জাফর ভাই ও ‘গণলাইন’


হঠাৎ দৈনিক সমকাল থেকে স্বল্প পরিসরে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরি – অর্থাৎ জাফর ভাইকে নিয়ে কিছু কথা বলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এটা আসলে আমার জন্য কঠিন। তাঁকে নিয়ে লেখার বিষয় বিপুল। এ ধরণের মানুষ সমাজে কালেভদ্রে জন্মগ্রহণ করে। জর্মন দার্শনিক নীটশের একটা কথা মনে পড়ল; নীটশের একটি ফয়সালা হচ্ছে বড় মাপের মানুষদের নিয়ে কিছু বলতে চাইলে হয় বিস্ময়ে অভিভূত থাক, অথবা উন্নাসিক হও! নাক উঁচু করে ভাব দেখাও এ আর এমন কী! কিছুই হয় নি ভাব করে এড়িয়ে যাও! আমার এখন হয়েছে সে অবস্থা! অর্থাৎ জাফর ভাইকে নিয়ে লেখালিখি কঠিন কাজ।

জাফর ভাইয়ের সাথে আমার জীবন নানা ভাবে সরাসরি জড়িত। আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি, তার জন্য নয়। তাঁর সঙ্গে অনেকেই কাজ করেছেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে গণমানুষের সেবা করে গিয়েছেন। এখনও যাচ্ছেন। আমার অন্য কারন আছে। সেটাই বরং স্বল্প পরিসরে বলার চেষ্টা করব।

বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতির একটি ধারা ষাট দশকে গড়ে উঠেছিল যারা মনে করেছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের পাশাপাশি গণমানুষের সমাজ কায়েমের মধ্যেই বাংলাদেশের জনগণের আত্মবিকাশ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। একে সহজে বোঝাবার জন্য ‘মাওবাদ’ নয় বরং মাও জে দং-এর ‘গণলাইন’-এর ধারণা মনে আসে। গণলাইন কথাটা আমার নিজের খুব পছন্দের। এর অর্থ হচ্ছে জনগণের সঙ্গে থাকা। তাদের ভাব ভাষা, চিন্তা ও চিন্তার ব্যাকরণ বোঝার কাজ করা। সম্প্রতি কেউ কেউ বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় বলছেন যে সমাজ পরিবর্তনের হাওয়াই কথাবার্তা বলা সহজ। কিন্তু কি করতে হবে এবং জনগণের ভাবনার জায়গা থেকে কি সম্ভব আর কি সম্ভব না, সেটা সহজ ভাষায় অনুবাদ করে বলা সবচেয়ে কঠিন কাজ। হয়তো উপমহাদেশে বিপ্লবী রাজনীতির ব্যর্থতার বড় কারণ আমরা মোটা মোটা তত্ত্ব কথা মুখস্থ করেছি, কিন্তু এখনকার কাজ সহজ ভাবে জনগণকে বোঝাতে শিখি নি।

রাজনীতির সারকথা হচ্ছে কোন তত্ত্ববাগীশী না। সাধারন মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা বাস্তবোচিত ভাবে সমাধানের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সচেতনতা ও গণভাষা গড়ে ওঠে – সেটাই গণলাইন। যেমন মওলানা ভাসানী ‘খামোশ’ বললে মনে হোত সারা দুনিয়া দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আমরা ভাষা ভুলেছি।

সমাজকে বদলে নেবার যে খাঁটি আবেগটুকু দরকার – সমাজকে বিশ্লেষণ ও বোঝার জন্য যে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দরকার এবং সর্বোপরি যে নীতি ও কৌশল গণমানুষের ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে – সেটাই গণলাইন। কাজের দিক থেকে এর সাধারণ সূত্র হচ্ছে জনগণের সঙ্গে থাকা, তাদের বাস্তব সমস্যাকে নিজের সমস্যা হিশাবে বোঝার চেষ্টা করা, জনগণকে নিয়েই তার সমাধান বের করা। নানান প্রকার শ্লোগান সর্বস্ব রাজনীতি এবং মতবাদী কর্মকাণ্ডের ফলে গণলাইনের ধারণা এখন আর বিশেষ অবশিষ্ট নাই। গণবিচ্ছিন্ন চিন্তা এবং সাধারণ মানুষের চেয়ে নিজেদের অতি পণ্ডিত ভাবা ইত্যাদি নানান কারণে বাংলাদেশে এই রাজনৈতিক চেতনা পরিচ্ছন্ন কোন রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে নি। কিন্তু বাংলাদেশে ‘গণস্বাস্থ্য’ নামে একটি শক্তশালী স্বাস্থ্য আন্দোলন গণলাইনের ধারায় গড়ে উঠেছে যার সাফল্য অস্বীকার করবার কোন জো নাই। কিন্তু এই সাফল্যের গোড়ায় রয়েছে গণমানুষের সঙ্গে থেকে তাদের বাস্তব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা। জাফর ভাইয়ের কাছ থেকে আমরা মানুষের সঙ্গে কাজ করতে শিখেছি।

গণস্বাস্থ্যের খ্যাতি এখন বিশ্বব্যাপী। ওষুধ ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরি এবং গণস্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অবদান হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা এবং বহুজাতিক কোম্পানির ভূয়া প্রচার ও মুনাফাকারী হিংস্রতার বিপরীতে কিভাবে গণমানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা ভাবতে পারি, ভাবা উচিত এবং এখনকার বাস্তবোচিত কাজ এখনই বাস্তবে করে ফেলতে পারি – সেই পথ তিনি আমাদের দেখিয়ে গিয়েছেন। কবে সমাজতন্ত্র আসবে, কোন এক নেতা একদা আমাদের উদ্ধার করবেন তার জন্য বসে থাকার মতো আহাম্মকী আর কিছু হতে পারে না।

জাফর ভাইয়ের ভালবাসা পেয়েছি আমি। তাঁকে ভালবেসেছি। ঠিক এই জন্যই। আমরা সবাই দোষেগুণে মানুষ। কিন্তু কখনই তাঁর মহৎ দিকটি চোখের আড়াল হয় নি। আমি ফার্মেসি ও অর্থশাস্ত্র পড়েছি বিদেশে। কিন্তু তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে দেশে ফিরে এসেছি এক সময়। আসতে পেরেছি। জাফর ভাই বলেছিলেন ফিরে যাওয়া যাবে না, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন ফিরিয়ে যাবার নৌকা ডুবিয়ে দিতে হবে, নইলে যুদ্ধে জেতা যাবে না। এটা সেনাপতিদের ভাষা। যে কাজে এসেছি সে কাজে সফল হতে হবে। সেটা আমারও মনের কথা ছিল। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেল গড়বার কাজে আমার যথাসাধ্য ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওষুধ বানানোই আমার কাজ ছিল না। একদা দর্শন, ইতিহাস, অর্থশাস্ত্র পড়েছি। বিপ্লবী রাজনীতির ধারার মধ্যে কৈশোর ও যৌবন কেটেছে। তাকে কাজে লাগাতে চেয়েছি। তাই এক সময় গণস্বাস্থ্যের বাইরে এসে নিজের মতো কাজ করতে শুরু করেছি। কিন্তু কখনই তাঁর সঙ্গে কাজের সম্পর্ক ছিন্ন হয় নি। যখনই ডাক পড়েছে ছুটে গিয়েছি।

তবে গণস্বাস্থ্যে আমার নিজের যে নতুন যে অভিজ্ঞতা হোল সেটা হোল স্বাস্থ্যকে দেখতে হবে প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার জায়গা থেকে। মানুষ প্রকৃতির বাইরের কোন বায়বীয় সত্তা না। দেহ একটা ম্যাটেরিয়াল বা প্রাকৃতিক ব্যাপার। তাহলে পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণব্যবস্থাকে যদি আমরা প্রাণ ধারণের জন্য বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দেই তাহলে শুধু মানুষ কেন, কোন জীব বা অণুজীবের পক্ষেও বেঁচা থাকা সম্ভব নয়। আমার মনে হয়েছে যদি গণলাইনের ধারাকে প্রাণবন্ত রাখতে চাই আমাকে কৃষি নিয়েই কাজ করতে হবে। সার, বিষ ও মাটির তলার আর্সেনিকযুক্ত পানি না তুলে কিভাবে ফলন বাড়ানো যায়, ওষুধ ছাড়া কিভাবে সুস্থ থাকা যায়, কিভাবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি মেটাতে কোন বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য না কিনে বাংলার কৃষকের কাছ থেকে পাই বা পাবার ব্যবস্থা করা যায় সেটাই আমার নতুন সাধনার ক্ষেত্র হয়ে উঠল। তাকেই কাজের ক্ষেত্র হিশাবে নিয়েছি। নয়াকৃষি আন্দোলনের জন্ম হয়েছে।

সামগ্রিক স্বাস্থ্য আন্দোলন থেকে নয়াকৃষি আন্দোলন আলাদা কিছু না। গণস্বাস্থ্যের জন্ম যুদ্ধক্ষেত্রে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন সহজ কোন কাজ ছিল না। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য আন্দোলন গণযুদ্ধের বাইরের কোন কার্যক্রম নয়। কিন্তু বিশ্ব এখন আরও জটিল হয়ে গিয়েছে। বার্লিন ওয়াল ভেঙে গিয়েছে এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার ফলে এককেন্দ্রিক যে বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে মোকাবিলা করা আগের চেয়ে অনেক বেশী দুঃসাধ্য হয়েছে। তাই দরকার চিন্তা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে দূরদর্শী ও কৌশলী হওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে সেরকম কোন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গড়ে ওঠে নি। নতুন ও কঠিন বিশ্বে বাংলাদেশের টিকে থাকা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা জাফর ভাইকেও আশংকিত করে। তারপরও তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে যা সঠিক গণ্য করেছেন সেটা করবার চেষ্টা করেন এবং অসুস্থ শরীর নিয়ে অবিশ্বাস্য সাহসের সঙ্গে তাঁর সাধ্যের অন্তর্গত সবই করবার চেষ্টা করেন।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও ওষুধ নিয়ে তাঁর কাজ সম্পর্কে আমি আজ এখানে কিছু বলব না। আগরতলায় বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত মুক্তিযোদ্ধা, উদ্বাস্তু ও নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নর-নারীর জরুরি চিকিৎসা সেবার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফিল্ড হাসপাতালের ইতিহাসও আমরা এখন কমবেশী জানি। কিন্তু জাফর ভাইয়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের একটু গভীরে ভাবতে হবে।

প্রথম হোল, বাংলা ভাষা প্রশ্নে তার অবস্থান। আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি কিন্তু জীবনের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের যে গুরুত্ব এবং রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে গঠন করবার মূল শক্তি যে আমাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা – সেটা আমাদের কাছে এখনও অস্পষ্ট। কিন্তু বরাবরই জাফর ভাইয়ের সকল কাজের কেন্দ্রে বাংলা ভাষার গুরুত্ব কাজ করেছে। ভাষার সত্য আমরা এখনও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি নি। এখনও বাংলাদেশের তরুণদের বৃহৎ অংশ বাজে কবিতা বাজে নাটক ও সস্তা গান লেখাকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি মনে করে। সাধারণ মানুষের ভাষা এবং তাদের দৈ্নন্দিন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোন ধারণা নাই। উচ্চ আদালতের বিচারকরা এখনও ইংরেজিতে রায় লিখেন। বাদী বা বিবাদী কেউ যদি সহজ ভাষায় অভিযোগ কিম্বা যে আইনে তারা দোষী কিম্বা নিরপরাধ সাব্যস্ত হোল সেটাই না বোঝে তাকে ন্যায়বিচার দূরের কথা, বিচার বলা যায় না।

বিচার বা বিচার প্রক্রিয়া মানে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে বুঝতে হবে তার অপরাধটা আসলে কি? কোন আইনে কেন তার বিচার হচ্ছে। এটা উকিল-ব্যারিস্টার বুঝলে হবে না। যে কোন সাধারণ নাগরিককেও বুঝতে হবে। ভাষার সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়া এবং ন্যায়বিচারের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। অথচ ভাষাকে আমরা আইন ও রাষ্ট্রের দিক থেকে উপলব্ধি ও বিচারের ক্ষমতা এখনও অর্জন করি নি। আমরা এমনই এক সংবিধান লিখেছি যার ভাষা সাধারণ জনগণের বোধগম্য নয়। ফলে জনগণের অধিকার হরণ করে নেওয়া সহজ। আজ অবধি আমরা জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করতে পারি নি। ব্যর্থতার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হোল সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন ও ব্যবহারের রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে আমাদের যারপরনাই অজ্ঞতা এবং মূর্খতা। ভাষাকে আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত বানিয়ে ফেলেছি, মুক্তিযূদ্ধের ক্ষেত্র বানাতে পারি নি। ।

এ ক্ষেত্রে জাফর ভাইয়ের দৃঢ়তা অপরিসীম যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেন নি তাঁদের পক্ষে বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁর নিবিড় সংযোগ বোঝা কঠিন। হয়তো সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ ও চর্চা এই ক্ষেত্রে কাজ করেছে। নিজের প্রতিষ্ঠান ও কাজের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন কঠোর। ভাষা নিয়ে আবেগি ন্যাকামি না। দৈনন্দিন কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা চর্চা আমাদের ব্যবহারিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে। বাংলা ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। জাফর ভাই সকল দাপ্তরিক কাজে বাংলা ব্যবহারকে তার নিজের প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করেছেন। ব্যাংকে বা যে কোন সরকারি বা বেসরকারি দফতরে চিঠি বাংলায় দেবার নিয়ম কঠোর করেছেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি বাংলায় কোন চিঠি না লিখলে তিনি গ্রহণ করেন না। যারা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বুঝতে অক্ষম তাঁরা সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন ও ব্যবহারের রাজনৈতিক তাৎপর্য ধরতে পারবেন না। এটা স্রেফ সাহিত্য বা নাকি সুরে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবার মামলা না। বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখা বা না রাখার প্রশ্ন। এই ক্ষেত্রে জাফর ভাইয়ের আপোষহীনতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝতে হবে। তিনি কম খরচে ডায়ালিসিস করবার যুযোগ দিয়ে গরিবের যে উপকার করেছেন সেটা নিশ্চয়ই সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু ভাষার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব অভিন্ন – এই সত্য তিনি নিজের কাজে ও জীবনে চর্চা করবার মধ্য দিয়ে যে পথ বেঁধে দিয়েছেন সেই পথকে আরও প্রশস্ত ও শক্তিশালী করাই এখনকার প্রধান কাজ। আশা করি আদালতের বিচারকরা আমাদের কথা যেমন বুঝবেন, তেমনি বাংলাদেশের তরুন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গাল্পিক সকলে আমার কথা বুঝবেন। সাহিত্য মানে লিটারেচার না – এটা কলোনিয়াল ইউরোপের ধারনা। । মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ নির্ণয় করে সাহিত্য, যার মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক গঠন প্রক্রিয়া চলে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভাষার মধ্য দিয়েই সম্বন্ধ তৈরি হয়। তাই সাহিত্যকে আলাদা করে রাজনীতি করতে হয় না। সাহিত্যচর্চা মানেই রাজনীতি।

এবার জাফর ভাইয়ের দ্বিতীর রাজনৈতিক তাৎপর্যের জায়গায় আসি। তাঁর রাজনৈতিক অবদানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে তিনি ‘জাতিবাদী’ প্রকল্প হিশাবে দেখেছেন বলে আমার কখনই মনে হয় নি। এখানে বাঙালি জাতিবাদী ফ্যসিস্টদের সঙ্গে তাঁর মৌলিক পার্থক্য। গণস্বাস্থ্য সব সময়ই মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করেছে স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি পালন করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যে একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধ এটা গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠা এবং সঠিক ওষুধ নীতি ও স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ণের যুদ্ধক্ষেত্র এটা ডা: জাফরুল্লাহ প্রমাণ করে ছেড়েছেন। বাংলাদেশকে বহুজাতিক বিদেশী কোম্পানির নতুন ব্যবসা ও মুনাফা কামাবার ক্ষেত্রে পরিণত করা যাবে না এই লড়াইয়ে আমি তাঁর সঙ্গে শামিল থাকতে পেরেছি। এখনও শামিল রয়েছি, আগামি দিনেও থাকব। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেল প্রতিষ্ঠত হবার পর আমরা দুঃসাহসের সঙ্গে বিজ্ঞাপন দিতে পেরেছি: ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি’। অনেককেই তা হতভম্ব করেছিল কারণ ওষুধ বানানো বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক বোঝার মতো মগজ বাংলাদেশের বামপন্থিদের ছিল না। তাদের মগজে তখনও ধরা পড়ে নি যে স্বাস্থ্য, খাদ্য, পুষ্টি ইত্যাদিও সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্র। তারা উলটা জাফর ভাইয়ের বিরোধিতা করেছে। ইতিহাস আজ সেইসকল তর্ক মীমাংসা করে দিয়েছে। কিন্তু জানি না গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি’ – ধরণের বিখ্যাত বিজ্ঞাপনগুলো কোথাও এখনও আছে কিনা! আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তগুলো এ সময়ের মধ্যে লিপ্ত রয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা কাগুজে কোন শ্লোগান না। অতএব আমরা সস্তা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা করি নি। করি না। বরং সাম্রাজ্যবাদ আমাদের জাতীয় এবং দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে কিভাবে হাজির রয়েছে তাকে শনাক্ত করাই আসল কাজ। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। কিভাবে? সেটা জাফর ভাই করে দেখিয়েছেন। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকাল স্রেফ একটা ওষুধ কোম্পানি না। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের বিপরীতে বাংলাদেশের মতো দুর্বল দেশগুলো কিভাবে তাদের জাতীয় বাজারের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের সঠিক নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করবে – এবং বাজারের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকবে – গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেল, ওষুধ নীতি ইত্যাদি তারই কংক্রিট নজির।

পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব বাজার, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক বা আইএমএফ-এর বিপরীতে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির পথ নিয়ে যদি ভাবি তাহলে যে সকল মানদণ্ডের ভিত্তিতে ক্ষতিকর, অকার্যকর এবং অনর্থক পণ্য আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসা জাতীয় ওষুধ নীতিতে নিষিদ্ধ ও বন্ধ করা হয়েছে সেই মানদণ্ড গুলো অন্য সকল ব্যবসার ক্ষেত্রেও আরোপ সম্ভব। জাতীয় ওষুধ নীতি জাতীয় ওষুধ শিল্পের বিকাশ নিশ্চিত করেছে। আমাদের দরকার গণস্বার্থের উপযোগী সকল শিল্পের বিকাশের পথ নির্ণয় করা। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা যে কংক্রিট পথ জাফর ভাই দেখিয়েছেন সেটা প্রচলিত বামপন্থা বা আকাশকুসুম সমাজতন্ত্র কায়েমের শ্লোগান না। মুক্তিযুদ্ধ মানে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই – সে লড়াই কিভাবে করব তার নীতি ও কৌশল নির্ণয় কিভাবে করতে হবে সেটা বাংলাদেশের শক্তিশালী স্বাস্থ্য আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা পেতে পারি। এই ক্ষেত্রে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে অবিসংবাদিত নেতা হিশাবে হাজির রয়েছেন।

জাফর ভাইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে বিজ্ঞা্ন ও কৃৎকৌশল স্থানান্তরের কাজ। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেল তৈরির সময় আমাদের বলা হয়েছিল বড় বড় আধুনিক মেশিন চালাবার লোক পাওয়া যাবে না। ওষুধ বানাবার কারিগর পাওয়া যাবে না, ইত্যাদি। আমরা বলেছি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের প্রশ্ন একালে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পশ্চাতে পড়ে থাকার কারন। আমরা সহজ বাংলা ভাষায় ম্যনুয়েল লিখেছি, প্রায় নিরক্ষর গ্রামের মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে তার কাজ শিখে নিয়েছে। গণস্বাস্থ্যের জন্য এটা নতুন কোন অভিজ্ঞতা নয়। এর আগে জাফর ভাই নার্স পেশার জন্য গ্রামের গরিব মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, বড় বড় স্বাস্থ্য প্রকল্পে গ্রামের সাধারণ ছেলেমেয়েদের কাজ করিয়েছেন। আমাদের জন্য কিছুই অসাধ্য নয়। কিন্তু দরকার দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস।

স্বল্প পরিসরে বলা এই কথাগুলো আশা করি যাঁরা বাংলাদেশের জনগণ নিয়ে ভাবেন তাঁদের কাজে আসবে। সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শনসহ সকল ক্ষেত্রে জনগণের কাছে যাওয়া ও মিশে যাওয়ার ডাক এসেছে। সেই ক্ষেত্রে গণলাইন নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তার জন্য জাফর ভাইকে তাঁর বাইরের কাজ দ্বারা বোঝা যথেষ্ট না। সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশকে অগ্রসর করে নেবার ক্ষেত্রে তাঁর কথা বলতে গিয়ে ‘গণলাইন’ কথাটা আমরা যেভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি সেখান থেকে বুঝতে হবে।

সেটা এখন আরও জরুরী। কারন ইতোমধ্যেই ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশের রণধ্বণি শোনা যাচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ মার্কা প্রপাগাণ্ডার বিপরীতে গণমানুষের রাজনৈতিক ধারা বা গণলাইনের কথা আমাদের বারবারই বলতে হবে।

১ চৈত্র, ১৪২৯/১৫ মার্চ, ২০২৩।। শ্যামলী

[ এ লেখাটি  ১৮ মার্চ ২০২৩ তারিখে 'জাফরুল্লাহ চৌধুরী: দেশের যোদ্ধা বন্ধু সবার' শিরোনামে দৈনিক সমকালের গুণীজন সম্মাননা ২০২৩ ক্রোড়পত্রে প্রথ ছাপা হয়েছিল)

 

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।