ব্যাপারে একজন বিখ্যাত মুফাসসিরের বক্তব্য শোনা যাক।

তিউনিশিয়ার বিখ্যাত মুফাসসির ও উসুলবিদ আল্লামা তাহের আশুরের 'তাফসিরুত তাহরির ওয়াত তানভির' আধুনিক যুগে লেখা প্রথম সারির তাফসিরগুলির একটি। এই তাফসিরে উনি বলছেন:

"নবীদের স্বপ্ন ঐশী ইঙ্গিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছেও প্রথম ওহি আসছিল সত্য স্বপ্নের বরাতে। কিন্তু শরিয়ত বা শরয়ী কোন বিধান ওনাকে স্বপ্নে দেওয়া হয় নাই...শরিয়তের বাইরে বিভিন্ন ইস্যুতে, কখনো ভবিষ্যতে ঘটবে এমন ঘটনার ইঙ্গিতরুপে, কখনো নিজের উম্মত বা সাথীদের সাথে ঘটিতব্য কোনকিছুর ইশারা হিশেবে, কাশফের সুরতে, ওনার স্বপ্নগুলি ওহি ছিল। ফলে, মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ব্যাপারটা স্বপ্নে আগাম দেখা সত্ত্বেও, উনি আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত হিজরতের তৈয়ারি করেন নাই...হযরত ইব্রাহিমের প্রতি খোদার নির্দেশনাটি ছিল একটি পরীক্ষা, শরিয়ত না। নতুবা, ইব্রাহিম সম্পূর্ণ হুকুম তামিলের আগেই তা রহিত হইত না; কারণ, কোন হুকুম তামিলের আগেই তা রহিত হয়ে যাওয়া শরিয়তের মূল মাকসাদের খেলাফ।" (তাহরির ওয়াত তানভির, ২৩/১৫০)

২.

বোঝা গেল, নবীদের স্বপ্ন সত্যি বটে, তবে শরিয়ত না। এই ফারাকের মর্ম বোঝা জরুরি। এরই সূত্র ধইরা, ইসলামি আইনজ্ঞরা বেশ গুরুতর কিছু উসুলি তর্কের অবতারণা করছেন। এর মধ্যে একটা তর্ক এই যে: হযরত ইব্রাহিম যা-ই স্বপ্নে দেখুক, সেখানে কি পুত্রকে জবাই করার আদেশ দেওয়া হইছিল? নাকি, জবাইয়ের আয়োজন ইত্যাদির আদেশ দেওয়া হইছিল? অর্থাৎ, এক্সাক্ট আদেশটা কী ছিল? এই পুরা তর্কটা ওঠে আদেশটা সরাসরি না হইয়া স্বপ্নে হওয়ার কারণে৷ কারণ, একদিকে ইব্রাহিম বলতেছেন: 'আমি স্বপ্নে দেখলাম, তোমারে জবাই করছি।' অন্যদিকে, জবাই করার আগেই আল্লাহ বলতেছেন: 'তুমি তো স্বপ্নরে সত্যে পরিণত করলা!' ফলে, এখানে একটা খোদায়ি হুকুম পালনের আগেই রহিত হয়ে যাইতেছে। এই যে, মানুশ পালন করার আগেই কোন খোদায়ি বিধান রহিত হওয়া, এইটা কি বৈধ? যৌক্তিক?

এই তর্কে আইনজ্ঞরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। ইমাম ফখরুদ্দিন রাযিসহ আলেমদের বড় একটা দলের মতে: হ্যাঁ, এটা বৈধ ও যৌক্তিক। ফলে তাদের রায় এই যে, স্বপ্নে হযরত ইব্রাহিম সরাসরি জবাইয়ের নির্দেশই পাইছেন, যা পরে পালনের আগেই রহিত করা হইছে।

অপরদিকে হানাফি ও শাফেয়ি আইনবিদদের একটা 'বড় জামাত', এবং আল্লামা যামাখশারি ও মু'তাযেলিদের মতে: এটা বৈধ না, যৌক্তিকও না। ফলে তাদের কথা এই যে, স্বপ্নে হযরত ইব্রাহিমরে জবাইয়ের আয়োজন বা 'প্রায়-জবাই'য়ের নির্দেশ দেওয়া হইছিল, যা তিনি পালন করছেন। (তাফসিরে রাযি, ২৬/১৫৫-৫৬, দারুল ফিকর)

৩.

ফরহাদ মজহার ওনার লেখায় যে প্রধান দার্শনিক তর্কটির অবতারণা করছেন, তা হইল: আল্লাহ কী পারেন, এমন একটা আদেশ দিতে, যা আদতে নিষ্ঠুর, খারাপ? উসুলে ফিকহের ভাষায় যদি কথাটা বলি: আল্লাহ কি কোন 'কবিহ লি-যাতিহি' বা সত্তাগতভাবে খারাপ কাজের আদেশ দিতে পারেন?

উল্লেখ্য, এটা ইসলামি আকিদার একটা গুরুত্বপূর্ণ তর্ক, যা পরে ইসলামের লিগাল আসপেক্টরেও প্রভাবিত করছে। আল্লাহর আদেশ/নিষেধের সাথে আকল বা যুক্তির সম্পর্ক কেমন? আল্লাহ কি সর্বদা 'ভাল' কাজের আদেশে দেন, আর 'খারাপ' কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন? মানে, কোন কাজ আমাদের আকল বা যুক্তি অনুযায়ী ভাল/খারাপ বলেই কি আল্লাহ তা করার/না করার নির্দেশ দেন, নাকি উনি নির্দেশ দেওয়ার পরেই আমরা সেটার ভালত্ব/খারাপত্ব বুঝতে পারি?

এই বিতর্কে ইসলামি তাত্ত্বিকরা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছেন। এ নিয়ে বিস্তারিত লেখতে গেলে আলাদা একটা প্রবন্ধেরই প্রয়োজন; আপাতত, যতটুকু না হইলেই নয়, ততটুকু আলাপ করা যাক।

এক্ষেত্রে মুসলিম তাত্ত্বিকদের মধ্যে মোটাদাগে ৩ ধরনের মতামত আছে। এই মতামতগুলা আবার সবযুগে একরকম থাকে নাই; চেঞ্জ হইছে, এক্সপান্ডেড হইছে, একটা আরেকটার সাথে ওভারল্যাপ করছে। ৩ মতের পর্যালোচনার মাধ্যমে নয়া মতও তৈরি হইছে। ছোট করে এই মতগুলা নিয়া আলাপ করা যাক।

১. প্রথম মত এই যে, যেকোন জিনিশের মধ্যে সত্তগতভাবেই 'হুসন'/ভালোত্ব বা 'কুবহ'/খারাপি আছে। এই ভালোত্ব/খারাপি মানুশ আকল দিয়াই বুঝতে পারে। তাইলে, শরিয়ত বা ঐশী নির্দেশনা কী করে? সে মানুশের 'আকল' বা বিবেকের এই বুঝটারেই আরো শক্ত করে, পষ্ট করে, প্রকাশ করে; খোদ কাজটা ভাল/খারাপ হওয়ার পিছনে শরিয়তের কোন ভূমিকা নাই। ফলে, এই মত অনুযায়ী: মানুশের আকল বা বিবেক দিয়াই ভাল-মন্দের তফাত ধরতে পারা জরুরি। তাই, যদি কোন ব্যক্তির কাছে খোদার তরফে কোন নবি বা কিতাব নাও আসে, তবু নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়া তার খোদারে চিনতে পারতে হবে। নইলে সে শাস্তির উপযুক্ত হবে। এই মতটা প্রধাণত মু'তাযিলাদের। তবে, প্রধানত হানাফি, পাশাপাশি শাফেয়ি, মালেকি ও হাম্বলি মাজহাবের অনেক ইমাম, মাতুরিদি ধারার তাত্ত্বিকগণ এবং ইমামি শিয়ারাও এই মত পোষণ করে থাকেন। যদিও, মাতুরিদি/হানাফি ধারার সাথে মুতাযিলাদের একটা স্লাইট ডিফারেন্স আছে, সেটা যথাস্থানে। (মুহাম্মদ সালেহ যারকান, ফখরুদ্দিন রাযি ওয়া আরাউহুল কালামিয়্যা ওয়াল ফালসাফিয়্যা, পৃ. ৫১০-১১; ইবনে তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া, ৮/৪২৮)

২. দ্বিতীয় মত এই যে— যেকোন কাজ ভাল/খারাপ হওয়া পুরাপুরি শরিয়তের উপর ডিপেন্ডেড। শরিয়ত আসার আগে সব কাজ সমান। আকল দিয়া বোঝাবুঝির কোন কাজ নাই। কোন কাজই সত্তাগতভাবে ভাল বা খারাপ না। ব্যাপারটা সহজে ব্যাখ্যা করতে গিয়া, বিখ্যাত শাফেয়ি ফকিহ ও আশ'আরি তাত্ত্বিক ইমামুল হারামাইন আল্লামা জুওয়াইনি (৪১৯-৪৭৮ হি.) বলছেন: 'ফলে, ভাল কাজ সেটাই, যার কর্তারে শরিয়ত ভাল বলছে; আর খারাপ কাজ সেটাই, যারে শরিয়ত খারাপ বলছে।' (জুওয়াইনি, আল ইরশাদ, পৃ. ২৫৮)।

তো, যেহেতু যা শরিয়তে জায়েজ, বা আদিষ্ট তা ভাল, আর যা নিষেধ তা খারাপ— ফলে আল্লাহ চাইলে কুফুরির আদেশ দিতে পারেন, পাপের আদেশ দিতে পারেন ইত্যাদি। ফলে, এই মতের অনুসারীরা বলেন: যদি কোন লোকের কাছে শরিয়ত না আসে, তার জন্য ঈমান, আমল, সৎকর্ম কিছুই জরুরি না। এই মতের অনুসারী হইলেন মূলত আশ'আরি মতাদর্শের তাত্ত্বিকরা; পাশাপাশি শাফেয়ি, মালেকি ও হাম্বলি মাযহাবের অনেক ইমামও এই মতের পক্ষে আছেন৷ এছাড়া, কালামি ঘরানার মধ্যে মুশাব্বিহা, খারেজি ও রাফেজিদের মতামতও এইরকম। (মুহাম্মদ সালেহ যারকান, ফখরুদ্দিন রাযি ওয়া আরাউহুল কালামিয়্যা ওয়াল ফালসাফিয়্যা, পৃ. ৫১০-১১; ইবনে তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া, ৮/৪২৮; আকমালুদ্দিন বাবারতি (৭১৪-৭৮৬ হি.), শরহু ওসিয়্যাতি আবি হানিফা, পৃ. ৫৩)

৩. তৃতীয় মতটা মাতুরিদি ও হানাফিদের। যদিও এইটা প্রথম মতের সাথে ওভারল্যাপিং, বাট দুই মতের মাঝে কিছু অনুসিদ্ধান্তগত তফাতের কারণে, এইটা আলাদা একটা মত হিশাবে গ্রহণযোগ্যতা পাইছে; যা মূলত প্রথম দুই মতের একটা মিক্সচার। মাতুরিদিদের মত এই যে, শরিয়ত আসার আগেই, অনেক কাজের মধ্যে সত্তাগতভাবেই ভালত্ব বা খারাপি থাকে এবং তা আকল দিয়া বোঝা যায়। তবে, এই ভালত্ব বা খারাপির কারণে, কোন কাজ বান্দার উপর আবশ্যক/অনাবশ্যক হয় না; সেটা হয় শরিয়ত বা খোদার আদেশের মাধ্যমে। এবং, শরিয়ত আসার আগে, বান্দার কোন কাজের জন্য আখেরাতের বিচার বরাদ্দ হবে না, যদিও তার ভালত্ব/খারাপি আকল দিয়াই বোঝা যায়। (খালেদ রমজান হাসান, মু'জামু উসুলিল ফিকহ, পৃ. ১০৮)

ফলে, মুতাযিলাদের সাথে মাতুরিদিদের ফারাক হইল:

১. মুতাযিলাদের মতে, আকল দিয়া কোন জিনিশের ভালত্ব/খারাপি বোঝামাত্রই, বান্দার জন্য ওই কাজ করা/না করা আবশ্যক। মাতুরিদিদের মতে, আকল দিয়া বোঝার পরে, সেটা করা/না করা আবশ্যক তখনই হবে, যখন শরিয়ত আসবে। কারণ, موجب বা কোন কাজ আবশ্যক করার অথরিটি একমাত্র খোদার, তবে তার আদেশ বোঝার একটা উপায় হইল আকল। যেমন, নবি-রাসুলও মূলত খোদার বিধান বোঝা বা জানার উপায়মাত্র। অর্থাৎ, আকল বা বিবেক মূলত খোদার হুকুমই ব্যাখ্যা করে; আর খোদা তার হুকুম জানার একটা মাধ্যম হিশেবেই মানুশরে আকল দিছেন।

২. মাতুরিদিদের মতে, শরিয়ত আসার আগে, কোন কাজের ভালত্ব/খারাপি বোঝা গেলেও, ওই কাজ করা/না করার উপর আখেরাতের বিচার প্রযোজ্য হবে না। মুতাযিলাদের মতে: হবে।

৩. মুতাযিলাদের মতে, সব কাজেরই ভালমন্দ আকল দিয়া বোঝা সম্ভব। মাতুরিদিদের মতে, সম্ভব না।

অন্যদিকে, আশ'আরিদের সাথে মাতুরিদি ও হানাফিদের ফারাক এই যে:

১. শরিয়ত আসার আগে, আল্লাহ প্রদত্ত ইলমের মাধ্যমে, যেকোন জিনিশের ভাল-মন্দ আকল দিয়া বোঝা যায়, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এটা বোঝা জরুরি৷ যেমন: খোদার শরিয়ত তো আমাদের জানান রাসুল। বাট রাসুল যে আসলেও রাসুল, এটা আমরা কীভাবে বুঝব? রাসুল যে আসলেই রাসুল— এটা প্রমাণ না হইলে শরিয়ত প্রমাণ হয় না। আর শরিয়ত প্রমাণ না হইলে, আশ'আরিদের মতে, আমাদের কিছুই মানা/না মানা আবশ্যক না; এমনকি রাসুলরে স্বীকার করাও আবশ্যক না। ফলে, এইখানে একটা প্যারাডক্স তৈয়ার হয়। আগে প্রমাণ হইতে হয় যে, রাসুল আসলেই রাসুল। এইটা আমরা বুঝি আকল দিয়াই। ফলে, শরিয়ত আসার আগে, আমাদের আকল দিয়া অনেক কিছুরই ভালমন্দ বোঝা সম্ভব, বরং উচিত। নাইলে খোদ শরিয়তই আমরা বুঝব না।

২. শরিয়ত আসার পরে, শরিয়তের প্রত্যেকটা কাজের হেকমত বা ভালমন্দ বোঝার জন্য আকল ব্যবহার করা লাগবে। আকলরে নিষ্ক্রিয় রাইখা, শুধু শরিয়ত দিয়া শরিয়তের মানশা বোঝা যাবে না। (বাবারতি, শরহু ওসিয়্যাতি আবি হানিফা, পৃ. ৫৪-৫৫; ইবনুল হুমাম, আল মুসামারাহ শরহুল মুসাইয়ারাহ, পৃ. ১৮৩; কাসেম বিন কুতলুবুগা, হাশিয়াতুল মুসাইয়ারাহ, পৃ. ১৭৬)।

এই উসুলের কারণেই, ইমাম আবু হানিফা বলছিলেন: 'আসমান-যমিনের সৃষ্টিরহস্য, নিজের শরীর ও আত্মার গঠনকাঠামো ও অন্যান্য জিনিশের গঠন-প্রকৌশল দেখার পরে, নিজের স্রষ্টার ব্যাপারে অজ্ঞ থাকার কোন অজুহাত দেওয়া সম্ভব না।' অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি বলছেন: বকোন একজন রাসুল না আসলেও, বিবেক কাজে লাগাইয়া স্রষ্টারে চেনা মানুশের জন্য আবশ্যক।' আর বেশিরভাগ হানাফি ও মাতুরিদি ইমামরা এটাই বলেন। (হাকিম শহিদের (মৃ. ৩৩৪ হি.) 'আল মুনতাকা'র বরাতে বাবারতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫)

যদিও, পরবর্তীতে ইমাম আবু হানিফার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া, আশ'আরিদের সাথে সমঝোতাপন্থী অনেক হানাফি ও মাতুরিদি ইমামদের অনেকেই বলছেন: এখানে 'আবশ্যক' মানে হইল: উচিত। অর্থাৎ, রাসুল না আসলেও আকল দিয়া খোদায় ঈমান আনা, না আনার চাইতে ভাল এবং উচিত; তবে, যদি না আনে/আনে, এর ভিত্তিতে আখেরাতে কোন সাজা সে পাবে না। (বাবারতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯)

৪.

আগের আলাপ ফিরি।

যারা বলেন, খোদায়ি বিধান পালনের আগেই রহিত করা অযৌক্তিক, তাদের যুক্তি এই যে: আল্লাহ যদি কোন লোককে কোন নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট একটা কাজ করতে বলেন, তার মানে কাজটা ভাল। কিন্তু পরেপরেই, কাজটা করার আগেই যদি আবার নিষেধ করেন, তার মানে কাজটা খারাপ। এখন, একটা কাজ একই সময়ে ভাল/খারাপ হওয়া তো সম্ভব না। ফলে, এখানে দুইটা অনুসিদ্ধান্তের একটাতে বিশ্বাস করা লাগে আমাদের: এক. আল্লাহ কাজটার ভাল/খারাপ ন্যাচারের ব্যাপারে অবগত হয়েই এই দুই ধরনের আদেশ দিতেছেন। সেক্ষেত্রে বলা লাগে: তিনি একটা খারাপ কাজের আদেশ দিতেছেন, বা ভাল কাজ করতে নিষেধ করতেছেন। দুই. আল্লাহ জানেনই না কাজটা ভাল/খারাপ (নাউজুবিল্লাহ)। এই প্যারাডক্সের কারণে, এইটা বলাই বেটার যে, আল্লাহ সরাসরি জবাইয়ের আদেশ দেন নাই, ফলে রহিত করারও কোন ব্যাপার নাই।

অন্যদিকে যারা বলেন, বিধান পালনের আগেও রহিত করা বৈধ ও যৌক্তিক, তাদের পালটা যুক্তি হইল: আকল বা লজিক দিয়াই যেকোন কাজের ভালমন্দ নির্ধারণ করার যে পন্থা, তার উপর ভিত্তি করে আগে থেকেই কোন কাজরে ভাল/মন্দ বলা হয়। কিন্তু এটা গ্রহণযোগ্য না; ওহির ক্ষেত্রে এটা সবসময় খাটে না। তবু, ভাল/মন্দের তর্কটা ধইরা নিয়াও বলা যায় যে, আল্লাহ সবসময় কেবল 'ভাল' ও 'কাম্য' জিনিশের আদেশ করেন তা না; তিনি এমন কাজের আদেশও দিতে পারেন, যা 'ভাল' না, এবং যার বাস্তবায়নও উনি চান না, কিন্তু অন্য কোন কারণে তিনি আদেশটা করেন (ইব্রাহিমের ক্ষেত্রে কারণ হইল: তারে যাচাই করা)। ফলে, এই মতের ওলামারা আরো একটা মূলনীতি তৈয়ার করছেন। সেটা হল: আল্লাহ এমন কাজের আদেশ দিতে পারেন, যার বাস্তবায়ন উনি চান না; বাস্তবায়নের বাইরে, ওই আদেশের উদ্দেশ্য ভিন্ন। (তাফসিরে রাযি, ২৬/১৫৫-৫৬, দারুল ফিকর)

এইখানে কিছু জরুরি নুকতা দিয়া রাখা লাগে। ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি কালামশাস্ত্রের বিশাল বড় ইমাম, যারে 'ইমামুল মুতাকাল্লেমিন' বলা হয়৷ তিনি লিগাল আসপেক্টে শাফেয়ি ও কালামি আসপেক্টে আশ'আরি ঘরানার অনুসারী। উপরে আমরা মুতাযেলি ও আশ'আরিদের যে মত বলছি, এইটা ছিল দুই মাজহাবের শুরুর দিকের তাত্ত্বিকদের মত। সময়ের সাথে সাথে, বিশেষত মাতুরিদিদের মধ্যস্থতায়, এই দুই মত কাছাকাছি আসে; এবং মুতাযেলি ও আশ'আরি উভয় দলই, নিজেদের মতামতে কিছু ছাড় দেন। এই ছাড়ের ক্ষেত্রে, মুতাযেলিদের মধ্যে প্রধানত অবদান রাখেন আফগানিস্তানের বিখ্যাত মুতাযেলি ফকিহ ও কালামবিদ কাযিল কুযাত আব্দুল জব্বার (৩৫৯-৪১৫ হি.); এবং আশ'আরিদের মধ্যে প্রধানত অবদান রাখেন ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি।

কাযি আব্দুল জব্বার বলেন যে, কোন কাজ পুরাপুরি সত্তাগতভাবেই ভাল/খারাপ হয় না; এর সাথে নানান বহিরাগত কারণ যুক্ত হওয়ার ফলেই তা ভাল/খারাপ হয়। (আল মুগনি, ১৩/২১৬-১৭, ২২৯) এবং, তার এই মতই পরবর্তীতে মুতাযেলিরা মাইনা নেন। আশ'আরিদের যুক্তি ছিল এটাই যে, ভালমন্দ খোদ কাজের মধ্যে থাকে না, এটা অন্য কোন বহিরাগত পরিস্থিতির কারণে যেকোন কাজের সাথে প্রযুক্ত হয়। ফলে এই মতের মাধ্যমে মুতাযেলিরা আশ'আরিদের মতের কিছুটা কাছাকাছি আসে।

অন্যদিকে, আশ'আরিদের মধ্যে ইমাম রাযি এইক্ষেত্রে বারবার মত ও চিন্তা চেঞ্জ করেন। তাফসিরে রাযির বরাতে উপরে যে যুক্তিতর্ক আমরা দেখলাম, তাতে বোঝা যায়, এই তাফসির লেখার সময় উনি আশ'আরিদের ডোমিন্যান্ট মতেই বিশ্বাস করতেন যে, আকল দিয়া কোন কাজের ভাল-মন্দ নির্ধারণ করা যায় না, এটা বাতিল মত। তবে, কালে কালে তার এই চিন্তায় পরিবর্তন আসে; এবং এই পরিবর্তনে আশ'আরি চিন্তাধারাও প্রভাবিত হয়।

রাযির আগে, ক্লাসিকাল আশ'আরি আলেমরা মানুশের কাজের 'ভাল/মন্দ' হওয়ারে দুইভাবে দেখতেন। এক. যেকোন কাজ ভাল/মন্দ হওয়ার অর্থ এই যে, কোন কাজে ব্যক্তি/সমাজের জন্য ফায়দা থাকা (ফলে তা ভাল); আর কোন কাজে ক্ষতি থাকা (ফলে তা খারাপ)। এই অর্থে, যেকোন কাজের ভালমন্দ আকল দিয়াই বোঝা যায়, এক্ষেত্রে কোন মতভেদ নাই। দুই. যেকোন কাজ ভালমন্দ হওয়ার আরেক অর্থ এই যে, এই কাজ করা/না করার কারণে আখেরাতে পুরষ্কার পাবে/শাস্তি পাবে। এই অর্থে, মুতাযেলিদের সাথে আশ'আরিদের বিরোধ। আশ'আরিদের মতে, শরিয়ত আসার আগে, কোন কাজ করা/না করায় আখেরাতে কোন শাস্তি বা পুরষ্কার নাই।

ইমাম জুওয়াইনি (আল ইরশাদ, পৃ. ২৬৫) বা ইমাম গাযালির (আল ইকতিসাদ ফিল ইতিকাদ, পৃ. ৭৬) মত আশ'আরি আলেমরা কাজের ভাল/মন্দ হওয়ার এই দুই ব্যাখ্যা দিছেন৷ এখানে ভাল/মন্দের প্রথম অর্থ মোতাবেক মুতাযিলাদের সাথে তাদের বাহ্যত কোন মতবিরোধ না থাকলেও, মুতাযিলাদের সাথে কোন মতের ঐক্যও তৈয়ার হয় নাই আসলে। কারণ, মুতাযিলাদের মতে, কাজের মধ্যে সত্তাগতভাবেই কিছু ভাল/মন্দের ব্যাপার থাকে; কিন্তু আশ'আরিদের প্রথম ব্যাখ্যা এটাই বলে যে, 'উপকার'/'অপকার'র মত বহিরাগত জিনিশের কারণেই আমরা কাজকে ভাল/মন্দ বলি, এর মধ্যে সত্তাগত কোন ভাল/মন্দ নাই।

ইমাম রাযি এইখানে একটা চেঞ্জ আনেন। এই মাসালায় উনার চিন্তা ৩ ধাপে চেঞ্জ হয়৷ শুরুতে উনি ক্ল্যাসিক আশ'আরিদের মতই বিশ্বাস করতেন, কাজের ভালমন্দ পুরাপুরি শরিয়তনির্ভর (আল ইশারাহ, পৃ. ৩৩)। সম্ভবত, তাফসিরে রাযি ওই সময়েরই রচনা; তাই দেখতে পাচ্ছি, এখানে উনি মুতাযেলিদের আকলের মাধ্যমে কাজের ভাল-মন্দ বিচাররে 'বাতিল' বলতেছেন। কিন্তু এরপরে রাযি তার মতে চেঞ্জ আনেন; ভাল-খারাপের আরেকটা নয়া অর্থ আবিষ্কার করেন, যা আশ'আরিদের মতরে মুতাযেলিদের কাছাকাছি নিয়া আসে। উপরের দুই অর্থ বাদেও, উনি তৃতীয় আরেকটা অর্থের কথা কন। সেটা এই যে: কোন কাজের ভাল/মন্দ হওয়ার অর্থ এও হইতে পারে যে, ওই কাজের মধ্যে কোন পূর্ণতার গুণ (ফলে ভাল) বা অপূর্ণতার দোষ (ফলে খারাপ) আছে। যেমন: এলেম বা জ্ঞান, আর জাহালত বা মূর্খতা। এই অর্থেও কাজের ভাল/মন্দ আকল দিয়াই বোঝা যায়, কোন শরিয়ত না আসলেও। এই অর্থ মোতাবেক, আশ'আরিরা এই কথা কিছুটা মাইনা নেন যে, কোন কাজের মধ্যে আপেক্ষিক বহিরাগত ইস্যুর কারণে তৈয়ার হওয়া ভাল/মন্দ ছাড়াও, সত্তগত ভালমন্দ থাকতে পারে, এবং তা আকল দিয়া বোঝা যাইতে পারে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াসহ অনেক স্কলারের মতে, রাযিই এই ব্যাখ্যা প্রথম দেন। (মুহাম্মদ সালেহ যারকান, ফখরুদ্দিন রাযি ওয়া আরাউহুল কালামিয়্যা ওয়াল ফালসাফিয়্যা, পৃ. ৫১৫-১৭) ভাল/মন্দের এই অর্থ পরে আশ'আরি স্কুল গ্রহণ কইরা নেয়, এবং এই তিন অর্থে তারা ভালমন্দ ব্যাখ্যা করেন। তবে, এই পর্যায়েও রাযি ক্ল্যাসিক আশ'আরিদের মতই মাইনা নেন এবং বলেন যে: যেহেতু বান্দার কাজ আল্লাহরই তৈরি এবং তার হুকুম মোতাবেক হয়, ফলে বান্দার কোন কাজই সত্তাগতভাবে মন্দ না, এবং শরিয়ত আসার আগে এর ভাল/মন্দ বোঝা যাবে না। ইবনে তাইমিয়া তার এবং আশ'আরিদের এই যুক্তিরে 'জাবরিয়্যাদের মত যুক্তি' এবং মুশরিকদের মত বাতিল যুক্তি বইলা সমালোচনা করেন। (মাজমুউল ফাতাওয়া, ১৬/২৪৬-৪৭)

তবে, জীবনের শেষ দুই বইতে (আল মা'আলিম ফি উসুলিদ দিন এবং আল মাতালিবুল আলিয়া) রাযি আল্লাহর কাজ ও বান্দার কাজের মধ্যে ফারাক করেন এবং বলেন: আল্লাহর কাজের কোন ভাল/মন্দ নাই; তবে বান্দার কাজের আছে এবং তা আকল দিয়াই বোঝা যায়। এক্ষেত্রে উনি কাযি আব্দুল জব্বারের মত পরবর্তী প্রজন্মের মুতাযেলিদের পক্ষে চলে যান। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১৭-১৯)

ফলে, তাফসিরে রাযিতে হযরত ইব্রাহিমের প্রতি আল্লাহর আদেশের ভালমন্দ বিশ্লেষণ করতে গিয়া তিনি আকলের মাধ্যমে ভালমন্দ নির্ণয় নিয়া যা বলছেন, তা তার শেষকথা না, এটা বোঝাই যায়৷

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এই মাসালায় মুতাযিলা ও আশ'আরি— দুই গ্রুপেরই সমালোচনা করছেন। এবং এ ব্যাপারে সঠিক মত বলতে গিয়া, হযরত ইব্রাহিমের প্রতি খোদার আদেশের হাকিকতও ব্যাখ্যা করছেন। উনার মতে, সঠিক ব্যাখ্যা এই যে: বান্দার কাজ মূলত ৩ ধরনের:

 ১. যে কাজে বান্দার কোন উপকার/ক্ষতি থাকে। এর ভালমন্দ শরিয়ত আসার আগেই আকল দিয়া বোঝা যায়। তবে, শরিয়ত আসার আগে বান্দা ওই কাজ করার কারণে আখেরাতে গুনাহগার/সওয়াবের উপযুক্ত হবে না। এক্ষেত্রে শাইখুল ইসলামের মত মাতুরিদিদের সাথে মিলে যায়।

 ২. শরিয়ত কোন কাজের আদেশ দিলে বা কোন কাজ করতে নিষেধ করলে, তা ভাল/মন্দ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে, কোন কোন কাজের মধ্যে শরিয়তের হুকুমের মাধ্যমেই ভাল/খারাপের বৈশিষ্ট্য সত্তাগতভাবেই প্রযুক্ত হয়। মাতুরিদিরাও তাই বলেন; এবং মাতুরিদিদের মতে, শরিয়তের হুকুমের ফলে ভাল/মন্দ হওয়া কাজের ভাল/মন্দ আকল দিয়াও বোঝা যায়।

৩. কিছু কিছু আদেশ আল্লাহ দেন পরীক্ষার জন্য; কাজটা আসলেই বান্দা করবে, এজন্য না। এর উদাহরণ হিশেবে উনি হযরত ইব্রাহিমের প্রতি খোদার আদেশের কথা বলেন। এক্ষেত্রে, ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি, মাতুরিদিসহ অন্যান্য ওলামার এই মতের সাথে তার মত মিলে যায়, যে: আল্লাহ বান্দারে এমন আদেশ দিতে পারেন, যা যুক্তিগ্রাহ্য না, এবং যার বাস্তবায়নই আসলে আল্লাহ চান না; বরং এসব আদেশের উদ্দেশ্য হয় ভিন্নকিছু (যেমন: পরীক্ষা ইত্যাদি)।

ইবনে তাইমিয়ার মতে, মুতাযেলিদের সমস্যা হইল: তারা এই লাস্টের দুইটা প্রকার বোঝে নাই, ফলে সব কাজরে, শরিয়তের বিধানের বাইরেই, আকল দিয়া ভাল/মন্দ হিশেবে রায় দেওয়ার কথা বলছে। অন্যদিকে, আশ'আরিদের কাছে পুরা শরিয়তটাই হয়ে গেছে এমতেহানের মত। অর্থাৎ, তাদের মতে শরিয়ত আসার আগে হোক বা পরে, কোন কাজের মধ্যে সত্তাগত কোন ভালত্ব/খারাপি আসে না, এবং আকল দিয়ে কোন কাজেরই ভাল/খারাপি বোঝা যায় না। ফলে আল্লাহর সব হুকুমই, তাদের মতে, বান্দার প্রতি একটা পরীক্ষা; যেন খোদ ওই কাজের মধ্যে বান্দার জন্য কোন ভালত্ব/খারাপি নাই। (মাজমুউল ফাতওয়া, ৮/৪৩৪-৪৩৬)

৫.

দেখা গেল, হযরত ইব্রাহিমের প্রতি আল্লাহর আদেশটি পর্যালোচনা করতে গিয়ে মুসলিম স্কলাররা মূল আদেশের ধরন এবং সেই আদেশ আসলে পালন হইল কিনা পুরাপুরি, না হইলে আদেশ কেন দেওয়া হইল, এই আদেশটি তাইলে কেমন, আল্লাহ আসলে এমন আদেশ দিতে পারেন কিনা— এসব নিয়া বিতর্ক করতেছেন৷ ইমাম কুরতুবির মতে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মত এইটাই যে, আদেশটি পালনের আগেই রহিত করা হইছিল। অর্থাৎ, আল্লাহ এমন আদেশ দিতে পারেন, যার বাস্তবায়ন উনি চান না৷ এবং এসব আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে বান্দার ভাল/মন্দ না, বরং তারে পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। (তাফসিরে কুরতুবি, ৩৭: ১০১-১০৭ দ্র.)

 ফলে, এই সিদ্ধান্তে আমরা খুব সহজেই আসতে পারি যে:

 ১. হযরত ইব্রাহিমের স্বপ্ন কোন শরয়ী নির্দেশনা হিশেবে আসে নাই। এইটা আসছে একটা পরীক্ষা হিশাবে৷ ফলে এর এবং শুধু নির্দেশনাটাই না, ইবরাহিম ও ইসমাইল/ইসহাক খোদ এই স্বপ্নরে কীভাবে দেখেন বা ব্যাখ্যা করেন, তাও ছিল এই পরীক্ষারই অন্তর্ভুক্ত।

২. এর প্রমাণ হইল, আল্লাহ বলছেন, 'তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তরিত করলে।' এই এক্সপ্রেশন গুরুত্বপূর্ণ।

 এখানে, নবীদের স্বপ্ন ওহি বললেই তর্কটি শেষ হয় না। কারণ, নবিদের স্বপ্ন ওহি বটে, কিন্তু তার বহু স্তর আছে; নানা রকম আছে। আল্লামা ফখরুদ্দিন রাযি দেখাচ্ছেন, নবী-রাসুলদের স্বপ্ন সত্য হইলেও, তার তিনটা স্তর আছে:

ক. কোন কোন ক্ষেত্রে স্বপ্ন হুবহু বাস্তবায়িত হয়। যেমন: নবিজির মসজিদে হারামে প্রবেশের স্বপ্ন (সুরা ফাতহ, আয়াত ২৭)।
খ. কোন কোন ক্ষেত্রে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় না; যেমন: হযরত ইবরাহিমের স্বপ্ন।
গ. কোন কোন ক্ষেত্রে স্বপ্নে নানারকম রূপক দেখানো হয়, যা ব্যাখ্যা কইরা স্বপ্নের আসল অর্থের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া লাগে। যেমন: হযরত ইউসুফের স্বপ্ন।

বোঝা যায়, নবীদের স্বপ্ন ঐশী প্রত্যাদেশ হইলেও, তার বিভিন্ন রকমফের আছে। নবি নিজেও নিজের স্বপ্ন নিয়া কনফিউজড হইতে পারেন। তাফসিরের বড় বড় প্রায় সবগুলা কিতাবে এই বর্ণনা পাওয়া যায় যে: হযরত ইব্রাহিম প্রথমে স্বপ্নটিরে শয়তানি স্বপ্ন ভাবছিলেন, ওয়াসওয়াসা ভাবছিলেন, খুব স্বাভাবিক কারণেই। পরপর তিনদিন স্বপ্নটি দেখার পর, উনি স্থির সিদ্ধান্তে আসেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসছে। তাইলে, খোদ স্বপ্নটারে হযরত ইব্রাহিম কীভাবে নিলেন, তার পুত্র কীভাবে নিলেন, সেটাও এই টেস্টেরই একটা অংশ।

আর সেজন্যেই, এই পুরা টেস্টে পাশের সার্টিফিকেট দেওয়া হইছে এভাবে: ইব্রাহিম, তুমি তো স্বপ্ন সত্য করলে! আল্লাহ কথাটা আরো অনেকভাবে কইতে পারতেন। যদি জবেহ করাটাই মূল ব্যাপার হইত, এভাবে বলা যাইত: তুমি তো পুত্রকে জবাই করেই দেখালে! তার বদলে, 'স্বপ্ন বাস্তবায়িত করলে'র দ্বারা বোঝা যায়, হযরত ইব্রাহিমের স্বপ্নটিও এই পুরা এপিসোডে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, মোটেই গৌণ নয়।

৩. এই টেস্টের ক্ষেত্রে, যে কাজের আদেশ খোদা দিছেন, তার বাস্তবায়ন তিনি চান নাই। যেহেতু আদেশের বাস্তবায়ন চান নাই, ফলে খোদ আদেশটারেও তিনি বান্দার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া, একটা ইশারা বা ইঙ্গিত, যা বান্দার সলভ করা লাগবে, একটা স্বপ্ন, যা বান্দার সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা লাগবে— এভাবে প্রকাশ করছেন।

৪. মোরাল ফিলোসফির জায়গা থেকে দেখলে, কাজটা কেমন? এই তর্ক তোলা যায়। স্বাভাবিকভাবে কাজটা কষ্টকর, নিষ্ঠুর। সেজন্যেই ইব্রাহিম শুরুতে এটারে শয়তানের ওয়াসওয়াসা ভাবছিলেন। তাতে আল্লাহ নাখোশ হইছেন, এমন কোন বয়ান আমরা পাই না।

খোদা এই কাজের আদেশ দেওয়া মানেই যে এর বাস্তবায়ন চাওয়া— তা কিন্তু না। ইবনে তাইমিয়া, আবু মনসুর মাতুরিদিসহ আলেমদের বড় একটা গ্রুপ একমত যে, তিনি এর বাস্তবায়ন চান নাই, তাই তিনি আদেশ পালনের আগেই রহিত করছেন। আর মুতাযেলাসহ ওলামাদের অন্য এক গ্রুপের মতে, স্বপ্নে তিনি 'নাফসুজ জাবহ' বা 'জবাই'র আদেশ দ্যান নাই; বরং 'প্রায় জবাই'র আদেশ দিছেন। কারণ: এক. এই কাজটা খারাপ, ফলে আল্লাহ এর আদেশ দিতে পারেন না। দুই. আল্লাহ বলছেন: 'তুমি স্বপ্ন সত্য করে দেখালে', অথচ তখনও জবাই হয় নাই। এদের এই প্রশ্নের উত্তরেই ইমাম রাযি ও ইবনে তাইমিয়ারা বলছেন যে: এখানে মূলত পরীক্ষা বা আদেশটাই উদ্দেশ্য, কী আদেশ করা হইছে তা বা তার বাস্তবায়ন না। ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি এখানে আরেকটা জরুরি কথা বলছেন। ইসমাইল বলছিলেন: 'আল্লাহ চাইলে আপনি আমারে ধৈর্যশীল পাবেন।' আল্লাহ ইসমাইলরে জবাইয়ের আদেশ দেওয়া মানে তো, তারে ধৈর্যশীল হওয়ারও আদেশ দেওয়া। তাইলে ইসমাইল 'ইন শা আল্লাহ' বা 'আল্লাহ চাইলে' কেন বললেন? মাতুরিদি বলেন যে, এ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ কোন কাজের আদেশ করলেই তা নাও চাইতে পারেন। (তাফসিরুল মাতুরিদি, ৮/৫৭৮)

এখন, আল্লাহ কি খারাপ কাজের মাধ্যমে আনুগত্য চাইতে পারেন? নির্দোষ পুত্রকে হত্যার মাধ্যমে? আল্লাহর এই পরীক্ষার মর্ম সামনের আলাপে আরো খোলাসা করার ট্রাই করব আমরা। আপাতত বলা যায় যে, আল্লাহ যে পুত্রহত্যা চান নাই, তা তো বুঝেই আসে। তিনি দেখতে চাইছেন মুহাব্বতের নজির। এই নজিররে সবসময় ভায়োলেন্সের মোরাল ফিলোসফি দিয়া ব্যাখ্যা করা যায় না। যেমন: আশেকের জন্য মাশুকের হাত কাটা, বা সন্তানরে বাঁচাইতে সাঁতার না জানা মায়ের পানিতে ঝাঁপ দেওয়া, বা শিয়াদের তাজিয়া মিছিল, আধুনিক যমানার বিডিএসএম— এরকম অনেক কিছুরেই পেইন ও ভায়োলেন্সের গতানুগতিক মোরাল ফিলোসফি দিয়া ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রেমের সাথে পেইন ও ভায়োলেন্সের সম্পর্ক চিরকালীন; তারে আমরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন।

তাফসিরের কিতাবাদিতে আছে, হযরত ইব্রাহিম নিজেই ছেলে হওয়ার পর মান্নত করছিলেন, এরে আমি আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করব। ছেলে বড় হওয়ার পর স্বপ্নে সেই মান্নতের ব্যাপারটা তার স্মরণে আনা হয়। ঘটনার এই ভার্শনে হযরত ইব্রাহিমই পুরা এপিসোডের সূত্রপাতকারী। ঘটনা যাই হোক, হযরত ইবরাহিম ও তার পুত্রের ঘটনাটি খোদার 'গৌণ' বা 'প্যাসিভ আদেশ'রে (ইফতেখার জামিলের লেখা থেকে এক্সপ্রেশনটি ধার করলাম) নিজেদের সিদ্ধান্তে নিজেদের জীবনে 'অ্যাক্টিভ' বা বাস্তবায়িত করার নমুনা হিশেবেই পাঠ করা যায়। আল্লাহর স্পষ্ট হুকুম পালন করা তো সকলের জন্যেই ফরজ; এটা কইরা কেউ 'খলিল' হয় না৷ ইব্রাহিম এইজন্যেই খলিল যে, আল্লাহর গৌন ইচ্ছারে তিনি নিজের ব্যাখ্যা ও কর্মের মাধ্যমে মূখ্য করে তুলছেন (অন্য ব্যাখ্যামতে তিনি নিজেই এই ইচ্ছা আল্লাহর দরবারে পেশ করছেন, মান্নতের সুরতে); অর্থাৎ, খোদার কুরবানি পাওয়ার ইচ্ছা না শুধু, এই ঘটনা একইসাথে সমানভাবে মানুশের কুরবান হওয়ারও ইচ্ছা।

ইসলামের মোরাল ফিলোসফিতে ইব্রাহিমের ঘটনার আউটপুট কী? মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জীবন বাঁচানোর জন্য কুফরি কথা বলা জায়েজ আছে ইসলামি শরিয়তে। কিন্তু কেউ যদি না বলে? সাহাবিদের অসংখ্য ঘটনা আছে, জালেম শাসকের সামনে দাঁড়ায়ে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা ঈমানের কলেমা ছাড়েন নাই। ফলে বলা যায়, বান্দারে এ ব্যাপারে রুখসত দিছেন খোদা। নিজের আনুগত্যের জন্য জানের নজরানা দিতে, স্বাভাবিকভাবে মানুশকে বাধ্য করেন নাই তিনি।

হযরত ইব্রাহিমের এই ঘটনার একদম সরাসরি ও ইতিবাচক প্রভাব আছে ইসলামের লিগাল ফিলোসফিতেও। যদি কোন ব্যক্তি তার ছেলেরে আল্লাহর রাহে কোরবানি করার মান্নত করে, তাইলে কী হবে? মান্নত পুরা করা লাগবে (মান্নত পুরা করা আবশ্যক)? ইমাম আবু হানিফা হযরত ইব্রাহিমের ঘটনার দলিল দিয়া বলেন, না, লাগবে না। পশু জবাই দিলেই হবে। (তাফসিরুল মাতুরিদি, ৮/৫৮০)

 

[ ফরহাদ মজহার কোরবানি নিয়ে লিখছেন। লেখাটি চলমান। এ পর্যন্ত চার কিস্তি লিখেছেন যা এখানে চিন্তা ওয়েবজিনে পাঠক পাবেন। দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশের পর কিছু তর্ক ওঠে। যে সকল বিষয়ে আপত্তি উঠেছে তুহিন খান ফেইসবুকে তার এ লেখায় পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। পাঠকের জন্য সুলভ করার জন্য আমরা লেখাটি এখানে পুনর্মুদ্রিত করছি। তুহিন খান রেফারেন্সগুলো হালনাগাদ করে দিয়েছেন, তাঁকে অসংখ্য ধন্যব্দ। ।  যারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা ও পর্যালোচনায় আগ্রহী, তারা স্বাগতম। যারা তাদের নিজেদের বোঝাবুঝির জায়গা থেকে সমালোচনা করছেন তারাও ধন্যবাদের পাত্র। আশা করি আলোচনা অব্যাহত থাকবে]

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।