চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা


১. ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ, মিছিল, জনসভা

অর্থনৈতিক ভাবে বাংলাদেশে অল্প কয়েকটি কোটিপতি এবং মাফিয়া পরিবার ছাড়া অধিকাংশ মানুষই অতিশয় খারাপ অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কোটিপতি আমানতকারী ৭৫ হাজার ৫৬৩ জন। দেশে আয়বৈষম্য বাড়ছে বিপুল ভাবে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় আয় বৈষম্যের যে মাত্রা সহনীয় বলে গণ্য করা হয় বাংলাদেশ তা ছাড়িয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর সময় দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। আর চলতি বছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ২৭২ জনে। করোনাকালীন এক বছরে কোটিপতি বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭ জন।

অতএব ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে আমাদের। সাধারণ মানুষের। আমরা তা প্রকাশ করতে চাই। সেটা শিক্ষিত বা সাক্ষর শ্রেণী শান্তিপূর্ণ ভাবে লেখালিখি করে জানায়, গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে সেটা তারা ছাপে এবং প্রচার করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের বিবেক ও মত প্রকাশের প্রধান ধরণ হচ্ছে রাস্তায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ, মিছিল করা, জনসভা ইত্যাদি। শিক্ষিত সাক্ষর শ্রেণী এবং সাধারণ বা গণমানুষের এই ফারাক আমরা মনে রাখি না। এর ফলে সমাজের শ্রেণী পার্থক্যের দিক থেকে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার হাল কি দাঁড়ায় তার মানেও আমরা আর ধরতে পারি না। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীন্তা এক প্রকার গায়েবি প্রতিশ্রুতি হিশাবে সংবিধানে লেখা থাকে, বাস্তবে এর আর কোন অর্থ থাকে না।ঙ্কখমতাসিন্দের দ্বারা গণ্মানুষ প্রতারিত হতে থাকে।

রাস্তায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ, মিছিল করা, জনসভা করা ইত্যাদির ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা শুরু হয়েছে বহু আগে থেকেই। বিরোধী চিন্তা দমন, রাজনৈতিক দলের সভাসমিতি করবার ওপর নানান প্রকার বাধা নিষেধ আরোপ, পুলিশি  হামলা, পুলিশের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দলীয় গুণ্ডা বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া -- ইত্যাদি নানান পন্থায় ক্ষমতাসীনরা গণমানুষের চিন্তা ও বিবেক হরণ করবার কু-কাণ্ড আমাদের চোখের সামনেই করে গিয়েছে এবং করে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন শক্তি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বিবেক ও মত প্রকাশের উপায় কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। মিছিলে গুলি চালানো সভাসমিতি পণ্ড করা কিম্বা ঘরের ভেতরে বসে আলোচনা করলেও ‘জঙ্গী’বলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আইন-শৃংখলা বাহিনী, ক্রমাগত দমন দমন পীড়ন চলছে। অর্থাৎ বিবেক ও মত প্রকাশের প্রধান ক্ষেত্র ক্ষমতাসীনরা সন্ত্রাসী ও সহিংস রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।   চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা বাস্তবে কিভাবে চর্চা কিম্বা করা হয় কিম্বা ক্ষমতাসীনরা কিভাবে তা হরণ করে সেটা আমাদের পরিষ্কার বুঝতে হবে। বিশেষত বুঝতে হবে ক্ষমতাসীনরা কিভাবে তা হরণ করে।

একই কাজ সামরিক কিম্বা একনায়কতান্ত্রিক সরকারও করে, কিন্তু সেটা তারা করে সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদ কিম্বা পুরা সংবিধান  স্থগিত রেখে।  কিন্তু ফ্যাসিবাদ সাধারণত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে, সংবিধান সংশোধন করে এবং তাদের চিন্তা ও মতাদর্শ আইনের নামে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। এটা তারা পারে কারন ফ্যাসিবাদের একটা জনভিত্তি থাকে, জাতীয়তাবাদী আবেগকে তারা কাজে লাগায়। যেমন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিম্বা চরম ইসলাম বিদ্বেষ, ইত্যাদি। ফ্যাসিবাদ মনে করে তাদের আবেগের যারা অনুসারী নয় কিম্বা যারা তাদের মতাদর্শ সমর্থন করে না, তারা দেশের শত্রু, মুক্তিযুদ্ধের দুষমণ। অতএব বাঙালি জাতিবাদ বিরোধীদের কোন নাগরিক বা মানবিক অধিকারও থাকতে পারে না। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা থাকার তো প্রশ্নই আসে না। অতএব বাঙালি জাতিকে রক্ষার জন্য যারা তাদের দুষমণ তাদের ওপর যে কোন প্রকার জুলুম চালানোকে তারা ছহি বা সঠিক কাজ বলে মনে করে। নাগরিকদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা হরণ করাকে 'জাতীয়' স্বার্থে তারা সঠিক বলে অনে করে।  এই পরিস্থিতিকেই 'ফ্যাসিবাদ' বলা হয়।

আমরা দেখি যে বাংলাদেশে  শিক্ষিত বা সাক্ষর শ্রেণীর বড় একটি অংশ এই পরিস্থিতিকে 'ফ্যাসিবাদ' বলে না। একে তারা বলে ‘কর্তৃত্ববাদী’ ব্যবস্থা, ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট সরকারকে তারা বলে ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকার।

কর্তৃত্ব ছাড়া কোন রাষ্ট্র হয় না। যে কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিচালনা করতে হলেও কর্তৃত্ব দরকার। একটি ছোট প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেও কর্তৃত্ব এবং কর্তৃত্বের পরম্পরা বা শৃংখলা থাকা দরকার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও অতএব কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র। তাহলে কর্তৃত্বের রূপ দ্বারাই আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ণিত হয়। কিন্তু আমরা পরিষ্কারই দেখি এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে 'কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র' এবং ফ্যাসিস্ট সরকারকে 'কর্তৃত্ববাদী সরকার' বলে অভিহিত করে থাকেন। তাদের ধারণা তারা বিদ্যমান ব্যবস্থা ব্যাখ্যার একটা ভাল পরিভাষা পেয়েছেন। আসলে রাষ্ট্রের যে রূপ ফুটে উঠছে , যে রূপ তারা তাদের চোখে সামনে প্রত্যক্ষ করছে, সেটা তারা আর অস্বীকার করতে পারছে না। চরম আহাম্মক না হলে একে কোন ভাবেই  আর 'গণতান্ত্রিক' বলা যাচ্ছে না। কিন্তু তারা আসলে যে কাজটা করেন সেটা হোল বিদ্যমান ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার চরিত্র  ক্রমাগত আড়াল করা। তার মূলত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রের সহযোগী হিশাবেই কাজ করেন।

তাহলে এটা পরিষ্কার সাধারণ মানুষকে সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়া, মিছিল ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রকাশ দমন ও পীড়ন চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনিতা অস্বীকার। রাষ্ট্র নাগরিকদের যে অধিকার রখ করবার কথা তার উল্টাটাই করছে। অন্যদিকে মত প্রকাশ ও সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার কথা বলেও বিশেষ ফায়দা নাই। গণমাধ্যমের মালিক হচ্ছে সেই সকল কোটিপতি, ভূমিদস্যু ও মাফিয়া চক্র, যাদের সঙ্গে জনগণের দ্বন্দ্ব বৈরী। সেই দ্বন্দ্ব গভীর ও পরিব্যাপ্ত। অল্প কিছু কোটিপতির হাতে পুঁজি ও সম্পদ দ্রুত কুক্ষিগত হচ্ছে। বাংলাদেশ আরও বৃহত্তর দ্বন্দ্বের গহ্বরে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিবাচক রূপান্তরের জন্য এই দ্বন্দ্বের আশু মীমাংসা দরকার। ন্যূনতম সুষম উন্নতিও অসম্ভব। গণমাধ্যমের মালিকদের নিজস্ব বৈষয়িক স্বার্থ যেমন আছে তেমনি স্বার্থ রয়েছে দেশী বা বিদেশী ব্যবসা কোম্পানি, বহুজাতিক কর্পোরেশান, ইত্যাদি – যাদের বিজ্ঞাপন ছাড়া গণমাধ্যম টিকে থাকতে পারে না। সে কারণে বাংলাদেশে সফল ও লাভজনক গণমাধ্যম হওয়ার অর্থ বাংলাদেশকে বহুজাতিক কোম্পানির বাজারে পরিণত করার ভূমিকা পালন করা। এই পরিস্থিতিতে মত প্রকাশের বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রধানত নব্য ধনী শ্রেণীর  স্বার্থ সংরক্ষণ করা। সমাজের আয়বৈষম্য বাড়বার অর্থ গচ্ছে দণ্মানুষের মত প্রকাশের ক্ষেত্র বাংলাদেশে নাই বললেই চলে।

পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেচাকেনার বাজারে‘সংবাদ’  আরেকটি প্রধান মুনাফাকারী পণ্য। ‘সংবাদ’ কিম্বা ‘গণমাধ্যম’ বলতে আমরা যা বুঝি তাকে আমাদের প্রচলিত অনুমান দিয়ে বুঝলে চলছে না। বুঝতে হবে পুঁজি এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী একটা মুনাফাকারী ব্যবস্থার অংশ কিম্বা সম্প্রসারণ হিশেব, সাধারণ মানুষ এই ব্যবস্থার বাইরের কেউ নয়। মত প্রকাশের বাহন হিশাবে সংবাদপত্র পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র হয়ে উঠলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ভূমিকা ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে এবং গণমাধ্যম সেই ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়।

সংবাদ বা গণমাধ্যমের যে ভূমিকা তখন প্রধান হয়ে ওঠে সেটা হোল আমাদের ইচ্ছা আকাংখাকে পুঁজি বা ব্যবসার স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করা, যেন জনগণকে পুঁজির বিচলন ও পুঞ্জিভব্ন প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া যায়। স্থানীয় এবং বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থির কারণে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করাবাংলাদেশে যে কারণে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে কঠিন।

“বাংলাদেশে গণমাধ্যমের মালিক কারা?” শিরোনামে ৪৮টি বড় মিডিয়ার উপর চালানো একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, এগুলোর মালিকানা মূলত ৩২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাতে কেন্দ্রীভুত। আর এইসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত।

এই বাস্তবতা মনে রেখে বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা এখানে কিছু আলোচনা করব।

চিন্তা বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা: সংবিধান ও রাষ্ট্র

বাংলাদেশের সংবিধানে  চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বাধা নিষেধ আরোপের অনুচ্ছেদ রয়েছে। সংবিধান নানান সংশোধন ও অদলবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে বাহাত্তর সালের আদি সংবিধানে যা ছিল, এখনও অনুচ্ছেদ তেমনই আছে।

৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

অনুচ্ছেদের ৩৯(১)-এ বলা হোল, “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হোল”। এর অধীনেই ৩৯ (২ক) অনুচ্ছেদে “প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং ৩৯(১খ) অনুচ্ছেদে “সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল” বাক্যগুলো রয়েছে। অর্থাৎ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার সংজ্ঞাও রাষ্ট্র আগাম সাংবিধানিক ভাবে নির্ধারণ করে দিচ্ছে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার মানে হোল, ‘বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা’ এবং ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’।  

কিন্তু ঠিক তার পরের ৩৯ (২) অনুচ্ছেদে তথাকথিত ‘নিশ্চয়তা’ নিশ্চিত ভাবে হরণও করা হোল। অনুচ্ছেদ ৩৯ (২) বলছেঃ “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্র সমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে” রাষ্ট্র নাগরিকরা বাক, ভাব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিচ্ছে।

অনুচ্ছেদ ৩৯ (২) ব্যাখ্যা করলে পরিষ্কার যে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার ‘নিশ্চয়তা’ দেওয়া হয় নি, সেটা হতে হবে শর্ত সাপেক্ষে। সেই শর্ত আইনের দ্বারা ‘যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে’, যে কোন সময় রাষ্ট্র ঠিক করতে পারবে, কখন এই অধিকার রাষ্ট্র হরণ করবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র যখন মনে করবে আইন করে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা হরণ করে নেওয়া দরকার, তখন তার পক্ষে ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ’ আরোপ করতে পারবে।

চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা স্বাধীন বা মুক্ত মানুষের ধারণার সঙ্গে যুক্ত। মানুষ সমাজ বিচ্ছিন্ন 'ব্যক্তি' নয়। মানুষ সমাজে বাস করে। কিন্তু সমাজে মানুষ যেন চিন্তা বা ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে কোথাও থেকে বাধা না পায় সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র উলটা এক হাতে দিয়ে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার কথা বলে অন্য হাতে তা আবার হরণ করে নিচ্ছে।

যদি ভারতীয় সংবিধান পাশাপাশি রেখে পড়ি তাহলে দেখব এই অনুচ্ছেদ প্রায় পুরাটাই ভারতীয় সংবিধান থেকে ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ’ সমেত টুকলিফাই করা। ভারত ১৯৪৯ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেছে তার ১৯ (১) অনুচ্ছেদই ডক্টর কামাল হোসেন টুকে বাংলাদেশের সংবিধানে ভিন্ন ভিন্ন অনুচ্ছেদ হিশাবে বাহাত্তরের সংবিধানে বসিয়ে দিয়েছেন। ভারতীয় সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদের সঙ্গে আমরা বাংলাদেশের সংবিধান পাশাপাশি রেখে পাঠ করলেই সেটা বুঝব।

(1) All citizens shall have the right

(a) to freedom of speech and expression; ( বাংলাদেশের সংবিধান অনুচ্ছেদ ৩৯ (২)

(b) to assemble peaceably and without arms; বাংলাদেশের সংবিধান অনুচ্ছেদ ৩৭

(c) to form associations or unions; (বাংলাদেশের সংবিধান অনুচ্ছেদ ৩৮)

(d) to move freely throughout the territory of India (বাংলাদেশের সংবিধান অনুচ্ছেদ ৩৬;

(e) to reside and settle in any part of the territory of India; (বাংলাদেশের সংবিধান অনুচ্ছেদ ৩৬) and

ডক্টর কামাল হোসেনের এই টুকলিফাইগিরি এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন? এ কারনে গুরুত্বপূর্ণ যে রক্তক্ষয়ী মুক্তি যুদ্ধের পরও আমরা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে আমাদের ইতিহাস, উপলব্ধি ও ঐতিহ্যের আলোকে দাঁড় করাতে পারলাম না। আমরা ভারতের সংবিধান টুকে দিলাম। উকিলদের মুসাবিদা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় কিভাবে পদদলিত করে বাংলাদেশের সংবিধান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ইতোমধ্যে স্বাধীনতার পর ৫০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে, আমাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ঔপনিবেশিক ইংরেজের ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি নিয়ে শাসক হয়ে জনগণকে শাসন করবার জন্য আমাদের ‘সংবিধান’ রচনার কথা ছিল না, ভারতীয় সংবিধান টুকলিফাইয়ের তো কোন প্রশ্নই আসে না। আমাদের দরকার ছিল নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’ (Constitute)। তার মানে আমাদের দরকার ছিল একটি গাঠনিক প্রক্রিয়া আরম্ভ করতে পারা যা জনগণকে যুগপৎ একটি ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) প্রণয়নের কর্তা হিশাবে গঠন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার খোদ ভিত্তি হতে হবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, যেন জনগণ পস্পরের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্বন্ধ নির্ণয় ও মজবুত মজবুত করবার ভিত্তিগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে, নিজেদের স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে গঠন করবার সূত্রগুলো নিজেরাই নির্ণয় করতে পারে। রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া জনগণের সেই  ‘স্বাধীনতা’ অর্থাৎ জনগণেরস্বাধীন  ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কেই যেন মূর্ত করে তুলতে পারে।

ইসলামাবাদ কিম্বা দিল্লির গোলাম হবার জন্য না -- নিজেদের স্বাধীন রাজনৈতিক কর্তা হিশাবে গঠন এবং নিজেদের রাষ্ট্র নিজেরা গড়বার অধিকার অর্জনের জন্য আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সেই  গাঠনিক প্রক্রিয়া – অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বাস্তবে মূর্ত করে তোলার প্রক্রিয়া থেকে জনগণকে বাদ রাখা হয়েছে। জনগণকে তাদের গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে দিল্লীর অধীনস্থ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা (Constituenr Assembly) গঠন না করে উকিলদের দিয়ে ‘সংবিধান’ মুসাবিদা ছিল সে কারনে ওইতিহাসিক ভাবে ভুল পদ্ধতি। যার মূল্য ৫০ বছর ধরে তিলে তিলে আমরা শোধ করছি। এটা ছিল বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে চরম প্রতারণা।

দ্বিতীয় প্রতারণা হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনের সত্তরের নির্বাচনে যারা পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল তাদের দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ প্রণয়ন। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণকে তাদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও রাষ্ট্র গঠন করতে দেওয়া হয় নি।

শুধু তাই নয়। একটি দেশের সংবিধা্ন প্রণয়ন করে সেই দেশের জনগণ। অথচ আজও বড়াই করে বলা হয় ডক্টর কামাল হোসেন বাংলাদেশের  সংবিধান প্রণেতা।

আমাদের দরকার ছিল জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে এমন একটি ‘গঠনতন্ত্র’। কিন্তু কামাল হোসেন আমাদের উপহার দিয়েছেন ঔপনিবেশিক শাসকদের শাসন করবার ইন্সটুমেন্ট বা ‘সংবিধান’। রাষ্ট্র গঠনের অর্থ যদি জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করা হয় তাহলে একটি স্বাধীন দেশের কনস্টিটিউশান কখনই জনগঙ্কে শাসন করবার স্রেফ ‘বিধান’ বা ‘সর্বোচ্চ আইন নয়। গঠনতন্ত্র সামষ্টিক সত্তা হিশাবে জনগণের স্বাধীন অস্তিত্ব যাপনের দলিল। সমাজ ও সমষ্টির মধ্যে ব্যক্তির মুক্তি ও স্বাধীন্তার গ্যারান্টি। কিন্তু আফসোস আমরা সেভাবে নিজেদের গঠন করতে পারি নি। আমাদের কোন ‘কন্সটিটিউশান’ বা ‘গঠনতন্ত্র’ নাই – অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের কোন দলিল আমরা তৈরি করি নি। আমাদের রয়েছে ঔপনবেশিক ইংরেজের মতোই একপ্রকার শাসনযন্ত্র, শাসকের হাতে চাবুকের মতো ধরা ডক্টর কামাল হোসেন প্রণীত ‘সংবিধান’ । এমনই এক ‘সংবিধান’ যারসঙ্গে সাধীনতার ঘোষণার কোন মিল নাই। এই সেই সংবিধান যা দিয়ে কার্যত দিল্লী আমাদের শাসন করতে পারে। সেই শাসনের রূপ কী হতে পারে তার রূপ আমরা এতোকাল ধরে দেখছি।

আমাদের সামনে অন্যান্য দেশের উদাহরণও ছিল। যদি নকলই করতে হয় তাহলে আমাদের সামনে হাজির ছিল গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ঘোষিত ফরাসি বিপ্লবের বিখ্যাত Declaration of the Rights of Man and of the Citizen ; কিম্বা ছিল, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা ‘Declaration of Independence’, ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গাঠনিক দলিল’ (Founding Document) কিম্বা ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) – বিশেষত মার্কিন গঠনতন্ত্রের প্রথম গণ-সংশোধনীর (First Amendment) ইতিহাস। কিন্তু আমরা তা করলাম না, আমরা নকল করলাম ভারতীয় সংবিধান!

মার্কিন গঠনতন্ত্রের প্রথম গণসংশোধনীর তাৎপর্য কি? এই সংশোধনী দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হোল, রাষ্ট্র নয়, জনগণই সার্বভৌম। অতএব রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও সীমিত থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন করে কংগ্রেস। আমাদের করে জাতীয় সংসদ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সংশোধনী পরিষ্কার ঘোষণা দিল:

Congress shall make no law respecting an establishment of religion, or prohibiting the free exercise thereof; or abridging the freedom of speech, or of the press; or the right of the people peaceably to assemble, and to petition the Government for a redress of grievances.

কিন্তু আমাদের ১৪২ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও (ক) সংসদের আইন-দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবে…”। তার জন্য শুধু ‘সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোট’ লাগবে। বাংলাদেশে্র সাংবিধানিক বৈশিষ্ট্যের কারণে রাষ্ট্র ক্ষমতা একজন ব্যাক্তির হাতে কেন্দ্রীভুত। তার মানে রাষ্ট্র ক্ষমতা যার হাতে থাকবে তিনি চাইলে সংবিধান বদলে দেবার একচ্ছত্র ক্ষমতা রাখেন। তাঁকে সাংবিধানিক ভাবে বাধা দেবার কোন ব্যবস্থা সংবিধানে নাই

চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তার অর্থ একই সঙ্গে ধর্ম চর্চার নিশ্চয়তা দেওয়া, কিন্তু রাষ্ট্রের নিজের কোন ধর্ম থাকে না, ধর্ম থাকতে পারে না। মার্কিন গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নী সংস্থা কি কি করতে পারবে না সেটাও সাফ সাফ বলে দেওয়া হোল।

প্রথমত দেখা যাচ্ছে মার্কিন গঠনতন্ত্রে ধর্মের কথা আগে এসেছে, কারণ ধর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধর্ম চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত। ধর্ম ও ধর্ম চর্চার অধিকার থেকে কোন নাগরিককে বঞ্চিত করা যায় না। তাই মার্কিন গঠনতন্ত্রে পরিষ্কার বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, কারন রাষ্ট্র কোন ধর্ম প্রতিষ্ঠার অধিকারী না, কারণ জনগণই সার্বভৌম, রাষ্ট্র না। আধুনিক রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সমান বিবেচনা করা। জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চত করাই আধুনিক রাষ্ট্রের কাজ। একটি ধর্মকে স্বীকার করে নিয়ে অপর ধর্মকে গৌন করা, একটি ধর্মের গুরুত্ব ও প্রাধান্য মেনে অপর ধর্মকে হেয় করা আধুনিক রাষ্ট্রের কাজ নয়।

জনগণের সার্বভৌমত্বই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। অতএব কে কোন ধর্ম বিশ্বাস বা পালন করবে সেটা জনগণের নিজস্ব ব্যাপার। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ধর্ম বিরোধী রাষ্ট্র নয়, বরং নাগরিকদের যার যার ধর্ম প্রচার ও ধর্মচর্চার অধিকার রক্ষা করবার দায়ও রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে অতি অবশ্যই তাহলে প্রত্যকটি নাগরিককে তার নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

রাষ্ট্র ধর্ম স্থাপন করতে পারবে না, কিন্তু ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে -- মূলত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার রাজনৈতিক ও আইনী তাৎপর্য মার্কন গঠনতন্ত্রের গণসংশোধনীর শুরুতেই প্রথমেই সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। ধর্ম আদতে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়ার অর্থ একই সঙ্গে ধর্ম চর্চার নিশ্চয়তা দেওয়া। রাষ্ট্রের নিজের কোন ধর্ম থাকে না, ধর্ম থাকতে পারে না, কিন্তু রাষ্ট্র নাগরিকদের ধর্ম চর্চায় অন্তরায় সৃষ্টি করে না। সেই এখতিয়ার আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে দেওয়া হয় না। বাধা দেওয়া দূরের কথা, বরং ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাজ।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র সম্পর্কে মারাত্মক ভুল ধারনা বদ্ধমূল রয়েছে বলে ধর্মচর্চার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমরা সততই দাঁড়াই। সেটা দাঁড়াই ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র নামে। যে কারণে আমি সব সময়ই বলে এসেছি যে গঠনতান্ত্রিক ভাবে বিচার করে দেখলে বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র’ কায়েম কখনই বাহাত্তরের সংবিধানের উদ্দেশ্য ছিল না। বরং উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে উপমহাদেশ থেকে ইসলাম বিতাড়ন এবং ইসলাম নির্মূল রাজনীতি চালিয়ে যাওয়া। এটা দিল্লির রাজনীতি। প্রাক-ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা। একাত্তর থেকেই দিল্লী বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতা বনাম ইসলামের নামে একটি সহিংস গৃহযুদ্ধ জারি রেখেছে। আর সেই উদ্দেশ্যই স্বাধীনতার ঘোষণা গায়েব করে দিয়েছে। অর্থাৎ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার – এই তিন নীতি বাদ দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংফ্লাদেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বীজ নিয়ে বাংলাদেশ শুরু করেছি। এখন তা ষোল কলায় পূর্ণ হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, কথা বলার, মত প্রকাশের, ভাব প্রকাশের, সংবাদ পত্রের, শান্তিপূর্ণ ভাবে জনগণের একত্রিত হবার, প্রতিবাদ জানাবার, সরকারের কাছে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানাবার অধিকার রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নী সংস্থা বা জাতীয় সংসদ কোন ভাবেই সংকীর্ণ বা ক্ষুণ্ণ করতে পারে না। নাগরিকদের এই অধিকার কোন ভাবেই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ক্ষুণ্ণ, সংকীর্ণ বা সংকুচিত করতে পারে না।

আমাদের অধিকাংশেরই ধারণা শান্তিপূর্ণ ভাবে জনগণের একত্রিত হবার, প্রতিবাদ জানাবার, সরকারের কাছে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানাবার অধিকার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা থেকে ভিন্ন একটি বিষয়। মোটেও না। কিম্বা মনে করি মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে মিছিল বিক্ষোভ আলাদা ব্যাপার। এটা আমরা সহজেই বুঝব যদি ভাবি যারা লেখালিখি করেন না, কিম্বা লিখতে জানেন না তারা কিভাবে মত প্রকাশ করবেন? শুধু শিক্ষিতদের কিম্বা সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, কিন্তু যাঁরা লেখালিখি করেন না, কিম্বা নিরক্ষর গরিব, হত দরিদ্র, শ্রমিক মেহনতি মানুষ তাদের কোন মত প্রকাশের ক্ষেত্র থাকবে না – সেটা তো হতে পারে না। তাই শান্তিপূর্ণ ভাবে জনগণের একত্রিত হবার, প্রতিবাদ জানাবার, সরকারের কাছে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানাবার অধিকার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার অন্তর্গত। এই দিকটা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের মারাত্মক ঘাটতি আছে। যে কারনে বিরোধী দলকে সর্বতোভাবে দমন করা এবং রাস্তায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ সহ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মিছিল দমন ও বন্ধ করবার বিষয়কে আমরা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা থেকে আলাদা করি। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা বলতে শুধু সংবাদপত্রের স্বাধীনিতা কিম্বা লেখালিখির স্বাধীনতা বুঝি। এটা মারাত্মক ভুল ধারনা। তাই মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে তাদের এক সঙ্গেই রাখা হয়েছে। এবং এক কথায়, সংক্ষেপে বলা দেওয়া হয়েছে চিন্তা ও বিবেক রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। কারন এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার মধ্যে রয়েছে সভা সমিতি সমাবেশের অধিকার, ক্ষোভ-বিক্ষোভ মিটিং মিছিল করবার অধিকার, লেখালিখি, প্রকাশনা ও ছাপা অধিকার, যে কোন মাধ্যমে কথা বলা ও প্রচারের অধিকার, ইত্যাদি। এদের একটিও ওপরটি থেকে আলাদা কিছু নয়। এগুলো তিন চার লাইনে বলা যায়। কিন্তু শুরু থেকেই বাংলাদেশের সংবিধানের মতলব ছিল ভিন্ন। এগুলোকে আলাদা লেখা হয়েছে, যেন আমরাও মনে করি এগুলো আলাদা আলাদা অধিকার। না, তারা আলাদা না। তারা একই অধিকার, অর্থাৎ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার অন্তর্গত।

ভারতীয় সংবিধান থেকে টুকলিফাই করা হলেও এমনকি ভারতীয় সংবিধানও এই ক্ষেত্রে সকল অধিকার ১৯(১) ধারায় এক গ্রন্থিত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে তা আলাদা লেখা হয়েছে।

ভারতীয় সংবিধানের সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে বাংলাদেশের। ভারতীয় সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা আলাদা করে বলা নাই। ভারতীয় সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে সব একই অনুচ্ছেদের অধীনে রয়েছে। বাংলাদেশে সেটা আলাদা আলাদা। যে দেশে অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর সেই দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়ে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায় না। বাবা সাহেব আম্বেদকার সেটা ভালই জানতেন। তাই সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমকে আলাদা গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন তিনি বোধ করেন নি। বরং সেই ক্ষেত্রে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশের গুরুত্ব সর্বাধিক। চিন্তা ও বিবেক প্রকাশের জন্য সভা সমাবেশ ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রকাশ করবার জন্য মিছিল অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে সেই সব আলাদা হাজির করা হয়েছে। গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার সম্পর্ক বুঝতে পারার অক্ষমতা একটা কারন হতে পারে। তবে শ্রেণী চেতনা এখানে প্রবল ভাবে কাজ করেছে। মিটিং মিছিল বিক্ষোভ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা থেকে আলাদা। সেই স্বাধীনতা শুধু ধনি ও শিক্ষিত শ্রেণীর আছে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা গরিবের নাই। তাই সভা সমতি বিক্ষভ মিছিলে রাষ্ট্র যখন তখন প্রবল সন্ত্রাসী ও সহিংস রূপ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। এই বন্দোবস্ত বাংলাদেশের সংবিধানেই করে রাখা হয়েছে। শ্রেণী স্বার্থে ভারতীয় সংবিধান টোকাটাও ভালভাবে করা হয় নি।

খসড়া সংবিধান নিয়ে তর্কে ডক্টর আম্বেদকারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আলাদা ভাবে ১৯(১) অনুচ্ছেদে নাই কেন? সংবিধান প্রণয়ণের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান হিশাবে আম্বেদকার উত্তর দিয়েছিলেন, “সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বিশেষ ভাবে আলাদা ভাবে বলা মোটেও জরুরি না, মত বা ভাব প্রকাশের অধিকারের দিক থেকে (right of expression) একজন ব্যক্তি কিম্বা নাগরিক একই”। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। যে কোন নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের নিশ্চয়তা পাবার যে অধিকার, সংবাদপত্র বা সাংবাদিকেরও ঠিক সেই অধিকার। কিন্তু চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সংক্রান্ত অন্য সকল অধিকার থেকে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতাকে আলাদা করা এবং সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের অধিকারকে নাগরিকদের চিন্তা ও বিবেকের অধিকারের উর্ধে স্থাপন করার ফলে বাংলাদেশে এক চরম অসাম্য তৈরি করা হয়েছে। তার কুফলও হয় মারাত্মক। কিছু কিছু সাংবাদিক ও গণমাধ্যম মনে করে তারা জনগণের উর্ধে প্রায় ঈশ্বরের কাছাকাছি বাস করে। ফলে তারা যা খুশি তাই বলতে পারে, নিজেদের বিবেকের কাছে দায়ী না হয়ে যা খুশি তাই প্রচার করতে পারে। বাংলাদেশে পরিচিত কিছু গণমাধ্যমের যে দানবীয় চরিত্র আমরা দেখি, রাষ্ট্রের হিন্স্র ও সন্ত্রাসী চেহারা তারাও পুরাপুরি ধারণ করে। তাদের এই বিমারির গোড়াও চিন্তা ও বিবেকের স্বাধী্নতা সম্পর্কে আমাদের সমাজে চরম অজ্ঞতা। এই দিকটি আমামদের বুঝতে হবে।

৩. চিন্তা বিবেকের স্বাধীনতা: আইন ও বাস্তবতা

বাংলাদেশে প্রেস এন্ড পাব্লিকেশান্স এক্ট, অফিশিয়াল সিক্রেসি এক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট ইত্যাদি নানান আইন জারি রয়েছে। রাষ্ট্র নিজের, মাফিয়া পরিবারগুলোর, কর্পোরেশান কিম্বা বিদেশী কোন শক্তির স্বার্থে আইন ও বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এইসব এক্টের মধ্য দিয়ে হরণ করছে। এটা আমরা দেখছি।

অফিসিয়াল সিক্রেক্টস অ্যাক্ট বানানো হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশকালে, ১৯২৩ সালে। লর্ড কার্জন যখন ভারতবর্ষের ভাইসরয় ছিলেন তখন এই আইন প্রণয়ন করা হয়। আঠারোশ নিরানব্বই সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েক-দফা এটি সংশোধিত হয়ে ১৯২৩ সালে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট জারি করা হয়। এই আইনটি করা হয়েছিল সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য— এই আইনের সঙ্গে তথাকথিত ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা’র ধারণা জড়িত। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনগণের কাছ থেকে আড়াল রাখার জন্য এই আইন জারি হয়।

প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা দায়ের করার পর তিনি কারাগারে ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর। পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগের নজির নাই, কিন্তু সেটা রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে এ আইন প্রয়োগ করে তাঁকে কারাগারে রাখার অর্থ হোল আমরা এখনও ইংরেজের আই দিয়ে দেশ চালাচ্ছি।

দুই হাজার ছয় সালে দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীকে নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতা ও ফোনালাপ রেকর্ড করার অধিকার মঞ্জুর করে ২০০১ সালের আইন সংশোধন করে টেলিকমিউনিকেশন (সংশোধন) অ্যাক্ট— প্রণয়ন করা হয়। প্রাইভেসি বা ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা’ আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। এই অধিকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে যেমন রয়েছে, তেমনি জাতিসংঘের নানান ঘোষণা, সনদ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা লাভ করেছে।

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০১৮ অদ্ভূত। এই আইনে যে কোন নাগরিককেই রাষ্ট্র বা আইনশৃংখলা বাহিনী চাইলে ‘দেশদ্রোহী’ বানিয়ে দিতে পারে। ‘মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, প্রভৃতি দলীয় রাজনৈতিক বয়ান বা ধ্যাণধারণার বিরুদ্ধে লেখালিখি করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস ইতিহাসবিদদের এখতিয়ারে আর নাই। ইতিহাসের গবেষকরা নয়, ইতিহাস ঠিক করে দিচ্ছে আদালত।

ইন্টারেস্টিং হচ্ছে আমরা সংখ্যা দিয়ে ভাল-খারাপ বিচার করি। যেমন, ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট কতো খারাপ সেটা বোঝার জন্য আমাদের সংখ্যা হাজির করতে হয়। মানবিধাকার সংস্থাগুলো সেই সংখ্যা আমাদের সরবরাহ করে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এর অধীনে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯১৩জন নাগরিক অভিযুক্ত হয়েছেন, আটক হয়েছেন ২৭৩জন। আটককৃত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে লেখক ও সাংবাদিক ৩১জন, রাজনীতিবিদ ২৭জন, ছাত্র-ছাত্রী ১৭জন, শিক্ষক রয়েছেন ১৫জন। এই আইনের আগে আইসিটি অ্যাক্টের অধীনে শহিদুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরপর ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এর অধীনে আটক মুশতাক আহমেদের করুণ মৃত্যু বিপুল সামাজিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। তুলনামূলক ভাবে অখ্যাতরা আমাদের নজরের আড়ালে থেকে গিয়েছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নির্মমতায় শারিরীক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। কয়জনেরই বা খোঁজ রাখি আমরা। আর তারা যদি ইসলামপন্থি অখ্যাত কেউ হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নাই। কারাগারে বা পুলিশী হেফাজতে অনেকের করুণ মৃত্যুর কথা আমরা জানি। তাছাড়া আটকাধীন অবস্থায় নির্মম জিজ্ঞাসাবাদের কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে অনেকেই

এখানেই শেষ নয়। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের উপর নজরদারি চলছে। গণ-নজরদারিতে সক্ষম কৃৎকৌশল ও সরঞ্জামাদি কিনেছে রাষ্ট্র, আইন-শৃংখলা বাহিনী তা ব্যবহার করছে। এটা পরিষ্কার বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। খুবই নগ্ন ভাবে ভিন্ন মত ভিন্ন চিন্তার দমন, পীড়ন, নির্যাতন চলছে। সেই কারণে চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ রণধ্বনি।

বাংলাদেশের বাস্তবতা আমাদের বিস্মিত করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই, কিন্তু বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো এতো গণমাধ্যম কেন? সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ৪৫টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, ২৮টি এফএম রেডিও, ৩২টি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন, এক হাজার ২৪৮টি দৈনিক পত্রিকা ও শতাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে। এটা ২০২০ সালের হিশাব। এখন নিশ্চয়ই আরো বেড়েছে।

এর কারণ বোঝা কঠিন কিছু না। আগেই বলেছি ব্যবসায়ী ও মাফিয়া পরিবারগুলোই কমবেশী গণমাধ্যমগুলোর মালিক। এটা তাদের ক্ষমতাধর হওয়ার চেষ্টা। বাংলাদেশে দ্রুত মুনাফা কামানো ও আত্মস্ফীতির উপায় হচ্ছে রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকা। গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকার একটি প্রধান উপায়। বাংলাদেশে পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তর খুবই শ্লথ, মন্থর, কষ্টকর এবং দীর্ঘ। বিনিয়োগ থেকে মুনাফা আদায় করা কঠিন কাজ। টাকা আছে আমদানি-রপ্তানি, ঠিকাদারি ও রাষ্ট্রের বড় বড় প্রকল্পে। তাই সেই সকল ব্যবসায়ী ও মাফিয়া গ্রুপ দ্রুত মুনাফা কামানোর ক্ষেত্র হিশাবে রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকা দরকার মনে করে। গণমাধ্যমের মালিক হওয়া তাদের জন্য জরুরি। তুলনামূলকভাবে বহুজাতিক কর্পোরেশানের স্বার্থ রক্ষা করে যারা মুনাফা কামায় তাদেরকেও সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রতিযোগী হিশাবে প্রভাবশালী থাকতে হয়।

২০১৬ সালে, বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী জানান, দেশের ১০৭৮ টি সংবাদপত্রের মধ্যে ১০০৫টিই, বা ৯৩% সংবাদপত্র তাদের সম্পাদকের মালিকানাধীন। অন্যভাবে বললে, মালিকই হচ্ছেন সম্পাদক। ভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায় মাত্র ১০০টিরও কম সংবাদপত্র পরিচালিত হয় পেশাদার সম্পাদক দিয়ে।

এ এক অদ্ভূত পরিস্থিতি!

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২১ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ খালি পেছাচ্ছে তো পেছাতেই আছে। বাংলাদেশ ২০১৯ সাল থেকে এক ধাপ করে পিছিয়েছে। দুই হাজার উনিশে বাংলাদেশের অবস্থান সূচক ছিল ১৫১, দুই হাজার একুশ সালে ১৫২। পাকিস্তান উপরে, ১৪৫; অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা উত্তম। পাকিস্তানের সঙ্গে ইন্ডিয়া্র সঙ্গে বিরাট কোন গ্যাপ নাই; মাত্র তিন কাঠি উপরে, ১৪২; অর্থাৎ একটু ভাল। তবুও বলা যায় ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশ খারাপ করে নি। হন্ডূরাস উপরে থাকলেও তুরস্ক নীচে। এমনকি রুয়ান্ডা, মিশর, সৌদী আরব, চিন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া নীচে – এইসব দেশের উপরে আছে বাংলাদেশ।

‘জনগন’ তাদের চিন্তা, বিবেক বা মত কিভাবে প্রকাশ করে? কিভাবে লিখে জানায়? যারা লিখতে পারে তারা না হয় তাদের মত লিখে, প্রকাশ করে এবং প্রচারের মাধ্যমে ভোগ করে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা লিখতে জানে না তাদের কথা আমরা ভাবি না।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য সাংবাদিকদের সংঘবদ্ধ লড়াই একসময় আমরা দেখেছি। বাকশালের সময় চারটি পত্রিকা রেখে আর সব পত্রিকা বন্ধ যেদিন বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেই দিনটিকে সাংবাদিকরা ‘কালো দিবস’ হিশাবে পালন করতেন। এখন তারা একসঙ্গে সেটা করেন না। কারন সাংবাদিকরাও দলীয় ধারায় বিভক্ত। বিভাজনের উর্ধে উঠে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার গুরুত্ব এতে সমাজে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পের কালো দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাকশাল কায়েমের অংশ হিশাবে শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগ চারটি সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ছাড়া বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর ১৯৭৮ সালে অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) বার্ষিক কাউন্সিলে গৃহীত এই দিনটিকে ‘কালো দিবস’ হিশাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এতোকাল আমরা দেখতাম প্রতি বছর এ দিনটিকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালন করা হোত। বাহ্যিক বিচারে বলা যায় সাংবাদিকরা বিভক্ত বলে এটা হচ্ছে না। কিন্তু সেটা বাইরের দিক। ‘কালো দিবস’ পালন না করা, কিম্বা বিভক্ত হয়ে দুর্বল ভাবে পালনের মতো দুর্দশায় আমরা এতো সহজে পড়তাম না।

কিন্তু চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা কি শুধু রাষ্ট্রের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য দরকার? রাষ্ট্র যদি দমন ও নিবর্তনমূলক আইন না করত, আমাদের কি গোড়ার প্রশ্ন বিচার করে দেখার দরকার হোত না? কী সেই প্রশ্ন? সেই প্রশ্ন হোল, কেন মানুষের সমাজে চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা অবশ্যই জরুরী?

চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা কেন দরকার?

চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা কি? কেন দরকার? এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আগামি দিনে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে পুনর্গঠন করবার প্রস্তুতি হিশাবে এই বিষয়টির গভীরে আমাদের যেতে হবে। আমরা অনেক কিছু স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে মানি। কিন্তু চিন্তা, বিবেক কিম্বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে কেন? না থাকলে কি অসুবিধা? সেই প্রশ্ন তুলবার হিম্মত আমরা এখনও অর্জন করি নি। আমরা যেমন, আমাদের রাষ্ট্রও তেমন। ফলে রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটবে পরে, আমাদের চিন্তা ও বিবেকের পরিণতি হিশাবে। সে কারণে কঠিন প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নাই। এ নিয়ে আলাদা ভাবে বিস্তৃত লিখতে হবে। তবে এই লেখাটির উপসংহার হিশাবে দুই একটি কথা বলে রাখা যায়:

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে চিন্তা ও বিবেক। চিন্তাকে অবশ্যই স্বাধীন এবং সততই সপ্রাণ রাখতেই হবে। এটাই গণতন্ত্রের প্রধান চ্যালঞ্জ। কিভাবে চিন্তাকে সচল, সজীব ও সক্রিয় রাখা যায় তার দ্বারাই সমাজ তার বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়।

চিন্তা করা ব্যক্তির প্রতিভা বটে, কিন্তু চিন্তা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ সমষ্টির উপলব্ধি, চেতনা, কামনা, বাসনা আকাঙ্ক্ষা বোঝার একমাত্র পথ হচ্ছে চিন্তাকে সামষ্টিক করে তুলবার প্রক্রিয়া গড়ে তোলা। একেই ‘রাজনৈতিক পরিসর’ বলা হয়। রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার অর্থ আমার ইচ্ছা, কামনা বাসনা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমি সমাজের বাইরের কেউ না, তাহলে সমাজই আমার ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা কামনা বাসনা চরিতার্থ করবার উপায়, সমাজের বাইরে আমি তা বাস্তবায়িত করতে পারব না। আমরা রবিনসন ক্রুসো না যে জাহাজ ভেঙে এক জনমানবহীন দ্বীপে এসে পড়েছি। তাহলে আমাদের সামাজিক হতে হবে। সামাজিক ভাবেই আমাদের সমস্যা মোচন করতে হবে। সমাজের অন্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা তর্ক বিতর্ক লাগবেই। ওর মধ্য দিয়েই ব্যক্তির ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা কামনা বাসনা সামষ্টিক বা সামাজিক হয়ে ওঠে এবং যে সমাজ আমরা জারি রাখি তার গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যও ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে।

কিন্তু শুধু রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থনৈতিক বিরোধ বা দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে পারে না। তবে সেই দ্বন্দ্বকে স্পষ্ট ও দৃশ্যমান করে তুলতে পারে। গণতন্ত্রকে তখন শুধু রাজনৈতিক অর্থে নাগরিক ও মানবিক অধিকারে সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না, সমাজের আর্থ-সা্মাজিক দ্বন্দ্বের মীমাংসার জন্য সামষ্টিক স্বার্থের কথা ভাবতে হয়। সেই দ্বন্দের মীমাংসা কিভাবে হয় বা হবে তার পরোটাই নির্ভর করছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে আমরা কতোটা ব্যাক্তি হিশাবে নয়, বরং সমাজের ভিত্তু হিশাবে ভাবতে ও বাস্তবায়ত করতে পেরেছি তার ওপর নির্ভর করবে। আর কোন সোজা রাস্তা নাই।

মানুষের পক্ষে কি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অর্জন সম্ভব? দর্শনের ইতিহাসে এ নিয়ে দীর্ঘ তর্ক আছে। তবে এরস্টটলের আমল থেকেই শক্তিশালী মত হচ্ছে জীবের পক্ষে তার প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির তাড়নায় যতোটুকু, তার অধিক ‘সামাজিক’ হওয়া সম্ভব না। যেমন একসঙ্গে এক পালে থাকা, এক সঙ্গে শিকার করা ও আহার করা, ইত্যাদি। কিন্তু মানুষ তার জীবমূলক স্বার্থের উর্ধে ওঠার ক্ষমতা রাখে। কারন মানুষ কথা বলে, অতএব মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী। সামাজিক বা রাজনৈতিক বলে মানুষ নিজের স্বার্থ সমাজের স্বার্থের জন্য ত্যাগ করতে সক্ষম। যেমন সমাজের সেবা করা, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া, ইত্যাদি। তাহলে মানুষের পক্ষে অবশ্যই 'রাজনৈতিক’ হওয়া এবং রাজনোইতিক অর্থে প্রজ্ঞাবান হওয়া সম্ভব। রাজনৈতিক হওয়ার অর্থ হচ্ছে সবার সঙ্গে কথাবার্তা আলাপ আলোচনা ও তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে বুঝতে পারা কোন দ্বন্দ্ব বা বিরোধ মতাদর্শিক, আর কোন ইচ্ছা, কামনা, বাসনা নিছকই জৈবিক। বিরোধের চরিত্র স্পষ্ট হলে তার মীমাংসাও সম্ভব। দ্বন্দ্ব যেখানে গোড়ার কিম্বা অর্থনৈতিক সম্পর্কের দ্বন্দ্ব থেকে তৈরি, তখন তাকে বৈপ্লবিক কায়দায় মোকাবিলা ছাড়া ইতিহাসে অন্য কিছু হয়েছে তার প্রমাণ নাই। কিন্তু মতাদর্শিক – অর্থাৎ চিন্তা ও বিবেকের বিরোধ মানুষ মীমাংসা করতে পারে। সেখানে গণতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের দুর্দশার কারন হচ্ছে চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশকে আমরা ফর্মুলা হিশাবে মুখস্থ বলি, কিন্তু তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি ও বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের প্রবল ঘাটতি আছে।

৩ জুলাই ২০২১।। শ্যামলী।

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।