দাবায়ে রাখতে পারবা না


জো বাইডেন শুরু থেকেই যেভাবে নিঃশর্তে নেতানিয়ানহুকে সমর্থন করে যাচ্ছিলেন তার রাজনৈতিক পরিণতি তাঁর জন্য ভাল হয় নি। ইসরায়েলের গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের প্রতি তার নিঃশর্ত সমর্থন দেশের ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে মার্কিন জনগণের বৃহৎ একটি অংশ তাঁর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার ভাবমূর্তি ও আধিপত্য খুইয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউক্রেনের পরাজয় এবং ইউরোপে রাজনৈতিক ও জ্বালানি সংকট। ইউরোপে রাজনৈতিক সংকট বাড়বে এবং বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোভূক্ত দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে প্রক্সি ওয়ার চালাচ্ছে তা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। জায়নিস্ট ইসরায়েলের নির্লজ্জ তল্পিবাহক হিশাবে স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজির হওয়া চরম লজ্জার বিষয়। এ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এখন কথা উঠেছে যে ইসরাইল আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক দেশ নয়। তাহলে উভয় দেশের স্বার্থ এক হতে পারে না। ভূরাজনৈতিক স্বার্থ নিয়েও তর্ক উঠছে। বহু কিছুই অতএব এখন দ্রুতবেগে ঘটতে থাকবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, গাজার ঘটনাবলীর চাপের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শক্তির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমবে কি? হ্যাঁ। আপাত দৃষ্টিতে কমতে শুরু করেছে। এখন দিল্লির সমর্থনে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদের পক্ষে নির্বাচন সহজ হোল। ঠিক। তাহলে কি বিএনপি ও বিরোধী দল বাদ দিয়ে জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচন হয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ, পারে। কিন্তু সেটা রাজনৈতিক সংকটের বিন্দুমাত্র সমাধান নয়, কিম্বা ফ্যাসিস্ট শক্তির আন্তর্জাতিক বৈধতা লাভও নয়। বরং সংকট আরও ঘনীভূত হওয়া। ফ্যাসিস্ট শক্তির বৈধতার ঘাটতি ঘরে বাইরে আরও চরম ভাবে ঘটবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট এখন অতিশয় গভীর। সেই সংকট ফ্যাসিস্ট শক্তি প্রবল ও প্রকট দমনপীড়ন দ্বারা মোকাবিলা করতে চাইবে। কিন্তু দমনপীড়ন ক্ষমতাসীনদের পতন ত্বরান্বিত করবে। সেই দমন পীড়নের নমুনা কেমন হতে পারে এবং তার দায় কিভাবে ক্ষমতাসীনদের ওপর বর্তাবে বুঝতে হলে মানবাধিকার সংস্থা হিউমেনরাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক রিপোর্ট (Bangladesh: Violent Autocratic Crackdown Ahead of Elections) আমরা পড়ে দেখতে পারি। বলা বাহুল্য, ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন এখন বরং আরও করুন ও কঠিন রূপ নেবে।

ফ্যাসিস্ট শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশের সংকট সামাল দেবার কৌশল তাহলে 'ক্রাকডাউন' -- বিরোধী দল ও ভিন্ন মতাবলম্বিদের ওপর চরম নির্যাতন ও দমনপীড়ন। এটা সকলেই বুঝে গিয়েছে। ক্ষমতাসীনরা আর কি চাইতে পারে? সহিংসতা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য। তারা চাইবে নির্বাচন ঘিরে বিএনপি ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস ও সহিংসতা ঘটুক, কিম্বা তারা নিজেরা ঘটিয়ে বিরোধী দলের ওপর ক্ষঅমতাসীনরাই চাপাবার চেষ্টা করবে। তারা চাইবে সংঘাতের নামে দিল্লি নিরাপত্তার অজুহাত এনে যেন আরও সরাসরি ও প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তির উদ্ধার কর্তা হিশাবে হাজির হোক। মণিপুর ও মায়ানমারের বাস্তবতা পরিষ্কার জানান দিচ্ছে যে পূর্ব ভারত ভূরাজনৈতিক দিক থেকে দিল্লির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, যাকে সামাল দেবার ক্ষমতা দিল্লি নিজেও দ্রুত হারাচ্ছে।

ভারতের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নন, এমন নয় মোটেও। বাইশে নভেম্বর Times of India-র সম্পাদকীয়কে তাই হাল্কা ভাবে নেবার উপায় নাই ‘Halting Hasina: India should worry about Bangla PM’s authoritarian streak. It will hurt her interests as well as New Delhi’s’ । অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারতের স্বার্থে হাসিনাকে থামানো উচিত? কেন? যেন রাজনীতির খেলাটা মূলধারার বিরোধী দল – অর্থাৎ বিএনপি ও আওয়ামি লীগের মধ্যে হয়। টাইমস অব ইন্ডিয়া রীতিমতো সম্পাকীয় ফেঁদে বলছে, বিএনপিকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উগ্রপন্থিদের পথ করে দেয়া। এটা বিএনপি এবং শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ উভয়ের জন্যই খারাপ।

খেয়াল করুন, এই সম্পাদকীয় বিএনপির ভাবমূর্তির জন্যও ক্ষতিকর বটে। বোঝা যাচ্ছে টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং দিল্লির নীতিনির্ধারকদের প্রভাবশালি একটি অংশের কাছে বিএনপি দিল্লির স্বার্থের প্রতিকুল নয়, অনুকুল। বিএনপিকে প্রান্তিক করা হলে বাংলাদেশে ‘উগ্রপন্থা’ শক্তিশালী হবে, তাই এই যুক্তি দিতে তারা দ্বিধা করছে না। । তার লক্ষণ এখনই নাকি দেখা যাচ্ছে। উচ্চ আদালত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার আগের নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ উদ্বিগ্ন যে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীরা যোগ দিচ্ছে, সেই খবর নাকি তাদের কাছে আছে। এই দলত্যাগীরা আওয়ামি লীগের ভেতর থেকে আওয়ামী নেতৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। তাছাড়া রয়েছে মার্কিন ফ্যাক্টর। ওয়াশিংটন স্পষ্টতই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদের অভিযোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যা তো ভাল্লুকের মতো মুখ হাঁ করে আছেই। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, এতে তিন মাসের আমদানির খরচ জোগাতে বাংলাদেশ ঘাটতিতে পড়বে। সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি শতকরা ৯.৬ ভাগ হয়েছে। তাই বিরোধী দলের যে অবস্থান থাকা উচিত, তাদেরকে সেই স্থান না দিলে, উগ্রপন্থিরা যে জায়গায় এখন নাই - তারা সেই অবস্থান তৈরি করে নেবে। ‘That’s terrible news for India. A radicalised Bangladeshi establishment can bring Pakistan back into play. New Delhi should tell Hasina to change tack, in its, and her, interest. -- ভারতের জন্য এটা ভয়ঙ্কর খবর। বাংলাদেশে নাকি একটি উগ্রবাদী বাংলাদেশি এস্টাবলিশমেন্ট ফিরে আসবে, অর্থাৎ বাংলাদেশ আবার পাকিস্তান হয়ে যাবে!!!

হা হা হা হা! এই হোল 'টাইমস অব ইন্ডিয়া'র সাংবাদিকতার দৌড়। ভারতীয় সাংবাদিকদের বুদ্ধি বা বোঝা বুঝি হোল বাংলাদেশ যেন আবার পাকিস্তান না হয় সেই জন্য নিজের এবং শেখ হাসিনার স্বার্থেই তাকে নয়াদিল্লির পথ পরিবর্তন করতে বলা উচিত।

দেখা যাচ্ছে বিএনপির সঙ্গে ফ্যাসিস্ট শক্তির সমঝোতা হোক এটা দিল্লির নীতিনির্ধারকদের বৃহৎ একটি অংশ চায়। টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় সেই দিক থেকে বিএনপির নেতৃবৃন্দের প্রতিও পরামর্শ। বিএনপি এই পরামর্শ কিভাবে নেবে সেটা দ্রুতই আমরা জানব। টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় থেকে আমরা বুঝি ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে বিএনপির সমঝোতা মূলত বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্য বহাল রাখবারই রাজনীতি। বিপরীতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিএনপির এখনকার যে অবস্থান তার বিজয় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লির পরাজয়। কিন্তু এই বিজয় অনবার্য। এটা পরিষ্কার ভারত বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাতের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনই দিল্লিকে মোকাবিলার ছহি পথ। উপমহাদেশে বাংলাদেশের শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্তিত্ব মজবুত করবার আর কোন পথ নাই।

ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার দৃশ্যমান শিথিল অবস্থা কি দীর্ঘস্থায়ী হবে? অবশ্যই না। কারন এশিয়া – বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন ভুরাজনৈতিক স্বার্থের চরিত্র এমনই যে চিনের ক্রমবর্ধমান শক্তি সঞ্চয়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিথিলতা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া অসম্ভব। জো বাইডেন প্রশাসনের কারণে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শক্তির ওপর চাপ আপাতত শিথিল হলেও, বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন নীতি অব্যাহত থাকবে। ভূরাজনৈতিক বস্তবতার বড় ধরনের পরিবর্তন না ঘটলে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি বদলানোর সম্ভাবনা বিশেষ নাই। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি সম্পর্কে একই নীতি অব্যাহত রাখবে। তারা এই রেজিম চলুক, সেটা চায় না।

প্রশ্ন হচ্ছে এই সকল টানাপড়েনে বর্তমান আন্দোলনের ধারা আপোষের গর্তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে কি? না, থুবড়ে পড়বে না। তবে হোঁচট খেতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, যদি আপোষ আদৌ ঘটে তবে আন্দোলন হোঁচট খাবে হয়তো, কিন্তু সেটা সাময়িক হতে বাধ্য। মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা আমি আদৌ দেখি না। সেই স্তর আমরা পার হয়ে এসছি। হোঁচট খাওয়া আর মুখ থুবড়ে পড়া একদমই আলাদা দুটি বিষয়।

অতএব পরিষ্কার, যারা অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে মাঠে রয়েছেন, এবং থাকবেন, বাংলাদেশের আগামি ইতিহাস তাদের দ্বারাই নতুন ভাবে লেখা হবে।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।