৩. বিএনপির 'রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা'


আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণরাজনৈতিক চেতনা বিকাশের লক্ষ্য নিয়ে বিএনপির ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’ পর্যালোচনা করছি। রাষ্ট্র ‘মেরামত’ করা জরুরি হয়ে পড়েছে এই দাবি শিশু কিশোরদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি। শিশূ কিশোরদের এই দাবি থেকে থেকে জাতীয় রাজনৈতিক পুনর্নির্মানে ‘মেটাফোর’ হিশাবে বিএনপি গ্রহণ করেছে। আমরা  যার প্রশংসা করি। কিন্তু এই ‘মেটাফোর’ বা রাষ্ট্র মেরামতের প্রতীকী ধারণাকে আমাদের পড়তে হবে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতের প্রতি নজর রেখে, জাতীয় রাজনীতি পুনর্নিমাণের আকাংখার প্রতি বিএনপির অঙ্গীকার হিশাবে। হয়তো তা বিএনপির নিজের রূপান্তরের ইঙ্গিতও হতে পারে। কিন্তু সে বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলবার সময় আসে নি।

আগেই বলেছি দল হিশাবে বিএনপির শ্রেণী ও মতাদর্শিক চরিত্র কোন মতেই বিপ্লবী নয়, এমনকি যদি আমরা জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপির অতীত ভূমিকা বিচার করি তাহলে বিএনপিকে লিবারেল বা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিকও দলও বলা যায় না। আজ আমরা গুম খুন ও আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়ছি। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে বাংলাদেশে র‍্যাপিড একশান ব্যাটেলিয়ন বিএনপির আমলেই তৈরি হয়েছিল। সেই সময় র‍্যাব সম্পর্কে আমি সবার আগে প্রতিবাদ করেছিলাম এবং সাবধান করেছিলাম বিএনপি নিজেই এর দ্বারা নিজেই কবর খুঁড়ছে।

তাহলে প্রশ্ন হোল, বিএনপির এই অতীত থাকা সত্ত্বেও ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’র প্রতি আমাদের পক্ষপাত ও মনোযোগ কেন? কারণ আমরা একে স্রেফ বিএনপির দলিল হিশাবে পড়ছি না, সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশের মাত্রা হিশাবে পর্যালোচনা করতে চাইছি। ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’ আমাদের বর্তমান জাতীয় রাজনৈতিক চেতনার দলিল, অর্থাৎ বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর একটি শক্তিশালী পক্ষের রাজনোইতিক চেতনার মাত্রা সম্পর্কে আমরা বোঝার জন্য এই দলিলকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। অর্থাৎ এই দলিল এবং দলিলটি কেন্দ্র করে তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে সমাজের রাজনৈতিক চেতনার অগ্রগতি কিম্বা পিছিয়ে পড়াকে  আমরা সম্যক বুঝতে পারব। রাজনৈতিক তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে আগামি দিনের জাতীয় রাজনীতির সম্ভাবনা ও সীমা উভয়ই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। কিম্বা হয়ে উঠতে বাধ্য। ফলে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে হাজির করা দলিলটি কেন্দ্র করে রাজনীতির পর্যালোচনা আমাদের জন্য ফলপ্রসূ হতে পারে। কোন বিমূর্ত তত্ত্ব বা ইউটোপিয়ায় যেন খাবি খেয়ে নিস্ফল না হয়।

দ্বিতীয়ত আমরা আগেই বলেছি আন্দোলন-সংগ্রামই জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের প্রধান ইস্কুল। সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ জনগণের চিন্তাচেতনার তুলনায় বহু অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু মার্কসের একটি অমোঘ বাণী রয়েছে। আক্ষরিক উদ্ধৃতি এই মূহূর্তে মনে নাই কিন্তু সারকথা হচ্ছে শুধু তত্ত্ব বা মতাদর্শ দ্বারা বৈপ্লবিক চিন্তা নিজেকে নিজে বাস্তবায়িত করতে পারে না, জনগণকেও তত্ত্বের প্রতি আকর্ষণ বা নৈকট্য বোধ করতে হবে। অর্থাৎ রাজনৈতিক বাস্তবতাকেও তত্ত্বের বাস্তবায়নের জন্য তৈরি হয়ে উঠতে হবে।

ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই আমাদের সাধারণ ভাবে সমাজে ব্যাক্তির বিকাশের রাজনৈতিক শর্ত যেমন তৈরি করছে, একই ভাবে ব্যক্তি স্রেফ সমাজ বিচ্ছিন্ন বা সমাজের বিপরীতে স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তা হিশাবে নয়, ‘জনগণ’-এর রূপ নিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করে চলেছে। আমরা কতোটা অর্জন করতে পারব এখনি বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ইতোমধ্যেই ‘জনগণ’ সকল রাজনৈতিক দলকে পেছনে ফেলে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে। এই অগ্রগতিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শুধু নয়, বিএনপিও যেন শ্লথ ও রুদ্ধ করতে না পারে সেই দিকেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। রাজনৈতিক চেতনার রূপান্তর যদি জনগণের মধ্যে ঘটা শুরু হয় তাহলে তার প্রভাব জনগণের যে অংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক তাদের মধ্যেও পড়তে বাধ্য। পড়ছেও বটে। একে ত্বরান্বিত করবার একমাত্র পথ হচ্ছে প্রতিহিংসার রাজনীতির একাট্টা বিরোধিতা করা। সংঘাত এবং সহিংসতা এড়ানো। বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আশা আকাঙ্খার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের এটাই বর্তমান বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় প্রধান কৌশল। দুই হাজার বাইশে গোলাপবাগ সফল হওয়ার এটাই ছিল প্রধান কারণ। 

এই লড়াইকে ‘গণতন্ত্র’(?) কায়েমের লড়াই বলা হলেও জনগণ আসলে কি চায়, তাদের অবস্থার পরিবর্তন কিভাবে করা সম্ভব, কিভাবে তারা তাদের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে -- ইত্যাদি বিষয় এখনও অস্পষ্ট ও অনির্ধারিত। বিএনপি রাষ্ট্রের ‘মেরামত’ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে গ্রহণ করলেও যে দেশে জনগণ নিজেদের রাষ্ট্র গঠন করবারই সুযোগ পায় নি সেই ক্ষেত্রে বিদ্যমান রাষ্ট্র  তো জনগণের নয়। জনগণ এই রাষ্ট্র বানায় নি, যাকে 'রাষ্ট্র' বলা হচ্ছে তা আসলে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া শক্তি ও কাঠামো। অতএব এটা পরিষ্কার থাকা দরকার যে  রাষ্ট্র জনগণের নয়, তার বোঝা বয়ে বেড়ানো বা তার কাঠামো 'সংস্কার' করবার কোন দায় জনগণের নাই। জনগণকে অবশ্যই রাষ্ট্র নতুন করে ‘গঠন’ (Constitute) করতে হবে এবং জনগণকে সেই ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করতে দিতে হবে। 

বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা সাংবিধানিক ভাবে শুধু একজন ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত তা না, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং সকল প্রকার বাংলাদেশ লুটপাটের বাহাদুরি একান্তই ঢাকা শহর ঘিরে।  এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। শুধু প্রেসিডেন্ট ও প্রধান মন্ত্রী, কিম্বা বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদের ক্ষমতার ভারসাম্য মোচন করলে হবে না, পুরা দেশের সকল জেলা উপজিলা ইউনিয়ন গ্রামের ওপর অর্থাৎ সর্বত্র জোঁকের মতো ঢাকা শহরের  ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর যে আধিপত্য -- পুরা দেশকে চুষে ছোবড়া বানিয়ে দেওয়া -- শহর ও গ্রামের এই অসম ক্ষমতার ভার ও 'কাঠামো' সবার আগে চুরমার করতে হবে। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রের বিপরীতে ক্ষমতা চর্চা ও প্রশাসনে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হলে রাষ্ট্রের সংস্কার নয়, বরং নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের বিকল্প নাই। রাজধানীকেন্দ্রিক চরম কেন্দ্রীভুত ক্ষমতাসম্পন্ন এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে দুই কক্ষ চাপিয়ে দিলে সেটা আদৌ সংস্কার কিনা সেটা আমাদের ভাবতে হবে। সেই রাষ্ট্রও লুটেরা ও মাফিয়াদের রাষ্ট্রই হবে। লুটেরা ও মাফিয়া গোষ্ঠির সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়া জাতীয় রাজনৈতিক দল হিশাবে বিএনপির নিজের টিকে থাকাও অসম্ভব। আমরা যেন এই সকল বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে না বসি। ক্ষমতা চর্চা ও প্রশাসনের সকল স্তরে জনগণের শক্তিশালী অংশগ্রহণের ব্যবস্থা ছাড়া স্রেফ উপরি উপরি সংস্কার কোন ফল দেবে না।

‘জনগণ’ আলুর বস্তা নয়, তাদের মধ্যে শ্রেণীভেদ আছে, নারী-পুরুষ ভেদ আছে, অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিযোগিতা আছে, ইত্যাদি। তবুও দুটো দিক পরিষ্কার। এক. সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই সরকারকে চায় না। দুই.‘জনগণ’ কোন বিমূর্ত রাজনৈতিক ধারণা বা বর্গ নয়। তাদের গঠন ও পরিগঠনেরও নিজস্ব ইতিহাস আছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘জনগণ’ তারাই যারা ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ছে। আর যারা ফ্যাসিবাদ লালন করে, ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায়, তারা জনগণের দুষমণ। বিএনপির সঙ্গে জনগণের অথবা গণরাজনৈতিক ধারার ঐক্যের জায়গা আপাতত এইটুকুই। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতারও দ্রুত বদল ঘটে। জনগণ কতদূর যাবে সেটা আমরা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে দেখব।

শ্রেণীভেদ, নারী-পুরুষ ভেদ অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিযোগিতা ছাড়াও বলাবাহুল্য ক্ষমতাসীনরা পুরানা কায়দায় রাজনৈতিক বিভাজনকে অস্পষ্ট করে দেবার চেষ্টা করবে। যেমন, সেকুলার বনাম ইসলামপন্থি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বনাম বিরোধী, ইত্যাদি। সেই দিক থেকে বিএনপি পরিষ্কার যে কথা বলছে আমাদের সমালোচনা থাকলেও তা জাতীয় রাজনীতিতে বড় অগ্রগতি। বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা বলছে, “…দেশপ্রেমের শপথে উজ্জীবিত এক সুকঠিন জাতীয় ঐকমত্য (National Consensus) প্রতিষ্ঠা ব্যতীত কোনো একক দলের পক্ষে বর্তমান বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও রাজনৈতিক কাঠামো পুনঃগঠন ও সংস্কার অত্যন্ত কঠিন”। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় আমরা এই উপলব্ধির সঙ্গে ১০০ ভাগ একমত।

কিন্তু দেশপ্রেমের শপথে উজ্জীবিত এক সুকঠিন জাতীয় ঐকমত্য কথাটার মানে কি আসলে? কাদের মধ্যে ঐক্য? রাজনৈতিক দলের? নাকি জনগণের? পরের কিস্তিতে আমরা তা আলোচনা করব? (চলবে)।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।