ছ ফা ব না ম ছ ফা

(এই লেখাটা আমি আর কনটিনিউ করতে পারি নাই। এত বড় ক্যানভাসে কাজ করার ক্ষমতা আমার এখনো হয় নাই—এক প্রবন্ধে আস্ত ছফা রচনাবলীর মোকাবিলা। যে যে পয়েন্ট আমার মাথায় ছিল কিন্তু লেখা হয়ে উঠে নাই সেগুলো বলে রাখছি, কোনো একদিন ফিরব: বাঙালি মুসলমান তত্ত্ব, আশির দশকের ইসলাম ও মার্কস প্রশ্ন, ভারতীয় পুঁজির চরিত্র, জাতিরাষ্ট্র ও পরিবেশবাদী রাষ্ট্রের ধারণা, ছফার স্কুল/কলেজজীবনের কৃষক বিপ্লবের ধারণা, নব্বইয়ের দশকে ছফার পুঁজিতান্ত্রিক বাস্তববাদিতা, হেগেলের রাষ্ট্রচিন্তার প্রভাব, দীনেশচন্দ্র বনাম বঙ্কিম কেচ্ছা (হিন্দুরাষ্ট্রতত্ত্বের বিরোধিতা) ইত্যাদি। এতকিছু বাদ পরা সত্ত্বেও এই লেখায় ছফার অনেকগুলো মৌলিক প্রশ্ন তুলে আনতে পেরেছি বলে মনে করি।)
আহমদ ছফা আমাদের সুদূর ভবিষ্যতে এমন কোন এক প্যাশনেট তরুণের অপেক্ষা করতে বলেছিলেন যে কিনা তার কাজের মধ্যে কোন একটা অর্থ খুজতে চেষ্টা করবে। সেই আকাঙ্ক্ষিত তরুণের আবির্ভাব ঘোষণা আমার উদ্দেশ্য নয়, তথাপি ছফার কাজের মধ্যে এক বা একাধিক অর্থ কিংবা অনর্থের খোঁজ করা সময়ের দাবি। যেহেতু বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিমণ্ডলে ছফা সাষ্টাঙ্গে বিরাজমান—পাতাকুড়ানির রূপে হোক কি মহাত্মার বেশে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের এক্সটেনশন আকারে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের যে বুদ্ধিবৃত্তিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে এবং এর ভেতরে ছফার নাম ভাঙানোর যে প্রবণতা, তার মোকাবিলা ছাড়া গত্যন্তর নাই। ছফা সত্যিই বাংলাদেশে একটা ঘটনা, এই ঘটনা ঘটে যাবার পর বাংলাদেশ আর আগের মতো থাকতে পারে নি। (মজহার ২০১৬:১৪৭) অবরুদ্ধ ইতিহাসের বীর্য আপন ঔরসে ধারণ করতে পেরেছিলেন তিনি। অপরিণত এক জাতির প্রসব বেদনা অনুরণিত হয়েছিল তার প্রত্যেক উচ্চারণে। আহমদ ছফা বাংলাদেশের বেড়ে ওঠার ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণ হয়ে আছেন।
তেইশ বছর আগে—২৮ জুলাই—কবি ও লেখক আহমদ ছফা ইন্তেকাল করেন। ছফার সাধনা কি পদার্থ, তার খোঁজ আমাদের করতে হবে একাত্তরের পাটাতনে। আহমদ ছফা একাত্তরের পয়দায়েশ, মুক্তিযুদ্ধকে মাতৃজ্ঞান করতে তিনি কখনো ভুলেন নাই। যখন তিনি দেখলেন মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল অপরে আত্মসাৎ করেছে, রক্ত দিয়ে চিন্তা করবার জেহাদে পিছপা হন নাই। মোটামুটি এখান থেকেই আজকের দিনে ছফাপাঠের জমিন তৈয়ার হচ্ছে।
আহমদ ছফার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে ২০০৬ সালে ফরহাদ মজহারের একটা লেখা প্রকাশিত হয় ‘আহমদ ছফা এবং ব্যক্তির মুক্তিতত্ত্ব’ নামে। লেখাটিতে ছফাপাঠের জন্য কিছু সাবধানবাণী রয়েছে যা আমাদের কাজে লাগে, “মুশকিল হলো, আহমদ ছফার লেখা সরল ও সুখপাঠ্য। কিন্তু যে সকল সিদ্ধান্ত ও জ্ঞানকান্ড অনুমান করে নিয়ে তিনি লেখেন সেটা অধিকাংশ সময়ই মৌলিক, ফলে তাকে পড়া যত আরামের, ‘পাঠ’ করা ঠিক সেই পরিমাণই কামলাগিরির—পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের।” (মজহার ২০১৬:১৪৫) এক্ষেত্রে কোন পাঠপদ্ধতি নির্বাচন করা যেতে পারে তা প্রশ্ন আকারে প্রথমেই হাজির হয়। এবং কি করেই বা ছফার সিদ্ধান্ত ও জ্ঞানকান্ডের অনুমান অনুসন্ধান করা যেতে পারে? তার সাধনা অনুধাবনের সহায় একমাত্র তার রচনাবলীর নিষ্ঠ পর্যালোচনা নয় কি? এর উত্তরে মজহার যোগ করবেন, “তার পুরো রাজনীতি, জীবনাচরণ ও কর্মকান্ড সর্ম্পকে সম্যক ধারণা না থাকলে তার রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাকে পেশ করা বিপজ্জনক।” এই সম্যক ধারণার জোগান ছফার রচনাবলী তো বটেই, তাছাড়া তার অপরাপর তৎপরতা এবং ইতিহাসবোধের ভেতরও রয়েছে। আহমদ ছফা আমাদের সামনে কিছু মৌলিক এবং অক্ষয় প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, আর “এমন নয় যে এইসব প্রশ্নের উত্তর ছফা দিয়ে ফেলেছেন, তাকে কোট করলেই ল্যাঠা চুকে।” তাই পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে ছফার মৌলিক জিজ্ঞাসাগুলো ছেঁকে বের করতে হবে, এ বিচারেই ছফার মানসাকাশের নক্ষত্রবিচার সম্ভবপর। আবার তার লেখালেখি থেকে বিচ্ছিন্ন উদ্ধৃতি দেবার বিপদও এড়ানো যাচ্ছে না। বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা ছফাকে যেভাবে ব্যবহার করে সেটার উপাদান ছফার ভেতর যেমন আছে, আবার এটা মোকাবিলা করবার হাতিয়ারও আমরা ছফার ভেতর পেতে পারি।
“ব্যক্তি আহমদ ছফা ও তাঁর লেখালিখি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে,” এই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠা একইসঙ্গে ‘ছফা’ নামক টেক্সটের পরস্পর সাংঘর্ষিক অর্থ উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়া হয়ে উঠাও বটে। অনুমান করি, প্রতিরোধের পাঠ তৈয়ারীর এই বীজ ছফার ভেতর বর্তমান। জাতীয়তাবাদের পূর্বানুমান থেকে ছফাপাঠ শুরু করা বিপজ্জনক এবং প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ হলেও ছফার লিমিটেশনগুলো ভুলে থাকলে চলবে না। বরং কিভাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বর্গ ছফার ভেতর বিরাজ করে এবং পঞ্চাশ বছরের লেখকজীবনে কিভাবে সেগুলোর রূপান্তর ঘটে তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। সাহিত্যিক সংবেদনশীলতার গুণ থাকার ফলে সময়ের চেয়ে প্রাগ্রসর চিন্তা তার লেখার ভেতর প্রায়শই ঝিলিক দিয়ে থাকে। এই রূপান্তরশীল চিন্তার যুগবিন্যাস কিভাবে হতে পারে, কোথায় আসলে বিভাজনরেখা টানা যেতে পারে এবং কিসের গুণেই বা এই রূপান্তর একটি পদ্ধতিগত অনুসন্ধানের অপেক্ষা রাখে—এসব এমন গুরুতর প্রশ্ন যার উত্তর এক ধাক্কায় দিয়ে ফেলা যায় না, দীর্ঘ ধারাবাহিক পঠনপাঠনের ফলে এর সুরাহা হলেও হতে পারে।
‘জর্মান ভাবাদর্শ’ লেখাটি মনীষী কার্ল মার্কসের তরুণ বয়সের লেখা হিসেবে পরিচিত। মাত্র আটাশ বছর বয়সে মার্কস জর্মান দেশের চিন্তার ইতিহাসে আবির্ভূত হয়ে দার্শনিকতার মানে বদলে দিচ্ছেন, উল্টো ঝুলে থাকা চিন্তাগিরিকে সোজা পায়ে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। অথচ “মার্কস ঠিক কোথায় বিপ্লবটা ঘটাচ্ছিলেন” তা গত দেড়শ-দুইশ বছরে আমরা ধরতে পারিনি! ১৯৪৩ সালে জন্ম হলে একাত্তরেও আমাদের আহমদ ছফার বয়স আটাশ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় আশ্রয় নিয়ে ওখানেই বাংলাদেশের নামে প্রথম বই বের করেন ছফা, জুলাই মাসে—নাম দেন ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। বইটার উদ্দেশ্য ছিল “বাংলাদেশের সংগ্রামের আসল চিত্রলেখা ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে নিরপেক্ষ বিচার এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা”। এরপর অনেক রক্তপাত। আহমদ ছফা দেশে ফিরেন। স্বাধীন দেশে পা রেখেই তিনি টের পান জাতীয় বিপ্লব বেহাত হতে চলেছে, কেননা নতুন সমাজের ভার বহন করবার মতো শক্ত বুনিয়াদ পুরাতন সমাজের ভেতর থেকে গড়ে ওঠেনি। এই দুশ্চিন্তার প্রতিফলন আকারে ছফা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রবন্ধটি “স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে” “কোন রকম চিন্তাভাবনা ছাড়া একটানা ১৭ ঘন্টা লিখে দু'দিনের মধ্যে” শেষ করেন। তরুণ ছফার রাজনৈতিক বাসনা সবচাইতে কাঁচা অবস্থায় ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ লেখাটিতে উঠে আসে।
যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে একটা রেনেসাঁর সম্ভাবনা দানা বেঁধেছে—এটাই মোটা দাগে লেখাটিতে ছফার অনুসন্ধান। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সামগ্রিক নৈরাজ্যের কারণ বীজ ছফা অনুসন্ধান করেছেন আমাদের জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিক ইতিহাসের গভীর থেকে।
রেনেসাঁর ধারণাটি তরুণ ছফার ভেতর বারবার ঘুরপাক খায়। এই বর্গটির ব্যবহারে তিনি ভুলেন না উনবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের এখানে একটা বেঙ্গল রেনেসাঁর গুজব চাউর ছিল। ছফা সাক্ষ্য দেন, এ সংবাদ গুজবমাত্র—“বাংলার উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের নবজাগরণ।” আমাদের ভূখণ্ডে যে রেনেসাঁ আবারো সম্ভাবিত হয়ে উঠেছে তা উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁর থেকে আরো ব্যাপক এবং গভীর। মজহারের ভাষায় ইঙ্গিত পাই, “ছফা খানিকটা বুর্জোয়া নবজাগরণের সাধক।” (মজহার ২০১৬:১৪৮) এই রেনেসাঁর একটা সংজ্ঞা ছফা দেন এভাবে: “রেনেসাঁর মূলকথা মানুষের জীবন সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ের নতুন মূল্যায়ন এবং বাস্তবসম্মত উপায়ে কি ব্যক্তিক জীবনে, কি সামাজিক জীবনে স্বীকার করে নেয়া।” (ছফা ২০১১:৩৬৪)
রেনেসাঁ, মানসবিপ্লব, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, জ্ঞানের শাসন—কথাগুলি ছফার কাছে একাকার হয়ে ওঠে। ছফা জীবনের অনেকগুলো বছর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, দলের ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় লিখেছেন। দলটির সঙ্গে তার সম্পর্ক ঘোষিতভাবে প্রেমের। জাসদ গঠনের নেপথ্যে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। এপর্যায়ে সিরাজের একটা উদ্ধৃতি পেশ করতে চাই: “বাঙালির জীবনে দু'বার জাগরণ এসেছিলো; বাংলার ইতিহাস থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে বাঙালি তৃতীয় জাগরণের ধাপ অতিক্রম করছে। অন্যভাবে বলা যায়, বাঙালি তৃতীয় জাগরণের পর্যায়ে রয়েছে।” (সিরাজ ২০১৯:১) এই জাগরণ ছফার রেনেসাঁর কাছাকাছি কিছু একটা নয় কি, যার সম্ভাবনা একাত্তরের মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝে বর্তমান হয়েছিল? উপলক্ষ্য ফুরাবার আগে বলে রাখি, সিরাজুল আলম খানের মতে আগের জাগরণদ্বয়ের প্রথমটি ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্য বা ইসলামের আবির্ভাব এবং দ্বিতীয়টি বেঙ্গল রেনেসাঁ। বাঙালির তৃতীয় জাগরণকে তিনি বুঝতেন বাঙালি সমাজের জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার পর্যায়ে উন্নীত হবার অভিযাত্রা। ছফা উবাচ, “সামাজিক বিপ্লবের পূর্বশর্ত সমাজের মুখ্য অংশে জ্ঞানের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।” (ছফা ২০১১:৩৬৫)
আগে বলেছি ছফার এই রেনেসাঁ জ্ঞানের সামাজিকীকরণও বটে। সামাজিক বিপ্লব ঘটে ‘জ্ঞানই শক্তি’ এই বোধ থেকে। ছফা এনলাইটেনমেন্টের ইউরোপীয় কাঠামো বা গতিপথ পরিহার করতে নারাজ, অথচ এর জন্য যে মানুষ বা লোকবল তার দরকার তাকে হতে হবে দেশজ: “আমাদের চাই নিজেদের মানুষ” যে ঢালাই হয় না, গড়ে ওঠে। আবার বাঙালি বর্ণহিন্দুর নবজাগরণের সমালোচনাও তিনি করছেন ‘পরিমাণগতভাবে’, ‘গুণগতভাবে’ নয়। বলেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের যে জাগরণটা ঘটেছে তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হিন্দু সমাজ এবং বাঙালি সমাজ শুধু হিন্দু সমাজ নয়।” হিন্দু সমাজের বাইরে এই যে বিপুল নির্যাতীত জনগোষ্ঠী যাদের ছফা ‘বাঙালি মুসলমান’ বলে চিহ্নিত করেছেন, তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব এখন এই মধ্যবিত্তীয় অপূর্ণতা পূর্ণ করা। বাঙালি হিন্দুর আয়নায় বাঙালি মুসলমানকে নিজের মুখ চিনতে শিখতে হবে!
একাত্তর আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের অগ্রগতি। ছফার মতে, “প্রতিটি রাজনৈতিক বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে একটা মানসবিপ্লবেরও প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে ওঠে।” স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ছফা যে অমোঘ মানসবিপ্লবের অনিবার্যতা দেখতে পান তা এজন্যেই। রাজনীতি এবং সংস্কৃতিকে পিঠাপিঠি ভাই-বোনের মত দেখা ছাড়া উপায় কোথায়? কেননা সমাজের পরিগঠন রাজনীতি এবং সংস্কৃতির যুগপৎ বিকাশের প্রশ্ন। উন্নততর সাংস্কৃতিক বিপ্লব উন্নততর রাজনৈতিক বিপ্লবের জন্ম দেবে, আবার সুস্থ রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া সুস্থ সংস্কৃতি কখনো আশা করা যায় না। নোকতা আকারে ছফা বলেন, “একটি সমাজের সর্বাঙ্গীণ গতির নাম রাজনীতি এবং সংস্কৃতি রাজনীতির রস-রক্ত।” ‘রাজনীতি ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক’, মোটামুটি এই ধারণাটা লেখার কেন্দ্রে ছিল বোধ করি। ছফার রেনেসাঁর অন্যতম খুঁটি রাজনীতি ও সংস্কৃতির মানসিক মেলবন্ধন সাধন।
‘সমাজতন্ত্র’ ছফার আরেক রহস্যশব্দ। বিশেষ করে এই লেখাটিতে সমাজতন্ত্র এসেছে সেই রেনেসাঁর পরিণতি আকারে। একটা বিষয় লক্ষ্য না করে পারা যায় না, ছফা এই শব্দগুলোকে তার সবচাইতে ব্যাপক এবং বৃহত্তর অর্থে ব্যবহার করছেন। যেমন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মূল কথা তার কাছে ‘মানুষ শুধু মানুষ’ এই বোধের উদ্বোধন। সমাজতন্ত্র কথাটাও এই ভঙ্গিতে পেশ করেছেন, ‘মানুষে মানুষে মিলন’। সমাজতন্ত্র কেবল একটা অর্থনৈতিক কাঠামো আকারে বা সাংবিধানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে আসবে না, সমাজতন্ত্র আসবে যখন সমাজতন্ত্রের মানুষ মন থেকে তৈয়ার হবে—যখন জনগণ নিজেকে ‘গঠন’ করবে। সমাজতান্ত্রিক দেশের যে সংস্কৃতি তা সেই সমাজের গণমানুষের দ্বারা পুরাতন সমাজের জঠর হতে টেনে নতুন সমাজে উত্তরণের মাধ্যমে সাধিত হয়েছে। অন্তত এতটুকু ছফা এই লেখায় আমাদের বলতে চেয়েছেন। আমাদের আরেক দিক দিয়েও সতর্ক থাকা দরকার, একবাল আহমেদ এটা ভালো করে বলতেন: “অসঙ্গতির অভিপ্রায় দাবি করে সংজ্ঞায়ন এড়িয়ে যাওয়া।” মাথায় রাখার মতো একটা কথা!
রেনেসাঁ, সমাজতন্ত্র, সাংস্কৃতিক বিপ্লব—এই বিবিধ শব্দ তরুণ ছফার চিন্তার বীজ আকারে বিবেচনা করা যেতে পারে। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক হস্তক্ষেপ যখন ছফা করছেন, এই শব্দগুলো তার কাছে গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে। এদের ভেতর ছফা একসময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তালাশ করেছেন বটে। ১৯৮২ সালের এক ডায়েরির ভুক্তিতে এই আহমদ ছফাই বলছেন, “আপাতত একটা সামাজিক বিপ্লবের পরিকল্পনা নেই।” স্পষ্টত আমরা ছফার ভেতর এমন চিন্তার বাঁকবদল বা মোড় পরিবর্তন দেখতে পাই কয়েক পর্যায়ে। “বাংলাদেশে আগামী দিনের বিপ্লব কৃষি বিপ্লব” (ছফা ২০১১:৪৬৫) থেকে “আমাদের এখানে আগামী বিপ্লব হলো বুর্জোয়া বিপ্লব” (ছফা ২০১৭:২৬০)—‘ছফা’ এক নয়, অনেক। চিন্তার এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছফার ভেতর অনুপস্থিত কল্পনা করাও কল্পনামাত্র। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২—এটা কি তাহলে ছফার সমাজবিপ্লবের যুগ? ‘বিপ্লব’ প্রশ্নটাকে কৃষি প্রশ্ন থেকে শুরু করে ধনতন্ত্রের বিকাশ পর্যন্ত আমাদের স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করতে হবে, তখন ছফার স্কুলজীবন থেকে কমিউনিস্ট সংশ্লিষ্টতার কথা উঠবে বা শেষ জীবনের বিপ্লব-বিরোধিতাও। বৃষ্টির সাথে বিপ্লবকে ছফা কিভাবে একাকার করে দেখতেন, মজহারের ‘শ্রাবণ ও বিপ্লব: যেদিন আমরা ছফাকে কবর দিয়ে এলাম’ লেখাটিতে তা এসেছে।
প্রসঙ্গে ফিরি। বুদ্ধিজীবিতার যে মুখরোচক সমালোচনা ছফার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ লেখায় পাই তা এর জনপ্রিয়তার মূলে থেকেও ‘বিশেষ’ দিক মাত্র, ‘সামান্য’ নয়। এই বইয়ের ভূমিকায় বদরুদ্দিন উমর যেভাবে বলছেন, “বাংলাদেশে আজ সাহিত্য ও কাব্যচর্চা এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রের ওপর তলায় সুবিধাবাদের যে নৈরাজ্য দেখা দিচ্ছে সেটা ওপর তলারই ব্যাপার। সামগ্রিক বিচারে তার গুরুত্ব তেমন বেশি নয়।” এই ওপরতলা-নিচতলার আলাপ অদূরদর্শী, ছফা স্পষ্ট দেখিয়েছেন কিভাবে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উৎপাদনের নৈরাজ্য সামাজিক নৈরাজ্যে রূপ নিচ্ছে এবং সেটা চিন্তার নৈরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। সুবিধাবাদটা সংস্কৃতির প্রান্তীয় গুণ নয় বরং একটি সুবিধাবাদের সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছিল।
সুবিধাবাদ যুদ্ধোত্তর লুটপাটতন্ত্রেরই চারিত্রিক বহিঃপ্রকাশ। একাত্তরের পর আমরা প্রত্যাশা করেছি বুদ্ধিজীবী এবং কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে “একটা বিরাট গুণগত পরিবর্তন” আসবে, তবে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী এবং লেখকেরা পূর্বের মতোই তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। কবি, সাহিত্যিক, লেখকেরা “গর্ভিণী নারীর মতো”, জাতীয় স্বপ্নের ভ্রুণ তারা আপন গর্ভে ধারণ করেন। অথচ বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবে, তা “আমাদের কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কল্পনায় আভাসিত হয়নি। দুই যুগ, এক যুগ, দুই বছর এমনকি এক বছর আগের লেখা কোন বইতে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হতে পারবে, তার ছিঁটেফোঁটা উল্লেখও নেই।” (ছফা ২০১১:৩২৪) এটাকেই ছফা কখনো ঐতিহাসিক পদ্ধতি বা ‘ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত’ বলেছেন। সলিমুল্লাহ খান কথিত ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ প্রবন্ধে ছফার এক নম্বর উপপাদ্য এমন: “বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতি ইতিহাসের অজ্ঞান উৎপাদন মাত্র, সজ্ঞান পরিকল্পনার ফসল নয়।” এই নোকতা আবারো ফিরবে।
ছফার মতে, সমাজে কবি-সাহিত্যিকদের ভূমিকা ঋষির মতো। ঋষি মানে যার দিব্যদৃষ্টি আছে, যিনি স্বপ্নদ্রষ্টা—“ভাবের আবেশে সামনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে ফেলেন—এই-ই হতে যাচ্ছে এবং এই-ই হবে।” এই দিব্যদৃষ্টির বদলে আমাদের বুদ্ধিজীবিতার প্রধান চরিত্র অন্ধত্ব, মানসিক দাসত্ব এবং সুবিধাবাদিতা। এজন্যই ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ লেখাটির প্রথম বাক্য, “বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।” বাংলাদেশের স্থপতি কেবল বাংলাদেশের জনগণ, কেননা “ঘটনা ঘটেছে ঘটনার নিয়মে।” সেখানে বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন নি। ছফা ১৯৭৭ সালে তার গুরুত্বপূর্ণ ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ লেখাটিতে বলছেন, “বাঙালি জনগণ যে আলাদা একটি জাতিসত্তা—এখানকার ডান-বাম কোন রাজনৈতিক দলের ঘোষণাতেই তার সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি মেলে না। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতেই বাঙালি জাতিসত্তা নিজেকে উন্মোচিত করেছে।” বিকাশমান বাঙালি মধ্যবিত্তের সংগঠন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম করেছে বটে (তাও আবার নিজের মধ্যশ্রেণীর স্বার্থে), তবে তারা একটা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিল না। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের কল্পনা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভেতর সরাসরি অনুপস্থিত ছিল এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যেসকল দ্বন্দ্বের সম্মুখীন তাদেরকে হতে হয় তা এই পরিকল্পনাহীনতা ও অপরিণামদর্শীতার ফল। ছফা স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে দুর্বার গণআন্দোলনটি সৃজিত হয়েছিল তার লক্ষ্যের অস্পষ্টতা, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, এ সমস্ত বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।” (ছফা ২০১১:৩৮০) সলিমুল্লাহ খানের একটা টীকা আমাদের একাত্তরের জটিল গ্রন্থি খুলতে সাহায্য করে: “মধ্যবিত্ত শ্রেণির গড়ন ও মনের বিচার ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বর্তমান পরিণতি বোঝা সহজ হবে না।” (খান ২০১০:১১৯)
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ লেখাটি থেকে শেষ বার ছফার কণ্ঠে শুনে আসি, “সমগ্র বাঙালি জাতির লিখিত ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মত তাৎপর্যবহ কোন ঘটনা নেই। এই প্রথম বাঙালি জাতি একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে।” এটাকে বলা যায় বাংলার ঐতিহাসিক অহমের অভ্যুদয়। পরবর্তী জীবনে এটাকে ‘বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক অহমের অভ্যুদয়’ বলতেন বোধ করি। ‘বাঙালি মুসলমান’ তত্ত্বে আমরা আসব, আপাতত ইতিহাসবিচারে ঢুকি। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা আর ইতিহাসের ধারণা নিয়ে ছফা তার ডায়েরিতে একবার লেখেন, “ইতিহাসের ধারণাই মানুষকে ঐতিহাসিক কর্মসাধনে প্রাণিত করে, ব্যক্তিত্ব কিংবা বীরের আলাদা কোনো মূল্য নেই।” (ছফা ২০০৪:৭৮) ছফার ইতিহাসবোধ তাহলে কেমন ছিল? ইতিহাসকে দেখার এই ভঙ্গিই কি ব্যক্তির রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাটাতন নির্মাণ করে দেয় না? আবার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের গভীর নিরীক্ষণে আমরা ব্যক্তির ইতিহাসবোধন সংগ্রহ করতে পারি কিনা? আমার ধারণা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস ছফাকে বারবার লিখতে হয়েছে এবং এর মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত নমুনা ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’।
জাতীয় জীবনের জটিলতার ইতিহাসে ছফা আবিষ্কার করেছিলেন ইতিহাসের জটিলতাগুলো। জাতির শরীরে যে রোগ তার উৎস ছফা সবসময় খুঁজতেন চাক্ষুষ লক্ষণ বা প্রত্যক্ষ আলামতের বাইরে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির ইতিহাসের গভীরে। এই পর্যায়ে আমরা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ থেকে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতায়’ প্রবেশ করছি, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭। মনে রাখা ভালো, সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত এসে ছফার মন থেকে জাসদের মোহ ভাঙে। এই ভাঙনের জোয়ার শেষোক্ত লেখাটিতে আছে। বাঙালি জাতির যে দ্বন্দ্ব ছফার আবিষ্কার তা দিয়ে এমনকি খোদ ছফার মনকেও পড়া যায়। একটা দোদুল্যমানতা যে কাজ করে বাঙালির মনে (ছফা এটা বাঙালি মুসলমানের মনেও আবিস্কার করেছিলেন), আমার দাবি এই দ্বিধাবিভক্তি ছফার কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। বেয়াদবি না হলে ফ্রয়েডীয় ভঙ্গিতে প্রশ্ন করা যেতো, বাঙালি জাতি বা বাঙালি মুসলমানের মনে যে টানাপোড়েন ছফা আবিষ্কার করেন বস্তুত তা তার নিজের অজ্ঞানের প্রতিফলন কিনা। ছফার ভাষায়, “একদিকে হচ্ছে ভয়ঙ্কর নিরাশা, হতাশা আরেক দিকে একটা নবজাগরণের ইঙ্গিত। এই দুটা প্রান্ত, এর মধ্যে জাতিটা দোদুল্যমান অবস্থায় আছে।” (ছফা ২০১৭:২৮২)
জাতীয় জীবনে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের বেহাত ফলাফলের হতাশা বা বাস্তবতা, আরেকদিকে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে একটা রেনেসাঁর সম্ভাবনা বা কল্পনা—এটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা। ছফাকে কালক্রমে দিশাহারা কম্পাসের কাঁটার মতো এই উত্তর-দক্ষিণে দুলতে দেখা গেছে।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ লেখাটি প্রকাশ পাবার পঁচিশ বছর পর, ১৯৯৭ সালে এর একটি পরিবর্ধিত সংস্করণ বের হয় নতুন ভূমিকা ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা’ যুক্ত করে। সাম্প্রতিক বিবেচনার অংশটি ছফার নব্বইয়ের দশকের ভাবনাচিন্তার দলিল, এটায় ‘অন্তিম ছফা’ নামক চিন্তার বীজগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা ছফার ইতিহাসের ধারণা খুঁজছিলাম। ইতিহাসের ধারণাই মানুষের ভবিষ্যত তৎপরতার দিক-নির্দেশনা দেয়, ইতিহাস থেকে মানুষ অন্তিম শিক্ষাটা কি নেয় তার ওপর নির্ভর করে সেই ব্যক্তির রাজনৈতিক বাসনা। ছফার শেষ বাসনা কি ছিল? সাম্প্রতিক বিবেচনার সপ্তম এবং অষ্টম পরিচ্ছেদ তাই আমাদের কাজে লাগে: “বামপন্থী রাজনীতির সার্বিক উত্থান ছাড়া এই দেশটির মুক্তি সম্ভব নয়” এবং “বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য বামপন্থী আন্দোলন এখন রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ উত্থানরহিত”। জাসদের প্রতি ছফার আবেগতাড়না আত্মঘোষিত। জাসদ, ন্যাপ প্রমুখ বামপন্থী রাজনৈতিক ধারার মহান ব্যর্থতার হতাশার ভেতর ছফার ইতিহাসের ধারণা নিহিত। ১৯৭৭ সালে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ লেখার সময় থেকে ছফার ভেতর এই ধারণাগুলি কাজ করেছে এবং সেই তাগিদ থেকে ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ নির্মাণ করেছেন। বামপন্থার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথাটা বলতে হয়তো তার আরো বিশ বছর লেগেছে, বামপন্থার পরাহত অতীতের আক্ষেপ তখন থেকেই ছিল। বলছেন জাসদ আর সর্বহারা পার্টির রাজনীতি ভুল খাতে প্রবাহিত না হলে দেশের ইতিহাস নতুনভাবে লেখা হতো। কেননা, “জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির তরুণরাই ছিলেন বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনের সবচাইতে সম্ভাব্য প্রতিশ্রুতিশীল শক্তি।” (ছফা ২০১১:৪০৪)
যুদ্ধপূর্ববর্তী ইতিহাসে ছফা খুঁটি গাড়ছেন পঁয়ষট্টি সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে ঘিরে, ঘোষণা দিচ্ছেন, “১৯৬৫-এর আগে বামপন্থী শক্তির যে ঐতিহ্যটা পূর্ববাংলায় ছিল তা পুনরুদ্ধার করতে হবে”। (ছফা ২০১৭:২১৯) ছফার মতে, উনিশ শ' পঁয়ষট্টি সালের পূর্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কৃষক সমিতি যখন অবিভক্ত ছিল, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের প্রথমার্ধের এই সময়টাই ছিল বামপন্থী রাজনীতির স্বর্ণযুগ। বলছেন, “১৯৬৫ সালের পূর্বে অবিভক্ত ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিই ছিল পূর্ববাংলার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।” (ছফা ২০১৭:২১৬) মনে রাখা ভালো, ষাটের দশকের শুরু থেকেই বামপন্থী রাজনীতিতে ভাঙন আসতে থাকে। সারাবিশ্বে বামপন্থী রাজনীতির বিকাশ রোধ করা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্র, তখন ঠাণ্ডাযুদ্ধ চলছে আর পৃথিবী পূর্ব-পশ্চিম ব্লকে বিভক্ত। সোভিয়েতের সাথে গণচীনও আছে। এরপর ইতিহাসের পরিহাসে ক্রুশ্চেভ প্রশাসনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণচীনের মাঝে বিরোধ লাগল। যদিও পরবর্তীতে দুই পক্ষকেই মার্কিনীদের সাথে যোগসূত্র রাখতে হয়—আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘সোভিয়েত-মার্কিন’ এবং ‘চীন-মার্কিন’ সম্পর্ক তৈরি হয় সোভিয়েত-চীন বিরোধের মধ্য দিয়ে। অপরদিকে ১৯৫৪ সালে বাংলায় শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি এবং সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর আওয়ামী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ছফার জবানে, “ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সহযোগিতা করার প্রশ্নে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং কেন্দ্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে মাওলানার মতান্তর ঘটে। তার ফলে জন্ম নেয় ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’।” (ছফা ২০১১:৩৯৯) ন্যাপের ঘোষিত লক্ষ্যের মধ্যে ছিল “স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অর্থনীতি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন।” এসবের জন্য ভারতের চর-দালাল, নাস্তিক, ইসলামের শত্রু, পাকিস্তানের সংহতির দুশমন এসব শুনতে যেমন হয়েছে, তেমন নেতারা জেলেও গেছেন। “আওয়ামী লীগ দলগতভাবে পাকিস্তানের মসনদে অসীন থাকার সময় কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবির বিরোধিতাই করেছিল”, অথচ যেখানে “বামপন্থী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকেই বাংলাদেশের জাতীয়তার বোধটি প্রথম অঙ্কুরিত ও মুকুলিত হয়” এবং বামপন্থী নেতাকর্মীদের হাতে এর বিকাশ।
আওয়ামী লীগ শুরু থেকে ছিল, ছফার মতে, তৎকালীন বিকাশমান পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক সংগঠন, তাই এই দল রাজনীতিতে শ্রেণীগত স্বার্থ কখনো ত্যাগ করতে পারেনি। শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর পক্ষ নিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন জোটের প্রতি সমর্থন দেন, এক পর্যায়ে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের অগ্রযাত্রা সরাসরি বিরোধিতা করেন। মূল কথা সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের সঙ্গে একটা প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপন করাই ছিল বাঙালি মধ্যবিত্তের মনঃপুত বাসনা। যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের এই প্রান্তে একটা মধ্য শ্রেণি গড়ে উঠেনি ততদিন আওয়ামী লীগ দলটি কম্পাসের কাঁটার মতো পশ্চিমে হেলে থেকেছে, তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেননি। ছফা উবাচ, “গোড়া থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলত পুঁজিবাদী রাজনীতি এবং স্পষ্ট ও প্রকাশ্যভাবে সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করাই ছিল আওয়ামী লীগ দলটির অন্যতম বৈশিষ্ট্যসমূহের একটি।” (ছফা ২০১১:৩৮২) ন্যাপ গঠনের পর আটান্ন থেকে পঁয়ষট্টি পর্যন্ত (১৯৫৮-১৯৬৫) অনেকগুলো ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে ঘটে। আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন, ভারত-চীন যুদ্ধে ভারত হারলে মার্কিনী সহায়তা পায়, এই অবস্থায় পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসে, সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্ততায় তাসখন্দ শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলন মস্কো-পিকিং বা সোভিয়েত-চীন দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে, মার্কিনীদের নিষ্পক্ষ ভূমিকার জন্যে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে আর পাকিস্তান গণচীনের দিকে হেলতে বাধ্য হয়। চীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত উভয়ের শত্রু, সেই সূত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ভারত মিত্র। কংগ্রেসের জোটনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং ঠাণ্ডাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এটা একটা গুরুতর পরিবর্তন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে মস্কোপন্থীরা ভারত এবং পাকিস্তানকে একসাথে একটা এশীয় ব্লক কল্পনা করতো, যেখানে টেকনাফ থেকে বেলুচের চাগাই পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করা হবে। তাই তারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি বা বাঙালি জাতির উত্থানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে বসল। আবার অন্যদিকে, গণচীনের সাথে আইয়ুব খানের সম্পর্ক ভালোর দিকে। সেই ভিত্তিতে পিকিংপন্থী ন্যাপের নেতা মওলানা ভাসানীকে মাওসেতুং বললেন, “আপনি আমাদের বন্ধু, এই মুহূর্তে যদি আপনি আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন তবে তা রাশিয়া, আমেরিকা ও ভারতের হাতকেই শক্তিশালী করবে। আপনার কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতিবিরুদ্ধ, তবে আমরা শুধু আপনাকে পরামর্শ দিতে চাই যে একটু ধীরে ও সতর্কভাবে এগোবেন। আপনাদের সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গভীর করার সুযোগ দিন।” (আলি ১৯৮৩:৭৭) মওলানা বাংলার কৃষকসমাজের প্রকৃত নেতা, তবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও ছফার মতে তিনি বিপথগামী হয়েছিলেন। ছফা এভাবে অভিযোগ তুলছেন, “সামরিক শাসকের সঙ্গে বাংলার প্রাণপ্রিয় কৃষক নেতার মাখামাখির ফলে যে ভুল করেছিলেন, আমাদের জাতি তার জন্য অনেক মূল্য দিয়েছে এবং এখনো মাশুল গুণে যাচ্ছে।” (ছফা ২০১১:৪০০) মওলানার প্রতি ছফা সদয় হন নাই: তার রাজনীতিকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং আধ্যাত্মিক ডাকেন, মওলানার প্রজ্ঞা আর মনীষা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সাপের মতো খোলস বদলানোর অভিযোগ দেন। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দোলন যে একাত্তরের আগে জাতীয় প্রশ্ন এড়িয়ে শ্রেণীপ্রশ্ন তুলে পরাজিত হলো তা প্রায় একা মূর্তিমান মওলানার ঘাড়ে চেপে দেন। বোধ করি, মওলানার প্রতি তার আকাশসমান প্রত্যাশা বা বামপন্থী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণে চরম হতাশা ছিল। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উত্তাল উত্থান ঘটে তার নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়ে যায় অন্তর্কলহ, বিপথগামিতা, ‘অঞ্চলবহির্ভূত আদর্শবাদী অন্ধ আনুগত্য’ ইত্যাদির কারণে, শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি নিয়ে এসে মধ্যবিত্তের সমর্থনে গণমানুষের শ্রেণীসংগ্রামের যে লড়াই বামপন্থী বা কমিউনিস্টরা কয়েক দশক ধরে গড়ে তুলেছিল তা হাইজ্যাক করে বসেন।
আওয়ামী লীগের ওপর ছয় দফা নাজিল হয় নাই, নিপীড়িত গণমানুষের দাবির একটা রূপ তারা ছয় দফার ভেতর আনতে পেরেছিল মূলত ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্বের’ ওপর ভিত্তি করে। ছফা টিপ্পনী কাটেন, “তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যে সকল বামপন্থী রাজনৈতিক দল প্রথমেই আন্দোলনের সূচনা করেছিল তাঁদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা শেখ মুজিবুর রহমানের অভূতপূর্ব সাফল্যের অন্যতম কারণ।” (ছফা ২০১১:৩৮২) মূলত জিন্নাহ সমর্থিত কেবিনেট মিশন প্ল্যান আর শেখ মুজিবের ছয় দফা একই, যা কিনা ফেডারেল স্টেটের দাবি। আবার স্বায়ত্তশাসনের দাবিও পাকিস্তান প্রস্তাবের সময় থেকে মানুষের মনের ভেতর আছে। পাকিস্তান গঠনের পর যখন এই ‘কৃষকের বেহেশত’ ভেস্তে যায়, এখানকার কৃষক-শ্রমিকশ্রেণীর গণরাজনৈতিক বামধারার প্রচেষ্টায় দুই পাকিস্তানের সম্পর্কের ঔপনিবেশিক চরিত্রের সত্য উঠে আসে। গণমানুষের দাবি যাদের রক্ষা করবার কথা তাদের ব্যর্থতার ফলে একটা সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তীয় সংগঠনের হাতে জাতির ভবিষ্যৎ এসে পড়ে। নিজেদের শ্রেণীগত সংকীর্ণতার কারণেই এই নেতৃবৃন্দ কখনো ঘুণাক্ষরে টের পাননি তারা একটা জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন, সেই দৌড় তাদের কখনো ছিল না: “বাংলাদেশের জেগে ওঠা জনগণকে সঠিক নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা শেখ মুজিব এবং তাঁর শ্রেণীর ছিল না। সে দায়িত্বটা ছিল কমিউনিস্টদের। বাংলাদেশের জনগণ শুধু স্বাধীনতা দাবি করেননি, সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির দাবিও করেছিলেন।” (ছফা ২০১১:৪৭৫) “আওয়ামী লীগের মূল দাবি ছিল ছয়দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা।” (ছফা ২০১১:১৯৩) একতলা ভিতের ওপর যেমন তিনতলা বাড়ি দাঁড়ায় না, তেমনি স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ দেয়া যায়। যা যায় না তা করতে গিয়ে “বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং মুক্তিসংগ্রাম পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে” ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের তুরুপের তাস হয়ে উঠল। দেশের মাটিতে যুদ্ধ করবার গৌরব হারাবার পাশাপাশি আজীবনের জন্য ভারতের সাথে একটা হীনমন্যতার সম্পর্কে প্রবেশ করলাম আমরা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আসল স্বরূপ বা বাঙালি জাতিসত্তার ঐতিহাসিক অহমের অভ্যুদয় আসলে কি তা বুঝতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ববর্গ একদম ব্যর্থ ছিল, যার ফলে কংগ্রেসীয় ‘সাতচল্লিশের ব্যর্থতার’ বয়ান আওয়ামী লীগকে তুলে ধরতে হয়েছে। ছফার এখানে একটা মৌলিক ফোঁড়ন আছে: “বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধন মাত্র ছিল না, ছিল যুগপৎ অখণ্ড ভারতীয় একজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধনও।” (খান ২০১০:১০৬) সরল ভাষায়: ভারতের হিন্দু-মুসলমান দুটি জাতি আলাদা এটা যেমন সত্য নয়, তেমনি সত্য নয় ভারতের সব জাতি মিলে এক জাতি। এক জাতি হলে তো যুদ্ধের পর ভারতের পেটের ভেতর ঢুকে গেলেই হতো না? ভারত কেনই বা বাংলাদেশের যুদ্ধ দত্তক নিয়েছিল তা খতিয়ে দেখেছেন ছফা।
ভারতের বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা কখনোই ছিল না, একটা শক্তিশালী পাকিস্তানের থেকে ভারতের একটা দুর্বল শ্লথ পাকিস্তান অনেক বেশি কাম্য ছিল। সেজন্যই ছয় দফা দাবির ভেতর ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণী একটা নতুন দুর্বল বাজারের গন্ধ পেয়েছিল, বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ভারতীয় প্রচারণা ব্যবস্থা ভারতীয় জনগণের কাছে অনেক জনপ্রিয় করে তুলেছিল এবং “শেখ মুজিবের মধ্যে ভারতীয় জনগণ একই সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, জওহরলাল নেহরু এবং মহাত্মা গান্ধীর সাক্ষাত লাভ করেছিল।” (ছফা ২০১১:১৯৯) ভারত বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তার মধ্যে এমন কি দেখতে পেরেছিল যা এমনকি তার নেতৃত্বও দেখতে ব্যর্থ হয়েছিল? তা হলো জনগণতান্ত্রিক মডেল আকারে বাংলাদেশ। বহুভাষী এবং বহুজাতিক ভারতীয় ইউনিয়নের প্রান্তদেশে একটা জনগণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র যদি গণঅভ্যুত্থান এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে তাহলে অনতিবিলম্বেই ভারতের অন্যান্য শোষিত জাতিসমূহ ঐ একই পথ ধরবে—যা বৃহত্তর ভারতীয় ঐক্যের পথে মূর্তিমান হুমকি। ছফা বলেন, “ভারত ঠিক একটি দেশ নয়, অনেক দেশের পাশাপাশি সমাহার।” (ছফা ২০১১:২০৬) মারাঠি, বাঙালি, পাঞ্জাবী, কাশ্মীরি প্রভৃতি জাতিসত্তার অস্তিত্ব আছে তবে ভাতীয় জাতিসত্তা বলে কিছু নেই, তা জোর করে টিকিয়ে রাখা। বাংলাদেশের মর্মবস্তু বা এর নিয়তি আপন স্বরূপে আহমদ ছফা দেখতে পেরেছিলেন সবচাইতে স্পষ্টভাবে: “বাংলাদেশের জাতীয়তার সংগ্রাম ভারতবর্ষের বহু জাতীয়তার সংগ্রামের পূর্বাভাস মাত্র।” (ছফা ২০১১:৩৮৬)
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে শ্রেণী নেতৃত্ব দিয়েছে শেখ মুজিব বলি কি আওয়ামী লীগ তারা কখনো এসত্য উপলব্ধি করেনি। বাংলাদেশের নিয়তিটা তাহলে কি? “সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে ভারতের নির্যাতিত জাতিসত্তাসমূহের সামনে বাংলাদেশকেই সর্বপ্রথম প্রেরণার দৃষ্টান্ত সরবরাহ করতে হবে।” এটাই বাংলাদেশের নিয়তি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রাদর্শগত ভিত্তি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মূল দ্বন্দ্ব সমাজব্যবস্থায়। বাংলাদেশ গঠন হতে চলেছিল একটা বিপ্লবের মাধ্যমে যা ভারতে হয়নি, মুক্তিযুদ্ধের ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ নামক যে আদি অঙ্গীকার তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে বাংলাদেশ একটা জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আকারে আবির্ভূত হয়। রাজনৈতিক বিপ্লব একই সাথে দাবি করে অর্থনৈতিক বিপ্লব, যাতে পুরাতন উৎপাদন সম্পর্ক ভেঙে শোষণমুক্ত সম্পর্ক নির্মিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রথম এবং প্রধান বাধা ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণীর থেকেই আসবে। ছফা আমাদের ভুলতে মানা করেছেন ভারত জনসংখ্যার দিক বিশ্বের বৃহত্তম পুঁজিবাদী দেশ এবং দুনিয়ার “তাবৎ পুঁজিপতিমহল ভারতের সঙ্গে গাঁটছড়ায় আবদ্ধ। তারাও ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার বিরোধিতা করবেন।” (ছফা ২০১১:২৩২)
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি যেমন ইতিহাসের আপন কক্ষপথে ঘুরতে আরম্ভ করেছে, তেমনি ভারতীয় উপমহাদেশ নতুন এক রাজনৈতিক কক্ষপথে প্রবেশ করেছে: “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে ভারত উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচাইতে আধুনিক রাষ্ট্র। ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের উত্থান বাংলাদেশের উত্থান আধুনিক ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে অভিনব ঘটনা।” (ছফা ২০১১:২৯৭) এই অর্থেই বাংলাদেশের নাড়ির স্পন্দনে যে ধ্বনি তার সুর আন্তর্জাতিক।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকায় ফিরি। ছফার কেন বলেন “পাকিস্তানকে দুর্বল করা ভারতের উদ্দেশ্য ছিল কিন্ত ভেঙে একেবারে দু'টুকরো করা ভারতের উদ্দেশ্য ছিল না” তা আমরা এখন বুঝতে পারি। অথচ বাংলাদেশের জন্মে ভারতের শাসক কংগ্রেস ধাত্রীর কাজ করেছিল ঠেলায় পড়ে, আম-ছালা একত্রে হারাবার ভয়ে। ভারতের চেয়েছিল একটা স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তান যার স্বতন্ত্র অর্থনীতি এবং স্বতন্ত্র বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষমতা থাকবে, যার প্রাদেশিক সরকারে থাকবে ভারতঘেঁষা আওয়ামী লীগ। ছফা ভারতীয় পুঁজির চরিত্র আমাদের ব্যাখ্যা করেছেন শেষ জীবনে: ভারতীয় মূলধন আমাদের ভারতের অর্থনৈতিক পশ্চাৎভূমি বানিয়ে ছাড়বে, অর্থাৎ সস্তা শ্রম বা কাঁচামাল এবং চড়াদামের দুর্বল বাজার। এজন্যেই বাংলাদেশকে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে একটা শক্তিশালী অর্থনীতি তৈরি করতে হতো। ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির দিকেও নজর দিতে হবে: “ভারতের রাজ্যে রাজ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছিল। কেরালাতে কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধি, আসামে ভাষাদাঙ্গা, বিহারে খরা, উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষ, তামিল ভাষাভাষী অঞ্চলে হিন্দিবিরোধী আন্দোলন এবং পশ্চিমবাংলায় নক্সাল আন্দোলন।” (ছফা ২০১১:২০০) বাংলাদেশ যদিও ভারতের কাছে শাপে বর তাও এক বাংলাদেশ সমস্যা দিয়ে সমস্ত ভারতীয় সমস্যা চাপা দেবার সুযোগ কংগ্রেস হাতছাড়া করতে পারতো না। ভারতের জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের সংগ্রাম প্রচারণার মাধ্যমে এতটা জনপ্রিয় করে ফেলা হয়েছিল যে বিরোধীদলগুলোকেও কংগ্রেসের বয়ান মেনে চলতে হলো। উনিশ শ' পঁয়ষট্টির যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের আক্রমণ পশ্চিম রণাঙ্গনেই সীমিত রেখেছিল যদিও পূর্ব পাকিস্তান ছিল অরক্ষিত। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি সবচেয়ে নগ্নভাবে এখানে ধরা পরে, সামরিক কায়দায় ভারত কখনো বাংলাদেশ দখল করবে কেননা সেটা কম লাভজনক। সারোয়ার তুষারের একটা নোকতা এক্ষেত্রে আমাদের মামলা বুঝতে সহায়ক হয়: “মূল কারবারটা হলো জিওগ্রাফি মাইনাস ডেমোগ্রাফি। জিওগ্রাফির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখে ডেমোগ্রাফির ম্যানেজমেন্ট লোকালদের দিয়েই করানো।”
ছফা বলেছিলেন, ভারত কখনো বাংলাদেশকে সমরশক্তিতে পরাস্ত করবে না। কারণ বাংলাদেশকে হজম করার শক্তি ভারতের নেই। পঁয়ষট্টির যুদ্ধের পর তাই ভারত পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য মধ্যশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠনের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে তুলে ধরে জনমত জয় করেছে। ভারত, পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া—এই সকল পক্ষের চাওয়াপাওয়ার অপূর্ব বিশ্লেষণ ছফা ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ প্রবন্ধে বিস্তারিত দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যাখ্যাগুলো পুনরাবৃত্তি করলে এই ছফাপাঠের সামগ্রিক চেষ্টার পরিসরটা বোধ করি নষ্ট হয় কিছুটা। আমরা ঐ লেখাটার শেষ অংশে আসি।
বাংলাদেশকে যদি স্বাধীন সত্তা আকারে বিরাজ করতে হয় সেক্ষেত্র তাকে নিজের “রাষ্ট্রাদর্শগত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মূল দ্বন্দ্ব যেখানে সেটিকেই শাণিয়ে তুলতে হবে।” (ছফা ২০১১:২৩১) বাংলাদেশের রাষ্ট্রাদর্শগত ভিত্তি কি? ইতিহাসের কর্তাসত্তা হয়ে উঠবার যে বৈধতা, যে চাহিদা বাঙালি জাতির ভেতর জন্ম নিয়েছে, সেটাকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন দুটি জিনিস—একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে গঠিত হওয়া এবং শোষণমুক্ত বৈপ্লবিক সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি কায়েমের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা। এটাকেই ছফা নিজের মতো বলছেন, “একটি জাতিগত আত্মপরিচয়, অন্যটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আদর্শ।” তাহলে আমাদের জাতিগত আত্মপরিচয়টা আসলে কি—এই বাঙালি জাতি কে? বাঙালি জাতি কি বাঙালি জাতীয়তাবাদী একটা ধারণা? ছফা ঘোষণা দিচ্ছেন একাত্তরের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতিসত্তার সংকট মীমাংসা হয়ে গেছে, “বাংলাদেশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই বাঙালি; হিন্দুত্ব, মুসলমানিত্ব এবং উপজাতিত্ব এখানে প্রধান নয়।” (ছফা ২০১১:২৩২) যদিও ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের ধারণায় ছফার ইমান খানিকটা বেশি এবং বাঙালির ভাষিক বা সাংস্কৃতিক সত্তার দিকে সাহিত্যিক হিসেবে তার আলাদা নজর ছিল, তথাপি ছফা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক ঘটনা আকারে পড়তে পেরেছিলেন।
এই সূত্রে বাংলাদেশের জনগণের আত্মপরিচয়ের ওপর ফরহাদ মজহারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা পড়ি, “একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমাদের ঐতিহাসিক সত্তার আবির্ভাব মুহুর্ত। একাত্তর আমাদেরকে রাজনৈতিক অর্থে বাঙালি বানিয়েছে। এটা কোন জাতীবাদী পরিচয় নয়। রাজনৈতিক পরিচয়। এই রাজনৈতিক পরিচয় অর্জনের জন্যই আমরা একাত্তরে রক্ত দিয়েছি। বাঙালি কোন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নাম নয়। মিশ্র, শংকর বা বহু জাতির রক্ত ‘বাঙালি’ ধারণ করে। অতএব সকল নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর স্বার্থ ধারণের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই আমরা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠার শর্ত আদায় করতে পারি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর রাজনৈতিক অর্থে ‘বাঙালি’ মানে একান্তই বাংলাদেশের বাঙালি, ভারতীয় বাঙালি নন। তাঁরা ভারতীয়। শুধু ভাষা বা সংস্কৃতি রাজনৈতিক কর্তাসত্তা নির্ণয় করে না। ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণ লড়ে এবং রক্ত দিয়ে ‘বাঙালি’ হয়েছে।” ছফার অনুরণন মজহারের লেখাতেও পাই, “স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিশাবে বাংলাদেশের আবির্ভাব নিত্য এই সত্যই প্রমাণ করে যাচ্ছে যে ভারত বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির দেশ। ‘ভারত’ কোন জাতির নাম নয়। অখণ্ড ভারত তত্ত্ব একটা কাল্পনিক ও ফাঁপা বেলুন ছাড়া কিছু না।” (মজহার ২০২৩:১২১) ... (অসমাপ্ত)
১৫ আগস্ট ২০২৪
দোহাইঃ
১। ফরহাদ মজহার, ব্যক্তি, বন্ধুত্ব ও সাহিত্য (ঢাকা ২০১৬)।
২। আহমদ ছফা, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ (ঢাকা ২০১১)।
৩। আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারসমগ্র, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত (ঢাকা ২০১৭)।
৪। সিরাজুল আলম খান, স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম ও আগামীর বাংলাদেশ, মো. সাখাওয়াত হোসেন সম্পাদিত (ঢাকা ২০১৯)।
৫। আহমদ ছফা, নিবেদন, জাগ্রত বাংলাদেশ (কলকাতা ১৯৭১)।
৬। আহমদ ছফা, সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (ঢাকা ১৯৯৭)।
৭। সলিমুল্লাহ খান, বেহাত বিপ্লব ১৯৭১ (ঢাকা ২০১০)।
৮। আহমদ ছফার ডায়েরি, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত (ঢাকা ২০০৪)।
৯। Eqbal Ahmed, Terrorism, Theirs & Ours, (12 October 1998, University of Colorado)
১০। Tariq Ali, Can Pakistan Survive? (New York 1983)
১১। ফরহাদ মজহার, গণঅভ্যুত্থান ও গঠন: বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ প্রসঙ্গে (ঢাকা ২০২৩)