প্রবাসী শ্রমিকদের বাদ দিয়ে কি এলডিসি থেকে উত্তরণ সম্ভব?


মার্চের ৫ থেকে ৯ তারিখে কাতার জাতীয় সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত হয় পঞ্চম স্বল্পোন্নত দেশের সম্মেলন। দোহার এই সম্মেলনে গিয়ে সরাসরি জানার সুযোগ হয়েছে কাতারে অবস্থানরত রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসী শ্রমিকরা কত কষ্টে আছেন। বড় বড় দালান, আকাশছোঁয়া বিল্ডিং আছে দোহায়। এসব দেখে মনে পড়লো আমাদের প্রবাসী ভাইদের কথা। তাদেরই শ্রমে-ঘামে এই বিল্ডিং এবং রাস্তা তৈরি হয়েছে। দোহার চাকচিক্য তাদেরই অবদান।

কাতারের দোহা শহরে অনুষ্ঠিত হলো পঞ্চম স্বল্পোন্নত দেশের সম্মেলন। মার্চের ৫ থেকে ৯ তারিখে কাতার জাতীয় সম্মেলন কেন্দ্রে এই আয়োজন করা হয়েছিল। আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান উবিনীগের পক্ষ থেকে তিন জন গিয়েছিলাম সিভিল সোসাইটি ফোরামে অংশগ্রহণের জন্য। মূল অনুষ্ঠানের পাশাপাশি স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় তুলে ধরা সিভিল সোসাইটি ফোরামের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ সরকার ৪৬টি স্বল্পন্নোত দেশের অন্যতম সদস্য, তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের ৯৬ সদস্যের একটি দল সেখানে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ করে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হবে, সেটা বিবেচনা করলে পরবর্তী সম্মেলনে বাংলাদেশকে নাও যেতে হতে পারে- এমন ধারণা করা হচ্ছে। ফিরে এসে মার্চের ১৩ তারিখ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই কথা বলেছেন।

স্বল্পোন্নত দেশের এই সম্মেলন ২০২১ সালে হবার কথা ছিল, কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা হয়নি। যদিও স্বল্পোন্নত দেশের জন্যে প্রোগ্রাম অব একশান (২০২২-২০৩১) ঠিক করা হয়ে গেছে ২০২২ সালের মার্চের ১৭ তারিখে এবং তা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এপ্রিলের ১ তারিখে গৃহিত হয়েছে। এতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় নি। এখন এই দোহা প্রোগ্রাম অব একশান (ডিপিওএ) সংশ্লিষ্ট সকল দেশকে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণের জন্যেই এই সম্মেলন । স্বল্পোন্নত ৪৬টি দেশের মধ্যে ৩৩টি বা ৭০% এর বেশি হচ্ছে আফ্রিকার দেশ, এশিয়ার ৯টি, প্যাসিফিক ৩টি এবং ক্যারিবিয়ান ১টি দেশ অন্তর্ভুক্ত । ফলে সকল আলোচনায় সংগত কারণেই আফ্রিকার দেশসমূহের সমস্যা প্রাধান্য পেয়েছে। আপাতত আমি সেসব বিষয়ে আলোচনা বাড়াচ্ছি না। আমি বাংলাদেশ প্রসঙ্গেই থাকছি।

বাংলাদেশের মানুষের কাছে, বিশেষ করে সাধারণ গ্রামের মানুষের কাছে দুবাই, দোহা, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নাম অপরিচিত নয়। এদেশের মধ্যবিত্ত ও ধনীরা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইউরোপের দেশের নাম বেশি জানে এবং সেখানে যাওয়ারই চেষ্টা করে, সেটা পড়াশোনার জন্যে হোক বা কাজের জন্য। কিন্তু গ্রাম থেকে তরুণদের একটি বড় অংশ আরব দেশে পাড়ি দিচ্ছে বছরের পর বছর কারণ তাদের পড়াশোনা বেশি নাই, দক্ষতাও কম। কেবল আছে শারিরীক শ্রম দেবার 'ক্ষমতা' এবং ইচ্ছা।

আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখেছি এই শ্রমিকরা অমানুষিক পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন যার গালভরা নাম হচ্ছে 'রেমিট্যান্স'। আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি যতটুকু পর্যায়ে এসেছে তাতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অস্বীকার করা বা খাটো করে দেখার কোন উপায় নাই। রপ্তানি আয়ের প্রায় ৩৫% রেমিট্যান্স থেকে আসে এবং বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি, এমনকি গার্মেন্ট শিল্পের অবদানের চেয়েও বেশি। কারণ গার্মেন্ট শিল্পের মাধ্যমে যা আয় হয় তার মধ্যে কাপড় আমদানিতে একটা বড় অংশ চলে যায়। প্রবাসী শ্রমিকের টাকা আসে যে ঘামের বিনিময়ে তা তার শরীরেই থেকে যায়।

দোহার এই সম্মেলনে গিয়ে সরাসরি জানার সুযোগ হয়েছে কাতারে অবস্থানরত রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসী শ্রমিকরা কত কষ্টে আছেন। আমি এর আগে এই প্রবাসী শ্রমিকদের দুবাই এয়ারপোর্ট, কিংবা দোহা এয়ারপোর্টে দেখেছি। ঢাকায় যখন তারা আসে প্লেন থামার আগেই তারা দাঁড়িয়ে যায় নেমে পড়ার জন্য, এতোই ইমোশনাল তারা; বিমান বন্দরে তাদের প্রতি অসম্মানসূচক আচরণ দেখি। তখন তাদের সাথে কখনও কথা বলেছি, কিন্তু অনুভব করতে পারিনি প্রবাসে থাকা অবস্থায় তাদের কষ্টের কথা। এবার দোহায় গিয়ে তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে কথা বলতে পেরেছি। স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হলে এই শ্রমিকদের ভাগ্যে কী হবে সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।

আমি আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভুতি থেকে কিছু বর্ণনা দিচ্ছি। আমাদের হোটেল থেকে শাটল বাসে করে সম্মেলন কেন্দ্র কাতার ন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে যাবার পথে যা দেখছি, তাতে প্রথমেই চোখে পড়ছে কোন গাছ নেই। খাঁ খাঁ করছে চারিদিক। গাছ বলতে খেজুর গাছ আর কিছু ফুলের গাছ; একটু বড় গাছ মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাতে চোখের কষ্ট কমছে না । মাটিও দেখি না, শুধু সাদা পাথরের কংকর। দামী জিনিস সন্দেহ নেই, কিন্তু মাটি যে আমাদের সোনার চেয়েও খাঁটি। বাংলাদেশে আমরা চারপাশে যে সবুজ দেখে অভ্যস্ত, এমনকি ঢাকা শহরের কংক্রিট বিল্ডিংয়ের ফাঁকেও যতটুকু সবুজ দেখা যায়, দোহা শহরে গিয়ে দেখলাম তাও নেই।

বড় বড় দালান, আকাশছোঁয়া বিল্ডিং আছে দোহায়। নানা রকমের আর্কিটেকচার, দেখতে সুন্দর সন্দেহ নেই। রাস্তাগুলো চওড়া। অনেকটা মানুষহীন। গাড়িগুলোও বেশ বাহারি। না, দোহা পুরোটা ঘুরে এমন মন্তব্য করছি না। সম্মেলন কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার পথেই এসব দেখেছি। এসব দেখে মনে পড়লো আমাদের প্রবাসী ভাইদের কথা। তাদেরই শ্রমে-ঘামে এই বিল্ডিং এবং রাস্তা তৈরি হয়েছে। দোহার চাকচিক্য তাদেরই অবদান।

যেই নির্মাণ শ্রমিকরা এসব বানিয়েছেন তাদের দেখা আমরা পাইনি। তবে কিছু প্রবাসী শ্রমিক পেয়েছিলাম কাতার ন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার এর বুফে লাঞ্চ এর বিশাল হল ঘরে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী কয়েক হাজার মানুষ এখানেই দুপুরের খাবার খেয়েছেন। আমরাও সেখানেই খাওয়া দাওয়া করেছিলাম। এখানে বেশ কিছু প্রবাসীদের সাথে সরাসরি দেখা হলো, কথা হলো। তারাই আমাদের দেখে হেসে এগিয়ে এসেছেন, জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশের কিনা। বাংলাদেশি জানতে পেরে সাথে সাথেই বাংলায় কথা শুরু করে দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করেছেন কী খাবো, কিছু লাগবে কিনা। তাদের আন্তরিকতায় আপ্লুত হয়েছি। এরা হচ্ছেন দোহায় বাংলাদেশের প্রবাসী 'শ্রমিক'। তাদের বেশিরভাগই অল্প বয়সের, ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হবে। বাড়ি ঢাকায়, লক্ষীপুর, রংপুর কত জেলায়…! দু'একজন একটু বেশি বয়সেরও আছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে কাতারে আছেন।

দোহায় স্বল্পন্নোত দেশের সম্মেলনে বিভিন্ন হোটেলের সৌজন্যে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট তাদের নিয়োগ দিয়েছে ক্যাটারিং সার্ভিসের জন্য। সম্মেলন যে কয়দিন চলবে ততদিনই তাদের কাজ থাকবে। এরপর কী হবে তারা জানে না । তবুও এতে তারা খুশি। গত বছরের ২০ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর দোহায় ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। আমরা বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখে আনন্দ উপভোগ করেছি, দোহার চাকচিক্য দেখেছি, চ্যাম্পিয়ন কে হচ্ছে তা নিয়ে মাতোয়ারা হয়েছি কিন্তু জানতে পারিনি যে সেখানে আমাদের দেশের যে শ্রমিকরা আছেন তাদের কী অবস্থা ছিল। তাদের সাথে কথায় জানলাম বিশ্বকাপের পর তাদের প্রায় সব কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোন কাজ ছিল না। এখানে কোন ইভেন্ট হলেই কাজ থাকে নইলে বসে থাকতে হয়। অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তারা বসে ছিলেন।

কাজ না থাকলে কী হবে? ঘরভাড়া আছে, খাওয়াদাওয়া তো করা লাগছেই। ঘরভাড়া ৩৫০-৪০০ রিয়েল বা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। বাংলাদেশের টাকায় ৩০,০০০ টাকা লাগছে থাকা খাওয়া বাবদ। খরচ কমাবার জন্যে এক রুমে ১০ জন কষ্ট করে থাকছে। "কী করবো? নিজে থাকবো আর আমাদের ভাইয়েরা রাস্তায় থাকবে তা তো হয় না।" দেশে আসা খরচের ব্যাপার। তাছাড়া অনেকের কাছে টাকা পাওনা থেকে যায়, গেলে তো আর ফিরে পাবে না। এ এক জটিল পরিস্থিতি।

কাজ না থাকলে দেশে ফিরে যাবেন সে অবস্থাও নেই। বিমান ভাড়া বেড়েই চলেছে। তারা দেখছেন নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা কাজ না থাকলে ১০০০ - ১২০০ কাতার রিয়েল খরচ করে যেতে পারে কিন্তু বাংলাদেশে যেতে হলে তাদের ২২০০ থেকে ২৫০০ রিয়েল (কমপক্ষে ৬৫০০০ টাকা) লাগছে। এত টাকা খরচ করে যাওয়া আসা সম্ভব নয়, তাই কষ্ট করে আবার কাজ পাওয়ার আশায় থেকে যাচ্ছেন।

কয়েকজনের মতে কাতারে এখন কাজ কম সেই সমস্যা তো আছেই, কিন্তু প্রবাসী হিসেবে তারা তেমন কোন সুযোগ সুবিধা পান না। তারা দেখছেন অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা কম খরচে আসতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আসতে হলে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ করে আসতে হয়, সে টাকা চার-পাঁচ বছর কাজ করেও শোধ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। শ্রমিকদের আসার খরচ না কমালে তারা রেমিট্যান্স পাঠাতে থাকবে কিন্তু তাদের ব্যাক্তিগত ঋণগ্রস্ততা ঘোঁচে না।

এই শ্রমিকরা আমাদের সাথে কথা বলতে পেরেই যেন খুশি হচ্ছেন, যদিও আমাদের সাধ্য নেই তাদের সমস্যার সমাধান করার। এক পর্যায়ে একজন বললেন, এখানে কেউ মারা গেলে তার লাশ দেশে পাঠাবার দায়িত্ববোধ থাকে না। তারা অনুরোধ জানান অন্তত লাশটা যেন দেশে পাঠানো হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি এ বিষয়ে ভেবেছেন কখনো?

এখানে সরকারের উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রীরা এসেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রীসহ উচ্চ পদস্থ আমলা, সংসদ সদস্য, সাংবাদিকরা ছিলেন। যারা এখানে খেতে এসেছিলেন তাদেরকেই প্রবাসীরা বলেছেন তাদের কষ্টের কথা। কাতারে তাদের অনেকসময় হয়রানি করা হয়। কাগজপত্র নেই বলে মিথ্যা মামলাও দিয়ে দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রীকেও তারা অনুরোধ করেছেন কাতার সরকারকে যেন এ বিষয়ে তিনি বলেন। আমি জানি না, সরকার মনে রাখে কিনা যে এঁদের টাকায় আমাদের ডলারের পরিমাণ বৃদ্ধ্বি পায়, খাজানা ভর্তি হয়। দেশে কাড়ি কাড়ি ডলার আসে। আর তাদেরই এই অবস্থা!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে তিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, আর্থিক সহায়তা, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, নিরাপদ অভিবাসন, জলবায়ু অর্থায়ন প্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের বিশেষ প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বাংলাদেশসহ উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর উন্নয়ন অর্জনকে গতিশীল রাখতে বর্ধিত সময়ে এলডিসিদের জন্য প্রযোজ্য অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এরমধ্যে প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকারের কথা নেই। এদের বাদ দিয়ে কি উত্তরণ সম্ভব হবে বা টিকিয়ে রাখা যাবে?

বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি ২০ মার্চ, ২০২৩ তারিখে 'প্রবাসী শ্রমিকদের বাদ দিয়ে কি এলডিসি থেকে উত্তরণ সম্ভব?' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।