২. বেগম খালেদা জিয়া এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ


একটি দৃশ্যমান হত্যা প্রক্রিয়ায় কিভাবে আমরা সকলে শামিল হই সেটাই আমার আলোচনার বিষয়। সুনির্দিষ্ট ভাবে ফ্যাসিবাদকে শনাক্ত করতে হলে বুঝতে হবে ফ্যাসিবাদ একনায়কতন্ত্র নয়। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আমাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্কে্র ধরণ একনায়কতন্ত্র থেকে আলাদা। আমাদের মন ও বুদ্ধির জগতে ফ্যাসিবাদ কিভাবে কাজ করে সেটাই এখানে বুঝবার এবং বোঝাবার চেষ্টা করছি।

আজকাল অনেকে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে 'ফ্যাসিস্ট' বলতে চায় না। মনে হয় তারা খুব শরমিন্দা বোধ করেন। এর একটা কারণ হতে পারে 'ফ্যাসিবাদ', 'ফ্যাসিস্ট শক্তি ' বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিছুটা ক্লিশে শব্দ হয়ে গিয়েছে, যা্র কারনে তারা মনে করেন এই শব্দগুলো বিশেষ কোন অর্থ বহন করে না। বলাবাহুল্য, তাঁরা ভুল। তাঁদের সঙ্গে আমরা একমত নই। কিন্তু এই শব্দ পরিহার করতে গিয়ে তারা যে শব্দ ব্যবহার করেন সেটা আরও মারাত্মক। সেটা হোল 'কর্তৃত্ববাদ'; ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে তারা বলেন, 'কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র'। এটা চরম হাস্যকর। এর কারণ হোল আসলে রাষ্ট্র মানেই কর্তৃত্ব -- কর্তৃত্ব ছাড়া রাষ্ট্র হয় না। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন তাই রাষ্ট্রকে বলেছেন 'বল প্রয়োগের হাতিয়ার' -- রাষ্ট্র মানেই এক শ্রেণীর দ্বারা আরেক শ্রেণীর ওপর বল্প্রয়োগের মাধ্যমে কতৃত্ব চর্চার প্রতিষ্ঠান। লেনিন বাদ দিন, কতৃত্ব ছাড়া রাষ্ট্র হয় কিভাবে? অতএব রাষ্ট্রকে আলদা করে  'কর্তৃত্ববাদী' বলা বালখিল্যতা। প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্র ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বা ফ্যাসিস্ট ক্ষমজতা ব্যবস্থা কিনা। যদি তাই হয় তাহলে 'গণতন্ত্র' -- অর্থাৎ জনগণের কতৃত্ব কায়েমের নীতি ও কৌশল কি হবে? আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি বিশেষ চরিত্র হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণীর কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতার বিশেষ কেন্দ্রীভূত রূপ নিয়ে হাজির থাকে। হিংসা বা বল প্রয়োগের একচেটিয়া, আইনী সার্বভৌমত্ব, State of Exception -- ইত্যাদি ধারণা বা বর্গ দিয়ে যে কারণে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সবসময়ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বোঝার চেষ্টা হয়।

একালের দার্শনিকরা বলছেন ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রে কেন্দ্রীভূত থাকে এই ধারণাটা ঠিক না। যেমন, শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষমতা উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কারখানা। তেমনি জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও পরিসর। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে পর্যালোচনার অধীনে না আনলে, এমনকি ব্যক্তি হিশাবে আমরাও কিভাবে বিদ্যমান ক্ষমতার উৎপাদন ও চর্চায় অংশগ্রহণ করি তাকে পর্যালোচনার অধীনে না আনলে আমরা ক্ষমতার রূপ বা চরিত্র কোনটিকেই বুঝব না। তাহলে আমাদের সমাজে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ক্ষমতা প্রভৃতি ধারণা এবং বিশেষভাবে 'জনগণ' নামক বর্গ কিভাবে হাজির রয়েছে -- কিভাবে সমাজে, চিন্তায় রাজনীতিতে বিভিন্ন ধারণা বা রাজনোইতিক বর্গ কাজ করে  তা না বুঝলে আমরা বুঝব না কেন এবং কিভাবে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার চর্চা হচ্ছে। কিভাবে আমরা সকলেই সেই চর্চায় অংশগ্রহণ করছি।

অতএব ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে 'কর্তৃত্ববাদী' বলার কোন অর্থ দাঁড়ায় না। মূল প্রশ্ন হচ্ছে কর্তৃত্বের রূপ বা ধরণ কেমন? এই মূল প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র বলার অর্থ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট চরিত্রকে আড়াল করা। এই যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে সুনির্দিষ্ট ভাবে ফ্যাসিস্ট না বলে 'কতৃত্ববাদী' বলা -- এটাও ফ্যাসিবাদ। ফ্যসিবাদ এভাবে রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট বৈশিষ্ট্য আড়াল করবার কাজও করে। তখন রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট চরিত্রকে চেনা সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জাতিবাদ, মুক্তি যুদ্ধের চেতনা, জাতির জনক ইত্যাদি ধারণা যেমন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র পরিগঠনের ভূমিকা রাখে, তেমনি রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট চরিত্রও আড়ালও করে। সবচেয়ে বিপদ হয় যাদের ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে চিনিয়ে দেবার কথা, তারা উলটা রাষ্ট্রের হিংস্র চরিত্র আড়াল করবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। 'কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র' বললে মনে হয় বুঝি নতুন কিছু বলা হোল! বুঝি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটা ব্যাখ্যা আমরা পেয়ে গেলাম! অথচ ঘটে উল্টাটা। রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট চরিত্র আড়াল করবার জন্যই 'কর্তৃত্ববাদ' কথাটি ব্যবহারের চল হয়েছে। বাংলাদেশে ইদানীং তার চল বেড়েছে। আমাদের তাই বুঝতে হবে 'কর্তৃত্ববাদ' ফ্যাসিস্ট বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বর্গ। ফ্যাসিবাদ এভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবেও জারি থাকে, রাষ্ট্রের চরিত্র আড়াল করবার মধ্য দিয়ে সক্রিয় থাকে।

ফ্যাসিবাদের একটি প্রধান লক্ষণ হচ্ছে সংবিধানে কথার কথা হিশাবে 'জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়' জাতীয় ভান থাকলেও সেটা নিছকই কাগুজে ব্যাপারের অধিক কিছু না । এটা জনগণের চোখে ঠুলি পরাবার জন্য ব্যবহার করা হয়। রাষ্ট্র যদি জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের চরম অভিব্যক্তি হয় তাহলে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে এই ইচ্ছা ও অভিপ্রায় সংবিধান বা রাষ্ট্র হিশাবে মূর্ত রূপ নিল? এ ব্যাপারে বাংলাদেশী ফ্যাসিস্টরা নির্লজ্জ। তারা দাবি করে বাংলাদেশের সংবিধান ডক্টর কামাল হোসেন লিখে দিয়েছেন। একজন ব্যাক্তির মুসাবিদাকে তারা জনগণে 'অভিপ্রায়' হিশাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে জনগণ কই? জনগণ কারা? কামাল হোসেন একাই কি তাহলে জনগন? মনে রাখতে হবে শুধু ক্ষমতাসীনরাই ফ্যাসিস্ট তা না, যারা শেখ হাসিনাকে সরিয়ে ক্ষমতায় যেতে চান তারাও ফ্যাসিস্ট চিন্তাচেতনা থেকে আলাদা কেউ না, যে কারণে আমরা গত নির্বাচনে দেখেছি কামাল হোসেনকেই শেখ হাসিনা বিরোধীরা তাদের নেতা বানিয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে এমন একটি পরিস্থিতি যখন 'জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়' অন্তঃসারশূন্য কথার ফানুশে পরিণত হয়।

'জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়' এবং তার 'পরম অভিব্যক্তি' গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধারণা বা বর্গ। তার আলোকে সংবিধান ও রাষ্ট্রের পর্যালোচনা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ফ্যাসিবাদ জনগণকে রাষ্ট্রচিন্তা থেকে বিয়োগ করবার জন্য রাষ্ট্রের এইসকল গোড়ার বিচার অস্বীকার করে। তখন সংবিধান, আইন বা রাষ্ট্রের আদৌ কোন ভিত্তি থাকে না। রাষ্ট্র পরিচালনা একটা হাওয়াই কারবার হয়ে ওঠে। এই হাওয়াই গুল্গুল অবস্থায়  ফ্যাসিস্ট শক্তি যাকে ‘আইন’ বা ‘বিচার’ বলে, তাকেই আমরা আইন ও বিচার বলে ধরে নেই ও মানি।

ফ্যাসিস্ট শক্তি তাই সামরিক বা বেসামরিক একনায়কতন্ত্র থেকেও পৃথক। সামরিক বা বেসামরিক একনায়ক্তন্ত্রে সংবিধান বা আইনের কোন বালাই নাই। ডিক্টেটর যা বলে ও আদেশ দেয় সেটাই আইন। একনায়কতন্ত্র -- সামরিক হোক বা বেসামরিক - চেনা যায়। বোঝা যায় একনায়কতন্ত্রের আইনী ভিত্তি বল প্রয়োগ কিম্বা বন্দুক। বন্দুকের বাইরে ক্ষমতার কোন ঐতিহাসিক কিম্বা প্রক্রিয়াগত বৈধতা বা ন্যায্যতা ডিক্টেটরশিপের নাই। সামরিক বা বেসামরিক একনায়কতন্ত্রে যিনি আইন দিচ্ছেন বা সংবিধান স্থগিত রাখছেন তার হাতে বন্দুক আছে বলে আইন বানাবার কিম্বা আদেশ নির্দেশের ক্ষমতাও তিনি ধারণ করেন। একনায়কতন্ত্রে বন্দুকের জোরই আদেশ, নির্দেশ ও আইন। জনগণ সেটা দেখতে পায় এবং বোঝে।

কিন্তু ফ্যাসিস্ট ধ্যানধারণা ও চিন্তা চেতনা জারি থাকার একটা সামাজিক ভিত্তি দরকার হয়। সেটা ছাড়া ফ্যাসিস্ট শক্তি তৈরি হতে পারে না। তাই ফ্যাসিস্ট শক্তি সামাজিক ও প্রক্রিয়াগত বৈধতা আদায় করতে চায়। নির্বাচনে নিজের সামাজিক ভিত্তি আছে প্রমাণ করতে উদ্গ্রীব থাকে এবং একটা আদর্শগত ন্যায্যতা বা আধিপত্য কায়েমের চর্চা করে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের সামাজিক ভিত্তি নির্মাণের প্রধান মতাদর্শিক হাতিয়ার হচ্ছে 'বাঙালি জাতিবা'দ। তাই হিংসা ও হানাহানির ক্ষমতা ফ্যাসিস্ট শক্তির জন্য যথেষ্ট না, সেই হিংসা ও হানাহানির পক্ষে একটা মতাদর্শ ও তত্ত্বও ফ্যাসিবাদ খাড়া করে। এমনকি আইনী বৈঢতার জন্য ফ্যাসিস্ট শক্তি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেও নিয়মিত ব্যবহার করে। হিটলারকে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান ঘটেছে এক এগারোর পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সামাজিক-মতাদর্শিক ভিত্তি ও আইনী বৈঢতা অর্জনের জন্য ফ্যাসিস্ট শক্তি নিয়মিত নির্বাচনের মহড়া দেয়।

কোন কিছু বোঝার ঘাটতি থাকা অন্যায় নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদের বয়ানকে আমরা যখন নির্বিচারে মানি, ক্রিটিকালি ভাববার বা পর্যালোচনার প্রয়োজন বোধ করি না, তখন আমরা আমাদের স্বাধীন চিন্তাশীলতার শক্তি হারিয়ে ফেলি। ফ্যাসিস্ট শক্তির বয়ানই আমাদের নিজেদের বয়ান হয়ে ওঠে। বিশ্বাস করতে শুরু করি খালেদা জিয়াকে বুঝি আসলেই আইনী প্রক্রিয়াতেই দণ্ড দেওয়া হয়েছে, এর সঙ্গে ফ্যাসিস্ট শক্তি বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন সম্পর্ক নাই। এই যখন আমাদের হাল হয়, তখন মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে মুক্তির দাবিও আসলে আর মানবিক থাকে না। সেটা হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থাকে মেনে নেবারই দাবি। সেটা হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও রাষ্ট্রশক্তিকে মান্যতা দিয়ে এবং টিকিয়ে রেখে ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছেই মানবিকতার আবেদন জানানো। এতে নিজেদের মানবিক কিম্বা খালেদা দরদী প্রমাণ করা যায়, কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা এতে আরও বৈধ ও মজবুত হয়।

আগেই বলেছি খালেদা জিয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির  লিবারেল রাজনীতির খেলার নিয়ম মেনে নিয়েছেন। বিএনপি ফ্যাসিস্ট শক্তির  আইনী প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করছে না। এই ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার দৃঢ়তা হচ্ছে  ক্ষমতাসীনদের কাছে চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে যাবার আবেদন জানান নি। কোন দয়াভিক্ষার আবেদন করেন নি। না করে খালেদা জিয়া একটা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। হয়তো ধরে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তার এই মুহূর্তে নিঃশব্দ প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছুই করণীয় নাই। বাকিটা তাঁকে ইতিহাসের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃবৃন্দের ভূমিকা প্রশ্নাতীত নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের মানবাধিকার রিপোর্ট পরিষ্কার স্বীকার করেছে, “International and domestic legal experts commented on the lack of evidence to support the conviction, suggesting a political ploy to remove the leader of the opposition from the electoral process.” ((2020 Country Reports on Human Rights Practices: Bangladesh, US Department of State) [১]  । অর্থাৎ পরিষ্কারই রিপোর্ট বলছে, আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে প্রমাণের অভাব রয়েছে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এটাও পরিষ্কার বলা হয়েছে যে তাঁকে বিচার করা এবং শাস্তি দেওয়া ছিল , নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বিরোধী দলের নেতাকে অপসারণের জন্য একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, প্রতিটি পরাশক্তি জানে তাঁর বিচার ও শাস্তি একটা রাজনৈতিক চক্রান্ত। কিন্তু আগেই বলেছি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া তাদের টার্গেটও বটে। তাই তার প্রতি এই অবিচারের জন্য তারা কোন অবস্থান নেবে না।

খালেদা জিয়াকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম কিস্তির সমালোচনা করতে গিয়ে খালেদা জিয়ার শাসনের বেশ কিছু মন্দ দিকের কথা কেউ কেউ তুলে ধরেছেন। তাঁরা অবশ্য ভুল বলেন নি। কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখলাম এই সমালোচনা মূলত আমারই করা সমালোচনার পুনরাবৃত্তি। অনেক ক্ষেত্রে প্রায় আমার লেখা থেকেই হুবহু টোকা। তাতে অসুবিধা নাই। কিন্তু আমি যখন খালেদা জিয়ার সমালোচনা করেছি তখন তিনি ক্ষমতায়। এখন তিনি অসুস্থ এবং বন্দী। একটা প্রবাদ আছে, গ্রীষ্মের ওয়াজ শীতকালে করা উচিত না। করলে শীতের কাঁথা পাওয়া কঠিন হয়। তাই আমরাও বলি, গ্রীষ্মের ওয়াজ শীতকালে করবার মতো বেয়াকুফি না করাই ভাল।

যখন সমালোচনা করবার তখন আমরা করি না। খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন আমি বিস্তর তাঁর সরকারের সমালোচনা করেছি। সমালোচনা ও প্রতিবাদ করে জেলও খেটেছি। কিন্তু এখন আমি খালেদা জিয়ার শাসনকাল কিম্বা প্রধানমন্ত্রী হিশাবে তাঁর ভূমিকা বিচার করতে বসি নি। যখন করব তখন দেখা যাবে। এখন আমাদের বুঝতে হবে খালেদা জিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে আমরা কিভাবে সায় দিচ্ছি এবং কিভাবে জেনে কিম্বা না জেনে একটি হত্যা প্রক্রিয়ায় সকলে মিলে শামিল হয়েছি।

ফ্যাসিবাদ একটা জাতিবাদী ইডিওলজি বা মতাদর্শও বটে। এর প্রধান দৃশ্যমান মতাদর্শিক চরিত্র লক্ষণ হচ্ছে পরিচয়বাদ বা পরিচয়সর্বস্বতা। এই পরিচয়সর্বস্বতা ভাষা এবং সংস্কৃতি থেকে যেমন তৈরি হতে পারে, তেমনি একই ভাবে ধর্ম পরিচয় থেকেও ঘটে। ধর্মও পরিচয়সর্বস্বতায় পর্যবসিত হয়ে ফ্যাসিস্ট রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে। তাই ফ্যাসিবাদের পর্যালোচনার দিক থেকে নিজেদের ‘বাঙালি জাতি’ ভাবা কিম্বা ‘মুসলমান জাতি’ ভাবার মধ্যে মর্মগত কোন ভেদ নাই। উভয়েই একই মূদ্রার এপিঠ আর ঐ পিঠ। ধর্মীয় কিম্বা সেকুলার হোক, যে কোন জাতিবাদী মতাদর্শ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত নিজের পক্ষে আনতে সক্ষম হতে পারে। সেই জাতিবাদী মতাদর্শ আশ্রয় করে ‘ফ্যাসিস্ট শক্তির’ উত্থান ঘটে। তখন ব্যক্তির নাগরিক ও মানবিক অধিকার অতি সহজে গণসম্মতির মাধ্যমে হরণ করা সম্ভব হয়।

তাহলে মতবাদ বা ইডিওলজি হিশাবে ‘ফ্যাসিবাদ’ বোঝা যেমন দরকার, তেমনি জনমতের ভিত্তিতে সেই মতাদর্শের পরিগঠিত সংঘবদ্ধ ক্ষমতা অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট শক্তিকে বোঝাও সমান জরুরি। দুটো আলাদা জিনিস। ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট শক্তি এক কথা না। এই পার্থক্য খেয়াল রাখতে হবে। ফ্যাসিস্ট শক্তি যখন নিজেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে তখন রাষ্ট্রব্যবস্থারও গুণগত রূপান্তর ঘটে। সেটা তখন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা তিনটি ভিন্ন রাজনৈতিক বর্গ। তাদের বিরুদ্ধে লড়বার নীতি ও কৌশকও আলাদা।

বাংলাদেশে পরিচয়সর্বস্ব জাতিবাদী ইসলামের মধ্যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা রয়েছে, কিন্তু ফ্যাসিস্ট শক্তি হিশাবে তার কোন পরিগঠিত ক্ষমতার রূপ বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার চেহারা বাংলাদেশে এখনও আমরা দেখি নি। কিন্তু বাকশাল আমল এবং এক-এগারোর পরবর্তী কালপর্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে রূপ আমাদের সামনে হাজির হয়েছে সেটা বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার চেহারা। বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কী জিনিস সেটা বর্তমান বাংলাদেশ দেখে নতুন ভাবে আমরা বুঝতে পারি। ক্ষমতাসীনরা সেটা আমাদের ভাল ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে।

ফলে বাস্তবে আমরা যার মুখোমুখি, বাস্তবোচিত ভাবে তার পর্যালোচনাই ছহি। সেটাই আমাদের উদ্দেশ্য।

সূত্র


খালেদা জিয়ার বিচার সম্পর্কে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেইটের রিপোর্ট লিখেছে:

In February 2018 former prime minister of Bangladesh and chairperson of the opposition Bangladesh National Party (BNP), Khaleda Zia, was sentenced to five years’ imprisonment on corruption and embezzlement charges, which were first filed in 2008 under a nonpartisan caretaker government. In October 2018 the High Court increased her sentence to 10 years. International and domestic legal experts commented on the lack of evidence to support the conviction, suggesting a political ploy to remove the leader of the opposition from the electoral process. The courts were generally slow in considering petitions for bail on her behalf. In March the government suspended Zia’s sentence for six months on humanitarian grounds, and suspended it again in September for another six months. In both instances the government restricted Zia’s travel, saying she would receive medical treatment in Dhaka and could not travel abroad.

(2020 Country Reports on Human Rights Practices: Bangladesh)


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।