গণমুখী রাজনৈতিক ধারার নীতি ও কৌশল প্রসঙ্গে


১.

পাকিস্তান আমল থেকেই গণতন্ত্র কায়েমের প্রশ্ন স্রেফ নির্বাচনী প্রশ্ন, অর্থাৎ নির্বাচন করা বা না করা, কার অধীনে নির্বাচন হবে, কিভাবে হবে -- ইত্যাদি তর্কের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও আজ অবধি সেই তর্কের অবসান হয় নি। বাংলাদেশ পুরানা প্রত্নতাত্ত্বিক ভাঙা রেকর্ডের মতো নির্বাচনসর্বস্ব পাকিস্তানী রাজনীতিই করে যাচ্ছে। নির্বাচন আর গণতন্ত্র সমার্থক নয় -- এই অতি প্রাথমিক জ্ঞানটুকু আমরা আজও অর্জন করতে পারি নি।

‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ও রাষ্ট্র ‘গঠন’ করবার ধারণা যে একদমই ভিন্ন ও পৃথক এবং গণতন্ত্র কায়েম যে আসলে সকল শৃংখল থেকে মুক্ত স্বাধীন জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে রাষ্ট্রের রূপ দেওয়া --এই অতি প্রাথমিক ধারণাও আমরা জনগণের কাছে স্পষ্ট করতে পারি নি। গণতন্ত্র বলতে আমরা তাই নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’ করা বুঝি না, শুধুই নির্বাচন বুঝি। নির্বাচনকেই গণতন্ত্র গণ্য করি।

অথচ গণতন্ত্র মানে স্রেফ নির্বাচন নয়।

২.

গণতন্ত্র পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা আধুনিক রাষ্ট্রের একটি বিশেষ রূপ। পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি ও বুঝি যে আগে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। ফরাসি বিপ্লব যেমন। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিজয়ী জনগণ গণতন্ত্র কায়েমের জন্য আগে ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) প্রণয়ন করে। গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করার পর নতুন গঠনতন্ত্রের অধীনে জনগণ সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন করে। নির্বাচনের দ্বারা গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না, কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পর নির্বাচন গণতন্ত্রকে সচল ও সজীব রাখার একটি প্রক্রিয়া। জাতীয় ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রে সংসদীয় গণতন্ত্র (Parliamentary Democracy) ব্যবস্থা থাকলে সেটা হয় সংসদীয় নির্বাচন, আর রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির গণতন্ত্র হলে সেটা হয় রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার কায়েমের নির্বাচন। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জনগণ যেন সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করতে পারে তার জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। গণতন্ত্র কায়েমের পর জনগন যেন তাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে তার জন্য নির্বাচন অবশ্যই  প্রয়োজন। গণতন্ত্র কায়েম থাকলেই নির্বাচন গণতন্ত্র চর্চায় ভূমিকা রাখতে পারে। নির্বাচন সেই ক্ষেত্রে বিদ্যমান গঠনতন্ত্রের অধীনে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া, কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া নয়। অর্থাৎ সরকার নির্বাচন বাঁ সরকার গঠন আর রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে নির্বাচন এক কথা নয়। রাষ্ট্র গঠনের জন্য নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষোয়। তাকে সেই জন্য সেটা রাষ্ট্র গঠন সভার প্রক্রিয়া বা Constituenr Assembly-র নির্বাচন বলা হয়। এই ফারাকগুলো আমামদের পরিষ্কার মনে রাখতে হবে।

বাংলায় Constituenr Assembly –র অনুবাদ করা হয় ‘গণ পরিষদ’। আর Parliament-এর অনুবাদ করা হয় ‘জাতীয় সংসদ। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র গঠনের নির্বাচন আর সরকার গঠনের নির্বাচন এক নয়। এই অনুবাদও শিক্ষণীয় হতে পারত। কিন্তু এই প্রাথমিক ফারাক আমরা এখনও জনগণকে পরিষ্কার ভাবে বোঝাতে পারি নি। তাই যেখানে ফ্যাসিস্ট সংবিধান বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহাল সেখানে নির্বাচন আদতে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থাকে বৈধতা দেওয়া ও দীর্ঘস্থায়ী করার কর্মসূচি। । যে ব্যবস্থার অধীনে লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ জনগণ দমন পীড়ন, আইনবহির্ভহূত হত্যা, গুমসহ নানান বীভৎস মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে, লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ মামলা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন মানে বিদ্যমান অবস্থা ও ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার কর্মসূচির অধিক কিছু না।

রাষ্ট্র যদি পুরানা,প্রাচীন, সামন্তীয় বা আধা-সামন্তীয় চরম অগণতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক ও ক্ষমতা ব্যবস্থা হয়ে থাকে তাহলে নির্বাচন মানে ব্যক্তি ও সমাজের বিকাশের পরিপন্থি পুরানা, নষ্ট, গণবিরোধী চরম জুলুম ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। সেই ক্ষেত্রে নির্বাচন মানে স্বাধীন ব্যাক্তি ও নাগরিক হিশাবে জনগণের মুক্তি তো নয়ই, বরং ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারহীন কঠিন সম্পর্ক ও শৃংখল আরও কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী করা, গণতন্ত্রহীনতাকে বৈধতা দেওয়া । যেখানে সবার আগে গণতন্ত্র কায়েমই প্রধান কাজ সেই ক্ষেত্রে বাংলদেশকে গণতন্ত্র হিশাবে ‘গঠন’ করবার কথা না বলে নির্বাচনের কথা বলার অর্থ ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থাকে বৈধতা দেওয়া। সেই ক্ষেত্রে গণতন্ত্র কায়েমের কথা না বলে নির্বাচনের কথা বলার অর্থ কি দাঁড়ায়?  সামনের দিকে না গিয়ে পেছনের দিকে হাঁটতে থাকা। অতএব নির্বাচনসর্বস্ব তথাকথিত গণতন্ত্রের 'বুলি’ ও 'বকোয়াজি'র বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই গণমুখী রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসূচক দিক। গণতান্ত্রিক রাজনীতির অতি প্রাথমিক অ আ ক খ।

৩.

বাংলাদেশ দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক ইংরেজ এবং তাদের ঔপনিবেশিক আইন ও বিধানাবলী দ্বারা শাসিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে শাসিত হয়েছে সামন্ত ভূস্বামী ও পেটিবুর্জোয়া সেনাবাহিনী-আমলা শ্রেণীর ক্ষমতার দ্বারা। তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েম মানে পুরানা ও প্রাচীন সকল সামন্তীয় সম্পর্ক, ঔপনিবেশিক আইন ও বিধি-বিধানের শৃংখল এবং পশ্চাতপদ পাকিস্তানী সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা চর্চার রূপ ও ধ্যান ধারণা সহ সকল প্রকার আবর্জনা বিজয়ী গণভ্যূত্থানের মাধ্যমে বৈপ্লবিক কায়দায় উৎখাত করা। ব্যক্তির আবির্ভাব, বিকাশ এবং মানবিক ও নাগরিক অধিকার বিরোধী সকল সম্পর্ক,কালাকানুনসহ পুরা জালিম ব্যবস্থা সমূলে উৎখাত করাই বাংলাদেশের জনগণের প্রথম কাজ। কিন্তু সেই কর্তব্য জনগণকে পরিষ্কার ভাষায় বারবার স্মরণ না করিয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীন শাসক ও সুবিধাভোগী শ্রেণী স্রেফ নির্বাচনকেই ‘গণতন্ত্র‘ বলে প্রচার করে। পুরানা ও পশ্চাতপদ সকল সম্পর্ক এবং জালিম ব্যবস্থা নির্বাচনের কথা বলে টিকিয়ে রাখা হয়।

গণতন্ত্রহীন বাংলাদেশে নির্বাচনকে গণতন্ত্র বলা মূলত গণতন্ত্রকে এবং বাংলাদেশের অনাগত আগামি ভবিষ্যৎ নস্যাৎ এবং দীর্ঘস্থায়ী করবার মতাদর্শ, জালিম ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করা ও টিকিয়ে রাখবার কৌশল। অথচ পাকিস্তান আমল থেকেই বালাদেশের জনগণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য লড়ছে। অকাতরে রক্ত দিয়েছে, শাহাদাৎ বরণ করেছে ,কিন্তু গণতন্ত্র কায়েম হয় নি। ইতোমধ্যে গণতন্ত্র কায়েম করবার ব্যর্থতার পরিণতিতে পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটেছে, কিন্তু আমাদের হুঁশ হয় নি। নির্বাচন নিয়ে আমরা বকোয়াজি করেই যাচ্ছি।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েম করার ন্যূনতম মানে হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের যে স্বাধীন চেতনা, ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের জন্ম হয়েছে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে প্রথমে গণশক্তিতে এবং ক্রমে বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপ দেওয়াই এখনকার ঐতিহাসিক কর্তব্য। সোজা কথায় বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ‘গঠন’ করার কাজ আমামদের সামনে হাজির হয়ে গিয়েছে।। কিন্তু নির্বাচনের নামে আজ অবধি ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তানী সামরিক-আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রই টিকিয়ে রাখা হয়েছে। জালিম ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নির্বাচনের নামে দীর্ঘস্থায়ীত্ব দেওয়া হয়েছে। এর দ্রুত অবসান ঘটাতে হলে নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলে হাজির করবার প্রতারণা থেকে মুক্ত হতে হবে।

৪.

‘গণতন্ত্র‘ একটি পাশ্চাত্য ধারণা। ধারণা হিশাবে গণতন্ত্র নিয়ে দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে শিক্ষণীয় তর্ক বিতর্ক আছে। গণতন্ত্রের সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিস্তর পর্যালোচনা আছে। প্লাটোর সময় থেকে গণতন্ত্র আদৌ রাষ্ট্রের আদর্শ রূপ হতে পারে কিনা তা নিয়ে তর্ক বিতর্কও জারি রয়েছে। খ্রিস্টিয় গির্জার আদলে দুনিয়ায় সার্বভৌমত্বের দাবিদার সমাজ বিচ্ছিন্ন পরজীবী ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান হিশাবে যে সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, সেই সমাজ বিচ্ছিন্ন পরজীবী প্রতিষ্ঠানকে ইসলামও সবসময় সন্দেহের চোখে দেখেছে। তাই আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্র কায়েম ইসলামের লক্ষ্য নয়, বরং ইসলাম শুধু আল্লার সৃষ্টি সকল প্রাণ ও প্রাণীর প্রতি ইনসাফ নিশ্চিত করা যায় এমন একটি বিশ্বসমাজ (উম্মাহ) কায়েমের কথা বলে। মানুষ সেই সৃষ্টির সেরা, কারণ সৃষ্টির সুরক্ষার দায় একমাত্র মানুষই বহন করতে সক্ষম। কারন মানুষ আল্লার খলিফা, বা প্রতিবিধি। এমন একটি সমাজের স্বপ্ন ইসলাম দেখায় যেখানে আল্লার খলিফা বা প্রতিনিধি হিশাবে আল্লার সৃষ্ট জগত সুরক্ষার দায় সামাজিক মানুষ পালন করতে সক্ষম। এমন এক বিশ্বসমাজ মানুষের পক্ষে কায়েম করা সম্ভব যেখানে মানুষের জীবন ও জীবিকার সমস্যা থাকবে না; প্রকৃতির বিনাশ, পরিবেশ বা জলবায়ু বিপর্যয় ঘটাবার মতো চরম আত্মঘাতী সমাজের আবির্ভাবও অসম্ভব হয়ে উঠবে। শুধু ইসলাম নয়, প্রকৃতির সঙ্গে আন্তরিক সম্বন্ধ বজায় রেখে আত্মিক বা পরমার্থিক বিকাশের সমৃদ্ধ ধারণা এই দেশের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যেও হাজির রয়েছে। এই সকল বিষয়ে আমাদের সমাজে আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্ক একদমই শূন্যের কোঠায়।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের অর্থ তাহলে ঔপনিবেশিক চিন্তাচেতনা ও ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত হওয়া। পরাধীন থাকা বাঁ শাসিত হওয়া নয়, বরং নিজেরাই নিজেদের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার হিম্মত অর্জন। কেবল তখনই সমগ্র মানুব জাতি ও সৃষ্টির কল্যাণ এবং মানুষের আত্মিক বিকাশের কথা ভাবতে পারার সামর্থ আমরা অর্জন করব। গণতন্ত্র মানে ঔপনিবেশিক শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদ আমাদের স্বাধীন চিন্তার বিকাশকে যেভাবে রুদ্ধ করে রেখেছে, সেই রুদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের স্বাধীন সত্তা উপলব্ধই করা এবং উপলব্ধই করতে শেখা, হীনমন্যতা কাটিয়ে ওঠা,  পাশ্চাত্যের প্রতি দাসত্বের মনোভাব ত্যাগ করা।

তাহলে গণতন্ত্রকে যদি আমরা বাংলাদেশে অর্থবহ করতে চাই তাহলে সবার আগে দরকার মানবেতিহাসের কর্তার ভূমিকায় নিজেদের উন্নীত করবার আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত তৈয়ার করা। বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েমের অর্থ হচ্ছে সবার আগে চিন্তা চেতনার দিক থেকে ঔপনিবেশিক মন মানসিকতা থেকে মুক্তি, পাশ্চাত্যের আধিপত্য ও আগ্রাসন মোকাবিলার হিম্মত অর্জন, সর্বোপরি নিজেদের ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নাড়ীর বন্ধন শক্ত করা। সেটা সম্ভব যদি সবকিছু নির্বিচারে মেনে না নিয়ে বিদ্যমান সবকিছু পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সমাজ নির্মাণ এবং শাসন ব্যবস্থার উন্নত রূপ অন্বেষণ আমরা জোরদার করতে পারি।

৫.

তবে ঐতিহাসিক ভাবে – বিশেষত ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দেখা যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘গঠন’ (Constitute) মানে বিজয়ী গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে অতীতের সকল সামন্তীয়, আধা সামন্তীয় এবং গণতন্ত্র বিরোধী আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাচীন ক্ষমতার সম্পর্ক সমূলে উৎখাত এবং বিজয়ী জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী নতুন ভাবে রাষ্ট্র ‘গঠন’, যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীন ‘ব্যক্তি’-র আবির্ভাবের স্বীকৃতি এবং ঐতিহাসিক ভাবে হাজির ব্যক্তির বিকাশের জন্য ক্ষমতা ও শাসন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ নতুন বিন্যাস বা নবরূপে গঠন। অথচ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর পঞ্চাশ বছরের অধিক কাল পেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু আজও স্বাধীন ব্যক্তির বিকাশ নিশ্চিত করাই গণতন্ত্রের কাজ -- এই সরল সূত্র আমরা বুঝতেই পারলাম না। ব্যক্তির বিকাশের বিরোধী সকল প্রাচীন ও পশ্চাতপদ সম্পর্ক থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি নি, ফলে সেই সকল সম্পর্ক উৎখাত করে সামাজিক ব্যক্তির মুক্তি বা বিকাশও আমরা নিশ্চিত করতে পারি নি। মুক্তি বা স্বাধীনতার তাৎপর্য আমরা বুঝি না, তাই নিজেদের বিকাশের জন্য কি ধরণের ‘রাষ্ট্র’ গঠন জরুরী সেটা আমাদের কাছে আদৌ কোন আলাপের বিষয়ই না।

রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর পঞ্চাশ বছরেও আমাদের কোন হুঁশ হয় নি। পঞ্চাশ বছরেও আমাদের কোন শিক্ষা হয় নি। নির্বাচনের নামে আমরা ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেছি। তারপরও গণতন্ত্র কায়েম করা বা বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশাবে ‘গঠন’ করবার কথা না বলে ‘নির্বাচন’ ‘নির্বাচন’ বলে চিৎকার করে যাচ্ছি। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ফারাক বোঝার ন্যূনতম জ্ঞানের ছিঁটেফোঁটা আমাদের মধ্যে আবিষ্কার করা অসম্ভব হয়ে রয়েছে। তারপরও জনগণের মধ্যে আমরা সম্প্রতি নতুন সাড়া, উদ্দীপনা ও আশার আভাস দেখছি। এই সাড়া, উদ্দীপনা ও আশাকে রাজনৈতিক ভাবে পূর্ণ রূপ দিতে হবে। যদি এবার বাংলাদেশকে জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিকে রাজনৈতিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হই তাহলে আগের মতো আমরা আগামি পঞ্চাশ বছর দুঃসহ বিপর্যয় ও দুর্দশার মধ্যে ক্রমাগত খাবি খেতে থাকব।

৬.

শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের জন্য ইয়াহিয়া খানের নির্দেশিত বিধান ‘লিগাল ফ্রেইম ওয়ার্ক অর্ডার ১৯৭০’ (LFO) মেনে এল এফ ও-র অধীনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ণের জন্য নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিপুল জয় লাভ করেও পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করতে পারেন নি। গণতন্ত্র দূরের কথা, নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনই বসাতে পারেন নি। সেই নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম প্রত্যক্ষ নির্বাচন। সেই প্রত্যক্ষ নির্বাচন এবং তার রাজনৈতিক পরিণতি হোল ভয়াল ২৫/২৬ মার্চের অপারেশান সার্চ লাইট, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ এবং পরিণতিতে পাকিস্তানের দুই টুকরা হয়ে যাওয়া। আমাদের জন্য পাকিস্তানের ব্যর্থতা মানে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অভ্যূদয়। এই হোল সত্তরের নির্বাচনের পরিণতি। এরপরও সমাজ, রাজনীতি ও ক্ষমতার পুনর্গঠনের কঠিন কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব এই দুরভিসন্ধি আমরা ক্রমাগত ফেরি করে চলেছি।

শেখ মুজিবর রহমানের ট্রাজেডি হোল মার্কিন পরাশক্তির পছন্দের পাত্র হওয়া সত্ত্বেও ভোটে জিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া দূরে থাক জাতীয় পরিষদেও তিনি বসতে পারেন নি। ফল হয়েছে এই যে পাকিস্তান ভেঙেছে এবং দিল্লির অধীন ভূখণ্ড হিশাবে বাংলাদেশ ‘স্বাধীন’ হয়েছে। পরাধীন বাংলাদেশ দিল্লীর আগ্রাসন, আধিপত্য, সীমান্ত হত্যা, লুটতরাজ ও অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনার শিকার হয়ে এখনও ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে।

লিগাল ফ্রেইম ওয়ার্ক অর্ডার ১৯৭০-এর অধীনে সত্তরের সুষ্ঠু নির্বাচন হবার পরেও পাকিস্তানে গণতন্ত্র কায়েম করা গেল না কেন? এর কারণ বোঝা সহজ। ইউরোপে আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্র উৎখাত করে জনগণের বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে। সেটা ঘটেছে সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ নির্বাচন করে গণতন্ত্র কায়েম হয় নি। সাতচল্লিশে যখন দেশ ভাগ হয়েছিল তখন সেটা উপনিবেশ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিক পরিণতি হিশাবে ঘটে নি। সেটা ঘটেছে ঔপনিবেশিক ইংরেজের তত্ত্বাবধানে। আপোষের মধ্য দিয়ে। এর ফলে ইংরেজের তৈরি আইনী ও শাসন ব্যবস্থার কাঠামো পুরাপুরি আমাদের দেশে বহাল থ্বেকে যায়। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে সকল প্রশাসনিক এবং আইনী সম্পর্কগুলো সমূলে উৎখাত করার কথা ছিল, সেইসব উৎখাত করা যায় নি। আমরা শুধু ঔপনিবেশিক চিন্তাচেতনা ও শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি বহাল রাখি নি একই সঙ্গে কলোনিয়াল আইন, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামোসহ বিবিধ ঔপনিবেশিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রেখেছি। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাথমিক শর্ত আমরা কার্যকর করিনি। সে সম্পর্কে আমামদের দ্যান্ধারনাও ছিল অস্পষ্ট। প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক এবং ঔপনিবেশিক আইন ও প্রশাসনিক কাঠামো  উৎখাত না করার জের আমাদের আজও বহন করতে হচ্ছে। 

গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন সত্তা সেই সত্তাকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়াই গণতন্ত্রের কাজ।  মুক্ত ও স্বাধীন জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে রাষ্ট্র হিশাবে রূপ দেওয়া যারা বিশ্বাস করে না সেই সামন্ত শ্রেণীসহ সকল প্রাচীন ও পশ্চাতপদ শ্রেণীকে পরাস্ত করে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যক্তি স্বাধীন ও মুক্ত এই সত্য রাজনৈতিক ভাবে কায়েম করে।  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাজ শুধু স্বাধীন ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করা নয়, স্বাধীন ও মুক্ত মানুষের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে সমাজ,অর্থনীতি,সংস্কৃতিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করা।

স্বাধীন ব্যক্তির অধিকার ও বিকাশ নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নতুন ধরণের রাষ্ট্র গঠনকেই ‘গণতন্ত্র’ বলা হয়। সেটা রাষ্ট্রের ‘সংস্কার’ বা ‘মেরামত’ নয়, সেটা রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে ‘গঠন’ (Constitute) করা। পাশ্চাত্য ইতিহাস থেকে আমাদের যে শিক্ষা নেবার কথা ছিল, সেটা আমরা গ্রহণ করি নি। আমরা নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বানিয়েছি এবং বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেছি। স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াইকে সহজ না করে আমরা আরও কঠিন করে তুলেছি।

সত্তরের সুষ্ঠু নির্বাচনের পরও গণতন্ত্র দূরে থাক, প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসনের দাবিও বাস্তবায়িত করা যায় নি। পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেল। আমরা দুইটা পাকিস্তান পেলাম, দাবি করলাম রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার কোন বিকাশ ছাড়া ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য আমাদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে স্বাতন্ত্র দান করবে । পাকিস্তানী আমলের পশ্চাতপদ রাজনৈতিক চিন্তা ও ধ্যানধারণাই আমরা বাংলাদেশে বহন করে চলেছি।

গণতন্ত্র কী? কিভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে হয় সে সম্পর্কে রাজনৈতিক সচেতনতা এখনও বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য রকম দুর্বল। আমাদের রাজনৈতিক চিন্তার দুর্বল স্তর ও দূরদর্শিতার অভাব দেখে বিস্মিত হতে হয়। অথচ আমাদের পরে নেপালের জনগণ সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রকে উৎখাত করেছে এবং নিজেদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ‘গঠনতন্ত্র’ গ্রহণ করতে পেরেছে। অথচ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পরও আমরা রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার দিক থেকে মোটেও অগ্রসর হতে পারলাম না। আমরা নেপালের চেয়েও পিছিয়ে পড়েছি। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছুই হতে পারে না।

৭.

শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধের পুরা সময়ই পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। নির্বাচনে জয়ী হয়েও পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ বসে নি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবর রহমান এক অদ্ভূত কাজ করলেন। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য লিগাল ফ্রেইম ওয়ার্ক অর্ডারের অধীনে যে সকল পাকিস্তানি নির্বাচিত হয়েছিল তাদের দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে শাসন করবার জন্য সর্বোচ্চ আইন পাশ করলেন। ব্যারিস্টার কামাল হোসেন ও অন্যান্য উকিলী মুসাবিদা অনুযায়ী একটি শাসনের বিধান বানালেন। একে বলা হোল ‘সংবিধান’।

যেখানে রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি শাসক ও শাসিতের – গণতন্ত্র নয়, সেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে শাসনের জন্য ‘সংবিধান’ বানায় শাসক শ্রেণী। শাসক শ্রেণী জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নয়, জনগণকে স্রেফ শাসন, শাস্তি ও শৃংখলার অধীনস্থ রাখার জন্য ‘সংবিধান’ বা তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ আইন' বানায়। সেই আইন জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের কোন তোয়াক্কা করে না,  ওপর থেকে সংবিধান চাপিয়ে দেয়। এ এক ঐতিহাসিক ট্রাজেডি যে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের জন্য কোন ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করতে পারে নি। ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা সম্পন্ন পাকিস্তনের সংবিধান বানাবার জন্য নির্বাচিতরাই স্বাধীন বাংলাদেশের উকিলি মুসাবিদাকে 'সংবিধান' বানিয়ে পাশ করেছে। রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার দিক থেকে পশ্চাতপদ পাকিস্তানীরাই তাদের নিজদের বানানো আইন বা ‘সর্বোচ্চ বিধান’-কে স্বাধীন বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ বলে চাপিয়ে দিয়েছে।

আইন করে জনগণের ওপর নিজেদের তৈরি সংবিধান চাপিয়ে দেয় কারা? সেটা করে ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণী।ঐতিহাসিক ভাবে বাংলাদেশে সেই কাজ করেছে ইংরেজ ও পাকিস্তানী শাসকেরাই। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকদের মানসিকতা নিয়েই পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ণের জন্য নির্বাচিত ‘পাকিস্তানী’রা নিজেদের স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন সভার সদস্য হিশাবে ঘোষণা দেয়। অথচ নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির রাষ্ট্র গঠনের জন্য নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা (Constituent Assembly) গঠন এবং নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ছিল ঐতিহাসিক দাবি। ইতিহাস নিয়ে ভাবলেই আমরা বুঝব যে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানীরাই – অর্থাৎ রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার দিক থেকে পশ্চাতপদ শ্রেণীটিই বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ লিখেছে।

এই ঐতিহাসিক সত্য আমরা ভুলে গিয়েছি। কিন্তু বারবার মনে করা দরকার বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও স্বাধীন বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ প্রণয়ণের স্বঘোষিত দাবিদাররা ছিল আসলেই ‘পাকিস্তানী’। কারণ তারা ইয়াহিয়া খানের লিগাল ফ্রেইম ওয়ার্ক অর্ডার মেনে পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন জনগণের ভোটে তারা নির্বাচিত হয় নি। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ আর আগের ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ছিল না। ফলে যারা ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র প্রতিনিধি হিশাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণের কোন ঐতিহাসিক কিম্বা আইনী-রাজনৈতিক (Juridico-Political) ন্যায্যতা তাদের ছিল না। পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিতরাই অন্যায় ভাবে বাহাত্তরের সংবিধান জারি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে রূপ দেবার জন্য কোন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা ডাকা হয় নি। তাই তথাকথিত বাহাত্তরের সংবিধানের কোন ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক কিম্বা আইনী ন্যয্যতা নাই।

এটা অতএব পরিষ্কার যে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যত অস্বীকার করে। তাই ঐতিহাসিক এবং আইনী-রাজনৈতিক (Juridico-Political) অর্থে বাহাত্তরের সংবিধান ছিল পাকিস্তানীদের রচিত সংবিধান। তারা পাকিস্তানের জন্য সংবিধান প্রণয়ণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়নের জন্য নয়। তাই Constitution – এর অনুবাদও তারা করেছে ঔপনিবেশিক  ভাষায়: ‘সংবিধান’। অর্থাৎ সংবিধান হচ্ছে তাদের অধীনস্থ শাসিতদের শাসন করবার ‘সর্বোচ্চ’ আইন বা বিধান। বাহাত্তরের সংবিধান গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রকল্প নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন জনগণের গঠনতন্ত্র নয়। অথচ এই পাকিস্তানী ভূত আমাদের ঘাড়ের ওপর পাঁচ দশকের অধিক কাল বসে আছে। এটা বিস্ময়কর। এই ভূত নামাতে হবে।

৮.

স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক ও আন্তর্জাতিক ন্যায্যতার ভিত্তি হচ্ছে দশই এপ্রিলের ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ (proclamation of Independence)। সেখানে পরিষ্কার ঘোষণা ছিল যে বাংলাদেশের জনগণ ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ এবং ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ নিশ্চিত করবার জন্য একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করবার জন্য লড়ছে। এটি কোন দলীয় দাবি ছিল না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে নীতি ও ভিত্তির ওপর বাংলাদেশ যেন শক্ত ভাবে দাঁড়াতে পারে তারই নীতি ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার । বাংলাদেশের জনগণের জন্য এই তিন নীতি নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীনতা লাভের পর পরই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘গঠন’ ছিল ন্যায্য এবং সেটাই ছিল বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক দাবি। এই তিন ঘোষিত নীতি বাস্তবায়নের জন্যই এই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ একতরফা সেই ঘোষণাকে অস্বীকার করে। দিল্লীর নির্দেশ অনুযায়ী বাঙালি জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের নীতি ও ভিত্তি ঘোষণার মধ্য দিয়ে একটি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ হিশাবে তারা ফেরি করতে শুরু করে যা কার্যত উপমহাদেশ থেকে ইসলাম নির্মূল রাজনীতির পরিকল্পনা হিশাবে বাংলাদেশে বাস্তবায়ন শুরু হয়।

বাহাত্তরের সংবিধান অতএব বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে চরম প্রতারণা এবং চরম বিশ্বাসঘাতকতা। এই সংবিধান পরিষ্কার ভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মিশ্রণ ঘটিয়ে চরম জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের দলিল হিশাবে হাজির হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে পেটিবুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট শ্রেণীর মতাদর্শিক আধিপত্য কায়েম রাখতে দীর্ঘকাল সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত ধর্ম নিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজমের নামে পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী দিল্লীর পক্ষে ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি চালিয়ে যায় এবং নিরন্তর দিল্লীর নির্লজ্জ তাঁবেদারের ভূমিকা পালন করে। এই সংবিধানই আবার কখনও বেয়নটের জোরে এবং কখনো আবার জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিভিন্ন গোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৭ বার সংশোধন করা হয়। সংবিধানে ১৪২ অনুচ্ছেদের বরাতে ছেঁড়া ত্যানার মতো সংবিধান যেভাবে কাঁটাছেঁড়া করা হয়েছে তা এক অভূতপূর্ব তামাশা ও লজ্জার ইতিহাস।

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যর্থতা শুধুমাত্র ক্ষমতাসীনদের কিম্বা রাজনৈতিক দলের দোষ ভাবা ঠিক না। একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক ‘গঠন’ সমাজের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের ওপর নির্ভরশীল,যা একই সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং লড়াই সংগ্রামের ফল। সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ আকাশ থেকে তৈরি হয় না। তার সঙ্গে সমাজের চিন্তাচেতনা ও ঐতিহ্যের দীর্ঘ ইতিহাস জড়িত থাকে। ব্যক্তি সমাজের বাইরের কোন সত্তা নয়। তাহলে সমাজের অন্তর্গত সামাজিক ব্যক্তির বিকাশ সমাজের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে জড়িত।

ধর্ম স্রেফ ‘বিশ্বাস’ নয়, বরং সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের অন্তর্গত। ধর্ম ভালমন্দ নীতি-নৈতিকতাবোধের উপলব্ধি তৈরি করে এবং ব্যক্তিকে সামাজিকতার গুরুত্ব শিক্ষা দেয়। আমরা চাই বা না চাই ধর্ম সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। ধর্ম, ধর্মের ঐতিহ্য এবং ধর্মের আভ্যন্তরীণ তর্ক বিতর্ক (discursive tradition) সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের অংশ। যে কারনে ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ধর্মের মর্মোদ্ধার উন্নত চিন্তা ও মনমাসিকতার বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অতএব জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ধর্মতাত্ত্বিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক চর্চা প্রত্যক্ষ ও সরাসরি ভূমিকা রাখে।

তাহলে সমাজের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ নিজেদের শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্ত। নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’-এর সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ অঙ্গাঙ্গী জড়িত।  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের অর্থ একটি সমাজে ব্যক্তির ঐতিহাসিক আবির্ভাব মাত্র নয় বরং ব্যক্তি যে একটি স্বাধীন ও মুক্ত সত্তা এবং সেই সত্তার বিকাশ একমাত্র সমাজের মধ্যেই সম্ভব, সমাজের বাইরে নয় – এই উপলব্ধির বিকাশ ও চর্চার জন্যই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন এবং আরও উন্নত সমাজ গঠনের আবশ্যিক পদক্ষেপ হিশাবে জরুরি। ব্যক্তি স্বাধীন ও মুক্ত সত্তা হিশাবে সমাজের মধ্যেই কিভাব বর্তমান থাকতে পারে এবং থাকা সম্ভব গণতন্ত্র আমাদের সেই উপলব্ধি ও শিক্ষা অর্জনের রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়। রাষ্ট্রের রূপ হিশাবে গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে সমাজের বিকাশ এবং সমাজের বিকাশও যে একমাত্র ব্যক্তির বিকাশের মধ্য দিয়েই ঘটে এই সত্য ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই উপলব্ধি জরুরি। ব্যক্তি ও সমাজের এই পারস্পরিক  নির্ভরশীলতার রাজনৈতিক  উপলব্ধি  ও সচেতনতা অর্জন অতিশয় জরুরি। সেটা শুধু রাজনৈতিক তৎপরতার দ্বারা অর্জন সম্ভব নয়। সমাজের প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গেও ব্যক্তির বিকাশের প্রশ্ন জড়িত। আমরা এখনও শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে গঠনের প্রক্রিয়া হিশাবে ভাবতে শিখি নি। ফলে রাজনোইতিক চিন্তা চেতনার দিক থেকে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি।

তবে বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরির আগ্রহ ও সামাজিক-রাজনোইতিক তর্ককে সামনে নিয়ে আসে বাঁ আসতে পারে।  বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এখন তাই দেখছি। গণমুখি  রাজনৈতিক ধারাগুলোর কাছে এটা পরিষ্কার থাকা দরকার সমাজের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ‘গঠন’ অঙ্গাঙ্গী জড়িত। অথচ রাজনৈতিক ভাবে গড়ে ওঠা এবং নিজেদের রাষ্ট্র হিশাবে ‘গঠন’ করবার  ন্যূনতম বোধ বাংলাদেশে এখনও তৈরি হয়েছি কিনা সন্দেহ। এ নিয়ে তর্ক বিতর্কও অনুপস্থিত। । সমাজে চিন্তাচেতনার স্তর ছাড়াও এই অভাব শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির অবস্থা দেখে আমরা বুঝতে পারি। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের তৎপরতা পর্যালোচনার দ্বারা আমাদের অভাব শনাক্ত  করা কঠিন নয়। ব্যক্তির বিকাশ এবং ব্যক্তিকে সমাজ বিচ্ছিন্ন সত্তা হিশাবে না দেখে সামাজিক সত্তা হিশাবে উপলব্ধি  বা বোধ বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক কিম্বা গণসমাজে এখনও অনুপস্থিত। এই অভাব দ্রুত কাটিয়ে তুলতে হবে।

তাহলে জনগণের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া হঠাৎ আকস্মিক কোন বিস্ফোরণ নয়। তার প্রস্তুতি চলতে থাকে দীর্ঘকাল ব্যাপী। গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কিম্বা রাষ্ট্র কিভাবে গঠিত হয় তাকে ধাপে ধাপে জানা এবং জনগণের ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ণের বাস্তবোচিত পদক্ষেপ কি – সেই সকল নীতি ও কৌশল সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা বাংলাদেশে বিরল। ফলে বাংলাদশের রাজনৈতিক চেতনা এখনও দুর্বল। তাই এটা বোঝা দরকার বাংলাদেশ নতুন ভাবে ‘গঠন’ করতে পারা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্পর্কে জনগণকে সচেতন ও সজ্ঞান করে তোলার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আমাদের এই বাস্তব সত্যের মুখোমুখি করে দেয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের তত্ত্ব ও কলাকৌশল সম্পর্কে আমরা এখনও যারপরনাই অজ্ঞ। এই অজ্ঞতা বিপজ্জনক। বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তব অবস্থা সেই সত্যই আমাদের সামনে বার বার হাজির করে।

চিন্তা পাঠচক্র তাই ‘গঠন’-এর কাজটিকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে জনগণকে সচেতন করবার ক্ষেত্রে যথাসাধ্য ভূমিকা পালন করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রতিটি গণআন্দোলন ও গণসংগ্রাম জনগণকে খুবই দ্রুত শিক্ষা দান করতে পারে। তত্ত্ব যখন বাস্তবের আন্দোলন সংগ্রামকে ধারণ করতে পারে, তখন তা বিপ্লবী গণশক্তিতে পরিণত হয়। তত্ত্ব তখন রাজনৈতিক হাতিয়ার ও অস্ত্র হয়ে ওঠে। তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নতুন করে গঠন করবার তত্ত্ব ও কৌশল জনগণকে জানাবার ও বোঝাবার  প্রকৃষ্ট সময়। সেই তত্ত্ব জনগণ মাঠের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করতে পারলে হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও দ্রুত জনগণের সচেতনতার মাত্রা বেড়ে যায়।

১০.

সাতই নভেম্বর সৈনিক জনতার বিপ্লবী মৈত্রীর ফলাফল হিশাবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা হিশাবে তাঁর অবদান অসামান্য। বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক মূহূর্তে তিনি দেশের হাল ধরেছিলেন। তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর উত্থান ঘটেছে। সেই সময় সদ্য হাজির হওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। তবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা – বিশেষত একটি রাষ্ট্র কিভাবে ঐতিহাসিক এবং আইনী-রাজনৈতিক ভাবে নিজের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে ইত্যাদি গুরুতর বিষয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকট অভাবের মধ্যেই তিনি আকস্মিক হাজির হয়েছিলেন। একজন সৈনিক হিশাবে তিনি সৈনিক-জনতার মৈত্রীর অনিবার্য ফল হিশাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন। সৈনিক জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবী মৈত্রীর ঐতিহাসিক মূহূর্ত বাংলাদেশের রাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।  বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্ট বা সেনাছাউনিতে - এই আওয়ামি-ফ্যাসিস্ট প্রপাগান্ডার অতএব কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই।

কিন্তু আওয়ামি লীগ ক্রমাগত কেন এই প্রপাগান্ডা করে?  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। কেন সেটা করতে হবে?  কারন আওয়ামি লীগ একাই দেশ স্বাধীন করেছে সেই বয়ান প্রতিষ্ঠা করবার জন্য এই প্রপাগান্ডা আওয়ামি লীগের জন্য জরুরী। অতএব জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না,  বিএনপি সেনাছাউনিতে জন্ম নিয়েছে এই সকল অন্তঃসারশূন্য প্রপাগান্ডার কোন মূল্য নাই।  সেনাবাহিনী এবং সৈনিকদের সাধারণ ভাবে হেয় করা এবং  দিল্লীর স্বার্থে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে বর্ডার গার্ডে পর্যবসিত করা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। ফলে বাংলাদেশের জনগণ এবং সৈনিকদের মৈত্রীর রাজনৈতিক প্রতীক হিশাবে জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি  ম্লান করা এবং সৈনিক বা সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক অবদানকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাই আওয়ামি রাজনীতি।

কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবের মধ্যে হাজির হবার কারনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার কথা ভাবেন নি। বা ভাবতে পারেন নি। তাই বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নতুন রাষ্ট্র গঠন সভা (Constituent Assembly) না ডেকে তাঁর অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা আরোহনকে সাংবিধানিক ন্যায্যতা দিয়েছেন। সেটা করতে গিয়ে তিনি সংবিধানের ততোটুকুই রদবদল করেন, যতোটুকু দিয়ে তিনি নিজেকে সাংবিধানিক ভাবে শাসক বা প্রেসিডেন্ট হিশাবে বৈধতা দিতে পারেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত নীতির ভিত্তিতে নতুন ভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ করবার কোন চিন্তা তাঁর ছিল না।

প্রজ্ঞার এই অভাব ও অজ্ঞতা সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিন্তার পশ্চাতপদতা। যেহেতু পেটিবুর্জোয়া শ্রেণী মনে করে নির্বাচনই ক্ষমতার আইনী বৈধতা প্রমাণের একমাত্র উপায়, তাই বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিজেদের ক্ষমতাকে ‘বৈধ’ বলে স্বীকৃতি নিয়ে নিলেই সেটা বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী ‘বৈধ’ হয়ে যায়। জিয়াউর রহমানও এই বিদ্যমান ধারণার অধিক ভাবেন নি। ভাবতে পারেন নি। জেনারেল এরশাদও একই ভাবে তাঁর ক্ষমতারোহনকে ‘বৈধতা’ দিয়েছেন।

কিন্তু সাতই নভেম্বর ছিল কার্যত একটি বিপ্লব এবং বাহাত্তরের পুরানা পাকিস্তানী সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ নতুন ভাবে ‘গঠন’ করবার আরেকটি ঐতিহাসিক সুযোগ বা মূহূর্ত। সেই মূহূর্তটিও আমরা আমাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার অভাবে ইতিহাসের ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। আবার আরেকটি সুযোগ আসন্ন। আমরা কি করতে পারি তা আমাদের নিজেদের ইতিহাস পর্যালোচনা ক্ষমতা এবং প্রজ্ঞার ওপর নির্ভরশীল

ক্ষমতা ও আইনের সম্বন্ধ নিয়ে দার্শনিক ও আইনজ্ঞদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তর্কবিতর্ক আছে। বল প্রয়োগের দ্বারা বিশেষত সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতারোহন আইনের চোখে বৈধ কিনা আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সে বিষয়ে শক্তিশালী ভিন্ন মত রয়েছে। উদাহরণ হিশাবে হান্স কেলসেন (Hans Kelsen)-এর নজির আমরা দিতে পারি। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করাকে আইনের দিক থেকে কেন বৈধ সেই যুক্তি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট হান্স কেলসেনের বরাতে দিয়েছিলেন, সেটা আমরা জানি। রাজনীতি ও আইনের ইতিহাসে ক্ষমতা ও ক্ষমতার আইনী বৈধতার তর্ক পুরানা তর্ক। ফলে সৈনিক ও জনতার বিপ্লবী গণভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা লাভের পরও জিয়াউর রহমান সাতই নভেম্বরের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ধরতে পারেন নি। তাঁর উচিত ছিল দিল্লীর তাঁবেদারির জন্য প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধান এবং তার বাকশালী সংযোজন আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা ডাকা (Constituent Assembly) এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করা।

১১.

বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের আরেকটি সুযোগ এসেছিল এরশাদ বিরোধী গণ অভ্যূত্থানের সময়। কিন্তু সেই সময় গণভ্যূত্থানকে বানচাল করে দিয়ে বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখবার জন্য ‘ত্রি দলীয় জোটের রূপরেখা’ প্রণয়ন করা হয়। সেই সময় আমরা কঠোর ভাবে ত্রিদলীয় জোটের এবং তথাকথিত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর সমালোচনা করেছি। (দেখুন, ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র’)। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ফল হোল পুরানা গণবিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখে এক ব্যক্তির হাত থেকে ক্ষমতা আরেক ব্যক্তির হাতে হস্তান্তর করা। তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষময় ফলের পরিণতি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক দুর্দশার মধ্যে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি।

১২.

বাংলাদেশের জনগণ আবার জেগে উঠেছে। এই জাগরণ কোন বিশেষ দলের প্রতি আনুগত্য বা বিশেষ দলকে ক্ষমতায় বসানোর বাসনা নয়। যদি কেউ জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বুঝতে ভুল করে তবে তাদের স্থান নিশ্চিত ইতিহাসের ডাস্টবিনেই হবে। জনগণ মৌলিক পরিবর্তন চায়, নতুন ভাবে অতীতের সমস্ত আবর্জনা বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন ভাবে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’ করতে চায়।

রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে অর্ধ শতাব্দিরও বেশী সময় আমরা পার করছি। জনগণের দুঃসহ কোন সমস্যারই আমরা সমাধান করতে পারব না, যদি আমরা গোড়ার কর্তব্যে ফিরে না যাই। সেটা হোল মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এবং অর্ধ শতাব্দির দীর্ঘ বঞ্চনা ও তিক্ত অভিজ্ঞতা মোচনের জন্য নিজেদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নতুন ভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ করা। বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা ডাকা এবং জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নই এই সময়ের প্রধান ও একমাত্র দাবি।

১৩.

চিন্তা পাঠচক্র দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠনের কথা বলে আসছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রচিন্তা এখনও দুর্বল ও অবিকশিত, ফলে আমাদের অনেক কিছুই নতুন ভাবে তুলতে হয়েছে, নতুন রূপে হাজির করতে হয়েছে, বিবিধ তর্কে জড়াতে হয়েছে। ফ্যাসিস্ট দমনপীড়ন দীর্ঘস্থায়ী হবার কারনে আমাদের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তারপরও আগের চেয়েও জনগণের সচেতনতা বেড়েছে এবং ইতিবাচক রূপান্তরের কথা এখন অনেকে ভাবতে পারছেন। বাঙালি জাতিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের গণরাজনৈতিক আকাংখাকে আমরা সামনে হাজির করবার চেষ্টা করেছি। আমরা বলেছি, স্বাধীনতার ঘোষণায় গৃহীত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, আইনী বৈধতা এবং রাজনৈতিকতা এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নাই, কারণ সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘গঠন’ করবার জন্যই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। এটা খুবই আশার কথা যে অনেকেই এখন সেটা স্বীকার করেন এবং তাঁদের রাজনৈতিক প্রকল্পের অন্তর্গত মর্ম গণ্য করেন। আজ অনেকেই রাষ্ট্রের সংস্কার এবং নতুন ভাবে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’-এর কথা বলছেন। এ সবই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিবাচক অগ্রগতি। রাজনৈতিক উপলব্ধি ও রূপান্তরের ইতিবাচক সম্ভাবনা আগের চেয়েও অনেক পরিষ্কার হয়ে উঠছে। বিক্ষোভ,আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিশোর, তরুণ ও সাধারণ মানুষ ‘রাষ্ট্র মেরামত’ করবার কথা তুলেছে, যা রাজনৈতিক সচেতনতার দিক থেকে এইসব গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। অনেকেই ‘রাষ্ট্রের সংস্কারে’-এর কথা তুলছেন। অনেক দল এখন সংবিধান ‘সংশোধন’ বা ‘সংস্কারে'র কথা তাদের দলিল পত্রে বলছে। অর্থাৎ সংবিধান সংস্কার হোক বা নতুন ভাবে ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করা হোক, রাষ্ট্রের গাঠনিক প্রশ্ন এখন ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। যা আমরা ইতিবাচক বলে মনে করি।

১৪.

সম্প্রতি দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র ক্ষোভ আমরা লক্ষ্য করছি। এটা পরিষ্কার জনগণ শেখ হাসিনার সরকারকে আর চায় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। সেটা অতীতের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে জনগণ অসম্ভব বলেই মনে করে। গণ আন্দোলন ও গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে সরকার বদল ঘটানোর প্রশ্নে জনমত গড়ে উঠেছে যা বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন।

বিএনপি আওয়ামী লীগের বিপরীতে দ্বিতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল। বিরোধী দল হিশাবে এই দলটিসহ ছোটবড় সকল দলই ব্যাপক ভাবে ফ্যাসিস্ট দমনপীড়ন, গুমখুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। বিরোধী দলের লক্ষ লক্ষ কর্মীদের বিরুদ্ধে ভূয়া মামলা ঝুলছে। ইতোমধ্যে ভু-রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল ঘটেছে।‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ পেছনে ফেলে বিশ্ব এখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য পরাশক্তির দীর্ঘকাল সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। দমন-পীড়নের মুখে আন্দোলন থেকে দূরে থাকা দল বিএনপি সম্প্রতি ব্যাপক ভাবে আন্দোলনে সক্রিয় হচ্ছে। ছোট ছোট দল গুলিও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলছে। রাজনৈতিক ভাবে আমরা পিছিয়ে নাই। জনগণ সক্রিয় ভাবে বিরোধী দলগুলোর ডাকে সাড়া দিচ্ছে।

১৫.

এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য একটি জাতীয় ঐক্যমত গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি সেটা যেন নিছকই সরকার বদল না হয় জনগণ সেই আশ্বাসও পেতে চেয়েছে। বিএনপি অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে এলে তারা ঠিক কি করবে সে ব্যাপারে কোন স্পষ্ট ধারণা বিএনপি দেয় নি। ফলে বিএনপি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিশেষ সমর্থন পায় নি। কিন্তু বিএনপির সাম্প্রতিক আন্দোলন আগের চেয়ে ভিন্ন, বিএনপি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন বিএনপি চায় না, বিএনপি বারবারই জানিয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলন করছে। বলা বাহুল্য,একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও রয়েছে। এই দাবি মেনে নেওয়ার আগে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কোনো সংলাপ বা আলোচনা বিএনপি চায় না। দাবি মেনে নেওয়ার পর সংলাপ বা আলোচনা হতে পারে। ইতোমধ্যে বিএনপির অবস্থানের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না, অতএব ক্ষমতাসীন  সরকারের 'অপসারণ' চায়। এই 'অপসারণ' সাংবিধানিক ভাবে চায়, নাকি গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে সেটা পরিষ্কার নয়। আমরা অনুমান করতে পারি গণ অভ্যূত্থান বিএনপি চাইবে না। বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, ফলে সাংবিধানিক সীমা বিএনপি লংঘন করতে চাইবে না। কিন্তু সেটা প্রধান কারন নয়।  বিএনপি যে শ্রেণীর বা গোষ্ঠির স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে সেই স্বার্থ গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতাচ্যূত করবার কথা ভাববে না। কারন গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটলে বিএনপি যে শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে তা বজায় বা বহাল রাখতে পারবে না,  সেই স্বার্থ নিশ্চিত ভাবে বজায় বা বহাল রাখা মুশকিল হবে। এই ঝুঁকি বিএনপি নেবে কিনা, কিংবা নিলেও কতটুকু নেবে সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। স্বার্থের বিবেচনা বিএনপিকে আন্দোলনের একটা পর্যায়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করবার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।  অনুমান করা সম্ভব যে মাঠের আন্দোলনের মাত্রা গতি এবং বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির অভ্যন্তরে এবং বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে অনিবার্য ভাবেই দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। এই সম্ভাবন আমরা আগাম অনুমান করতে পারি।

ইতোমধ্যে তারেক রহমান জানিয়েছেন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে  আগামী নির্বাচন হলে  নির্বাচনের পরে বিএনপি একা সরকার গঠন করবে না। সরকার পতনের আন্দোলনে যারা সাথে থাকবেন সবাইকে নিয়ে বিএনপি জাতীয় সরকার গঠন করবে। দ্বিতীয়ত দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ইঙ্গিতও তারেক রহমান দিয়েছেন। এর যুক্তি হচ্ছে অনেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগ দেবেন না, কিন্ত তাদের পরামর্শ বিএনপির দরকার। এ জন্য সংসদে উচ্চ কক্ষ সৃষ্টি করা হবে। উচ্চ কক্ষে এসে তারা তাদের মতামত রাখবেন। অর্থাৎ এটা পরিষ্কার বিএনপি বিদ্যমান সংবিধান সংস্কারের কথা জানিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের আগামি রাজনীতির জন্য এই ঘোষণা ও সংবিধান সংস্কারের ইঙ্গিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এতে রাজনৈতিক নেতা হিশাবে তারেক রহমানের গ্রহণযোগ্যতা যেমন বেড়েছে একই সঙ্গে জনগণ বিএনপির ডাকে আগের চেয়ে অধিক সংখ্যায়  সাড়া দিচ্ছে এবং সাড়া দেবে।

প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রের সংস্কার বা নতুন ভাবে বাংলাদেশ গঠনের কোন পরিকল্পিত চিন্তা বা কর্মসূচি আদৌ বিএনপির রয়েছে কিনা? সেই ক্ষেত্রে তার সম্ভাবনা খুবই কম বলে ধরে নেওয়াটাই সঠিক। বিএনপি ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে চায়, কিন্তু বিএনপি বিদ্যমান সংবিধানের নীতিবিধান মেনে চলা একটি বৈধ নিয়মতান্ত্রিক দল। দীর্ঘকাল তারা তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে, জনগণ সাড়া দেয় নি। কিন্তু এখন সরকার অপসারণের ডাক দেওয়ায় বিপুল ভাবে বিএনপির প্রতি জনগণের সমর্থন আমরা দেখছি। প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি যদি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটায় তাহলে তার পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পদক্ষেপ গুলো কি হবে সে বিষয়ে কোন পরিষ্কার ধারণা আমরা পাই না। আগামি ১০ তারিখে ঢাকার সমাবেশে বিএনপির প্রস্তাবের ওপর এখন অনেক কিছুই নির্ভর করছে। তবে মাঠের আন্দোলনের দ্বারা এটা পরিষ্কার জনগণ ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট সরকারকে 'অপসারণ' নয়। উৎখাত করতে চায়। বিএনপিকে এই নতুন রাজনোইতিক বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হবে।

বিএনপি গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে এবং এখনও সংসদে আছে। তা সত্ত্বেও যেহেতু জিয়াউর রহমান সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য লড়েছেন, সে কারণে জিয়াউর রহমানের প্রণীত ১৯ দফায় তার ছাপ রয়েছে। জিয়ার আদর্শে নিষ্ঠ থাকলে সেই আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিএনপি অনায়াসেই দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে। যদি বিএনপি সেই অবস্থান নেয় তাহলে বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তি দ্রুত শক্তিশালী হবে সেটা হবে বাঙালি জাতিবাদী ও আওয়ামি ফ্যাসিস্ট রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া। সেই সম্ভাবনা অসম্ভব না হলেও হয়তো অতি প্রত্যাশা হতে পারে। কারণ বিএনপি নির্বাচন মুখি দল। ধনি ও উঠতি ধনি শ্রেণীর স্বার্থের বাইরে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরিব, শ্রমিক ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষার দল হিশাবে বিএনপি গড়ে ওঠে নি। অতএব বিএনপি তার শ্রেণী বৃত্তের বাইরে কিছু করবে সেই আশা করা বোকামি হবে।

কিন্তু রাজনীতি ছকে বাঁধা এক্কাদোক্কা না। একটা প্রক্রিয়াও বটে। শেখ মুজিবর রহমান ছয় দফা চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায় তাঁর দাবি ছিল না। ইতিহাস তার নিজের গতিতে অনিবার্য সম্ভবনাকে বাস্তবায়িত করে। এর বিপরীতে দাঁড়াবার চেষ্টা ইতিহাসের গতি প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে বাইরে চলে যাওয়া। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামের ওপর বিএনপির নেতৃবৃন্দের কতোটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে ক্ষমতাসীন সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারন, বিভিন্ন দলকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনীবং সুষ্ঠু নির্বাচনের যে দাবি বিএনপি তুলেছে তা বিপুল ভাবে জনগণের সমর্থন পেয়েছে। সেটা মোটেও অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণই জনগণের এখনকার প্রধান দাবি। এই অবস্থান থেকে বিএনপি পিছু হটলে সেটা বিএনপির জন্য আত্মঘাতী হবে – এইটুকু আমরা অনায়াসে অনুমান করতে পারি। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে অস্বচ্ছতা ঙ্গেকটি বিশাল জিজ্ঞাসাচিহ্ন হিশাবে হাজির রয়েছে।

এই আলোকে যেসকল ছোট ছোট দল রাষ্ট্র ‘মেরামত’, রাষ্ট্রের সংস্কার কিম্বা ভূ-রাজনীতি এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের বাস্তবতা মাথায় রেখে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ভাবে নিজেদের ‘গঠন’ করতে চাইছেন এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিজেদের স্থান নতুন করে নির্ণয় করা জরুরি মনে করেন, চলামান আন্দোলনে তাদের সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল কি হতে পারে সে বিষয়ে আমরা কিছু বিষয় এখন আলোচনা করব। অর্থাৎ গণ্মুখি রাজনীতি যারা চর্চা করেন তাদের এখনকার কর্তব্য কি হতে পারে সেই বিষয়েই আমরা আলোকপাত করব।

১৬.

রাজনৈতিক সংকট বা বিপ্লবী পরিস্থিতিতে জনগণ বিপুল ভাবে শেখে এবং অভিজ্ঞতা লাভ করে। বইপড়া বা বুদ্ধিজীবীগিরি দ্বারা যা ২০ বছরেও করা যায় না, আন্দোলনের ভেতরে জনগণের লড়াই সংগ্রামের মধ্যে থেকে জনগণকে তা শেখাতে দুই মাসের বেশী সময় লাগে না। তত্ত্ব বা আমরা কি চাই জাতীয় দলীয় মতাদর্শ এবং রাজনৈতিক প্রচারের দরকার আছে। কিন্তু যখন ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণ সংগঠিত হতে শুরু করে তখন আন্দোলন-সংগ্রামকে আরও ঘনীভূত করা এবং বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ সবচেয়ে বেশী জরুরি।

বিএনপি এখন যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলছে এবং ছোট ছোট দলের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে সংলাপ চালিয়ে যেতে চাইছে, বিএনপির কাছে এটা পরিষ্কার যে ফ্যাসিস্ট শক্তি বিরোধী লড়াইয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা জনগণের কাছে বিএনপির রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির শর্ত। সেই ক্ষেত্রে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল এখন অবধি সঠিক। গণরাজনৈতিক ধারায় বিশ্বাসী ছোট ছোট দল, যারা রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক উপাদান যুক্ত করতে সমর্থ – তাদের উচিত এই বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সফল ভাবে কাজে লাগানো। সেই ক্ষেত্রে গণরাজনৈতিক ধারার ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম কাজ হচ্ছে সবার আগে নীতি এবং কৌশলের ফারাক স্পষ্ট ভাবে বোঝা।

১৭.

অনেক দল সংবিধান সংস্কারের কিম্বা নতুন ভাবে সংবিধান রচনা বা গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের কথা বলছেন। প্রথমত ‘সংবিধান’ শব্দটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভোকেবুলারি থেকে বাদ দিতে হবে। জনগণকে সহজ ভাষায় বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশকে নতুন করে ‘গঠন’ করা দরকার, অতএব জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে সেইরকম একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে কিভাবে গঠন করা যায় সেটাই এখনকার একমাত্র রাজনৈতিক তর্ক।

রাষ্ট্র গঠনের রণনীতি ও রণকৌশলে্র ধ্রুপদি পদক্ষেপগুলোর বিপুল প্রচার এখন জরুরি। সেই কাজ গণরাজনৈতিক ধারার পক্ষে মতাদর্শ নির্মানে নিয়োজিত বুদ্ধিজীবীদের কাজ। এইসকল তর্ক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের তর্ক। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের রণনীতি নির্ণয়ের তর্ক। প্রতিটি দলকে অবশ্যই পরিচ্ছন্ন ভাবে যার যার রণনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার ভাবে হাজির করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে ছোট ছোট দলগুলোর রণনৈতিক তর্ক তোলা এবং প্রচার খুবই ইতিবাচক। সেই প্রচার অবশ্যই বিপুল ভাবে চালাতে হবে।

১৮.

সেই ক্ষেত্রে ‘সংবিধান সংস্কার’ করবে কারা: জাতীয় সংসদ নাকি সংবিধান (সংস্কার) সভা?’ – জাতীয় তর্ক খুবই ভুল ও বিভ্রান্তিকর তর্ক। প্রশ্ন থেকে যায় যদি আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হয় তাহলে বাস্তবে তা কিভাবে ঘটে তার সঙ্গে এই প্রশ্ন জড়িত। যদি ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর – অর্থাৎ এক ব্যক্তির হাত থেকে আরেক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মধ্য দিয়ে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করে তাহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আবারও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পরিণতির অধিক কিছু হবে না। কোন পরিবর্তন হবে না। এটা অনুমান করা কঠিন নয় যে বিএনপির নেতৃত্বের বড় অংশের মনে এই ধরণের মীমাংসার অধিক কোন চিন্তা নাই। শুধু ক্ষমতার হাত বদল হোক এটাই বিএনপির দিক থেকে বর্তমান আন্দোলন সংরামের আদর্শ পরিণতি। কিন্তু আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ, এবং অংশগ্রহণের রূপ ও মাত্রা বুঝিয়ে দিচ্ছে এবার শুধু নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে স্রেফ ক্ষমতার হাত বদলে জনগণকে সন্তুষ্ট করা যাবে না।

তাহলে আন্দোলনের পরিণতি কি দাঁড়াবে তা একান্তই নির্ভর করবে ফ্যাসিস্ট শক্তি বিরোধী আন্দোলনে ছোট ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণের মাত্রা এবং জনগণের ওপর মতাদর্শিক আধিপত্য বিস্তারের সাফল্যের ওপর। মনে রাখতে হবে আন্দোলন-সংগ্রামের সময় একদিকে পরিচ্ছন্ন রণনৈতিক অবস্থান (Strategy) – অর্থাৎ নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শের আলোকে বাংলাদেশে তারা কোন কাজ সম্পন্ন করতে চায় বা কি কর্তব্য সাধন করতে ইচ্ছুক এবং সেটা কেন সম্ভব সেটা পরিষ্কার ভাবে বলা তাদের কাজ। এরপর অবিলম্বে যে বিষয় জনগণকে পরিষ্কার জানানো উচিত সেটা হোল বাংলাদেশে তাদের কর্তব্য নির্ধারণের আলোকে বর্তমান আন্দোলনে তারা কিভাবে, কেমন করে যুক্ত থাকবে এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করবে সেটাও স্পষ্ট ভাবে পেশ করতে হবে। কেবল তখনই তারা বর্তমান আন্দোলন সংগ্রামে তাদের চিন্তা ও তৎপরতার ছাপ ফেলতে পারবে। বর্তমান আন্দোলন-সংগ্রামে নিজ নিজ করণীয় নির্ধারণকে বলা হয় ‘কৌশল’ (Tactics) । অর্থাৎবিএনপির নেতৃত্বে জনগণ ক্ষমতাসীন সরকারকে অপসারণের জন্য মাঠে নেমে এলেও গণমুখী রাজনৈতিক ধারায় সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল জনগণকে কি করা উচিত সেই বিষয়ে সচেতন করবে এবং বর্ত্মান আন্দোলন-সংরাম থেকে কিছু ইতিবাচক ফল লাভের আশা আমরা করতে পারি।

১৯

তাহলে যে কাজের কথা পরিষ্কার ভাবে বলা দরকার সেটা হোল:

ক. যথাসম্ভব বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তিতে যৌথ কিম্বা যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রথম ও প্রধান কাজ; অর্থাৎ এই আন্দোলন একটি বুর্জোয়া দলের নেতৃত্বে হচ্ছে বলে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে অপসারণের আন্দোলন থেকে দূরে থাকা হবে আত্মঘাতী অবস্থান। একাত্তরে বিভিন্ন বাম ধারা এই রকম অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণের প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়েছে। তাদের অবদান এবং আত্মত্যাগ বিরল ইতিহাস, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁরা ফুটনোট হয়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশের গণমুখী রাজনৈতিক ধারা আশা করব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে এবং  ইতিহাসের পূর্বানুবৃত্তি ঘটাবে না। 

খ. আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান ফ্যাসিস্ট শক্তি মোকাবিলা অত্যন্ত জরুরি কারণ এক মূহূর্তের জন্যও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ক্ষমতাসীনরা বেগতিক দেখলে ভয়াবহ সন্ত্রাস ও দমনপীড়িন চালাতে পারে, দরকার তার জন্য প্রস্তুত থাকা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট সরকার বৈধতা হারালেও আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশের গণআন্দোলন ও গণসংগ্রাম চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি লাভ করুক তা চায় না। তারা আরেকটি তাঁবেদার সরকারই চাইবে যেন আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক শোষণের সম্পর্ক বহাল রাখা যায়।

গ. আন্দোলন সংগ্রাম তখনই পরিণতি লাভ করবে যদি তা বিজয়ী গণভ্যূত্থানের রূপ নেয়, এবং ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল ছোটবড় সকল দল নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। আন্দোলন-সংগ্রাম সেই মাত্রা পরিগ্রহণ করলে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল ছোটবড় সকল দল নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন না করলে বিএনপি আওয়ামী লিগ এবং গত কয়েক দশকে গড়ে ওঠা সুবিধাবাদী ও সন্ত্রাসী শক্তিকে মোকাবিলা করতে পারবে না। কারণ জনগণ চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আবার কয়েক দশক বিএনপিকে নতুন করে লুটতরাজের সুবিধা করে দেবে, এটা এবার আশা করা যায় না। এই আন্দোলন বিএনপির নেতৃত্বে ও চরিত্রেও পরিবর্তন আনতে বাধ্য।

ঘ. ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের কাজ বিদ্যমান সংবিধান বহাল রেখে নির্বাচন কিম্বা বিদ্যমান সংবিধানের কোন সংস্কার নয় বরং তাদের প্রথম কাজ অবিলম্বে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ণের কাজ হাতে নেওয়া, শান্তিশৃংখলা ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের বিরুদ্ধে যেন কোন প্রকার ষড়যন্ত্র হতে না পারে তার জন্য পুলিশ, আমলা, সেনাবাহিনীর মধ্যে গণবিরোধীদের শনাক্ত করা এবং গণমুখি চিন্তা প্রশস্ত করা; ব্যাংক ও বাংলাদেশের সম্পদ যে সকল মাফিয়া গ্রুপ, ভূমি দস্যু, ব্যাংক মালিক আত্মসাৎ করেছে তা উদ্ধার করা, জনগণের খাদ্য, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অবিলম্বে স্থানীয় সরকারগুলোর পুনর্গঠন – বিশেষত জনগণ যেন তাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে জাতীয় সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা পায় তা নিশ্চিত করা, ইত্যাদি। বলা বাহুল্য আরও অনেক সুনির্দিষ্ট বিষয়ও এখানে যুক্ত হতে পারে।

২০

বলা বাহুল্য, সফল ও বিজয়ী গণ-অভ্যূত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের বৈধতার ভিত্তি বিদ্যমান সংবিধান হতে পারে না, বরং সফল ও বিজয়ী গণঅভ্যূত্থানের অর্থ বিদ্যমান সংবিধান বাতিল ও কার্যকর হয়ে যাওয়া। সেই ক্ষেত্রে সংবিধান টিকিয়ে রাখার অর্থ হচ্ছে গণ অভ্যূত্থানকে ‘অবৈধ’ প্রমানের ব্যবস্থা রেখে দেওয়া। তা হবে রীতিমতো মারাত্মক এবং আত্মঘাতী। জনগণের অভ্যূত্থানই অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের ভিত্তি ও বৈধতা। জাতীয় সরকারের কাজ তখন নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ণের প্রক্রিয়া শুরু করা এবং অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা বহাল রাখবার জন্য নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ অবধি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জরুরি সাময়িক আইন ও বিধিবিধান জারি করা, ইত্যাদি। আমরা চাইলে এ বিষয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনা করতে পারি। কিন্তু রণনীতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যে কথাটা পরিষ্কার ভাবে বলা দরকার সেটা হোল বর্তমান আন্দোলন-সংগ্রামের লক্ষ্য:

(ক) সফল ও বিজয়ী গণ অভ্যূত্থান ও অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন,

(খ) গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা (Constituent Assembly) আহ্বান এবং জনগণের অংশ গ্রহণের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ’গঠন’ (Constitution) করা

(গ) নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পরপরই অন্তবর্তীকালীন জাতীয় সরকার পদত্যাগ করবে এবং নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

কিন্তু রণনীতির ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে এই তর্কগুলো এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাস্তব ব্যবহারিক তর্ক হিশাবে হাজির হয় নি। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচার এবং রণনৈতিক তর্কবিতর্ক হিশাবে গণরাজনৈতিক ধারার দলগুলোকে এই তর্কগুলো অবশ্যই নিজেদের মধ্যে তুলতে হবে, জনগণের মধ্যে প্রচার করতে হবে এবং জনগণের সচেতন অংশের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা ও কৌশল সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন অবস্থান অর্জন করতে হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করে গণরাজনৈতিক ধারার রাজনীতিকে বৃহত্তর ঐক্যসূত্রে সংঘবদ্ধ করবার চেষ্টা চালাতে হবে। চিন্তা ও কৌশলের পরিচ্ছন্নতাই বর্তমান আন্দোলন-সংগ্রামে গণরাজনৈতিক ধারার অনুসারী রাজনৈতিক দলগুলো মতাদর্শিক আধিপত্য এবং সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। আন্দোলন-সংগ্রামে তারা নির্ধারক ভূমিকা রাখবার ক্ষেত্রে সমর্থ হয়ে ওঠার জন্য রণনৈতিক তর্কবিতর্ক জারি রখা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ। গণশক্তি পরিগঠনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কবিতর্ক জারি রাখা ছাড়া সহজ কোন পথ নাই।

নিজেদের বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ভাবে গঠনের সহজ ও শর্টকাট কোন রাস্তা নাই। পৃথিবীর কোন দেশে সেটা আপনা আপনি ঘটে নি। তার মানে সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক স্তরকে এমন জায়গায় উন্নীত করতে হবে যাতে ব্যক্তির আবির্ভাব, ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক এবং ব্যক্তির বিকাশের রাজনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধির শক্তি সমাজে গড়ে ওঠে। তবে সঠিক নীতি এবং তত্ত্বের বাস্তবায়নের জন্য চেয়েও সবার আগে দরকার সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ – অর্থাৎ সঠিক রণকৌশল। তত্ত্ব আপনা আপনি সমাজে বাস্তবায়িত হয় না, সমাজকেও তার জন্য তৈরি হতে হয় এবং সমাজকে তৈরি করতে হয়। এখন তাহলে রণকৌশল নিয়ে আমরা আলোচনা করব।

২১.

তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিক কিম্বা রণনীতি ও রণকৌশল পরস্পর থেকে আলাদা নয়, কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামই তত্ত্ব বাস্তবায়নের কৌশল নির্ণয় করে দেয়। তত্ত্ব বা নীতি নির্ণয়ের দিক থেকে সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বহূদূর অগ্রসর হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তাকে বাস্তবায়নের উপযুক্ত রাজনৈতিক মূহূর্ত সঠিক ভাবে নির্ণয় করাই রাজনীতি। গণমুখি রাজনৈতিক ধারাকে অতএব রাজনৈতিক বিবেচনার ক্ষেত্রেও বিচক্ষণ হতে হবে। বিচক্ষণতার অভাব ঘটলে সঠিক তত্ত্বও স্রেফ তত্ত্ববাগীশতায় পরিণত হয়। তাই রাজনীতির ব্যবহারিক ও কৌশলগত প্রশ্ন সঠিক ভাবে নির্ণয়ের ওপর সঠিক নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, নইলে তা রাজনৈতিক বিপর্যয় তৈরি করে।

এই দিকটি বোঝার জন্য আমরা একাত্তরে বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারার রণধ্বণি থেকে নজির দিতে পারি। একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের চেতনা যখন জনগণের মধ্যে তুঙ্গে তখন গণমুখী বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারার রণধ্বনি ছিল ‘কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। যারা এই রণধ্বনি দিতেন তাঁদের রাজনৈতিক কর্মসূচী ছিল বাংলাদেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা। একে কেউ ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’, আবার কেউ চিনের নজির অনুযায়ী ‘জনগণতান্ত্রিক’ বিপ্লব বলতেন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি হিশাবে এই রণধ্বণি সঠিক ছিল। কিন্তু তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নি। জাতীয় নিপীড়ন, শোষণ এবং বাংলাদেশের স্বায়ত্ব শাসনের দাবি অস্বীকার করার পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তখন তুঙ্গে। অর্থাৎ জাতিবাদী চেতনা অন্য সকল বিবেচনাকে গৌন করে ফেলেছে। স্বাধীনতা অর্জনই তখন জনগণের রাজনোইতিক আকাঙ্ক্ষায় দানা বেঁধেছে। শ্রেণী প্রশ্ন বা বিশেষ ভাবে কৃষক ও শ্রমিকের প্রশ্ন জাতীয় মুক্তির প্রশ্নের অধীন হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে কিন্তু যুক্ত হয়ে পড়েছে। শ্রেণীর প্রশ্নের আগে জনগণ জাতীয় প্রশ্নের মীমাংসাই আগে নিষ্পত্তি করতে চেয়েছে। সেই সময় রণনীতিভাবে গণতন্ত্র বা জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের দাবি সঠিক ছিল, কিন্তু রণকৌশলগত দাবি ছিল মারাত্মক ভুল। ফলে জাতিবাদীরা যখন রণধ্বণি তুলল যে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ তখন বিপ্লবী বাম ধারা খড়ের কুটার মতো ভেসে গেল। কারন জাতিবাদী মূহূর্ত শ্রেণীর প্রশ্ন মীমাংসার মূহূর্ত নয়। বাংলাদেশের জনগণ যেখানে স্বাধীনতা লাভের জন্য উদ্গ্রীব তখন শ্রেণীর প্রশ্ন মীমাংসার দাবি তাদের কাছে গ্রহনীয় হয় নি। বাংলাদেশের বিপ্লবী বাম রাজনীতির ঐতিহাসিক ট্রাজেডি হচ্ছে ভুল রণধ্বণি বা বা ভুল রণকৌশল নির্ণয়। যার ফলে জাতিবাদী রাজনীতি অনায়াসেই তাদের পরাস্ত করতে পারল। তারা পরাস্ত হোল।

অন্যদিকে শেখ মুজিবর রহমান যখন ছয় দফা প্রস্তাব করেছিলেন,সেটা বাংলাদেশ স্বাধীন করবার কর্মসূচি ছিল না। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েন । ছয় দফাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে মূর্ত করে তুলেছে। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না। কিলানোই সার হয়।

এখন যখন ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট ও লুটেরা শ্রেণিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য জনগণ রাস্তায় নেমে আসছে তখন সঠিক রণকৌশল হচ্ছে জনগণের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকা। আন্দোলনে নিঃশর্ত ভাবে অংশগ্রহণ এবং রণনীতিগত অবস্থা সক্রিয় রাজনোইতিক কর্মীদের কাছে প্রচার। রণকৌশল্গত পরিচ্ছন্ন চিন্তা বাদ দিয়ে নিরর্থক অসময়োচিত তর্ক গণরাজনৈতিক ধারাকে দুর্বল ও হাস্যকর করে তুলতে পারে। জনগণের সামনে এখন প্রধান প্রশ্ন ফ্যাসিস্ট শক্তি মোকাবিলা এবং ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ। এটাই এখন বাংলাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আগামি ১০ তারিখে বিএনপির ডাকা সমাবেশের পর জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মান কোন স্তরে পৌঁছায় সেটা তখন বোঝা যাবে। এখন নয়। যেখানে আগামি নির্বাচন আদৌ হবে কিনা তারই কোন খবর নাই সেই ক্ষেত্রে ‘সংবিধান সংস্কার করবে কারা: জাতীয় সংসদ নাকি সংবিধান (সংস্কার) সভা?’ – খুবই বিমূর্ত তর্ক।

এটা কি রণনৈতিক নাকি কৌশলগত প্রশ্ন।? আসলে কোনটাই নয়। যদি বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানই রণনৈতিক অবস্থান হয়, তাহলে যারা সেই অভ্যূত্থানে নেতৃত্ব দেবে তারাই ছোট দলগুলো চাক বা নাক জাতীয় সরকার গঠন করবে। সেই সম্ভাবনার কথা মনে রেখে বিএনপি আগেই ঘোষণা করেছে তারা আন্দোলনের সাথী সকল দল নিয়ে ‘জাতীয় সরকার' গঠন করবে। বিএনপির দিক থেকে এটা সঠিক রাজনৈতিক কৌশল, এই ঘোষণা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির প্রতি বিশ্বাস ও সমর্থন বাড়িয়েছে। গণরাজনৈতিক ধারার অনুসারী ছোট ছোট দলগুলোর জন্য এটা সুযোগ বলে আমি মনে করি। বিএনপি বাংলাদেশ নতুন ভাবে গঠন'করবে সেই ভরসা না করেও ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের সংগ্রামে সরাসরি যুক্ত থাকাই গণমুখী রাজনৈতিক ধারার সঠিক রণকৌশল।

তাহলে রণনীতিকে রণকৌশল থেকে আলাদা করতে শিখতে হবে। ‘সংবিধান সংস্কার করবে কারা: জাতীয় সংসদ নাকি সংবিধান (সংস্কার) সভা?’ -- এই শিরোনামে একাডেমিক আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু গণরাজনৈতিক ধারার রাজনীতি বিকাশের জন্য এই ধরণের আলোচনা কোন ফায়দা দেবে আমি মনে করি না। একাডেমিক তর্ক হিশাবে এই তর্ক অবশ্য তোলা যেতেই পারে। কিন্তু এই প্রশ্ন যেহেতু এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যবহারিক তর্ক হিশাবে হাজির হয় নি অতএব সেটা রাজনৈতিক দলের প্লাটফর্মে না তুলে সামাজিক প্লাটফর্মের তোলাই কৌশলের দিক থেকে শ্রেয়। এ বিষয়ে ভিন্ন মত থাকতে পারে। তবে তার মীমাংসা কংক্রিট কাজের ফল থেকেই বোঝা যাবে।

যদি বাংলাদেশকে নতুন ভাবে 'গঠন' করাই আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য হয়, তাহলে সেই নীতিগত অবস্থানে প্রচার এবং তা মতাদর্শিক ভাবে প্রতিষ্ঠার কাজকে রণকৌশলগত ব্যবহারিক পদক্ষেপ থেকে আলাদা করতে হবে। বিএনপির সঙ্গে যৌথ ভাবে আন্দোলন করবার প্রধান শর্ত হচ্ছে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক ভাবে নতুন করে গঠন করবার নীতি প্রচারের স্বাধীনতা। নইলে ‘যুগপৎ আন্দোলন’ চলবে। বিএনপি নিজেও সম্ভবত ‘যৌথ’ নয় , ‘যুগপৎ’ আন্দোলন চায়। অর্থাৎ গণরাজনৈতিক ধারা আন্দোলনের মাঠে প্রচার করতে পারবে যে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির জন্য তথাকথিত বাহাত্তরের সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন ‘গঠনতন্ত্র' প্রণয়ন করতে হবে।এই প্রচারই জোরদার করতে হবে। তা না করে কৌশলগত প্রশ্নকে নীতিগত প্রশ্ন আকারে হাজির করা ভুল। এতে জনগণ বিভ্রান্ত হয় এবং ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য তৈরির প্রতিবন্ধকতা হিশাবে সেটা হাজির হয়। এই ধরণের তর্ক সফল ও বিজয়ী গণ অভ্যূত্থান এবং নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য ‘রাষ্ট্র গঠন সভা’ আহ্বানের রণনৈতিক অবস্থানকে আড়াল, অপরিচ্ছন্ন এবং অস্পষ্ট করে ফেলে। জনগণ বিভ্রান্ত হয়। কৌশলগত প্রশ্নকে নীতিগত তর্কে পর্যবসিত করলে আন্দোলন-সংগ্রাম বিজয়ী গণঅভ্যূত্থানের দিকে বিকশিত না হবার সম্ভাবনা বাড়ে। সংগ্রাম ব্যাহত হয়। জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়ার ভয় থাকে। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য বিএনপির সঙ্গে কৌশলগত ‘যৌথ আন্দোলন’ জনগণের দিক থেকে প্রত্যাশা, কারন তা ন্যায্য এবং দরকারি। সেটা না হলেও ‘যুগপৎ আন্দোলন সঠিক পদক্ষেপ। গণরাজনৈতিক ধারার অনুসারী ছোটদলগুলোর মতাদর্শিক আধিপত্য এতে বৃদ্ধি করবে এবং জনগণের ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও সংকল্প ধারণ করবার সাংগঠনিক শক্তি ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ গঠনের ধ্রুপদী রণনৈতিক তর্কবিতর্ক এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অজ্ঞতা আমাদের বারবারই পিছিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় সেই নীতি বাস্তবায়নের কৌশল আলোচনা ও পর্যালোচনাই আমাদের এখনকার মুখ্য ব্যবহারিক বিষয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে রণকৌশল নির্ণয়ই এই ক্ষেত্রে আমাদের এখন প্রধান বিবেচনা হওয়া উচিত।

২২

এখন প্রথম কাজ হচ্ছে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘যৌথভাবে’ আন্দোলনে শরিক হবার চেষ্টা করা। সেটা সম্ভব না হলে অবশ্যই ‘যুগপৎ’ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হওয়া। জনগণ ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করবার জন্য যেভাবে রাস্তায় নেমে আসছে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝা খুবই জরুরি। জনগণের দিক থেকে এখন কে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেই তর্ক একদমই মুখ্য নয়। দলে দলে রাস্তায় নেমে এসে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাজিত করা এবং ক্ষমতা থেকে ফ্যাসিস্ট শক্তির অপসারণই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। যা খুবই ইতিবাচক। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের জন্যও ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ মুখ্য। কারন এই সরকারের পতন না ঘটালে লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা উঠিয়ে নেওয়া হবে না। বহু তরুণের জীবন চিরকালের জন্য বরবাদ হয়ে যাবে। বিএনপিসহ সকল বিরোধী দলের কর্মীদের জন্য ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ তাদের নিজেদের বাঁচামরার সঙ্গে যুক্ত। অতএব এই আন্দোলনকে সমর্থন না করার কোন বিকল্প নাই । তাই যুগপৎ বা যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা অপসারণই দরকারি কাজ।

বিএনপির সঙ্গে এই সময় বিমূর্ত তাত্ত্বিক তর্কবিতর্ক সঠিক কৌশল নয়। তাই ‘সংবিধান সংশোধন’ করবে কারা?-- এই প্রশ্ন তোলার আগে বোঝা দরকার জনগণ যেভাবে সাড়া দিচ্ছে তাতে এই সরকারকে হটিয়ে নতুন অন্তর্বর্তী বা জাতীয় সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয় তখন নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন না হোক, নিদেন পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কার মুখ্য রাজনৈতিক তর্ক হিশাবে উঠবেই। তখন বিএনপিকেও অবস্থান নিতে হবে। তখনই এই ধরণের কৌশলগত তর্কবিতর্ক ফলপ্রসূ হবে। এখন নয়।

২৩

কতিপয় সাবধান বাণী। শক্তিশালী দল হিশাবে আওয়ামী লীগকে হিশাবের বাইরে রাখা বোকামি। ক্ষমতার বদল প্রবল সংঘর্ষ ও সহিংসতা ছাড়া সম্ভব কিনা সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আওয়ামি লীগ সমর্থন হারালেও আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার পক্ষপাতী হবে। সেই ক্ষেত্রে বিএনপি যদি ক্ষমতা ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চায় এবং ক্ষমতায় গিয়ে টিকে থাকতে চায় তাহলে ছোট ছোট দলের ন্যায়সঙ্গত ও বাস্তবোচিত দাবি তার নিজের স্বার্থেই মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ বিএনপি যদি এই আন্দোলনকে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলনে রূপ দিতে না পারে, তাহলে ক্ষমতার হাত বদল হলেও বিএনপি তা ধরে রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ। আওয়ামী লীগ এবং গত কয়েকদশকে ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা ও লুটপাটের ভাগীদাররা এতো সহজে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দেবে সেটা এখনও বিশ্বাস করা কঠিন। তাই বিএনপির নিজের স্বার্থে এখনি যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তোলা, এবং আন্দোলনকে দলীয় সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে জাতীয় রূপ দেওয়া, আন্দোলনের সংস্থা গড়ে তোলা জরুরি কাজ। ফলে যুগপৎ নয়, এখনই যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তোলা সঠিক কৌশল হবে, নইলে এর মূল্য বিএনপিকে পরে দিতে হবে। বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন দলের আলোচনা বা আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না, সে বিষয়ে কিছু বলা এখন সম্ভব নয়।

সাবধানতার দ্বিতীয় দিক হচ্ছে জামায়াতে ইসলামি সহ ইসলাম্পন্থি রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনের বাইরে রয়ে গেছে। এদের আন্দোলনের বাইরে থাকা আন্দোলনের মারাত্মক দুর্বলতা। এতে আন্তর্জাতিক ভাবে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা বাহয়তো ড়বে, কিন্তু আভ্যন্তরীন ভাবে বিএনপিকে মারাত্মক দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দেবে। বিশেষত গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইসলামপন্থি অনেক দলের সন্ধি ও মৈত্রী বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন উপাদান হিশাবে মজুদ হয়ে রয়েছে। চলমান আন্দোলনকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করবার বর্তমান আন্দোলনের আরেকটি মারাত্মক দুর্বলতা হচ্ছে এই আন্দোলন এখনও মূলত পেটি বুর্জোয়া মধবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আন্দোলন। এই আন্দোলনে শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, নারী – বিশেষত পোশাক তৈরি কারখানার নারী শ্রমকদের কোন উপস্থিতি নাই বললেই চলে। এমনকি মধ্যবিত্ত নারীদেরও কোন সংগঠিত উপ্সথিতি নাই, তা ফ্যাসিস্ট শক্তি বিরোধী আন্দোলনের বিশাল দুর্বলতা। তাহলে গণমুখী রাজনৈতিক ধারার কাজ হচ্ছে পেটি বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাইরে শ্রমিক, কৃষক ও খেটে খাওয়া শ্রেণীর স্বার্থের কথা তোলা যথাসম্ভব তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা এবং জাতীয় রাজনীতিতে তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতি দৃশ্যমান করে তোলা। বর্তমান আন্দোলনের সফলতা এবং বিফলতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কারা জাতীয় রাজনীতিতে উপস্থিত এবং কারা অনুপস্থিত তার দ্বারাই আগামি রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ঠিক হবে। এর অন্যথা হবে না বলে আমি নিশ্চিত।

২৪.

বিএনপির দিক থেকে আগামি রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক দিক হোল আন্দোলনে বিএনপি কি একাই নেতৃত্ব দেবে, নাকি জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে বড় দলের অহংকার এবং দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করে যৌথ আন্দোলন যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। বিএনপি ধরে নিচ্ছে যে জনগণ বিপুল সংখ্যা রাস্তায় নেমে আসছে বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে, কিম্বা বিএনপির প্রতি জনগণের বিশ্বাস বেড়েছে বলে। বিএনপির অনেক অহংকারি নেতা দাবি করছেন তারা তাঁদের শক্তি আগে প্রদর্শন করবেন, কিন্তু আমরা এখন যা দেখছি তা বিএনপির সাংগঠনিক কিম্বা মতাদর্শিক শক্তি নয়, বরং একে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা উচ্ছেদের পক্ষে জনগণের রাস্তায় নেমে রায় দেওয়া। সেই হিশাবে বোঝাটাই সঙ্গত। এটা বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবার রায় না। যদি সেটা ঘটেও বিএনপি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। বিএনপিকে সেটা বুঝতে হবে। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে বিএনপি কিছুই অর্জন করতে পারবে না। আগামি ১০ ডিসেম্বরের সভা সেই দিক থেকে বিএনপির জন্য নির্ধারক। তার আগে বিএনপি যদি একক দল হিশাবে হাজির না থেকে যৌথ আন্দোলনের নেতৃত্ব গড়ে তুলবার নজির দেখাতে না পারে তাহলে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। অতএব ছোট দল গুলোর সঙ্গে বিএনপির সংলাপ এবং যৌথ আন্দোলন গড়ে তুলবার সিদ্ধান্ত এই সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যৌথ আন্দোলনের সংস্থা হিশাবে কোন জাতীয় প্লাটফর্ম প্রদর্শন করা না গেলে, আন্দোলনে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ারই সম্ভাবনা। বিএনপি যদি বিপ্লবাত্মক কিছু নাও চায়, তবুও ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা মোকাবিলার জন্য জাতীয় স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ দল হিশাবে নিজেকে হাজির থাকতে হলে তাকে খানিক বিপ্লবী না হলে উপায় নাই। এ ছাড়া বিএনপির কোন বিকল্প নাই। জনগণ যেভাবে সাড়া দিচ্ছে তা বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে না।

২৫.

যদি বিএনপি আসলেই সংবিধানের সংস্কার কিম্বা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের সম্ভাবনা মাথায় রাখে, কিন্তু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কৌশলগত কারণে তা এখনই বলতে না চায়, তাহলে কৌশলের দিক থেকে সেটা ভুল নয়। বরং বিচক্ষণতা। সেই ক্ষেত্রে বিএনপি আদৌ বিচক্ষণ কিনা বোঝা যাবে বিভিন্ন ছোট বড় দল নিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী সংস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিএনপির দৃঢ়তা এবং আন্তরিকতা। আন্দোলনের সংস্থা গড়ে তোলা ছাড়া ফ্যাসিস্ট শক্তি মোকাবিলার আর কোন বিকল্প নাই। বিজয়ী গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে এই যৌথ আন্দোলনের সংস্থাই ‘অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার’ হিশাবে ক্ষমতা গ্রহণ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে বা করবে। ‘অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের জন্য বিএনপির কোন নির্বাচনের দরকার নাই। বিজয়ী গণঅভ্যূত্থানই অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের বৈধ ভিত্তি।

তাহলে বিএনপিকে অবশ্যই তার নিজের স্বার্থেই যৌথ আন্দোলন ও যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।

আমরা গণ আন্দোলন গণ সংগ্রামের ইতিবাচক পরিণতি কামনা করি।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।