ভাসানী ও নতুন বৈপ্লবিক চিন্তার পুনর্গঠন


ভাসানী নিয়ে আমার পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে তরুণ সমাজের পক্ষে হাফিজ আল- মুতাসিম আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন।

১. বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামপন্হার রাজনীতির সাথে ভাসানীর পার্থক্য ও গুরুত্ব কোথায়?

২. মুজিব জিয়া পরিবারতন্ত্রের দাগের বাহিরে ভাসানী আদর্শের জাগরণ ও সম্ভাবনা কতটুকু?

৩. আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠাতা ও কাগমীর সম্মেলনে 'আসসালামু আলাইকুম', বলনে ওয়ালা জননেতা ভাসানীর রাজনৈতিক অন্তিমকাল কেমন ছিলো ও কেন?

বলা বাহুল্য, তরুণদের প্রতি আমি দায় বোধ করি। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বড় বিষয়, কিন্তু সংক্ষেপে দুই একটি কথা বলবো।

ভাসানীর যে কোন জীবনী গ্রন্থে তৃতীয় প্রশ্নের কিছুটা হলেও উত্তর পাওয়া যাবে। তাই বাদ রাখছি।

ভাসানী-আদর্শের জাগরণ ও সম্ভাবনা বিপুল। কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে তাঁর 'আদর্শ'টা কি? তাঁর জীবনী, বক্তৃতা, লেখালিখি এবং কর্মজীবন জানলেই হবে না। কি আদর্শ দ্বারা তিনি নিজে নিজেকে পরিচালিত করেছেন সেটা তাঁর সারাজীবনের কীর্তি থেকে ছেঁকে বের করে আনতে জানতে হবে। তাঁর মানে তাঁর জীবনের একটা পর্যালোচনা দরকার। সেই ক্ষেত্রে আমরা তার যোগ্য হয়েছি কিনা সবার আগে সেটা বোঝার দরকার আছে।

ভাসানী শেখ মুজিবর রহমানের মতো 'জাতিবাদী' নেতা নন। কিম্বা তাঁকে দিল্লী ও আওয়ামী লীগ যেভাবে জাতিবাদী 'মহানায়ক' বানাতে গিয়ে হিটলার ও মুসোলিনির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে গণমানুষের মহানায়ক ভাসানীর মধ্যে সেই প্রকার 'জাতিবাদী' উপাদান নাই বা ছিল না। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নিঃশর্ত সমর্থক ছিলেন কিন্তু জাতিবাদী ছিলেন না। তিনি জিহাদি -- অর্থাৎ ইসলাম কায়েমকে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই হিশাবে গণ্য করেছেন। স্বাধীনতার আগে শেখ মুজিবর রহমানকে সমর্থন এবং একাত্তরের পরে ভাসানীর শেখ মুজিব বিরোধিতার মর্ম এখানে নিহিত। যারা এইসব বোঝে না তার নানান উলটাপালটা কথাবার্তা বলে।

ইসলাম জাতিবাদ মানে না। গরিব মজলুম সর্বহারার বিপরীতে তাই ভাসানীকে বাঙালি জাতিবাদী শোষক শ্রেণী ও ফ্যাসিস্টদের নেতা বানানো যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি ইসলামের নেতা বানানও না। কারন যে সকল আলেম মওলানা মুফতি বা নানান কিসিমের ইসলামি আন্দোলনের নেতা জালিমদের স্বার্থে কাজ করে -- বাংলাদেশে সৌদী রাজতন্ত্র কায়েম কিম্বা বাংলাদেশকে ইরানি বা তুরানি সাম্রাজ্য বানাতে চায় -- ভাসানী আলবৎ তাদের পছন্দের মানুষ না।

তবে ভাসানী বুঝেছিলেন বাংলাদেশের জনগণকে ইতিহাসের একটি জাতিবাদী পর্যায় অতিক্রম করে যেতে হবে। এখানেই তাঁর দূরদর্শিতার শক্তি। সে কারণে উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের অবিসংবাদিত নেতা হওয়া সত্ত্বেও আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি এবং তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তির লড়াই ভাসানী সমর্থন করে গিয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতার অংশীদার হবার চেষ্টা করেন নি।

জ য় ভা সা নী।

ভাসানি তাই আঞ্চলিক বা জাতীয় নেতা নন, কিম্বা বাঙালি জাতির মুক্তি দাতাও নন, কারন -- বরং সারা দুনিয়ার মজলুমের মুক্তির লড়াইয়ের তিনি নেতা। পাকিস্তানী, সৌদী ইরানি তুরানি শোষকদের হাত থেকে ইসলামের ঝাণ্ডা কেড়ে নিয়ে তিনি মজলুম সর্বহারার হাতে তুলে দিতে চেয়েছেন। এটা আন্তর্জাতিক লড়াই, একই সঙ্গে ইসলামের আভ্যন্তরীণ লড়াইও বটে। তাই পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি নতুন বিপ্লবী ইসলামী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক নেতা। এই ইসলাম ইহলৌকিক, আত্মসচেতন এবং শ্রেণী সচেতন। তাই ভাসানীর চিন্তার প্রতাপ এবং প্রভাব সারা দুনিয়ার মজলুম জনগণের লড়াইয়ের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে ইসলামের বিপ্লবী ইতিহাস। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে তিনি সামনে আসতে থাকবেন। এর অন্যথা হবে না বলেই আমি মনে করি।

কিন্তু ভাসানীর আদর্শ ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে হলে ঔপনিবেশিক আমল থেকে বাঙালি মুসলমান -- বিশেষত কৃষক এবং নতুন গড়ে ওঠা মধ্যবিত্তের লড়াই কিভাবে সাতচল্লিশের পরে 'বাঙালি'র স্বাধীনতার লড়াইয়ে রূপ নিল সেটা বুঝতে হবে। এই কালপর্ব -- একই সঙ্গে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দি-আবুল মনসুর আহমদ -আবুল হাশেম - অলি আহাদদের লড়াই থেকে ভিন্ন নয়। শেখ মুজিবর রহমান সেই লড়াইয়ের পরিণতি মাত্র। তাই শেখ মুজিবরের ঐতিহাসিক ভূমিকা বাদ দিয়ে মওলানা ভাসানীকে বোঝা যাবে না। সেটা হবে ঐতিহাসিক বোকামি এবং ইতিহাসে ফ্যাসিস্ট শক্তির জায়গা পোক্ত করবার ব্যবস্থা করা।

ভাসানীকে বাদ দিয়ে শেখ মুজিব কিম্বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধও বোঝা যাবে না। ভাসানীকে শেখ মুজিবর রহমান থেকে কিম্বা শেখ মুজিবর রহমানকে ভাসানী থেকে বিচ্ছিন্ন করা বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট ইতিহাস চর্চার সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র। বাংলাদেশের গরিব মজলুম জনগণ এবং তাদের জালিম বিরোধী ধর্মচেতনাকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্যই ভাসানীকে ইতিহাস থেকে, পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে পরিষ্কার বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াই সুনির্দিষ্ট ভাবে এই ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত করতে হবে।

ভাসানী ও মুজিবের ঐক্য ও বিরোধ দুটোই পরিষ্কার বুঝতে হবে।

উনসত্তরে গণ অভ্যূত্থানে ভাসানী নেতৃত্ব না দিলে এবং আগরতলা মামলায় তাঁর দুঃসাহসী নেতৃত্বে 'জেলের তালা ভাঙ্গব, শেখ মুজিবকে আনব' -- এই স্পর্ধা ও রণধ্বনির দ্বারা শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্ত করা না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস আজ ভিন্ন হোত। স্বাধীনতা অর্জন দূরের কথা। ভাসানীর অসাধারণ প্রজ্ঞা হচ্ছে জাতীয় মুক্তির লড়াই গায়ের জোরে পাশ কাটিয়ে গিয়ে বিমূর্ত শ্রেণি সংগ্রাম নামক কোন সংগ্রাম নাই -- এই সহজ সত্যটা তিনি বুঝেছিলেন। কিন্তু জাতীয় মুক্তি অর্জনের পর জাতিবাদ বা জাতীয়তাবাদ একান্তই ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ এবং ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা পরিগঠনের রণধ্বনি। দুইয়ের সম্বন্ধ বুঝি নাই বলে আমরা বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেছি। একালে ভাসানীর আদর্শ অতএব ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাতের লড়াই।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যারা বর্তমান ব্যবস্থাকে 'ফ্যাসিস্ট' না বলে 'কর্তৃত্ববাদ' বলেন, তারা মূলত জেনে বা না জেনে ফ্যসিস্টদের দোসর হিশাবে ভূমিকা রাখেন। ইতিহাস সম্পর্কেও তারা অজ্ঞ। যারপরনাই কনফিউজড।

তাহলে ভাসানীর আদর্শ বুঝতে হলে বাংলাদেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তার আদর্শের সম্ভাবনাও বিচার করতে হবে, তার জন্য বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কেও সম্যক ধারণা থাকতে হবে আমাদের। কি অর্জন সম্ভব আর কি নয় সে সম্পর্কেও কাণ্ডজ্ঞান থাকতে হবে। তখন বোঝা যাবে ভাসানীকে আমরা বর্তমান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোকে আদৌ বুঝতে পারছি কিনা। সেই বোঝাবুঝিটাই সমাজের নতুন চেতনা ও রাজনীতির দিশা হবে। 'জাগরণ' তখনই ঘটতে পারে।

ভাসানী নিয়ে আমার লেখালিখি ভাসানী-আদর্শের এই জাগরণ বোধ থেকে এবং জাগরণের সম্ভাবনা থেকে জাত। তাই তাঁর চিন্তা ও কাজ সম্পর্কে প্রথাগত অনুমান ও খোপবদ্ধ মূল্যায়নের আমি সবসময়ই বিরোধিতা করি। যেমন, 'রেডগিরি' ও 'পীরগিরি'র বিরোধিতা। যেন আগামি দিনের রাজনীতি গড়ে তুলবার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হিশাবে মওলানাকে সটান হাজির রাখতে পারি। বলা বাহুল্য সেই কাতারে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দি, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল হাশেম, শেখ মুজিবর রহমান, অলি আহাদ, আতাউর রহমান খান -- এঁরা সকলেই আছেন। নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একাত্তরে স্বাধীনতা ঘোষণার দলিলের জন্য তাজউদ্দীন আহমদকেও আমি ইতিহাসের খাতার বাইরে রাখি না। আরো অনেকে আছেন। তাই ভাসানীকে আমরা কিভাবে নিজেরা বুঝি এবং অন্যকে বোঝাতে পারি তার ওপর ভাসানীর আদর্শের ভূমিকা আগামিতে নির্ধারিত হবে।

গত কয়েক দশক ধরে ভাসানী নিয়ে আলাপ আলোচনার ফলে তরুণদের মধ্যে ভাসানী সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, ভাসানীকে পর্যালোচনার সঠিক জায়গা শনাক্ত করা তাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক কর্তব্যের আলোকে তাঁকে আত্মস্থ করতে পারাটাই মূল কাজ।

এবার পরিবারতন্ত্র সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক।

পরিবারতন্ত্র সমাজে পুরানা সামন্তবাদী আনুগত্য ও স্বাধীন নাগরিক হিশাবে চিন্তা করবার অভাবের কারনে দীর্ঘস্থায়ী হয়। এটা চিরস্থায়ী কিছু না। তবে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগ ডাইনেস্টির যুগ না। বাংলাদেশে কোন ডাইনেস্টিরই এখন আর টিকে থাকার সম্ভাবনা নাই। সেটা 'মাইনাস টু' বা 'ব্যাটলিং বেগামস' তত্ত্ব এবং খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে অ-রাজনৈতিক ভাবে অপসারণের মধ্য দিয়ে ২০০৮ থেকে শুরু হয়েছে। ওয়ার অন টেররের জন্য শেখ হাসিনা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছেন, কিন্তু তাঁর সময়ও সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক র‍্যাব এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কিছু কর্তাব্যাক্তির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তার লক্ষণ হিশাবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু ওয়ার অন টেররের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেখ হাসিনা বিএনপি ও বিরোধী দলীয় রাজনীতিকে যেভাবে দমন ও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছেন তার বিষাক্ত জের দীর্ঘদিন আমাদের পোহাতে হবে। বন্দী অবস্থায় খালেদা জিয়া তাঁর প্রয়োজন মতো চিকিৎসা পাবার অনুমতি না পেলে তা আরও বিপজ্জনক রূপ নেবে।

আসলে 'রেজিম চেইঞ্জ' বা 'মাইনাস টু' দুই হাজার আট সাল থেকেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে চলছে। পুঁজি নিজের স্বার্থেই ডাইনেস্টির বিনাশ ঘটাবে। ঘটাচ্ছে। মাফিয়া পুঁজির দাপট সেটা ত্বরান্বিত করবে। অতএব বিএনপি বাংলাদেশে যদি কোন ভূমিকা রাখতে চায় তাহলে জনগণের সঙ্গে সম্বন্ধ পরিষ্কার করতে হবে।

'ভিক্টিম' সাজা রাজনীতির কাজ না। যে ভিক্টিম, নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে যে পালটা রুখে দাঁড়াতে পারে না বা অক্ষম, রাজনীতি তাদের জন্য নয়, জনগণ তাদের পেছনে দাঁড়াবে কেন? খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি বিএনপি কাজে লাগাতে পারে, কিন্তু নিদেন পক্ষে জিয়াউর রহমানের ১৯ দফার মানে ২০২১ সালে বাংলাদেশের জনগণের কাছে কি হতে পারে সেই সকল গোড়ার আলোচনা অবশ্যই সামনে আনতে হবে। জনগণের সঙ্গে সম্বন্ধ স্পষ্ট ভাবে নির্ণয় করার অর্থ নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ স্বচ্ছ ও স্পষ্ট করে বলা এবং পরিচ্ছন্ন ভাবে হাজির করা।

তাই এটা বলা যায় আদর্শ ছাড়া কোন ডাইনেস্টি বা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলের প্রতাপ তৈরির ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিএনপির এতোদিনে এই কাণ্ডজ্ঞান তৈরি হবার কথা।

বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামপন্হার রাজনীতির সাথে ভাসানীর পার্থক্য ও গুরুত্ব কোথায় সেই বিষয়ে পোস্ট দেব কাল।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।