গণতন্ত্রের সংকট: উত্তরণের উপায়


গত ২৫ ডিসেম্বর (২০২১) প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফিউজে) আয়োজিত ‘গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের সংকট শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিশাবে লেখাটির সারসংক্ষেপ পেশ করেছি। কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনাও করেছি। পুরা নিবন্ধটি এখানে পেশ করা হোল। 

বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এবং এখনকার সুনির্দিষ্ট কর্তব্যের আলোকে গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের সংকট নিয়ে কিছু কথা বলবার জন্য এই খসড়া। উদ্দেশ্য হচ্ছে কিছু বিষয় কেন্দ্র করে আলোচনার সুত্রপাত ঘটানো। আমি মতবাদী নই, অর্থাৎ আগাম নির্ধারিত বদ্ধমূল মতের বোঝা বেড়ানো আমার ধাতে নাই। অতএব এখানে উদ্দেশ্য হবে চিন্তা উসকে দেওয়া, যেন আমরা বদ্ধমূল চিন্তার খোপ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ভাবে চিন্তা করতে পারি।

গণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের দিক থেকে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সংকট সরাসরি চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার ধারনার সঙ্গে যুক্ত। এ নিয়ে আমি ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’ শিরোনামে ‘চিন্তা’ ওয়েবসাইটে আলাদা লিখেছি।  লেখাটি পড়ে নিলে খুশি হব। এখানে আমি গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের সংকটের ওপর আলোকপাত করেছি।

গণতন্ত্রকে নির্বাচন সর্বস্ব ধারণায় পর্যবসিত করা

শিরোনাম,‘গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের সংকট’। এই শিরোনামটি আমার দেওয়া না। তাতে অসুবিধা নাই। শিরোনাম উদ্যোক্তারা দিয়েছেন। তবে এভাবেই আমরা বলতে ও চিন্তা করতে অভ্যস্ত। সাধারণত আমরা অনুমান করি বাংলাদেশে বুঝি একসময় গণতন্ত্র ছিল। এখন সেই গণতন্ত্রে সংকট তৈরি হয়েছে। এই অনুমানের পেছনে প্রধান কারন হচ্ছে গণতন্ত্র বলতে আমরা স্রেফ নির্বাচন বুঝি। অথচ গণতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্রের একটি বিশেষ রূপ। তথাকথিত সার্বভৌম ক্ষমতা চর্চার একটি বিশেষ ধরণ ও ব্যবস্থা।

গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের অনুমান স্রেফ নির্বাচনে পর্যবসিত হওয়াটা রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতির পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের বাস্তব সমস্যা বাস্তবোচিত ভাবে আমরা তাই চিহ্নিত করতে অক্ষম। সমাধানের সুনির্দিষ্ট আশু কর্তব্য নির্ধারন করতেও আমরা পারি না। তাই ক্রমাগত গণতন্ত্র নামক আজগবি অনুমানের জন্য চিৎকার করতে থাকি। দাবি করি, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়া হোক। আমামদেওর গণতন্ত্রর সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।

অর্থাৎ আমরা রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়ার আলোচনা বাদ দিয়ে নির্বাচনের দাবি করতে থাকি। ভাবি, একটা নির্বাচন দিলেই বুঝি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক বা গাঠনিক সংকটের সমাধান হয়ে যাবে। বুঝি কোন এক মায়াবী যাদুকরের দণ্ড আমাদের হাতে আছে, সেই যাদুদণ্ডের জোরে আমরা আমাদের গণতন্ত্রের সমস্যা নির্বাচনে জয়ী হয়েই সমাধান করে ফেলতে পারব। এটা অসম্ভব। অতএব রাজনীতি, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি বলতে আমরা কি বুঝি সেইসব দ্রুত আলোচনার বিষয়ে পরিণত করতে হবে এবং আমাদের আশু কর্তব্য সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত দ্রুত গড়ে তুলতে হবে।

গণতন্ত্রকে স্রেফ নির্বাচন ভাবার দুর্দশা দেখে বোঝা যায় রাজনীতি, রাজনৈতিকতা এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে আমাদের সমাজে অতি প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা ও পর্যালোচনার প্রকট অভাব রয়েছে। গণতন্ত্র সম্পর্কে অতি প্রাথমিক ধারণাটুকুও আমরা অর্জন করতে পারি নি যে গণতন্ত্র স্রেফ নির্বাচন না, গণতন্ত্র হচ্ছে আধুনিক খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্যে সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিশেষ একটি রূপ। ইউরোপের সুনির্দিষ্ট খ্রিস্টীয় ইতিহাসের মধ্যেই এর উদ্ভব ঘটেছে। যে কারণে তরুণ কার্ল মার্কস কোন রাখঢাক না করে বলেছিলেন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ধর্মতত্ত্বেরই বিকশিত রূপ । তাই ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা ছাড়া সমাজ, অর্থনীতি রাজনীতি বা রাষ্ট্র ইত্যাদির রহস্য কোনদিনই উন্মোচন করা যাবে না। আধুনিক রাষ্ট্র নিজেকে সেকুলার দাবি করলেও মর্মের দিক থেকে ধর্মতত্ত্বেরই আধুনিক রূপ। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র একটি ধর্মীয় বা ধর্মতাত্ত্বিক প্রকল্প।

এই দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার একমাত্র পথ হচ্ছে গোড়ার বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনার শক্তিশালী ধারা গড়ে তোলা। বলা বাহুল্য একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির আত্মসচেতন হওয়ার মাত্রা সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল এবং রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার গভীরতা ও মাত্রা দিয়ে বোঝা যায়। এই সকল বিষয়ে আলোচনার প্রাথমিক সামর্থ আমরা অর্জন করেছি বলা কঠিন। ইতোমধ্যে সমাজ আরও জটিল হয়েছে, অর্থনীতি পুঁজির বৈশ্বিক ও গোলকায়িত বৃত্তের অধীনস্থ হয়ে পড়েছে, সংস্কৃতিও অনেক বেশী জটিল হয়ে পড়েছে, বিজ্ঞান ও টেকনলজির বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছে এবং আমাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আমরা দ্রুত বদলে যাচ্ছি । বদলের প্রক্রিয়া ও তার সর্বব্যাপী প্রভাব এবং গভীরতা সম্পর্কে আমরা নিজেদেরই আদৌ হুঁশ নাই। এইসব গতি ও বদলের কিছুই অস্বাভাবিক নয়। মানবেতিহাস স্থির বা নিষ্প্রাণ কিছু না। রূপান্তর এবং গতির মধ্য দিয়েই ইতিহাস নিজেকে মূর্ত করে তোলে। এই অবস্থায় অতিশয় প্রাথমিক ও গোড়ার বিষয়সকল নিয়ে আলোচনার হিম্মতও আমাদের সমাজে গড়ে ওঠে নি। রাজনীতি ও রাষ্ট্রের বিষয়ে অজ্ঞতা এবং চিন্তার অভাব ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারপরও আমাদের কাউওকে না কাউওকে কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে।

গণতন্ত্র স্রেফ নির্বাচন না, রাষ্ট্রের একটি রূপ বা ধরণ

রাজনীতির আলোচনা মূলত ক্ষমতা, ক্ষমতার রূপ এবং ক্ষমতা চর্চার আলোচনা। ক্ষমতার আলোচনা নিছকই বল প্রয়োগ বা শক্তির আলোচনা নয়। ক্ষমতার সঙ্গে মতাদর্শ, শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং টেকনলজির প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গী জড়িত। রাষ্ট্রের আলোচনা এ যাবত কাল রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভুত ক্ষমতা এবং বল প্রয়োগের শক্তি কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্রচলিত বামপন্থার প্রভাব আছে। রাষ্ট্র শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার এই ধারণ কমবেশী জনপ্রিয়। প্রচলিত বামপন্থা রাষ্ট্রকে স্রেফ বল প্রয়োগের হাতিয়ারের অধিক কিছু গণ্য করে না। পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপের মধ্যে বল প্রয়োগের ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত হওয়া। ক্ষমতার চরিত্র বা বল প্রয়োগের রূপের দিক থেকে আধুনিক রাষ্ট্র সশস্ত্র এবং সহিংস। যেমন, ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের বরাতে লেনিন বলেছিলেন সশস্ত্র লোকের সেনাবাহিনী, পুলিশ, কারাগার, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি।

কিন্তু রাষ্ট্রের এই বিশেষ রূপ পাশ্চাত্যের আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যেই সর্বোচ্চ বিকশিত হয়েছে। যা আসলে খ্রিস্টিয় গির্জার সার্বভৌম ক্ষমতার আধুনিক সেকুলার রূপ মাত্র। রাষ্ট্রের এই বিকাশ আল্লার সার্বভৌমত্বকে গির্জার ক্ষমতায় পর্যবসিত করা, এরপর গির্জার সার্বভৌম ক্ষমতাকে রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা এবং রাজার সার্বভৌম ক্ষমতাকে জনগণের সার্বভোম ক্ষমতা হিশাবে দাবি করে ‘জনগণ’ নামক বিমূর্ত ধারণার নামে আধুনিক রাষ্ট্র তথাকথিত সার্বভৌম ক্ষমতা চর্চার প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। এই য়াধুনিক রাষ্ট্র একচেটিয়া সশস্ত্রতা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে চর্চা করে। খ্রিস্টীয় গির্জার এই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশাবে রূপান্তরিত হয়ে আসার ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি এই ধারণাই পাকাপোক্ত করা হয় যে রাষ্ট্র সম্পর্কে খ্রিস্টিয় চিন্তার বাইরে আর কোন চিন্তা সম্ভব না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলতে খ্রিস্টিয় ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্রই আমাদের বুঝতে হবে। এমনকি ইসলামপন্থিরাও যখন ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কিম্বা ‘ইসলামি খেলাফত’ দাবি করে তারা আদতে এই খ্রিস্টিয় রাষ্ট্রকে ইসলামি লেবাস পরিয়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে শরিয়া কায়েম করবার কথাই বলে। এটাই তাদের ধর্মীয় বাসনা। ইসলামে ক্ষমতা তৈরি ও চর্চার ভিন্ন রূপ কিম্বা পাশ্চাত্যের অনুকরণ না করে শৃংখলা, ক্ষমতা , আইন ও শাসন ব্যবস্থার ভিন্ন বিন্যাস সম্ভব সেটা নিয়েও প্রচলিত শরিয়ার বাইরে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা নাই। ইসলামের নামে তারা খ্রিস্টিয় প্রজেক্ট বাস্তবায়নের কথাই বলে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা গির্জার সার্বভৌম ক্ষমতারই আধুনিক সেকুলার রূপ মাত্র। পাশ্চাত্যের আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা খ্রিস্টিয় গির্জার সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আদতে একটি রাজনৈতিক ধর্মতাত্ত্বিক বর্গ। ইসলামে কোন ভ্যাটিকান নাই। তাই ফতোয়া দেবার অধিকারী হলেও ইসলামে সার্বভৌম ক্ষমতা চর্চার অধিকার বা এখতিয়ার আলেম-ওলেমা বা মওলানাদের দেওয়া হয় নি। এই পার্থক্যগুলো মনে রাখা পাশ্চাত্যকে অনুকরণ না করে বাংলাদেশে নতুন গণ-রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার উন্মেষের জন্য জরুরি। যেন আমরা নিজেদের সমষ্টিগত ভাবে একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অন্তর্গত কল্পনা করতে ও ভাবতে শিখি এবং নিজেদের রাজনৈতিক রূপ মূর্ত করে তুলতে পারি।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি হিশাবে বলা আছে যে “প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে”। দেখা যাচ্ছে প্রশাসন বা শাসন ব্যবস্থার কাঠামো বা রূপ নির্ণয়ের গণমুখী চিন্তাভাবনার উপাদান আমামদের সমাজে ছিল, কিম্বা আছে। কিন্তু সেইসব রয়েছে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ভাবে, রাষ্ট্রগঠনের সামগ্রিক কল্পনা বা ধারণার অন্তর্গত গাঠনিক ভিত্তি হিশাবে দানা বাঁধে নি। বাংলাদেশের সংবিধানে এই অনুচ্ছেদটিকে তাই প্রক্ষিপ্ত বাক্যের অধিক গণ্য করা কঠিন। এ ধরনের চিন্তা রাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি হিশাবে গ্রহণ করা হয় নি। সংবিধানের মূল নীতি অধ্যায়ে নিছকই উপদেশমূল পরামর্শ রূপে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। উপদেশমূল পরামর্শ বলার কারন হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূল নীতি বাস্তবায়নের কোন সাংবিধানিক বা আইনী বাধ্যবাধ্যকতা নাই। কি ধরনের রাষ্ট্র প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত গণ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে তা নিয়ে সমাজে বা রাজনীতিতে কোন অর্থবহ তর্কবিতর্কও নাই। সংবিধানের মূল নীতিতে শুধু জনগণের অংশগ্রহণ বলা হয় নি। বলা হয়েছে ‘কার্যকর অংশগ্রহণ’। অর্থাৎ রাষ্ট্রের রূপ নির্ণয়ের বাধ্যবাধকতা না রেখে ‘মুলনীতি’ অধ্যায়ে পরামর্শ আকারে রাখার ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের এই অনুকুল ধারণা স্রেফ আকাশকুসুম কল্পনা হিশাবে রয়ে গিয়েছে।

এর পরিণতি ভয়ংকর হয়েছে। বাংলাদেশে কোন গণতান্ত্রিক প্রশাসন গড়ে ওঠে নি। বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র ভয়ংকর রূপ নিয়ে খোদ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই গিলে ফেলেছে। আমলাতন্ত্র ও জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব প্রকট ভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নামক যা অবশিষ্ট ছিল সেটাও কার্যত ধ্বংস করা হয়েছে । তাহলে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারে প্রাশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত গণ প্রতিনিধিদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবার জন্য কি ধরণের শাসনকাঠামো দরকার তা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবনা চিন্তা করা। আমলাতন্ত্র থেকে মুক্তি দরকার সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু কি ধরণের রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র জনগণের টুঁটি টিপে মারবে না শাসন ব্যবস্থার সেই সম্ভাব্য রূপ নিয়ে বাস্তবোচিত ভাবে ভাবতে হবে।

ক্ষমতা এবং শাসনের সুনির্দিষ্ট রূপ হিশাবে গণতন্ত্রকে বোঝার প্রকট ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ‘গণতন্ত্র’ ‘গণতন্ত্র’ বলে বাংলাদেশে সারাক্ষণ মুখে ফেনা তোলা হয় কেন? এটা রাজনৈতিক ভাবে ফাঁপা একটি সমাজের লক্ষণ। এই কোলাহল রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাংখা থেকে নয়, কোলাহল ওঠে স্রেফ একটা অন্তঃসারশূন্য নির্বাচনের জন্য। বাংলাদেশের জনগণ প্রকট ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার দ্বারা চরম নিপীড়িত। এই অবস্থায় মৌলিক রাজনৈতিক প্রশ্ন হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে মুক্তি লাভ। যার অর্থ পালটা গণশক্তি নির্মাণ এবং জনগণের ক্ষমতাকে এবং গণতান্ত্রিক প্রশাসনকে সুষ্ঠ রূপ দেওয়া। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণে সক্ষম রাষ্ট্র গড়ে তোলা। রাষ্ট্রকে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের মূর্ত রূপ হিশাবে গড়ে তোলা। রাজনীতির মূল সংকট উপেক্ষা করে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি প্রধান বিরোধী দলকে জনগণকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির বিপরীতে বিএনপি গণ সমর্ত্থন হারিয়েছে। আফসোস গণতন্ত্র বলতে আমরা নির্বাচন ছাড়া আর কিছু বুঝি না।

নির্বাচন নিয়ে কোলাহল এই কোলাহল গণতন্ত্র বা রাষ্ট্রের ধরণ বোঝার অক্ষমতাও হয়তো নয়। কিম্বা ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও গণতন্ত্র কায়েম করতে আদৌ আগ্রহী কি? এই দিকটি স্পষ্ট ভাবে না বললে অন্তঃসারশূন্য নির্বাচনী কোলাহলের কোন ব্যাখ্যা হয় না। জনগণের মনে এই সন্দেহ দৃঢ় হয়েছে যে বিরোধী দল এমন একটি নির্বাচন চায় যাতে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও ক্ষমতা ব্যবস্থার তারা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার দুঃশাসন নিজেরাই চালাতে পারে। অর্থাৎ ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের পরিবর্তে পরিচালিত হবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের দ্বারা। জনগণের এতে কি ফায়দা? ক্ষমতায় থেকে বর্তমান ফ্যাসিস্ট শাসকদের লুটতরাজ ও লুন্ঠনের যে বাদশাহী আমরা দেখেছি মনে হয় বিরোধী দলও সেই একই বাদশাহী ভোগ করতে চায়।

রাজনৈতিক ভাবে বিএনপির বর্তমান দুর্দশার প্রধান কারণ গণতন্ত্রকে নির্বাচন সর্বস্ব ধারণা হিশাবে পর্যবসিত এবং প্রচারের মধ্যেই নিহিত রয়েছে, বিএনপি যতো দ্রুত তা উপলব্ধ করতে পারবে ততোই তা দলটির জন্য মঙ্গল।  ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে বাংলাদেশের জনগণের যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা হয়েছে তার কারণে তারা মৌলিক বা বিপ্লবী রূপান্তর না হোক, নিদেন পক্ষে রাষ্ট্রের কিছু সংস্কার আশা করে। কিন্তু বিএনপি জনগণের মধ্যে তেমন সংস্কারের সম্ভাবনা বা আশা জাগাতে পারে নি। বিএনপি কোন বিপ্লবী দল না। জনগণ বিএনপিকে বিপ্লবী দল মনে করে না। অতএব শ্রেণীর দিক থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরিব, দরিদ্র ও সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গে বিএনপির বিরোধ থাকবে। এই বিরোধ বাস্তব। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিপরীতে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এই বোধটুকু সাধারণ মানুষের আছে।

আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান বিএনপিকে একটি উদারনৈতিক বুর্জোয়া দল হিশাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত বাঙালি জাতিবাদীদের 'সমাজতন্ত্র' নামক অর্থনৈতিক নিগড় ভেঙে গতিশীল বাজার ব্যবস্থার সুবিধা নিতে চাওয়া মূলত জাতিবাদী ফ্যাসিস্টদের ‘সমাজতন্ত্র’ থেকে সরে আসাও বটে। চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বাজার ব্যবস্থার পক্ষে যে রক্তক্ষয়ী লড়াই চলছিল বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রসর করে নেবার প্রয়োজনীয়তা তিনি চিন থেকেও পেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের উদারনৈতিক রাজনৈতিক ধারা নিজের অনিবার্য প্রয়োজনেই বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরোধী বিভিন্ন বিপ্লবী রাজনৈতিক প্রবণতার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে চেয়েছে। বিএনপির শক্তি তাহলে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে ন্যূনতম বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আদর্শ রক্ষার অঙ্গীকারের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। বিএনপি নির্বাচনপন্থি দল, অতএব নির্বাচন চাওয়া কিম্বা নির্বাচনে যাওয়া বিএনপির জন্য মোটেও বেঠিক কোন কাজ নয়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার কিভাবে করবে তার কোন কর্মসূচী না থাকায় বোঝা যায় গণতন্ত্রকে বিএনপি নির্বাচন সর্বস্ব ধারণার অধিক কিছু মনে করে না।

তাহলে বুঝতে হবে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কারের কোন প্রস্তাবনা না করার অর্থ বিএনপি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। শক্তিশালী বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির বিপর্যয়ের এটাই প্রধান কারন।

শুধু সংখ্যা দিয়ে রাজনীতি হয় না। ‘বাম দল’ নামে যারা পরিচিত তারা মূলত বাঙালি জাতিবাদ এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের মিত্র । তারা ইসলাম বিদ্বেষ কিম্বা ইসলাম নির্মুল রাজনীতির খোপ থেকে আদৌ বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারা ক্ষুদ্র ও ক্ষীণ স্রোত হলেও বিরাজ করে। সামগ্রিক বৈশ্বিক পরিবর্তনের পরিপ্ররেক্ষিতে তাদের প্রধান কাজ আগামি দিনে গণমানুষের রাজনীতির দিশা নির্ণয় করা এবং নির্বাচনী কোলাহলের বাইরে ভবিষ্যতের ওপর নজর রেখে কাজ করে যাওয়া। গণমানুষের রাজনৈতিক স্বার্থ সম্পর্কে চিন্তাচেতনার বিকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জনগণের রাজনীতি আগামি দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

‘গণতন্ত্র’? আদৌ কোন অর্থ বহন করে কি?

হতে পারে বাস্তব সমস্যা বা সংকটকে সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করবার অক্ষমতার কারণে আমরা অভ্যাসবশত গণতন্ত্রের কথা বলি। কিন্তু কি বলি বা কেন বলি নিজেরাই হয়তো জানি না। বাস্তব অবস্থা আড়াল করবার উদ্দেশ্যেও গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। যেমন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টরাও নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে থাকে। ভূয়া নির্বাচন -- সন্ত্রাসী ও সহিংস কায়দায় ব্যালট বাক্স ভরে দেওয়া – বাংলাদেশে এটাও ‘গণতন্ত্র’ (!) বটে। নৈতিক, রাজনৈতিক, আইনী বা গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার বৈধতা ছাড়া একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আছে। তারা বিরোধী মত, দল ও নাগরিকদের দিনের পর দিন দমন পীড়ন, আইন বহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন এবং আরও নানান অপরাধ করে যাচ্ছে – লুটতরাজ তো আছেই। প্রশ্ন হচ্ছে তাদেরকে কি জনগণের বড় একটি অংশ মেনে নেয় নি? না নিলে তারা ক্ষমতায় আছে কি করে? শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের স্থানীয় শক্তি বা বরকন্দাজ হিশাবে তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিও রয়েছে। এই প্রকার সহিংস রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণভিত্তি ও সমর্থন আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটা ফ্যাসিবাদ নামে পরিচিত।

সামরিক, বেসামরিক কিম্বা সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদ এক না। এই পার্থক্য আমাদের মনে রাখতে হবে। ফ্যাসিবাদ সমাজের বিশেষ সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা যার গোড়ায় কোন না কোন জাতিবাদী প্রবৃত্তি বা বিচারহীন আবেগ কাজ করে। ফ্যাসিবাদ সমাজের বড় একটি অংশের সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। ফ্যাসিস্টও যথার্থই নিজেকে নিজে গণতান্ত্রিকই বলে। তাই বলছি, গণতন্ত্রের কথা বলা আমাদের একটা অভ্যাস। আমাদের সমাজে একটা প্রবাদের প্রচলন আছে। ভাসুরের নাম মুখে নেওয়া যায় না। আমাদেরও হয়েছে একই অবস্থা। আমরা সযত্নে ফ্যাসিবাদ কথাটা পরিহার করি।

শুধু সাধারণ মানুষ না, বাংলাদেশের বড় বড় বুদ্ধিজীবী, যাদের কিছুটা হলেও বুঝ আছে, তারাও ফ্যাসিবাদকে ফ্যাসিবাদ বলে না। তারা বলে ‘কর্তৃত্ববাদ’। খুবই মজার ব্যাপার। পাশ্চত্যের আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদল সবচেয়ে বিকশিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র। কারণ কর্তৃত্ব ছাড়া রাষ্ট্র দূরে থাক কোন প্রতিষ্ঠান চালানো অসম্ভব। কর্তৃত্ব ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা অসম্ভব। এই কর্তৃত্বের আসল নাম ‘সার্বভৌমত্ব’, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা। এটা তো বাচ্চা ছেলেটিরও বোঝার কথা। তাহলে এই সকল বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক এই শব্দটা ব্যবহার করে কেন? এর একটাই উদ্দেশ্য: ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার আসল চেহারা আড়াল করা। তারা ফ্যাসিবাদকে সরাসরি মুখোমুখি মোকাবিলা করতে ভয় পায়। আমরা এই ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণার গহ্বরে পড়ে গিয়েছি।

‘গণতন্ত্র’ আমাদের দেশীয় কোন ধারণা না। আমরা পাশ্চাত্য থেকে ডেমোক্রাসির ধারণা নকল করে কথা বলি। বহু আগে জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, “দুনিয়ার যতো কিসিমের সরকার দেখা যায় তারা সবাই নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করে” (Orwell, 1954, পৃষ্ঠা ১৬২)। ফরাসী রাজনীতিবিদ ও ঐতিহাসিক ফ্রসোঁয়া গিজো (১৯৮৭-১৮৭৪) সেই ১৮৪৯ সালে বলেছিলেন, “গণতন্ত্র কথাটার এতোই ক্ষমতা যে কোন দল বা সরকারের পক্ষে মাথা তুলে দাঁড়ানো সম্ভব নয়, কিম্বা তারা বিশ্বাস করে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাও অসম্ভব যদি তারা তাদের ব্যানারে গণতন্ত্র কথা খচিত না রাখে। এটা আগের চেয়ে এখন অধিক সত্য” (Guizot, 1849, পৃষ্ঠা ৩)। সবাই গণতান্ত্রিক! দুনিয়ায় একটিও একনায়কতন্ত্র নাই যারা দাবি করে না তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের স্পিরিট নাই, সবাই গণতন্ত্রী সাজতে চায়”। কমিউনিস্ট পার্টীগুলোও নিজেদের সব সময় গণতন্ত্রী বলে দাবি করে আসছে। পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট পার্টি এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রগুলিও নিজেদের গণতন্ত্রী বলে রাজনৈতিক বৈধতা লাভের চেষ্টা করত।

আমার কবিতা লেখার দুর্নাম আছে। তাই কবি টি এস এলিয়ট ১৯৩৯ সালে কি বলেছিলেন তার একটা উদ্ধৃতি ইংরেজিতেই দেব। তিনি বলেছিলেন: “When a term has become so universally sanctified as “democracy” now is, I begin to wonder whether it means anything, in meaning too many things.’ (Eliot, 1949, পৃষ্ঠা ১১)। ফরাসী দার্শনিক Bertrand de Jouvenel ১৯৭৫ বলেছেন, “গণতন্ত্রের পক্ষে বলি কিম্বা বিপক্ষেই বলি—যে কোন ভাবে বলাটাই বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে বেকার, কারন কি বিষয়্ নিয়ে কথা বলি সেই বিষয়টাই অনিশ্চিত” । জিওভান্নি সাতোরি বলেছেন যে “শুনতে ধাঁধাঁ মনে হবে আসলে কিন্তু উর্ধে বিরাজিত আসমানি যে বিষয়কে গণতন্ত্র বলা হয়, তার আসলে কোন অস্তিত্বই নাই” (Jouvenel, 1962, পৃষ্ঠা ২৭৬)।

তাহলে গণতন্ত্রের প্রধান সংকট হচ্ছে গণতন্ত্র নিয়ে নানান প্রকার বকোয়াজি এবং আজগবি ধ্যানধারণা। সবচেয়ে দুর্দান্ত হোল বাংলাদেশে গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা। সেটা হোল গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন। আর নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র। ব্যস। ফুলস্টপ। গণতন্ত্রকে নির্বাচন সর্বস্ব একটি ধারণা বানিয়ে ফেলা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দেবার অঙ্গীকার বা কর্তব্যবোধ থেকেই তৈরি হয়। যে কারণে আমরা দীর্ঘকাল ধরে শুনে আসছি বাংলাদেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেই বাংলাদেশের সকল সমস্যার অবসান হবে। এখন কাজ হচ্ছে উৎসব মুখর ভাবে ফ্যস্টিভালের মতো নির্বাচনে সকলকে অংশগ্রহণ করা। ক্ষমতাসীন বিরোধীরাও একই কথা বলে অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকে থাকুক। দরকার শুধু একটি নির্বাচন যেন সেই ব্যবস্থা হাতে পেয়ে আমরাও লুটতরাজ, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন ইত্যাদি চালাতে পারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্তাব্যাক্তিদের এবং প্রতিষ্ঠান হিশাবে র‍্যাব-কে শাস্তি দিয়েছে। এই শাস্তি দেওয়া দেখে কেউ কিছু শিখবে কিনা সেটা ভবিষ্যতই বলবে। নির্বাচন সর্বস্বরা অতোটুকুই সংস্কার চায় যাতে ক্ষমতাসীনদের বিপরীতে তারা নির্বাচনে জিতে আসতে পারে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিও সেই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেই করা হয়। এর অন্তর্গত মর্ম হচ্ছে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার হাত বদল এবং নির্বাচন সর্বস্ব গণতন্ত্রের নামে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং ফ্যসিস্ট শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা।

তাহলে বুঝতে হবে গণতন্ত্রর প্রধান সংকট গণতন্ত্র নিজে। বাংলাদেশের সংকট আরো গভীরে। যেখানে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করবার কথা সেখানে গণতন্ত্র কথাটিকে যত্র তত্র নানা অর্থে নানান মতলবে ব্যবহারটাই বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক সংকট হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে স্রেফ ভোটাভুটি যাতে বিরোধী দল ক্ষমতায় যেতে পারে। ভোট কেনাবেচাও ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচন করা ব্য্যবহুল ব্যাপার। নির্বাচনে দাঁড়াবার টিকিটও পায় ধনি শ্রেণী, দলের কোন ত্যাগী কর্মী না। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র এই ধারনার আধিপত্য বাংলাদেশে ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।

‘গণতন্ত্র’ গ্রিকদের কাছ থেকে আসা, কিন্তু গ্রিকদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হিশাবে যিনি পরিচিত তিনি গণতন্ত্র পছন্দ করতেন না। তিনি গণতন্ত্র বিরোধী ‘জ্ঞানীপুরুষ’ ছিলেন। আমরা বুঝি তিনি কেন ‘ভিড়’ (mob), ‘গণ’ (Demo) বা সংখ্যা (demography) অপছন্দ করতেন। গণতন্ত্রের কারবার যদি সংখ্যা হয় গণের শাসনে তাঁর আস্থা ছিল না। কারন জ্ঞানচর্চা, প্রজ্ঞাবান হওয়া বা সত্য বলা কিম্বা সত্য নির্ণয় গণতন্ত্রের কাজ না। সংখ্যা দিয়ে জ্ঞানের বৈধতা বা শক্তি নির্ণয় করা যায় না। যা সত্য তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মিথ্যা বলে ভোট দিলেই তা মিথ্যা হয়ে যায় না। সবাই যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে সূর্য আসলে ঠিকই বিকাল বেলা ডুবে যায় এবং পৃথিবী সূর্যের চার দিকে নয় বরং সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে – তাতে বিজ্ঞানের সত্য উলটে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে উপলব্ধির সত্যও মিথ্যা হয় না। কারন সূর্য ডোবে, আমরা দেখি। রাতের পরে দিন হয়। আমরা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরি। পশুপাখিও ঘরে ফেরে। কারণ সূর্য তো আসলেই ডোবে। এই দুই প্রকার সত্য গণতন্ত্রের দ্বারা নির্ণয় করা যায় না। তাহলে যে শাসনব্যবস্থা জনগণের চেতনা, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটায় – জনগণের উন্নতি আনে -- উন্নত জীবনের নিশ্চয়টা দেয় -- সেই শাসন ব্যবস্থার বৈধতা স্রেফ ভিড়, জনমত বা সংখ্যার ভিত্তিতে নির্ণয় করা যায় কিনা এই তর্ক বহু পুরানা। দর্শনে বা রাষ্ট্র বিজ্ঞানে তার মীমাংসা হয়েছে দাবি করা কঠিন।

কিন্তু ইউরোপে যখন সামন্ত ব্যবস্থা ও সামন্ত শ্রেণীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবার জন্য বিপ্লব হয়েছিল তখন সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বটে, কিন্তু বৈপ্লবিক রূপান্তর যাদের হাতে ঘটেছে তাঁরা ছিলেন বিপ্লবী। তাঁরা শুধু গণ, ভিড় বা সংখ্যার ওপর ভরসা করেন নি। তাঁদের ‘স্বাধীনতা (Liberté) সাম্য’, (Egalité) এবং ভ্রাতৃত্বের ( Fraternité) রণধ্বনি দিতে হয়েছে। আর এই রণধ্বণির মধ্য দিয়ে ইতিহাসে যে নতুন সামষ্টিক চেতনার আবির্ভাব ঘটল তার নাম ‘জনগণ’ (People)। দেখা যাচ্ছে এই ‘জনগণ’(People) -কে স্রেফ ‘ভিড়’, ‘গণ’ বা ‘সংখ্যা’ দিয়ে আর বোঝা যাচ্ছে না। এরা সামন্তবাদ উৎখাত করবার জন্য সশস্ত্র গণ অভ্যূত্থানের রণকৌশল গ্রহণ করেছে। ভোট বা নির্বাচনের তামাশা দিয়ে সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটানো হয় নি। হয়েছে সশস্ত্র গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে গণসমষ্টির আবির্ভাব ঘটেছিল তারা স্রেফ ‘ভিড়’, ‘গণ’ বা ‘সংখ্যা’ নয়। একই ভাবে বলশেভিক বিপ্লব, চিনা বিপ্লব কিম্বা ইরানী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে ঐতিহাসিক জনগণের আবির্ভাব ঘটেছে তারাও শান্তিপূর্ণ ভোট কিম্বা ‘নির্বাচনকে উৎসবে পরিণত করুন’ মার্কা ঘোষণা দিয়ে জনগণকে সামষ্টিক রাজনৈতিক কর্তাসত্তা আকারে ইতিহাসে হাজির করে নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই আবির্ভাবের পথ ছিল, কঠিন এবং রক্তে স্নাত।

একাত্তরে আমাদের ঘোষণা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার। আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি এবং নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বিশ্বে নিজেদের হাজির করেছি। সেটাও ছিল রক্তস্নাত। কিন্তু সেটা করেছি বাইরের শত্রুকে পরাজিত করে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমাদের ভেতর থেকে রাজনৈতিক সচেতনতার বিকাশ ঘটিয়ে নিজেদের সামষ্টিক রাজনৈতিক কর্তাসত্তা হিশাবে পরিগঠনের কাজ আমরা সম্পন্ন করতে পারি নি। অর্থাৎ আজও জনগণের রাষ্ট্র বা জনগণের শাসন ব্যবস্থা আমরা কায়েম করতে পারিনি। যার পরিণতিতে এখনও আমাদের ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে থাকতে হচ্ছে।

তবে কয়েক দশকের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎখাত ভোটাভুটি করে কিম্বা ‘নির্বাচনকে উৎসবে পরিণত করুন’ মার্কা প্রপাগাণ্ডা দিয়ে অর্জন করা যাবে না। বাংলাদেশ আরেকটি বৃহৎ রাজনৈতিক উল্লম্ফনের জন্য তৈরি হতে চলেছে। আমরা তা কতোটুকু উপলব্ধি করতে পারছি তার দ্বারা তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের সংকট’ আমরা কতোটা উপলব্ধি করছি তার মাত্রা বোঝা যাবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েমের অর্থ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করা। বিশ্ব ব্যবস্থায় বাহ্যিক ভাবে স্বতন্ত্র ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি’র স্বীকৃতি পেয়ে সন্তুষ্ট না থেকে আভ্যন্তরীণ ভাবে নিজেদের সামষ্টিক রাজনৈতিক কর্তাসত্তা হিশাবে পরিগঠন। অর্থাৎ সামষ্টিক চেতনার দিক থেকেও আমাদের ‘জনগণ’ হতে হবে। ভিড় হওয়া, ‘গণ’ হওয়া কিম্বা স্রেফ ভোটাবুটির সংখ্যা হয়ে থাকলে আমরা বিনাশের দিকে যেতে থাকব। আমাদের দরকার নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে অন্তরের দিক থেকে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’ (Constitute)। তাহলে অবিলম্বে দরকার একটি গাঠনিক প্রক্রিয়া আরম্ভ করতে পারা যা জনগণকে যুগপৎ একটি ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) প্রণয়নের কর্তা হিশাবে গঠন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করবে। রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার খোদ ভিত্তি হতে হবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, যেন জনগণ পরস্পরের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্বন্ধ নির্ণয় ও মজবুত করবার ভিত্তিগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে, নিজেদের স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে গঠন করবার সূত্রগুলো নিজেরাই নির্ণয় করতে পারে।

নিজেদের স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে গঠন করবার সূত্রগুলো আমাদের নতুন করে তৈরি করতে হবে আমি মনে করি না। কারণ জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের নিজস্ব ইতিহাস আছে, কোন ব্যক্তির তত্ত্ব বা কল্পনা দ্বারা – যতোই মৌলিক ও বিপ্লবী হোক -- আমরা নিজেদের নতুন ভাবে গঠন করতে পারব না। তবে ব্যাক্তির চিন্তায় সমাজের সামষ্টিক ইচ্ছ ও অভিপ্রায় ধরা পড়তেই পারে। আমাদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসের মধ্যেই আমাদের নিজেদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সূত্র খোঁজা অধিক ফলপ্রসূ। কংক্রিট ইতিহাস হিশাবে সেই সকল সূত্র হাজিরও রয়েছে। ওতএব তাদের ঐতিহাসিক ও আইনী বৈধতাও আছে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার তিনটি রণধ্বণি রয়েছে: সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। তাহলে ‘গণতন্ত্র’ – অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি মূর্ত করে তোলার কাজ এখান থেকেই শুরু করতে হবে। তাহলে এখন দরকার স্বাধীনতার এই তিন ঘোষণা কেন্দ্র করে একটি সামষ্টিক সচেতনতা এবং উপলব্ধি গড়ে তোলা। যার ভিত্তিতে আমরা আসলেই নিজেদের ‘জনগণ’ ভাবতে পারি এবং নিজেদের ‘ভিড়’ ‘গণ’ বা ভোটাভুটির ‘সংখ্যা না ভেবে ‘জনগন’ হয়ে উঠতে পারি। নতুন রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার কর্তা হয়ে ওঠাই এখনকার প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য। জনগণ যেন তাদের ‘স্বাধীনতা’ অর্থাৎ তাদের স্বাধীন ইচ্ছা ও অভিপ্রায় মূর্ত করে তোলার কঠিন পরীক্ষায় সফল হতে পারে। আমাদের সংকটের সমাধান এখানেই নিহিত রয়েছে।

বলা বাহুল্য গণমাধ্যমের সংকটও গণতন্ত্রের সংকট থেকে আলাদা নয়। গণমাধ্যমের সংকট মূলত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চনার সঙ্গে যুক্ত। এ নিয়ে আমি ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’ প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। নিজেদের নতুন করে ‘গঠন’ করবার ভিত্তি নির্মানের ক্ষেত্রেও প্রধান লক্ষ্য হবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

সুনির্দিষ্ট ভাবে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে হবে

তাহলে আমি মনে করি আমাদের দরকার খুবই সুনির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট ভাবে সমস্যার জায়গা থেকে কথা বলা। ‘গণতন্ত্র’ একটি বিমূর্ত ধারণা। নানান জনে নানান ভাবে, নানান উদ্দেশ্যে ‘গণতন্ত্র কথাটা ব্যবহার করতেই পারে। আমরা সুনির্দিষ্ট ভাবে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে পারি। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের মৌলিক সংকটটা এখানে। এখানে একই কথা তিনবার বলা হয় নি। তিনটি শব্দ ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যুক্ত হলেও মূলত তিনটি ধারনার কথা বলা হয়েছে। সেটা হোল ‘মতবাদ’, ‘ক্ষমতা’ ও ‘রাষ্ট্র ব্যবস্থা’। অতএব পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাদের আলাদা ভাবে বোঝা জরুরী। তাদে্র আলাদা ভাবে বুঝলে কাজের ক্ষেত্রগুলোও আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে। তাদের পার্থক্য না বুঝলে তাদের বিরুদ্ধে লড়বার সঠিক নীতি ও কৌশল নির্ণয় করা কঠিন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা জাতিবাদ একটি ফ্যাসিস্ট মতবাদ। তার ঐতিহাসিক রূপ বাকশাল বলি কিম্বা বর্তমানের মহাজোট সরকারের আমল বলি, বাংলাদেশে আমরা দেখেছি এবং দেখছি। ‘মুক্তি যুদ্ধের চেতনা’র নামে এই ফ্যাসিস্ট মতবাদ গড়ে উঠেছে। এই ফ্যাসিস্ট মতবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আমাদের অনেককে দীর্ঘকাল ধরে লড়তে হয়েছে। কারণ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে জাতিবাদী ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে উদ্ধার করা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় সারা দুনিয়ার বাংলাভাষীদের জন্য জরুরী রাজনৈতিক কর্তব্য। এটা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে জনগণের আত্মত্যাগ এবং শহিদদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের সঙ্গে জড়িত। কারন তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিম্বা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির গৌরবকে ফ্যাসিবাদে পর্যবসিত করবার জন্য আত্মনাহুতি দেন নি। এই লড়াই একই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষা এবং জনগোষ্ঠির স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষার লড়াই। যেন সংখ্যাগুরু বাঙালি ও বাংলাভাষীদের আধিপত্যের ভারে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে না আসে। তারা যেন মারা না যায়। দেখা যাচ্ছে ফ্যাসিবাদকে মতবাদ হিশাবে চিহ্নিত করতে পারলে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী লড়াই সম্পর্কে আমরা সচেতন হতে পারি এবং সেই লড়াই সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত ভাবে করতে পারি।

ইসলাম জাতিবাদ বরদাশত করে না, কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ম ভিত্তিক জাতিবাদ এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবনতা রয়েছে। ইসলামের বৈপ্লবিক মর্ম উদ্ধার, রক্ষা ও বিকাশের জন্য ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট মতবাদের বিরুদ্ধেও আমাদের নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তার মানে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক ভাবে ইসলামের বৈপ্লবিক মর্ম আমাদের চেতনা, চিন্তা এবং কাজে আন্তরিক করে নেবার দরকারেই ইসলামের নামে ফ্যাসিস্ট প্রবণতার বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। সেজন্য ইসলামের নামে বিভিন্ন জাতিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের গুরুত্ব বিপুল। ইসলাম শুধু আমাদের নয়, -- পুরা উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক পম্পরা্র অন্তর্গত। ইসলাম উপমহাদেশে জনগণের মধ্যে চিরস্থায়ী হতে এসেছে। যাবার জন্য আসে নি। এই দিকটা বুঝলে আগ্রাসী দিল্লী এবং উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়বার গুরুত্ব আমরা সকলেই কমবেশী উপলব্ধি করব। নইলে তা ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে পরিণত হবে এবং পাকিস্তানী শাসকদের কীর্তির পক্ষে দোহাই দেবার উপায় হয়ে উঠবে। আমাদের দরকার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুরা উপমহাদেশে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা অর্জন। যেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ এবং পাশ্চাত্যসহ সকল প্রকার পরাশক্তির আধিপত্যের বিরুদ্ধে পুরা উপমহাদেশের জনগণের সঙ্গে দৃঢ় ঐক্য আমরা গড়তে পারি। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভিত্তিও রচিত হবে এই ঐক্যের মধ্যে। আজ হিন্দুত্ববাদ স্রেফ আধুনিক জাতিবাদী মতাদর্শ নয়। রাজনৈতিক শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিশাবে হিন্দুত্ববাদ উপমহাদেশে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত। হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার শর্ত হয়ে হাজির হয়েছে। একে মোকাবিলার সঠিক নীতি ও কৌশলের ওপর পুরা উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।

এই গেল ফ্যাসিবাদের মতবাদগত। কিন্তু ফ্যাসিবাদ সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিশাবেও প্রতিষ্ঠিত। তার জন্য আমাদেরও সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিশাবে সংগঠিত হওয়া জরুরী। শক্তির রূপ ছাড়াও ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিশাবে বাংলাদেশে পরিগঠিত। বাংলাদেশ একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই সত্য যদি আমরা পরিষ্কার ভাবে না বুঝি এবং কোন টাল্টিবাল্টি ছাড়া পরিষ্কার ভাবে না বলি তাহলে ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে মুখে ফেনা ছড়াবার কোন অর্থ নাই। বাংলাদেশের জনগণের প্রধান রাজনৈতিক সংকট হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এটাই গণতন্ত্রের একদমই গোড়ার সংকট। তাই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কথাটা আমাদের পরিষ্কার ভাবে বলতে হবে। যদি পরিচ্ছন্ন ভাবে কথা বলতে শিখি তাহলে আমাদের রাজনৈতিক কর্তব্যও পরিষ্কার জনগণ বুঝবে। আমরাও জনগণের কাছে জনগণের স্বার্থের দিকগুলো পরিষ্কার তুলে ধরতে সক্ষম হব।

আমাদের এখনকার প্রধান কাজ হচ্ছে সমাজে গণসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারা, দল ও শক্তির মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিলয়ের জন্য জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করা। ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করাই এখন প্রধান কাজ। জনগণের বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন ভাবে গণশক্তিকে সুনির্দিষ্ট রূপ দেওয়া এবং জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে নতুন রাষ্ট্র এবং জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য গঠনতন্ত্র সভা ডাকা আশু কর্তব্য ও প্রধান কাজ হিশাবে হাজির হয়েছে। নতুন ভাবে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে পরিগঠনের প্রতি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক মনোনিবেশ এখনকার সময়ের দাবি। খেয়াল করবেন আমি ‘গণতন্ত্র’ শব্দটা এড়াতে চাইছি যেন ‘গণতন্ত্র’ রক্ষার নামে ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা রক্ষার কোন অজুহাত গড়ে না ওঠে। তদুপরি গণতন্ত্র রক্ষার নামে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ চালাবার ছুতাও যেন খুঁজে না পায়।

রাজনীতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনায় ক্ষমতা এবং ক্ষমতা চর্চার প্রসঙ্গ ছাড়াও আরও এই তিনটি ক্ষেত্র নিয়ে পর্যালোচনার দরকার আছে। তিনটি ক্ষেত্র পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্র হিশাবে আলাদা: ১. রাজনীতি বা রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ , ২. রাজনৈতিকতা বা রাজনৈতিক শত্রু মিত্র নির্ণয়ের পরিসর এবং ৩. জনগণের দ্বারা সরাসরি প্রশাসন বা শাসন ব্যবস্থার কাঠামো বা রূপ নির্ণয়। আগে কিছু করেছি, তবে সামনের দিনগুলোতে সুনির্দিষ্ট ভাবে এই সকল বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করব।

২৫ ডিসেম্বর ২০১২১।। শ্যামলী।

 

প্রাসঙ্গিক সূত্র

Eliot, T. S. (1949). Christianity and Culture. New York : Harcourt, Brace & World.

Guizot, F. (1849). Democracy in France. London: John Murray.

Jouvenel, B. d. (1962). On Power . Boston: Beacon Press.

Orwell, G. (1954). A Collection of Essays. New York: Doubleday, 1954.

 

[ ২৫ ডিসেম্বর প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফিউজে) আয়োজিত ‘গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের সংকট শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিশাবে লেখাটির সারসংক্ষেপ পেশ করেছি। কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনাও করেছি। পুরা নিবন্ধটি এখানে পেশ করা হোল। লেখাটি ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধী’নতা' নিবন্ধটির সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে খুশি হব। -ফম।]

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।