বিএনপি, ভোটাভুটির বাজার ও গণতন্ত্র - ২


 ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান’

এবার আমরা আসি বিএনপির অসহযোগ ঘোষণার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে। সেটা হোল, অনির্বাচিত ও অবৈধ সরকারকে ট্যাক্স, খাজনা ও ইউটিলিটি বিল না দেওয়া। নির্বাচিত সরকার না হলে ট্যাক্স, খাজনা বা কর নেবার অধিকার নাই, বা "নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান" – গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সম্পর্কে এই ধারণা দানা বেঁধেছে মার্কিন দেশে আঠারোশ শতকের শেষের দিকে। এই রণধ্বণি প্রথম তোলা হয়েছিল ১৭৬৫ সালে, যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে স্ট্যাম্প আইন পাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ব্রিটেনের কলোনি। এই আইন অনুসারে, আমেরিকার উপনিবেশবাসীরা সকল সরকারি দলিল, পত্রিকা, বই, ইত্যাদিতে স্ট্যাম্প কর দিতে বাধ্য ছিল। উপনিবেশবাসীরা এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, কারণ তারা মনে করত যে এই আইন তাদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই তাদের উপর চাপানো হয়েছে। তারা এই আইনকে "অনৈতিক" এবং "অস্বাভাবিক" বলে আখ্যায়িত করে। 

"নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান" রণধ্বনি, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে দাবি ও মতবাদ হিশাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেকে দাবি করেন গণতন্ত্রের এই মতাদর্শই মার্কিন জনগণের উপনিবেশ বিরোধী লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এই রণধ্বণির ভিত্তিতে আমেরিকার উপনিবেশবাসীরা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করে জয়ী হয়েছে। তাহলে অনির্বাচিত ও অবৈধ সরকারকে বিএনপির ট্যাক্স, কর বা খাজনা না দেবার দাবি আদতে উপনিবেশ বিরোধী গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের দাবি। শুধু নীতিগত নয়, কৌশলগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কারন এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ মার্কিন জনগণের ঐতিহাসিক লড়াই সংগ্রামকে উপমহাদেশে অর্থপূর্ণ ভাবে হাজির করলো। দিল্লির তাঁবেদার ফ্যাসিস্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ট্যাক্স, কর বা খাজনা না দেওয়া পরাধীন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আরেকটি স্তরে প্রবেশ করা। যার তাৎপর্য বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত হতে পারে। "নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান" – অতএব চলমান আন্দোলনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ অবদান হিশাবে হাজির হতে চলেছে। যারা বাংলাদেশের জনগনের লড়াই-সংগ্রামে অর্থপূর্ণ ভাবে অবদান রাখতে আগ্রহী তারা ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রপ্রেজেন্টেশান’ মতবাদের উল্লেখযোগ্য সমর্থকদের লেখালিখি পড়তে পারেন। জোনাথন এডামস (১৭৩৫-১৮২৬): আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নেতা এবং ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান’ মতবাদের অন্যতম প্রচারক। থমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬): আমেরিকার তৃতীয় রাষ্ট্রপতি এবং ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান’ মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা। প্যাট্রিক হেনরি (১৭৩৬-১৭৯৯): আমেরিকার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং বক্তা। তিনি ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান’ মতবাদের প্রচারণায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান" – নির্বাচিত ও অবৈধ সরকারকে কর, ট্যাক্স বা খাজনা না দেওয়া মোটেও র‍্যাডিকাল দাবি না। বরং একান্তই ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক’ দাবি। এই রাজনৈতিক মতাদর্শ আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমেরিকার সংবিধানে ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান’ নীতি হিশাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই নীতি অনুসারে, আমেরিকার সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কোন ট্যাক্স, কর বা খাজনা আরোপের আইন পাস করতে পারে না।

সত্য বলতে কি, আসলে এই দাবি – অর্থাৎ জনগণের কাছে এই আবেদন বিএনপির অনেক দেরিতে তুলল। ভোটচুরির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা অনির্বাচিত, অবৈধ ফ্যাসিস্ট শক্তি জনগণের কাছে খাজনা আদায় করবার কোন অধিকার রাখে না। এই সচেতনতা জনগণের মধ্যে গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটা উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়বার একদমই গোড়ার দাবি। তাই জনগণকে সচেতন করবার জন্য এই দাবি বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর অনেক আগেই তোলা উচিত ছিল।

‘অনির্বাচিত অবৈধ সরকার’ স্রেফ একটা গালি কিম্বা বিরোধী দলের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা নয়। এই রণধ্বণির 'বুর্জোয়া' বা গণতান্ত্রিক তাৎপর্য সম্পর্কে আমাদের সমাজ এখনও অসচেতন ও অজ্ঞ। অবৈধ সরকারকে খাজনা না দেওয়া কিম্বা অসহযোগ আন্দোলনের ডাকও বিপ্লবী কোন দাবি না, একান্তই বুর্কোয়া মতাদর্শিক দাবি। মনে রাখতে হবে বিএনপি কিম্বা বিরোধী দলগুলোও কোন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল নয়। কারন সমাজ এখবও পশ্চাতপদ। ফলে অসহযোগ আমাদের রাজনোইতিক চেতনায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সম্ভাবনা তৈরি করবে। সেই জন্য আমরা সবসময়ই আন্দোলন-সংগ্রামকে সমর্থন করেছি। আন্দোলন-সংগ্রামই জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করবার সদর রাস্তা। এর বিকল্প নাই।

গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, বরং রাষ্ট্র ব্যবস্থাও বটে, আর যেকোন রাষ্ট্রই অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। রাষ্ট্র চলে জনগণের টাক্স, কর বা খাজনার টাকায়। বাইরের দেশ কিম্বা দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক সূত্র থেকে যতো ঋণ নেওয়া হয়েছে সেই ঋণও জনগণের নামেই নেওয়া হয়েছে। তার দায় জনগণকেই শোধ করতে হবে। তাহলে একমাত্র জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই ট্যাক্স, কর বা খাজনা আরোপ করতে ও আদায় করতে পারে ও তুলতে পারেন। কর আরোপ করবার বৈধতা এবং নাগরিক হিশাবে কর দেওয়া জনগণের সাথে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্কের গোড়ার জায়গা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাই কর আরোপ করতে পারে। আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের কর্মচারিদের বেতন জনগণের টাকাতেই মেটানো হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কখন ট্যাক্স, কর বা খাজনা আদায় করবার অধিকার রাখে? এই প্রশ্ন গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠবার গোড়াতেই পরিষ্কার ভাবে ফয়সালা হয়ে রয়েছে। কি সেই ফয়সালা? ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান’ – অর্থাৎ নির্বাচিত সরকার না হলে তাকে ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এটাই গণতান্ত্রিক বিধি। অতএব অনির্বাচিত ও অবৈধ সরকারকে কোন ট্যাক্স, কর বা খাজনা না দিয়ে ‘অসহযোগ’ আন্দোলন গড়ে তোলার যে ডাক বিএনপি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী দলগুলো তুলেছে তা অতিশয় গণতান্ত্রিক, ন্যায্য এবং যৌক্তিক।

বিএনপি কেন এতোদিন অনির্বাচিত ও অবৈধ সরকারকে ট্যাক্স না দেবার দাবি তোলে নি তার জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করা উচিত। নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বোঝার যে মারাত্মক ভুল ও বিভ্রান্তি বাংলাদেশে রয়েছে বিএনপি সেই ভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয়। তবুও দেরিতে হলেও বিএনপির মধ্যে গণতান্ত্রিক ও গণমুখি প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি। যা ইতিবাচক।

নির্বাচন করব কি করব না সেটা একদিকে রাজনীতিতে কৌশলগত প্রশ্ন, জনগণকে সঙ্গে রেখে গণশক্তি বিকাশের কৌশল। কিন্তু নির্বাচন মানে গণতন্ত্র নয় এবং নির্বাচনসর্বস্বতা আদতে ফ্যাসিস্ট শক্তির আবির্ভাব এবং রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট রূপান্তর ত্বরান্বিত করে – জনগণের মধ্যে সেই সচেতনতা আনার মধ্য দিয়েই বিএনপি আগামি দিনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে ভূমিকা রাখতে পারে।

সেই ক্ষেত্রে করণীয়গুলো বোঝা দরকার। প্রথমত বিএনপিকে অবশ্যই নির্বাচনবাদ ও অন্তঃসারশূন্য নির্বাচনের খপ্পর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নির্বাচন বর্জন করা এবং অসহযোগ আন্দোলন সেই দিক থেকে খুবই যৌক্তিক এবং সঠিক পদক্ষেপ। এই কর্মসূচির ফলে বিএনপির নেতৃত্ব থেকে যতো দ্রুত ক্ষমতালোভী, সরকারি দালাল ও দিল্লির চরগুলো বেরিয়ে যাবে ততোই বিএনপি জনগণের আরও কাছে চলে আসবে এবং অসহযোগ আন্দোলন শক্তিশালী হবে। ততোই ‘নো ট্যাক্স উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান’- আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপির মধ্যে গণতান্ত্রিক এবং ‘বুর্জোয়া’ চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটবে বলে আমরা আশা করি।

বিএনপিসহ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা বিরোধী সকল বিরোধী দলকে এই দিকগুলো নানাভাবে বোঝানোই বুদ্ধিজীবিতার কাজ। ট্যাক্স, কর বা খাজনা সম্পর্কে আগে থেকেই আমরা বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। নজির হিশাবে দুই হাজার সতেরো সালের জুন অর্থাৎ আজ থেকে ৫ বছর আগে ঠিক এই বিষয়টা নিয়েই আমরা লিখেছি। আগ্রহীরা দেখুন, ‘নো ট্যাক্স উইদআউট রিপ্রেজেন্টেশান’। কমেন্টে লিংক দিচ্ছি।

বিএনপির মধ্যে হিন্দুত্ববাদী দিল্লীকে সন্তুষ্ট রাখার প্রবণতা যেমন রয়েছে, তেমনি সম্প্রতিকালে জায়নিস্ট রাষ্ট্র ইসরায়েলের নিঃশর্ত সমর্থক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রীতি ও সন্তুষ্টি লাভের প্রবল আগ্রহ আমরা দেখছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্যাংকশান দেয় নিজের স্বার্থে, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য না। এই কাণ্ডজ্ঞান বিএনপির আছে বলে মনে হয় না। যদি বিএনপি বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে অবিচল থাকে, পৃথিবীর কোন শক্তি নাই গণমুখি রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে ওপর থেকে বাংলাদেশে কোন পরিবর্তন ঘটিয়ে দেবে। অসহযোগের ডাক সফল করতে হলে বিএনপিকে দেশের বাইরের কোন পরাশক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। জনগণে্র কাছে যেতে হবে। পরাশক্তির প্রতি অতি নির্ভরশীলতা প্রধান বিরোধী দল হিশাবে বিএনপির জন্য আত্মঘাতী । আমাদের দরকার ভারতের জনগণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণসহ বিশ্বের সকল দেশ ও রাষ্ট্র নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মৈত্রী ও সম্পর্ক গড়ে তোলা।

গণতন্ত্র সম্পর্কে নীতিগত অবস্থান পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ভাবে হাজির করা এবং সঠিক সময়ে সঠিক রণধ্বণি তোলার ক্ষমতা অর্জন করতে পারার ওপর বাংলাদেশের আগামি রাজনীতি নির্ভর করে।

আমরা পিছিয়ে পড়ি নি মোটেও। এগিয়ে যাচ্ছি। (চলবে)


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।