২. বিএনপির 'রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা'


বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্ভাগ্য হচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে শ্রমিক শ্রেণীর উপস্থিতি যেমন নাই, তেমনি কৃষকও হাজির নাই। জাতীয় রাজনীতিতে হতদরিদ্র সর্বহারা এবং বিভিন্ন মেহনতজীবী জনগণকেও আমরা হাজির দেখি না। দ্বিতীয়ত তথাকথিত প্রতিনিধিত্বমূলক গমতন্ত্র (?) জনগণকে স্রেফ ভোটের সংখ্যায় পর্যবসিত করে। বিএনপি আওয়ামী লীগের মতোই জনগণকে ভোটের সংখ্যা হিশাবে বোঝে। এর অধিক কিছু বোঝার কোন বাধ্যবাধকতা বিএনপির নাই। কারণ বিএনপি শ্রেণী রাজনীতি করে না। কিন্তু 'জনগণ' স্রেফ সংখ্যা নয়। গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশের জন্য তাই বিভিন্ন শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্তার বিচার জরুরি। কিন্তু তথাকথিত নির্বাচন-সর্বস্ব গণতন্ত্রে সেটা বোঝার প্রয়োজন পড়ে না। ক্ষমতার বৈধতা নির্বাচ সর্বস্ব গণতন্ত্রে স্রেফ সংখ্যার দ্বারা নির্ণয় করা হয়। এর দ্বারা শেষাবধি ধনী ও লুটেরা শ্রেণীর স্বার্থই রক্ষা করা হয়।

অতএব ভোটের সংখ্যার বাইরে জনগণকে বিএনপি অধিক কোন মূল্য দেয় তা প্রমাণ করা কঠিন। জাতীয় রাজনীতিতে  শক্তিশালী নারী আন্দোলনও নাই। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং অবাঙালিদের প্রশ্নও জাতীয় রাজনীতির উপেক্ষিত বিষয়। এই সকল বাস্তবতা যদি আমরা মানি তাহলে এটা পরিষ্কার বোঝা সম্ভব যে বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের রূপরেখার  ভিত্তিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার চরিত্র সংকীর্ণ এবং তার ফলাফলও সীমিত হতে বাধ্য।

বিএনপি তার আন্দোলনের দশ দফা দাবি এবং  রূপরেখায় বিষয়টা বিশদেই বলেছে। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে সরিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়।

"দেশপ্রেমের শপথে উজ্জীবিত এক সুকঠিন জাতীয় ঐকমত্য (national consensus) প্রতিষ্ঠা ব্যতীত কোনো একক দলের পক্ষে বর্তমান বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও রাজনৈতিক কাঠামো পুনঃগঠন ও সংস্কার অত্যন্ত কঠিন। আর সে জন্যই চলমান আন্দোলনে জনতার বিজয় অর্জনের পর একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় একটি অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী হলে, সবার মতামত ও সম্মতির মাধ্যমে দেশ পরিচালনার নিমিত্তে, বর্তমান সরকারবিরোধী রাজপথের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলসমূহকে নিয়ে ‘একটি জাতীয় সরকার’ গঠন করার প্রস্তাব করছি"।

এর মানে হচ্ছে বিএনপি তার পুরানা দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির বাইরে কিছু বলছে না। তফাতটা হচ্ছে ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে ভেঙে পড়া অবস্থা তৈরি হয়েছে বিএনপি একা তার দায়দায়িত্ব নিতে চাইছে না। সেই দায়টুকু সকলের ওপর বিএনপি দিতে চায়। কারন 'বর্তমান বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার'  বিএনপির একার পক্ষে করা সম্ভব না। তাই তার দায়দায়িত্ব এখন সকল দলকেই নিতে হবে।

অন্যদিকে 'রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠন ও সংস্কার' বলতে বিএনপি 'রাষ্ট্রশক্তি'র চরিত্রে কোন রূপান্তর বোঝে না। স্রেফ  'কাঠামো'র সংস্কার বোঝে। সেই বিষয়ে বিএনপি কিছু প্রস্তাব দিয়েছে এবং কিছু হয়তো অন্যদের কাছ থেকেও শুনতে চায়। যেটা আমাদের পরিষ্কার বুঝতে হবে 'রাষ্ট্র শক্তি'  ও 'রাষ্ট্রকাঠামো' পরস্পরের সম্বন্ধযুক্ত কিন্তু একদমই দুটো আলাদা ধারণা। বিএনপির রাষ্ট্র সংস্কার বিদ্যমান রাষ্ট্র শক্তি রূপান্তরের কোন দাবি, 'ভিশন' বা কর্মসূচি নয়।  বিএনপি ক্ষমতায় এলেও রাষ্ট্রশক্তি একান্তই বাংলাদেশের ধনি ও লুটেরা  শ্রেণীর হাতেই থাকবে। লিবারেলদের মুখে ফেনা তুলে নিত্য বলা  'গণতন্ত্র' নামক জিকির আবছা হলেও 'গণশক্তি'র একটা ধারণা দেয়, কিন্তু গণশক্তিকে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক রূপ দেওয়া  বিএনপির রাষ্ট্র মেরামত প্রস্তাব না। বিএনপি তার চিরাচরিত রাজনীতি অনুযায়ী এমন একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা বা পরিবেশ চায় যাতে ভোটের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন শাসকদের প্রতিপক্ষ হিশাবে বিএনপি জিতে ক্ষমতায় আসতে পারে। এরপর যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন।

'রাষ্ট্র শক্তি'  ও 'রাষ্ট্রকাঠামো' পরস্পরের সম্বন্ধযুক্ত কিন্তু একদমই দুটো আলাদা ধারণা, এটা তত্ত্বগত ভাবে বিএনপি বোঝে কিনা সেটা একটা তর্ক হতে পারে, কিন্তু বিএনপি, আওয়ামী লীগ দল সহ বাংলাদেশের সকল শাসক দলই সেটা হাড়ে হাড়ে বোঝে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু এই বোঝাবুঝির মাত্রা বা রাজনৈতিক চেতনা জনগণের মধ্যে খুবই কম। কারন বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্র কাঠামোর ভেদ বিচার নাই বললেই চলে।  ধনী ও লুটেরা শ্রেণীর দিক থেকে ক্ষমতা যেন কোন অবস্থাতেই জনগণের ক্ষমতা বা গণশক্তি না হয়ে ওঠে -- সেটাই বিএনপি বা আওয়ামী লীগের  রাজনীতির মূল কথা বা বা বাংলাদেশের বুর্জোয়া শ্রেণীর শ্রেণীগত মর্ম।

কিন্তু রাজনীতির এই গুরুতর এবং কেন্দ্রীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করবার দায় বুর্জোয়া দল হিশাবে  বিএনপির, আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টী বা জামায়েতে ইসলামি প্রভৃতির নয়, সেই দায় একান্তই বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে চর্চার মধ্য দিয়ে পরিচ্ছন্ন করা  এবং তাকে জনগণের রাজনৈতিক চেতনায় সঞ্চারিত করবার দায় একান্তই বামপন্থি বা গণমুখি রাজনীতির দাবিদার দলগুলোর। বিএননপির 'রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা' পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের 'বামপন্থা' বা তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার অন্তঃসারশূন্যতা এবং বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক পশ্চাতপদতা তুলে ধরা জরুরি । কারন সর্বহারা, শ্রমিক, হতদরিদ্র জনগণ, ক্ষুদ্র জাতি সত্তা, নারী সহ সকল অবহেলিত শ্রেণী ও গোষ্ঠির জাতীয় রাজনীতিতে সরবে হাজির থাকার অর্থ রাষ্ট্রশক্তির প্রশ্ন জাতীয় রাজনীতির বিষয়ে পরিণত করতে পারা।

আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণের কাতার থেকে বিষয়টি আমরা বিচার করি এবং জনগণকে আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা সংকীর্ণতা  মনে করিয়ে দিতে চাই কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের আমরা বিপক্ষে নই। জনগণের রাজনৈতিক চেতনার অভাব আমরা ডিনগিয়ে পেরিয়ে যেতে পারি না। জাতীয় রাজনীতিতে সংস্কারের চেতনা এসেছে সেটা অগ্রগতি। কিন্তু যে শ্রেণী ও গোষ্ঠির পক্ষে আমরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাই তারা ধনী ও ও লুটেরা শ্রেণী  নয়। সাধারণ মজলুম জনগণ। কিন্তু এক ধাপে সব কিছু জনগণ অর্জন করতে পারব না। কিম্বা পারবে কিনা আমরা আগাম জানি না। সেটা আন্দোলন-সংগ্রামের  চরিত্র, গতি ও অভিমুখই আগামি দিনে নির্ধারণ করবে। আমাদের পর্যালোচয়ান সেই অভিমুখ ধরিয়ে দেবার জন্য। বিএনপি কিম্বা অন্য যে কোন দলের ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামকে আমরা তাই নিঃশর্তে সমর্থন করি। কারন আন্দোলন-সংগ্রামই গুরুতর প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্ন যেমন -- রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত বা সংস্কার বনাম ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির বিপরীতে গণশক্তি পরিগঠন এবং বিজয়ী গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন ভাবে 'গঠন' করা -- এই দুইয়ের সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে পারে। রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত বা  সংস্কারবাদী রাজনীতির বিপরীতে বিজয়ী গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন ভাবে 'গঠন' করার রাজনীতিকে শক্তিশালী জাতীয় রাজনীতিতে পরিণত করতে পারে। ফ্যাসিস্ট শডক্তি বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামই বাংলাদেশ নতুন ভাবে 'গঠন'-এর রাজনীতিকে জনগণের সামনে প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য হিশাবে হাজির করতে পারে। এটাই এই সময়ের প্রধান কাজ। এটাই বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারা বিকাশের পথ। কারন জনগণের দিক থেকে বর্তমান আন্দোলন-সংগ্রাম একান্তই ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত ও নতুন ভাবে বাংলাদেশ গঠনের লড়াই। বিএনপি এটা বুঝবে অনুমান করি না। কিন্তু যতোটুকু বুঝবে দল হিশাবে তার অর্জনও এই উপলব্ধির ওপর নির্ভর করবে।

মাঝে মধ্যে মুখ ফস্কে বক্তৃতায় ফ্যাসিবাদের কথা বললেও ফ্যাসিস্ট শক্তি বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধরণের রাজনৈতিক বর্গ বিএনপির রাজনৈতিক উপলব্ধি ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। 'ফ্যাসিবাদ' স্রেফ বিরোধী দলকে গালির ভাষা হিশাবে ব্যবহৃত হয়, যাকে আমরা  নিছকই  Rhetoric বা রাজনৈতিক বকোয়াজি বলতে পারি। অথচ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বর্গ । আওয়ামী লীগ বিরোধী ছোটবড় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কাছে এই সকল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বর্গ আদৌ কোন তাৎপর্য বহন করে কিনা সন্দেহ। এটাই জাতীয় রাজনীতির বাস্তবতা।

ফলে এই অনুমান মাথায় রেখেই বর্তমান  আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। যেন আমরা হতাশ না হই তার জন্য আগেই বুঝতে হবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে 'অপসারিত' হলেও আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল লাভের সম্ভাবনা সংকীর্ণ ও সীমিত। কিন্তু তারপরও ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যৌথ বা যুগপৎ  সংগ্রাম আমরা সমর্থন করি। কারন জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সজ্ঞান  এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশের জনগণের বর্তমান রাজনৈতিক চেতনার পর্যায় গুণগত ভাবে অতিক্রম করে যাবার সম্ভাবনা উন্মোচন করার জন্য এই ক্ষমতাসীন শক্তির বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলনে জনগণের  অংশগ্রহণ আমরা আবশ্যক মনে করি। বিদ্যমান ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের  মধ্য দিয়েই জনগণ তাদের রাজনৈতিক চেতনার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করবে এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান সংকটের  সুনির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের নীতি ও কৌশল নিয়ে ভাবতে আগ্রহী হবে।

তাহলে এটা পরিষ্কার থাকা উচিত যে বর্তমান আন্দোলনের সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা  সহজেই যে কারুরই চোখে পড়বার কথা। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার জন্য বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা কোন শাসক শ্রেণিকে দোষ যাওয়া যায় না। কারন সেটা তাদের সমস্যা নয়, তাদের রাজনীতিও নয়। সাধারন ভাবে বাংলাদেশের তথাকথিত বামপন্থাই এর জন্য দায়ী। বলা যায়  মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, মাওবাদ বা নানান কিসিমের বামের ব্যর্থতা। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী সর্বহারা, গরিব বা হতদরিদ্রদের জন্য রাজনীতি করে না। তারা শাসক শ্রেণী হিশাবে টিকে থাকবার জন্যই রাজনীতি করে।

বাংলাদেশের মতো একটি পোস্ট কলোনিয়াল সমাজে বা রাষ্ট্রে ধনি হওয়ার ক্ষেত্র উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে সম্ভব না। তার ক্ষেত্র হচ্ছে প্রধানত রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র ক্ষমতা, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং ব্যাংক। বৈদেশিক বাণিজ্য ও ব্যাংক ছাড়াও রাষ্ট্রীয় খাত  তুলনামূলক ভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, কারন বড় বা বৃহৎ প্রকল্প থেকে ক্ষমতার জোরে অর্থ লুট করা সহজ। ক্ষমতায় থাকা বা না থাকাটা যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বাঁচা মরা বা টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন। যে কারণে শান্তিপূর্ণ মানে আপোষ, আইন বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে ক্ষমতা হস্থানর বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে অসম্ভব। শ্রেণী চরিত্র এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বাস্তবতার কারনে বিএনপি অতএব নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ছাড়া বাংলাদেশের কোন গুণগত সংস্কার বা রূপান্তরের দাবি তুলতে অক্ষম। এই বাস্তব পরিস্থিতি মনে রেখেই তাদের 'রাষ্ট্র মেরামতের রূপ্রেখা' আমামদের পর্যালোচনা করতে হবে।

কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রবল ক্ষোভ ও রোষের মুখে বিএনপির মধ্যেও পরিবর্তন ঘটছে। ফলে ক্ষমতাসী্নদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ অগ্র পদক্ষেপ। এখন আমরা যারা গণমানুষের রাজনীতি করি এবং বাংলাদেশে শক্তিশালী গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ চাই আমাদের কাজ হচ্ছে যাদের কন্ঠস্বর গরহাজির এবং যাদের স্বার্থ জাতীয় রাজনীতিতে অনুপস্থিত তাদের কন্ঠস্বর তুলে ধরা এবং জাতীয় রাজনীতিতে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করবার মতাদর্শিক তর্কবতর্ক চালিয়ে যাওয়া। আমাদের রূপরেখার পর্যালোচনা অতএব যারা মাঠের আন্দোলনে সরবে হাজির নাই তাদের অবস্থান থেকে করতে হবে। কিন্তু সেটা সস্তা শ্লোগান বা মুখস্ত বিদ্যা আউড়িয়ে করলে হবে না। করতে হবে বাস্তবের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সুনির্দিষ্ট কর্তব্য নির্ণয় করে । বিশেষত বাংলাদেশের রাজনৈতিক মতাদর্শের গোড়ার বা নির্ধারক তর্কবিতর্ককে সামনে এনে। সেটা বিমূর্ত তত্ত্ব হিশাবে করলে হবে না। করতে হবে জাতীয় রাজনীতিতে যে সকল তর্ক বিতর্ক চলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলাদেশে গণমুখী রাজনৈতিক ধারা গড়ে তুলবার সুনির্দিষ্ট নীতি ও কৌশলের প্রতি নজর রাখার মধ্য দিয়েই আমরা তাই বিএনপির 'রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা-র পর্যালোচনা হাজির করবার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির প্রচলিত তর্ক আমরা অনুসরণ করতে চাই না। সেটা কোন দলের পক্ষ, বিপক্ষ বা সুবিধাবাদী নিরপেক্ষ ধারার কোন্টীউ আমরা গ্রহণ করতে চাই না। আমরা চলমান রাজনীতির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের মূল মর্মবার্তা তুলে ধরতে চাই, যেন সাধারণ মানুষ তা সহজে বুঝতে পারে। যেমন, রষ্ট্রট কাঠামো সংস্কারের রূপরেখায় লুটেরা ও ধনী শ্রেণীর কাঠামোর একটু আধটু সংস্কারের কথা বলা আছে কিন্তু ফ্যাসিস্ট শক্তির বিপরীতে গণশক্তির পরিগঠনের কথা নাই। অথচ গণ্মানুষের দিক থাকে গণশক্তি পরিগঠনই মূল কথা।


 

অন্যান্য পর্ব পড়ূ
১. বিএনপির 'রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা


 

প্রভাবশালী একটি গণমাধ্যমে কারো কারো বক্তব্য দেখলাম বলা হচ্ছে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখায় 'দু-একটি বিষয় বাদ দিলে খুব বেশি নতুন কিছু নেই। মূলত জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০-এর সংমিশ্রণে এই রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে।' (দেখুন, 'বিএনপির রূপরেখায় রাষ্ট্র 'মেরামতের' নির্দেশনা কতটা পাওয়া গেল' । জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০-এর সংমিশ্রণে এই রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে সেটা তো ঘোষিত রূপরেখায় বিএনপি নিজেই সেটা বলছে।

‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ নিয়ে আমাদের বিস্তর সমালোচনা আছে। কিন্তু এই রূপরেখার ঘোষণায় ‘নতুন কিছুই নাই’ এই প্রকার মূল্যায়নের সঙ্গে আমরা একদমই একমত নই। প্রথমত বাংলাদেশের প্রধান একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের কাছে অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি হিশাবে এই রূপরেখা ঘোষণা করেছে। এটা কোন সাহিত্য রচনা নয়। এর মধ্যে ভালমন্দ  যাই থাকুক সেটাই ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় রাজনৈতিক চেতনার মাত্রা হিশাবে  পাঠ করতে পারা জরুরি। এই রূপরেখা ঘোষিত হচ্ছে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে একটি জাতীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এটা ঠিক যে তারেক রহমান এই ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন আন্দোলন-সংগ্রামের মাত্রা ও ব্যাপ্তি এখনকার মতো ছিল না। প্রাথমিক পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং অন্যান্য আন্দোলনকারী দল বা মতের সঙ্গে সম্বন্ধ তৈরির সম্ভাব্য কৌশল হিশাবে জাতীয় সরকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ‘মেরামত’ বা রূপান্তরের আলোকে বিষয়টি হাজির হয় নি। কিন্তু 'রূপ্রেখা'র বিস্তর সমালোচনার পর এখন ঢাকা সমাবেশের পরে এই অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি আন্দোলন-সংগ্রামের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রস্তাব।

রাষ্ট্র মেরামত রূপরেখায় বিএনপি বলছে, 'চলমান আন্দোলনে জনতার বিজয় অর্জনের পর' তারা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় একটি অবাধ নির্বাচন চায়। অর্থাৎ বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করবার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আন্দোলন-সংগ্রামের  মাধ্যমে জনগণের বিজয় অর্জন বলতে বিএনপি কি বোঝে আমরা জানি না। সেটা আগামি দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে।  কিন্তু 'জনগণের বিজয় অর্জন' নামক ইঙ্গিতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিভাষার অর্থ 'গণভ্যূত্থান' । কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক , নির্বাচনপন্থি সাংবিধানিক দল হিশাবে  বিএনপির  'গণ অভ্যূত্থান' এড়িয়ে যাওয়া এবং পরিবর্তে সাধারণত 'চলমান আন্দোলনে জনতার বিজয় অর্জন' ব্যবহার আমরা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতার আলোকে সঠিক বলে মনে করি। তবে বিএনপির অনেক নেতা মাঠে ময়দানের বক্তৃতায় 'গণভূত্থানের কথা বলেছেন। একে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই না। তারপরও জনগণের 'বিজয় অর্জন'- বলতে বিএনপি যদি গণঅভ্যূথান না বুঝিয়ে কোন না কোন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মতো কোন না কোন সাংবিধানিক কায়দাকানুনের কথা ভেবে থাকে আমরা আন্দোলন-সংগ্রামের বর্তমান মূহূর্তে তার বিরোধিতা করি না। বিএনপি যদি এর দ্বারা রাজনৈতিক কৌশল হিশাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে আন্দোলন সংগ্রামের দ্বারা ‘অপসারণ’ বুঝিয়ে থাকে এবং সংবিধান বহির্ভূত 'জাতীয় সরকার' গঠন করে তাহলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রচলিত তত্ত্ব অনুযায়ী সেটা জনগণের বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার। অর্থাৎ বিপ্লবী সাময়িক সরকার। কারন এই ধরণের সরকারকেই সাংবিধানিক সরকারের বিপরীতে বিপ্লবী’ সরকার বলা হয়। গণঅভ্যূত্থানের  মধ্য দিয়ে গঠিত এই ধরণের সরকার সাংবিধানিক ভাবে – অর্থাৎ সংবিধান দ্বারা বিধিবদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয়, বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে। বিএনপির নতুন ঘোষণায় তারই ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু ইঙ্গিত দিয়েও বিএনপি যদি তাকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মতো স্রেফ নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনী সরকার বানাতে চায় সেটা হবে গণ আন্দোলনের শক্তি ও সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা।  বিএনপির রূপরেখা' বিপ্লবী সাময়িক সরকারের ইঙ্গিত যেমন দেয় এক ভাবে তা নস্যাৎ করবার সম্ভাবনাও জারি রাখে।

'রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা' বলছে, "চলমান আন্দোলনে জনতার বিজয় অর্জনের পর একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় একটি অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী হলে, সবার মতামত ও সম্মতির মাধ্যমে দেশ পরিচালনার নিমিত্তে, বর্তমান সরকারবিরোধী রাজপথের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলসমূহকে নিয়ে ‘একটি জাতীয় সরকার’ গঠন করার প্রস্তাব করছি"। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে 'চলমান আন্দোলনে জনগণের বিজয়' মানে কি? জনগণের বিজয় মানে হচ্ছে বিজয়ী গণ অভূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত। উৎখাতের পর আন্দোলন পরিচালনাকারী সংস্থাই জনগণের বিজয়ের পর বিপ্লবী অন্তর্বর্তী কালীন সরকারে পরিণত হয়। অর্থাৎ যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে তারাই বিপ্লবী সরকার হিশাবে হাজির হয়। বিপ্লবী কারণ এই সরকার সাংবিধানিক ভাবে নয়, ক্ষমতাসীনদের অসাংবিধানিক ভাবে উৎখাত করে গঠিত হয়। এটাই 'অপসারণ' কথাটার অর্থ।

কিন্তু 'চলমান আন্দোলনে 'জনতার বিজয়'কে বিএনপি ছিনিয়ে নিতে চাইছে। সেটা চাইছে বিপ্লবী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিএনপি 'নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার' বানিয়ে। 'জনগণের বিজয়'কে বিএনপি পর্যবসিত করতে চায় জনগণের পরাজয়ে। অর্থাৎ তাকে নিয়ে আবার ঢোকাতে চায় বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে। বিপ্লবী অন্তর্বর্তী সরকারকে স্রেফ নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থায় পর্যবসিত করে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সরকার বিএনপি গঠন করতে চায়। এরপর টুকটাক সংস্কার করে পুরানা রাষ্ট্র ব্যবস্থাই টিকিয়ে রাখবার ব্যবস্থাপত্র পেশ করছে বিএনপি তার 'রাষ্ট্র মেরামত রূপরেখা'। এই প্রস্তাব আসলে জনগণের বিজয়কে আগাম নস্যাৎ করবার রূপরেখা। এ ব্যাপারে আমরা বিএনপির কাছ থেকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করি।

আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণের বিজয়ের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার একান্তই ‘অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকার’ ছাড়া ভিন্ন কিছুই হতে পারে না। সেই সরকারের কাজ বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার জন্য নতুন 'রাষ্ট্র গঠন সভা' Constituent Assembly) ডাকা। তাকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানানো এবং বিদ্যমান সংবিধান মেনে নিয়ে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন দেওয়া এবং বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে জয়ীদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা -- পুরাটাই নতুন বোতলে পুরানা মদ পরিবেশনের চেষ্টা। বিএনপি গণ আন্দোলন গণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের বিজয়ী হবার পরও নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা না ডেকে পুরানা সংবিধান বহাল রাখবার কৌশল নিয়েছে। বিএনপির তথাকথিত জাতীয় সরকার গঠন আসলে বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সংবিধান বহির্ভূত ‘বিপ্লবী’ সরকারকে নাকচ বা নস্যাৎ করবার রণকৌশল।

যেহেতু গণ আন্দোলন গণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের 'অপসারণ' দিয়ে গঠিত সরকার সংবিধান বহির্ভূত সরকার, অতএব এই ধরণের সরকারকে বিদ্যমান সংবিধান দ্বারা ন্যায্য প্রমাণের কোন উপায় নাই। বিএনপির ফর্মূলা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক যদি বিপ্লবী সরকার না হয় তাহলে এই সরকার অসাংবিধানিক ও অবৈধ। এই ধরণের সরকারের অধীনের নির্বাচনও অবৈঢ ও অসাংবিধানিক হবে। অতএব বিএনপির প্রস্তাবিত রূপরেখায় ‘জাতীয় সরকার’ গঠিত করা শেষাবধি পুরানা সংবিধান আবার জনগণের ওপর আরোপ করবার প্রস্তাব। শাসক শ্রেণী হিশাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শ্রেণীগত মিলের জায়গাটা আমরা এখানে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আওয়ামী লীগ তাদের দলের সুবিধার জন্য সংবিধান সংশোধন করেছে, বিএনপিও সাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে নিজেদের দলীয় সুবিধা আদায় করবার জন্য পুরানা সংবিধানই আবার বহাল রাখবার কথা বলছে। কিন্তু বলছে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, চাতুরির সঙ্গে। পুরানা সংবিধান বহাল রেখেই তার সংবিধানের টুকটাক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। সারমর্মে এটাই তাদের ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’।

ক্ষমতাসীন দলকে অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে নিজেদের সুবিধামতো সংবিধান সংস্কারের ইতিহাস বাংলাদেশে নতুন কিছু না। অতীতে ঘটেছে। অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার পর সেই অসাংবিধানিক কাজকে পুরানা সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ দিয়ে আবার বৈধ করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের বিপদ ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমি এর আগে বহুবার আলোচনা করেছি। (আগ্রহীরা ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র’ বইটি দেখতে পারেন)। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ ক্ষমতা, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র গঠনের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয়। এ নিয়ে আলাদা ভাবে আমাদের বিস্তর আলোচনা করতে হবে।

কিন্তু এবারকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এই ভিন্নতার তিনটি দিক আমাদের বিবেচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত শেখ হাসিনা যখন বলছেন তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ সহজ না, তাকে হুমকি হিশাবে ভাবলে চলবে না, আক্ষরিক অর্থে বুঝতে হবে। সর্বোপরি সাংবিধানিক অর্থেও বুঝতে হবে। বিএনপি দাবি করে এই সরকার রাতের ভোটে ক্ষমতায়, অতএব অনির্বাচিত এবং অবৈধ। কিন্তু সেই জাতীয় পরিষদে বিএনপির সদদ্যরা যোগ দিয়ে থেকেছেন এবং অবৈধ সরকারকে তারা বৈধতা দিয়েছেন। এই ঘোর স্ববিরোধিতা বিএনপির রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারনে অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাসীনদের অপসারণ আগের চেয়ে অনেক বেশী বিপজ্জনক। ফ্যাসিস্ট শক্তি বাংলাদেশে এখন অনেক বেশী সংগঠিত এবং শক্তিশালী। তাই উলটা ক্ষমতাসীন দল হিশাবে ফ্যাসিস্ট শক্তি সংবিধানের দোহাই দিয়ে দেশদ্রোহিতা হিশাবে অনায়াসেই ক্ষমতা থেকে তাদের অপসারণকে 'অসাংবিধানিক’ আখ্যায়িত করতে পারে এবং তাদের সমর্থক আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় সাংবিধানিক ভাবে তাকে মোকাবিলা করবার বিস্তর আইনী ও সহিংস পথও তারা অবলম্বন করতে সক্ষম। সে কারনে শেখ হাসিনা যখন বলেন তিনি সাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতায় এবং তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানো সহজ না, তিনি অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা থেকে তাকে অপসারনের বিরুদ্ধে খোদ সংবিধানকেও অস্ত্র হিশাবে ব্যবহারের কথাই বলেন। আসলেই ‘অপসারণ’ এবার অতো সহজ না। এই রকম পরিস্থিতি তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন বলে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন।

দ্বিতীয় দিক হচ্ছে ভূ-রাজনীতি। ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিভিন্ন পরাশক্তির অবস্থান যাই থাকুক, অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাসীনদের অপসারণ প্রক্রিয়া যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে কোন পরাশক্তি তার প্রতি নির্বিচারে সায় দেবে না। আন্দোলন-সংগ্রামের চরিত্র আরও গণমুখী না হলে এবং কৃষক, শ্রমিক মেহনতি জনগণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হলেও শেষাবধি তার ফল যেই লাউ সেই কদুর অতিরিক্ত কিছু হবে না।

এখান থেকে আমরা তৃতীয় দিকের বিচারে আসতে পারি। সেটা হোল বাস্তবে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ‘গঠন’ করবার চেতনা জনগণের মধ্যে আমরা কতোটা সঞ্চার করতে পেরেছি? আমরা গণ আন্দোলন গণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিজয়ী গণ অভ্যূত্থান সফল করবার পর আবার ১৪২ অনুচ্ছেদ দিয়ে জনগণের অর্জনকে ফ্যাসিস্ট সংবিধান দিয়ে বৈধ করবার পথ বেছে নেব কি? ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে পুরানা ফ্যাসিস্ট সংবিধান আবার কার্যকর করাই কি আমাদের কাজ? তার জন্য কি আমরা রক্ত দেব, আর লাশ হয়ে যাব? নাকি আমরা বাংলাদেশকে নতুন ভাবে 'গঠন' করব, নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করব? বাংলাদেশকে আমরা নতুন ভাবে গঠন করতে চাই নাকি চাই না সেটাই জনগণের দিক থেকে আমাদের এখনকার মৌলিক রাজনৈতিক প্রশ্ন। 

আমরা মনে করি, গণচেতনাই শেষাবধি আন্দোলন-সংগ্রামের ফলাফল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। আমার ধারণা জনগণের চেতনার মাত্রা আগের চেয়ে উন্নত এবং জনগণ অর্থপূর্ণ অর্জন চায়। কিন্তু জনগণ কি চায় বা না চায় তাকে অনুমান হিশাবে ধরে নেওয়া ঠিক নয়, গণচেতনার বিকাশ ঘটানোই গণমানুষের রাজনীতি। আমরা আদৌ ঠিক বলছি কিনা সেটা আগামি দিনগুলোতেই স্পষ্ট হবে। (চলবে)

23 December 2022

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।