বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা


‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা’ চটি পুস্তিকাটি মোহাম্মদ তোয়াহা (২ জানুয়ারি ১৯২২ - ২৯ নভেম্বর ১৯৮৭) গত শতাব্দির আশির দশকের মাঝামাঝি লিখেছেন। এটি প্রকাশিত হয়েছে ১লা অগাস্ট ১৯৮৫ সালে। বাংলাদেশের তরুণরা বাংলাদেশে বিপ্লবী কমিউনিস্ট ধারার চিন্তা ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানে না। এই পুস্তিকাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিপ্লবী কমিউনিস্ট ধারার বহু ভুলভ্রান্তি রয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান আমলে এবং পুরা ষাট ও সত্তর দশকে তাদের অবদান ছিল অসামান্য।  সামন্ততন্ত্র, আধা বা সামন্ততান্ত্রিক অবশিষ্ট – অর্থাৎ প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সকল সম্পর্ক উৎখাত করে উৎপাদন শক্তির গতিশীল বিকাশের জন্য তাঁরা লড়েছেন। একদিকে তাঁরা আর্থ-সামাজিক দিক থেকে প্রাচীন ও প্রাকপুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক উৎখাত করে পুরানা, পশ্চাৎপদ এবং পিছে টেনে ধরে রাখা অর্থনৈতিক সম্পর্কের নিগড় থেকে জনগণের মুক্তি চেয়েছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক ভাবে তাঁরা চেয়েছেন স্বাধীন ও মুক্ত ব্যক্তির উপযোগী আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কায়েম হোক, যাকে আমরা ‘গণতন্ত্র’ বলে থাকি। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে চেয়েছেন ব্যক্তির বিকাশ যেন সমষ্টি বা সমাজের বিপরীতে না হয় ; অর্থাৎ ব্যক্তি যে সমাজের মধ্যেই স্বাধীন, সমাজের বাইরে বা বিপরীতে নয় – ব্যক্তির মধ্যে এই সামাজিক চেতনার বিকাশ ঘটুক। গণতন্ত্রে সমাজবাদী চিন্তার শর্ত তৈরি হোক। প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে গতিশীল পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে প্রবেশের আগে এই সকল বিষয়ই ছিল আমাদের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয়। যেসকল কমিউনিস্ট তাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন তাঁরা কখনই 'তার আগেচাই চাই সমাজতন্ত্র' জাতীয় পেটিবুর্জোয়া রোমান্টিক প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যানধারণাকে প্রশ্রয় দেন নি। কমিউনিস্ট ইশতেহারের শেষের পাতাগুলোকে  মার্কস ও এঙ্গেলস 'পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্র'-কে মিন্দা করেছেন। এই ধরনের নানান কিস্মের সমাজতন্ত্রীদের 'প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র' পরিচ্ছে আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের যেসকল তরুণরা আগামি দিওনে ইতিহাস তৈরি করবেন, তারা পড়ে নিতে পারেন। কমিউনিস্ট হিশাবে মোহাম্মদ তোয়াহা সমাজতন্ত্র নয়, বরং গতিশীল অর্থনীতির জন্য গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করাকেই সবার আগে কর্তব্য গণ্য করেছেন। মোহাম্মদ তোয়াহা এখানে তাঁদেরকে সঠিক ভবেই তাঁর এই পুস্তিকায় ‘খাঁটি গণতন্ত্রী’ বলেছেন।

কমিউনিস্টদের ব্যর্থতার একটা বড় কারন হোল প্রতিক্রিয়াশীল পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির বাঙালি জাতিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ হিশাবে ‘সমাজতন্ত্র’ কায়েমের রণধ্বণি মতাদর্শিক এবং সাঙ্গঠনিক ভাবেমোকাবিলা করতে পারেন নি। ফলে বাংলাদেশের রাজনোইতিক ইতিহাসে তাঁরা গৌন হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতা ও ব্যররথতা থেকে আমামদের শিক্ষ্ণীয় রয়েছে। মনে রাখতে হবে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ দ্রুত পেটি বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে আকৃষ্ট করে। বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট মতবাদ ও শক্তির আবির্ভাবের ফলে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ধারা মার খেয়ে যায়। যার কাফফারা আমরা সকলেই এখন গুনছি।

আশা করি এই হারিয়ে যাওয়া বা মুছে ফেলা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সম্পর্কে তরুণ বিপ্লবীরা আরও জানবার চেষ্টা করবেন। না জানলে ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের নাড়ির বাঁধন তাঁরা মজবুত করতে পারবেন না। ইতিহাস পর্যালোচনা ছাড়া রাজনীতিতে ইতিবাচক কিছু করা অসম্বঝব। রাজনীতি হাওয়াই কারবার না। তাই মোহাম্মদ তোয়াহার রাজনৈতিক মূল্যায়নের এই ঐতিহাসিক দলিল আমরা এখানে পুনর্মূদ্রণ করছি।

মোহাম্মদ তোয়াহার সংক্ষিপ্ত পরিচয়

মোহাম্মদ তোয়াহা ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী এবং রাজনোইতিক আদর্শের দিক থেকে কমিউনিস্ট। তাঁর হাতেই সাম্যবাদী দল গড়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন অন্যতম ছাত্র নেতা

তিনি জন্মেছিলেন সেই সময়ের বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় লক্ষীপুরে। বর্তমান লক্ষ্মীপুর একটি জেলা, সেখানে রামগতি উপজেলার হাজিরহাট গ্রামে তোয়াহা জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী মোহাম্মদ ইয়াসিন এবং মাতা হাসনা বানু। তিনি ফরাশগঞ্জ স্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪১ সালে আইএ পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ১৯৫০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ফজলুল হক হলের উপ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন।

১৯৪৬ সালে মোহাম্মদ তোয়াহা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অধীনে সিলেট গণভোটে কর্মী হিসাবে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিপ্লবী ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের সাথে যুক্ত ছিলেন।

ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে মোহাম্মদ তোয়াহা অধিকাংশ পোষ্টার, নিবন্ধ, লিফলেট তৈরী করেছিলেন। ১১ মার্চ, ১৯৪৮ তারিখে যখন তোয়াহার নেতৃত্বে একটি দল সচিবালয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দিতে যায় তখন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পাকিস্তান আমলে পুলিশের দ্বারা নির্যাতীত হয়ে তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।

মোহাম্মদ তোয়াহা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির একজন নেতা ছিলেন। ফলে সরকারের সাথে সকল ধরনের বৈঠকে তিনি অংশ নিতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের তিনি ভিপি ছিলেন। সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদে তিনি যুব লীগের সংবাদদাতা ছিলেন। ১৯৫২ সালের শেষের দিকে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ তোয়াহা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন নামে একটি শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলেন এবং এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে তিনি আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জাতীয় আওয়ামী পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং পরে এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করার পরে তিনি গোপন রাজনীতিতে ফিরে আসেন। ১৯৬৯ সালে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় তিনি তখনকার নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর ও রামগতি অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। একই সঙ্গে ভারতীয় আগ্রাসন এবং আধিপত্য থেকে বাংলাদেশকে রক্ষ করা এবং বাংলাদেশকে ভারতের পরাধীন করবার পরিকল্পনা রুখে দেয়ার জন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গেও যুদ্ধ করেন। এর ফলে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিতর্কিত হয়ে আছেন।

স্বভাবতই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী হয়, তিনি আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৭৬ সালে তার গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হয়। এরপর তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে তিনি আট দলীয় মনোনীত প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন।

 মোহাম্মদ তোয়াহা ১৯৮৭ সালের ২৯শে নভেম্বর লক্ষ্মীপুরের রামগতির হাজিরহাটে মৃত্যুবরণ করেন।


বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা
মোহাম্মদ তোয়াহা

দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিগত বছরগুলিতে যে আন্দোলন চলে আসছিল সম্প্রতিকালে সে আন্দোলন-পরিস্থিতির কিছুটা গুণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অকল্পনীয় সংকটগ্রস্ত সামরিক আমলা চক্র এবং তার প্রতিপক্ষ উভয়েই গণতন্ত্রের নামে সোচ্চার। সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খাঁটি গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির মধ্যে সম্প্রতিকালে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটেছে। তারা নতুনভাবে পুনর্গঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবছেন। একদিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঠিক পথের প্রশ্নে প্রায় প্রতিটি দলের মধ্যে মতবাদ দেখা দিয়েছে, অপরদিকে বাস্তব অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতিতে সাম্যবাদী ও বামপন্থী দলগুলির মধ্যে ঐক্যের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উপরোক্ত পটভূমিতে খাঁটি গণতন্ত্রের সপক্ষ শক্তি কারা, ইতিহাসের আলোকে তার একটা বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

১৯৪৭ সালে তৎকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পটভূমিতে বাংলার কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন, বিহারে কৃষক আন্দোলন, তেলেঙ্গানায় সশস্ত্র লড়াই, বোম্বের নৌ বিদ্রোহ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদের পরাজয় ও পাশ্চাত্যের সম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের পলায়মান অবস্থায়, যে শ্রেণীশক্তি এ দেশে ক্ষমতাসীন হয়েছিল তারা গণতন্ত্রের সপক্ষ ছিল না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুগ্রহভাজন ও তার অনুগত সামন্ত-মুৎসুদ্দি শ্রেণীকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। তাদের মাথার উপর সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিক ও সামন্ত-মুৎসুদ্দি শ্রেণীস্বার্থের পাহারাদারীর ধারাবাহিকতা বহনকারী সামরিক-আমলা বাহিনীকে পাহারাদার হিসেবে বসানো হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে ব্যাপক জনগণ যখন সাম্রাজ্যবাদীদের দলটি বাহক চক্রকে উচ্ছেদ করল তখন সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ ও নির্দেশে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক আমলা বাহিনী জনগণের নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদ করে সামরিক আমলাতন্ত্রকে ক্ষমতাসীন করল। শুরু হলো সামরিক আমলাবাহিনীর রাজত্ব। সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে খাঁটি গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহকে কারারুদ্ধ করা হলো এবং সামরিক আমলাবাহিনী তথা সাম্রাজ্যবাদের অনুগত কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী নানা অপকৌশলে যুক্ত ফ্রন্টে তথা গণ ঐক্যে ভাঙ্গন ধরালো। বিভিন্ন অঙ্গদলের দুর্বলচিত্ত নেতৃবৃন্দ সামরিক আমলা বাহিনীর অধীনে সাম্রাজ্যবাদীদের নির্দেশ পালনের শর্ত মেনে নিয়ে পুনরায় পার্লামেন্টারি সরকারে পুনর্বাহল হলেন। কিন্তু ওয়াশিংটনের নির্দেশে একের পর এক সরকার ভাঙ্গাগড়ার খেলা চলল ১৯৫৮ সালের ৮ই অক্টোবর পর্যন্ত। এইভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম ১২ বছরে কেন্দ্রীয় প্রদেশে ১৩টি সরকারের পতন উত্থান ঘটলো। ইতিমধ্যে গণদাবীর পটভূমিতে দেরিতে হলেও ১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে তৎকালীন পাকিস্তানের উভয় অংশে একত্রে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও তার নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী প্রস্তাবিত নির্বাচনকে ভয়ের চোখে দেখেছিল। কেননা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা পুরো মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। কেন্দ্রীয় শাসকচক্র তাই সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচি বাতিল করে ১৯৫৮ সালের ৮ই অক্টোবর জেনারেল আইয়ুবকে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করালো। আইয়ুব ক্ষমতায় এসে সাম্রাজ্যবাদের ফর্মুলা অনুযায়ী "নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র" "মৌলিক গণতন্ত্র" প্রভৃতি ছেলে ভুলানো অনেক ছড়া শোনালেন এবং ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত শ্রেনীকে তার পেছনে সমবেত করার উদ্দেশ্যে পূর্ববর্তী বেসামরিক সরকারের আমলে গৃহীত যৎকিঞ্চিৎ ভূমি সংস্কার আইন বাতিল করে পরিবার প্রতি ১০০ বিঘার পরিবর্তে ৩৭৫ বিঘা 'সিলিং' নির্দেশ করলেন। কাজেই সামন্ত মুৎসুদ্দি শ্রেণীর সব কয়টি রাজনৈতিক দল--- মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলাম, রিপাবলিকান পার্টি প্রভৃতি সর সর করে আইউবের সামরিক শাসনের ছাত্র ছায়ায় ঢুকে পড়লেন এবং তার সামরিক শাসন মেনে নিয়ে তাতে অংশগ্রহণ করে একদশক কাল সামরিক স্বৈরশাসনের অংশীদার হলেন। এমনকি তাদের সহযাত্রী খাঁটি গণতন্ত্রের বিশ্বাসীরাও শ্রেণী চরিত্রগত দুর্বলতার কারণে আত্মসমর্পণ করলেন।

সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষিত সামরিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে মাথা নত করেননি একটি মাত্র ব্যতিক্রম শক্তি। তারা হলেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি তথা বামপন্থী দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহ। দীর্ঘ কাল আত্মগোপনে থেকে তারা আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে লড়াই চালালেন। তাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে ছাত্রসমাজ মূল্যবান অবদান রাখলেন, যার ক্রমপরিণতিতে ১৯৬৯ সালে সামরিক শাসন বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটল। জেনারেল ইয়াহিয়াকে ক্ষমতাসীন করে শাসক শ্রেণী ঘর সামলাবার চেষ্টা করলো।

কিন্তু ইতিমধ্যে দুর্ভাগ্যবশত পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার তথা স্বাধীনতার প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা দিল। পার্টির একাংশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৬ দফার সমর্থনে দাঁড়ালেন। যদিও এ সত্য সর্ব মহলেই স্বীকৃতি ছিল যে আওয়ামী লীগের ৬ দফায় জাতীয় মুক্তির কথা ছিল না। পার্টির অপরাংশ গণতান্ত্রিক স্বাধীন 'রাষ্ট্র' গঠনের প্রস্তাব হাজির করলেন এবং তার ভিত্তিতে যথা পরিকল্পনা গ্রহণ করে অগ্রসর হলেন। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে কমিউনিস্ট পার্টি (বর্তমান সাম্যবাদী দল) জাতীয় ভিত্তিতে তিনটি সংগঠনে নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছিল। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুল হক এবং দেশের বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা ও সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল হোসেন খান। পার্টির পক্ষ থেকে উপস্থাপিত "জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা (যা হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র)" পরিকল্পনার ব্যাপারে পার্টির সাথে মৌলানা ভাসানী ছিলেন একমত‌। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল।

সেই পটভূমিতে কেন্দ্রীয় সামরিক আমলা শাসক চক্রের পক্ষ থেকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অংশীদারিত্বের আশ্বাস পেয়ে শেখ মুজিব ব্যাপক জনমতের বিপরীতে আইউবের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিলেন এবং "৬ দফা কোন বাইবেল নয়" ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের "অখণ্ডত্ব রক্ষার" শর্ত (এল, এফ, ও ১৯৭০-র প্রধান শর্ত) মেনে নিয়ে কেন্দ্রীয় সামরিক-আমলা শাসক চক্রের সাথে আপোষ করলেন।

১৯৬৬ সালে মস্কো-পিকিং মতাদর্শগত বিতর্কের ফলশ্রুতিতে কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়। পার্টির এই দ্বিধাবিভক্তির ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা এবং গণমুক্তির সংগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যাইহোক জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে পার্টির মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে সংগঠিত অংশ তাদের "জনগণতান্ত্রিক স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব বাংলা রাষ্ট্র" গঠনের সংগ্রামের কর্মসূচিতে অটল থাকলেন।

১৯৬৯ সালে বামপন্থীরা আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলনের সৃষ্টি করেন। কিন্তু তখনকার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ প্রভৃতি স্বাধীনতাকামী বামপন্থী প্রগতিশীল সংগঠনগুলির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধ ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভাঙ্গাভাঙ্গির কারণে ব্যাপক আন্দোলনকে মুক্তি সংগ্রামে পরিণত করার মত শক্তিশালী নেতৃত্ব গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ আন্দোলনের পুরো ভাগে এসে দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগের ভেতর ভিড় জমায় আমলা, মুৎসুদ্দি, বুর্জোয়া ও লুম্পেন ভবঘুরে গোষ্ঠীর লোকেরা। সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই উগ্র জাতীয়তার রণধ্বনিতে অভ্যুত্থান মুখী আন্দোলন সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি বাহিনী হিংস্র আক্রমণের থাবা মেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিকামী মানুষের উপর। স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন শ্রমিক কর্মচারী, কৃষক, ছাত্র, ব্যবসায়ী জনতা এবং ইপিআর পুলিশ, আনছার প্রভৃতি সংগঠনের দেশপ্রেমিক অংশ। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত রাশিয়া এবং প্রতিবেশী ভারতের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী এবং বামপন্থী দলগুলো বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানায়। আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতে পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা করেন। ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সরকার এই সুযোগ গ্রহণ করে বাঙালি জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তাহাদের সম্প্রসারণবাদী উচ্চবিলাষ চরিতার্থ করার কাজে লাগায়। শ্রেণী চরিত্রগত দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগ ভারতের জনগণ তথা জনগণের দলগুলি বিশেষতঃ মার্কসবাদী লেনিনবাদীদের উপর বিশ্বাস স্থাপন না করে ভারতীয় বুর্জোয়া শোষক শ্রেণীগুলির সম্প্রসারণবাদী শাসক চক্রগুলির নিকট আত্মসমর্পণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের অধীনে আমাদের দেশের মুক্তি পাগল হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ঠেলে দেয়। এইভাবেই বাঙালি জাতি ও তার অগণিত মুক্তিযোদ্ধার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তির আকাঙ্খাকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করা হয়। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের একটি অংশ নিজস্ব নীতি-কৌশল ও শক্তি সামর্থের প্রতি আস্থাহীন হয়ে আওয়ামীলীগকে অনুসরণ করে চলেন। কোন কোন কমিউনিস্ট ও বামপন্থী বাঙালি গণমানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে এই সংগ্রামকে "দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি" বলে আখ্যায়িত করেন। অন্যদিকে কমিউনিস্টদের এক অংশ (বর্তমান সাম্যবাদী দল) সহ কয়েকটি দল ও গ্রুপ দেশের মাটিতে থেকে বিভিন্ন জেলায় মুক্তি সংগ্রাম শুরু করে নোয়াখালীর ১২০০ বর্গ মাইল এলাকায় মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠে। এই এলাকায় জনগণের নির্বাচিত গণ আদালতের মাধ্যমে জনগণের সমস্যা ও সংকটের সমাধান করা হয়। রেজাকার আলবদরদের ক্যাম্পগুলি মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করতে থাকে। অপরদিকে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে পরিচালিত "মুক্তি বাহিনী" বোধগম্য কারণেই সাম্যবাদী দলের মুক্তিযোদ্ধাদের পেছন থেকে আক্রমণ করতে থাকে।

কমিউনিস্ট নেতৃত্বে বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রাম প্রসারতা লাভ করছে বলে ভারত, গ্রেড ব্রিটেন সহ বিশ্বে বিভিন্ন দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলি প্রচার করতে থাকে। এতে প্রতিবেশী দেশগুলি সহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিক, কৃষক এবং বামপন্থীরা যেমন উৎসাহিত হয়ে ওঠেন তেমনি সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলরা সন্ত্রস্ত ও সতর্ক হয়ে ওঠে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি ভ্রমণ করে তাহাদের অনুমতি ও নির্দেশ নিয়ে এসে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সশস্ত্রভাবে বাংলাদেশে প্রেরণ করেন। বাংলাদেশের অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও লাখ লাখ নর-নারীর রক্তে সিক্ত মুক্তিবাহিনীগুলির পতাকাকে বাংলাদেশের বুকে ধূলায় নিক্ষেপ করে নতুন এক ষড়যন্ত্রের নাটক অভিনীত হয়। ঢাকার বুকে পাকবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। বস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তদান, ত্যাগ তিতিক্ষা ও মান-সংম্ভ্রমকে পায়ে মাড়িয়ে ভারতীয় বাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে আপোষ রফা হয়। এইভাবেই ৯ কোটি বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী চক্রের বুটের তলায় ঠেলে দেয়া হলো। দেশে সৃষ্টি হল বন্দুকের নিয়ন্ত্রিত এক নতুন ধরনের স্বৈরশাসনের। শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে দেশে ফিরে নিজেকে নতুন পরিস্থিতির অসহায় শিকারে পরিণত করেন। সত্যিকারের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামীদের আড়াল করে রেখে দেশ-বিদেশের স্বার্থবাদী চক্র শেখ সাহেবকে ঘিরে রাখে। দেশে চলে অকল্পনীয় অরাজকতা, হত্যা, নারী নির্যাতন ও লুটতরাজ। বর্তমান সাম্যবাদী দলসহ বামপন্থীরা আত্মগোপনে থেকে মুক্তি সংগ্রামের ধারা অব্যাহত রাখেন। অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে তারা শ্রমিক-কৃষক মধ্যবিত্ত ছাত্র-জনতার অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের সপক্ষে এবং ভারতীয় বুর্জোয়া গোষ্ঠীর শোষণ ও আগ্রাসী আধিপত্যের বিরুদ্ধে দুর্বার সংগ্রাম চালিয়ে যান। এতে হাজার হাজার দেশ প্রেমিক প্রাণ হারান। এই সমস্ত ঘটনার বাস্তব অভিজ্ঞতা শ্রমিক-কৃষক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তান সিপাহী জওয়ানদের মধ্যে একদিকে যেমন দেশপ্রেমিক মন-মানসিকতা ও ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি করে অন্যদিকে তেমনি সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতিতে তাহাদের মধ্যে অস্থির চিত্ততা ও উচ্চাভিলাসও জন্ম লাভ করে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। দেশবাসী এই পরিবর্তন বিশেষতঃ ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে মৌলিক পরিবর্তন মনে করে নতুন শাসকদের সমর্থনে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু অচিরেই ধরা পড়ল নতুন শাসকরা ওই একই শাসক শ্রেণীর অংশ। গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ও শ্রমিক কৃষকের চিন্তাভাবনার সঙ্গে যোগাযোগের অভাবে তারা অবাস্তব "পরিকল্পনার" পেছনে অজস্র টাকা খরচ করে জনজীবনের আর্থিক সংকট দূর করার পরিবর্তে সংকটকে জটিলতর করতে থাকেন। অতীতের সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিক আমলের ধারাবাহিকতা বহনকারী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব পুনরায় মার্কিন নেতৃত্বে সংগঠিত আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির সেবা দাসে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক প্রভুদের পরামর্শে জেনারেল জিয়া নিজের শক্তিকে সংহত করার উদ্দেশ্যে খাঁটি গণতন্ত্রকামী শক্তি সমূহকে এড়িয়ে রাজাকার আল বদর নির্বিশেষে ব্যক্তি স্বার্থান্বেষী ও সুবিধাবাদী দলছুট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে নিজের দল গঠন করলেন এবং স্বীয় অবস্থানকে সংহত করার উদ্দেশ্যে মার্কিনের সহায়তায় আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ (২২ হাজার কোটি টাকার উপর) ঋণ গ্রহণ করে দেশকে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির নিকট দায়গ্রস্ত করলেন।

এর পাশাপাশি ভেতরে ভেতরে আরেকটি জটিল সংকট পেকে উঠেছিল। ১৯৭১ এর গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর একাংশে যেমন দেশপ্রেমিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, অন্যদিকে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা বোধ বিনিষ্ট হয়েছিল। এই পটভূমিতে স্বাধীনতা উত্তর মুজিব সরকারের সাড়ে তিন বছরে অমার্জনীয় ব্যর্থতা তাদের মধ্যে অস্থির চিত্ততা এবং ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণের প্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলেছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণবাদী শক্তি সমূহ তাদের এই প্রবণতাকে প্ররোচনা দিয়ে উত্তেজিত করেছিল। তার‌ই ফলশ্রুতিতে একের পর এক সরকার পরিবর্তন অথবা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা বদলের খেলা চলল এবং পরিপূর্ণ সামরিক আমলা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সামরিক আমলা বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের যে বিবৃক্ষের বীজ বপন করা হলো তারই ফলশ্রুতিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রক্রমে জেনারেল জিয়াকে বিদায় নিতে হল এবং জেনারেল মঞ্জুরসহ অনেকগুলি অমূল্য জীবন হারাতে হলো। এইভাবেই সামরিক আমলা কর্তৃত্বে রদবদলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ ১৯৮৫ সালের মধ্যবর্তী অকল্পনীয় আর্থ-সামাজিক সংকটগ্রস্ত অবস্থায় পৌঁছেছে।

জেনারেল এরশাদের সাথে নেতৃত্বে সামরিক শাসনের বিগত তিন বছরে জাতীয় সংকট এক অকল্পনীয় ও নজিরবিহীন অবস্থায় পৌঁছেছে। ঘুষ দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ইতিপূর্বের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চুরি এখন প্রায় নেই; তার স্থানে দখল করেছে প্রকাশ্য দিবালোকে ডাকাতি, রাহাজানি এবং খুন-খারাবি সহ লুটতরাজ ও ছিনতাই। নারীহরণ, নারী নির্যাতন আজ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। উপজেলা আদালত প্রতিষ্ঠার পর মামলার ব্যায় বেড়ে গেছে। গ্রামবাংলায় টাউট বাটপারদের প্ররোচনায় মিথ্যা মামলা দরিদ্র জনগণের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। সীমান্তে চোরাচালান অঘোষিত আইনি ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেশের সম্পদ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বহু কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য সামগ্রী এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত সম্পদ সার প্রভৃতি সীমান্তের ওপারে চোরাচালান পথে চলে যাচ্ছে।

তারো চেয়ে লজ্জাকর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে ক্ষমতাশালী কোন চক্রের সহায়তায় কোটি কোটি টাকার বেআইনি আমদানি। বিমানবাহিনীর যন্ত্রাংশের লেভেল আঁটা বাক্স ভর্তি এক কোটি টাকা মূল্যের ঘড়ি আমদানির কেলেঙ্কারির ঘটনা এবং সাম্প্রতিককালে কাস্টমস কর্তৃক ধৃত তিনজন বিদেশী ব্যবসায়ী কর্তৃক দেড় কোটি টাকা মূল্যের চিনি কেলেঙ্কারির ঘটনা শাসকদের প্রতি মানুষের বিক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। অন্য একটি উদ্বেগজনক ঘটনা হলো রাস্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা। এই ঘটনাবলী আপাত দৃষ্টিতে যত রহস্যাবৃত বলে মনে করা হোক না কেন আসলে তা মোটেই রহস্যময় ব্যাপার নয়। রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাশালী কোন একটি চক্রের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতিরেকে এ ধরনের ঘটনা যে সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়, তা বোঝার জন্য যে খুব একটা বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সম্প্রতিকালে ৩০, ০০০ টেলিফোন লাইন এবং বিজলি লাইন কাটার কেলেঙ্কারিময় ঘটনাবলী বিশেষ করে সরকারের অভ্যন্তরে ওয়াপদা এবং টেলিফোন দপ্তরের পাল্টাপাল্টি লাইন কাটাকাটি ঘটনাবলী কি নির্দেশ করে? দেশে যে কোন সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন ব্যবস্থা নেই, অথবা থাকলেও তার অভ্যন্তরে কি অভাবনীয় অরাজকতা বিরাজ করছে তা নির্দেশ করে না কি!

আরেকটি অরাজকতাময় ঘটনা হচ্ছে সম্প্রতিকালে ওয়াসার ট্যাক্সের ঘটনা। সামরিক শাসনামলে বাড়ির পুনর্মূল্যায়নের নামে বিগত প্রায় আড়াই বছর যাবৎ ওয়াসার দ্বিমাসিক বিল আদায় বন্ধ রেখে এবং বাড়ির নবমূল্যায়ন বিশগুণ অথবা ততোধিক পরিমাণ বৃদ্ধি করে তার ভিত্তিতে একত্রে সার চার্জ সহ আড়াই বছরের বকেয়া ট্যাক্স আদায়ের নোটিশ জারি করেছেন ওয়াসা। মিথ্যা বাড়তি টেলিফোন বিল, বিজলির মিথ্যা বাড়তি বিল (উদাহরণস্বরূপঃ একটি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে একটিমাত্র কামরা, তাতে একটি মাত্র বাতি জ্বালানো হয়। তার মাসিক বিজলীর বিল আসছে ৪৭ টাকা) এবং সর্বশেষে ওয়াসার বাড়তি বিল প্রভৃতি ঘটনাবলী দৃষ্টে মনে হয় যেন দেশে কোন দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নে ই অথবা শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাসীন অংশ দেশবাসীর শেষ রক্ত বিন্দুটুকুও চুষে নিতে বদ্ধপরিকর।

বিগত তিন বছরে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চূড়ান্ত দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছেছে। দেশের খাদ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে গড়পড়তা বার্ষিক ১৫ লক্ষ টন। মুখে খাদ্য উৎপাদন বাড়াবার কথা বলা হলেও সরকার বিপরীত ব্যবস্থাই কার্যত গ্রহণ করে চলেছেন। এবারের বাজেটে ভর্তুকি তুলে দিয়ে সারের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা থেকে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা না করে নতুন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৭৩ লক্ষ টন খাদ্য আমদানির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষকের অর্থকরী ফসল পাটের মূল্য উৎপাদন খরচ এবং বাড়তি পাট কলগুলির আর্থিক সঙ্গতির সাথে মিল করে এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে মিলিয়ে যুক্তিসঙ্গতভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। পাট উৎপাদনকারী কৃষকদের ফড়িয়া মহাজনদের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে বিগত বছরে যে ক্ষেত্রে পাটের প্রতি মন বিক্রয় হয়েছিল গড়ে পাঁচশত টাকার উপর। এবার সেই পাটের দাম গড়ে ২৫০ টাকার কম। তাও বাজারে বিক্রয় হচ্ছে না।

আজ দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় কোটি। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৪ কোটিতে। সামগ্রিক বিচারে গ্রামবাংলার কৃষক এবং শহর অঞ্চলের শ্রমিক তথা শ্রমজীবী মানুষের জীবন আজ ওষ্ঠাগত। কৃষক জীবনের সাথে অঙ্গিআঙ্গিভাবে জড়িত খাদ্য সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে উৎপাদনমুখী ভূমি ও কৃষি সংস্কার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে দেশে দ্রুত শিল্পায়নের সঠিক নীতি এবং ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক বহুজাতিক লগ্নি পুঁজির নিকট থেকে ঋণের বোঝা বাড়ানো হচ্ছে। এই দেনা আজ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মুদ্রা সংকট নিরসনের লক্ষ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কাগজি নোট ছাপিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন এবং মুদ্রাস্ফীতি ঘটানো হয়েছে এবং হচ্ছে। এই জন্যই দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে গেছে। উৎপাদন ব্যবস্থায় চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতিতে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, এবারের বাজেটই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

যে কাঁচা পাট এবং আকারিক পাট শিল্পের উপর নির্ভর করে পাকিস্তান আমলে গোটা দেশের শিল্প ব্যবস্থা তথা সমগ্র অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল এবং টাকার মূল্যমান ভারতের রুপির তুলনায় দেড়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, সেই পাট কলগুলো বিগত অর্থ বছরে ১১৬ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্পের অবস্থাও তথৈবচ।

সম্প্রতিকালে সরকারের ঘোষিত শিল্পনীতি আপাত দৃষ্টিতে শিল্পায়নের অনুকূল মনে হলেও তাতে দেশের শিল্পায়নে অগ্রগতি হবে না। কারণ দেশের চলতি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে পুঁজির মালিকরা পুঁজি নিয়োগে উৎসাহিত হবেন না‌। অথচ এই শিল্পনীতি আপাত দৃষ্টিতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন অপকৌশলে দেশের বাহিরে পুঁজি পাচারের প্রবণতাকেই উৎসাহিত করবে। এর একমাত্র প্রতিকারের পথ হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মারফত জনগণের আস্থাভাজন একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে গণমনে আস্থার ভাব জাগিয়ে তোলা। এর বিকল্প অকল্পনীয় আর্থ সামাজিক অরাজকতা ছাড়া আর কিছু এই মুহূর্তে ভাবা যায় না। এই আর্থসামাজিক অরাজকতার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে বিগত ২১ এপ্রিলের "হা-না" ভোট এবং উপজেলা নির্বাচনে ভোটের জালজালিয়াতির ঘটনা ইতিমধ্যে প্রচলিত ভোটব্যবস্থা সম্পর্কে গণমনে অনাস্থা সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কোন কোন মহলে সামরিক শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্রের ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সামগ্রিক বিচারে শাসকগোষ্ঠী পূর্ববর্তী জেনারেলদের পদাঙ্কই অনুসরণ করে চলছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে জেনারেলদের প্রদর্শিত খেলারই পুনরাবৃত্তি চলছে। ব্যক্তি স্বার্থান্বেষী সুবিধাবাদীদেরকে মন্ত্রিত্বের টোপ গিলানোর মধ্য দিয়ে তথাকথিত ন্যাশনাল ফ্রন্ট গঠনের মধুর বাণী শোনানো হচ্ছে। মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন গৃহযুদ্ধ এড়িয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেছেন। অথচ জেনারেল এরশাদ বলেছেন, তারা (মন্ত্রীরা) তাদের ভুল স্বীকার করে তার (জেনারেল এরশাদের) দর্শন গ্রহণ করেছেন। আরেক মন্ত্রী বলেছেন আগামী শীতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হবে এই শর্তে তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেছেন। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই যে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে মন্ত্রী সেই গ্যারান্টি কোথায় পেলেন? আসলে এসবই ধোঁকাবাজি। অতীতের ধারাবাহিকতায় শ্রেণী তথা গোষ্ঠীগত স্বার্থেই এরা সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সাথে হাত মিলিয়েছেন।

যাই হোক উপরের সমগ্র আলোচনা থেকে যে সত্যটি বেরিয়ে আসে তা হলঃ ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৫৪, ১৯৭১, ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালের সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণবাদের মদদপুষ্ট সামন্ত-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া সামরিক-আমলা তথা শাসক শ্রেণীগুলির এক অংশকে উচ্ছেদ করা হলেও একই শ্রেণী গোষ্ঠীর অপর অংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দক্ষিণপন্থীরা সামরিক-আমলা-শাসক-চক্রের সাথে প্রতিবারই আপোষ করে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন। আজ বহুধা বিভক্ত হলেও খাঁটি বামপন্থী গণতান্ত্রীরাই সামন্ত বুর্জোয়া সামরিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিষ্ঠার সাথে লড়াই চালিয়ে এসেছেন এবং সেই লড়াই আজও অব্যাহত রয়েছে। তারাই স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে নতুন চিন্তাধারার উন্মেষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাঙনের প্রক্রিয়ার বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠে খাঁটি গণতন্ত্রী ও তথাকথিত গণতন্ত্রীদের মধ্যকার সীমারেখা সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাদের মধ্যে নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এটা আশার কথা। উপরোক্ত পটভূমিতে বামপন্থী গণতন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে আমরা কয়েকটি কথা নিবেদন করতে চাই। প্রথমতঃ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করতে হবে এবং একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ তাদের উপলব্ধি করতে হবে যে তারা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের সংগ্রামে পুরোধা শক্তি। কিন্তু একমাত্র শক্তি নন। তৃতীয়তঃ তাদের অতি অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে খাঁটি গণতন্ত্রকামী শক্তি সমূহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন সর্বত্র। গণতন্ত্রকামীরা আছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে; বিভিন্ন শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুব সংগঠনে; আছেন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে; আছেন সরকারি প্রশাসনযন্ত্রে; সেনাবাহিনীর মধ্যেও আছেন গণতন্ত্রকামীরা; কারণ দেশের শ্রমিক-কৃষক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের নিয়েই সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন বাজী রেখে তারাও লড়াই করেছেন। এরা সামরিক শাসনের অবসান এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা কামনা করেন। কামনা করেন শ্রেণীবিভক্ত শোষণ মূলক এই সমাজের পরিবর্তন।

তাই দেশপ্রেমিক বামপন্থীদের অতি অবশ্য করণীয় হবে প্রথমতঃ নিজেদের মধ্যে ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং তার সাথে সাথে উপরে বর্ণিত অন্যান্য গণতন্ত্রকামীদের ঐক্যবদ্ধ করে সত্যিকারের জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করার লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া। এই প্রস্তাবিত গণতান্ত্রিক ফন্টের রাজনৈতিক দর্শন অতি অবশ্যই হতে হবেঃ

(১) বন্দুক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে না; রাজনীতিই বন্দুককে নিয়ন্ত্রিত করবে।

(২) এটা জনগণতন্ত্রের যুগ বিধায় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকার‌ই জনগণের পক্ষে সার্বভৌম ক্ষমতা পরিচালনা করবেন।

উপরোক্ত রাজনৈতিক দর্শন ভিত্তিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে আমরা দলমত নির্বিশেষে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহকে ঐক্যবদ্ধ করার ভিত্তি হিসেবে বর্তমান পর্যায়ে নিম্ন বর্ণিত কর্মসমূহ হাজির করছিঃ

(১) সামরিক শাসনের অবসান এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।

(২) বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ করা।

(৩) দেশের খাদ্য সংকট দূরীকরণ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে উৎপাদন মুখি কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করা স্বল্প ব্যয়ে পানি ব্রিজ সার ও কীটনাশক সরবরাহ করা বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা ভূমিহীনদের জমি দান করা এবং খেত মজুরদের ন্যায্যমজুরির নিশ্চয়তা বিধান।

(৪) দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে কৃষিভিত্তিক ও দেশীয় কাঁচামাল ভিত্তিক শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটানো এবং শ্রমপ্রধান (Labour intensive) শিল্প বিস্তার করা।

(৫) বিলাসীকরণের ভ্রান্ত নীতি পরিহার করা, মূল ও ভারী শিল্প রাষ্ট্রীয় খাতে রেখে ব্যক্তি মালিকানায় অন্যান্য শিল্প কারখানা গড়ে তোলার ব্যাপারে উৎসাহ দান করা।

(৬) শিল্পের দ্রুত বিকাশের স্বার্থে শিল্প শ্রমিকদের সাংগঠনিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার সমূহ প্রতিষ্ঠা এবং ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা। টাকার নিরিখে নামমাত্র মজুরি বৃদ্ধির পরিবর্তে যথাসম্ভব সস্তা দামে রেশন, বিনা ভাড়ায় অথবা নামমাত্র ভাড়ায় বাসস্থান, বিনা পয়সায় বিজলি ও পানি সরবরাহ, শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা ও বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রভৃতির ব্যবস্থা করা। এই ব্যবস্থা দেশে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের সহায়ক হবে।

(৭) শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধন করে গণমুখী ও উৎপাদনমুখী এবং কৃৎকৌশলগত শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ঘটানো।

(৮) অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ হ্রাস ও বিলাস দ্রব্য আমদানি বন্ধ করা। দ্রব্যমূল্য হ্রাস করা।

(৯) ঘুষ-দুর্নীতি, ডাকাতি-রাহাজানি সহ সামাজিক অনাচার কঠোর হস্তে দমন করা।

(১০) নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা। নারী সমাজের পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান।

(১১) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ; সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়---- নীতি অনুসরণ করা।

(১২) প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমূহের সাথে বিশেষ করে ভারতের সাথে সমস্যা সমূহ--গঙ্গার পানি বন্টন, সীমান্তের সিটমহল তথা তিন বিঘা করিডোর সমস্যা, তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা প্রভৃতি সমস্যাবলীর আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে নীতি অনুসরণ করা।

(১৩) তৃতীয় বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর করা। সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন ও সংরক্ষণের সংগ্রামে লিপ্ত দেশসমূহের প্রতি সমর্থন দান।

(১৪) বিশ্ব শান্তির সপক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলা। স্থায়ী শান্তি রক্ষার স্বার্থে বৃহৎ শক্তিসমূহের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শান্তির সপক্ষ শক্তি সমূহের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নীতি অনুসরণ করা।

আমরা বিশ্বাস করি উপরোক্ত কর্মসূচি ভিত্তিক একটি জনগণতান্ত্রিক মোর্চা গঠনের কাজ সময় সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য কাজ। তড়িঘড়ি করে এ কাজ সাধন সম্ভব নয়। কিন্তু সততা ও নিষ্ঠার সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করা গেলে এবং দলীয় বা গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা পরিহার করে জাতীয় ও ব্যাপক জনস্বার্থের প্রতি অবিচল নিষ্ঠার সাথে অগ্রসর হওয়া গেলে এরূপ একটি জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলা সম্ভব। তার মধ্যে নিহিত রয়েছে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্যা তথা বর্তমান জাতীয় সংকটের সমাধান এবং জাতি ও জনগণের সার্বিক মুক্তি।

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।