জেসমিন সুলতানার মৃত্যু ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে প্রশ্ন


জেসমিনের কি অপরাধ ছিল তা তদন্তের বিষয়। কিন্তু, তাকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দেয়া এই আইনের ‘অপব্যবহার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ২৯ মার্চ আইনমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তা অনেকটা ‘এপোলজেটিক’।

জেসমিন সুলতানা র‍্যাবের হাতে আটক অবস্থায় মারা গেছেন। তাঁকে রাজশাহী র‌্যাব-৫ এর একটি দল রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্মসচিব) এনামুল হকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আটক করেছিল। জেসমিন সুলতানা একজন চাকরিজীবী নারী ছিলেন, তিনি সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন।

যেদিন জেসমিনকে আটক করা হয় তার পর দিন সকাল ৯টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। এখানেই শেষ নয়। জেসমিন মরেও রেহাই পাননি। তাকে আটকের পরদিন রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (বা DSA) তার বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে একটি মামলা হয়। এমন সময় মামলা হলো যখন ডিজিটাল সিকিরিউটি আইন বাতিল বা সংস্কার করা নিয়ে তীব্র আলোচনা হচ্ছে। ফলে জেসমিনের মৃত্যুতে বহু গুরুতর প্রশ্ন উঠছে, তার উত্তর আমাদের পেতে হবে।

র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব অভিযোগ ওঠে এবং যা সরাসরি মানবাধিকার লংঘনের পর্যায়ে পড়ে, জেসমিনের ঘটনায় সেগুলো পরিষ্কার ভাবেই আছে। ঘটনার প্রথম দিন থেকেই পত্রিকায় যেসকল রিপোর্ট আমরা পড়েছি তাতে পরিষ্কার জেসমিন সুলতানাকে আটক এবং আটক থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা। তাঁর স্বজনদের অভিযোগ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নওগাঁর মুক্তির মোড় থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে র‌্যাবের লোকজন তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে র‍্যাবের কোন ক্যাম্পে নেওয়া হয়েছে জানা যায় নাই, স্বজনরা তাঁর ব্যাপারে শুনেছেন প্রথম নওগাঁ সদর হাসপাতাল এবং পরে রাজশাহী মেডিকেলে, যেখানে তার মৃত্যু হয়। Unmute

জেসমিন সুলতানা যদি মারা না যেতেন তাহলে তাকে জেলের ভাত খেতে হতো। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন তো তেমনই আইন। এতে জামিনের সুযোগ রাখা হয়নি। এরই মধ্যে স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশিত প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস এর রিপোর্ট এবং তাকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে আটক করে জেলে পাঠানোর কারণে এই বিষয়ে আলোচনার পটপরিবর্তন হয়েছে। শামস কয়েকদিন জেল খেটেও এসেছেন। তীব্র প্রতিবাদের মুখে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা হলে তাতে জামিন পেলেও যেমন ওঠে না, তেমনি অভিযুক্ত মারা গেলেও আইনের অবসান হয় না। মামলা থেকে যায়। শামসুজ্জামান শামসের মামলা যেমন আছে, তেমনি জেসমিনের মামলাও উঠে যায়নি।

মামলা নম্বর ১৬। এনামুল হক মামলার অভিযোগে বলেছেন, তার ছবি ব্যবহার করে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে জেসমিন প্রতারণা করেছেন। অতএব এটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেরই বিষয়, র‍্যাবের কর্তাদের কাছে সেটাই মনে হয়েছে। তাই তারা তাকে আটক করা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

জেসমিন সুলতানাকে কেন একজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আটক করা হলো এবং তারপর তার মৃত্যুও হলো, এই বিষয়গুলো তো তার সাথে কবরে চলে যায়নি। এগুলো এখনও জ্বল জ্বল করছে। এর উত্তর তো পেতেই হবে। এর মধ্যে দৃষ্টি অন্য দিকে যাবার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে যেমন বঙ্গবাজারের আগুন, র‍্যাব নিয়ে ডয়চে ভেলের ডকুমেন্টরি – তবুও জেসমিনের কথা ঘুরে ফিরে আসছে। এবং আরো আসতে থাকবে।

যিনি জেসমিনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, এনামুল হক, তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, যুগ্ম সচিব। তিনি জেসমিনের বিরুদ্ধে শুধু অভিযোগ করেই ক্ষান্ত হন নাই, তাঁর উপস্থিতিতেই তাকে আটক করা হয়েছে। এরকম উদাহরণ কি আরও আছে? তিনি কি সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার কারণে র‍্যাব তার মৌখিক অভিযোগ খতিয়ে না দেখেই অভিযুক্তকে আটক করে ফেললো? এটা কি কোন আইনের আওতায় পড়ে? এখন বিষয়টির তদন্ত চলছে তাই কোন মন্তব্য না করেও বলতে পারি, যে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ করা হচ্ছে তা যদি সত্যও হয়– তাহলেও কি এই পদ্ধতিতে আটক করে নির্যাতন করা যায়?

জেসমিনের মৃত্যুর কারণ নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। র‍্যাব বলছে তিনি স্ট্রোক করে মারা গেছেন। জেসমিনের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন আটকের পর র‌্যাব হেফাজতে জেসমিনকে নির্যাতন করা হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসেছে ২ এপ্রিল। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাথায় রক্তক্ষরণ থেকে হওয়া শকে মৃত্যু হয়েছে জেসমিনের। শরীরে দুটি জখম থাকলেও তা মৃত্যুর কারণ নয় বলে দাবী করা হয়। তবে তার কপালের বাম পাশে ২ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার ও ডান হাতের কনুইয়ের ভেতর ২ সেন্টিমিটার জখম ছিল। জখম মৃত্যুর কারণ নয়, কিন্তু জখম কেন হলো সে প্রশ্ন তো তোলাই যায়। সুস্থ মানুষকে রাস্তা থেকে আটক করে নেয়া হলো; তারপরই তিনি স্ট্রোক করলেন এবং তার শরীরে জখম হলো কী করে? কোনপ্রকার শারিরীক নির্যাতন না হলে জখম হওয়ার কথা নয়।

জেসমিনের ওপর জোরজবরদস্তি অবশ্যই করা হয়েছে। সেটা তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় থেকেই। পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শীদের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, জেসমিন রিক্সা করে যাচ্ছিলেন। তাকে থামিয়ে রিক্সা থেকে নামানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি নামতে না চাইলে র‍্যাবের দুই নারী সদস্য জোর করে টেনে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। তিনি তখন চিৎকার করে জানতে চেয়েছিলেন তার অপরাধ কী? উত্তরে র‍্যাব সদস্যরা বলেছিলেন, তার সাথে কথা বলা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কথা বলার পরিণাম কি তার মৃত্যু!

জেসমিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া যে সঠিক ছিল না তার প্রমাণ র‍্যাব নিজেই দিয়েছে। জড়িত র‍্যাবের ১১ সদস্য, যার মধ্যে মাইক্রোবাসের চালকও রয়েছে তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, তদন্তের স্বার্থে তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে।

জেসমিনের মৃত্যু নিয়ে সমাজে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, যে জেসমিনের ছেলে এবং পরিবারের সদস্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হচ্ছে আটক ব্যক্তিকে যেখানে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপনের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেখানে সুলতানা জেসমিনকে আটকের ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় পর আসামি করে মামলা করা হয়েছে। আসক এই বিষয়টি তাদের লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেছে।

বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছে এই মৃত্যু নিয়ে। এই কথা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না যে আটকের পর র‍্যাবের হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই আঘাত তার মৃত্যুর কারণ নয় বলে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হলেও আঘাত কেন হলো সেই দায় র‍্যাব কি এড়াতে পারে?

জেসমিনের কি অপরাধ ছিল তা তদন্তের বিষয়। কিন্তু, তাকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দেয়া এই আইনের 'অপব্যবহার' বলে আখ্যায়িত করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ২৯ মার্চ আইনমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তা অনেকটা 'এপোলজেটিক'। তিনি বলেছেন 'সুলতানা জেসমিনকে যখন তুলে নেয়া হয় তখন তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা ছিল না। আইনমন্ত্রী জেসমিনের মৃত্যু নিয়ে বললেন "ভদ্র মহিলার দুর্ভাগ্য এবং ট্র্যাজেডি যে, তিনি যখন মারা যান তখনও কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা ছিল না। মামলা করা হয়েছে তার পরের দিন"। তিনি এই ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হয়েছে বলে পরিস্কার বলেছেন এবং যেক্ষেত্রে "এই আইনের অপব্যবহার হচ্ছে সেখানে অপব্যবহার বন্ধ করার আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি'।

এখন প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে, এখনও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সংস্কার না বাতিল- এই বিতর্ক এখন সবাই করছে। এই আইন কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয় – দীর্ঘকাল ধরে মানবাধিকারে বিশ্বাসী সকল মানুষ এর বিরোধিতা করছে। এই আইনের দ্বারা যে কাউকে যখন তখন রাস্তাঘাটে জবরদস্তি করে ধরে নেয়া যায়, আইনশৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে – সেটাকে কি নেহায়েত আইনের অপব্যবহার বলে চুপ করে থাকা যাবে?

 

[এই লেখাটি ১১ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে 'বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড' পত্রিকায়  'জেসমিন সুলতানার মৃত্যু ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে প্রশ্ন' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে]


 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।