৭. বিএনপির 'রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা'


এক
রাজনৈতিক প্রস্তাবনা হিশাবে বিএনপির ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’- অতিশয় সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সেই গুরুত্বটুকু আমরা দিতে চাই। এর কারন হচ্ছে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এটি পেশ করা হয়েছে। জনগণ এই লড়াই থেকে বিএনপির কাছ থেকে কি পেতে পারে তার একটি ধারনা আমরা এই দলিলে পাই। অর্থাৎ আন্দোলনকে বেগবান করবার জন্য এই ধরনের রূপরেখা জনগণের সামনে হাজির করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের কাছে আন্দোলন সংগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ, তাই রূপরেখাকে আমরা প্রাধান্য দিতে চাই।

জনগণ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে ওঠে। এই কথাটা আমরা বারবারই বলি এবং বরাবরই বলতে চাই। বিশেষত আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জনগণ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শব্দাবলী, বর্গ ও বক্তব্য পর্যালোচনা করতে শেখে। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে সচেতনতা গড়ে ওঠে সেটা স্রেফ ব্যক্তি পর্যায়ের সচেতনতা নয়, বরং এই সচেতনতা সামষ্টিক। এই সামষ্টিক বোধ বিদ্যমান ক্ষমতার বিপরীতে নতুন ক্ষমতা বা নতুন গণশক্তি বিকাশের প্রাথমিক শর্ত তৈরি করে। দ্বিতীয়ত আন্দোলন-সংগ্রামের দ্বারাই ‘জনগণ’ কথাটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক তাৎপর্য পরিগ্রহণ করে। জনগন বলতে আমরা যেভাবে দলা পাকানো বা দলাবাঁধা মানুষের দঙ্গল বা সংখ্যা বুঝি আন্দোলন-সংগ্রাম সেই বিমূর্ত আন্দাজ থেকে জনগণকে দুভাবে বিভক্ত করে। এক ভাগ বিদ্যমান ক্ষমতা বা ক্ষমতাসীন শক্তির উপকারভোগী। অন্য ভাগ দমন পীড়ন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমখুন ও নানান দুঃশাসনের বিরোধী। তারাই ‘জনগণ’ যারা শুধু নিজের জন্য না, সকলের মুক্তির জন্য লড়ে। তাদের লড়াইয়ের মধ্যে বিশেষ দেশকালে পুরা সমাজের স্বার্থ নিহিত থাকে। তাই বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই জনগণকে অনিবার্য ভাবেই দুই ভাগে ভাগ করতে বাধ্য। এক পক্ষ সমাজের সামষ্টিক বা সাধারণ স্বার্থের অভিমুখি, যাদের আমরা ‘জনগণ’ বলে থাকি। অপর পক্ষ ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহাল রাখবার শক্তি। ‘জনগণ’ এই ভাবে রাজনৈতিক অর্থে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মরিয়া, বিদ্যমান ব্যবস্থার সুবিধা বা মাখন তুলে নেবার স্বার্থ তারা রক্ষা করতে চায়। অপরপক্ষে, যারা ক্ষমতা ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ছে তাদের লড়াইয়ের মধ্যে সমগ্র জনগণের স্বার্থ বিরাজ করে। জনগণের বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিশা আর নির্দেশ ফুটে ওঠে।

ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই দীর্ঘদিনের। বিএনপি বিরোধী দল হিশাবে নিজেও সেই জুলুমের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা একদিনে গড়ে ওঠে নি। গড়ে ওঠার ধারাবাহিকতায় বিএনপির নিজেরও অবদান রয়েছে। কিন্তু যে দিকটা আগামী জাতীয় রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেটা হোল দীর্ঘ সময় ধরে দমন পীড়ন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমখুনের শিকার হয়ে রাজনৈতিক চেতনা ও রাষ্ট্র ভাবনায় বিএনপির আদৌ কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা সেটা আমাদের বোঝা দরকার। বোঝা দরকার ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে বিএনপি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে এখন আদৌ সমর্থ কিনা। সেই ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট আশাবাদী না হলেও বিএনপি বলেছে ‘দেশের মানুষ ও জাতির মুক্তির প্রয়োজনে’ তাদের তরফে ‘রাষ্ট্র মেরামতের প্রস্তাব’ করেছে। কিন্তু এটি ‘একটি অতি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা’। এই ‘রূপরেখা’ নিয়ে আরও অনেক কাজ করবার রয়েছে। বিএনপি জানিয়েছে, ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের এই রূপরেখা অধিকতর সমৃদ্ধ করতে’ বিএনপি ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে’ সকলের ‘ গঠনমূলক পরামর্শ’ সাদরে গ্রহণ করবে। আমরা তাই আন্তরিকতার সঙ্গে ‘রূপরেখা’ পর্যালোচনার দায় বোধে করেছি, আমাদের পর্যালোচনা তুলে ধরছি।

দ্বিতীয়ত বিভিন্ন ছোটবড় সেকুলার বা প্রথাসিদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ দল বিএনপির ডাকে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয়েছে এবং হচ্ছে, একে আমরা সমর্থন করি। আমরা মনে করি ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাজিত করতে হলে ‘যুগপৎ’ আন্দোলন নয়, বাংলাদেশে ‘যৌথ’ আন্দোলনের শর্ত তৈরি করা সবার আগে জরুরী। আর ঠিক তার জন্যই বিএনপির 'রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা'র কঠোর পর্যালোচনা দরকার। কারন আন্দোলনের পক্ষ থেকেই এই রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছে। তাই আমরা মনে করি আন্দোলনের একক নেতৃত্ব দানকারী সংস্থা গড়ে তোলাই আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ে প্রথম ও প্রধান কাজ। বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখার পর্যালোচনা আমরা সেই তাগিদ থেকেই করছি। সমাজের নেতৃত্ব দানকারী সংস্থা এবং তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট হতে পারলে জনগণ বিপুল ভাবে আন্দোলনে যোগ দেবে এবং যোগ দেয়। ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে।

আমরা শুধু বিএনপির রাজনৈতিক চিন্তা বা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখার ভালমন্দ নিয়ে চিন্তিত না। ব্যবহারিক রাজনীতির সূত্র ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক ভাবে সমাজের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা বিকাশে আমরা আগ্রহী। আমাদের পর্যালোচনাও সেই উদ্দেশ্যে। কারণ রাষ্ট্র সমাজের চিন্তাচেতনার বাইরের কিছু না। অতএব কিছু গোড়ার রাজনৈতিক বিতর্ককে সামনে নিয়ে আনতে আমরা আগ্রহী। তাত্ত্বিক আলোচনা বা বিতর্ককে ব্যবহারিক রাজনীতির আলোকে এবং একই ভাবে ব্যবহারিক রাজনীতিকে তাত্ত্বিক বিচারের দিক থেকে বোঝা দরকার। সমাজের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা বিকাশের এটাই পথ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কি সম্ভব আর কি সম্ভব নয় চিন্তা ও বাস্তবতার বিচারের মধ্য দিয়েই জনগণ সেটা বুঝতে পারে এবং ইতিহাসে ভূমিকা রাখবার হিম্মত অর্জন করে।

দুই

বিএনপি ‘রূপরেখা’-র ১৯ নম্বরে জানিয়েছে “বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হবে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের 'জাতীয় স্বার্থ' কী,  'রূপরেখা'-র কোত্থাও সেটা খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও জাতীয় স্বার্থের ধারণা জাতিরাষ্ট্রের (Nation State) উত্থান ও আবির্ভাবের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু একালে তাকে 'জাতি'র সঙ্গে নয়, রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত করে বোঝা হয়। তাই জাতীয় স্বার্থ (National Interest)  বলতে রাষ্ট্রের স্বার্থ বোঝানো হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিসরে জাতীয় স্বার্থের ধারণা খুবই গোড়ার গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। সকলের স্বার্থ যদি এক হয় তাহলে মানব জাতির বহু রাষ্ট্রে বিভক্ত থাকার কোন যুক্তি থাকে না। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির 'রাষ্ট্র' হিশাবে টিকে থাকার ন্যায্যতা 'জাতীয় স্বার্থ' নির্ণয়ের সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক-দার্শনিক ধারনা হিশাবে একে অনেক সময় রাষ্ট্র সত্তার যৌক্তিক অভিমুখ (Reason of the State) হিশাবেও আলোচনা করা হয়।

মোটা দাগে জাতীয় স্বার্থ ধারণার দুটো দিক আছে। একটি হচ্ছে রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বা গাঠনিক দিক। কিভাবে আমরা নিজেদের একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অন্তর্গত বলে ভাবতে শিখব, যাতে আমাদের পরস্পরের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ় হয় এবং  বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় নিজেদের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা হিশাবে আমরা নিজেদের উপলব্ধি করতে পারি। বুঝতে পারি এবং বিশ্বসভায় নিজের স্থান পাকাপোক্ত করতে পারি। তার জন্য অবশ্যই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমাদের রাজনৈতিক সত্তার যৌক্তিক অভিমুখ সম্পর্কেও আমাদের সজ্ঞান ও সচেতন হতে হবে। আরেকটি হচ্ছে বাইরের দিক। সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য। তার মধ্যে রয়েছে আর্থ-সামাজিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়।

'জাতি' এবং 'জাতীয় স্বার্থ' বিশেষ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বর্গ যা 'জাতি' নামক আগাম বা পূর্ব নির্ধারত সত্তা অনুমান করে। বাংলাদেশ  কি বাঙালি জাতির' রাষ্ট্র?  নাকি এখানে ছোট বড় অনেক জাতি রয়েছে। শেখ মুজিবর সবাইকে 'বাঙালি' হয়ে যেতে বলেছিলেন, যেখান থেকে পাহাড়ের অবাঙালি জনগোষ্ঠি তাদের জাতিত্ব রক্ষার জন্য বাঙালিদের মতো হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ইতিহাসের প্রহসন হচ্ছে সকল জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি ধর্ম ইত্যাদি সহ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল অধিবাসীকে জিয়াউর রহমান 'বাঙালি' নয়,  'বাংলাদেশী' বলেছিলেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে সকলকে নিয়ে তাদের নিজ মাতৃভুমিতে শান্তিতে বসবাস করা। কারন সকলেই 'বাংলাদেশী'। ইতিহাসের প্রহসন হচ্ছে যে সমস্যা শেখ মুজিবর তৈরি করেছিলেন তার দায় এখন বিএনপির ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। এর কারন হচ্ছে জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশের জনগণকে জাতিবাদী পরিচয় থেকে বের করে এনে সকলকে বাংলাদেশের নাগরিক হিশাবে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। বিএনপি এর রাজনৈতিক মর্ম আদৌ উপলব্ধি করে কিনা তার কোন নজির নাই।

নিজেদের 'বাঙালি' না বলে 'বাংলাদেশী' বলা একই সঙ্গে জাতিবাদের গর্ত থেকে বের হয়ে আসা। আমরা তার মর্ম আজও বুঝে উঠতে পেরেছি কিনা সন্দেহ।  ইতিহাসের প্রহসন, যে সমস্যা শেখ মুজিবর উৎপাদন করেছিলেন তার আবর্জনা বিএনপি বহন করে চলেছে। নিজেদের 'বাঙালি' না বলে 'বাংলাদেশী' বলা শুধু জাতি পরিচয় থেকে রাষ্ট্রীয় পরিচয় পরিগ্রহণ করা নয়, একই সঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে ভাবতে শেখা এবং জনগণকে ভাবতে শেখানো। রাষ্ট্রের নাগরিক হিশাবে অন্য সকলের সঙ্গে সমান স্বীকৃতি এবং একই অধিকার ভোগ করার মধ্য দিয়ে জাতিসত্তার উর্ধে রাজনৈতিক সত্তার বিকাশ ঘটানো এবং ঘটাতে পারা। ভাষা, ধর্ম, নৃতত্ত্ব এতে মুছে যায় না। কিন্তু তা সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, ঘৃণা কিম্বা হিংসায় সহজে রূপ নিতে পারে না। বিপরীতে পরস্পরকে জানা, বোঝা এবং একই রাষ্ট্রে একসঙ্গে বাসের সঠিক তরিকা আবিষ্কার করা যায়। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের ভাবতে শেখার অর্থ নিজ নিজ জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির জাতিবাদী সংকীর্ণতা অতিক্রম করে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র এবং বৈচিত্র সহ বৃহৎ রাজনৈতিক পরিসরের অন্তর্ভুক্ত হতে পারা। এখানেই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থ নিহিত রয়েছে। জিয়াউর রহমান যে সম্ভাবনার বীজ রোপন করে দিয়েছিলেন বিএনপির রাজনৈতিক চিন্তায় তার ছিঁটেফোঁটাও অবশিষ্ট নাই।

অতএব 'বাংলাদেশী' হিশাবে জাতিবাদী বিচ্যুতি থেকে মুক্ত হওয়ার অর্থ একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিবাদী প্রবণতা থেকে মুক্তি । ভিন্ন ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও নৃতাত্ব্বিক বৈশিষ্ট্সম্পন্ন জনগোষ্ঠির সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে পারস্পরিক আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে বড় ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠি হিশাবে গড়ে ওঠা। জিয়াউর রহমান এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উপলব্ধির সূচনা করেছিলেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক মর্ম আমরা ধরতে পারি নি, বা বুঝি নি। নিজেদের বাঙালি না বলে 'বাংলাদেশী' বলাকে আমরা স্রেফ নাম বদল বুঝেছি। 

'জাতীয় রাষ্ট্রকে প্রাধান্য' দেবার পরপরই রূপরেখা দাবি করছে, "বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবেনা এবং কোন সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক ঢাল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে ভিন্ন মতের বিরোধী শক্তি এবং রাজনৈতিক বিরোধী দল দমনের অপতৎপরতা বন্ধ করা হলে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হবে”। দেখা যাচ্ছে 'জাতীয় স্বার্থ' রক্ষা মানে সন্ত্রাস দমন।

বাংলাদেশ কোন সন্ত্রাস বা সহিংসতার ক্ষেত্র হবে না, এই আশ্বাস বাংলাদেশের জনগণের তরফে বিশ্ববাসী ও প্রতিবেশীদের বিএনপির আশ্বস্ত করা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি। বিএনপি ‘শান্তিপূর্ণ’ মহাসমাবেশ করেছে। আমরা তার গুরুত্ব স্বীকার করেছি। কিন্তু সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসবাদকে নিছকই রাষ্ট্রীয় আইনশৃংখলা বা শাসন ব্যবস্থার বিষয় ভাবলে বিএনপি মারাত্মক ভুল করবে। বাংলাদেশকে ধর্মীয় সন্ত্রাস বা সহিংসতার উর্বর ক্ষেত্র থেকে বের হবার দুটো নীতিগত পদ্ধতি আমাদের শক্ত ভাবে নিতে হবে। প্রথম কাজ হচ্ছে সকল প্রকার জাতিবাদী বা পরিচয়বাদী মতাদর্শ এবং তার প্রণোদনায় গড়ে ওঠা ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের বিরোধিতা। এ যাবতকাল উচ্চ বর্ণের হিন্দুর হাতে তৈরি ইসলাম বিদ্বেষী এবং ইসলাম নির্মূল রাজনীতির ধারক ‘বাঙালি জাতিবাদ’এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া বা একই মুদ্রার অপর পিঠ হিশাবে হাজির পরিচয়সর্বস্ব ধর্মবাদ বা ধর্মীয় জাতিবাদ। ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেই প্রয়োজনীয়তা আমরা যথেষ্ট পরিমান বোধ করি নি। ইসলামকে জাতিবাদ ও পরিচয়বাদের খোপ থেকে বের করে আনার ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্তব্য আমরা সাধারণত বোধ করি নি। এই অভাব অতিশয় বিপজ্জনক। এতকাল ক্ষমতাসীন শক্তি বাঙালি জাতিবাদকে ফ্যাসিস্ট শক্তির পরিগঠনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে। কিন্তু শাহবাগের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের মধ্য দিয়ে যে ধর্মবাদী জাতিবাদ উত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাকে মোকাবিলার জন্য আমরা প্রস্তুত না। অথচ পরিচয়বাদ বা ধর্মবাদী জাতিবাদের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই। ইসলাম জাতিবাদী বা পরিচয় সর্বস্ব ধর্ম বা আদর্শ না। সাধারন জনগনের কাছে এই বিষয়টি মোটেও পরিষ্কার নয়।

বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা শুরু হয়েছে ‘চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, জ্বালানি, গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন ও বিদ্যুতের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়া, পরিবহণ ব্যয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি’ পাওয়া ইত্যাদি নিয়ে।

সবকিছুর ‘নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধি’ অবশ্যই সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস তুলেছে এবং এর বিহিত অতি জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা দরকার শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা, আগুনে পুড়ে মরা, দালান ধসে পড়ে জীবন্ত কবর হয়ে যাওয়া এবং নিত্যদিনের নির্যাতন, ও বঞ্চনার ব্যাপারে বিএনপির ২৭ দফাতে কোন টুঁ শব্দটিও নাই। বিএনপির কাছে শ্রমিকদের সমস্যা জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার সমস্যা থেকে আলাদা কোন সমস্যা না। কিন্তু সেটা তো সুনির্দিষ্ট ভাবে শ্রমিক সমস্যা না – সকলেরই— অর্থাৎ বাংলাদেশেরই অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যা। বিএনপির কাঠামো সংস্কার পড়লে মনে হয় মুদ্রাস্ফীতি ছাড়া শ্রমিকের কোন আলাদা সমস্যা নাই। কিম্বা শ্রমিকের সুনির্দিষ্ট সমস্যা অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে আলাদা এই ন্যূনতম হুশটুকুও বিএনপির নাই। থাকতে পারে তার কোন ইঙ্গিত, ইশারাও বিএনপির ‘রূপরেখা’য় আমরা পাই না। বাংলাদেশে ‘শ্রমিক’ নামক কিছু আছে তার কোন চিহ্ন বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। শুধু তাদের ১৭ নম্বর কর্মসূচিতে বিএনপি লিখেছে “মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে”। এই হোল ‘জনগণ’ নিয়ে বিএনপির ভাবনা। ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে শ্রমিকদের স্বার্থের পক্ষে কথা বলা এবং নিজেদের পক্ষে রাখা জরুরি – এই বুদ্ধিটুকুও আমরা বিএনপির মধ্যে দেখি না। আমরা এই বাস্তবতায় বাস করি।

বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে সরাসরি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। ফলে এর অর্থনৈতিক দুর্দশার সমাধান ‘অনির্বাচিত’ সরকারের পরিবর্তে ‘নির্বাচিত’ সরকার এলে কিচ্ছু যাবে আসবে না যদি বিএনপি বাংলাদেশের বর্তমান কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থা বা উদার অর্থনীতিবাদী নীতির (Neo Liberal Economic Policy) বিপরীতে অর্থনৈতিক বিকাশের ‘জাতীয়’ রূপরেখা কিম্বা কোন ‘জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের রূপরেখা’ আগে ঘোষণা না করে। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্গত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কিভাবে আমরা ‘জাতীয়’ রূপ দিতে পারি বা জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার দিকে পরিচালিত করতে পারি সেটাই বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বিএনপিসহ বিরোধী সবগুলো নির্বাচনবাদী রাজনৈতিক দল সবসময়ই বাংলাদেশের সমস্যাকে নিছকই নির্বাচনের সমস্যা হিশাবে হাজির করে, যেন ভোট দিয়ে জনগণ তাদের নির্বাচিত করে। তারা অনির্বাচিত সরকারের বিপরীতে ‘নির্বাচিত’ সরকার চায়। সেটা তারা সঙ্গত কারনে চাইতেই পারে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কিভাবে তারা জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে তার কোন চিন্তা বা চিন্তার ছিঁটেফোঁটা তাদের দাবিদাওয়া বা কর্মসূচির মধ্যে পাওয়া যায় না।

এটা শুধু বিএনপির সমস্যা না, সকল রাজনৈতিক দলেরই একই অবস্থা। শুধু তাই নয়, তাদের কারও আদর্শ বা কর্মসূচির মধ্যে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন খোদ রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কাঠামো উভয় ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে এবং ঘটিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে কোন হুঁশ দেখা যায় না। সবচেয়ে সৎ বা ফেরেশতাদের বসিয়ে দিলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনা সহজ নয়। বাংলাদেশের বাণিজ্য, মুদ্রা, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন নীতি নির্ধারণ করে আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ইত্যাদি। ফলে চাইলেও জনগণের মঙ্গল বা কল্যাণের জন্য সরকারের পক্ষে কোন জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশ নীতি প্রণয়ন, গ্রহন ও বাস্তবায়ন গ্রহণ করা সম্ভব না। খুবই কঠিন। অথচ এটাই বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু। এই এক বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ যার সমাধান জাতীয় ভাবেই আমাদের মীমাংসা করতেই হবে।

তিন
আমরা বাস করছি কাছাখোলা অবারিত বাজার ব্যবস্থায়। এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা ও মজবুত রাখার যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতি তাকেই নয়া উদারনৈতিক অর্থ ব্যবস্থার নীতি (Neo-liberal Economic Policy) বলা হয়। কিন্তু বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের কোত্থাও এই নীতি সম্পর্কে ছিঁটেফোঁটা এক অক্ষর কথা নাই। এই নীতির অধীনে বিএনপি কিভাবে দ্রব্য মূল্য কমাবে বা মূদ্রাস্ফীতি হ্রাস করবে? তাই বলা যায় রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের এই সকল দাবি অন্তঃসারশূন্য ও হাস্যকর। এর মারাত্মক বিপদ হচ্ছে জনগণকে ভুল বা মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কোন দেশের পক্ষেই সহজ হয় নি, কারন তা সহজও নয়। একে মোকাবিলার জন্য জনগণের সামনে সঠিক ও বাস্তব চিত্রই তুলে ধরতে হবে। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং অসম বিশ্ব ব্যবস্থার বিপরীতে ‘গণমুখি জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের নীতি ও কৌশল’-এর খসড়া প্রণয়ন করাই এই সময়ের সবচেয়ে জরুরী রাজনৈতিক কাজ। জনগণকে সেই নীতি প্রণয়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করবার ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই দরকার, এখনই। কারন বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতার মোকাবিলায় জনগণকে সঙ্গে রাখতে হবে। কাজটা মোটেও সহজ নয়। বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা মোচন করার আদৌ কোন ইচ্ছা বিএনপির আছে কিনা সেটা প্রমাণ করবার এটাই প্রথম এবং প্রধান নির্দেশক।

তাহলে ‘অনির্বাচিত’ সরকারের পরিবর্তে ‘নির্বাচিত’ সরকার এলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে সেটা মোটেও ঠিক না। এটাই বাস্তব সত্য। কিন্তু নির্বাচন অবশ্যই দরকার, নির্বাচন অর্থনৈতিক সংকটের কোন সমাধান করতে পারবে না। কিন্তু সমাধানের জন্য নির্বাচন রাজনৈতিক শর্ত তৈরি করতে পারে। ‘গণমুখি জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের নীতি ও কৌশল’-এর খসড়া প্রণয়ন একমাত্র জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই সম্ভব – এই আশ্বাসটুকু বিএনপিকে দিতেই হবে। এই খসড়া অর্থনৈতিক জাতীয় দলিল বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি এখন থেকেই তৈরি তার প্রমাণও বিএনপিকে পরিষ্কার ভাবে রাখতে হবে। কাজ এখনই শুরু করতে হবে।

জনগণ বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে সরাসরি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত বলার মানে এই নয় যে আমরা বর্তমান ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা মেনে নেব। বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতা থেকে অপসারন ছাড়া কোন জাতীয় কর্তব্যই আমরা সমাধান করতে পারব না। কিন্তু আশু কর্তব্যগুলো সম্পর্কে এখনই আমাদের ধারণা পরিষ্কার থাকতে হবে এবং এখনই কাজ শুরু করতে হবে।

‘অনির্বাচিত’ সরকারের জায়গায় ‘নির্বাচিত সরকার’ এলে বাংলাদেশের জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সমাধান হবে , মূদ্রাস্ফীতি থাকবে না – অর্থাৎ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে – এই ধরনের অন্তঃসার শূন্য মিথ্যা আশ্বাস বিএনপির দেওয়া ঠিক হয় নি। বিএনপি এই ধারণাই দিচ্ছে যে ক্ষমতায় যাওয়া বিএনপির মাথায় বিএনপি আর কোন চিন্তা ভাবনা নাই। বিশেষত পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন ও পরাশক্তি সমূহের স্বার্থের প্রতযোগিতা এড়িয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসন কিভাবে সম্ভব তার কোন চিন্তা ভাবনা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরেও বিরল। অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতা নিয়ে বিএনপির নিজেরও  কোন চিন্তা ভাবনা নাই। বিএনপি আদৌ কিছু ভাবে না। কিম্বা ভাববার কোন সামর্থ বিএনপির নেতৃত্বে নাই। বিএনপির এই ভাবমূর্তি বিএনপির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিএনপির সামর্থ নিয়ে জনগণের সন্দেহ নিরসন অবিলম্বে জরুরি। বিএনপির ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে’র দাবিগুলো বিচার করলে যেটা পরিষ্কার, সেটা হোল, বিএনপি অর্থনীতি ও রাজনীতির অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক বুঝতে অক্ষম। তাদের রাষ্ট্র মেরামতের দলিল ধরে ধরে সেটা বোঝানো সম্ভব। দলিলেই স্পষ্ট। তবে এই অক্ষমতা বিএনপির একার নয়, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ বা যৌথ আন্দোলনে যুক্ত সবগুলো দলেরই সমস্যা।

ফলে সারকথা হচ্ছে, বিএনপি নিজের আত্মসমালোচনা না করে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য আওয়ামী লীগকে একা দায়ী করতে পারে না। বিএনপি যদি শক্তিশালী গণ আন্দোলন গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে চায় তাহলে রূপরেখায় পরিষ্কার ভাবে বিদ্যমান নিউ লিবারেল ইকনমিক পলিসির বিপরীতে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল হিশাবে গণমুখী অর্থনৈতিক আদর্শ যতোটুকু হাজির করা সম্ভব বিএনপিকে তা করতে জানতে হবে। তবে এর জন্য বিএনপি বা লিবারেল দলগুলোকে আমরা দোষারোপ করতে পারি না। বাংলাদেশে কোন শক্তিশালী অর্থনৈতিক চিন্তার ধারা গড়ে ওঠে নি। ফলে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের নির্দেশেই আমাদের অর্থনীতি চলছে। অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্বন্ধ বিচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে মার্কস এবং তাঁর ছাত্র ও অনুসারীদের ধারা। রাজনৈতিক ধারা হিশাবে ‘বামপন্থা’ দুর্বল হতে পারে, কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে বা উচ্চতর শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে পলিটিকাল ইকনমির ওপর তরুণদের পড়বার বা পড়াবার কোন ব্যবস্থা নাই। বাজার ব্যবস্থার হিশাব নিকাশের বাইরে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক চিন্তা ভাবনা মুদি দোকানের খেরো খাতার হিশাব চর্চার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারে নি। বাংলাদেশের জন্য এটা খুবই দুর্ভাগ্যের ব্যপার।

চার

তাহলে আমরা দাবি করতে পারি বাংলাদেশের বর্তমান কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থা বা উদার অর্থনীতিবাদী নীতির (Neo Liberal Economic Policy) বিপরীতে অর্থনৈতিক বিকাশের ‘জাতীয়’ রূপরেখা কিম্বা ‘জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের রূপরেখা’ সবার আগে ঘোষণা করা দরকার। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্গত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কিভাবে আমরা‘জাতীয়’ রূপ দিতে পারি বা জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার দিকে পরিচালিত করতে পারি সেটাই বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত। কিন্তু বিএনপিসহ বিরোধী সবগুলো নির্বাচনবাদী রাজনৈতিক দল সবসময়ই বাংলাদেশের সমস্যাকে নিছকই নির্বাচনের সমস্যা হিশাবে হাজির করে। তারা শুধু ভোট চায়, যেন ভোট দিয়ে জনগণ তাদের নির্বাচিত করে আনে এবং তারাও সানন্দে লুটপাট করতে পারে।

বিএনপি অনির্বাচিত সরকারের বিপরীতে ‘নির্বাচিত সরকার’ চায়। সেটা তারা সঙ্গত কারনেই চাইতেই পারে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কিভাবে তারা জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে সেটা তাদের পরিষ্কার ভাবে বলতে হবে। এটা শুধু বিএনপির সমস্যা না, সকল রাজনৈতিক দলেরই একই অবস্থা। শুধু তাই নয়, তাদের কারও আদর্শ বা কর্মসূচির মধ্যে খোদ রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কাঠামো উভয় ক্ষেত্রেই পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন যে বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে এবং ঘটিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে কোন হুঁশ দেখা যায় না। সবচেয়ে সৎ বা ফেরেশতাদের বসিয়ে দিলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনা সহজ নয়। বাংলাদেশের বাণিজ্য, মুদ্রা, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন নীতি নির্ধারণ করে বান্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ইত্যাদি। জনগণের মঙ্গল বা কল্যাণের জন্য সরকারের পক্ষে কোন জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশ নীতি প্রণয়ন খুবই কঠিন। অথচ এটাই বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে আগে আমাদের করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে কোন দেশই পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বাইরে বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে বাস করে না।এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় অবস্থিত বিশ্বপুঁজির প্রান্তিক দেশগুলো্র পক্ষে বর্তমান এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় আদৌ অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগ আছে কিনা সেটাই গোড়ার প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত জনগণের দিক থেকে বোঝা দরকার বিএনপির আমল থেকে যে কাঠামোগত সংস্কার, অবাধ বাজার ব্যবস্থা ও নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে পাশ্চাত্য পরাশক্তির সেই অর্থনৈতিক আদর্শ থেকে বিএনপি একচুল পরিমান সরে এসেছে কিনা। কিম্বা সরে আসবার কোন রাজনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা বিএনপির আদৌ আছে কিনা? আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা যায় বিশ্বব্যাংকের প্রিয়ভাজন ও প্রতিভূ অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের আছর থেকে বর্তমান বিএনপি কতোটা মুক্ত হতে পেরেছে ? বিএনপিকে যেটা বুঝতে হবে বাংলাদেশের বর্তমান দুর্দশার জন্য আওয়ামী লীগ যতোটা দায়ী, বিএনপির আমলে শুরু হওয়া স্ট্রাকচারাল রিফর্ম ও নিউ লিবারেল ইকনমিক পলিসিও সমান ভাবে দায়ী। আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক নীতিমালা বিএনপির শুরু করা কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থা নীতির ধারাবাহিকতা মাত্র। পার্থক্য হচ্ছে বাকশাল আমলে আওয়ামী লীগ ‘সমাজতন্ত্র’ বলতে বুঝেছে কলকারখানা জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে দলীয় লুটপাট বা নিজেরা দ্রুত ধনী হয়ে যাবার ব্যবস্থা করা। নিউলিবারেল ইকনমিক জমানায় তারা তাদের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ আরও সুন্দর ভাবে চর্চা করতে পে্রেছে সেটা হোল অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রগুলোতেই তারা ‘দলীয় সমাজতন্ত্র’ কায়েম করেছে। একেই আমরা ‘দুর্নীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়ন’ বলছি। অর্থাৎ অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের সকল খাতকে দলীর করা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট ও পাচার করা, ইত্যাদি। নিউলিবারেল ইকনমিক পলিসির জমানায় আওয়ামী সমাজতন্ত্রের আধুনিক ডিজিটাল রূপ এ ছাড়া ভিন্ন কিছু হতে পারত না। আওয়ামী লীগের প্রপাগান্ডা মেশিন শক্তিশালী হবার কারনে লুটতরাজের কর্মলীলা মসৃণ হয়েছে। এটা পরিষ্কার যে নিউ লিবারেল ইকনমিক পলিসির শক্তিশালী পর্যালোচনা ছাড়া আমরা কোন ‘জাতীয় অর্থনীতি’-র পরিসর গড়ে তুলতে পারব না।

বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগের ডিজিটাল টেকনলজি এক ঢিলে বেশ কয়েকটি পাখি মারা বলা যায়। প্রথমত বিএনপিকে অনাধুনিক ও পশ্চাতপদ প্রমাণ করা। বিএনপির আমলে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনে দেরি করে বাংলাদেশকে ডিজিটাল টেকনলজির হাইওয়েতে ওঠার সুযোগ দেবার ক্ষেত্রে বিএনপির আমলে গড়িমসি হয়েছে। সেই প্রপাগান্ডা উঠতি ও পাশ্চাত্যমুখী তরুণ তরুণীদের প্রভাবিত করেছে। আওয়ামি লীগ তা বুঝতে পেরে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছে তরুণদের। ফলে তরুণদের বিশাল একটি অংশের কাছে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এটা এক নম্বর পাখি মারা। পুরানা সাফল্যে বুঁদ হয়ে বিএনপির ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ এখন ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশের রণধ্বণি দিতে শুরু করেছে। আমরা ডিজিটাল আছি, আরো ডিজিটাল হবো, আমরা আর ‘আন স্মার্ট’’ থাকব না। আওয়ামী লীগ আমাদের ‘স্মার্ট’ বানাবে।

আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বাংলাদেশ বানিয়ে দ্বিতীয় যে পাখি মারতে পেরেছে সেটা হোল নিমেষে দুর্নীতি ও লুটপাটের টাকা বিদেশে পাচার করা। ডিজিটাল টেকনলজি ফাইনান্সিয়াল ট্রাঞ্জেকশান এবং হুণ্ডি ব্যবসাকে খুবই সহজ করে দিয়েছে। এর পুরা সুবিধা আওয়ামী লীগ ভোগ করেছে। আওয়ামী লীগের ডিজিটাল হওয়া তাহলে দ্বিতীয় পাখি শিকার। তৃতীয় পাখি ডিজিটাল ব্যাংক এবং টাকা লেনদেন ব্যবসার মধ্য দিয়ে ডিজিটাল টেকনলজি নতুন লুটেরা শ্রেণী গড়ে তুলেছে তোলার সুবিধা করে দেওয়া। তারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির হাত শক্ত করে রেখেছে। একটা ডিজিটাল মাফিয়া রাষ্ট্রের রূপ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এখন পরবর্তী পাখি শিকারের জন্য আওয়ামী লীগ আমাদের ‘স্মার্ট’ বানাতে চায়।

বিএনপির 'রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা' হাজির করার পর আওয়ামী লীগ 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ে তুলবার প্রপাগান্ডা শুরু করেছে। 'ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ' থেকে আওয়ামী লীগ 'স্মার্ট ফ্যাসিবাদ'-এর পর্যায়ে উত্তরণের পরিকল্পনা হাজির করেছে। বিএনপির 'রূপরেখা' এই প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম নয়। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হতে চাইলে বিএনপিকে দেশ ও দশ নিয়ে আরও গভীর ভাবে ভাবতে শিখতে হবে।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।