৩. ইউক্রেন: ইতিহাস, মতাদর্শ ও হাইব্রিড যুদ্ধ
ইউক্রেনের যুদ্ধ আরও তীব্র হচ্ছে। যুদ্ধ পূর্ব ইউক্রেনের দিকে জোরদার হবার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের চরিত্রেরও বদল ঘটতে থাকবে। পূর্ব ইউক্রেন বলতে বোঝায় পাঁচটি প্রদেশ: দনেস্ক (Donesk), খারখিভ (Kharkiv), লুহান্সক (Luhansk), জাপোরিঝঝিয়া (Zaporizhzhia) এবং নিপ্রোপেট্রোভস্ক(Donipropetrovsk)। ডনবাস অঞ্চল দখল নিয়ে ডনবাসের বিভিন্ন শহরে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার বাহিনীর মধ্যে এখন রাস্তায় রাস্তায় লড়াই চলছে। ডনবাসে ৩০০ মাইল দীর্ঘ এক রণক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশ বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তবে লুহানস্ক এলাকায় ক্রেমিনা এবং আরও একটি ছোট শহরের দখল রুশ বাহিনীর হাত চলে গেছে। ডনবাস যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা রাখবে বলে সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ইতোমধ্যে রুশরা দক্ষিণে শিল্প ও বন্দর নগরী মারিওপোল দখল করে নিয়েছে বলছে, যদিও বিশাল ইস্পাতের কারখানা এজভস্টাল স্টীল প্লান্ট (Azovstal steel plant in Mariupol) এখনও ইউক্রেনের সৈন্য এবং বহু বেসামরিক নাগরিক আটকা পড়ে আছে। তাদের ঘিরে রেখেছে রুশ সৈন্য। তবে রাশিয়া তাদের নিরাপদে সরে যেতে দিতে রাজি হয়েছে।
পাশ্চাত্য গণমাধ্যমগুলো ক্রমাগত এই যুদ্ধে রাশিয়া হেরে যাচ্ছে বলে প্রচার করছে। অন্যদিকে রাশিয়া কড়া কড়া কথা বলছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো ভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার পূর্ব দিক থেকে সমরাস্ত্র দিয়ে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার যে চেষ্টা চালাচ্ছিল তার একটা জবাব তারা পেয়েছে। এই যুদ্ধে রাশিয়ার ঘোষিত ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কখনই অস্পষ্ট ছিল না। রাশিয়ার পূর্ব দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণ রাশিয়া চায় নি, এটা যেমন স্পষ্ট ছিল, তেমনি রাশীয়া চেয়েছে ইউরোপ যেন তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্বাধীন অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ আটলান্টিক সামরিক মৈত্রীর সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্কের একটা পরিণতি চেয়েছে রাশিয়া। ন্যাটোভূক্ত থেকে ইউরোপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রীয় নীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়ন করুক রাশিয়া তা চায় নি। ইউরোপ স্বাধীন ভাবে নিজের স্বার্থ দেখুক – সেটাই রাশিয়ার দিক থেকে দাবি। ইউরোপ উত্তর আমেরিকার পররাষ্ট্রীয় এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়নের হাতিয়ার হোক – রাশিয়া সব সময়ই তার বিরোধিতা করেছে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্নায়ু যুদ্ধেরও অবসান হয়। রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ওয়ারস প্যাক্ট জোটও ভেঙে যায়। তাহলে একটা চিরস্থায়ী যুদ্ধাবস্থা জারি রেখে বিশ্বকে শাসিয়ে বেড়ানোর মধ্যে ইউরোপের কোন স্বার্থ নিহিত নাই। সেটা মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করে। তাই এই ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক জোট বাঁধার কোন অর্থ হয় না। তার মানে দাঁড়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্থ থেকে একটা এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে খামাখা টিকিয়ে রাখা। অথচ ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ হিশাবে ভৌগলিক ভাবে আলাদা। এবং তাদের নিজস্ব ভু-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু ইউরোপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকৃষ্ট তাঁবেদারির ভূমিকা পালন করে চলেছে।
রাশিয়া ভূ-রাজনৈতিক ভাবে ইউরেশিয়াকে মার্কিন আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে চায়। যাতে এক-কেন্দ্রিক (unipolar) বিশ্ব ব্যবস্থা ভেঙে বহুকেন্দ্রিক (multipolar) বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠার শর্ত তৈরি হয়। কিন্তু ইউরোপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে রাশিয়াকে পূর্ব দিক থেকে সামরিক ভাবে ঘিরে ধরছে। রাশিয়ার পুর্ব দিকের দেশগুলো যারা আগে রাশিয়ার অন্তর্গত ছিল না কিম্বা ওয়ারস প্যাক্টভূক্ত দেশ ছিল -- তাদের ন্যাটোতে অন্তর্ভূক্ত করে রাশিয়ার নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এই যুদ্ধে রাশিয়া যা অর্জন করতে চেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ইউরোপ আসলে কি করতে চায় সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা। এখন দেখা যাচ্ছে নিরপেক্ষ দেশ হিশাবে ইউরোপ ও সুইডেন ন্যাটোতে যোগদান করতে চাইছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম দাবি করছে রাশিয়ার এই যুদ্ধং দেহি ভাব দেখে ন্যাটোভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সংহতি আরও বেড়েছে। আগে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইউরোপে শৈথিল্য ছিল। এখন ব্যয় বেড়েছে। এই সকল লক্ষণ রাশিয়ার পরাজয় হিশাবে বলার চেষ্টা হচ্ছে। ইউরোপ স্বাধীন পথে চলবে নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়া খাটবে সেটাই ছিল রাশিয়ার দিক থেকে নিষ্পন্ন করবার বিষয়। ইউরোপ যদি ন্যাটো জোটের মধ্য দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে পারবে বলে মনে করে তবে সেটাই হোক। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশান’ পরিচালনার মধ্য দিয়ে রাশিয়া আধুনিক ইউরোপের চেহারা দেখতে চেয়েছে। সেই দিক থেকে এই যুদ্ধে রাশিয়াকেই বরং সফল বলতে হবে। কিন্তু চূড়ান্ত কথা বলবার সময় এসেছে বলে আমরা মনে করি না। এই দিকটা বুঝতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এই যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ হোক – এই দাবি যুদ্ধ বিরোধীরা সঙ্গত কারণেই তুলছেন। কিন্তু সেটা বিমূর্ত ও অর্থহীন যদি রাশিয়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত ন্যায্য প্রশ্ন উপেক্ষা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধকে খুঁচিয়ে দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। ইতিমধ্যে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট ১৬৫ মিলিয়ন ডলার ইউক্রেনকে অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য বরাদ্দ করেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির সঙ্গে এন্টনি ব্লিঙ্কেন ও কয়েড আওস্টিন কিয়েভে দেখা করেছেন এবং ৩২২ মিলিয়ন সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রাশিয়া বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা আসলে আগুনে আরও তেল ঢালা’। মিথ্যা বলে নি। ফলে রাশিয়া ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে অনবরত গোলা বর্ষণ করে চলেছে। যুদ্ধের বীভৎসতা বাড়ছে।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রবল দাপটের ফলে আমরা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোভূক্ত দেশগুলোর ভাষ্যই শুনি। ফলে ক্রিটিকাল অবস্থান গড়ে তোলা আয়াসসাধ্য। বাংলাদেশে আমরা ইউক্রেনের ইতিহাস, ভাষা এবং জনগণ সম্পর্কে খুব ভাল জানি না। তাই ভুল অনুমান করি যে ইউক্রেনিয়ানরা বুঝি একই ভাষা ও সংস্কৃতির অন্তর্গত। দীর্ঘকালব্যাপী তারা একই ইতিহাসের মধ্যে বড় হয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে অর্থপূর্ণ আলোচনা করতে হলে এই অনুমানগুলো মাথা থেকে বাদ দিতে হবে। ইউক্রেনের বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মধ্যে ভহাষা, সংস্কৃতি ও জাতিবোধের ফারাক প্রবল। ইউক্রেনের ঐতিহাসিক জটিলতা, জনগণের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং এখন যারা জেলেনস্কির নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছে সেই অভিজাত শাসক শ্রেণী সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা ছাড়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বোঝা মুশকিল। বিভিন্ন শ্রেণির আদর্শ যেমন আলাদা, জাতিগোষ্ঠির চাওয়া-পাওয়াও একরকম নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আনুগত্যের দিক থেকে দুটো মোটা দাগের ভাগ আছে। এক পক্ষ রাশিয়ার পক্ষে। আরেক পক্ষ প্রকট ভাবেই ইউরোপের প্রতি অনুগত। তারা তাদের ইউরোপীয়ই মনে করে। তাতে কোন অসুবিধা নাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যারা ইউরোপের প্রতি আকৃষ্ট তারা ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক, সেটা চায়। রাশিয়ার কাছে এর মানে হচ্ছে ইউক্রেনের নিরাপত্তার নামে মূলত রাশিয়াকে সামরিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের বেষ্টনীর মধ্যে রাখতে চাইছে। যা রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। রাশিয়া কখনই ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে নি, কিন্তু সেটা রাশিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে নয়। অর্থাৎ ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। ন্যাটো জোটে থাকা যাবে না। রাশীয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের মার্কিন রাশীয়ার দিকে তাক করে পারমাণবিক বোমার স কার পক্ষে ইত্যাদি বিষয় মোটা দাগে হলেও মোটামুটি বোঝা দরকার। সেই ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি।
একটি অসম যুদ্ধে ইউক্রেন কেন জড়িয়ে পড়ল সেটা বোঝার জন্য রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন অতএব গুরুত্বপূর্ণ। ন্যাটোররাশিয়া বিরোধী সামরিক জোট। তাহলে জেলেনস্কি এবং তার সমর্থকরা সদস্যপদ চেয়ে এই যুদ্ধকে নিজেরাই ডেকে এনেছে। দ্বিতীয়ত তারা সমগ্র ইউক্রেনের জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি সেটা দাবি করতে পারে না। পাশ্চাত্য সমর্থিত একটি অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়েই তারা ক্ষমতায় এসেছে। ইউক্রেনের এই শাসক শ্রেণী কারা? ইউক্রেনের জাতীয় স্বার্থের চেয়েও তাদের রুশ বিদ্বেষ এবং ন্যাটো প্রীতি এই যুদ্ধের কারণ। অবশ্য ইউক্রেনের দুর্বল বা ভঙ্গুর জাতিসত্তাকেও আমাদের আমলে নিতে হবে। ইতিহাসবিদরা একমত যে ইউক্রেন একটি মাত্র জাতির দেশ নয়। ইউক্রেনে জাতিসত্তার বন্ধনও তাই খুবই দুর্বল। ইউক্রেনীয় জনগণ প্রধানত তিনটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দ্বারা বিভক্ত এবং শাসিত হয়েছে: অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, পোল্যান্ড এবং লিথুয়ানিয়া রাজ্য এবং জারিস্ট রাশিয়া। দীর্ঘ বছরের বিদেশী শাসন এবং বিভাজন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিষ্কার সাংস্কৃতিক/জাতিগত এবং ধর্মীয় বিভাজনের ছাপ ফেলেছে। এই বিভেদ স্রেফ ঐতিহাসিক থাকে নি, বরং পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, পার্থক্য এবং স্বাতন্ত্র্যবোধও তৈরি করেছে। এই ক্ষেত্রে রাশিয়ার বক্তব্য হচ্ছে লিবারেল রাজনৈতিক মতাদর্শের যুক্তিতে ইউক্রেনের ভৌগলিক অখণ্ডতা এবং জাতিগত সার্বভৌমত্বের যে দাবি তোলা হয় তা বিতর্কিত।
পূর্ব ইউক্রেন, দীর্ঘদিন ধরে রুশ শাসনের অধীনে ছিল, ফলে ব্যাপকভাবে রাশিয়ান হয়ে গেছে। বিপরীতে, পশ্চিম ইউক্রেন, দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রিয়া এবং পোল্যান্ডের শাসনাধীন, তারা পশ্চিম ইউরোপ দ্বারা প্রভাবিত। ক্যাথলিক চার্চ এবং অর্থোডক্স চার্চ (রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয় উভয়ই) উভয়েই পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের জন্য পরস্পরের প্রতিযোগী। এই প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাংস্কৃতিক/জাতিগত মুশকিলগুলোকে ফাটলে পরিণত করেছে। একটি ধর্মীয় বিভাজন রেখা সহজে জনগণকে বিভক্ত করতে পেরেছে।
এক কথায় বলা যায় ইউক্রেনে একটি নয়, দুটি ইউক্রেন রয়েছে। একটি ইউরোপের দিকে, অন্যটি রাশিয়ার দিকে। জাতিবাদের যুগে বিশ শতকের শুরুর দিকে যখন ইউক্রেনীয় জাতীয় আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটে, তখন সেটা মূলত পশ্চিম ইউক্রেন ভিত্তিক ছিল। কিন্তু তার রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ এমন ভাবে ঘটেছে যার মধ্যে ইউক্রেনিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠির স্বাতন্ত্র্য আমলে নিয়ে তাকে কোন জাতিগত আকাংখায় রূপ দিতে পারে নি। সমস্ত ইউক্রেনীয়দের একত্রিত করে ‘ইউক্রেন’ নামচিহ্নের মধ্যে ধারণ করবার যে আদর্শ ও প্রজ্ঞার দরকার ছিল সেখানে সবসময়ই ঘাটতি ছিল। ফলে সকল স্বাতন্ত্র ও পার্থক্য আমলে নিয়ে ‘ইউক্রেন’ নামের মধ্যে সকলকে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠিতে গঠন করা সম্ভব হয় নি। সেটাই এখন বিভক্তি ও গৃহযুদ্ধ হিশাবে আত্মপ্রকাশ করছে।
ইউক্রেনের ইতিহাস নিয়ে মার্ক ভন হেগেন কাজ করেছেন। ইউক্রেন সম্পর্কে তিনি লিখছেন: বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে "ইউক্রেন" একটি রাজনৈতিক, আঞ্চলিক, জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক প্রতীকচিহ্ন হতে পারে কিনা তা নিয়ে তর্কবিতর্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। ইউক্রেনকে বুঝতে হলে এই ব্যর্থতার দিকটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইউক্রেন নামক একাট্টা জাতি, ধর্ম, পরিচয় কিম্বা একাট্টা কোন দেশ বা রাষ্ট্র আছে কিনা সে ধারণারও ক্রমাগত বদল ঘটছিল। অন্য কথায়, এমন কোন ইউক্রেন ছিল না যার উপর সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ যেকোন সময়ে একমত হতে পারে । একমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিভিন্ন ভূখণ্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইউক্রেনিয়ার জনগণ সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে একটি জাতিরাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহণ করে। সেটা সহজ কোন কাজ ছিল না। এর কারন হোল ইউক্রেনের জনগণ বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে তাদের আইন ও শাসন ব্যবস্থার দ্বারা বিভক্ত ছিল। পোলান্ড থেকে পশ্চিম ইউক্রেনকে বের করে পূর্ব ইউক্রেনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্ত করেছে ১৯৩৯ সালে। যা ১৯২২ সাল থেকে ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক হিশাবে অন্তর্ভূক্ত ছিল। পরবর্তীতে চেকোশ্লোভাকিয়া এবং রোমানিয়া ইউক্রেনিয়দের যে সকল ভূখণ্ড দখল করে রেখেছিল সেসব তাদের কাছ থেকে আলাদা করে ইউক্রেনকে মোটামুটি এখনকার রাষ্ট্রীয় রূপ দেওয়া হয়।
সোভিয়েত শাসনের অধীনে, একটি রাষ্ট্র হিসাবে ইউক্রেনকে কেবল পুনরুদ্ধার করা হয়নি বরং এর সীমানা প্রসারিত করা হয়েছিল। বৃহত্তর রাশিয়ার জনবহুল ক্রিমিয়ান উপদ্বীপ কখনোই ইউক্রেনের অংশ ছিল না কিন্তু রাশিয়ান ফেডারেশনের অংশ ছিল। ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৮০র দশকে যখন ইউক্রেনীয় জাতীয় আন্দোলন শুরু হয় এবং ইউক্রেন বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক সমাজের ব্যানারে স্থান পেতে শুরু করে তখনই ইতিহাসের এই সকল বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত অতীত ও টুকরোটাকরা বিষয়গুলো সামনে চলে আসতে শুরু করে। একটা অখণ্ড ভৌগলিক ও রাজনৈতিক অঞ্চল হিশাবে ইউক্রেনকে অখণ্ড সত্তা হিশাবে কল্পনা, নির্মান ও মেনে নেওয়াও অনেকের কাছে কঠিন হয়ে পড়ে। ইউক্রেনের দুর্বল সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিও উদাম হয়ে পড়তে শুরু করে। গর্বাচেভের অধীনে উদার ও শিথিল রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দল ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পার্থক্যকে সামনে আনতে থাকে, অনেকে বিচ্ছিন্ন বা স্বাধীন হবার আন্দোলনও শুরু করে। যাইহোক, জনগণকে এভাবে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত করার জন্য বিপুল আন্দোলন বিক্ষোভ মূলত ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় এবং পশ্চিমের শহরগুলোতে অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ফলে গ্রাম ও শহরের ফারাকও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোজোট ভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রনের এই আভ্যন্তরীণ বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে। এটা আমরা সহজে বুঝব যদি একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় দিল্লীর ভূমিকা আমরা মনে রাখি। জাতিবোধ বা জাতিগত চেতনার যে বিভক্তি তৎকালীন পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে দিল্লী দ্বিধা করে নি। ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটেছে। ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা গৃহযুদ্ধকে পুর্ব ইউরোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য কায়েম করবার জন্য ব্যবহার করছে। প্রবল ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও একে মোকাবিলা করা ছাড়া রাশিয়া নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। এই যুদ্ধের পশ্চাত কারণ বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত।
আসলে রাশিয়ার পূর্ব দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ইউক্রেন যুদ্ধের কারন বটে কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। ক্রিমিয়া রুশভাষী অঞ্চল। ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বে গৃহযুদ্ধ চলছে অনেকদিন ধরে। একটা শান্তিচুক্তি হয় ২০১৫ সালে, একটা আপোষ-মীমাংসার চেষ্টা আছে, কিন্তু যুদ্ধের তীব্রতা কমলেও দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই থামে নি। বিগত আট বছর ধরে চলা ইউক্রেনের সীমিত গৃহযুদ্ধই এখন পুরাপুরি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ পুরা ইউক্রেনের গৃহ যুদ্ধেরই একটা রূপ, কিন্তু ন্যাটোর আগ্রাসন এই যুদ্ধকে বৈশ্বিক যুদ্ধে পরিণত করেছে এবং একে প্রবল পারমানবিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
বলা যায় রাশিয়ান-ইউক্রেনীয় যুদ্ধ ১ ফেব্রুয়ারী ২০১৪-এর শেষের দিকে শুরু হয়েছিল। সেটা ঘটেছিল গোপনে, এটা প্রকাশ্য কোন অপারেশান ছিল না। পাশ্চাত্যের দাবি রাশিয়ান সৈন্য এবং তাদের ‘বিশেষ-অপারেশন ইউনিট’ স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র ক্রিমিয়া সামরিক ভাবে দখল করেছে । রাশিয়া দাবি করে এই ক্ষেত্রে তাদের কোন হাত নাই। কারণ যারা স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিশাবে ক্রিমিয়াকে মুক্ত করেছে তারা ক্রিমিয়ারই জনগণ। সরকারি অফিস, সামরিক স্থাপনা নিজেদের দখলে বাইরের কোন শক্তি করে নি, সেটা ক্রিমিয়ার জনগণই করেছে। এটা ক্রিমিয়ার আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের পরিণতি। তারা একটা রেফারেন্ডামও করেছে ১৬ মার্চ ২০১৪ সালে। যার মধ্য দিয়ে ক্রিমিয়া নিজেকে ইউক্রেন থেকে আলাদা ঘোষণা করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কাউন্সিল একে জাতিসংঘ সনদ এবং হেলসিংকি ফাইনাল এক্টের পরিপন্থি গণ্য করে। ইউরোপ এটিও দাবিও করে বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম ১৯৯৪ এবং ১৯৯৭ সালের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি (Treaty on Friendship, Cooperation and Partnership of 1997) রাশিয়া ক্রিমিয়ার সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। কিন্তু ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি। পুতিন পরে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান সৈন্য মোতায়েন করেন। রাশিয়া শুরুতে কোন সামরিক হানাদারি বা দখলদারি করে নি, এটা সত্য। কিন্তু ক্রিমিয়াকে পাশ্চাত্য মেনে নেয় নি।
ক্রিমিয়ান অপারেশনকে পাশ্চাত্য রাশিয়ার হাইব্রিড যুদ্ধের কাজ বলে মনে করে। সেটা শুধু ক্রিমিয়ায় নয়, ইউক্রেনের পশ্চিম বা রাশিয়ার পূর্ব দিকের অন্যান্য রাজ্য বা ভূখণ্ডেও রাশিয়া তাদের হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করেছে। রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য তাকে দোষী গণ্য করা অন্যায্য। একে আগ্রাসন বলাও ভুল। কারন শুরুতে দৃশ্যমান সামরিক অপারেশান না করে অদৃশ্য থেকে সামরিক তৎপরতার সঙ্গে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ব্যবহার করে রাশিয়া তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছে। প্রচলিত এবং অপ্রচলিত যুদ্ধের মিশ্রণের কারণে একে হাইব্রিড যুদ্ধ বলা হয়। এটা পুরানা ‘মতাদর্শিক লড়াই’-এর আধুনিক রূপ।
রাশিয়ার সামরিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কৌশল নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, যার অনেক কিছুই আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। বিশেষত রাশিয়ার বুদ্ধিজীবি ও দার্শনিকদের তত্ত্বগত প্রচার ও পাশ্চাত্যের তথাকথিত ‘আধুনিক’ চিন্তার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে নব্য রাশিয়ার উপলব্ধি নতুন অভিমুখ ও মাত্রা পেয়েছে। পাশাপাশি আগামি বিশ্ব ব্যবস্থার একটা সম্ভাব্য রূপরেখাও আমরা পাই এই সকল তত্ত্বগত বিষয় আমাদের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেইসব নিয়ে আমরা আলাদা আলোচনা করবার ইচ্ছা রাখি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মার্কিনী ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের অধীন তথাকথিত ‘আধুনিক’ ইউরোপ রাশিয়ার নতুন ধারার বুদ্ধিজীবীদের ‘উগ্র-ডান পন্থি’ বলে চিহ্নিত করে। তাতে আমাদের বিভ্রান্ত হবার কিছু নাই। কিন্তু পাশ্চাত্যের গবেষকরা একটা কথা বলেন যা মিথ্যা নয়। সেটা হোল তথাকথিত অতি দূর দক্ষিণ পন্থি (Far Right) বা উগ্র ডান পন্থি বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকরা এই ক্ষেত্রে খুবই নির্ধারক ভূমিকা পালন করছেন। পাশ্চাত্যের চোখে তারা উগ্র ডান বা ‘ফার রাইট’ কারন তারা মার্কিন ‘লিবারেলিজম’, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’, ব্যক্তিতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও জীবন যাপন ইত্যাদির বিরোধী। বিপরীতে ধর্ম, সমাজ ও ঐতিহ্য পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য জরুরি – তাদের এই দাবি ফেলনা নয়। মার্কিন সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হলে মাতদর্শিক লড়াইকে প্রধান করে তুলতে হবে। এই তর্ক বাংলাদেশেও গুরুতর রাজনৈতিক-আদর্শিক তর্ক হিশাবে হাজির রয়েছে যা নিয়ে আমাদের অবশ্যই আরও বিস্তৃত অন্যত্র আলোচনা করা খুবই জরুরি। এটা সত্য রাশিয়ার বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকরা রাশিয়ার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিশেষত যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক কেন্দ্রিক বিশ্বের বিপরীতে একটি বহুকেন্দ্রিক কিন্তু মোটা দাগের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার আত্মপ্রকাশ ত্বরান্বিত করতে চান। সেই জন্য নব্য ইউরেশিয়া ও বহুকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা তারা গড়ে তুলতে চাইছেন।
অতএব নব্য ইউরেশিয়া তত্ত্বের ভালমন্দ পর্যালোচনা আমাদের জন্যও জরুরি হয়ে পড়েছে।