র‍্যাব বিতর্ক


'র‍্যাব' বা র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে আমাদের সমাজে। নাগরিকদের মধ্যে সম্মানিত অনেকে আছেন যারা বলছেন- ‘র‌্যাব’ এর ভূমিকা আমাদের প্রশংসা কারা উচিত, সন্ত্রাস দমনে র‌্যাব ইতিমধ্যেই ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে ‘মানবাধিকার’- এর কথা তুলে তীব্র সমালোচনা চলছে যে, ‘ক্রসফায়ারে’ র‌্যাবেরই হেফাজতে থাকা অভিযুক্ত অপরাধী মারা যাওয়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

আমি র‌্যাব বা ইংরেজি Rapid Action Battalion- এর বাংলা করেছি ‘জলদি কাম খতম করার সংঘ বা বাহিনী’ (দেখুন প্রথম আলো, ১ নভেম্বর, ২০০৪)। আমি র‌্যাবের সমালোচনা করি এবং নাগরিক হিসেবে নিজের কথা স্পষ্টভাবে বলা দায়িত্ব বলে মনে করি। আমি র‌্যাব-বিরোধী। সেটা নীতিগত। আমি মনে করি না, এটা সন্ত্রাস দমনের পথ। কিন্তু আমার কথা নিছকই সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস দমনের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের আন্তরিক ও বাহ্যিক বিকাশ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিগঠন, এবং নিজেদের প্রতিরক্ষার গুরুতর প্রশ্নের আলোকেই র‌্যাবকে বিচার করতে হবে। তারই কিছু প্রাথমিক কথা ছিল দৈনিক প্রথম আলোয় প্রথম প্রকাশিত লেখাটিতে। কিন্তু র‌্যাব নিয়ে সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক তর্ক- বিতর্ককে ইতিবাচক অর্থে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য আরও কয়েকবারই এ বিষয়ে লেখা দরকার হবে।

র‌্যাব সম্পর্কে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া আছে আমাদের সমাজে। প্রথমে আসে তাদের কথা যারা সত্যি সত্যিই মনে করেন যে, র‌্যাব, চিতা, বাঘ বা ভাল্লুক জাতীয় হিংস্র কিছু না বানালে – অর্থাৎ বল প্রয়োগের রাষ্ট্রীয় সংস্থা তৈরি ছাড়া আমরা সন্ত্রাস দমন করতে পারব না। তারা র‍্যাবের বিরোধিতাকে পছন্দ করছেন না। তাদের এক পক্ষের যুক্তি হচ্ছে - খালেদা জিয়া সন্ত্রাস দমনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, ফলে শাসক হিসেবে তিনি শক্ত হাতে সন্ত্রাস দমন করার চেষ্টা করছেন, এটা ভাল। সরকার যদি সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে যায় তাহলে তার বিপদ র‌্যাবের মানবাধিকার লংঘনের চেয়েও বেশি। র‌্যাব সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার লংঘন করেনি এই দাবি তারা করছেন না। কিন্তু ওর ক্ষতির চেয়েও সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বব্যাপী সন্ত্রাসের যে চেহারা ফুটে উঠছিল তাকে দমন করাই হচ্ছে এখনকার প্রথম কাজ। অতএব র‌্যাবের সমালোচনা এখন ঠিক না। সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বব্যাপী সন্ত্রাস দমনই এখন আসল কাজ।

আরেক অংশ র‌্যাবের বিরোধিতাকে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের বা আওয়ামী ধারার সমর্থকদের রাজনৈতিক চালবাজি বলেই মনে করেন। যদিও মানবাধিকার কর্মীদের একটা বড় অংশই র‌্যাব গঠনের সাংবিধানিক বা আইনি প্রশ্ন না তুলেও তার কর্মকাণ্ডের – অর্থাৎ মানবাধিকার লংঘন সংক্রান্ত দিকের তীব্র সমালোচনা করছে। বিপরীতে র‌্যাব সমর্থকদের যুক্তি হচ্ছে -- ব্যবসা, বিনিয়োগ চাঁদাবাজি বন্ধ করার ক্ষেত্রে র‌্যাব প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। এই দাবি হয়তোবা মিথ্যা নয়। কিন্তু এটা সাময়িক হতে বাধ্য। ঈদের সময় সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রেও র‌্যাবের ভূমিকা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে।

র‌্যাবের সমর্থকদের কথার সারমর্ম হচ্ছে, ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করার নীতিটাই আমাদের দরকার। এরকম কিছু একটা না হলে সন্ত্রাসীরা খামোশ হবে না, সন্ত্রাসও বন্ধ হবে না। সমাজে যারা সম্পদশালী, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ছোটবড় পুঁজির মালিক এবং চাকরিজীবীদের মধ্যে উচ্চবিত্ত না হলেও যারা মোটামুটি সচ্ছল, তারাই এই ধারণা বেশি পোষণ করেছেন। সমাজের সম্পদশালী, ছোটবড় পুঁজির মালিক এবং সচ্ছল চাকরিজীবীদের পাশাপাশি যদি গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষও ভাবতে শুরু করে যে, সন্ত্রাস নিছকই একটা অপরাধ, ‘সন্ত্রাসী’ হওয়ার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক নীতির কোন যোগ নেই, তখন ফ্যাসিবাদ একটি সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রবণতা হিসেবে সমাজে শেকড় গেঁড়ে বসে। এর পরিণতি সেই জনগোষ্ঠীর জন্য ভয়াবহ হতে বাধ্য। এ কারণে এ ধরনের নীতি বা চিন্তার পরিপোষণ সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। সমাজে এ ধরনের চিন্তা যখন প্রবল ও প্রকট হয়ে ওঠে তার সঙ্গে ফ্যাসিবাদের যোগ থাকে। ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়।

সেইদিকে থেকে পিটিয়ে জনতার হাতে ছিনতাইকারী বা অপরাধীকে হত্যা এবং র‌্যাবের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ অভিযুক্ত অপরাধীর মৃত্যু- দুটোই একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। র‌্যাবের প্রতি যদি সত্যি সত্যিই জনসমর্থন বাড়ে বা বাড়ছে প্রমাণিত হয়, তাহলে সেটা ভাল লক্ষণ নয়। মানুষকে পিটিয়ে বা ‘ক্রসফায়ারে’ মারাকে যদি আমরা স্বাভাবিক মেনে নিই তাহলে অনেকগুলো বিপদ উপস্থিত হয়। সেই বিপদগুলো সম্পর্কে হুঁশ থাকলে র‍্যাব সম্পর্কে আমাদের বিচার আরও পরিচ্ছন্ন হবে।

কয়েকটি বিপদের কথা বলছি:

এক. যদি রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় অপরাধের বিচার আর অপরাধীর প্রতি ইনসাফের কোন ভূমিকা না থাকে তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের নৈতিক ভিত্তি নষ্ট হয়। সংবিধান ও আইন নিছকই বিচারক-উকিল- ব্যারিস্টারদের ব্যাপার নয়- বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান ও জনগণের পরস্পরের প্রতি দায় ও জবাবদিহিতা প্রমাণ এবং প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াও বটে।

দুই. অপরের প্রতি বা অপর মানুষের প্রতি সংবেদনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা যদি না থাকে সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব বাড়ে। এই ফাঁকা জায়গাগুলোতেই সন্ত্রাসের চাষাবাদ হয়। অপরাধীও এই অন্যায় ও অসম সামাজিক ব্যবস্থার এক ভুক্তভোগী- এই বোধ সমাজের দরকার। তার প্রতি সমাজেরও দয়া আছে এবং সমাজ তা চর্চা করে- এই সত্য যদি অপরাধীর কাছে প্রতিষ্ঠিত করা না যায়- তাহলে অপরাধ ও অপরাধীর সামাজিক শাসন ও নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। সমাজে দয়া ও ক্ষমার ঘাটতি থাকলে অপরাধীও সমাজের বিরুদ্ধে আরও হিন্স্র ভাবে দাঁড়ায়, আইওন-আদালত-পুলিশ দিয়ে তার মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়ে।

তিন. যে সমাজে দয়ামায়া, মমতা নেই সেই সমাজকে তথাকথিত অপরাধীরাও কেন ‘স্বাভাবিক সমাজ’ বলে মানবে? তখন অপরাধের জগত থেকে অপরাধীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা কখনোই সম্ভব হয় না। এদিক থেকে র‌্যাব, কোবরা, চিতা মার্কা সমাজ যেমন ‘অস্বাভাবিক’, ঠিক তেমনি অপরাধীর সমাজও ‘অস্বাভাবিক’। দুটো একই বিকৃতির দুই দিক মাত্র। যে সমাজ শুধু শাস্তি দিতে জানে, কিন্তু দয়া দেখাতে জানে না- সেই ধরনের সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। দয়ার এই ধারণাকে নিছকই মানবিক বৃত্তি ভাবার কোন কারণ নেই। কারণ, অধুনিক সংবিধান ও আইনেও ‘দয়া’-র স্বীকৃতি আছে। বিচার ও ইনসাফের সার্বজনীন বিধান হচ্ছে- যতক্ষণ অপরাধ প্রমাণিত না হয় ততক্ষণ ‘অভিযুক্ত’- কে আইন ও সমাজ কখনোই অপরাধী বলে গণ্য করে না। তারপর মুত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীরও রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে দয়া ভিক্ষা চাওয়ার বিধান আছে।

চার. রাষ্ট্র যদি বল প্রয়োগের সামাজিক, নৈতিক ও আইনি ন্যায্যতা প্রমাণ না করে ‘ক্রসফায়ার’-এ অপরাধীদের মারে তাহলে তথাকথিত ‘অপরাধী’দের মধ্যেও পাল্টা বল প্রয়োগের ক্ষমতা বেড়ে উঠতে বাধ্য। তার মানে, র‌্যাবের কার্যক্রম সাময়িক সুফল বয়ে আনলেও পরিণতি হবে মারাত্মক। যদি বন্দুকের পেছনে বিবেক না থাকে তাহলে সেই বন্দুক পাল্টা আমাদের টার্গেট করতে পারে। বিবেকই অপরাধ ও অপরাধী দমনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, ট্রিগার না। ট্রিগারই যদি প্রধান হয়ে ওঠে- তাহলে বন্দুকের হাতবদল হতে বাধ্য। বিবেক আর বন্দুকের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে বিবেক মানুষকে ছেড়ে যায় না। বন্দুকের হাতবদল হয়। আজ যিনি শিকার করেছেন, কাল তিনি শিকারের লক্ষ্যবস্তু হবেন। কিন্তু বিবেকের ক্ষেত্রে এটা হয় না। বন্দুকের পেছনে কি আছে তার দ্বারাই বন্দুক দিয়ে কি কাজ হচ্ছে তার ন্যায়-অন্যায় বিচার করা হয়। বিপ্লবীর হাতের বন্দুক আর ডাকাতের বন্দুকের মধ্যে পার্থক্য আছে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সশস্ত্রতা কি ‘অপরাধ’ ছিল? কিন্তু পাকিস্তানি সংবিধান, আইন কিংবা সামরিক বাহিনী পুলিশ গোয়েন্দা সবার কাছেই সেই সশস্রতা ছিল সেটা ‘দুষ্কৃতকারী’ বা অপরাঢীর অপরাধ সংঘটন।

পাচঁ. যদি এই তৃতীয় যুক্তিটা আমরা বুঝি তাহলে এই আশঙ্কা অমূলক নয়, র‌্যাব শাসক ও শ্রেণীর ‘প্রাইভেট আর্মি’ হিসেবে গণমানুষের রাজনীতি যারা করেন তাদের বিরুদ্ধে একদিন ব্যবহৃত হবে। আজ পিচ্চি হান্নান হয়তো ‘দুষ্কৃতকারী’ কিন্তু কাল একজন বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীকেও ‘সন্ত্রাসী’ বলে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হবে। যেমন- সিরাজ সিকদারকে এবং বাকশাল আমলে নির্বিচারে ‘নকশাল’ দের হত্যা করা হয়েছিল। তাছাড়া প্রশ্ন, কি অপরাধ আর, কি অপরাধ নয়, তার সিদ্ধান্তই বা কে নেবে? আজ না হয় র‌্যাব ‘দুর্ধর্ষ’ সন্ত্রাসীদের মারছে। কিন্তু কাল এই র‌্যাবই ব্যবহৃত হবে সেসব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে, যারা জোট সরকার কিংবা আওয়ামী শাসকদের বিরোধী। অর্থাৎ বাংলাদেশের সম্পদশালী ও ছোটবড় পুঁজির মালিক এবং চাকরিজীবী উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে যারা খেটে খাওয়া মানুষ এবং কৃষক শ্রমিকের স্বার্থে লড়াই সংগ্রাম করছেন তাদেরও কি মারবে না এই ধরণের র‌্যাব, চিতা, কোবরা ? এই নামে না হোক হয়তো সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি, টিকটিকি ইত্যাদি কোন না কোন নামে?

যাক এবার আসি দ্বিতীয় ধরণের প্রতিক্রিয়ায়: যারা র‌্যাবের বিরোধিতা করেন এবং র‌্যাব বিরোধী লেখালেখি পছন্দ করেন। এর আগে সম্পদশালী, ছোটবড় পুঁজির মালিক ও সচ্ছল চাকরিজীবীদের কথা বলেছি। তাদের তো র‌্যাবের পক্ষেই হওয়ার কথা কিন্তু তাদেরই একটা অংশ আবার র‌্যাবের বিরোধিতা করছে। তাদের মধ্যে দুটো ধারা আছে। এক হচ্ছে-মানবাধিকার রক্ষার জন্য সক্রিয় এনজিওগুলো – তারাই এক্ষেত্রে সোচ্চার। তারা একটা নীতিগত জায়গা থেকে বিরোধিতা করছেন, যদিও ‘মানবাধিকার’ সংক্রান্ত সংজ্ঞা এনজিও কর্মকাণ্ডের পরিমণ্ডল এবং দেশের বাইরে থেকে আসা অর্থ সাহায্যের সীমা দ্বারা নির্দিষ্ট।

এই শ্রেণীর অপর যে অংশ র‌্যাবের বিরোধিতা করছে তারা প্রধানত আওয়ামীলীগ বা আওয়ামী ধারার পন্থী। নিছকই সংকীর্ণ উদ্দেশ্য ছাড়া তাদের সমালোচনাকে অধিক মূল্য দেয়ার কোন কারণ নেই। তবে তাদের সমালোচনাই আমরা বেশি জোরে শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তাদের এই সমালোচনাই আদৌ কোন সুস্পষ্ট আওয়ামী নীতির ইঙ্গিত নয় বা এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ কি করবে তারও কোন ইশারা নয়। এসব সমালোচনা জোট সরকারকে খেয়ে না খেয়ে সর্বক্ষেত্রে বিরোধিতা করার নিত্যকর্মের মধ্যেই পড়ে। সেই দিক থেকে এসব সমালোচনা একান্তই দলীয় প্রচার - কোন নীতিগত অবস্থান নয়। এই বিরোধিতা শ্রেণীগত কারণে নয়। মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে যারা এনজিওগুলোর তরফে বিরোধিতা করেছেন তাদের কাছেও এটা কতটা নীতি আর কতটা এনজিও কর্মসূচী - সেটা বিচার করা মুশকিল। শ্রেণীগত কারণে সমাজের সম্পদশালী, ছোটবড় পুঁজির মালিক ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে সচ্ছল অংশ র‌্যাবের পক্ষে থাকবে, আমাদের এই অনুমান তাদের কৌশলগত বা পেশাগত বিরোধিতার দ্বারা নাকচ হয় না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে একই শ্রেণীর দুই অংশের মধ্যে র‌্যাবের পক্ষে-বিপক্ষে থাকা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এই পক্ষাবলম্বন দিয়ে র‌্যাব সংক্রান্ত সামাজিক-রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ককে আমরা বুঝব না। সেক্ষেত্রে যারা তথ্য, যুক্তি, বুদ্ধি, বিচারবোধ থেকে তাদের কথা পেশ করছেন তাদের প্রতিক্রিয়া বোঝা জরুরি। তারা পক্ষেই বলুন আর বিপক্ষেই বলুন। তর্কটা আমাদের সমানে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

বারো জুলাই, ২০০৩ তারিখে বাংলাদেশ গেজেট অনুযায়ী র‌্যাব গড়া হয়েছে The Armed Police Battalions (Amendment) Act 2003 নামক আইনি বিধানের আওতায়। এ ধরনের প্যারা মিলিটারি ফোর্স গঠন আকস্মিক বা নতুন কিছু নয়। যারা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে র‌্যাবের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন তাদের কথা হল এ ধরনের সংস্থা আমাদের দরকার, কারণ অন্য দেশেও এরকম সংস্থা আছে। অপরাধ ও অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি তদন্ত করা, বিশেষত সরাসরি ‘সরকারের নির্দেশে’ যে কোন অপরাধ ‘তদন্ত’ (investigate) করা র‌্যাব-এর কাজ। সরকার যেখানে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা ভোগ করে এবং যেখানে বিচার বিভাগ এখনও নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক নয়, সেখানে ‘সরকারি নির্দেশে’ এ ধরনের বাহিনীর ‘তদন্ত’ করার ক্ষমতা কার্যত ক্ষমতাসীন সরকারের প্রাইভেট আর্মি হিসেবেই কাজ করা। র‌্যাব গঠন করার বিধানের ৬ বি ধারা অনুযায়ী, The government may, at any time, direct the Rapid Action battalion to investigate any offence!

অসম বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অন্যায়, শোষণ ও নির্যাতনের প্রক্রিয়া ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ছে দ্রুত। শাসক ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক উভয় ধরনের বিক্ষোভ-প্রতিবাদও বাড়ছে। এরই একটা কুফল হচ্ছে ‘সন্ত্রাস’ বা বিদ্যমান আইনের চোখে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধি। নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে সন্ত্রাস দমন সম্ভব নয়। সন্ত্রাসের আর্থ-সামাজিক কারণগুলোর দিকেই বরং মনোযোগ দিতে হবে। যারা র‌্যাবের পক্ষে বলছেন, তারা বিষয়টিকে অপরাধ ও দমনের জায়গা থেকেই বিচার করেছেন। যেন অপরাধ বা সন্ত্রাস আর্থ-সামাজিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিসরের বাইরের কোন ব্যাপার। এখানেই তাদের নঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ঘটে যায় এবং আমরা ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে এসে দাঁড়াই। আশা করি, ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে আমরা অপরাধ ও সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারব।

২৭ কার্তিক ১৪১১, ১১ নভেম্বর, ২০০৪

(যুগান্তর, ১৩ নভেম্বর ২০০৪)


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।