আইন, সংবিধান ও গণতন্ত্র


সাজানো বা বিন্যাসের প্রশ্ন

আমরা ‘আইন, সংবিধান ও গণতন্ত্র’ নিয়ে কথা বলব। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা নতুন নয়, কিন্তু সম্প্রতি গণতন্ত্র কাজ করছে না, এই অভিযোগ খোদ পাশ্চাত্যে প্রবল ভাবে উঠেছে। লিবারেলিজম সম্পর্কে পুরানা অভিযোগ যে উদারবাদী রাজনৈতিক আদর্শের কেচ্ছা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা কায়েমের আদর্শ। মার্কিনিরা তাদের স্বার্থের তাগিদে  দেশে দেশে যাকে যখন দরকার ক্ষমতায় বসায়, সরকার বদলায়, অভ্যূত্থান ঘটায়, ইত্যাদি। তাদের কাজ বিশ্ব ব্যবস্থার মোড়লি করে বেড়ানো এবং হামেশা গণতন্ত্রের কেচ্ছা গেয়ে যাওয়া।। রাশিয়া দীর্ঘকাল ধরেই সাবধান করছিল যা তারা তাদের পূর্ব দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণ বরদাশত করবে না। কিন্তু তাই করা হোল। ফল হোল, রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে 'স্পেশাল মিলিটারি অপারেশান' চালাচ্ছে। এরকমই একটি অবস্থায় আমরা বাংলাদেশিকে রাজনৈতিক ভাবে গঠন করবার সম্ভাব্য পথ নিয়ে আলোচনা করব।

একাত্তরে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি বটে এবং বিশ্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একটি রাষ্ট্র হিশাবে স্বীকৃতিও পেয়েছি। কিন্তু দীর্ঘ একটা সময় গিয়েছে এটা বুঝতে যে স্বাধীন রাষ্ট্র হিশাবে বিশ্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বীকৃতি পাওয়া আর রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের  ‘গঠন’ (Constitute)  দুটো ভিন্ন প্রক্রিয়া এবং ভিন্ন কাজ। রাজনৈতিক গঠন মানে কোন বিল্ডিং বানানো না, আমরা কী, কেমন এবং বিশ্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কিভাবে হাজির থাকতে চাই রাষ্ট্র হিশাবে নিজেদের সেই রূপ্টা দেখাতে পারা। তার জন্য আগে নিজেদে ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি’ হিশাবে চিনতে ও বুঝতে পারতে হবে। এই চেনা ও বোঝাবুঝির ব্যাপারটা ধরা পড়ে যখন আমরা নিজেদের  কোন অর্থাএ ‘আমরা’ বলি, কাদের সেই ‘আমরা’-র অন্তর্ভূক্ত করি আর কাদের বাদ রাখি ইত্যাদি দ্বারা। এর মদধ্য দিয়েই একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠি তাদের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করে এবং নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিশাবে অস্তিত্বমান হয়ে থাকার নৈতিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনোইতিক ন্যায্যতা প্রমাণ করে। আমরা আমাদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করি। বলাবাহুল্য সেই বিচার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ওপর যেমন নির্ভরশীল, তা একই সঙ্গে ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সমাজের সামগ্রিক রাজনৈতিক-দার্শনিক চিন্তাচেতনা বিকাশের সঙ্গেও জড়িত। সেই দিক থেকে নিজেদের ‘আমরা’ বলতে পারা  গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মূহূর্ত। এই আমরা কারা সেটা সমাজের সামষ্টিক বিকাশের মাত্রা এবং গণচেতনার ওপর নির্ভরশীল।

মানুষ একরকম নয়, সমাজে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য থাকে। রাজনৈতিক পরিগঠনের অর্থ হোল সেই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের নিরাকরণ ঘটানো নয়। বরং কোথায় আমরা এক বা একইরকম সে ব্যাপারে একই অনুমান বা ধারণ করা বা পোষণ করা। শুধু বুদ্ধির বিচার নয়  কল্পনা ও আদর্শের ভিত্তিতেও মানুষ নিজেদের একই সমাজের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করতে পারে। করি সে ব্যাপারে মোটামুটি ধারণা থাকা। বলাবাহুল্য নিজেদের সম্পর্কেমানুষের  ধারণা এই ধারণা স্থির বা চিরন্তন কিছু না। এই ‘আমরা’ ভাবার বোধ বদলায়, ফলে রাষ্ট্র ভাঙে, ইতিহাসের উত্থানপতন হয়। সেই ভাঙাগড়া রাজনৈতিক পরিগঠন সামষ্টিক  রাজনৈতিক চেতনা এবং উপলব্ধির সঙ্গে যুক্ত। আধুনিক সংবিধানে ‘We the People’ ঘোষণা দিয়ে যে সামষ্টিক কর্তাসত্তার নামে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ ও গ্রহণ করা হয়, সেই গঠনতন্ত্রই ব্যাখ্যা করে এই ‘আমরা’ কারা। তাদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, আদর্শ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির প্রতি তাদের সম্পর্কের ধরণ কি হবে তা  ‘গঠনতন্ত্র’-ই ধারণ করে।

বাংলাদেশে পুরানা একটি তর্কের অবসান ঘটেছে। সেটা হোল বাহাত্তর সালে যে 'সংবিধান' উকিলদের মুসাবিদা মাফিক বানানো হয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের  ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে সেটাঘটে নি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের আলোকেও  গঠনতন্ত্র প্রণীত হয় নি। স্বাধীনিতার ঘোষণায় ঘোষণায় সাম্য,মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি ছিল সেই প্রতিশ্রুতি বাহাত্তরের সংবিধানে পালিত হয় নি। গোড়াতেই গলদ ঘটেছে। স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য যে ধরণের রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার ছিল তা পালন করা হয় নি। ফলে বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদয় ঘটেছে। এই রাষ্ট্রের পরিবর্তে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ধারণ করে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে আবার ‘গঠন’ করতে হবে।

সম্প্রতি কালে বেশ কয়েকটি নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য আশাব্যঞ্জক। তাদের নামোল্লেখ  এই আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে তাদের শনাক্ত করবার জন্য বলা যায়, তারা সঠিক ভাবেই বিদ্যমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা গণ্য করে এবং যথাসাধ্য এর বিরুদ্ধে লড়ে। এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিশেষ প্রকার জাতিবাদী রাজনৈতিক মতবাদের ওপর দাঁড়ানো, যা ‘বাঙালি জাতিবাদ’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ফ্যাসিস্ট ধারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’-র কথা বলে সহজে পরিগঠিত হতে পেরেছে। অথচ স্বাধীনতারঘোষণা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েম। এই সকল আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে গঠন করবার কর্তব্য পালিত হয় নি। তার বাস্তবায়নই এখনকার প্রধান ও মুখ্য রাজনীতি।

বলাবাহুল্য মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের আবেগের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের বিজয় ও উত্থানের ঘটনা। তাই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটার বিপুল আবেদন রয়েছে। কিন্তু এই আবেগই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমে জ্বালানি জুগিয়েছে। এই ফ্যাসিবাদ মোকাবিলা করা তাই বাংলাদেশের জন্য সহজ ছিল না। তবে এখন বলা যায়, বাংলাদেশে সম্ভবত জাতিবাদী ও ফ্যাসিস্ট কালপর্ব পার হয়ে যাবার শর্ত আগের চেয়ে অনেক বেশী পরিণত।

জাতিবাদের যুগে শুধু ভাষা বা সংস্কৃতি আশ্রয় করে ‘জাতি’ বা ‘জাতিবাদী’ ধারণা তৈরি হয় না, ধর্ম পরিচয়ও আধুনিক জাতিবাদী রাজনৈতিক চরিত্র গ্রহণ করতে পারে এবং করে। বাংলাদেশে ধর্ম ভিত্তিক অধিকাংশ রাজনীতি বাঙালি জাতিবাদের প্রতিযোগী। তাই একপক্ষ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তাদের জাতি ভাবনা ও জাতিরাষ্ট্র কল্পনার মর্মে স্থাপন করে এবং বাঙালি পরিচয়কেই তাদের একমাত্র রাজনৈতিক পরিচয় গণ্য করে। ঠিক তেমনি তাদের প্রতিপক্ষ ধর্মীয় পরিচয় দ্বারা জাতি এবং জাতিরাষ্ট্রের ধারণা কল্পনা করে। সেটা হিন্দু মহাজোট হোক কিম্বা হোক নানান নামের ইসলামি দল।

ইসলাম জাতিবাদ বরদাশত করে না। কিন্তু তারপরও পরিচয় সর্বস্ব জাতিবাদী ইসলামের রাজনৈতিক ধারা বাংলাদেশে রয়েছে। পরিচয়বাদ বা জাতিবাদের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ঘটেছে আধুনিকতা এবং জাতিবাদী যুগের প্রাবল্যের জন্য। আধুনিক ইউরোপে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফল হিশাবে। ফলে জাতিবাদ বা পরিচয়বাদের বিচার আধুনিকতার পর্যালোচনার সঙ্গে যুক্ত, সরাসরি ভাষা, সংস্কৃতি বা ধর্মের নয়। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রতিটি জনগোষ্ঠির উপলব্ধি, চিন্তা বা নতুন দার্শনিক আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাখবেই। কিন্তু তাদের নিছক পরিচয়ে পর্যবসিত করা এবং সেই পরিচয়কেই মানুষের পরমার্থ নির্ণয়ের মান্দণ্ডে পরিণত করা একান্তই আধুনিক কালের লক্ষণ। ধর্মীয় জাতিবাদের সঙ্গে ইসলাম কিম্বা সনাতন ধর্মের অনিবার্য কোন সম্পর্ক নাই। একদিকে ভাষা ও সংস্কৃতি এবং তার বিপরীতে ধর্মের এই জাতিবাদী রাজনৈতিক পরিগঠন মোকাবিলা দীর্ঘকাল বাংলাদেশের জন্য কঠিন রাজনৈতিক লড়াই হয়ে হাজির থেকেছে। তবে অনুমান করি সম্ভবত আমরা পরিচয়বাদ বা জাতিবাদী কালপর্ব অতিক্রম করে যাচ্ছি।

অতিক্রম করে যাবার একটা লক্ষণ হচ্ছে বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক-আদর্শিক ভাবে ‘গঠন’ করবার তর্ক প্রধান হয়ে উঠেছে। যদি তা সত্য হয় তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এটা বড় ঘটনা। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য যেমন আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে বাংলাদেশের সঠিক স্থান আদায় করবার লড়াই আছে, তেমনি নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাসের সঙ্গেও নতুন করে মোকাবিলার কথা উঠেছে। পাশ্চাত্যের ‘লিবারেলিজম’ এবং ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কেও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। নানান প্রকার সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্ব ফেরি করা নতুন কিছু না। তবে সবকিছুই পর্যালোচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। পুরা বিশ্বকে আমরা এখন যদি আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত গণ্য করি তাহলে বাংলাদেশে্র রাজনৈতিক ‘গঠন’-এর কর্তব্যকে এখন আর সংকীর্ণ রাজনৈতিক পরিসরে আলোচনা ও নির্ণয় করা সম্ভব নয়। নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’ পাশ্চাত্য জাতিরাষ্ট্রের পুরানা বর্গ দিয়েও সম্ভব নয়। নানান দিক থেকে আইন সংবিধান গণতন্ত্র ইত্যাদি ধারণার পর্যালোচনাও অতিশয় জরুরি হয়ে পড়েছে।

ইউরোপে পুঁজির বিকাশের যে পর্যায়ে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছিল সেই বাস্তবতা এখন আর নাই। পুঁজি এখন গোলোক ব্যাপী বিস্তৃত এবং তার পুঞ্জিভবন ও স্ফীতির প্রক্রিয়াও পুরা গোলক জুড়ে চলছে। এই প্রক্রিয়া ‘পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন’ নামে পরিচত। যে পুঁজি একসময় তার পুঞ্জিভবন ও স্ফীতির দরকারে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল, সেই পুঁজিই এখন রাষ্ট্র ভাঙছে। পুঁজির কায়কারবারের ওপর এখন রাষ্ট্রের কোন এখতিয়ার থাকুক পুঁজি তা চাইছে না। যার ফলে কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থার যুগে আমরা প্রবেশ করেছি, যা নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতিবাদ (Neo-Liberal Economic Policy) নামে পরিচিত। রাষ্ট্র কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থার যুগে তার অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে অনেক আগেই। ইউরোপে যে ওয়েস্টফেলিয়া শান্তিচুক্তির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা গড়ে উঠেছিল, যে চুক্তির দ্বারা ইউরোপে ৩০ বছর ধরে চলা যুদ্ধ শেষ হয় – সেই সার্বভৌমত্বের ধারণা নিরর্থক হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের রক্ষা করবার মানবিক দায়ের কথা বলে সার্বভৌমত্বের তোয়াক্কা না করে সেই দেশে সামরিক হস্তক্ষেপও এখন জায়েজ হয়ে গিয়েছে। এটা Humanitarian Intervention নামে পরিচিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বও এখন সীমিত। যদি বাজার ব্যবস্থাই আমাদের জীবিন ও জীবিকা নিয়ন্ত্রণ করে এবং রাষ্ট্রের কোন দায় নাই বলা হয় তখন রাষ্ট্রের একটাই ভূমিকা থাকে। সেটা হোল সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা। দেশি ও বহুজাতিক কর্পোরেশান, লুটেরা ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা এবং নানা মাোফিয়া গোষ্ঠির পাহারাদার হিশাবে রাষ্ট্রের পুলিশ, সেনাবাহিনী, আইন শৃংখলা বাহিনী এবং বিচার ব্যবস্থা ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্র নিচকই একটা নিরাপত্তা রক্ষার হাতিয়ারে পর্যবসিত হয়েছে। যে ইউরোপের ইতিহাসকে মানুষের সার্বজনীন ইতিহাস গণ্য করে আমরা আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা গড়ে তুলেছিলাম বাস্তবে তা ফাঁপা হয়ে গিয়েছে। নিজেদের সার্বভৌম রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে ‘গঠন’-এর তর্ক কোথা থেকে কিভাবে শুরু করা যায় সেটাই বিতর্কিত হয়ে গিয়েছে।

তারপরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাষ্ট্রের সংস্কার কিম্বা রাষ্ট্র নতুন ভাবে গঠনের কথা অনেকে বলছেন। আমার এ লেখার প্রধান উদ্দেশ্য নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে গঠনের কর্তব্যকে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে লড়ে যাওয়া নতুন উদ্যোগগুলোর আলোচনার ক্ষেত্রগুলো কি হতে পারে সে বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করা। সজীব বুদ্ধিবৃত্তিক ধারাকে শক্তিশালী করা দরকার যেন সম্ভাব্য ঐক্যের ক্ষেত্রগুলো আমরা শনাক্ত করতে পারি। সেই বিষয়ে ভাবতে গিয়েই আমরা সাধারণত আইন, সংবিধান ও গণতন্ত্রের কথা তুলি। রাজনৈতিক তৎপরতার দিক থেকে এই বিষয়গুলোই সবার আগে উঠে আসে। সাধারণত পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এভাবেই আমরা ধারণাগুলোকে পরপর সাজিয়ে কথা বলি। খুব ভেবে বলি তা না, কিন্তু অবচেতন ভাবে সাজানো হয়ে যায়। হয়তো এই পর পর সাজানোর কোন বিশেষ মানে নাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোন ধারণাটিকে নিয়ে কথা শুরু করলে আমরা বাকি ধারণাগুলোর অন্তর্নিহিত মর্ম ধরতে পারি? শুরু থেকেই – অর্থাৎ বিষয়ে প্রবেশ ও পর্যালোচনার আগে বিন্যাসের ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা না থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বিন্যাস যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা শুরুতে বোঝা দরকার। তা না হলে ধারণাগুলো কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত আমরা তা ধরতে পারব না। নিদেনপক্ষে এই ব্যাপারে হুঁশ না থাকলে আলোচনা অস্পষ্ট, অপরিচ্ছন্ন ও বিমূর্ত হয়ে যাবার বিপদ ঘটতে পারে, বোঝাবুঝির চেষ্টা হোঁচট খায়। তখন এভাবে পর পর সাজানোটাই প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক কর্তব্য যথাসাধ্য নির্ণয় করতে চাইলে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে তুলতে হবে।

আমরা সম্পূর্ণ নতুন একটা সময়ে বাস করছি। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন – অর্থাৎ পুঁজির বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি ও স্ফীতি আরও পরিব্যাপ্ত ও গভীর হয়েছে। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটেছে, এর মধ্যে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের টেকনলজি মানুষের শরীর ও মন উভয়কে আগের চেয়ে অনেক সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। একালে রাজনীতি বিজ্ঞান ও টেকনলজির পর্যালোচনা ছাড়া সম্ভব নয়। এর সঙ্গে যুক্ত বৃহৎ পুঁজি – বিশেষত বহুজাতিক কর্পোরেশানগুলোর ভূমিকা, যাদের অনেকেরই ক্ষমতা আধুনিক রাষ্ট্রের চেয়েও অধিক এবং প্রবল।

এরপর রয়েছে জীবাশ্ম ভিত্তিক জীবনযাত্রা এবং মানুষের প্রবল ভোগলিপ্সার ওপর দাঁড়ানো বর্তমান পরিবেশ বিধ্বংসী সভ্যতা। রাজনীতি দূরে থাকুক মানুষের বাঁচামরার প্রশ্ন প্রধান হয়ে উঠেছে। বর্তমান সভ্যতা মানুষসহ প্রতিটি প্রাণের অস্তিত্বকে প্রবল হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এই অবস্থা চলতে থাকলে গ্রহ হিশাবে এই পৃথিবী আদৌ টিকে থাকবে কিনা। গ্রিন হাউস গ্যাসে আকাশ ফুটা হয়ে যাওয়া এবং জলবায়ু বিপর্যয় সেই আশংকা প্রবল করে তুলেছে। পৃথিবী নামক গ্রহে আগামিতে আদৌ কোন প্রাণের অস্তিত্ব টিকবে কি না। সেই ক্ষেত্রে সমুদ্রের তলায় তলিয়ে যাবার সমূহ বিপদ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে। একে আমরা সবার আগে মোকাবিলা করব কিভাবে? নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে গঠনের তর্ক তাহলে আমাদের জৈবিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েছে।

ইতিহাস বিচারের ধারাও গুণগত ভাবে বদলে যাচ্ছে, বলা হচ্ছে আমাদের এখন মানুষের ইতিহাসের কথা না বলে উচিত গ্রহের ইতিহাসের কথা বলা, কারণ আমরা এখন মানুষের ভেতর বাইরের সম্বন্ধের চরিত্রের দিক থেকে এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে যাকে চিন্তার পুরানা কোন প্রত্যয় বা বর্গ দিয়ে আর বোঝা যায় না। ইতিহাসকে আমাদের এখন ভূতাত্ত্বিক বর্গ দিয়ে বুঝতে হবে। যেমন ‘এনথ্রোপসিন’ (Anthropocene)। ‘এন্থ্রো’ মানে মানুষ, ‘সিন’ মানে সময়। এনথ্রোপোসিন মানে মানুষের কার্যকলাপের কারণে গ্রহের জলবায়ু এবং প্রাণ ব্যবস্থার ওপর যে বিকট বিনাশী প্রভাব পড়েছে সেই কাল বা সময়। তাহলে মানুষের কারণে পৃথিবী নামক গ্রহের যে বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে তাকে গ্রহীয় রূপান্তর হিশাবে বোঝা দরকার। যে কোন রাজনৈতিক পরিগঠন ‘মানুষ’ সংক্রান্ত ধারণার ওপর দাঁড়ায়। তাহলে বাংলাদেশ নতুন রাজনৈতিক পরিগঠনের কথা চিন্তা করতে গেলে ‘মানুষ’ সম্পর্কে আমাদের ধারণা কি হবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

এ যাবত কাল আমরা প্রকৃতি, জগত, গ্রহ বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে ‘মানুষ’ নামক প্রাণীর ইতিহাস নিয়ে ভেবেছি। মানুষকে এভাবে বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাবলে মানুষের বাহিরকে প্রকৃতি, জগত, গ্রহ বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যাই বলি সেই বিশাল ব্যাপার মানুষের ইতিহাসের বাইরে থেকে যায়। ভেতরতো বটেই এমনকি বাহিরকে আমরা কিভাবে বদলাচ্ছি এবং কিভাবে সকল প্রাণের জন্য বিপজ্জনক করে তুলছি এবং প্রাণ ব্যবস্থার ক্ষয় সহ পুরা গ্রহের বিনাশও ত্বরান্বিত করে তুলেছি তা নিয়ে ভাবতে না শিখলে আমাদের বর্তমান সমস্যার কিছুই আমরা ধরতে পারব না, বুঝব না এবং সমাধানও করতে পারব না। শ্রুতি আছে, যা আছে ভাণ্ডে তাই ব্রহ্মান্ডে বা যা ব্রহ্মাণ্ডে তাই ভাণ্ডে। তাহলে মানুষের ইতিহাস ব্রহ্মাণ্ডকে মানুষের বাইরের ভেবে রচনা করলে কিছুই বোঝা যাবে না। ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস মানেই মানুষের কিম্বা মানুষের ইতিহাস মানে ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস। আমাদের নিজেদের পুরানা কথা আমাদের আবার নতুন ভাবে ভাবতে হচ্ছে। যেন মানুষের মধ্য দিয়ে গ্রহ নিজের ইতিহাসের কথা নিজেই বলতে পারে।

বাহির বা বাইরের জগতকে আমরা এতকাল স্রেফ মানুষের ভোগের বিষয় হিশাবে ভাবতে শিখেছি, পৃথিবী বুঝি স্রেফ আমাদের ভোগের কাঁচামাল সরবারাহকারী কিম্বা ভোগ্য জিনিস উৎপাদনের উপায়। আমরা বিশ্বাস করেছি, মানুষের কাজ হচ্ছে ‘জগত জয় করা’, পৃথিবীর ওপর মানুষের প্রভূত্ব কায়েম। একটা আপাদমস্তক ম্যাসকুলিন অর্থাৎ পুরুষালি বা ব্যাটাগিরি চিন্তা দ্বারা মানুষের সঙ্গে বাইরের জগতের সম্বন্ধ আমরা ভেবেছি। চিন্তার এই অভ্যাস থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। কারণ এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা প্রজাতি হিশাবে মানুষের টিকে থাকা অসম্ভব করে তুলেছে এবং আমাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটাই এখন যম হয়ে জলবায়ু বিপর্যয় নামে মানুষের সামনে হাজির হয়েছে। জগৎ যে নিছকই মানুষের ভোগের জন্য নয়, এই হুঁশটুকু দ্রুত আমাদের ফিরে পাওয়া দরকার। সবার আগে সত্য হচ্ছে এই যে আমরা এই জগতে ‘বাস’ করি। প্রকৃতি আমাদের লালন পালন করেন। ‘বাস’ বা ‘আবাস’ তাই একালে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বর্গ। কোন রামান্টিক পরিবেশবাদিতা বিষয় না। একালে রাজনৈতিক গঠন প্রাণ এবং প্রাণের ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন বাদ দিয়ে করা সম্ভব না। জীব হিশাবে টিকে থাকতে পারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনোইতিক বিষয় হয়ে উঠেছে।

পৃথিবী আমাদের ‘আবাস’। নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’ মানে নিজেদের ‘আবাস’ বা বসবাসের জীবন্ত ভূগোল সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকা। আধুনিক পরিবেশ বিদ্যায় আবাসকে ইকোলজি (Ecology) বলা হয়। সহজ বাংলায় একে আমরা আবাস, বা আরও সহজ ভাষায় আমাদের বাড়ি বলতে পারি। এই গ্রহ আমাদের বাড়ি, তার যে অংশে আমরা বাস করি তার সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার জন্য নিজেদের গঠন করার অর্থ গাঠনিক পরিকল্পনায় অন্যদেরকেও গাঠনিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত রাখা। আমাদের নদী, ভূগোল, সমুদ্র, বাতাস, রৌদ্র এবং অপরাপর প্রাণের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনা একই সঙ্গে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয়েরও প্রশ্ন। পুরানা জাতিবাদ কিম্বা কেন্দ্রীভুত ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক জাতিবাদী রাষ্ট্র সেই ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। আমাদের নতুন রাজনৈতিক পরিগঠন পুরানা জাতিরাষ্ট্রের বর্গ দিয়ে ভাবা আর সম্ভব না। পুরানা রাজনৈতিক চিন্তার পর্যালোচনা ছাড়া ইতিবাচক কিছু প্রস্তাব করতে আমরা সক্ষম হব না।

পৃথিবী নিজেই একটি ‘জীবন্ত প্রাণ ব্যবস্থা’, গ্রিকদের ভাষায় GAIA। আমরা এই গোড়ার কথাটাই ভুলে বসে আছি। আমাদের গ্রিকদের মতো ভাবতে হবে এমন কোন কথা নাই। বাংলার ভাবুকদের মধ্যে একটি কথার চল আছে। সেটা হোল ‘জগজ্জননী’। পৃথিবী বা জগৎ আমাদের জননী, যা সকল প্রাণের উৎস বা জন্মদাতা। ইসলামে মানুষের ধারণা আল্লাহ এবং তাঁর সৃষ্টির ধারণার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। কারণ মানুষের সৃষ্টি হয়েছে জগতে আল্লার খলিফা হিশাবে ভূমিকা রাখবার জন্য। ফলে বিশ্বজগতের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই মানুষের কাজ, ধ্বংস করা না। পৃথিবীকে মানুষ সহ সকল প্রাণের বাড়ি বা আবাস হিশাবে ভাববার তাগিদ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী প্রবল হয়েছে। একালের রাজনীতি মানুষের ভেতর বাহিরের সম্বন্ধকে কঠোর পর্যালোচনার অধীনে না এনে আর নির্ণয় করা যাবে না। নতুন চিন্তার সঙ্গে মোকাবিলা না করে আমাদের বাংলাদেশে কি করা কর্তব্য তা নির্ণয় করাও এখন অসম্ভব।

আরেকটি দিক থেকেও আমরা নতুন কালপর্বে প্রবেশ করছি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ মোটামুটি শান্ত হবার পর যুদ্ধ ইউরোপে সরে গিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটো প্রক্সি ওয়ার চালাচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে, পালটা জবাব হিশাবে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশান’ শুরু করেছে। রাশিয়ার অভিযোগ হচ্ছে প্রাক্তন সোভিয়েট রাশিয়া ভেঙে যাবার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তার অবসান দরকার। একটি বহুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে না উঠলে পৃথিবীর অন্য কোন জনগোষ্ঠির পক্ষে নিজের ধর্ম, ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং বৃহত্তর সভ্যতার পরিমমণ্ডলের অন্তর্গত থেকে নিজদের বিকাশ ঘটাতে পারবে না। সময় এসেছে লিবারেলিজম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেশে দেশে মিলিটারী কায়দায় ‘গণতন্ত্র’ ফেরি করে বেড়ানো বন্ধ করবার ব্যবস্থা করা।

দুনিয়া আমাদের চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র, সংবিধান, আইন ইত্যাদি প্রতিটি ধারণা, প্রত্যয় বা বর্গ আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। নতুন রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ণয়ের জন্য আমাদের ধীরে ধীরে এই বর্গগুলোকে জিজ্ঞাসার অধীন করতে হবে। যেন তারা আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়াতে না পারে। এই সকল প্রসঙ্গে আমরা লাফ দিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জটা কতো বড় সে সম্পর্কে ধারণা দেবার জন্য ভূমিকা হিশাবে কথাগুলো বলতে হোল।

বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে এলোমেলো আমরা শুরু করতেই পারি, শুরুর দরকারে। বিষয়কে কোন সুনির্দিষ্ট সূত্র দিয়ে আগাম বেঁধে ফেলা হয়তো ঠিক না। হয়তো খোলা আলোচনাই অধিক ফলদায়ক। কিন্তু বিন্যাস্টা এভাবে কেন হোল, বা হয়? আমাদের অবচেতনেই কি হয়? পরপর এই বিন্যাসেই কি আমরা ভাবতে অভ্যস্ত? যেমন, সবার আগে ‘আইন’, তারপর ‘সংবিধান’ এবং সবশেষে ‘গণতন্ত্র’। কিন্তু এই যে আমরা পরপর সাজালাম, কি বুঝে এভাবে আমরা সাজাই? সাজাবার পেছনে আমাদের কোন অনুমান বা সজ্ঞান সিদ্ধান্ত রয়েছে কি? যেমন ‘আইন’ ব্যাপারটা কি আসলে? কিভাবে একটি সমাজে আইন তৈরি হয়? আইন কোথা থেকে আসে? আইনের বৈধতা কি করে ঠিক হয়? ‘আইন’ কি সংবিধানের বাইরের, স্বাধীন কোন ব্যাপার? যার উদ্ভব ও বৈধতার ভিত্তি আধুনিক সংবিধান রচনারও আগে। আইন কি প্রাকৃ্তিক, ঐশ্বরিক বা অন্য কিছু? হয়তো আমরা অনুমান করি যে আলাদা ভাবে ‘আইন’-এর মর্ম বুঝলেই আমরা সংবিধান বা গণতন্ত্রের মর্ম বুঝব। তাই ‘আইন’ কথাটা কি আপনা আপনি আগে এসে যায়? । আমরা কি মনে করি আইন আগে, তারপর সংবিধান এবং সবশেষে গণতন্ত্র?

‘সংবিধান’ আরেকটি বিতর্কিত ধারণা। ‘সংবিধান’ কী? তারপর ‘গণতন্ত্র’।

তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘আইন’ তৈরি করে জনগণ, সেটা তৈরি হয় তাদের নির্বাচিত আইন প্রণয়নী সভা বা পার্লামেন্টের সদস্যদের দ্বারা। যদি সংবিধান দিয়ে আলোচনা শুরু করি তাহলে বোঝা যায় বিধান বা ‘আইন’ ধারণার আলাদা কোন রহস্য নাই। আধুনিক রাষ্ট্রে আইন বানায় আইন প্রণয়নী সভা, অর্থাৎ জাতীয় সংসদে আইন তৈরি হয়। জনগণ জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। তারপর ভোটে নির্বাচিতরা যারা ভোট দিয়েছে তাদের জন্য আইন তৈরি করে। আইন জনগন সরাসরি তৈরি করে না। কিম্বা বাস্তবে আমরা পরিষ্কারই দেখি যে যাদের ভোটে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হোল তারা জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে আইন তৈরি করছে। শুধু তাই নয় যাদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণ রাখবার কথা তাদের কন্ঠরোধ করা, তাদের বাক, বিবেক বা ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করবার আইন জাতীয় সংসদেই পাশ হয়েছে। যেমন ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট’।

১০ই এপ্রিল ২০১৮ সালের সপ্তদশ সংশোধনী সহ বাংলাদেশের সংবিধান সব মিলিয়ে ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন জনগণের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের ওপর নির্ভরশীল না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ১৪২নং অনুচ্ছেদ রয়েছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের সদস্যদের মোট সংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সংবিধান বদলে দেওয়া যায়। তবে পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী, ত্রয়োদশ সংশোধনী ও ষোড়শ সংশোধনী বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্ট বাতিল করবার রায় দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত দেবার সঙ্গে কারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে তার সম্পর্ক রয়েছে। তাহলে বাস্তব সত্য হচ্ছে একবার ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতাসীন শাসক চাইলে নিজের সুবিধা মতো সংবিধান বদলাতে পারে। সেটা সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ দ্বারা হোক, কিম্বা হোক আদালতের দ্বারা। আদালত বাতিল করবার যুক্তি হিশাবে সংবিধানের মূল কাঠামোর (Basic Structure) অজুহাত দিয়েছে। আদালত বলেছে, সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন হয়ে যায় এরূপ কোনো সংশোধনী আনা যাবে না; আনা হলে তা হবে এখতিয়ার বহির্ভূত।

কিন্তু সংবিধানের ‘মূল কাঠামো’র তর্ক সংবিধানের অন্তর্গত তর্ক না। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধানে ‘সংবিধানের মূল কাঠামো’ নামক কোন ধারণা নাই। ‘মূল কাঠামোর’ তর্ক আদালতের তৈরি করা তর্ক, আদালতের ব্যাখ্যা। সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন হয়ে যায় এরূপ কোনো সংশোধনী এতে আনা যাবে না; আনা হলে তা হবে এখতিয়ার বহির্ভূত। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুই তৃতীয়াংশ সদস্য ভোট দিলেই সংবিধানের যে কোন আইন বদলানো যায়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ‘সংবিধান’ কথাটির একটি আইনী ব্যাখ্যা আছে। বলা হয়েছে সংবিধান মানে সেই বিধান যা দেশের সর্বোচ্চ আইন, যার অধীনে জাতীয় সংসদ বিভিন্ন আইন তৈরি করে। কিন্তু আইন শুধু জাতীয় সংসদ প্রণয়ন করে সেটা সার্বজনীন সত্য নয়। আধুনিক রাষ্ট্র যখন ছিল না তখনও মানুষ সমাজের জন্য বিধিবিধান রচনা করেছে এবং মেনে চলেছে। সেটা অধিকাংশ সময় ছিল নৈতিক, ধর্ম সেখানে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। আইন শাস্ত্রে প্রকৃতিগত আইন (Natural Law) বা মানুষের স্বাভাবিক নীতি-নৈতিকতা বোধ থেকে সৃষ্ট আইনের স্বীকৃতি আছে। সেই আইন সমাজের প্রথা, ঐতিহ্য ও চর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইন। বাংলায় ‘ধর্ম’ ধারণার একটি গভীর ব্যঞ্জনা আছে, যা ইংরেজি ‘রিলিজিয়ন’ ধারণায় নাই। সেটা হোল সমাজে বাস করবার জন্য আমরা যা ধারণ করি তাই ‘ধর্ম’। আধুনিক কালে আমরা সেই প্রাচীন উপলব্ধি কিম্বা সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছি যাকে আমরা ‘স্বাভাবিক’ ভাবতাম এবং আধুনিক রাষ্ট্রের মতো বল প্রয়োগ ছাড়াই সমাজ থেকে চ্যুত হবার ভয়ে মানতাম। সমাজ যতোটা প্রবল সামাজিক নীতিনৈতিকতার শক্তিও ততোটাই প্রবল থাকে। সমাজ থেকে ‘একঘরে’ হয়ে যাওয়াটা ভয়ংকর শাস্তি। সামাজিক নীতি ও সংস্কৃতি না মানার জন্য প্রাচীন শাস্তিবোধ আমাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট নাই বটে, কিন্তু সমাজের ভয়ে আমরা এখনও অনেক কিছুই স্বেচ্ছায় করি, বহু সামাজিক বিধান আমরা মানি। তাহলে ‘ন্যাচারাল ল’ বা প্রকৃতিগত আইনের ভূমিকা এখনও সমাজে রয়েছে। সেই আইন বোঝার কাজটা নৈতিক এবং নৃতাত্ত্বিক পরিমণ্ডলের বিষয় হয়ে আছে। নীতির বিচার বা নৈতিকতার তর্ক আমাদের অনিবার্যভাবেই একটা পরাবিদ্যামূলক পর্যালোচনার পরিমণ্ডলে প্রবেশ করতে বাধ্য করে। তবে এখন আইন বলতে আমরা সাধারণত মানুষের তৈরি আইন (Positive Law) বুঝি। যেমন, ‘সংবিধান’, জাতীয় সংসদে পাশ করা আইন, ইত্যাদি। ‘আইন’ কোন বিমূর্ত পরাবিদ্যামূলক বিষয় কিনা সেটা আমরা সহজে ধরতে পারি না। কিন্তু সেটা পরিষ্কার ধরা পড়ে যখন আমরা দেখি যে রাষ্ট্রের দ্বারা তৈরি বা মানুষের তৈরি আইন সবসময়ই বল প্রয়োগের মধ্য দিয়েই বাস্তবায়িত হয়। আধুনিক কালে ধর্ম ও নীতিনৈতিকতার সঙ্গে আইনের পার্থক্য আমরা সহজে উপলব্ধি করতে পারি যদি খেয়াল করি যে আইন যদি ‘বলবৎ করা না যায়, সেটা আর আইন থাকে না। এমন আইন বাংলাদেশে বিস্তর আছে। কোন আইন বলবৎ হবে আর কোন আইন হবে না সেটা ঠিক হয় রাষ্ট্রের ক্ষমতা কোন শ্রেণী, গোষ্ঠি বা মাফিয়াদের হাতে রয়েছে তার দ্বারা।

আমাদের আলোচনার জন্য যে দিকটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হোল আধুনিক কালে আইন মানেই বলবৎযোগ্য আইন, অতএব আইন আর বলপ্রয়োগ বা শক্তি আলাদা কিছু না। আইন বুঝতে হলে শক্তি বা বলপ্রয়োগের ক্ষমতার বিচার অত্যন্ত জরুরি। যারা ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ‘Critique of Violence’ পড়েছেন তারা জানেন আইনের গোড়ায় রয়েছে ভায়োলেন্স। আইনের উৎপত্তি এবং আইন বহাল রাখা উভয়েরই গোড়ায় রয়েছে সন্ত্রাস ও বল প্রয়োগ। দর্শনের জগতে প্রবেশ করল এই দিকগুলো আস্তে আস্তে আমাদের সামনে পরিচ্ছন্ন হতে শুরু করে।

আইন, সংবিধান ও গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনার শুরুতে সাজানো বা বিন্যাসের দিকটা আমরা সামনে এনেছি বোঝাতে যে আধুনিক কালে ‘আইন’ বা ‘সংবিধান’ বলতে আমরা সাধারণত রাষ্ট্রের তৈয়ারি আইন (positive Law) বুঝি। কিন্তু প্রকৃতিগত বা স্বাভাবিক নীতি নৈতিকতা, সামাজিক বিধান কিম্বা ধর্মের ভূমিকা (Natural Law) জাতীয় সংসদে প্রণীত আইন নয়। কিন্তু সমাজে নীতিনৈতিকতা, ধর্ম ও প্রকৃতিগত আইনওহাজির থাকে। এই দুইয়ের পার্থক্য আমাদের মনে রাখতে হবে। এ নিয়ে আইনশাস্ত্রে তর্কবিতর্ক অনেক গভীর ও বিস্তৃত। এখানে আমাদের আলোচনা আমরা ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে নিবদ্ধ রাখতে চাই। মানুষের তৈয়ারি আইন বনাম প্রকৃতিগত আইনের তর্ক আমরা ভিন্ন ভাবে অন্যত্র আলোচনা করব।

আইন, সংবিধান ও গণতন্ত্র। এই অর্ডার বা বিন্যাস তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে আমার। এটা যেন আইন, সংবিধান ও রাষ্ট্র সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত অনুমানেরই প্রতিচ্ছবি। সংবিধানের আগে ‘আইন’-এর কথা কিম্বা রাষ্ট্রের আগে আইন ও সংবিধানের কথা বলা আমাদের অবচেতন অনুমান ও চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। আমাদের সংবিধান দাবি করে সংবিধানের বাইরে কোন আইন নাই। তাহলে বিচ্ছিন্নভাবে আইন নিয়ে আলোচনা নিরর্থক তেমনি মানুষের তৈরি আইন (Positive Law) বাদ দিয়ে ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি বা দৈব আইন নিয়েও আলোচনার কোন দরকার নাই। ধর্ম এবং আধুনিক রাষ্ট্রের সম্পর্ককেও আমরা পাশ্চাত্যের ইতিহাস এবং পাশ্চাত্য বাস্তবতার বাইরে ভাবতে পারি না। পাশ্চাত্য আধুনিক রাষ্ট্রকেই আমরা মানবেতিহাসের সবচেয়ে বিকশিত আধুনিক রূপ গণ্য করি।

গণতন্ত্র কি নির্বাচন!

গণতন্ত্র বলতে আমরা বুঝি নির্বাচন। কয়েক বছর পর পর কে বা কারা আমাদের শাসন করবে তাদের নির্বাচন। আসলে কি তাই? কাণ্ডজ্ঞান আমাদের বলে যে যদি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে নির্বাচন রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চর্চার একটি দিক মাত্র, কিন্তু রাষ্ট্রই যদি গণতন্ত্র না হয়, তাহলে নির্বাচন স্রেফ গণবিরোধী বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার অধিক কিছু হতে পারে না। তাহলে নির্বাচন-সর্বস্বতার যুগে আমরা ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে ভাবনা কোথা থেকে শুরু করব? গণতন্ত্র কি স্রেফ একটা মত বা আদর্শ? গ্রিসের দার্শনিকদের কাছ থেকে আমরা যেসব শিখেছি? গ্রিসে ‘ডেমোক্রাসি’ বলতে বোঝাত ‘জনগণের শাসন’ – এটাই আমরা শিখেছি, কিন্তু দার্শনিকদের মধ্যে ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘জনগণ’ কারা? কিভাবে জনগণ ইতিহাসে হাজির হয়। গ্রিস সভ্যতার ভিত্তি দাস ব্যবস্থা। গ্রিসে তো সকলে শাসক নির্বাচনের অধিকারী ছিল না। যারা ‘স্বাধীন’ শুধু তারাই তাদের শাসক নির্বাচনের অধিকারী ছিল। নারীও স্বাধীন ছিল না। নারীরা গরুছাগলের মতো অস্থাবর সম্পত্তি ছিল। দেখা যাচ্ছে শাসক নির্বাচনের দিক থেকে গণতন্ত্রকে বিচার করলেও একটি সমাজে কে ‘স্বাধীন’ আর কে ‘স্বাধীন’ নয় এই তর্কের মীমাংসা আগে, তারপর ডেমোক্রাসির তর্ক। একটি সমাজে কারা মুক্ত কিম্বা স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অধিকারী – অর্থাৎ কারা ‘মানুষ’ সেই তর্কের মীমাংসা না করে একালে গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। এই তর্কটা একালে একটি সমাজে কাকে আমরা ‘মানুষ’ ভাবি আর কাকে ‘মানুষ’ ধারণার বাইরে রাখি তার সঙ্গে যুক্ত। সেটা কাগজে কলমে হোক কিম্বা হোক আমাদের চিন্তাচেতনা বা বুদ্ধির নির্ণয় হিশাবে। অতি প্রাথমিক পর্যায়ে ভাবলেও দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের বিচার ‘মানুষ’ বা ‘জনগণ’ ইত্যাদি ধারণার ওপর দাঁড়ানো। একটি সমাজে সেই ধারণা কিভাবে হাজির তার দ্বারাই সেই সমাজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আমরা বুঝি। অন্যথায় নয়।

শুরুতে এটা বলা যায় গণতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত একটি মতাদর্শ এবং আধুনিক রাষ্ট্রের রূপ বা ধরণের তর্কের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু স্রেফ মতাদর্শ হিশাবে বিচার করলে ‘গণতন্ত্র’ বলতে কি বোঝায় তার কিছুই বোঝা যায় না। বাস্তবে তার রূপের বিচার – অর্থাৎ রাষ্ট্রের রূপ হিশাবে গণতন্ত্র কিভাবে গঠিত হোল বা গঠিত হয় সেই তর্কটাই তাই আমাদের মূল আলাপের জায়গা হয়ে ওঠে। কিন্তু রাষ্ট্রের রূপের বিচার জরুরি।

আমরা যদি আধুনিক পাশ্চাত্য ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যায় ‘গণতন্ত্র’ স্রেফ নির্বাচন না, বরং রাষ্ট্রের একটা বিশেষ ঐতিহাসিক ধরণ বা রূপ। দ্বিতীয়ত এই রাষ্ট্র হঠাৎ হাজির হয় নি, সশস্ত্র ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর মধ্য দিয়ে হাজির হয়েছে। ‘গণতন্ত্র’ কায়েম করবার জন্য গণতন্ত্র বিরোধী শ্রেণীর বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যকে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। এর মানে হোল মানুষ প্রাচীন যে সকল চিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল সেই সকল চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে আগে স্বাধীন ভাবে নিজেকে উপলব্ধি করতে শিখেছে, স্বাধীন ভাবে ভাবতে শিখেছে। অর্থাৎ মানুষের যে একটা স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি আছে, সেটা মানুষ টের পেতে শুরু করেছে। যে সকল চিন্তা নিজেদের সম্পর্কে মানুষের মধ্যে হীনতা বোধ তৈরি করত, সামন্ত শ্রেণী ও গির্জার পুরোহিতদের দাসত্ব মেনে নেবার জন্য মানুষের মন ও ইচ্ছাকে পরিচালিত করত – অর্থাৎ সামন্ত শ্রেণী ও গির্জার ক্ষমতা ও আধিপত্যকে স্বেচ্ছায় কিম্বা বাধ্য হয়ে তারা মেনে নিত -- বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যে সেই সবের অবসান ঘটেছে। মানুষ প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক প্রাকৃতিক শৃংখল থেকে মুক্ত হবার পরই নিজেকে স্বাধীন রূপে হাজির দেখেছে এবং স্বাধীন বলে ভাবতে শিখেছে। স্বাধীন মানুষের আবির্ভাব পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বিস্তৃত হবার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত।

মানুষের পক্ষে নিজেকে স্বাধীন উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে হঠাৎ করে নয়। তার কারন চেতনাগত রূপান্তরের আগেই আর্থ-সামাজিক রূপান্তর ঘটেছে বলে ঐতিহাসিকরা দাবি করেন। পাশ্চাত্যে সামন্ত ব্যবস্থা যখন পুঁজিতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক আবির্ভাবের ফলে বদলে যেতে শুরু করে তখন সমাজে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ‘বুর্জোয়া’ বা স্বাধীন ব্যক্তি চেতনার উদ্ভব ঘটে এবং স্বাধীন ব্যক্তিদের সমাজ তখন তাদের উপযোগী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করবার জন্য চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে। চিন্তা, দর্শন বা বুদ্ধিজীবিতার জগতেও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন এই ধারণার প্রতি বিপুল সাড়া দেখা দেয়। এই পর্বটাকে বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্বও বলা যায় মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন ব্যক্তি – এই ধারণা যখন ইতিহাসে হাজির হোল, মানুষ নিজের সম্পর্কে প্রাচীন চিন্তা ভাবনা থেকেও দ্রুত মুক্ত হতে শিখল। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ গড়ে ওঠার আগে মানুষ নিজের স্বাধীন সত্তা উপলব্ধি করে নি, তা নয়, কিন্তু তা প্রায় সবসময়ই স্থানীয় উপলব্ধির অধিক কোন মর্ম লাভ করতে পারে নি। কখনও কখনও তা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক রূপ নিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছে। সার্বজনীন সত্য হিশাবে মানুষ ‘স্বাধীন’ বা ‘মুক্ত’ এই ধারণার প্রসার, বিস্তৃতি ও সার্বজনী স্বীকৃতির সঙ্গে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বিস্তৃতির ইতিহাস জড়িত।

আর্থ-সামাজিক রূপান্তর ও নতুন ভাবে নিজেদের নিয়ে ভাববার চিন্তা, আদর্শ বা দর্শন তাহলে আগে ঘটেছে। সেটা যেমন ঘটেছে আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, তেমনি একই সঙ্গে দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও। রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটেছে পরে। এই রূপান্তর একটা স্তরে পৌঁছাবার পর স্বাধীন ও সচেতন ব্যক্তিরা নিজেরা একসঙ্গে বসে কি ধরণের রাষ্ট্রে তারা বাস করতে চায়, তার গোড়ার নীতি বা আদর্শ কি হবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে। প্রবল তর্কবিতর্ক চলে। সামাজিক তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়েই নতুন সম্ভাব্য রাষ্ট্রের নকশা বা সেই রাষ্ট্রের আগাম রূপ নির্ণয়ের জন্য মানুষ ভেবেছে। ‘জনগণ’ কথাটির মর্মও এর মধ্য দিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ‘জনগণ’ মানে তারা যারা মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন এই সত্যে বিশ্বাস করে। নিজেদের সম্পর্কে তাদের উপলব্ধিও সেই রকম। রক্ত, জাত, বংশ বা আভিজাত্য না, মানুষ সকলে সমান এই ধারণাও মোটামোটি সমাজে দানা না বাঁধলে গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না। কেবল তখন স্বাধীন ও মুক্ত মানুষের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র নতুন করে গঠন করবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মানুষ স্বাধীন এবং তার স্বাধীন ইচ্ছা ও অভিপ্রায় রয়েছে এই সত্য বাস্তবায়নের জন্য যারা সেটা বিশ্বাস করে না কিম্বা যারা মানুষের সাম্যে বিশ্বাস করে না তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয়। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ‘মানুষ, ‘মানব’ ‘মানবতা, ‘স্বাধীনতা’, ‘সাম্য’ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা সমাজে ক্রমশ দানা বাঁধে। সকল স্বাধীন ও মুক্ত মানুষদের নিয়ে তখন নতুন ধরণের সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার চিন্তাও প্রবল হয়। সেই সকল চিন্তা সমাজের সকল স্তরে পৌঁছাতে শুরু করে, আন্দোলন সংগ্রাম তীব্র হয় এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপ নেয়। পাশ্চাত্যে সশস্ত্র গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়েই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে, ভোটাভুটির দ্বারা না।

একটি পুরানা গাঠনিক প্রশ্নঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া

‘জনগণ’ সশস্ত্র রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামন্ত শ্রেণীকে উৎখাত করে ক্ষান্ত হয় নি। তারা রাষ্ট্রের নতুন রূপও আবিষ্কার ও গঠন করেছে। তাই কিভাবে ইউরোপে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হোল সেই প্রক্রিয়া বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা বাহুল্য সেই ইতিহাস নানানভাবে নানাজনে লিখেছেন। আমাদের আলোচনার জন্য সারকথাগুলো এখানে হাজির করছি।

গণতান্ত্রিক বিপ্লবে ‘বিজয়ী’ হয়ে জনগণ সবার আগে একটি ‘অন্তর্বর্তী কালীন সরকার’ গঠন করে। অন্তবর্তী কালীন সরকারের কাজ হচ্ছে একটি ‘গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ’ করা। নতুন রাষ্ট্র ‘গঠন’ করবার জন্য যা আবশ্যিক কর্তব্য। কিন্তু অন্তবর্তী কালীন সরকার সেটা নিজেরা করে নি। সমাজে নতুন রাষ্ট্র গঠনের জন্য নানা চিন্তা থাকতেই পারে, কিন্তু কাজ হচ্ছে এমন একটি ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করা যা যথাসম্ভব সকল জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করতে পারে। তাই সকলে মিলে যেন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা যায় তারা জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকার নিজেরা নয়, কিন্তু জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা ডাকে। এই সভা ‘রাষ্ট্রগঠন সভা’ (Constituent Assembly) নামে পরিচিত। যার কাজ হচ্ছে আগামি রাষ্ট্রের জন্য জনগণের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের আলোকে রাষ্ট্রের জন্য একটি ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) প্রণয়ন করা। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আবির্ভাব কিভাবে বাস্তবে ঘটাতে হয় তা বোঝার জন্য এই প্রক্রিয়া ও ধাপগুলো বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এই দিকগুলো এখনও খুবই অস্পষ্ট।

যে সত্য আমাদের বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে এবং বারবার বাংলাদেশের জনগণকেও বোঝাতে হবে সেটা হোল, পাশ্চাত্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভোটের বাক্সে ব্যালট পুরে দিয়ে আসে নি। দীর্ঘকাল তারা গণআন্দোলন, গণসংগ্রাম, গণবিক্ষোভ সংগঠিত করেছে এবং সশস্ত্র গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গণবিরোধী এবং গণতন্ত্র বিরোধী ক্ষমতাসীন শ্রেণীকে উৎখাত করে আগে ‘বিজয়ী’ হয়েছে। তারপর আন্দোলনের যে সর্বোচ্চ সংস্থার নেতৃত্বে বিজয় ঘটেছে সেই সংস্থার নেতৃত্বে তারা ‘অন্তর্বতী কালীন সরকার’ গঠন করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিশাবে আগে তারা ‘রাষ্ট্রগঠন সভা’ (Constituent Assembly) আহ্বান করেছে। রাষ্ট্রগঠন সভা একটি খসড়া ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) প্রণয়্ন করার পর তার প্রতি জনগণের সম্মতি নির্ণয় করবার জন্য রেফারেণ্ডাম করেছে। তার আগে দীর্ঘিকাল ধরে সমাজের অগ্রসর বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মী এবং ভাবুক-দার্শনিকরা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় কি তা নানা ভাবে তাদের লেখালিখিতে হাজির করেছেন এবং হাজির রেখেছেন।

এটা তাহলে বোঝা দরকার বিপ্লবের রূপ সশস্ত্র গণ অভ্যূত্থান হলেও বিপ্লব কোন রাজনৈতিক দলের কিম্বা সামরিক বাহিনীর ক্যু দেতা বা সশস্ত্র কায়দায় ক্ষমতা দখল নয়। সমাজের চিন্তাচেতনা এবং রাজনৈতিক আশা আকাঙ্খার স্বাভাবিক পরিণতি। কি ধরণের ‘রাষ্ট্র’ জনগণ চাইতে পারে বা চায় সেই বিষয়ে যতো বেশী সমাজে আলোচনা ও তর্কবিতর্ক চলে গণআন্দোলন গণ বিক্ষোভ সফল হবার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক শর্ত ততোই মজবুত হয়। যে কারণে প্রতিটি বিপ্লবই একই সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এটাও দেখা যাচ্ছে ‘রাষ্ট্র গঠন সভা’ যে খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে সেটা আপনা আপনি জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের দলিল হয়ে ওঠে না। কারণ জনগণের অধিকাংশ যদি আত্মসচেতন এবং নিজের স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন না হয়, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ‘জনগণ’ ঐতিহাসিক ভাবে হাজির না থাকে তাহলে গণতন্ত্র কায়েম সম্ভব না। য়ামাদের দেশে আমরা গণতন্ত্র কেন কায়েম করতে পারছিনা তা বুঝতে হলে আমামদের আর্থ-সামাজিক এবং সংস্কৃতির ইতিহাসের হদিস নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। গণতন্ত্র তাই স্রেফ মতাদর্শ নয়, এটা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণ আত্মসচেতন হয়ে উঠতে পারে। বলাবাহুল্য জনগণকে সচেতন করবার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা যতোটা তার চেয়েও অনেক বেশী থাকে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। গণতন্ত কোন গাছের ফল নয় যে যে আপনা আপনি পাকে এবং পেড়ে খাওয়া যায়।

রাষ্ট্র গঠনসভা (Constituent Assembly) খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ করলেই তা গৃহীত হয় না। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে খসড়া গঠনতন্ত্র সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তার জন্য জনগণের আলাদা সম্মতি নেবার প্রয়োজন পড়ে। এটা নিছকই সম্মতির ব্যাপার না। যে রাষ্ট্র গড়ে তোলা হচ্ছে তার সঙ্গে জনগণের উপলব্ধি, চেতনা ও আশা-আকাংখার সারকথা নিহিত আছে সেটা মিলিয়ে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চর্চা। এই ক্ষেত্রে ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যে ভাষায় ‘গঠনতন্ত্র’ লেখা হবে তা অবশ্যই সহজ, সরল ও জনগণের কাছে বোধ্য ভাষায় লিখতে হবে। গঠনতন্ত্রের ভাষা হবে সরল ও সুবোধ্য। জনগণ তাদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় যে ভাষায় প্রকাশ করে সেই ভাষাতেই লিখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান একজন ইংরেজিতে লিখেছেন, আর সেটা আরেকজন দুর্বোধ্য প্রাচীন গদ্যে অনুবাদ করেছেন। এতে বোঝা যায় জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় জনগণ কিভাবে প্রকাশ করে, সমাজের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে ভাষার বিকাশ কিভাবে ঘটেছে তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ যতো বেশি সাধারণ মানুষের ভাষার কাছাকাছি যেতে সক্ষম হবে গণতন্ত্রে ‘জনগণ’ বলতে যা বোঝানো হয় তাদের আবির্ভাবও ততোই ত্বরান্বিত হবে। সাধারণ মানুষের ভাষায় গঠনতন্ত্র (Constitution), আইন বা বিধিবিধান প্রণয়ন করার ক্ষমতার সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক সরাসরি। গণতন্ত্র কায়েম করার সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের সম্বন্ধ সম্পর্কে আমামদের ধারণা নাই বললে চলে। তাই বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের ভাষা এবং আদালতের কায়কারবার দেখলেই আমরা বুঝব গণতন্ত্র বাংলাদেশে এখনও অনেক দূরের পথ। গণতন্ত্রে স্বাধীন ও মুক্ত ব্যক্তি স্রেফ একটি বিমূর্ত দার্শনিক ধারণা নয়, গঠনতন্ত্র, আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন ব্যক্তির স্বাধীনতা রাষ্ট্র রক্ষা করে। এই জন্যই নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান চরিত্র লক্ষণ। গঠনতন্ত্র (Constitution) সাধারণ মানুষের ভাষায় লিখতে পারা এবং সাধারণ মানুষের ভাষায় আইন ও বিধি বিধান প্রণয়ণ গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই জন্যই আদালতের ভাষা এবং বিচারপতিদের সহজ সরল বাংলায় বিচার প্রক্রিয়া ও রায় বাংলাতে লিখতে পারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম ও চলমান রাখার প্রধান একটি শর্ত।

পাশ্চাত্যে বুর্জোয়া শ্রেণী নির্বাচনকে বাংলাদেশের মতো ‘গণতন্ত্র’ বানাবার তামাশা করে নি। সকলের ভোট দেবার অধিকারের জন্য লড়াই হয়েছে। আন্দোলন-বিক্ষোভ যেমন, তেমনি পাশাপাশি চিন্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই বুর্জোয়া ‘শ্রেণী’ হিশাবে পরিগঠিত হয়েছে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণী তাই পাশ্চাত্যে নেতৃত্ব দিতে পেরেছে। সামন্ত শ্রেণীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে তারা পুরানা রাষ্ট্র বহাল রাখে নি, পুরানা রাষ্ট্র এবং ক্ষমতার রূপ তারা আমূল বদলিয়ে দিয়েছে। গণতন্ত্র তাই ক্ষমতার রূপ নির্ণয়ের প্রশ্ন। ক্ষমতার রূপ বদলিয়ে আগে তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করেছে। তারপর সেই রাষ্ট্রের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে।

মূল কথা হচ্ছে ঐতিহাসিক ভাবে হাজির হওয়া ব্যক্তি চেতনার উপলব্ধি ও শক্তিকে রাজনৈতিক রূপ দেবার প্রক্রিয়া আমাদের ঘনিষ্ঠ ভাবে বোঝা দরকার। ঠিক যে পাশ্চাত্যে সেই সময়ের সামন্ত সম্পর্ক এবং সামন্ত শ্রেণীকে সশস্ত্র ভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেই ‘গণতন্ত্র’ কায়েম হয়েছে। কিন্তু ‘জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়’ কোন বায়বীয় ব্যাপার না। সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কবিতর্ক যেমন, তার চেয়েও অনেক কংক্রিট ও বাস্তবিক ভাবে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের প্রকাশ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে ঘটেছে। সেই জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করবার পরও শান্তিপূর্ণ সভা সমাবেশ ও বিক্ষোভের অধিকার – অর্থাৎ বাক, ব্যক্তি ও বিবেকের স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা জারি রাখা গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিশাবে স্বীকৃত। সেই ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হলে তা এখনও অনেক ক্ষেত্রে গণঅভ্যূত্থানে রূপ নেয়।

পাশ্চাত্যে শান্তিপূর্ণ ভাবে নয়, সশস্ত্র গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের উৎখাত করে গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে এই সত্য একালের অহিংস, উদারবাদি বা তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি নিরন্তর আমামদের ভুলিয়ে দিতে চায়, গণতন্ত্রের ইতিহাস থেকেীই সত্য মুছে ফেলতে চায় এবং অস্বীকার করে। তাই এই দিক থেকেই – অর্থাৎ সশস্ত্র গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বাংলাদেশে আমাদের ঘনিষ্ঠ ভাবে পাঠ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র কায়েমের প্রধান ঐতিহাসিক নজির হিশাবে পাশ্চাত্যের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এখনও আমাদের সামনে হাজির রয়েছে। গণতন্ত্র তাই কোন শুকনা মতাদর্শ বা বিশ্বাসের ব্যাপার না। গণতন্ত্র সামাজিক-ঐতিহাসিক ভাবে জনগণের আবির্ভাব ত্বরান্বিত করা এবং তাদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার কর্তব্যের সঙ্গে যুক্ত।

যেসব দেশে বুর্জোয়া শ্রেণী পরিগঠিত হয় নি অতএব গণতান্ত্রিক ‘জনগণ’ বাস্তবে হাজির নাই সেইসব দেশে তাহলে কি হবে? বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টীর সেই ক্ষেত্রে কি করা উচিত? এই ক্ষেত্রে বিপ্লবী রাজনীতির ধ্রুপদি প্রস্তাব হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা। ‘শ্রমিক শ্রেণী’ বলতে তাদেরকেই বোঝানো হয় যারা মনে করে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সেই সব দেশের প্রধান কাজ হবে দ্রুত ও ত্বরান্বিত উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটানো। অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি করাই প্রধান কাজ। অর্থাৎ পুরানা অর্থনৈতিক সম্পর্কে জায়গায় গতিশীল অর্থনীতি কায়েমই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই তর্কগুলো নিয়ে বাংলাদেশে বিশেষ আগ্রহ নাই। অথচ ‘জনগণ’-এর আবির্ভাব ত্বরান্বিত করা এবং সমাজের বিকাশ ত্বরান্বিত করতে হলে এই দিকগুলো নিয়ে আলোচনা আরও নিষ্ঠার সঙ্গে করা জরুরি।

তবে পাশ্চাত্য ইতিহাসকে মানুষের সার্বজনীন ইতিহাস ভাবার মুশকিল আছে। আমাদের সামনে বলশেভিক বিপ্লব এবং চিনা বিপ্লবের নজির রয়েছে, যা পাশ্চাত্য বিপ্লবের নজির দ্বারা অনেকাংশেই প্রভাবিত। কিন্তু ইরানি বিপ্লবও রয়েছে। আমরা যেহেতু ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে আলোচনা করছি তাই আলোচনার সুবিধার্থে সেই সবের সঙ্গে তুলনা আমরা পরিহার করছি। কিন্তু তুলনামূলক আলোচনা ছাড়া আমরা পাশ্চাত্য ইতিহাস থেকে কতোটুকু নেব কি নেব না তা নির্ণয় করতে পারব না। তাই সেইসব আলোচনায় আমরা ফিরব অবশ্যই। পাশ্চাত্য ইতিহাসকে মানুষের সার্বজনীন ইতিহাস গণ্য করার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যের বাইরের অন্যান্য মানব সমাজের লড়াই বা অভিজ্ঞতাকে আমরা পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করি এবং সাধারণত তাদের হীন প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকি। পাশ্চাত্যের অনুমান ও ধ্যান ধারণা আশ্রয় করে ঘটে যাওয়া বলশেভিক বা চিনা বিপ্লবকেও আমরা বিচার করি এইসব বিপ্লব কতোটা পাশ্চাত্যের মতো হতে পারল বা পারল না তার দ্বারা। এইসব ঔপ্নিবেশিক হীন্মন্যতা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে ঘটে। ইরানি বিপ্লবের কথা নাহয় আপাতত তুললাম না।

তবে পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা আমাদের যা শেখাতে পারে সেটা হোল বুর্জোয়া সমাজ ব্যাক্তিতান্ত্রিক সমাজ হলেও ‘বুর্জোয়া’ বিচ্ছিন্ন বা একা কোন ‘ব্যক্তি’ হিশাবে নয়, সামষ্টিক ভাবে ‘শ্রেণী’ হিশাবে প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কে রূপান্তর ঘটায়। শ্রেণী হিশাবে বুর্জোয়া সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত হতে পেরেছে। এই সংগঠিত হতে পারাটা পাশ্চাত্যে দর্শন, বুদ্ধিবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়েছে। ‘শ্রেণী’ কথাটা বলার মানে হচ্ছে পুরানা সামন্ত সমাজের প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক বন্ধন থেকে মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে মুক্ত হওয়াটাই যথেষ্ট নয়। পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ ঘটলেই আপ্সে আপ গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটবে তার কোন নিশ্চ্যতা নাই। ঐতিহাসিক ভাবে নিজেকে সকল ‘প্রাকৃতিক বন্ধন’ থেকে মুক্ত হিশাবে হাজির দেখতে পেলেই বুর্জোয়া শ্রেণী আপসে আপ গড়ে ওঠে না। সমাজে চিন্তা ও মতাদর্শিক ভাবে স্বাধীন ব্যক্তিকে ‘শ্রেণী’ হিশাবে পরিগঠনের প্রক্রিয়া সরাসরি দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। দর্শন, সংস্কৃতি ও শিক্ষা ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা অসম্ভব। মানুষ স্বাধী এই স্বাধীনতা বোধের উপলব্ধি চিন্তা ও সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে নিয়া আসাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজটাই যে কোন শ্রেণীর শ্রেণি হিশাবে পরিগঠনের শর্ত। ধনি হলেই কেউ চিন্তাচেতনায় ‘বুর্জোয়া’ হয় না। বরং চরম সামন্ত ও ব্যক্তি স্বাধীনতা বিরোধী হতে পারে। শ্রেণী হিশাবে পরিগঠিত হতে পেরেছে বলেই সশস্ত্র ভাবে বূর্জোয়া শ্রেণী তাদের প্রতিপক্ষ সামন্ত শ্রেণীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পাশ্চাত্যে সক্ষম হয়েছিল। স্বাধীন ব্যক্তি হিশাবে সচেতনতা এই ক্ষেত্রে যেমন জরুরি, তেমনি সামষ্টিক ভাবে চিন্তাচেতনা এবং রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে ‘শ্রেণী’ হিশাবে পরিগঠনও সমান জরুরি। সেটা অবশ্যই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির শ্রেণী সচেতন হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ঘটেছে। মোটেও আপসে আপ ঘটে নি।

দ্বিতীয়ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হতে পেরেছে শ্রেণীর আলোকে শত্রুমিত্র নির্ণয় করতে পারার ওপর। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং পাশ্চাত্যে গণতন্ত্র কায়েম ‘জনগণ’-কে গণ আন্দোলন, গণবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে পরিগঠন এবং গণবিরোধী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঘটেছে। শ্রেণী হিশাবে শত্রুমিত্র ভেদ্জ্ঞান গড়ে না উঠলে গণতান্ত্রিক বিপ্লব আদৌ সম্ভব নয়।

একালে গণতন্ত্রের ধারণা গ্রিসের ধারণার সাথে মিলিয়ে পাঠ করে লাভ নাই, গণতন্ত্রকে বুঝতে হবে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রের বিশেষ একটি রূপ বা ধরণ হিশাবে। এই বিপ্লবের কর্তা ‘জনগণ’। কিন্তু ‘জনগণ’ মিস্টেরিয়াস বা রহস্যজনক কোন ধারণা নয়। কোন আলুর বস্তাও নয় যার মধ্যে মানুষ দলা করে ভরা আছে। ‘জনগণ’ মানে জনগণের সেই সচেতন অংশ যারা নিজেদের অবস্থা এবং অতীত ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন – বিশেষত ব্যক্তি ও ব্যক্তির অধিকার সম্বন্ধে যেমন, তেমনি একই সঙ্গে সাধারণ ভাবে ‘মানব’ বা মানবাধিকার সম্পর্কেও সজ্ঞান। এই সচেতনতা এবং সজ্ঞানতার চরিত্র কেমন সেটা বোঝার জন্য সাধারণত ফরাসি বিপ্লবের একটি ঐতিহাসিক দলিলের উল্লেখ করা হয়। সেটা হোল: Declaration of the Rights of Man and of the Citizen বা মানুষ আর নাগরিকদের অধিকার। (ফরাসি ভাষায়, des Droits de l’Homme et du Citoyen)। ব্যক্তি স্বাধীন বা মুক্ত এই অনুমানের ভিত্তিতে মানুষ ও নাগরিক ‘অধিকার’-এর যেসকল দাবি ফরাসি দেশে জনপ্রিয় হয়েছে সেই অধিকার বাস্তবায়নের জন্য পুরানা রাজতান্ত্রিক সামন্ত রাষ্ট্রের জায়গায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে। ‘গণতন্ত্র’ নামক রাষ্ট্রের একটি বিশেষ ধরণ বুর্জোয়া শ্রেণী পাশ্চাত্যে কায়েম করতে পেরেছে এবং তাদের গণতন্ত্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বজনীন রূপ হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করতেও সক্ষম হয়েছে।

‘জনগণ’: গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বর্গ

তাহলে দেখা যাচ্ছে আইন, সংবিধান ও গণতন্ত্র কথাগুলো পরপর বললেও কোনটি আগে কোনটি পরে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাও আমরা বুঝতে পারছি ব্যাপারটি শুধু ‘আইনী’ ব্যাপার নয় এর সঙ্গে সমাজের দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রশ্নও জড়িত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘সংবিধান হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রের ‘সর্বোচ্চ আইন’। বলা হচ্ছে, জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন...” ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে আইন তাহলে দুই প্রকার। একটি হোল সাধারণ ‘আইন’ যার ভিত্তি বা ব্যাখ্যার সূত্র আরেকটি ‘আইন’ দ্বারা নির্ণয় করা হয়। সেই আইনই হচ্ছে ‘সর্বোচ্চ আইন’ বা ‘সংবিধান’ যা অন্য সকল আইনের বৈধতার ভিত্তি। তাহলে আইনের আলোচনা আগে করে কোন লাভ হচ্ছে না, আগে ‘সংবিধান’ বা ‘সর্বোচ্চ আইন’ ব্যাপারটা বুঝতে হবে।

‘সর্বোচ্চ আইন’ বা সংবিধান তাহলে কি? সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেটা হচ্ছে ‘জনগণের অভিপ্রায়ের চরম অভিব্যক্তি’। কিন্তু ‘জনগণের অভিপ্রায়’ কথাটারই বা মানে কী? জনগণের অভিপ্রায়ের চরম অভিব্যক্তি কিভাবে, কোথায় কি রূপে ব্যক্ত হয়? সেটা কি শুধু আইন হিশাবে, নাকি তার প্রকাশের বিশেষ বিশেষ রূপ ও আলাদা ইতিহাসও আছে। আন্দোলন-সংগ্রাম যেমন, তেমনি ধর্ম শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সমাজ মতাদর্শিক তর্কবিতর্ক অবশ্যই জনগণের ইচ্ছা প্রকাশের নানান রূপ ও চর্চার ধরণ। এই সবের মধ্যে ‘জনগণ’ যেভাবে বর্তমান বা হাজির থাকে সেই খানে জনগণকে চেনা এবং তাদের অভিপ্রায়ক বোঝা এবং জানা জরুরি। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজের বিদ্যমান মতাদর্শগুলোর বিচার জনগণের ইচ্ছা বা অভিপ্রায় বোঝার খুবই বাস্তবিক এবং দরকারি জায়গা হলেও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে আমরা সাধারণত রাজনীতির বিপরীতে বা রাজনীতির বাইরের পরিসর বলে গণ্য করি। তাই একজন উকিল বা ব্যারিস্টার ‘সংবিধান’ মুসাবিদা করে দিলেই সেটা জনগণের অভিপ্রায় বলে মেনে দিতে কিম্বা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে আমাদের অসুবিধা হয় না। তাহলে গোড়ার প্রশ্ন কিন্তু আইন, সংবিধান কিম্বা গণতন্ত্রও নয়। সবার আগে যে বর্গট আমাদের পরিচ্ছন্ন করা অতিশয় জরুরি সেটা হচ্ছে ‘জনগণ’ কারা? কিভাবে তারা তাদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেই অভিপ্রায় বোঝার সঠিক পদ্ধতি কি এবং তা বাস্তবায়নেরই সঠিক প্রক্রিয়া কিভাবে আমরা নির্ণয় করব। তথাকথিত আধুনিক গণতন্ত্রের এটাই হচ্ছে আদ্য কথা।

তাহলে শুরুতেই এই দিকটা বোঝা খুবই জরুরি যে ‘জনগণ’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বর্গ। তেমনি ‘জনগণের অভিপ্রায়’ কথাটিও আধুনিক চিন্তা ও রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আইন, সংবিধান ও গণতন্ত্র নিয়ে কোন আলোচনা ‘জনগণ’- নামক বর্গ বাদ দিয়ে করা সম্ভব না। আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণায় তাই ‘We the people’ বা ‘আমরা অমুক দেশের জনগণ’ -- এই ঘোষণাটি দেওয়া হয়। ঘোষণার মধ্য দিয়ে জনগণকে গঠনতন্ত্রে বা গাঠনিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভূক্ত ও ‘বর্তমান’ করে নেওয়া রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

পাশ্চাত্যে ‘জনগণ’ সামন্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে স্বাধীন বা মুক্ত ব্যক্তির চেতনা, ধারণা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। সেই ধারণা নিয়েই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কি ‘জনগণ’ সেভাবে গঠিত হয়েছে? আমরা দীর্ঘকাল বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছি। ঔনিবেশিকতা আমাদের মনোগঠন এবং রাজনীতির ওপর ভূতের মতো বসে আছে। আমাদের সমাজ আর পাশ্চাত্য সমাজ এক না। আমাদের দেশে ‘জনগণ’ কথাটা বুঝতে হলে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস এবং তার বিরুদ্ধে জাত বর্ণ ধর্ম ভাষা পরিচয় নির্বিশেষে সকল জনগণের ইতিহাসকে সামনে আনতে হবে। তেমনি সামনে আনতে হবে কিভাবে ঔপনিবেশিক শাসন মোটা দাগে পরিচয় সর্বস্ব হিন্দু ও মুসলমান ‘জাতি’ হিশাবে আমাদের ভাগ করতে পেরেছে। সর্বোপরি আধুনিক পাশ্চাত্য শুধু গণতন্ত্রের ধারণা আমামদে দেয় নি, একই সঙ্গে জাতিবাদের আলোকে জাতিবাদী রাষ্ট্র গঠন করবার তাগিদ তৈরি করেছে। নৃতত্ত্ব, ধর্ম, ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি যেদিক থেকেই বিচার করি এখানে জাতিবাদ গড়ে উঠেছে ঔপনবেশিকতার ঔরসে, আধুনিক পাশ্চাত্যের অনুকরণে। এদেশের ধর্ম, সমাজ, শাসনব্যবস্থা, ইতিহাস বা ঐতিহ্যের সূত্র ধরে বা সেইসবের আলোকে আমরা মানুষ, সমাজ, নীতিনৈতিকতা, আইন, ক্ষমতা ইত্যাদি বুঝি নি। ইংরেজের ফেলে যাওয়া রাজনৈতিক কাঠামো এবং ঔপনিবেশিক চিন্তাচেতনার আলোকেই বুদ্ধি, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজ গঠনের চেষ্টা হয়েছে। একটা কঠিন ঔপনিবেশিক আস্তরণের তলায় ‘জনগণ’ যেমন চাপা পড়ে গিয়েছে, তেমনি সম্ভাব্য অন্যান্য প্রত্যয়, ধারণা ও বর্গও হারিয়ে গিয়েছে। তাদের তাৎপর্য আমাদের কাছে এখন আর পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতার আবির্ভাব ঘটাতে হলে ইতিহাসের দিকে তাকানো প্রধান কর্তব্য হয়ে পড়েছে। ঐতিহাসিক ভাবে ‘জনগণ’ কিভাবে হাজির থেকেছে , এখন হাজির আছে এবং আগামি দিনে জনগণের পরিগঠন ও উপস্থিতির কি রূপ আমরা ভাবছি এবং বাস্তবে সেই রূপের বাস্তবায়ন কিভাবে হবে -- সেই সকল জিজ্ঞাসার মীমাংসাই আমাদের এখনকার প্রধান কাজ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হয়। ঔপনিবেশিক শিক্ষার উত্তরাধিকার হিশাবে রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী আমরা পেয়েছি । পাশ্চাত্য শিক্ষিত এবং পাশ্চাত্যের অনুকরণকারিদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় হিশাবে আজ অবধি আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিন্তা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের জানা বোঝার কাজটা শুরু করতে পারি। ঔপনিবেশিক শাসনের মারাত্মক ফল হচ্ছে আমরা ভাবতে শিখেছি যে আমাদের নিজেদের চিন্তা ও জগত বোঝাবুঝির কোন ইতিহাস নাই। যদি থাকেও তাকে ইউরোপীয় ইতিহাসের আদলে ভাবতে হবে। সেটা ভাববে পাশ্চাত্য শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণী। বোঝা দরকার, উপনিবেশ আমাদের জন্য স্রেফ রাজনৈতিক পরাধীনতা ছিল না, একই সঙ্গে মানসিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরাধীনতাও ছিল।

এই কথাগুলো অনেকেই বলেছেন এবং বলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখান থেকে বের হবার পথ কি? ঔপ্নিবেশিক ইতিহাসের ভারে চাপা পরে যাওয়া আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ইতিহাস জানা দরকার। শুধু মুঘল বা স্বাধীন সুলতানদের ইতিহাস জানলে সেই ইতিহাস জানা সম্পূর্ণ হবে না। জগণের ইতিহাস জানা চাই। এই কাজ বাদ দিয়ে যদি আমরা বলি, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ...’ – তখন জনগণ একটা বিমূর্ত ধারণা হিশাবে তৈরি হয় এবং একটি বিশেষ শ্রেণীর আধিপত্য ও কর্তৃত্ব কায়েম করবার জন্য ‘জনগণ’ কথাটির ব্যবহারকেই আমাওরা সচল রাখি। ‘আইন, সংবিধান ও গণতন্ত্র আপাত দৃষ্টিতে স্রেফ ক্ষমতা ও প্রশাসনিক চর্চার কাঠামো হলেও আরও বৃহৎ পরিসরে ইতিহাস ও সমাজের গতিশীল ধারাবাহিকতার মধ্যে নতুন করে বোঝাবুঝির দরকার রয়েছে।

আমাদের জন্য কাজটা খুবই কঠিন। কারন বাংলাদেশে আমরা আজও এই সকল প্রাথমিক আলোচনায় প্রবেশ করতে পারি নি। রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা বালখিল্য পর্যায়ের। নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে গঠন তো অনেক দূরের কথা। আমাদের রাষ্ট্রচিন্তা এখনও অতিশয় নিম্ন পর্যায়ের। আমরা কলোনিয়াল আমলে রাষ্ট্র বলতে বৃটিশ শাসন এবং তাদের আইন বুঝেছি। তাই রাষ্ট্র বলতে আমরা এখনও স্রেফ ‘আইন’ বুঝি, আর আইনের সর্বোচ্চ রূপও আমাদের কাছে ঔপনিবেশিক ক্ষমতার মতো স্রেফ বাইরে থেকে আরোপ করা আইন ও শাসন ব্যবস্থা। গণতন্ত্রের যুগে কিভাবে আইন, ক্ষমতা ও রাষ্ট্র জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে যুক্ত সেই সম্বন্ধের বিচার আমরা এখনও শিখি নি। ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো আমাদের শাসকরাও শাসিতদের কলোনিয়াল প্রজা ভাবে এবং সেভাবেই শাসন করে। উপনিবেশ নাই, তো কি হয়েছে? আমরা নিজেরাই নিজেদের ঔপনিবেশিক গোলাম বানিয়েছি। আর আমাদেরই বানানো উপনিবেশে জনগণকে শাসন করবার জন্য বাদামি চামড়ার সাহেবদেরও বানিয়েছি। দারুন কাজ। তাই রাষ্ট্র মানে আমাদের কাছে ‘সর্বোচ্চ আইন’। উকিলি মুসাবিদায় তৈরি ‘সংবিধান’ শাসিতদের শাসনযন্ত্র বা হাতিয়ার মাত্র। আইন, শাসন, শাস্তির বাইরে আমাদের আজও কোন স্বাধীন সমাজ ও রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে ওঠে নি। এই প্রকট অভাবের দিকটা সবার আগে আমাদের বুঝতে হবে।

সংবিধান নিয়ে কিছু কিছু লেখালিখির কারনে সংবিধানের কথা আমরা আজকাল বলি বটে, কিন্তু বড়ো দীর্ঘকাল বাহাত্তরের সংবিধানকে আমরা পবিত্র গ্রন্থ হিশাবে পূজা করে এসেছি। আমরা দেখেছি এরশাদ বিরোধী গণ আন্দোলন প্রায় গণঅভ্যূত্থানে পরিণত হয়েছিল। ‘সংবিধান’ এরপর থেকে একটু-আধটু আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠতে শুরু করে, কিন্তু সেটাও মূলত সংবিধান ও আইন দিয়ে বাঙালি জাতিবাদ বা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ রক্ষার দরকারে। পরবর্তীতে আমরা দেখেছি আদালত কিভাবে ইতিহাস লিখবার দায় নেয়। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান আদালতকে ইতিহাস লিখবার কিম্বা ইতিহাসের সত্য মিথ্যা নির্ণয়ের দায় দেয় নি। কিন্তু বাংলাদেশের আদালত ইতিহাসের সত্য মিথ্যা নির্ধারণের ভূমিকা নেয় এবং নিচ্ছে। ইতিহাসের জিজ্ঞাসা ও গবেষণার বিষয়কে আদালতের বিষয়ে পর্যবসিত করতে পারার ঘটনা বাংলাদেশের সমাজ বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

আইন, সংবিধান ও গণতন্ত্র এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কে সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ঔপনিবেশিক এবং অতিশয় দুর্বল। সাম্রাজ্যবাদের যুগে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগাণ্ডার প্রধান মতাদর্শিক অস্ত্র হিশাবে ‘গণতন্ত্র’ নিরন্তর ব্যবহৃত হবার ফলে গণতন্ত্র আমাদের কাছে রীতিমতো কুসংস্কার এবং নির্বিচার ধর্মের রূপ পরিগ্রহণ করেছে। এই সকল কুসংস্কার, নির্বিচার অনুমান এবং প্রপাগাণ্ডার বাইরে এসে পাশ্চাত্য থেকে শিক্ষণীয় দিক কিভাবে গ্রহণ করব , একই সঙ্গে পাশ্চাত্যের মতাদর্শিক আধিপত্য এবং সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কিভাবে আমরা মোকাবিলা করব সেই বিষয়গুলো নিয়ে দ্রুত ভাবনা জরুরি। নতুন ভাবে ভাবতে হলে আমাদের পাশ্চাত্যের বাইরের সমাজ, সম্পর্ক, নীতি, ক্ষমতা, শাসন ব্যবস্থা, শিক্ষা, সংস্কৃতির ইত্যাদি সংক্রান্ত ধ্যান ধারণা এবং তাদের ইতিহাস জানা জরুরি। দরকার আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও সমাজের মধ্যে যে সকল ধারণা, প্রত্যয় বা চিন্তার বর্গ রয়েছে তাদের প্রতি তাকানো। একালে সেই সকল চিন্তা, প্রত্যয় বা বর্গের নতুন উপযোগিতা নির্ণয়ের কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা আছে কিনা তা বিচার করা। দরকার সবকিছুই নতুন ভাবে পর্যালোচনা। যেন আধুনিক ও সাম্রাজ্যবাদী ধ্যান ধারণা অনুকরণ না করে আমরা আমাদের ভূগোলের জনগণকে নতুন জীবন, জগত ও সমাজ গঠনের পথ দেখাতে পারি। ‘গণতন্ত্র’ নামক মুখস্থ নামচিহ্ন ও অভ্যাস নতুন ভাবে চিন্তা করবার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে রয়েছে, সেই অবস্থা আমাদের আগে কাটিয়ে উঠতে হবে। এই নামচিহ্নটি নিয়ে আমরা আমাদের পরের আলোচনা শুরু করব।

পাশ্চাত্যে উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ (Liberalism) এবং গণতন্ত্র। চরম হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গণতন্ত্র লিবারেলিজমের রাজনৈতিক রূপ ও প্রাতিষ্ঠানিক গঠন। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই হুমকি বস্ফোরিত হয়ে তীব্র ভূ-রাজনোইতিক তর্কবিতর্কের অংশে পরিণত হয়েছে। এর পরিণতি কোথায়গিয়ে ঠেকে এখনও পরিষ্কার নয়। সম্ভবত ইউক্রেন যুদ্ধের পরেইণতির সঙ্গে তা জড়িত হয়ে পড়েছে। লিবারেলজম এবং গণতন্ত্রের ব্যর্থতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তর্ক চলছে। বাংলাদেশে আমাদের জন্যও তা সম্পূর্ণ নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অভিযোগ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লিবারেলিজম এবং গণতন্ত্র ফেরি করে তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে। মূলত এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা কায়েম এবং সেই ব্যবস্থায় নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্য কায়েম রাখাই মার্কিনি উদারবাদ ও গণতন্ত্রের কেচ্ছা জোরেসোরে প্রচারিত হয়। যদি মার্কিন নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই তাহলে লিবারেলিজম এবন গণতন্ত্রের কঠোর পর্যালোচনা জরুরি। এই সকল বর্গের পরিবর্তে উচিত সভ্যতা, ইতিহাস, ধর্ম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষাসহ বিভিন্ন স্থানিক এবং ভূগোল -নির্দিষ্ট চিন্তা, প্রত্যয় ও বর্জ্ঞুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়া। ভূগোল কিভাবে একটি জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব এবং ভু-রাজনৈতিক সত্তা নির্ণয় করে সেই দিকে আমাদের য়ারইও অধিক মনোযোগ দেওয়া উচিত। উচিত নিজ নিজ ভূ-রাজনোইতিক স্বার্থের দিক থেকে সংস্কৃতি, ধর্ম এবং চিন্তার ইতিহাসের সঙ্গে নতুন করে মোকাবিলা । লিবারেলিজম এবং পাশ্চাত্য প্রপাগাণ্ডার কোলাহল থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি হয়ে পড়েছে।

তবে পাশ্চাত্যেরবিশ্বব্যদ্যালয় কেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তি এবং বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে লিবারেলিজম এবং গণতন্ত্রকে সার্বজনীন এবং সকলের অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় একমাত্র আদর্শ হিশাবে যেভাবে হাজির করা হয় এবং সামরিক হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করবার কোশেশ করা হয় তা তীব্র সমালোচনা মুখে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের পর থেকে মাঝে মধ্যে ঝাঁকি খেলেও পুঁজিতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক শান্তি এবং রাজনৈতিক বৈধতার একটা কালপর্ব গিয়েছে। কিন্তু এই শতাব্দির শুরু থেকে সেখানে ক্ষয় ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং কার্যত পশ্চিম ইউরোপের সব দেশেই এক ধরণের গণবিক্ষোভ দৃশ্যমান যাকে জনতুষ্টিবাদ বা জনবাদ বলে অভিহিত করা হয়। গণতন্ত্রের সাথে তথাকথিত জন্তুষ্টিবাদের ফারাক নির্ণয় তাহলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কারন দেখা যাচ্ছে পাশ্চাত্যে উদারনৈতিক রাজনোইতিক অদাদর্শেই ফল হিশাবে যে সকল প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছিল তারা আর আগের মতো কাজ করছে না। নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গণতান্তৃক রাষ্ট্র কায়েম হয়েছিল সেগুলো ভেঙে পড়ছে। নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয় এমন আইন তৈরি হচ্ছে আভিবাসীদের ব্রুদ্ধে বর্ণবাদী ঘৃণা দেখা যাচ্ছে। মানবতা ও নাগরিক অধিকারের যেসকল বাগাড়ম্বর এতোদিন শোনা গিয়েছিল সেইসবের আবেদন মারাত্মক ভাবে কমেছে এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ ও বিভক্তি বেড়েছে।

এটা পরিষ্কার যে দুনিয়ার অনেক দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং গণতান্ত্রিক অনুশীলনগুলো চরম ভাবে ব্যর্থ। একে নিছকই বাস্তবায়নের সমস্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পাশ্চাত্যে তথাকথিত উদার রাজনীতিকে সার্বজনীন আদর্শ এবং গণতন্ত্রকে সফল মনে হলেও সেটা সবসময়ই ঔপনিবেশিক দখলদারি এবং সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠনের ওপর দাঁড়া্নো ছিল। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ, দুই হাজার আট সালে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার সংকট এবং পুঁজির পরিধির দেশগুলোর অস্তিত্বের সংকট, মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রকে টেরিটরিতে পর্যবসিত করে সাম্রাজ্যাদী বিলিবন্টনের অধীনে নিয়া আসা – ইত্যাদি কারণে বোঝা গিয়েছে মতাদর্শ হিশাবে লিবারেলিজম এবং ক্ষমতার বিশেষ রূপ হিশাবে তথাকথিত গণতন্ত্রের আমূল পর্যালোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে। তার আগে একটি বদ্ধমূল অনুমান ও চিন্তার আছর থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি। ছহি ও সার্বজনীন চিন্তা একমাত্র পাশ্চাত্য চিন্তার বলয়েই সম্ভব কিম্বা অন্যান্য জনগোষ্ঠি তাদের সমাজ, নীতি-নৈতিকতা বোধ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিকে যদি নতুন কোন গাঠনিক রূপ দিতে চায়, তবে তা ছহি গণতন্ত্র হবে না -- এই সকল দাবির কোন ভিত্তি নাই। ।

রাজনৈতিক বর্গ হিশাবে গণতন্ত্রের যদি কোন উপযোগিতা থাকে তাহলে সবার আগে দুটো বর্গ পরিচ্ছন্ন ভাবে ভাবা দরকার। ‘জনগণ’ বলতে আমরা আসলে কি বুঝব? এরপর, ‘জনগণের অভিপ্রায়’ নির্ণয় করব কিভাবে? জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের রাজনৈতিক গঠন পাশ্চাত্যের কার্বন কপি হবে এমন কোন কথা নাই।

পরবর্তী কিস্তিগুলোতে আমরা দেখব, আমাদের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই নতুন করে চিন্তা করতে হবে।


 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।