চিন্তা পাঠচক্র কী? এবং তারা কি চায়?


১. আমরা কি চাই?

আমরা মানুষের মহিমা উপলব্ধি করতে চাই, একালে তার তাৎপর্য বিচারের জন্য সজীব ও সক্রিয় চিন্তার ধারা গড়ে  তোলা জরুরি মনে করি, যেন বৈষয়িক জীবন ও জগতের অন্তর্গত মানুষকে তার সামগ্রিক কায়কারবারসহ আমরা বুঝতে পারি। বুঝতে পারি কিভাবে বৈষয়িক জীবন ও জগত মানুষকে এবং বিপরীত দিক থেকে মানুষের চিন্তা বৈষয়িক জীবন ও জগতকে প্রভাবিত ও নির্ণয় করে। এই পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝা ও বিচার একালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার পরও  কোন অতিরিক্ত দিব্য সম্ভাবনা 'মানুষ' নামক জীবের রয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন আমরা তুলি। কারণ এর দ্বারাই মানুষের অনাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগাম আন্দাজ করা সম্ভব এবং সেই অনুযায়ী  বাস্তবোচিত কাজের পরিকল্পনা বা নীতি ও কৌশল আমরা নির্ধারণ করতে পারি। জীবের অতিরিক্ত যে দিব্যসম্ভাবনা মানুষে নিহিত  তাকে বর্তমান করে তোলাই আমার সাধনা।

মানুষ স্রেফ জীব নয়, তাই মানুষের মহিমা পুনরুদ্ধার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রকার বর্ণবাদ, গোত্রবাদ, রক্তবাদ, বংশবাদ, জাতিবাদ, পরিচয়বাদ এবং সর্বোপরি শ্রেণী ও নারী-পুরুষ ভেদের বিরুদ্ধে সক্রিয় বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সংগ্রামকে আমরা নিঃশর্তে সমর্থন করি।

মানুষের মহিমা উপলব্ধির প্রথম তরিকা হচ্ছে মানুষ সমাজ বিচ্ছিন্ন নয়, মানুষ সব সময়ই সামাজিক, সমাজের অন্তর্গত -- এই সত্য সবসময় মনে রাখা। সমাজের বাইরে একা কোন মানুষের জন্ম হয়েছে বা একা একা মানুষ সমাজের বাইরে বড় হয়েছে এমন কোন নজির ইতিহাসে নাই। তাই মানুষ মানেই সামাজিক মানুষ। অতএব সামাজিক মানুষের ইতিহাস – অর্থাৎ তার আর্থ-সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিচার আমাদের কাজের গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু সেই বিচার করতে গিয়ে মানুষকে স্রেফ বস্তুর ইতিহাসে পর্যবসিত করলে বস্তুর অতিরিক্ত যাকে আমরা ‘মানুষ’ বলি তাকে চেনা যাবে না। সেই অতিরিক্তটা কী? -- এই জিজ্ঞাসা আমরা জাগ্রত রাখি।

কিন্তু মানুষের মহিমার কথা বলে আমরা জীব ও বস্তুজগতের ওপর মানুষের একক কতৃত্ব ও ‘অধিকার’ কায়েম করবার কথা বলছি না। আমরা অধিকারবাদী না। 'অধিকার'-এর ধারণা আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনী অর্থে বিশেষ ভাবে দানা বেঁধেছে। যা রাষ্ট্রের দ্বারা বলবৎ যোগ্য। জগত এবং সকল জাগতিক প্রাণ ও প্রাণীর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করা আমাদের লক্ষ্য না। আমরা উল্টাটা করতে এসেছে। মানুষের মহিমা কায়েমের অর্থ হচ্ছে মানুষ যেমন এই বৈষয়িক জগতের অন্তর্গত তেমনি জগতের রক্ষা কর্তাও বটে। মানুষের মহিমার অর্থ হচ্ছে জগতের সুরক্ষা নিশ্চিত করবার ক্ষমতা উপলব্ধি। মানুষ নিজেও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অধীন এবং নশ্বর এই হূঁশ ফিরে পাওয়া। মানুষের মহিমা উপলব্ধি ও কায়েমের অর্থ হচ্ছে সৃষ্টির সুরক্ষা নিশ্চিত করবার দায় ও কর্তব্য উপলব্ধি করা। কারন বাসবে আমরা দেখি মানুষ তার প্রাকৃতিক বা জীব্বৃত্তির বাইরে নিজের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলেও অপরিচিত বা অপরের সঙ্গে মমতার সম্বন্ধে জড়াতে চায়। মানুষের এই পরমার্থিক আকুতির বিকাশকেই আমরা মানুষের মহিমা উপলব্ধি এবং তার বিকাশ হিশাবে বোঝার চেষ্টা করি।

মানুষের মহিমা উপলব্ধি ও বিচার একালে মানুষের সম্ভাবনারও বিচার। তাই মানুষের মহিমা নির্ণয়ের আলোকে অনাগত আগামিকে সজীব ও সক্রিয় চিন্তার চর্চা এবং তৎপরতার মধ্য দিয়ে বর্তমান করে তোলাই চিন্তা পাঠচক্রের কাজ। আমরা মনে করি যদি আমরা মানুষের মহিমার তাৎপর্য বুঝতে পারি, তবে সেই তাৎপর্যের আলোকে আমরা সামাজিক মানুষকেও নতুন ভাবে ভাবতে এবং কল্পনা করতে শিখব এবং সেই ভাবনা ও কল্পনাকে জাগতিক করে তোলার নীতি ও কৌশলও নির্ণয় করতেও সক্ষম হব।

পুঁজির বিশ্বব্যাপী নৈর্ব্যক্তিক বিচলন, স্ফীতি ও পুঞ্জিভবন প্রক্রিয়ার ইতিহাস থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে একালে মানুষ কিভাবে ইতিহাস নির্মাণের কর্তা হতে পারে সেই সম্ভাবনা বিচার করার প্রতি আমরা বিশেষ ভাবে নিষ্ঠ। সেটা আমাদের জন্য খুব সহজ কাজ নয়। কারন আমাদের বাসব সমস্যা অনেক জটিল ও গভীর। আমরা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ থেকে ‘বাংলাদেশ’ হয়েছি। কিন্তু ইসলামাবাদ থেকে ‘স্বাধীন’ হয়ে তক্ষণি আবার দিল্লীর ‘পরাধীন; হয়ে যেতে আ্মাদের এক মূহূর্তও দেরি হোল না ইউরোপে বার্লিন ওয়াল টেঁকে নি, ভেঙে গিয়েছে; দুনিয়া কাঁপানো বলশেভিক বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা টিকল না; কমিউনিস্টদের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেলো; চিন চিনা ধাঁচের সমাজতন্ত্র কায়েম করে বিশ্বে নতুন পরাশক্তি হিশাবে হাজির, আমাদের পাশেই ভারত ইসরাইলের মতো জাতিগত বৈষম্য (apartheid) ভিত্তিক হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হিশাবে গড়ে উঠল। যে বৌদ্ধ ধর্মকে আমরা শান্তির ধর্ম নামে চিনতাম তারা কিভাবে চোখের সামনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালালো, তাদের নিজ বাসভূমি থেকে তাড়িয়ে দিল। আমরা দেখেছি। বাংলাদেশ অবাঙালি ও ক্ষুদ্র জাতি সত্তার অধিকার মেনে নিতে পারে নি। নাগরিক হিশাবে সংখালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় নি। অর্থাৎ আমাদের বাস্তব সমস্যা প্রকট, গভীর ও বিস্তৃত। সেই সবের বাস্তবোচিত সমাধানের ওপর বাংলাদেশের নিজের অস্তিত্ব নির্ভর করে।

আজকাল দাবি করা হয় মানুষ উত্তরাধুনিক অবস্থার (Postmodern Condition) মধ্যে বাস করছে; বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে উত্তরাধুনিকতার যুগ (Postmodern) চলছে; আমরা উপনিবেশোত্তর (Postcolonial Condition) অবস্থায় আছি, ইত্যাদি। যদি সব বাস্তবিক পরিস্থিতি বিচার বিবেচনা করি তাহলে মানুষের মহিমার কথা বলা এবং তা কায়েমের স্বপ্ন দেখানো রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার।

মানুষের সম্ভাবনা – অর্থাৎ কি পারে আর কি পারে না – তা নিয়ে মানুষের ভাবনা দীর্ঘ দিনের। এই জিজ্ঞাসার জবাব শুধু তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্যে নয়। মানুষের জীবন, জীবিকা এবং সকল প্রাণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করার চলমান প্রক্রিয়ার বিরোধিতা এবং দুনিয়ার সম্পদ অল্পকিছু কোম্পানি ও পরিবারের হাস্তে পুঞ্জিভূত হওয়ার প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করার মধ্য দিয়েই মানুষের মহিমা আমরা বুঝতে পারব। তার জন্য পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন, জীবাশ্ম ভিত্তিক আধুনিক সভ্যতা এবং গ্রহীয় বিপর্যয়ের বর্তমান কাল পর্যায় দ্রুত অতিক্রম করে যাওয়া আশু কর্তব্য। সর্বোপরি পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিলয় ঘটিয়ে পুঁজির ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটনোর মধ্য দিয়েই মানুষের মহিমা কায়েমের তাৎপর্য বাস্তব সত্য হিশাবে হাজির হবে।

চিন্তাপাঠচক্র বাংলাদেশে বিপ্লবী গণরাজনৈতিক চিন্তাধারা ও তৎপরতা বিকাশের জন্য কাজ করে। আমরা কোন রাজনৈতিক দল নই বা কোন দলের সাথে যুক্তও নই। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদ,ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা এবং বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপান্তরকে আমরা এখনকার প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য বলে মনে করি। ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারাই তাত্ত্বিক, গণসাংগঠনিক, সাংস্কৃতিক কিম্বা রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করি। আমাদের আশু লক্ষ্য হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তিকে সমাজের সকল স্তরে মোকাবিলা এবং বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটিয়ে জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে নতুন গাঠনিক রূপ দেওয়া। বাংলাদেশ পরিগঠনের নতুন মতাদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক চর্চা গড়ে তোলাই এখন প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য। আমরা বাংলাদেশে আগামিতে সম্ভাব্য সমাজ, গণশক্তি এবং রাষ্ট্রের রূপ কি হতে পারে তা নিয়ে এখন থেকেই ভাবি এবং তাকে বর্তমান করে তোলার জন্য কাজ করি।

আমরা জাতিবাদী নই, মানুষের মহিমা অস্বীকারকারী সকল প্রকার মতাদর্শ ও রাজনীতির আমরা বিরোধী। আপনি যদি নিজেকে বৃহৎ, বিচিত্র মনুষ্য সমাজের একজন গণ্য করেন, নিজেকে দুনিয়ার সজীব ও সক্রিয় প্রাণের উৎসবে শরিক গণ্য করেন এবং মানুষের পক্ষে নতুন এক বিশ্বসমাজ গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন আপনি অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন।

২. মানুষের ‘মহিমা’ কায়েম করতে হবে কেন?

আমরা সাদা চোখে মানুষকে আলাদা ও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন জীবসত্তা হিশাবে দেখি। সাদা চোখে মানুষকে মোটা দাগে একদিকে আর তার বিপরীতে মানুষের বাইরে প্রকৃতি, জগত, ব্রহ্মাণ্ড আছে বলে কল্পনা করি। কিন্তু একটু ভাবলেই আমরা বুঝি মানুষ আলাদা কোন সত্তা নয়, মানুষ  ব্রহ্মাণ্ড, জগত বা প্রকৃতিরই অংশ। এরপর আমরা বুঝি শুধুমাত্র দেখাদিখি ও বোঝাবুখির বিষয় না, সত্য হোল ব্রহ্মাণ্ড, জগত বা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সুনির্দিষ্ট বৈষয়িক সম্পর্ক বা সম্বন্ধ আছে। অবস্থা, অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস ভেদে কিম্বা দেশকালপাত্রভেদে এই সম্বন্ধ নানা ভাবে মানুষের কাছে ধরা দেয়। আমরা তার কিছুটা বুঝি, কিছুটা আমাদের কাছে অজানা থেকে যায়। নতুন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তা নতুন ভাবে ধরা দেয়।

কিন্তু সার কথা হচ্ছে ইতিহাসের যে কোন পর্যায়ে মানুষ নিজের সঙ্গে তার বাইরে হাজির প্রকৃতি, জগৎ বা ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট বৈষয়িক, আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্বন্ধ রচনা ও চর্চার মধ্য দিয়েই জীব ও প্রজাতি হিশাবে টিকে থাকে। এই সম্বন্ধ রচনার প্রকৃতি বা ধরণই বিভিন্ন সমাজ ও সভ্যতার রূপ ও চরিত্র গড়ে তোলে। সেটাও নির্ভর করে নিজের সঙ্গে মানুষের নিজের মহিমা সম্পর্কে ধারণার ওপর, যার ভিত্তিতে বাইরের বিপুল জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধ রচিত হয়। এই বৈষয়িক বা জাগতিক সম্বন্ধ জীব ও প্রজাতি হিশাবে মানুষের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের সম্বন্ধ হিশাবে ভাবুক বা দার্শনিকদের কাছে পরিচিত। সেই সম্বন্ধের পরিবর্তন, বিবর্তন, রূপান্তর বা বিকাশ আছে যা ইতিহাস হিশাবে মানুষের কাছে পরিচিত।

কিন্তু আজ অবধি মানুষ এই ইতিহাস নিজের কিম্বা তার বাইরের প্রকৃতি, জগত বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দায় নিয়ে সচেতন ভাবে রচনা করেনি মানুষ ও মানুষের চিন্তাচেতনা তাই জগতের ক্ষতির কারন হয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক ও গ্রহীয় বিপর্যয়ের গোড়া এখানে নিহিত। মানুষ আজ অবধি নিজেকে প্রকৃতির ‘প্রভু’ ছাড়া এবং বিশ্ব জগত শুধুমাত্র তার ভোগের জন্য হাজির – এই চিন্তার বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি। মানুষের মুখে যাকেই ‘প্রভু’ বলুক, জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধের ধরণ দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায় মানুষ শুধু নিজেকেই প্রকৃতির প্রভু গণ্য করে। বিশ্বজগতকে তার ভোগ কিম্বা ভোগ্য বস্তু উৎপাদনের উপায়ের অধিক কিছু গণ্য করে না। এর ফলে নিজের আমিত্ব বা অহংকার মুক্ত হয়ে মানুষ যে প্রকৃতিরই অংশ এই উপ্লব্ধি মানুষ হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতি তার ভোগের বিষয় নয়, বরং মাতৃগর্ভের মতো তার আবাস, তার আশ্রয় --এই সহজ উপলব্ধি অর্জন অসম্ভব হয়ে ওঠে। যুগে যুগে মানুষের মধ্যে মহাপুরুষরা এই উপলব্ধি ও দায় বোধ করেছেন এবং নিজেকে সহ সৃষ্টির দায় নেবার জন্য মানুষকে নানা ভাবে উজ্জীবিত ও সচেতন করেছেন। আত্মাভিমান এবং অহংকার ত্যাগ করে আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে আশ্রয় ও শান্তির কথা বলেছেন। দেশকালপাত্র ভেদে এবং তাঁদের সময়ের সুনির্দিষ্ট সমস্যার নিরিখে সুপথ দেখাবার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের প্রয়াস একসময় ধর্ম বিপ্লবের এবং নীতি-নৈতিকতার কর্তব্য হয়ে হাজির হয়েছে।

তবে পুঁজির আবির্ভাব এবং শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেই ধর্ম হয়ে উঠেছে। আমরা যে ভোগী মানুষের আবির্ভাব দেখি তার ভিত্তি হচ্ছে জগতের ওপর ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক ভোগদখল ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করবার সম্পর্ক। মানুষ ও মানুষের সঙ্গে জগতের যে ভোগের সম্বন্ধ তৈরি হয়েছে সেই সম্বন্ধেরই নৈর্ব্যাক্তিক আধুনিক রূপের নাম ‘পুঁজি’। ‘পুঁজি’ পুরা গোলককে তার স্ফীতি এবং পুঞ্জিভবনের অধীনস্থ করেছে। কিছুই আর পুঁজির বাইরে নয়। পুঁজিই কার্যত আল্লাহ বা ঈশ্বর হয়ে উঠেছে। পুঁজির বিনাশ ছাড়া মানুষের কোন ধর্ম বা দ্বীন আর সম্ভব না।

অন্যদিকে জীবাশ্ম ভিত্তিক শিল্প সভ্যতা প্রাণ, প্রকৃতি ও জগতের বিনাশ এমনই ত্বরান্বিত করেছে যে আজ পৃথিবী নামক গ্রহ আদৌ টিকে থাকবে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। আধুনিক কালে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে এবং জগতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ নতুন করে উপলব্ধি, নির্ণয় ও রূপান্তরের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয় নি। কারন সেই বিপ্লবের কেন্দ্রেও মানুষকে দুনিয়ার প্রভু হিশাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছাড়া অধিক কিছু ভাববার বা করবার চেষ্টা করে নি।

তাহলে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ নির্ণয়ের দুটো বিশেষ চরিত্রের কারণে মানুষের মধ্যে প্রাণ, আবাস, আশ্রয় ও আত্মসমর্পনের ধারনা বিকশিত হয় নি। প্রথম কারণ জগতের ওপর মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েমের ধারণা এবং এই ধারণার ওপর গড়ে ওঠা পুঁজি, আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্র এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদি। জগতের ওপর মানুষের প্রভুত্বের ধারণাই এ যাবতকাল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে, যা একই সঙ্গে মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্বও কায়েম করেছে। আধুনিক কালে নানান সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটেছে। কিন্তু মানুষ এখনও উপলব্ধি চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তি কিম্বা সাংস্কৃতিক ভাবে এমন কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে নি, যাতে প্রভুত্বের ধারণা বাদ দিয়ে প্রজাতি হিশাবে মানুষ সমগ্র সৃষ্টির দায় নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারে। মানুষ এখনও এমন এক বিশ্ব সমাজ গড়ে তুলবার সম্ভাবনা দেখাতে পারে নি, যেখানে কোন মানুষই অন্য কোন মানুষের প্রভু নয়, বরং সকলে একই প্রজাতির সদস্য। মানুষের সঙ্গে মানুষের বৈচিত্র্য, ভিন্নতা এবং পার্থক্য মধুর। কারন এর দ্বারাই মানুষ বিচিত্রকে সামগ্রিক মাধুর্যসহ চিন্তা পারে। কিন্তু বিচিত্র ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের নানান জনগোষ্ঠি প্রজাতি হিশাবে পরস্পরের সঙ্গে একই বন্ধনে যুক্ত বলে ভাবতে পারার জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক বিকাশ দরকার মানুষ আজও তা অর্জন করতে পারে নি। এক জোড়া মানুষ মানুষী থেকে সকল মানুষেরই আগমন ঘটেছে এই সহজ সত্যের উপলব্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও মানুষ মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে আছে। যে সকল উপলব্ধি – বিশেষত অহংকার ত্যাগ করে আত্মসমর্পনের আনন্দ মানুষকে তার প্রজাতিগত সত্তা সম্পর্কে সচেতন ও সজ্ঞান করে তুলতে পারে এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের বিপুল বৈচিত্র্য, ভিন্নতা এবং পার্থক্য নিয়ে একটি বিশ্বসমাজ গড়ে তোলা যায় -- মানুষের মধ্যে সেই দিব্য প্রণোদনা তৈরি হওয়ার কাজ এখনও পড়ে আছে। বাকি রয়ে গিয়েছে। অথচ এই উপলব্ধি, চেতনা এবং জগতের সঙ্গে নতুন সম্বন্ধ নির্ণয় একমাত্র মানুষের দ্বারাই তৈরি করা সম্ভব। এই নতুন সম্বন্ধ নির্ণয় ছাড়া মানুষের নিজেদের এবং তাদের আবাস এই পৃথিবীর বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

বিশ্ব-ঐতিহাসিক ভাবে আমরা এমন কালপর্বে এসে পৌঁছেছি যাতে দুনিয়ায় মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে পুরা পৃথিবী নামক গ্রহ বিশাল বিপর্যয়ের মুখে। প্রাণের ক্ষয় এবং প্রাণের বিলুপ্তি ঘটছে দ্রুত, প্রজাতির পর প্রজাতি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবী উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের নিজেরই টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দ্রুত দুনিয়া এমন এক অবস্থায় পৌঁছাচ্ছে যখন এই গ্রহে মানুষসহ কোন প্রাণেরই বেঁচে থাকা আর সম্ভব হবে না।

কেন এটা ঘটছে? এক কথায় এর কারণ হচ্ছে জগতের সঙ্গে আমাদের যে সপ্রাণ, সজীব ও দায়িত্বশীল ব্যবহারিক সম্বন্ধ রচনার দরকার ছিল, আমরা তা রচনা করি নি। আমরা মহা বিপর্যয়ের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছি।

তাই আমরা সবার আগে মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে জগতের (বা প্রকৃতি, বা ব্রহ্মাণ্ডের) প্রত্যক্ষ ও বাস্তবিক ব্যবহারিক সম্বন্ধ উপলব্ধি ও পর্যালোচনার ক্ষমতা অর্জন করতে চাই। জগতের সঙ্গে আমাদের বস্তুগত ও ভাবগত উভয় সম্পর্ক বিচার করবার শক্তি অর্জন করাকে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিশাবে গণ্য করি। ‘পাঠচক্র’ সেই ক্ষেত্রে খুবই শক্তিশালী মাধ্যম বলে আমরা গণ্য করি। বাংলাদেশে চিন্তা ও রাজনৈতিক তৎপরতা বিকাশের ইতিহাসে ‘চিন্তা পাঠচক্র’ তাই এখন পরিচিত এবং আমাদের ভূমিকা স্বীকৃত।

চিন্তা পাঠচক্র তাই বুদ্ধিবৃত্তিক বা রাজনৈতিক-দার্শনিক চর্চার শক্তি অর্জনের ওপর জোর দেয়। এই শক্তি অর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদের সঙ্গে জগতের বৈষয়িক ও মতাদর্শিক ব্যবহারিক সম্বন্ধের যে ঐতিহাসিক বিবর্তন ঘটেছে এবং কিভাবে কোথায় এসে আমরা বর্তমান দুর্দশায় পৌঁছেছি তা বুঝতে পারব বলে আমরা মনে করি। যে ব্যবহারিক সম্বন্ধ ও চর্চা অসম, মুনাফাসর্বস্ব, ভোগী এবং প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিধ্বংসী বিশ্ব ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে তাকে মোকাবিলা ও বদলাবার নীতি ও কৌশল নির্ণয়ের শক্তি দ্রুত অর্জন করাই আমাদের লক্ষ্য। বিদ্যমান যে সম্বন্ধ এ যাবতকাল জগতকে নিছকই মানুষের হানাদারি, দখলদারি ও ভোগের বিষয় ও উপায়ে পর্যবসিত করেছে তার উচ্ছেদই একালের প্রধান কর্তব্য -- আমরা তা নিজেরা বুঝতে চাই এবং সকলকে বোঝাতে চাই।

৩. আমাদের এখনকার আশু রাজনৈতিক কর্তব্য

আমরা অনুমানবাদী না, বর্তমান নিয়ে কারবার করি।

অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝি মানুষ নশ্বর হলেও মানুষের ইতিহাস কখনই স্থির, অনড়, শ্বাশ্বত বা চিরস্থায়ী কিছু নয়। ফলে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা এবং জীবাশ্মভিত্তিক ধ্বংসাত্মক সভ্যতা মানুষের নিয়তি নয়। মানবেতিহাস মঞ্চের কোন নাটক নয় যে তার শুরু বা শেষ নশ্বর জীব নির্ণয় করতে সক্ষম। অতএব বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার কালপর্ব মানুষ অবশ্যই অতিক্রম করে যেতে সক্ষম এবং মানুষ তা অবশ্যই অতিক্রম করে যাবে। তার জন্য অবিলম্বে দরকার মানুষের মধ্যে যে অন্তর্নহিত দিব্য সম্ভাবনা সদাসর্বদা বিরাজ করছে তার যত্ন এবং বিকাশ। দরকার মানুষের ভেতর ও বাহির দুই জগতেরই পরিবর্তন ও রূপান্তর। বাইরের জগত এবং ভেতরের জগত যুগপৎ বদলানো ছাড়া আমরা মানুষের দিব্য সম্ভাবনাকে বর্তমান করে তুলতে পারেব না। ভেতর ও বাহির উভয়ের রূপান্তরই কেবল নতুন সম্বন্ধ নির্ণয় এবং মানবেতিহাসের অনাগত দিব্য সম্ভাবনাকে বর্তমান করে তুলতে পারে।

‘মানুষ’ বলতে আমরা দেহসম্পন্ন রক্তমাংসের মানুষ বুঝি। মানুষের মহিমা মানে এই জ্যান্ত বা জীবন্ত মানুষেরই মহিমা ও দিব্য সম্ভাবনা; মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকে বিবর্তিত হয়ে চলেছে এবং ক্রমাগত নতুন নতুন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বিকশিত হচ্ছে। জ্যন্ত বা জীবিত মানুষের বাইরে কিম্বা রক্তমাংসের মানুষের দেহের বাইরে কোন বিমূর্ত,অশরিরী বা বায়বীয় কোন চিন্তা আছে বলে আমরা মনে করি না।মানুষ মানেই চিন্তাশীল দেহ, অথবা দেহসম্পন্ন চিন্তা। চিন্তা দেহধারী। তাই দেহ ও চিন্তা – অর্থাৎ বস্তুজগত ও ভাবুকতার জগতকে আমরা আলাদা গণ্য করি না। ভাবের জগত মানুষের সঙ্গে জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার ভাবগত রূপ। ভাবের ঘরেই আগামি সম্ভাব্য জগতের রূপকল্পনা হাজির হয় এবং মানুষ ইতিহাসে তার বাস্তবায়ন ঘটাতে পারে।

আমরা মনে করি ‘পুঁজি’, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ও পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করার সামর্থ অর্জন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার আশু কর্তব্য। মানবেতিহাসের পুঁজিতান্ত্রিক কালপর্ব দ্রুত অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল নির্ণয়ই এখনকার প্রধান কাজ হওয়া জরুরি। মানুষের ইতিহাস মানে পুঁজি বাঁ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার ইতিহাস নয়, পুঁজির বিলয়ের মধ্য দিয়েই মানুষের ইতিহাস শুরু হতে পারে।

পাশাপাশি দরকার বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের নির্মোহ পর্যালোচনা এবং বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের নির্বিচার পূজার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা। বুদ্ধি মানুষের একমাত্র বৃত্তি নয়।একালে মানুষের বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে নির্বিচারে বুদ্ধির সর্দারি মেনে নেওয়া। বিজ্ঞান ও টেকনলজির নির্বিচার পূজা। বুদ্ধির অবশ্যই দরকার, কিন্তু বুদ্ধির বাইরে এবং বুদ্ধির বিপরীতে মানুষের নীতি-নৈতিকতা বোধ, স্বপ্ন, কল্পনা, প্রেম, ভালবাসা, অপরের প্রতি টান ও আকর্ষণ এবং অপরকে আপন করে নেবার বৃত্তি অস্বীকার নতুন সমাজ গড়ে তোলার প্রধান প্রতিবন্ধক। বুদ্ধির বিপরীতে হৃদয়বৃত্তিসহ মানুষের অপরাপর বৃত্তির বিকাশ প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষকে শুধু বুদ্ধিমান কিম্বা যুক্তি, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলে উন্নত হলে চলে না, দরকার সকল বৃত্তির বিকাশ, হৃদয়বান হবার সাধনা, স্বাধীন মানুষের উপযোগী নীতি-নৈতিকতার চর্চা ও জীবনযাপন, ইত্যাদি।

মানুষ বুদ্ধির ব্যবহার করে, কিন্তু বুদ্ধির সর্দারি মানুষের অন্যসকল বৃত্তির বিকাশের প্রতিবন্ধক। মানুষের দিব্য সম্ভাবনার অর্থ মানুষের সকল বৃত্তির সুষম বিকাশ এবং জাগতিক বাস্তবতা আমলে নিয়ে সকল বৃত্তির সুষম ও বাস্তবোচিত ব্যবহার। মানুষই নতুন বা অনাগত জীবন, সমাজ বা জগতের কল্পনা করতে পারে এবং তা অর্জনের জন্য সংকল্প, অর্থাৎ অকাতরে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে করতে পারে। মানুষ সুন্দর।

অতএব মানুষের পক্ষেই মানুষ-কেন্দ্রিক এবং পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ও সম্পর্কের বিলয় ঘটিয়ে নতুন ভাবে জগতের নির্মাণ সম্ভব যেখানে সকল প্রাণের আবাস, বৈচিত্র্য, গভীরতা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতার বিস্তৃতি প্রকৃতিকে নতুন ভাবে বিন্যস্ত করতে পারে। মানুষই জগতকে নতুন ভাবে গড়তে পারে।

আমরা 'মতবাদী'না। আমরা কোন চিন্তাকে আস্তিকতা/নাস্তিকতা,প্রগতি/প্রতিক্রিয়াশীলতা, আধুনিক/অনাধুনিক ইত্যাদি আগাম নির্ধারিত বাইনারি দিয়ে বিচার করি না। বৈষয়িক বা ইহলৌকিক সমস্যার ব্যাখ্যা বা সমাধানের ক্ষেত্রে যে কোন চিন্তার উপযোগিতা কিম্বা সম্ভাব্য ভূমিকা বাস্তবোচিত ভাবে বিচার এবং তার সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিণতিই আমাদের কাছে বিচার্য।

কোন ‘মতবাদ’কেই আমরা চিরন্তন ও চিরায়ত গণ্য করি না, হোক তা সেকুলার কিম্বা ধর্মীয়। সজীব ও সক্রিয় চিন্তার পর্যালোচনা ছাড়া কোন কিছুই আমরা নির্বিচারে গ্রহণ করি না। সক্রিয় ও সজীব চিন্তার মধ্য দিয়েই যুগে যুগে বিশেষ বিশেষ বাস্তবতায় ইতিহাসের কর্তা তৈরি হয় এবং সমাজে সংস্কৃতিতে ইতিহাসে রাজনীতিতে সেই চিন্তা বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করে।

এক কথায় মতাদর্শ ও চিন্তার পর্যালোচনাকে বিদ্যমান অবস্থা বদলাবার বিপ্লবী গণরাজনৈতিক ধারা হিশাবে গড়ে তুলতে চিন্তা পাঠচক্র বিশেষ ভাবে আগ্রহী। যেন মানুষের বৈষয়িক জীবনের সঙ্গে চিন্তা বা মতাদর্শের ব্যবহারিক সম্বন্ধ আমরা বুঝতে পারি এবং বিদ্যমান বাস্তবতা বদলাবার বাস্তবোচিত নীতি ও কৌশল নির্ণয় করতে পারি।

আমরা কল্পনার ইতিবাচক ভূমিকা স্বীকার করি কিন্তু মাথায় কোন ইউটোপিয়ান বা অসাধ্য কল্পনার বোঝা বহন করি না। কিন্তু মনে করি কল্পনা,বিস্ময়বোধ,আবেগ,ইচ্ছা,বাসনা, অভিপ্রায় ইত্যাদি মানুষের সহজাত বৃত্তি,সেই সকল বৃত্তির বিকাশ আমরা চাই,যেন বর্তমানের চেয়েও আরও সুন্দর জগত আমরা গড়তে পারি।

এক কথায় ‘অনুমান’ নয়,বরং সবসময়ই ‘বর্তমান'নিয়েই আমাদের কারবার। বর্তমানে হাজির থাকাই আমাদের সাধনা। আমরা বর্তমানে বাস করি,অতীত দিয়ে বর্তমান বুঝি এবং বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যৎ আবিষ্কার করি।

আমরা হাওয়াই মানবতাবাদ,ব্যক্তিবাদ,বিমূর্ত নীতিবাগীশতায় আস্থা রাখি না। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি পুঁজি যেভাবে মানুষকে তার দাসে পরিণত করেছে এবং টেকনলজি মানুষকে যেভাবে স্রেফ যন্ত্রের নাটবল্টুতে পরিণত করে রেখেছে,সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মানুষের মহিমা পুনরুদ্ধারই মানবেতিহাসের বর্তমান কালে সবার আগে দরকার।

আমরা ভালগার বা ইতরোচিত বস্তুবাদের বিরোধিতা করি এবং মানুষের আত্মিক, সামাজিক ও সামষ্টিক বিকাশের জন্য, ধর্ম, দ্বীন, নীতি, নৈতিকতা, সংস্কৃতি, বা এককথায় রুহানি বিকাশ বা রুহানিয়াতের চর্চার কথা বলি। মানুষের মহিমা উপলব্ধির জন্য আমরা ধর্মের ইহলৌকিক মর্মোদ্ধারকে জরুরি রাজনৈতিক-মতাদর্শিক কাজ বলে মনে করি।

৪. পুঁজি বনাম দ্বীন ও ধর্ম

আল্লা এবং দ্বীন কিম্বা ঈশ্বর এবং ধর্ম মানুষের ইহলৌকিক জীবন থেকে বহিষ্কৃত, পুঁজি সার্বভৌম ক্ষমতার আসনে আসীন।

পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে মানুষ স্রেফ পুঁজির দাস; পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বাইরে তার কোন স্বাধীন মানবিক বা রুহানি জীবন নাই বা থাকা অসম্ভব। এই অভাবকে আমরা বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক সভ্যতার প্রধান সংকট গণ্য করি। রুহানিয়াতের চর্চা মানে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের বিরুদ্ধে মানব জাতির ঐক্যবদ্ধ সামষ্টিক রুহানিয়াতের আবির্ভাবের জন্য চর্চা।

পুঁজির দাসত্ব মানে ইহলোকে পুঁজিকেই মানুষের একচ্ছত্র প্রভু হিশাবে মেনে নেওয়া। পুঁজি মানুষের ইচ্ছা, কামনা, বাসনা, সংকল্প, কল্পনা ইত্যাদির সকল বৃত্তির সার্বভৌম নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে। অতএব পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে মানুষের মহিমা প্রতিষ্ঠা কিম্বা ধর্ম বা দ্বীন কায়েম করার অর্থ মানুষকে পুঁজির দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া। এর অন্যথা হতে পারে না। অতএব আমরা মনে করি এই কালে পুঁজির দ্বারা নির্ধারিত জীবনের বাইরে কোন ধর্ম,দ্বীন, আদর্শ বা নীতি-নৈতিকতার চর্চা মোটেও সম্ভব না যদি না তা একই সঙ্গে পুঁজি,পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক এবং বর্তমান অসম বিশ্বব্যবস্থা এবং তার স্থানীয় অভিপ্রকাশের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই থেকে বিরত থাকে এবং বিনা প্রতিবাদে পুঁজির দাসত্ব মেনে নেয়।

ভোগী বৈষয়িক জীবন এবং পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা্র মধ্যে আল্লাহ, ভগবান, বা গড যে নামেই ডাকি মানুষের জীবনে তার কোন ইহলৌকিক তাৎপর্য আর অবশিষ্ট নাই। ফলে সকল রিলিজিয়ন, ধর্ম বা দ্বীন ইহলৌকিক তাৎপর্য হারিয়ে অনিবার্য ভাবেই অন্তঃসারশূন্য পারলৌকিক বিশ্বাস ও ব্যবসায় পর্যবসিত হয়েছে। মানুষের ইলোকিক জীবন ও বাস্তবতা থেকে নির্বাসিত হয়ে পারলৌকিকতায় পর্যবসিত ধর্ম বা দ্বীনের পক্ষে মানুষের আত্মিক উৎকর্ষ চর্চা এবং ইতিহাসের অভিমুখ বদলে দেবার কর্তাসত্তা নির্মানের ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখা সম্ভব না।

৫. গণরাজনৈতিক ধারা ও চিন্তা পাঠচক্র

চিন্তা পাঠচক্র কোন প্রকার বদ্ধমূল বা মতবাদী ধ্যানরণার দাস নয়। আমাদের কাজ সজীব ও সক্রিয় গণরাজনৈতিক চিন্তা এবং তার আলোকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা বিকাশের জন্য কাজ করা। গণরাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা বলতে বোঝায় পুঁজির শক্তির বিরুদ্ধে গণশক্তি নির্মানের সুনির্দিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংগঠনিক তৎপরতা এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা সকল প্রকার পরিচয়বাদ, ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা মোকাবিলা ও রূপান্তর। বৈশ্বিক দ্বন্দ্বের স্থানীয় চরিত্র শনাক্ত করা এবং স্থানীয় দ্বন্দ্বের সঙ্গে বৈশ্বিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন করা বাংলাদেশে আমাদের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে।

মানুষের অপার সম্ভাবনা এবং মহিমা বাস্তবায়নের জন্য মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বিদ্যমান হানাদারি, আধিপত্যকামী, ভোগী ও আগ্রাসী সম্পর্কের উচ্ছেদ ও বিলয় ঘটানোর জন্য জীবনের সর্বস্তরে আমাদের কাজ করতে হবে। এই হানাদারি ও ধ্বংসাত্মক সম্পর্কের চূড়ান্ত দৃশ্যমান ও বাস্তব কয়েকটি রূপ আমরা সহজেই ধরতে ও বুঝতে পারি। বোঝার সুবিধার জন্য কয়েকটি নজির দিচ্ছি:

পুঁজির ক্রমাগত এবং অনন্ত আত্মস্ফীতি, পুঞ্জিভবন এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের মধ্য দিয়ে অসম পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা কায়েম এবং অল্পকিছু ব্যক্তি ও বহুজাতিক কর্পোরেশানের হাতে দুনিয়ার সকল সম্পত্তির কেন্দ্রীভবন। কিন্তু ‘পুঁজি’ সম্পর্কে বাংলাদেশে ধারণা খুবই দুর্বল। মতাদর্শ হিশাবে ‘পুজিবাদ’ আর ‘পুঁজি’ এক নয়। ‘পুঁজিবাদ’ বলতে আমরা সাধারণত সমাজতন্ত বা সমাজবাদের বিপরীতে বাজার ব্যবস্থা ও মুনাফা কামাবার অধিকার এবং ধনি শ্রেণী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থা বুঝি। কিন্তু ‘পুঁজি’ এমন এক সামাজিক সম্পর্ক যা আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু আমরা সকলেই নৈর্ব্যক্তিক এবং সার্বভৌম শক্তি হিশাবে পুঁজির দাসত্ব করি। আমাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, কামনা বাসনাও পুঁজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশে তাই ‘পুঁজি’ বোঝা গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষত তেল, গ্যাস, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে তাদের স্রেফ ভূখণ্ড বা টেরিটরিতে পর্যবসিত করা এবং শক্তিশালী পাশ্চাত্য দেশগুলোর মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা সম্পন্ন করা। অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালপর্বে সাম্রাজ্যবাদের সুনির্দিষ্ট রূপ শনাক্ত করা এবং তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঠিক নীতি ও কৌশল নির্ণয় জরুরি কাজ।

ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল হত্যাযজ্ঞ – অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিমেষে হত্যা করবার টেকনলজি আবিষ্কার ও যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ, যুদ্ধ ব্যবসা এবং ক্রমাগত যুদ্ধ বাঁধানো। যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন নিষিদ্ধ না করে ‘শান্তি, শান্তি’ বলে চেঁচিয়ে যাওয়া।

জীবাশ্মভিত্তিক (Fossil fuel) নগরায়ন ও সভ্যতা, প্রকৃতির জীবনী শক্তি নাশ এবং প্রাণ, প্রাণবৈচিত্র এবং কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস করাকে আধুনিকতা ও প্রগতি গণ্য করা।

নারী এবং নারীদেহকে পুরুষের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তি গণ্য করা; নারীর শরীরকে পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফার ক্ষেত্রে পর্যবসিত করা; মানুষের সঙ্গে মানুষের গভীর ও নিবিড় প্রেমের ভিত্তিতে পারিবারিক সম্বন্ধ ও প্রেমের বন্ধন দৃঢ় করার প্রাকৃতিক আকুতি ও সংস্কৃতির চর্চা না করে বিপরীতে বুর্জোয়া ব্যক্তিতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে সত্য ও শ্বাশ্বত জ্ঞান করা। প্রজনন বা প্রজাতি পু্নরুৎপাদনের গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য নারী ও পরিবারকে সমাজের কেন্দ্রে না রেখে পরিবারকে পুঁজির জন্য সস্তায় শ্রমশক্তি উৎপাদনের কারখানায় পরিণত করা।

তাহলে সজীব ও সক্রিয় গণরাজনৈতিক চিন্তা এবং তৎপরতা বলতে বোঝায় মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সকল প্রকার হানাদারি ও দখলদারি সম্পর্কের উৎখাত এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ এমন ভিত্তির ওপর দাঁড় করা্নো যাতে এই জগৎ সকল প্রাণের আবাস হয়ে ওঠে। প্রাণের স্ফুর্তি এবং আনন্দ নিশ্চিত করা সম্ভব এই বিশ্বাস আন্তরিক ও দৃঢ় হয় এবং তার জন্য আমরা বাস্তবোচিত পরিকল্পনা ও কাজের কৌশল নির্ণয় করতে পারি।

আমরা মনে করি আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং ক্ষমতাবহির্ভূত হবার কারণে দলিত বা নিম্ন বর্ণের মানুষ, গরিব কৃষক, শ্রমিক, নানান পেশায় নিয়োজিত মেহনতজীবী জনগণ, বিভিন্ন নিপীড়িত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা জনগোষ্ঠি এবং পুরুষতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামী নারী সমাজ বিপ্লবী গণরাজনৈতিক ধারার আবেদন ও মর্ম সহজে উপলব্ধি করবেন। বলা বাহুল্য তাদের বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্তাসত্তার বিকাশ ত্বরান্বিত করাকেই আমরা আমাদের প্রধান কাজের ক্ষেত্র গণ্য করি। তাদের ডাকে আমরা সদাসর্বদাই সাড়া দিতে তৈরি থাকি।

৬. অবিলম্বে দরকার:

(ক) জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিপরীতে গণশক্তিতে রূপ দেবার কাজে নিষ্ঠ থাকা।

বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত এক দিকে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এবং তাদের বিপরীতে রয়েছে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত শ্রেণী, গোষ্ঠি, বিভিন্ন ব্যাংকের মালিক, আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ী, টেন্ডারবাজ, ভূমিদস্যু, স্থানীয় টাউট, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতাবান শ্রেণী, নানান কিসিমের লুটেরা ও মাফিয়া গোষ্ঠি এবং সর্বোপরি কয়েকটি চিহ্নিত গণমাধ্যম। শত্রুমিত্রের এই বিভাজন বাদ দিয়ে যারা দলীয় ভাবে জনগণকে বিভক্ত করতে চায়, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা বিরোধী জনগণের চেতনা ও ঐক্য বিনষ্ট করতে যারা তৎপর, ধর্ম ও সেকুলারিজমের কুঠার দিয়ে যেসকল ধর্মবাদী ও সেকুলার গোষ্ঠি এখনও জনগণকে দ্বিখণ্ডিত রেখে রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করতে চায় -- তাদের চিহ্নিত করা এবং জনগণের শত্রু হিশাবে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গণশক্তির বিকাশ বাংলাদেশে ঘটবে এবং ঘটতে বাধ্য। গণশক্তি তৈরির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের উপযোগী সঠিক গণরাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপ স্পষ্ট হবে। সেই রূপ অন্বেষণ ও কায়েমই আমরা আমাদের আশু লক্ষ্য গণ্য করি। সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই আমরা বিভিন্ন জরুরি বিষয় নিয়ে পাঠ, আলোচনা ও পর্যালোচনার আয়োজন করে থাকি।

(খ) গণবিচ্ছিন্ন, বিমূর্ত এবং পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর রোমান্টিক আবেগ, মতবাদী অন্ধত্ব, এবং অপরিণামদর্শী চিন্তাচেতনা থেকে মুক্ত থাকা এই সময় অত্যন্ত জরুরি। সেই জন্য কংক্রিট গণআন্দোলন ও গণসংগ্রাম এবং লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট দাবিদাওয়া জনগণ যেভাবে তোলে, ব্যক্ত করে এবং রণধ্বণি দেয় -- সেই সকল দাবিদাওয়ার মধ্যে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের মর্ম বোঝা সবার আগে জরুরি। বিভিন্ন লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হওয়া দাবিদাওয়ার মধ্যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা শনাক্ত করতে পারা এবং প্রচারের ব্যবস্থা করা এখনকার সবচেয়ে জরুরি ও দরকারি কাজ। নিরর্থক ও অপ্রাসঙ্গিক তর্ক বিতর্ক পরিহারের এটাই সঠিক ও পরীক্ষিত পথ।

(গ ) বদ্ধমূল প্রাচীন চিন্তার বোঝা আমরা নিরর্থক বয়ে বেড়াতে চাই না। আমাদের কাজ পর্যালোচনামূলক চিন্তার বিকাশের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক কর্তার আবির্ভাব ঘটবার শর্ত তৈরি করা। সেই জন্য জীর্ণ ও নিস্ফল রাজনৈতিক ধ্যানধারণা ও বর্গ পরিহার করে সারকথা সহজ ভাবে বলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

যেমন, সমাজে ব্যক্তির পরিপূর্ণ আবির্ভাব এবং বিকাশ নিশ্চিত করবার উপযুক্ত আদর্শ ও ব্যবস্থার কথা না বলে অন্তঃসারশূন্য শব্দ ‘গণতন্ত্র’ প্রচার এবং অনর্থক বাগাড়ম্বর বাংলাদেশকে গভীর খাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

আরেকটি অন্তঃসারশূন্য ধারণা হচ্ছে ‘নির্বাচন’। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় প্রভাবশালী শক্তির সন্ত্রাস ও লাঠিয়ালগিরির বাইরে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নাই। নদী, নালা, খাল, বিল সবই স্থানীয় সন্ত্রাসীরা দখল করে নিয়েছে। প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপন্ন। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অর্থ হচ্ছে একজন ব্যক্তির হাতে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা ও পুরা শাসন ব্যবস্থা তুলে দেওয়া। অথচ ‘আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়’ – বাংলাদেশের সংবিধানের ‘রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিশাবে এখনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিশাবে ১১ নম্বর অনুচ্ছেদ রয়ে গিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে”। তাহলে জাতীয় নির্বাচন দ্বারা একনায়কী ব্যক্তির শাসন ও ক্ষমতা কায়েম নয়, নির্বাচন হতে হবে ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে’। আর এর দ্বারাই ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ““প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত” করা গেলেই বাংলাদেশ নিজেকে ‘গণতন্ত্র’ বলে দাবি করতে পারবে। কারন সেখানে, “মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে”, ইত্যাদি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়াকে ‘নির্বাচন’ ও ‘গণতন্ত্র’ বলা চরম তামাশাই বটে।

(ঘ) ব্যক্তির মধ্যে সমাজ এবং সমাজের মধ্যেই ব্যক্তির বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। অতএব সমাজ বা রাষ্ট্রের নামে ব্যক্তির দমন-নিপীড়ন সমাজ বিকাশের জন্য যেমন ভয়ংকর, ঠিক তেমনি ব্যাক্তি স্বাধীনতা বা ব্যক্তিতান্ত্রিকতার নামে সমাজকে ব্যক্তির বিপরীতে দাঁড় করানো বাংলাদেশের জনগণের সামষ্টিক স্বার্থের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। ব্যক্তি ও সমষ্টি বা ব্যক্তি ও সমাজের এই পারস্পরিকতার আলোকে পাশ্চাত্য ‘লিবারেলিজম’ বা সমাজের বিপরীতে ব্যক্তিকে খাড়া করবার নানান কিসিমের আদর্শ আমরা নাকচ করি। এর বিপরীতে রয়েছে সমষ্টির স্বার্থের নামে ব্যক্তিকে বিলোপ করবার নানান মতাদর্শ। সমাজতন্ত্রের দাবিদার অনেক রাষ্ট্রে এটা ঘটেছে । উদাহরণ হিশাবে বলা যায় সামষ্টিক স্বার্থের প্রভূত ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও ব্যক্তির বিকাশ দমন করবার যে নজির আমরা চিন এবং ইরানে দেখি, তার প্রতি আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। চিনে উইঘুরে দমনপীড়ন বাংলাদেশের জনগণের জন্য অস্বস্তির, বিশেষত চিন এখন পরাশক্তি এবং এশিয়ায় চিনের প্রভাব উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে।

ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব মীমাংসার এই দুই প্রকার প্রবণতা ও পরিণতি সতর্ক ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়াকে আমরা জরুরি মনে করি। এই দুই প্রকার রাজনীতি মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জনগণের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ পাশ্চাত্য ‘লিবারেলিজম’ আমাদের কঠোর ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। যার মানে সমাজের সামষ্টিক নীতি, নৈতিকতা, ধর্ম, আচার, সংস্কৃতির প্রশ্ন বাদ দিয়ে এবং সামষ্টিক স্বার্থের উর্ধে ব্যক্তিকে ‘সার্বভৌম সত্তা’ হিশাবে দাবিকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভাবে মোকাবিলা করা জরিরি। ‘লিবারেলিজম’ মার্কিন ও ন্যাটো নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা্র মতাদর্শ। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় লিবারেলিজম দুর্বল বাংলাদেশের প্রধান মতাদর্শিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি সামষ্টিক স্বার্থের ব্যঘাত না ঘটিয়ে ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশ কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটাই বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারা ও সংস্কৃতির প্রধান ব্যাবহারিক প্রশ্ন। বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থা এবং ভুরাজনৈতিক বাস্তবতা আমলে নিয়ে একদিকে লিবারেলিজমের নানান বয়ানের পর্যালোচনা এবং বাংলাদেশের জন্য বাস্তবোচিত রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল প্রণয়ন অতিশয় জরুরি এন্যদিকে সমষ্টির স্বার্থের নামে ব্যাক্কে দমন এবং ব্যাক্তির বিকাশ রুদ্ধ করা এই দুই প্রকার বিপদ পরিহার করাকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।

(ঙ) পরাশক্তি হিশাবে চিনের উত্থানের ফলে বাংলাদেশে আমরা নতুন বিশ্ববাস্তবতার মুখোমুখি। মার্কিন ও ন্যাটো জোটভূক্ত পাশ্চাত্য দেশগুলো যে এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা কায়েম করে রেখেছে তার বিরুদ্ধে চিন-রুশ জোট ঐক্যবদ্ধ। ভারত দোদুল্যমান। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ পরিষ্কার। ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে, তার প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি অনুধাবন জরুরি। এ সবের ফলাফল এখনও অনিশ্চিত। কিন্তু আঞ্চলিক ও বিশ্ব ব্যবস্থায় রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশের জনগণের শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার বিচার অতিশয় জরুরি। কোন মতাদর্শই বাস্তবতা থেকে মুক্ত ও বিচ্ছিন্ন স্বাধীন সত্য নয়। অতএব ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে বিভিন্ন মতাদর্শ – বিশেষত ‘গণতন্ত্র’, ‘নির্বাচন’ এবং লিবারেলিজম/নিউ লিবারেলিজম ইত্যাদির কঠোর ভাবে পর্যালোচনা করা যেমন জরুরি, তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য থেকে নতুন রাজনীতির ভাষা ও বয়ান তৈরিও সমান জরুরি। সঠিক রাজনীতি ও কৌশল নির্ণয়ের জন্য সঠিক ভাষা, প্রত্যয়, বর্গ ও বয়ান নির্মাণই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।

(চ) পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের ফলে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে অনেক আগেই। তথাকথিত ‘উইপন অব মাস ডিস্ট্রাকশান’ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’, ‘হিউমেনিটারিয়ান ইন্টারভেনশান’ বা বিভিন্ন ছুতায় দুর্বল দেশ আক্রমণ করা , লুন্ঠন করা ইত্যাদির দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে ওয়েস্টফিলিয়ান চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের যে সার্বভৌমত্ব কাগজে কলমে একদা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল তা এখন বায়বীয় ও অর্থহীন। সবচেয়ে সৎ ব্যক্তিকে নির্বাচিত করলেও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শৃংখল থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে পারবে না, তেমনি বিভিন্ন শক্তিশালী দেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, আগ্রাসন ও আধিপত্য থেকেও সহজে মুক্ত হতে পারবে না। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখা এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা আমলে নিয়ে অর্থনীতির দ্রুত ও ত্বরান্বিত বিকাশের নীতি ও কৌশল প্রণয়নই বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রধান কর্তব্য হিশাবে হাজির হয়েছে।

পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে পুরানা রাষ্ট্র ভাঙ্গছে,ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ব্যবস্থা আরো পোক্ত হচ্ছে,একদিকে রাষ্ট্রের পুরানা সার্বভৌমত্ব আর নাই,কাজ করে না বা ক্ষয় পাচ্ছে,অন্যদিকে দেয়াল, কাঁটাতার, ইমিগ্রেশান আইন,ইত্যাদির বেড়া উঠছে। পণ্য ও পুঁজি যেখানে খুশি যেতে পারে,কিন্তু মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারে না। আমাদের কাজ হচ্ছে নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় বাংলাদেশের বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালভাবে বোঝা এবং একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে টিকে থাকার সঠিক নীতি ও কৌশল দ্রুত নির্ণয় করা।

(ছ) বাংলাদেশে কার্যত কোন শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নাই। বাংলাদেশের অস্তিত্ব কার্যত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাই দ্রুত শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। জাতিবিদ্বেষী (apartheid) হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হিশাবে ভারতের রূপান্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি। একই ভাবে মায়ানমার সেনাবাহিনীর যে হিংস্রতা এবং বৌদ্ধ সাধুদের বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা আমরা রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশ থেকে তাড়ানোর ক্ষেত্রে দেখেছি তাতে পরিষ্কার বাংলাদেশ কার্যত সীমান্তের সকলদিক থকাই শত্রু পরিবেষ্টিত।

বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা মজবুত করতে হলে গণপ্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করা ছাড়াও ভারতে জাতিবিদ্বেষ , হিন্দুত্ববাদ এবং সকল প্রকার ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনগণের সঙ্গে শক্তিশালী মৈত্রী গড়ে তোলা অবিলম্বে জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশকে দুনিয়ার সকল বাংলাভাষী ও বাঙালিদের সাংস্কৃতিক এবং ভাষিক বন্ধনের কেন্দ্র হিশাবে গড়ে তুলতে হবে। এই বন্ধন দৃঢ় করা বাংলাদেশের গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ। আমরা যতো তাড়াতাড়ি এই সত্য উপলব্ধি করতে পারি ততো তাড়াতাড়ি আমরা উপমহাদেশে আমাদের জাতীয় নিরপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারব।

গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সাধারণ নীতি হচ্ছে সৈনিকতা স্রেফ চাকুরি নয়, দেশ ও জনগোষ্ঠির সুরক্ষা। এটা সকলেরই নাগরিক দায়িত্ব। অতএব সকল নাগরিকেরই বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা জরুরি।

দ্বিতীয়ত যুদ্ধবিদ্যাকে টেকনলজির কারসাজি বা যন্ত্র ও টেকনলজিতে পর্যবসিত না করে সৈনিকতার মর্যাদা নীতিনৈতিকতা, প্রশিক্ষণ ও আদর্শের ওপর নির্ভরশীল --এই সত্যের প্রতিষ্ঠা জরুরি। সৈনিকতাকে লুটেরা মাফিয়া গোষ্ঠির সম্পদ পাহারাদারি থেকে মুক্ত করে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং জাতির সামষ্টিক সত্তার পাহারাদার হিশাবে উপযুক্ত সম্মানের স্থানে অধিষ্ঠিত করা দরকার। বাংলাদেশ শক্তিশালী দেশ হিশাবে নিজেকে দ্রুত তৈরি করার এটাই পথ।

সৈনিকতা অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার পেশা। সৈনিকতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা ও সমুন্নত রাখার ওপর জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের টিকে থাকা ও না থাকা নির্ভর করে। সৈনিকতাকে কোন মুনাফাকারী ব্যবসা ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা কিম্বা বাইরের শত্রু মোকাবিলার পরিবর্তে দেশের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার ভ্রান্ত পথ পরিহার করতে হবে।

সর্বোপরি গণপ্রতিরক্ষা বলতে শুধু জাতীয় সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বোঝায় না। পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র, জীবন ও জীবিকার সুরক্ষাসহ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশের জনগণের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষাও বোঝায়।

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।