৬. বিএনপির 'রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা'


এর আগের কিস্তিতে আমরা একটি বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছি। আমরা দেখছি বর্তমান ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বিএনপিসহ সেকুলার জোট ও দলগুলো ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলা এবং ইসলামপন্থি দলগুলোকে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করবার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করছে না। একে আমরা জাতীয় রাজনীতির বিপজ্জনক প্রবণতা বলে মনে করি। ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলার নানান দিক আছে। আমরা বিশেষ ভাবে রাজনৈতিক কর্তব্য হিশাবে ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলার গুরুত্ব উপলব্ধি না করা এবং জাতীয় রাজনীতিতে ইসলাম প্রশ্ন অবহেলার কথা বলছি। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলার অর্থ কী?

ইসলাম প্রশ্ন রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার অর্থ হচ্ছে ইসলামের ঐতিহাসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক চিন্তা ও অবদান আমলে নিয়ে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশের জনগণের মনোজগতের স্বরূপ নির্ণয়ের কাজ সম্পন্ন করা। অন্যদিকে ইসলাম যেন বাঙালি জাতিবাদের মতো ইসলামকেও সংকীর্ণ জাতিবাদ বা পরিচয়বাদে পর্যবসিত করতে না পারে সে সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকা। বাংলাদেশে আমরা এখনও জাতিবাদী ও জাতিরাষ্ট্র সংক্রান্ত রাজনৈতিক অনুমান বা বিশ্বাসের জগতে বাস করি অতএব ধর্মকেও  জাতিবাদ এবং অনায়াসে ফ্যাসিস্ট পরিচয়বাদে পর্যবসিত করি। জাতিবাদের যুগে ফ্যাসিবাদ যেমন সেকুলার হতে পারে তেমনি ধর্মীয় রূপও পরিগ্রহণ করতে পারে। জাতিবাদের যুগে এটা সাধারণ বা স্বতঃস্ফুর্ত একটি প্রবণতা। ইসলাম জাতিবাদী দুর্দশায় পতিত হলে বাঙালি বা হিন্দু জাতিবাদের মতো ইসলামও ফ্যাসিস্ট মতাদর্শে পর্যবসিত হবে। তাহলে বাংলাদেসে ইসলাম প্রশ্ন রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার অর্থ হচ্ছে ইসলামকে জাতিবাদী ও ফ্যাসিস্ট মতাদর্শে পর্যবসিত করবার বিরুদ্ধে ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলা এবং ইসলামের সার্বজনীন বৈপ্লবিক মর্ম যুক্তি, বুদ্ধি ও দার্শনিক পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে বিশ্বসভায় হাজির করবার হিম্মত অর্জন করা। 

বাংলাদেশের জনগণের মনোজগতের স্বরূপ নির্ণয়ের কাজ কথাটা আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে। রাজনৈতিক ভাবে ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলা শুধু ইসলামের ঐতিহাসিক, বৌদ্ধিক বা দার্শনিক পর্যালোচনা নয়। তবে ইসলাম বাঙালি সংস্কৃতিতে কিভাবে ভূমিকা রেখেছে বা বাঙালির চিন্তা ও সংস্কৃতিকে কিভাবে রূপদান করেছেন সেই সকল আলোচনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ইসলাম ও মুসলমানদের অবদান নিয়ে একাডেমিক পর্যায়ে প্রচুর কাজের দরকার আছে। দীনেশ চন্দ্র সেন যেমন করেছেন। এমনকি সাংস্কৃতিক বিচারের কাজের ক্ষেত্রও বিশাল। নজরুল কিভাবে গজল লিখেছেন কিম্বা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে মুসলমানদের অবদান ইত্যাদি নানান দিক থেকে আলোচনার দরকার রয়েছে। বলাই বাহুল্য হচ্ছেও কিছু কিছু; সেই সকল কাজ রাজনৈতিক কর্তব্যও বটে।

কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলা শুধু এই সকল জরুরি কাজ করা বোঝায় না। সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের হৃদয়বৃত্তি, ইচ্ছা, অভিপ্রায়, নীতি-নৈতিকতা, সংস্কৃতি ইত্যাদির পরিগঠনে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলাম কিভাবে ভূমিকা রাখে তার আলোকে আঞ্চলিক ও বিশ্ব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক জাতীয় রাজনীতির অভিমুখ নির্ণয় করাকেই রাজনৈতিক ভাবে ইসলাম প্রশ্ন মোকাবিলা বোঝায়। পরাশক্তি সমূহের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, পুঁজির বিশ্বব্যাপী স্ফীতি ও পুঞ্জিভবন, বিজ্ঞান ও টেকনলজি, সমর বিজ্ঞান, অস্ত্র উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদি বাস্তবতার আলোকে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি  হিশাবে বাংলাদেশের জনগণের  রাজনৈতিক-মনোগাঠনিক সত্তার স্বরূপ অন্বেষণ ও নির্ণয়ই এই ক্ষেত্রে প্রধান কাজ।  সেই রাজনোইতিক-মনোগাঠনিক সত্তার ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণ কিভাবে এবং কোন অর্থে নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি গণ্য করে সেটা নির্ণয় করা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি কথা বলে রাখা দরকার। বাঙালি জাতিবাদী পরিচয়ের বিপরীতে ধর্মকে জাতিবাদী বর্গ হিশাবে ব্যবহার করা এবং হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে  নিজেদের 'বাঙালি মুসলমান' হিশাবে হাজির করবার প্রবণতা ভুল ও সংকীর্ণ পরিচয়বাদিতা।। ইসলামকে জাতিবাদের গর্তে নিক্ষেপ করার  স্থূল ও  আত্মঘাতী পথ  আমাদের পরিহার করতে হবে। ইসলাম স্রেফ একটি ধর্ম বা পরিচয় নয়। ইসলামের ইতিহাস শুধু আরব্দের ইতিহাস নয়, একই সঙ্গে এই উপমহাদেশেরও ইতিহাস। অতএব ইসলাম শুধু মুসলমান্দের বিষয় নয়, উপমহাদেশের সঙ্গে ইসলাম নানান সম্পর্ক ও বন্ধনে আবদ্ধ।  ফলে ধর্মীয় জাতিবাদী সংকীর্ণতা আমাদের পরিহার করতে হবে।
এই বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করি না তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ইসলাম জনগণের ইচ্ছা, অভিপ্রায় কামনা, বাসনা ও নীতিনৈতিকতাকে যেভাবে নির্ণয় ও গঠন করে তার রাজনৈতিক সম্ভাবনা কি? এই প্রশ্নের বিচারের মধ্যেই আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। অর্থাৎ বাংলাদেশে ইসলাম কি ধরণের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রণোদনা জনগণকে দেয় তার হদিস না নিলে বাংলাদেশকে আমরা কোন্‌ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাই সেটা বুঝব না আঞ্চলিক  ভূ-রাজনীতি এবং বিশ্ব রাষ্ট্র সভায় কিভাবে আমরা  টিকে থাকতে চাই তা নির্ণয় করা যাবে না।
অতএব ইসলাম প্রশ্নের মোকাবিলা সংক্ষেপে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশের জনগণের স্বরূপ নির্ণয় বোঝায়। এটিই বাংলাদেশে এখনকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ। কারণ এর দ্বারাই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের একটা অর্থ দাঁড়ায়। কারন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দাবি করে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ই গণতন্ত্রের বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি। তাহলে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় কি তা বুঝতে হলে আমাদের অবশ্যই ইসলামের কি রূপ জনগণ বাংলাদেশে দেখতে চায় সেই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে। করতেই হবে। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজিয়ে রাখলে তুফান এড়ানো যায় না। বাংলাদেশ একটি আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছে। সেকুলার জাতিবাদিরা যদি মনে করেন একটি অঘোষিত গৃহযুদ্ধ জারি রেখে তারা ইসলাম প্রশ্ন আড়াল করবেন এবং বাংলাদেশে ইসলাম রুখে দেবেন, তারা দিবাস্বপ্ন দেখছেন। আমরা ইতোমধ্যে শাহবাগ ও শাপলা চত্বর পার হয়ে এসেছি।
এই উপলব্ধি থেকেই আমরা বার বার বলছি সেকুলার ও ফ্যাসিস্ট বাঙালি জাতিবাদী ধারা বাঙালির মনোজগত নির্ণয়ের কঠিন ও পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজ না করে বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা ও চেতনা বিকাশের প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে বিরাজ করছে, যার প্রতিক্রিয়া হিশাবে বাংলাদেশে জাতিবাদী ইসলামি ধারা বা সংকীর্ণ পরিচয়বাদী ইসলামি ধারা শক্তিশালী হয়ে উঠতে বাধ্য। ইসলাম প্রশ্ন মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলে বাঙালি জাতিবাদের বিপরীতে ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক প্রবণতা বা ধারা হিশাবে পরিচয়বাদী জাতিবাদী ইসলাম অনিবার্য কারণেই শক্তিশালী হবে।
ইসলাম জাতিবাদ বরদাশত করে না, অথচ ইসলামের ঝান্ডা নিয়েই ধর্মীয় জাতিবাদ শক্তিশালী হবে। এই সম্ভাবনাকে মোকাবিলা করতে হলে ইসলামী দলগুলোকে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী লড়াইয়ে সম্পৃক্ত করা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিএনপি সহ সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলো সজ্ঞানে ইসলামপন্থি দলগুলোকে বর্তমান আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে দূরে রাখছে। এই নীতি ও কৌশলের আমরা কঠোর সমালোচনা করি। বিএনপি সহ সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলো এই কাজ করে পাশ্চাত্য পরাশক্তি ও দিল্লীর সমর্থন পাবার আশায়। ভারত কিম্বা মার্কিন পরাশক্তির সমর্থনে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বাংলাদেশের জন্য বিপপজ্জনক।
আমরা মনে করি আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের রাজনীতি সঠিক। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে ইসলাম প্রশ্ন অস্বীকার বা অবহেলা একান্তই সেকুলার, লিবারেল ও পাশ্চাত্য পরাশক্তিমুখি প্রবণতা। এই প্রবণতা বিএনপি ও বর্তমান সরকার বিরোধী আন্দোলন নস্যাৎ করতে পারে এবং আন্দোলনের জন্য বুমেরাং হতে পারে। বিএনপির এযাবতকালের অর্জনও নস্যাৎ হতে পারে। এর অনিবার্য পরিণতি হবে ইসলামপন্থি দলগুলোকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করবার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে দেওয়া। শেখ হাসিনা এই সুযোগপুরাপুরি গ্রহণ করবেন। সম্প্রতি আওয়ামি নেতাদের ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্বন্ধ বাড়াবার উদ্যোগ এবং ইসলামি দলগুলোর পারস্পরিক কলহ ও ঝগড়াঝাঁটি নিরসন করে ঐকবদ্ধ হবার আহ্বান সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। ইসলাম প্রশ্নের মীমাংসার ক্ষেত্রে বিএনপি সহ সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলোর অবহেলা ও অক্ষমতা আগামি দিনে তাদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ হয়ে উঠবে। মার্কিন ও ন্যাটো জোটভূক্ত পরাশক্তির সহায়তায় ‘রেজিম চেইঞ্জ’-এর স্বপ্ন চুরমার হয়ে যেতে পারে। আমাদের অবশ্যই ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে, এর কোন বিকল্প নাই। কোন বিদেশি শক্তির ওপর নয়।
বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারা বিকাশের ক্ষেত্রে তাহলে আমাদের কাজ কি?

রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের পরিগঠনের জন্য ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা বিরোধী আন্দোলনে ইসলামী দলগুলোকে অর্থপূর্ণ ভাবে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজে ব্যর্থ হলে জাতীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ সম্ভব না। ধর্ম বনাম সেকুলারিজমের বৈরি বাইনারি বাংলাদেশে কার্যত একটি গৃহযুদ্ধাবস্থা জারি রেখেছে। এই অবস্থা নিরসন এবং বর্তমান রাজনৈতিক পর্যায় অতিক্রম করা গেলেই জাতীয় রাজনীতিতে গণরাজনৈতিক ধারার আবির্ভাব এবং ‘জনগণ’-এর পরিগঠন সম্ভব।

রাজনৈতিক অর্থে ‘জনগণ’ কোন সংখ্যা বা আলুর বস্তা না। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারাই ‘জনগণ’ যারা ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী লড়াইয়ে যুক্ত কিম্বা এই লড়াইয়ের সমর্থক। বিশেষত যারা বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ নতুন ভাবে ‘গঠন’ করবার জন্য লড়ছে।

মোটা দাগে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিকে যদি গণমুখী করতে হয় বা গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ ঘটাতে হয় তাহলে তিনটি পর্যায়ে আমাদের গণসচেতনতা এবং গণপ্রতিরোধ বাড়াতে হবে।

১. একটি হচ্ছে বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিজমসহ সকল কিসিমের পরিচয়বাদী ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকা। আধুনিক জাতিবাদ শুধু সেকুলারদের ফ্যাসিস্টে পরিণত করে না, একই সঙ্গে ইসলামকেও সমগ্র মানবজাতির মুক্তির আদর্শ ও চর্চার ঐতিহ্য থেকে সরিয়ে স্রেফ জাতিবাদী-পরিচয়বাদী ফ্যাসিস্ট মতাদর্শে পরিণত করে। সেটা প্রধানত ঘটে ইসলামের আবির্ভাব কালের বৈপ্লবিক মর্ম এবং তার পরে ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য পর্যালোচনা ও বোঝাবুঝির মারাত্মক অভাব থেকে। পুঁজিতান্ত্রিক জমা্নায় মানুষ আল্লাহর নয়,পুঁজির দাসে পরিণত হয়। এর ফলে পুঁজি মানুষের ইহলৌকিক জীবনে যে অনিবার্য অসহায়তা তৈরি করে এক শ্রেণীর পরকাল ব্যবসায়ীরা তার সুযোগ গ্রহণ করে। তাদের দাপট ও আধিপত্য বাড়ে। ইসলাম ক্রমশ ইহলৌকিক জীবনের সমাধান দিতে ব্যর্থ হয় এবং পারলৌকিক কাল্টে পর্যবসিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি গভীর ও ব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে। এর ফ্যাসিস্ট অভিব্যাক্তি ঘটে ধর্মীয় জাতিবাদে। ইসলাম বা ‘মুসলমান’ তখন বিধর্মীদের বিপরীতে স্রেফ পরিচয় সর্বস্ব জাতিবাদী মতাদর্শ হিশাবে হাজির হয় এবং নিজেদের সংকীর্ণ ধর্মীয় পরিচয়বাদের গর্তে নিক্ষেপ করে। অথচ ইসলাম ‘জাতিবাদ’ বরদাশত করে না, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং ইনসাফের কথা বলে। সাম্য, মানবিকতা এবং ইনসাফ কায়েমের রাজনীতি একান্তই ইসলামী রাজনীতি, অথচ এই রাজনীতির গায়ে কোন ধর্মীয় পরিচয়বাদী জোব্বা পরানোর প্রয়োজন পড়ে না।

২. দ্বিতীয় দিক হচ্ছে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে গণশক্তি পরিগঠনের লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রামের নীতি ও কার্যকর কৌশল নির্ণয়। অর্থাৎ আমাদের অবশ্যই ফ্যাসিস্ট শক্তি ও গণশক্তির পার্থক্য পরিষ্কার বুঝতে হবে। এই পার্থক্য সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং জনগন যেন পাল্টা ফ্যাসিস্ট ও প্রতিহিংসা পরায়ন ‘ভিড়’ (Mob) না হয়ে ওঠে সেই বিষয়ে এখন থেকেই জনগণকে হুঁশিয়ার করা আমরা কর্তব্য গণ্য করি।

৩. বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান, রাষ্ট্র ক্ষমতা ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার পর্যালোচনা এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা আমলে নিয়ে বাংলাদেশে সম্ভাব্য গণরাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তি ও রূপ কি হতে পারে সে সম্পর্কে বিপুল তর্কবিতর্ক আমরা উৎসাহিত করতে চাই,যেন ইতিবাচক জনমত গড়ে ওঠার বাস্তব শর্ত তৈরি হয়। সেই ক্ষেত্রে গ্রিক-খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা তথাকথিত আধুনিক রাষ্ট্রই আমাদের কপি-পেস্ট করতে হবে আমরা তা মনে করি না। ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার বিপরীতে জনগণের শক্তি বা গণশক্তি পরিগঠন এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎখাত করে বাংলাদেশের সকল জনগণের ধর্ম, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা ইত্যাদির আলোকে বাংলাদেশকে শক্তিশালী গণভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে নতুন ভাবে ‘গঠন’ করবার রাজনৈতিক তাগিদ তীব্র করাকে আমরা বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকি।

৩ জানুয়ারী ২০২২


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।