রাষ্ট্রেরও আগে মানুষ
পাশ্চাত্য মিডিয়াগুলিতে হরদম যখন দাবি করা হয় যে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, তখন অনেকের কাছে সেটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনে ‘এপারথেইড’ যদি অপরাধ হয়, তাহলে একটি এপারথেইড রাষ্ট্র সগর্বে টিকিয়ে রাখার যুক্তি কি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোভূক্ত ইউরোপ কেন ইসইরাইল রাষ্ট্রের চরিত্র না বদলিয়ে সশস্ত্র, সহিংস ও ‘এপারথেইড’ রাষ্ট্র হিশাবেই ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে? কেন ইসরাইলের চরিত্র ও নীতি পরিবর্তনের কথা বলছে না। কেন সারা বিশ্বের সামনে প্রকাশ্যেই তারা একটি জনগোষ্ঠিকে এপারথেইড রাষ্ট্রের অধিকারের ধূয়া তুলে নির্মূল করবার সহযোগী হয়েছে? কেন তারা নির্বিচারে নিরীহ শিশু সহ নিরপরাধ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করছে। নির্লজ্জ ভাবে মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ করে যাচ্ছে?
কোন একটি জাতি, বর্ণ বা জনগোষ্ঠিকে হীন, হেয় ও অমানুষ গণ্য করে তাদের ওপর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আইনী শ্রেষ্ঠতা বহাল রাখবার ব্যবস্থা বা চেষ্টাকে ইংরেজিতে Apartheid বলা হয়। বাংলায় এর অনুবাদ করা হয় জাতিবৈষম্য বা বর্ণবৈষম্য। কিন্তু এই অনুবাদের দ্বারা ‘এপারথেইড’-এর ভয়াবহতা যেমন বোঝা যায় না, তেমনি আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে কেন সেটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সেটাও পরিষ্কার হয় না। ফলে পাশ্চাত্য পরাশক্তি নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবর ভিত্তি করে ‘এপারথেইড’ ও কলোনিয়াল-সেটলার রাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে যে প্রপাগান্ডা কিম্বা পালটা প্রপাগান্ডা চালানো হয় আমরা তার শিকার হই এবং ভুল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। তাই এ বিষয় নিয়ে ভাববার দরকার আছে।
‘এপারথেইড’ আন্তর্জাতিক আইনে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে গণ্য; বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষই সেটা জানে না। তাহলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ‘এপারথেইড’ রাষ্ট্র হিশাবে ইসরাইলের কি টিকে থাকার কোন ‘অধিকার’ থাকতে পারে? এপারথেইড রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার আইনী ভিত্তি কি? নাই। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী 'ইসরাইল' একটি ‘ জায়নবাদী অবৈধ’ রাষ্ট্র ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো সদস্যভূক্ত ইউরোপ টিকিয়ে রেখেছে।
জাতিবৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ২০০২ সালের রোম সংবিধি (Rome Statute of the International Criminal Court) দ্বারা সংজ্ঞায়িত। মানবতার বিরুদ্ধে অন্যান্য অপরাধের মতোই ‘এপারথেইড’ অমানবিক: "committed in the context of an institutionalized regime of systematic oppression and domination by one racial group over any other racial group or groups and committed with the intention of maintaining that regime". একটি জাতি বা জনগোষ্ঠির ওপর আরেকটি জাতিগত গোষ্ঠীর পদ্ধতিগত নিপীড়ন। জাতিগত আধিপত্যের প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি এপারথেইড রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যেই হাজির থাকে। ইসরায়েল তেমনি 'এপারথেইড' কায়েম রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ একটি রাষ্ট্র।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর, বর্ণবাদ ও জাতিবৈষম্য সংক্রান্ত অপরাধের দমন ও শাস্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন (The International Convention on the Suppression & Punishment of the Crimes of Apartheid) স্বাক্ষর ও অনুমোদনের জন্য উন্মুক্ত করে। সেখানে জাতি ও বর্ণবৈষম্যের অপরাধের সংজ্ঞা হচ্ছে। "একটি জাতিগত গোষ্ঠীর দ্বারা অন্য কোন জাতিগত গোষ্ঠীর উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সংঘটিত অমানবিক কাজ এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের নিপীড়ন"।
জায়নিস্ট শক্তি ঔপনিবেশিক ইউরোপ ও সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় ইউরোপে ইহুদিদের পুড়িয়ে মারার ইতিহাসকে মানবতাবর্জিত লাভজনক ব্যবসাতে (Holocaust Industry) পরিণত করেছে, ইহুদিদের পুড়িয়ে মেরেছে ইউরোপ; আরবরা নয়, মুসলমানরাও নয়। আর ‘আরব’ মানেই মুসলমান নয়। ‘আরব’ মানে যারা আরব দেশগুলোর বাসিন্দা। প্যালেস্টাইনের স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলেই আছে। ইসরাইলের বিরোধিতা মানে ইহুদি বিরোধিতা নয়। । প্যালেস্টাইনে হাজার হাজার বছর ধরে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান একসঙ্গে বাস করে আসছে। তাই আরবদের ভূখণ্ড দখল করে সেখানে ইউরোপের জায়নবাদী ইহুদিদের জন্য দখল করে নেওয়া অন্যায়।
ইসরাইল স্থানীয় অধিবাসীদের বিতাড়িত করেছে। বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনীরা তাদের নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে শরণার্থী শিবিরে বাস করছে। ইসরাইল প্যালেস্টাইনের জনগণের ভূমি দখল ও সম্প্রসারিত করে চলেছে। সহিংসতার গোড়া আসলে এখানে। আসল প্রশ্ন বাদ দিয়ে হামাসের হামলাকে বিচ্ছিন্ন হামলা গণ্য করে নিন্দা করার মধ্য দিয়ে এপারথেইড ইসরাইলের পক্ষে জনমত তৈরি করার এই কৌশল পুরানা। দেখা যাচ্ছে সেটা এখন বিশেষ কাজ করছে না। ইসরাইলের হিংস্রতা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মাত্রা এখন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে।
ইসরাইল নিজেকে ইহুদিদের রাষ্ট্র বলে দাবি করে। কিন্তু খোদ ইহুদিদের মধ্যেই এ নিয়ে ঘোর মতভেদ আছে। ইহুদি ধর্মানুযায়ী ইসরায়েল রাষ্ট্রের কোন ধর্মীয় বৈধতা নাই। ধর্মপ্রাণ কোন ইহুদি মনে করে না রাষ্ট্র কায়েমের কোন বিধান তাদের ধর্মে আছে। ইহুদি ধর্মের দিক থেকেও ইসরায়েল একটি অবৈধ ও ধর্মবিরোধী রাষ্ট্র।
অতএব আরবদের নিজ দেশ থেকে উৎখাত করে ইউরোপ ও বাইরে থেকে ইহুদিদের এনে আরবদের ভূমি দখল করা কোন ভাবেই বৈধ হতে পারে না। এই ইহুদিরা স্থানীয় আরব নন। অধিকাংশকেই ইউরোপ বা আরব দেশের বাইরে থেকে এনে বস্তি স্থাপন করতে দেওয়া হয়েছে। এপারথেইড রাষ্ট্র ইসরায়েলের টিকে থাকার অতএব কোন ধর্মীয়, আইনী বা নৈতিক যুক্তি নাই।
ইসরায়েল টিকে আছে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ধারাবাহিকতায় আরবের তেল ও আরব ভূখণ্ডের সম্পদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর আধিপত্য ও শোষণ কায়েম রাখার দরকারে। তাই ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে বলা মানে সাম্রাজ্যবাদ, উপবেশবাদ, সেটলার-কলোনিয়াল স্টেইট এবং জায়নবাদের পক্ষাবলম্বন। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পক্ষে দাঁড়ানো