গৌরবের মৃত্যু জাফর ভাইয়ের


তার মৃত্যুতেও গৌরব আছে। নিজ দেশে, নিজ হাসপাতালে, নিজ চিকিৎসক ও কর্মীদের হাতের সেবা নিয়ে তিনি গেছেন। কোনো আপোষ করেন নি।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বা জাফর ভাইকে আর কোনো সভায় বা মানববন্ধনের ব্যানারের পেছনে কিংবা মিছিলের সামনে হুইল চেয়ারে দেখা যাবে না । কিংবা দেখা যাবে না কোনো টেলিভিশন টক শো তে। তিনি এই ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি দেশের কোটি মানুষের ভালবাসা। তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।

তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে অনেকের মতো আমরাও ছুটে গিয়েছিলাম। এত শোকের মাঝখানেও সেখানে গিয়ে মনে হল, জাফর ভাইয়ের এই মৃত্যুতে গৌরব আছে। তিনি নিজের গড়ে তোলা হাসপাতালেই, নিজেদের গড়ে তোলা চিকিৎসক ও কর্মীদের সেবা নিয়ে গেছেন। তিনি মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সেবা দেবেন বলে ঢাকা শহরে একটি হাসপাতাল গড়ে তুলেছিলেন; বেসরকারি হাসপাতালের তালিকায় নাম লেখাবার জন্যে নয়, ঢাকা শহরের গরিব মানুষদের দারিদ্রের বিভিন্ন ক্যটেগরি অনুযায়ী স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা সেবা দেবার জন্যে। এ কারণে তিনি নিজের হাতে স্বাস্থ্য কর্মী গড়ে তুলেছেন সাধারণ গরিব ঘরের ছেলে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে। সব ধরনের কাজ তাদের শেখানো হয়েছে, ল্যাব থেকে শুরু করে আইসিইউ পর্যন্ত। এখানে যারা চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন তাদের পক্ষে অন্যকোনো বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ মেটানো সম্ভব নয়।

আমরা জানি, বাংলাদেশে চিকিৎসার জন্যে সরকারি হাসপাতালেও ৬৮.৫% চিকিৎসা খরচ রোগীকেই বহন করতে হয়। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই কথা মাথায় রেখে চিকিৎসা সেবাকে গরিব মানুষের কাছে সহজলভ্য করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন । তাঁর হাসপাতাল যেমন আছে, তেমনি আছে ফার্মাসিউটিক্যালস। অর্থাৎ, ওষুধও কম দামে পাওয়ার ব্যবস্থা তিনি করেছেন। ওষুধ নীতিতে তাঁর অবদানের কথা এখানে আলোচনয়া করলাম না।

যখন থেকে জাফর ভাইকে আমরা চিনেছি, তাঁকে অসুস্থ হতে খুব একটা আমরা শুনতাম না। তিনি সারা দেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন কাজে, চরে গিয়ে শল্য চিকিৎসা দিচ্ছেন। আজ ঢাকা আছেন, তো কাল গাইবান্ধা বা খুলনা। এরই মধ্যে কবে তাঁর কিডনি রোগ ধরা পড়েছিল সেটা আমার জানা নেই। তবে ২০১৭ সালে যখন তিনি ঢাকায় নগর হাসপাতালে ১০০ বেডের গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করলেন, তখন জানলাম তাঁর কিডনি রোগ আছে। এর উদ্ভোধনীর দিন আমাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন জাফর ভাই। গিয়েছিলাম। সেদিন দেখলাম জাফর ভাই খুব খুশি। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এনে গরিব বিকল কিডনি রোগীদের রাত ৮টা থেকে ভোর ৫টার শিফটে হেমো-ডায়ালাইসিসে অল্প খরচে বিশেষ সুবিধা দিতে পারবেন। তিনি উদ্ভোধনী ভাষণ দেওয়ার সময় কেন এই ডায়ালাইসিস সেন্টার করেছেন তার একটি গল্প বললেন।

কিডনি রোগের জন্যে তাঁর ডায়ালাইসিস নেওয়ার প্রয়োজন হলো, তাই তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে নিয়মিত সেবা নিতেন। তখন আশেপাশে যেসব রোগীদের দেখতেন তাদের অবস্থা জানতে চাইতেন। একবার তিনি লক্ষ্য করলেন, কম বয়সী একটি ছেলে আর নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে আসে না। কারণ হিসেবে জানলেন সে এই ডায়ালাইসিসের ব্যয় বহন করতে পারছে না । গল্পটি বলতে গিয়ে জাফর ভাই নিজে যেমন কাঁদলেন, তেমনি উপস্থিত সবাইকে কাঁদালেন। তখনই তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন যেমন করে হোক ডায়ালাইসিস সেন্টার করতে হবে। যেখানে কারো টাকার অভাবে যেন ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করতে না হয়। তিনি এই ডায়ালাইসিস সেন্টার করার জন্যে অর্থের যোগান, মেশিন পত্র কেনা ইত্যাদির জন্যে প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। এবং সফলও হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ সেবা নিচ্ছে। জাফর ভাই নিজেও সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালাইসিস নিতেন নিজেরই হাসপাতালে। এই ডায়ালাইসিস সেন্টার তাঁর ঘর বাড়ির মতো হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ডায়ালাইসিস চলছে, অন্যদিকে তিনি লিখছে্ন না হলে পড়ছেন। অথবা কাউকে ডেকে কাজের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এমন কি টেলিভিশনের টক শোতেও যোগদান করছেন। মৃত্যুর দিনও তিনি ৬ ঘণ্টা ডায়ালাইসিস নিয়েছেন বলে জানতে পেরেছি।

করোনা মহামারির সময় জাফর ভাইকে আর এক যুদ্ধ করতে দেখেছি। এই সময় তিনি লক ডাউনে ঘরে বসে থাকেননি । তিনি সামাজিকভাবেও যেমন কাজ করেছেন, তেমনি বৈজ্ঞানিকভাবেও চেষ্টা করেছেন। COVID-19 Rapid Antigen Test kit তৈরি করে অনুমোদনের জন্যে লড়াই করেছেন প্রাণপণ। তবে এখানে নানাধরনের স্বার্থগোষ্টি থাকার কারণে সেটা হয়নি। জাফর ভাই চেয়েছিলেন কম খরচে এবং কম সময়ে যেন কোভিড শনাক্ত করা যায়। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও কোভিডে আক্রান্ত হলেন এবং খুব সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে গেলেন। মনে আছে সে সময়ও সারাদেশের মানুষ তার সুস্থতার জন্যে দোয়া করেছিল। তিনি ফিরেছিলেন। এরপর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল অনেক কোভিড আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়েছে; কোভিড ওয়ার্ড, কোভিড আইসিইউ সবই করেছেন। যখন অক্সিজেনের স্বল্পতার জন্যে রোগীরা হাহাকার করছে তখন এই হাসপাতালের রোগীদের যেন চিকিৎসা ঠিকমত হয় সে নিশ্চয়তা তিনি দিয়েছিলেন। আমার প্রতিষ্ঠান উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা) একজন কর্মী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছিল। সে এই নগর হাসপাতালে চিকিৎসা পেয়ে দীর্ঘ ২ মাস হাসপাতালে থেকে যেভাবে সুস্থ হতে পেরেছেন, সেটা আর কোথাও থাকলে হোত না, এই কথা নিশ্চিত বলতে পারি। জাফর ভাই রোগীদের ব্যাপারে সরাসরি খোঁজখবর নিতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন।

জাফর ভাইয়ের লড়াকু রূপ দেখেছিলাম ২০১৫ সালে। সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে ট্রাইব্যুনালের জরিমানার রায়ের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে জাফর ভাইসহ আমরা ৪৯ জন একসাথে বিবৃতি দিয়েছিলাম। এতে আমাদের সকলের বিরুদ্ধ্বে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল। আমাদের মধ্যে একটি অংশ আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু আমরা ২৩ জন আরো কিছুদিন আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এক পর্যায়ে আমরা সবাই আদালতের কাছে ক্ষমা চাইলেও জাফর ভাই একা ক্ষমা চান নাই। তাকে এক ঘণ্টার কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এই সময় জাফর ভাইয়ের যোদ্ধা রূপের কাছে আমরা হেরে গিয়েছিলাম। স্যালুট জানাই।

গণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেও তিনি শত শত গ্রামের ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার পথ করে দিয়েছেন। আমাকে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি সদস্য করা হয়েছে জাফর ভাইয়ের প্রস্তাবে। এটা আমার জন্যে সম্মানের। এর মাধ্যমে সুযোগ হয়েছে তাঁর এমন উদ্যোগের সাথে পরিচিত হবার। তবে সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হচ্ছে জাফর ভাইয়ের কাজের আসল পরিচয়। তাঁর প্রাণ। এখানে প্রত্যেক কর্মীর কাছে জাফর ভাই বা, বড় ভাই এক অন্য ব্যাপার। জাফর ভাই হাঁটতে চলতে ধমক দিচ্ছেন, কথা বলছেন, হাসছেন – এসবের অর্থ কর্মীরা বোঝে। গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল গত বছর। তখনও জাফর ভাই খুব সুস্থ ছিলেন না । তবুও তিনি এসেছিলেন, গাড়ি থেকে নেমেই হুইল চেয়ারে বসলেন। হুইল চেয়ারে বসে একে ডাকছেন, ওকে ডাকছেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বৃক্ষ রোপণ ছিল। জাফর ভাই প্রথম গাছটি লাগাবেন, কিন্তু তিনি তো হুইল চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারছেন না, তাই হুইল চেয়ারে বসেই গাছ মাটিতে পুতে দিলেন। এতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তবুও তিনি করলেন, গাছে পানিও দিলেন। হঠাৎ দেখি আমার পাশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সিনিয়র নারী কর্মীরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। প্রথমে বুঝতে পারি নি। পরে তারা বললেন বড় ভাই কত দৌড়ঝাপ করা মানুষ, আজ হুইল চেয়ারে বসে গাছ লাগাচ্ছেন। এই দৃশ্য তারা সহ্য করতে পারছিলেন না। ভাবতে পারছি না, তারা জাফর ভাইয়ের এই বিশ্ব থেকে বিদায় নেওয়াকে কেমন করে মেনে নেবেন।

অথচ হুইল চেয়ারে বসেই জাফর ভাই মিছিলের সামনে সবাইকে উৎসাহ যুগিয়েছেন। যেখানে প্রতিবাদ করার ব্যাপার হয়েছে হুইল চেয়ারে করেই তিনি গেছেন। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেছেন। মিছিলের সামনে জাফর ভাইয়ের হুইল চেয়ারে বসা ছবিগুলো আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। কাজ করতে চাইলে কোনো কিছুই বাধা নয়।

তার মৃত্যুতেও গৌরব আছে। নিজ দেশে, নিজ হাসপাতালে, নিজ চিকিৎসক ও কর্মীদের হাতের সেবা নিয়ে তিনি গেছেন। কোনো আপোষ করেন নি। আজ জাফর ভাইকে নিয়ে আরো অনেক কথাই লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু হাত চলছে না । জাফর ভাই ভাল থাকুন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি ১২ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে 'গৌরবের মৃত্যু জাফর ভাইয়ের' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।