১. বেগম খালেদা জিয়া এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ


খুবই দৃশ্যমান ভাবে -- অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণকে দেখিয়ে দেখিয়ে এবং জনগণের সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে 'হত্যা' করা হচ্ছে। বলাবাহুল্য 'হত্যা'র এই প্রক্রিয়া বা কাণ্ডটিকে যার যার মর্জি মাফিক স্রেফ মেটাফোর হিশাবে, কিম্বা বাস্তবেই ঘটানো হচ্ছে বলে নানান জনে নানান ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন, অসুবিধা নাই। তাই সকলে যেন নিজের নিজের অনুমান ও ধারনাগুলোর প্রতি ঘনিষ্ঠ ভাবে ফিরে তাকাতে পারেন সেটাই আমরা চাই। এতে আমি যে বিষয়ের অবতারণা করতে চাই তার জেরজবরে বিশেষ ভেদ হবে না।আইন ও রাজনীতির বিবিধ অনুমান নিয়ে জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তোলা জরুরী।

বেগম খালেদা জিয়া হত্যা প্রক্রিয়ার কর্তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তার জোট, কিন্তু অংশগ্রহণকারী আমরা সকলেই। ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে বৈধতা দেবার জন্য বিএনপির কিছু নেতা জাতীয় সংসদে রয়েছেন। ফ্যসিস্ট শক্তির প্রণীত আইন, তাদেরই সংশোপধিত সংবিধান এবং তাদেরই আদালতে বিএনপি সুবিচার পাবে বিএনপি আমাদের সেটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। যা খুবই বিস্ময়কর। ক্ষমতাসীনদের দ্বারা এই দৃশ্যমান হত্যা প্রক্রিয়া দেখেও জাতীয় সংসদে থেকে বিএনপি ফ্যসিস্ট ক্ষমতা বৈধ করণের ভূমিকা ত্যাগ করেন নি। অর্থাৎ প্রতিবাদে তারা জাতীয় সংসদ থেকে বেরিয়ে আসেন নি। অর্থাৎ জনগণের সঙ্গে থেকে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আদর্শিক, রাজনৈতিক কিম্বা কর্মসূচিগত ভাবে চ্যালেঞ্জ করে নি বিএনপি। বিষয়টি তো তত্ত্ববাধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা বা না করার তর্ক না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত এবং বেগম খালেদা জিয়াকে জনগণের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্ত করে আনার মামলা। কেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ এই অবস্থান নেন নি, তার ব্যাখ্যা তাদের অবশ্যই একদিন না একদিন দিতে হবে।

এটা আমার থিসিস না যে বেগম খালেদা জিয়াকে বন্দী অবস্থায় বিষ খাওয়ানো হয়েছে যা কেউ বুঝছে না, শুধু আমিই বুঝে গিয়েছি। সরি, আমার মাথা এতো উর্বর না। কিম্বা এটা আমার দুর্বলতাও হতে পারে যে আমি কোন কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করি না। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সমকালীন ঘটনাঘটন বোঝার অক্ষমতা থেকে তৈরি হয়। এটাও সত্য চলমান ইতিহাসের মধ্যে আমরা যখন বাস করি তখন চলমান ইতিহাসের বহুকিছুই আমাদের বুদ্ধি ও বিচারের আড়ালে থেকে যায়। সেটা আমরা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, গুজব কিম্বা নানা প্রকার আজগবি যুক্তি খাটিয়ে জোড়াতালি দিয়ে থাকি। এটা করলে সমাজ ও জনগোষ্ঠি মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে পড়ে। কিন্তু আমার ইচ্ছা এগিয়ে যাওয়া। পিছিয়ে পড়ে থাকা না।

বিএনপির রাজনীতি নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হতে পারে, তবে বেগম খালেদা জিয়া মূলত নয়-এগারোর পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের রাজনৈতিক ভিক্টিম। তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, সাজা দেওয়া এবং এখন চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে না দিয়ে মেরে ফেলার প্রক্রিয়া জারি রাখাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোকে বুঝতে হবে। সেই আলোকেই তাঁর রাজনৈতিক ব্যর্থতারও বিচার করতে হবে কারণ বাংলাদেশের জনগণকে পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়েই মেরুদণ্ড সিধা করে দাঁড়াতে হবে।

দুই হাজার একের নির্বাচনে বিএনপি যখন ক্ষমতায় এল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে আলাদা ভাবে আমরা আলোচনা করব। তারপরও তিনি এতোদিন কিভাবে বেঁচে আছেন সেটা একটা বিস্ময়। পরাশক্তি গুলোর 'ব্যাটলিং বেগম' থিওরি সম্পর্কে আগে আমার ধারণা ছিল সেটা বাংলাদেশের 'মাইনাস টু' রাজনৈতিক প্রকল্পেরই অংশ। এই থিওরি অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার প্রধান কারণ দুই নেত্রীর ঝগড়া। এই থিওরি অনুযায়ী এক এগারোর কর্ম পরিকল্পনায় 'মাইনাস টু' মানে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা উভয়কেই রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় করে দেবার বন্দোবস্ত পাকাপাকি করা। কিন্তু দুই হাজার আটের নির্বাচনে আমরা বুঝলাম শুধু খালেদা জিয়াকেই আগাগোড়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রধান টার্গেট করা হয়েছিল। তাঁর বিষয়ে বাংলাদেশের বিদেশি দূতাবাসগুলোর নির্লিপ্ততা ও ভূমিকা দেখে বোঝা যায় এই হত্যা প্রক্রিয়ায় পরাশক্তিরও সানন্দ সায় আছে। বাংলাদেশের জনগণকে বাদ দিয়ে বা উপেক্ষা করে পরাশক্তি বা দূতাবাসকেন্দ্রিক রাজনীতির পরিণতি কি হতে পারা সেটা বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান বিএনপির অবশ্যই থাকা উচিত।

খালেদা জিয়ার প্রশ্নে আমরা নিজেদের দুই ভাগে ভাগ করতে পারি।

একপক্ষের দাবি তিনি আইন মোতাবেক বিচারে দণ্ড পেয়েছেন। কিন্তু যে আইনের কথা ক্ষমতাসীনেরা বলে সেটা কি আদৌ কোন 'আইন'? ধরা যাক 'আইন' বটে'। তাহলে কার আইন? কিভাবে এই আইন কায়েম ও বলবৎযোগ্য হোল? কোন অর্থে আইন? কেন এই আইন সকলের মানা বাধ্যতামূলক? ইত্যাদি খুবই গোড়ার কিন্তু অতি গুরুতর প্রশ্ন তুললে আমরা বুঝব কিভাবে 'আইন'  এই হত্যা প্রক্রিয়ায় প্রধান অস্ত্র হিশাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশের সংবিধান দাবি করে সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। বেশ। অন্য সকল আইন এই 'সর্বোচ্চ আইন'-এর অধীন। তাহলে সংবিধানের আলোকে যে আইন ও প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে তার পর্যালোচনা হতে পারে। সেটা কিভাবে সম্ভব? বাংলাদেশের সংবিধান নিজের সম্পর্কে দাবি করে যে এটি "জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যাক্তি" (দেখুন অনুচ্ছেদ ৭(২)। তাহলে আমাদের জানতে হবে কিভাবে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় আইনের রূপ পরিগ্রহণ করে? অন্যদিকে কিভাবে 'আইন' ভুত হয়ে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের টুঁটি টিপে ধরে?

বাংলাদেশে 'আইন' একটা ভুতুড়ে শক্তি, চাইলে যে কারো ঘাড় মটকে দেওয়া যায়। তাই আইনে খালেদার সাজা হয়েছে বলার অর্থ ভুতও এই হত্যা প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখছে। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় সংক্রান্ত গুরুতর দিকের পর্যালোচনা হলেই কেবল আমরা বুঝতাম 'আইন'এর দোহাই দিয়ে কিভাবে একজন নাগরিকের চিকিৎসা পাবার অধিকার অস্বীকার করে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সংবিধান ও আইনের পর্যালোচনা করলেই আমরা বুঝতাম খালেদা জিয়াকে সাজার বিধান ও প্রক্রিয়া আদৌ জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়েরই পরম অভিব্যাক্তি' কিনা। যদি হয় তাহলে এ ব্যাপারে আমাদের আর কিছু বলার নাই। তাঁকে শাস্তি পেতে হবে এবং চিকিৎসা না পেয়ে মরতে হবে।

আমাদের তাই গোড়ায় জিজ্ঞাসায় ফিরতে হবে। 'জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়' মানে কী? কিভাবে সেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায় আমরা বুঝব? বোঝার প্রক্রিয়া কেমন হতে পারে? সেই প্রক্রিয়া এবং তার ইতিহাস বিচারের দ্বারাই আমরা বিদ্যমান সংবিধান এবং আইন নিয়ে ওঠা বিবিধ প্রশ্নের নিষ্পত্তি করতে পারি। নইলে কি করে বুঝব এবং সকলে একমত হব যে বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান আসলেই "বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যাক্তি"। তাই না?

বলেছি আইন বাংলাদেশে ভুতের কারবার। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ তম সংশোধনীর কারনে এই সকল গোড়ার গুরুতর প্রশ্নের পর্যালোচনার কোন সুযোগই নাই। দুই হাজার এগারো সালের ৩০শে জুন সংসদে পাশ হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনী এর কারন। এই সংশোধনী সম্পর্কে ডঃ কামাল হোসেন বলেছেন এই সংশোধনীর কারনে "সংবিধানের ব্যাখ্যা করা বা এ নিয়ে আলোচনা করাও এখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে"। তাঁর উদ্ধৃতি দিলাম, কারন তাঁকে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা বলা হয়। অর্থাৎ আমরা চাইলেও বিদ্যমান আইন আদৌ 'আইন' কিনা সে নিয়ে কোন আলোচনাও করতে পারব না। সেটাও জাতীয় সংসদে বিল পাশ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

আইন দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনের পর্যালোচনা নিষিদ্ধ করা এক দারুন ঘটনা।

পর্যালোচনা নিষিদ্ধ থাকার কারণে তাই শুরুতেই এটা পরিষ্কার বলা যায় খালেদা জিয়াকে আইন মোতাবেক বিচার করে দণ্ড দেওয়া হয়েছে এই দাবি ঠিক না। নিশ্চিত ভাবে এ কথা বলার কোন সুযোগই নাই। খালেদা জিয়াকে আইন মোতাবেক বিচার করে দণ্ড দেওয়া হয়েছে এটা একটা মীথ। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা চর্চার গল্প। 'আইন' সম্পর্কে তাদের নিজেদের ক্ষমতার প্রচার ও প্রপাগাণ্ডা। তাদের গল্পকে ভূয়া ও প্রপাগান্ডা হিশাবে আলোচনা ও প্রমাণ করাকেও তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিশাবে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে বন্ধ করে রেখেছে। ফলে আমরা একটা আইনী গহ্বরে পড়ে গিয়েছি। চরম ঝুঁকি নিয়ে হলেও এই সত্য কথাটি বলতে না পারলে আমরা আমাদের বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব। যদি খালেদা জিয়া না হয়ে আজ একই অন্যায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা হোত, তাহলে এক এগারোর মতো আমি শেখ হাসিনার পক্ষে একই কথা বলতাম। কোন হেরফের হোত না। তাছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান একজন ব্যাক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভহূত করবার ব্যবস্থা করে রেখেছে। ফলে 'জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়' কথাগুলো সকল প্রকার সাংবিধানিক, আইনী ও রাজনৈতিক তাৎপর্য হারিয়েছে। আইন মোতাবেক আদালতে খালেদা জিয়াকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে এর কোন সারবত্তা নাই। আমরা একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাস করছি।

এবার দ্বিতীয় ভাগ বা দ্বিতীয় পক্ষের কথায় আসা যাক।

দ্বিতীয় পক্ষ মানবিক কারনে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা চান। ভাল। অর্থাৎ তাঁরা বলতে চান আইন ঠিক আছে, খালেদা জিয়ার শাস্তি বা দণ্ডও ঠিক, কিন্তু তাঁর প্রতি শেখ হসিনার দয়া দেখানো উচিত। বলাবাহুল্য শেখ হাসিনাও তাঁদেরকে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন আদালতে যান, আমার যতোটুকু মানবতা প্রদর্শন করবার আমি করেছি। প্রথম আর দ্বিতীয় পক্ষের মধ্যে আইন, সংবিধান, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোন মতপার্থক্য নাই। ভূত দুই পক্ষেই সমান ভাবে হাজির।

তাই শেষমেষ হত্যাকাণ্ডটি সকলের চোখের সামনেই ঘটছে। এই বিশদ হত্যার প্রক্রিয়া অবলোকন করতে করতে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের নিজেদের অসুখ ও বিকৃতিগুলো আমরা আলোচনা করতে পারব কিনা সেটাই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই শুরুতেই বলি এই হত্যার প্রক্রিয়ায় আমি সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন পক্ষকে দোষী বা দায়ী করবার উদ্দেশ্যে সত্য কথা বলবার দোকা্ন খুলতে বসিনি। কিম্বা কেউ বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি অনুকম্পাবশত কিছু বলছি ভাবলে ভুল করবেন। এতে তাকে অপমান করা হবে। খালেদা জিয়া একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ফলে মৃত্যুকে মোকাবিলা করবার ধৈর্য এবং দুঃসাহস তাঁর আছে। তিনি পরিষ্কার জানেন, যে অপরাধে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে সেটা রাজনৈতিক মামলা। এটাও জানেন তাঁর বিচারটা প্রহসন। তিনি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্য বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থা মেনে নিয়েছেন কিনা আমরা জানি না। তিনি কোন বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের নেতা নন। একটি উদারনৈতিক নির্বাচনসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের প্রধান। অতএব লিবারেল রাজনীতি খেলার নিয়ম মেনে চলতে তিনি বাধ্য। তিনি আদালতে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতো 'হিস্ট্রি উইল এবসল্ভ মি' জাতীয় বিপ্লবী বক্তৃতা দিয়ে ' এই আদালত মানি না ' বলেন নি। সেটা তাঁর রাজনীতির ব্যাকরণ না। শুরুতেই এটা বুঝতে হবে। যদি বুঝি তাহলে জনপগণের বৈপ্লবিক সচেতনতার বিকাশ এবং আন্দোলন-সংগ্রামে বিপুল ভাবে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি প্রধান আইকন হবেন কিনা সেটা আগামি ইতিহাসই বলে দেবে। তবে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে বিএনপির বিশাল একটি দূরত্ব তৈরি হবে -- এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।


আইন মন্ত্রী আনিসুল হক যখন সুমিষ্ট ভাষায় বলেন, খালেদা জিয়া 'মুক্ত'। কিন্তু এ যেমন তেমন 'মুক্ত' না। তিনি জোর দিয়েই বলেন এই মুক্তির 'শর্ত' আছে। খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে পারবেন না। অর্থাৎ ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি পরিষ্কারই বুঝিয়ে দেন যে খালেদা জিয়া 'মুক্ত' নন। অথবা 'মুক্ত' কথাটার মানে আমাদের সকল অভিধান থেকে মুছে দিয়ে আনিসুল হকের উকিলি মুসাবিদা অনুযায়ী পুনর্বার লিখতে হবে। আমাদের নতুন করে বাংলা ভাষা আইন ও রাজনীতির পাঠ নিতে হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক 'মুক্ত' কথাটার শর্তযুক্ত মানে কেন দাঁড় করিয়েছেন কেন সেটা আমরা বুঝি। তিনি বলতে চাইছেন এবং বারবার বলেছেনও যে খালেদা জিয়া সরকারের হেফাজতে নাই। তিনি তাঁর নিজ দায়িত্বে নিজের বাড়িতে আছেন। এর মানে হোল বেগম খালেদা জিয়া যদি এখন মরে যান তখন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের মতো বেরসিক মানবাধিকার কর্মীরা 'পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু' বলে আরেকটি সংখ্যা যোগ করতে পারবে না। য়ানিসুল হকের ইন্টেলিজেন্ট উকিলী বুদ্ধি মানবাধিকার কর্মীরা ভালই বোঝে, আইন মন্ত্রী সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন। । তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিধানে তাঁর যুক্তি খাটবে বলে মনে হয় না।

আমার এই পোস্টটির উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষতস্থানের গভীরে যাবার চেষ্টা করা। আমরা প্রত্যকেই কিভাবে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার সক্রিয় অংশগ্রহণকারী সেটা বোঝানো। সেই জন্য চোখের সামনে ঘটতে থাকা দৃশ্যমান হত্যা প্রক্রিয়ার ব্যবচ্ছেদ দরকার। শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই ২০০৮ সালের রাজনৈতিক ঘটনাঘটনের প্রেক্ষিতে আমি সেই বছর এপ্রিলে লিখেছিলাম বাংলাদেশের জনগন একটা বড় ধরণের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। সেই 'যুদ্ধ আরও কঠিন আরও গভীর'। এই তুলনামূলক উক্তি এক এগারোর ঘটনাবলী -- অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে পরের বছর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পরিপ্রেক্ষিতে বলা। এক এগারোর পরে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহন বাংলাদেশকে একটি দীর্ঘ, কঠিন ও গভীর যুদ্ধে নিক্ষেপ করেছে। এই গহ্বর আগামিতে আরো গভীর হবে।

বাংলাদেশে সংবিধান, আইন, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার একটা বড় সমস্যা হচ্ছে বহু শব্দ আমরা অনর্গল এলোপাথাড়ী ব্যবহার করি সুনির্দিষ্ট ধারণা বা বর্গ হিশাবে আমরা সেটা বুঝি না, বুঝতে চাই না। ফলে গুরুতর জাতীয় বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার কোন 'সামাজিক ভাষা' বাংলাদেশে গড়ে ওঠে নি। 'সামাজিক ভাষা' মানে যে ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধারণা ও বর্গ সম্পর্কে সমাজের চিন্তাশীল অংশ সচেতন এবনহগ নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করতে সক্ষম। সামাজিক তর্কবিতর্কে অংশগ্রহণের ভাষা বিকাশের সঙ্গে সমাজের রাজনোইতিক সচেতনতার মাত্রা বোঝা যায়। সামাজিক তর্কবিতর্ক থেকেই সমাজ যে কোন বিষয়ের জটিল গ্রন্থি ধরতে পারে, বাস্তব সমস্যা সমাধানের দিশা খুঁজে পায়। দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোন বিকশিত সামাজিক ভাষা আজ অবধি গড়ে ওঠে নি।  ফলে গুরুতর জাতীয় বিষয়ে কোন ফলপ্রসূ তর্কবিতর্ক রীতিমতো অসম্ভব বলা যায়। এখন তো সংবিধান পালটিয়ে, ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট নামক আইন বানিয়ে সামাজিক তর্কবতর্ক অসম্ভব করে তোলা হয়েছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে 'ফ্যাসিবাদ', 'ফ্যাসিস্ট শক্তি' এবং 'ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা' নিয়ে তর্কবিতর্কের প্রকট অভাব। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে শুধু জুলুম-নির্যাতন দিয়ে বুঝলে  দিয়ে বোঝা যাবে না। ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থায় আমরা নিজেরা কি করে অংশগ্রহণ করি সেটাই বিশেষ ভাবে বুঝতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যমান 'সংবিধান', আইন, ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা নাই বললেই চলে। সেই ক্ষেত্রে পুরা সমাজেই ভয়ংকর অজ্ঞতা এবং অস্পষ্টতা প্রকট। যদি আমরা বুঝতাম তাহলে এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু আমাদের থাকত যে বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর শত্রুপক্ষ গুলি করেও মেরে ফেলতে পারত। কিন্তু আইন, সংবিধান ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতার সুযোগে যদি ক্ষমতাসীন শক্তি আইন দিয়েই বাংলাদেশের তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিতে পারে, তাহলে বুলেটের ঝামেলা নেবার দরকার কি?

'ফ্যাসিবাদ', 'ফ্যাসিস্ট শক্তি' এবং 'ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা' নামক ধারণা বা চিন্তার বর্গ আমরা সহজে কিভাবে মানুষকে বোঝাতে পারি তার ওপর বাংলাদেশের আগামি রাজনীতি নির্ভর করে। আইন, সংবিধান, বিচার প্রক্রিয়া এবং নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞান ও অসেচতন থাকার অর্থ আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কোন না কোন নাগরিকের হত্যা প্রক্রিয়ায় জেনে বা না জেনে অংশগ্রহণ করা। যদু মধু করিম মফিজদের আমরা পুছি না। তারাতো নিত্যদিন মরছেই। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও, আমরা দেখি, একই প্রাণঘাতী প্রক্রিয়ায় আমরা শামিল হয়েছি।

আমাদের হুঁশ হবে কি? বিমূর্ত তাত্ত্বিক বিষয় হিশাবে আমরা ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করলে সাধারণ মানুষকে আমরা কিছুই  বোঝাতে পারবো না। বরং চোখের সামনে ঘটা কংক্রিট ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলে সাধারণ মানুষ হয়তো জটিল রাজনৈতিক বিষয়গুলো বুঝতে পারবে।

হয়তো। দেখা যাক।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।