গণসার্বভৌমত্ব ও বাজেট প্রসঙ্গ

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তাই এবারের বাজেটে আশা ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিদেন পক্ষে কিছু ইতিবাচক অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে নেবার কিছু ইচ্ছা বা দিশা এই বাজেটে জনগণ দেখবে। কিন্তু জনগণ যেটা পেলো সেটা হোল অসমর্থিত ও অনির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান দিয়ে পুরনা চিন্তার ধারাবাহিকতা। বাজেট প্রস্তাবনা নিছকই লুটেরা-নিয়ন্ত্রিত টেকনোক্র্যাটিক প্রস্তাবনার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারলো না। অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। আমরা গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের প্রয়োজনীয়তার আলোকে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় এখানে আলোচনা করব।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শক্তিশালী অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় নি। সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। এই সরকারের সীমাবদ্ধতা ইতোমধ্যে আমাদের কাছে পরিষ্কার। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সহ অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে গণসার্বভৌমত্ব কায়মের সম্ভাবনা ইতোমধ্যে নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। তারপরও গণসার্বভৌত্বের আলোকেই আমরা বাজেট নিয়ে এখানে কিছু আলোচনা করব। আমাদের উদ্দেশ্য রাষ্ট্র কিভাবে বাজেট ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও প্রকল্পের মাধ্যমে বিশাল লুটতরাজকে বৈধতা দেয় সেই দিক বিশেষ ভাবে তুলে ধরা। অর্থনৈতিক পরিসরে গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের অর্থ জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি শক্তিশালী করা। রাষ্ট্র লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য বাজেটসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়িত করে। গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রের নামে অবাধ লুটপাট ব্যবস্থা প্রতিহত করা। তথাকথিত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের নামে রাষ্ট্র লুটপাটের কাজ করে থাকে । গণসার্বসার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের এই কীর্তিকলাপকে প্রশ্নাত্মক করে তোলে এবং রাষ্ট্রকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য করে। যে রাজনীতি রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতায় বাধ্য করে তা গণরাজনৈতিক ধারা নামে পরিচিত। অর্থনৈতিক পরিসরে গণসার্বভৌমত্ব কায়েম করার অর্থ অবিলম্বে রাষ্ট্রের নামে লুটতরাজ বন্ধ করা। এরপর দরকার পরজীবী ও শোষণমূলক ক্ষমতা ও আদেশদাতা না বানিয়ে রাষ্ট্রকে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চার পরিসর ও প্রতিষ্ঠান হিশাবে গড়ে তোলা। জুলাই গণভ্যুত্থানের স্পিরিট বিকশিত করতে হলে এর সকল দিক নিয়ে আমাদের ভাবতে শিখতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় রাষ্ট্রের কীর্তিকলাপ পর্যালোচনার জন্য নিজেদের সচেতন ও শিক্ষিত করে তোলা দরকার। আমাদের ভাবতে হবে জনগণ কিভাবে নিজেরা নিজেদের সমস্যা শনাক্ত, সমাধান ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা হাতে পেতে পারে। জনগণের ক্ষমতা বিকাশের মধ্য দিয়ে এবং জনগণের সামষ্টিক চেষ্টায় বাংলাদেশকে দ্রুত অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ করাবার পথ জনগণ নিজেরাই যেন নির্ণয় করতে পারে সেই চেষ্টাই আমাদের করতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রে সামষ্টিক রাজনৈতিক সত্তা হিশাবে জনগণের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নর ক্ষমতা অর্জনই সহজ বাংলায় গণসার্বভৌমত্ব কায়েম নামে পরিচিত। কোন টেকনোক্রেট, গণবিচ্ছিন্ন দেশী বা বিদেশী পরামর্শদাতা কিম্বা আমলা যেন জনগণের ভাগ্যের ওপর লাঠি ঘোরাতে না পারে তার ব্যবস্থা করাই এখনকার আশু কর্তব্য।
কিন্তু সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে গণসার্বভৌমত্ব অর্জনের সম্ভাবনা অংকুরেই বিনষ্ট করা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় জনগণের অভিপ্রায় বা চাওয়া পাওয়া গৌণ হয়ে গিয়েছে। পুরনা লুটেরা ব্যবস্থার কোন গুণগত পরিবর্তন বা সংস্কা্রের কোন ইঙ্গিত বাজেট প্রস্তাবনায় নাই। অবাধ বা কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থা ( Neo-liberal Economic Policy) দ্বারাই নগ্ন বাজার ব্যবস্থার অসুখ নিরাময়ের প্রস্তাব হাজির করা হয়েছে। বাজেটের পঠন ও বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে গণনির্ভর বাস্তব তথ্যের বদলে অনির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন সূচক এবং ওপর থেকে আর্থিক শৃঙ্খলা আরোপের ঠিকাদারি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। একে “contractarian technocracy”-র ভাল একটি নমুনা বলা যায়।
বাজেট বক্তৃতায় বারবার বলা হয়েছে এটি "discrimination-free", “zero poverty, zero carbon society”, “holistic development”-এর উদ্দেশ্য পূরণের জন্য রচিত। অথচ বাজেটে অর্থনীতির ওপর কোথাও “জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্ব” প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ মুনাফাখোরি ব্যবস্থার বিপরীত গণমুখি অর্থনীতির কথা নাই। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এটাই ছিল জনগণের প্রধান চাওয়া। কাছাখোলা বাজার নীতি বা লুটপাটের অর্থনীতির বিপরীতে জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের একটি রূপরেখা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের প্রধান প্রত্যাশা ছিল। অথচ জনগণের চাওয়া পাওয়ার কোন প্রতিফলন বাজেটে নাই। লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য কায়েম রাখা কাছাখোলা বাজার অর্থনীতির বিপরীতে জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিতর্ক এড়িয়ে একটা অ-রাজনৈতিক কৌশলগত দলিল হিশাবে বাজেট হাজির করা হয়েছে।
বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯%; ব্যয় ৭,৯০,০০০ কোটি, ঘাটতি ২,২৬,০০০ কোটি (জিডিপির ৩.৬%); “iBAS++” সিস্টেমে ডিজিটাল বাজেট ও EFT এর মাধ্যমে বেতন প্রদান ইত্যাদি আছে। পরিসংখ্যান-নির্ভর আগাম কিছু অনুমান সম্পাদন (performance-driven) করা যায় তার ব্যয়পত্র হিশাবে এই বাজেট হাজির করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর বিপরীতে জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতি কিম্বা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন মুখ্য নয়, বরং কতটা ট্যাক্স আদায় হবে, কতটা বৈদেশিক ঋণ আসবে, কতটা কোন সেক্টরে ব্যয় হবে—এসব প্রশ্ন গুরুত্ব পেয়েছে। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির জন্য একটি উদার বাজেট পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল (EPZ), অবকাঠামো, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, ব্যাংক ও পুঁজিবাজার সংস্কার—সব খাতেই সুস্পষ্টভাবে লাভবান ঠিকাদার গোষ্ঠী, বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বুরোক্র্যাট-লবিস্ট চক্রের প্রয়োজন মেটাবার জন্য বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক:
১০টি ইকোনমিক জোন চালু করা হবে, যেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিছকই মুনাফাখোরদের সেবা দান করা। অন্যদিকে বিশাল অঙ্কের ঋণ শোধের জন্য জনগণের উপর চাপ বাড়ানোর ব্যাবস্থা হয়েছে।
সুদ প্রদানে ১,২২,০০০ কোটি বরাদ্দ ধরা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে “লুট ও অদৃশ্যকরণ”-এর কথা উল্লেখ করলেও কারা করেছে, কীভাবে তারা বিচার এড়িয়েছে—তা আমরা এখনও জানি না। ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নত ও শক্তিশালী করবার কোন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় নি। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন নীতিও নাই। তাহলে শেখ হাসিনার আমলে যে সকল লুটেরা গোষ্ঠি ব্যাংক লুট করে বাংলাদেশকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেল এখন নতুন পরিস্থিতিতে কি নতুন লুটেরা শ্রেণী তৈরি হবে? জুলাই গণ অভ্যুত্থানে এই কি আমাদের অর্জন?
কাঠামোগত রাষ্ট্রীয় লুটপাটতন্ত্র
রাষ্ট্র কিভাবে কর্পোরেট পুঁজির দখলদারি ও লুটপাটকে বৈধতা দেয়?
রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর বহুজাতিক পুঁজির কর্পোরেট দখলদারিকে বৈধতা দেবার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের নীতি, পরিকল্পনা, প্রকল্প, বাজেট ইত্যাদি দ্বারা লুটপাটের ব্যবস্থা করে দেওয়া । এটা কাঠামগত লুটপাটতন্ত্র নামে ( structural laundering of looting through planning”) পরিচিত । বাজেটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর বহুজাতিক পুঁজির কর্পোরেট দখল বৈধ করা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু। বলা বাহুল্য, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পরই এই বিষয়টি অর্থনৈতিক বিষয়াদি তদন্তের প্রধান বিষয় হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের দ্বারা সেই সকল তদন্ত রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গণভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করে হাজির করা জরুরি।
“Structural Laundering” কথাটা অর্থশাস্ত্রে অর্থনৈতিক কেলেংকারি বা অপরাধ সাফসুতরা করে বৈধ করে নেবার কৌশল বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটা হোল রাষ্ট্রীয় নীতি, বাজেট, বা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে লুট বা শোষণকে ‘আইনি ও উন্নয়নমূলক’ রূপ দেবার কৌশল। অর্থনৈতিক অপরাধ সাফসুতরা করবার সাধারণত তিনটি ধাপ থাকে।
এক: লুট বা শোষণের অপরাধ ঘটানো (Extraction);
দুই: বাজেট বা রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, প্রকল্প বা কর্মসূচির (Planning / Programming) মাধ্যমে তাকে একটা কাঠামোগত রূপ দেওয়া ।
অর্থাৎ এমন একটি ভাব সৃষ্টি করা যাতে জনগণকে বোঝানো হয় রাষ্ট্র চাইলেই রাষ্ট্রের নামে করা সকল কাজ বা সকল নীতি আপনা আপনি বৈধ হয়ে যায়। তথাকথিত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখবার মধ্য দিয়ে লুটপাটতন্ত্রকে অনায়াসে বৈধ করা সম্ভব হয়। এই জন্যই তথাকথিত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিপরীতে গণসার্বভৌমত্ব কায়েম জরুরি হয়ে পড়ে। অর্থাৎ গণসার্বভৌমত্বের অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র সদা সর্বদাই জনগণের কাছে জবাব্দিহিতে বাধ্য থাকবে। রাষ্ট্র লুটপাটতন্ত্রের লীলা ক্ষেত্র হবে না।
তিন: আন্তর্জাতিক দাতা বা উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বারা লুটপাটতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া (Validation)।
গণসার্বভৌমত্ব কায়েম করতে হলে বাংলাদেশের জনগণকে অবশ্যই বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা সহ বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষক সকল প্রতিষ্ঠান ও সম্পর্ক গভীর ভাবে পর্যালোচনার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সবচেয়ে বেশী মনোযোগী থাকতে হবে বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেশান বা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী কর্পোরেশানগুলোর তৎপরতা এবং তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চুক্তি ও লেনদেন।
বড় একটি উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের তথাকথিত IPP ও LNG প্রকল্প। সরকার বাজেটে ১,২২,০০০ কোটি টাকা সুদ ও বিদ্যুৎ ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ দিয়েছে; এই অর্থের বড় অংশ নতুন IPP (Independent Power Producer) ও LNG-ভিত্তিক কর্পোরেট কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে; সেইসব কোম্পানি বাস্তবে অল্প উৎপাদন করেও “capacity payment” বাবদ লক্ষ কোটি টাকা পাচ্ছে। এই খরচ “বাজেটের বৈধ পরিকল্পনা” হিসেবে দেখা হলেও, এটি আসলে কর্পোরেট লুন্ঠনের (corporate loot) নগ্ন ধরণ। এই লুটতরাজকে বাজেট পরিকল্পনার নামে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। লুটপাটকে রাষ্ট্রের দ্বারা এভাবে সাফসুতরা ও বৈধ করাই structural laundering নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে SEZ (Special Economic Zone)-এ জমি অধিগ্রহণ। হাজার হাজার একর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে সরকার বিদেশি কোম্পানিকে অত্যন্ত কম মূল্যে প্রদান করছে। স্থানীয় কৃষক ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না, কিংবা পেলেও পাচ্ছে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম; কর্পোরেট লুটপাটের এই প্রক্রিয়া “রপ্তানিমুখী বিনিয়োগ উন্নয়ন” হিসেবে বাজেটে উপস্থাপিত হচ্ছে। অর্থাৎ, সামাজিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বহুজাতিক দখলদারি কায়েম হচ্ছে অথচ তাকে “উন্নয়ন” বলে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এটি আসলে জনগণকে তাদের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার থেকে পরিকল্পিত ভাবে বঞ্চিত ও বিতাড়িত করা। পরিকল্পিত ভাবে জনগণকে জমি ও জাতীয় সম্পদ থেকে বঞ্চিত করাটাই ‘লুটপাট’ (planned dispossession) ও ‘কর্পোরেট দখলদারি। আর প্রহসন হোল এই লুটপাট আর দখলদারিকেই জাতীয় উন্নয়ন নীতি (National Development Policy) হিশাবে হাজির করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের অর্থ হচ্ছে শুধু জনগণের কাছে জবাদিহিতা থাকলেই চলবে না বরং জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত রাখতে হবে। কিন্তু লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণী এটা চায় না। তারা দাবি করে ভোট দিয়ে আমরা তাদের নির্বাচিত করি। এরপর তারা রাষ্ট্রের নামে লুটপাট করতে থাকুক। গণসার্মত্ব কায়েমের প্রশ্ন মীমাংসা না করে নির্বাচনের দাবি এই জন্যই লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর রাজনীতি। এই রাজনীতি রুখে দেওয়ার ওপর বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।
তৃতীয় আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে বাজেটে অবকাঠামো প্রকল্পের ফুলিয়ে ফেলা ব্যয়
• Padma Bridge, Metro rail, Elevated Expressway ইত্যাদি প্রকল্পে প্রায়শই দেখা যায় ৩০-৪০% বেশি ব্যয় বরাদ্দ;
• টেন্ডার প্রক্রিয়া ‘বিশেষজ্ঞ-নির্ভর’ হলেও আসলে তা লুটেরা গোষ্ঠী ও বহুজাতিক নির্মাণ কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে।
• অথচ বাজেট এই ব্যয়কে স্বাভাবিক উন্নয়ন ব্যয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
এই সকল উদাহরণের দ্বারা পরিষ্কার যে লুটপাট চলছে বাজেট, পরিকল্পনার উন্নয়ন ইত্যাদির ছদ্মবেশে। এই বিশাল লুটপাট প্রকাশ্যেই চলছে। আর বাজেটের মধ্যে সেটা চলছে ঘোষণা দিয়ে, বাজেটের ভাষার মধ্যে গোপন রেখে।
প্রশ্ন হচ্ছে লুটপাটের এই মহোৎসব কিভাবে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতাকে ফাঁকি দেয়। এই দিকটি বুঝলেই আমরা গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের দাবির রাজনৈতিক গুরুত্ব শুধু নয়, অর্থনৈতিক গুরুত্বও বুঝব।
প্রথমেই বুঝতে হবে এই ধরনের লুটপাট “উন্নয়ন” নামে বৈধতা পায়, জনগণের কাছে পৌঁছায় ‘অগ্রগতির গল্প’ হিসেবে। এই প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার আমলের উন্নয়নের কেচ্ছাগুলি আমরা স্মরণ করতে পারি। সংসদে বাজেট পাস হলেও, তাতে জনগণের অংশগ্রহণ বা স্বচ্ছতা থাকে না।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আদালত বা দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাও কিছু করতে পারে না, কারণ সবকিছু রাষ্ট্রের “নীতি” বা “পরিকল্পনা” হিসেবে হাজির ও নৈতিক ভাবে সিদ্ধ করা হয়। জনগণ এক অদৃশ্য কর্পোরেট লুটপাট বা বহুজাতিক শোষণ কাঠামোর মধ্যে আটকা পড়ে। এই লুটপাট প্রশাসনিক ভাষা ও আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে বৈধতা পায়। এই ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন কোন কাজ করবে না। আর, দুর্নীতি দমন কমিশন তো রাষ্ট্রের অধীন সংস্থা। এই জন্যই প্রাচীন রাষ্ট্রীয় সার্ব্বহৌমত্বের ধারণা দিয়ে জঙ্গণের স্বার্থ রক্ষা অসম্ভব। যে কারণে গণসার্বভৌমত্বই গণতন্ত্র এই চিন্তা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মধ্যে জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বীজ নিহিত রয়েছে। তাই গণসার্বভৌমত্ব কায়েম ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সামনে আর কোন পথ নাই।
১২ জুন ২০২৫