এনায়েতুল্লাহ আব্বাসির বক্তব্য: শরিয়তের অপব্যাখ্যা, হত্যার প্ররোচনা এবং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি


বাংলাদেশে তাকফিরি প্রবণতার একটা পর্যালোচনা দীর্ঘদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মতাত্ত্বিক কাজ হিসাবে হাজির রয়েছে। বর্তমানে মুফতি এনায়েতুল্লাহ আব্বাসির জনসম্মুখে দেওয়া কিছু বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ‘তাওহিদি ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি ইসলামের নামে ‘শাতিমে রসুল’ (নবী (সা.) অবমাননাকারী) ও মুরতাদদের (ধর্মদ্রোহী) শাস্তিস্বরূপ ‘কল্লা কেটে দেওয়ার’ এবং ‘নিজ হাতে’ ফাঁসি কার্যকর করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন। তার এই ঘোষণার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন বিশিষ্ট দার্শনিক ফরহাদ মজহার, বুদ্ধিজীবি সলিমুল্লাহ খান, লেখক রাখাল রাহা এবং কবি সোহেল হাসান গালিবের মতো নাগরিকেরা।

সাম্প্রতিক সময়ে আরেক ভিডিওতে আব্বাসী সরাসরি ফরহাদ মজহারকে ‘ভণ্ড বাউল’, ‘কাফের’ এবং ‘জাহান্নামের কুত্তা’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেন, ‘এই ভণ্ড বাউলকে প্রকাশ্যে হত্যা করাও জায়েজ।’ এছাড়া, তিনি জনগণকে উত্তেজিত করে ফরহাদ মজহারকে রাজপথে পেলে কোদাল দিয়ে দাড়ি চেঁছে জুতা-পেটা করে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। একইসাথে, তিনি সরকারের কাছে ফরহাদ মজহারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দাবি জানান। এই বক্তব্যগুলো ইসলামের নামে ব্যক্তিগতভাবে হত্যা করার অধিকার দাবি এবং সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়ার প্রমাণ।

এই লেখায় আমরা আব্বাসির বক্তব্যের একটি ত্রিমাত্রিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করবো : 

১. ধর্মতাত্ত্বিক অসঙ্গতি: আব্বাসির ফতোয়াটি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, কোরআনের সহনশীলতার আদর্শ এবং বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত হানাফি ফিকহের প্রতিষ্ঠিত বিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। হানাফি ফিকহে ধর্মদ্রোহী ও কটূক্তিকারীর জন্য অনুশোচনা (তাওবা) করে ফিরে আসার সুযোগ রাখা হয়েছে। আব্বাসি তা স্পষ্টত উপেক্ষা করেছেন। বিপরীতে তিনি জনগণকে হত্যায় প্ররোচিত করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। তার বক্তব্য মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রী শাসকগোষ্ঠীর চিন্তাধারার প্রতিফলন এবং ইসলামের মানবিক মূল্যবোধ ও শরীয়তের মেজাজ ও মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

২. আইনগত অপরাধ: আব্বাসির বক্তব্য বাংলাদেশের প্রচলিত দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (Penal Code, 1860) এর ধারা ১০৯, ১১৫, ৩০২, এবং ৫০৫ এর অধীনে সরাসরি হত্যার প্ররোচনা (Incitement to Murder) এবং জনসাধারণের মধ্যে শত্রুতা ও সহিংসতা উসকে দেওয়ার অপরাধ। উপরন্তু, তার ‘সশস্ত্র বিপ্লবের’ ডাক সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ (Anti-Terrorism Act, 2009) এর অধীনে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে উসকানি হিসাবে বিচার্য।

৩. রাজনৈতিক-মতাদর্শিক বিপদ: আব্বাসির মতবাদ রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা অস্বীকার এবং শান্তিপূর্ণ নাগরিকদের হত্যার হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে খারিজি বা তাকফিরি মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটায়। এই ধরনের তাকফির (কাফের ঘোষণা) শাসকগোষ্ঠী বা বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৈধ করার একটি কৌশল। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তী নষ্ট করার প্রচেষ্টা। দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য চরম হুমকি।

অতএব আব্বাসীর বক্তব্য কেবল ধর্মীয় গোঁড়ামি নয়। বরং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, আইনের শাসন এবং দেশের অভ্যন্তরে সুশীল সমাজের অস্তিত্বের ওপর সরাসরি আক্রমণ। তাই, তাকে অবিলম্বে নৈরাজ্যবাদী ও সহিংস উগ্রবাদী হিসাবে ঘোষণা করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জাতীয় নিরাপত্তা, আইনের শাসন ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক।

আব্বাসির বক্তব্য ও ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপট

মুফতি এনায়েতুল্লাহ আব্বাসি কর্তৃক এমন ঘোষণাটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারির জুমার নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গোটে ‘তাওহিদি ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে তিনি তার বক্তব্য রাখেন।

আব্বাসী তার বক্তব্যে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী, লেখক ও দার্শনিকদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কার্যকর করার হুমকি দেন। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, “আর মিছিল নয়, এবার শরিয়া আদালতে মুরতাদের শাস্তি ফাঁসি আমরা নিজ হাতে কার্যকর করব। আল্লাহ ও তার হাবিব (সা.)-এর বিরুদ্ধে বেয়াদবি করে যারা, নাস্তিকদের মধ্যে সেটা যদি বাকস্বাধীনতা হয়, তাদের কল্লা কেটে দেবো— এটা আমাদের হাতের স্বাধীনতা”। তাঁর ভাষায় ‘কুখ্যাত রাখাল রাহা-গালিবকে গ্রেফতার করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে বলেন এবং হুঁশিয়ারি দেন যে কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কথা বললে তারা তাদের হাতের স্বাধীনতা চালু করে দেবেন।’ তিনি স্পষ্টভাবে যাদেরকে হত্যার সংকল্প প্রকাশ করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট দার্শনিক ফরহাদ মজহার, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি সলিমুল্লাহ খান, এবং লেখক ও গবেষক রাখাল রাহা ও কবি সোহেল হাসান গালিব ।

তিনি তাঁর বক্তব্যে কার্যত ৫ আগস্টের জনগণের সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থানকে অস্বীকার করেছেন। তার ভাষায়, ‘৫ আগস্ট আপনারা দেশ দখল করেছেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে না, চরমপন্থায়। মুসলমানও চরমপন্থায় নামতে বাধ্য হবে’। 

তিনি তার ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সরাসরি হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা নাস্তিকদের প্রশ্রয় দেওয়ার কারণেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। একইভাবে, যদি ইউনূস সরকার রাখাল রাহা, গালিব, ফরহাদ মাজহারকে প্রশ্রয় দেয়, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকেও বাংলাদেশ ছাড়তে হবে। তিনি আলেম-ওলামাদের নেতৃত্বে আরেকটি বিপ্লবের ডাক দিয়ে জাতীয় সংসদ দখল করে নাস্তিকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার ঘোষণা দেন, যা প্রয়োজনে সশস্ত্র বিপ্লব হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন।

এই কৌশলগত লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন (বুদ্ধিজীবীদের হত্যার হুমকি) এবং সরকারকে সরাসরি হুমকি দেওয়ার উদ্দেশ্য হোল: প্রথমত, উদারপন্থী চিন্তাধারার প্রতিনিধিদের ওপর সহিংস আক্রমণ করে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা; দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে আব্বাসীর লক্ষ্য কেবল ধর্মীয় নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা বা সরকারের নীতি-নির্ধারণে চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি করা।

ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: রিদ্দা ও শাতিমে রসুলের শাস্তির বিধানের পুনর্মূল্যায়ন

এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর দাবি, ধর্মদ্রোহী ও নবী অবমাননাকারীর জন্য মৃত্যুদণ্ড বাধ্যতামূলক এবং তা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কার্যকর করার অধিকার রয়েছে। এই কঠোর ব্যাখ্যাটি ইসলামের শিক্ষা, কোরআনের সহনশীলতা এবং ঐতিহাসিক ফিকহী বিশ্লেষণের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে অসার প্রমাণিত হয়।

ক. ইসলামের মূলনীতি: সহনশীলতা, সংলাপ এবং ক্ষমার আদর্শ

ইসলামের মৌলিক ভিত্তি হোল মানব জীবন, সম্পদ এবং প্রাকৃতিক অধিকার ও সম্মানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। আব্বাসীর ‘ব্যক্তিগত প্রতিশোধ’ এর দাবি সরাসরি কোরআনের নির্দেশিত উত্তম আচরণের নীতির পরিপন্থী।

প্রথমত, কোরআন সংলাপ ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি আর উত্তম উপদেশের মাধ্যমে প্রতিপালকের পথে আহ্বান জানাতে বলেছেন এবং বিতর্কের ক্ষেত্রে অতি উত্তম পন্থা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা আন-নাহল ১৬:১২৫)। এমনকি যখন মুসলমানরা অজ্ঞদের মুখোমুখি হয়, তখন তাদের ‘সালাম’ বা শান্তি দিয়ে বিদায় নিতে বলা হয়েছে (সূরা আল-ফুরকান ২৫:৬৩) ।

দ্বিতীয়ত, আকিদার (বিশ্বাস) ক্ষেত্রে ইসলামে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কোরআন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিয়ে বলে: ‘সত্য ও মিথ্যা স্পষ্ট হয়ে গেছে, যে ইচ্ছা করে সে ঈমান আনুক, আর যে ইচ্ছা করে সে কুফর করুক’ (সূরা আল-কাহফ ১৮:২৯)। এই আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে ইসলাম কারো মতামত বা বক্তব্যের জন্য ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহণের অনুমতি দেয় না। বরং বিচারিক ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত করেছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর বিচার করো মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার দ্বারা…’ (সূরা আন-নিসা ৪:৫৮)। আব্বাসীর নিজ হাতে হত্যার দাবি সরাসরি আইনের শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে।

খ. মুহারাবাহ (সশস্ত্র বিদ্রোহ) তত্ত্ব এবং ব্লাসফেমির সংযোগ

ধর্মদ্রোহিতার শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড বাধ্যতামূলক নয় এবং কোরআন বা হাদিসে এর কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। আব্বাসীর মতো উগ্রবাদীরা প্রায়শই মৃত্যুদণ্ডের ভিত্তি হিসাবে সূরা মায়েদাহ (৫:৩৩-৩৪) এর উদ্ধৃতি দেন। এই আয়াতে বলা হয়েছে, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে অরাজকতা সৃষ্টি করে, তাদের মৃত্যুদণ্ড, ক্রুশবিদ্ধকরণ, হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা বা দেশ থেকে নির্বাসিত করার শাস্তি দেওয়া হবে”।

তবে ফিকহশাস্ত্রের মধ্যে এই আয়াতটি ধর্মদ্রোহিতা বা মৌখিক অবমাননার জন্য নয়। বরং এটি মুহারাবাহ (যুদ্ধ বা সশস্ত্র বিদ্রোহ) এবং ফাসাদ ফিল আরদ (রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য) সৃষ্টিকারী অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য। মুহারাবাহ শব্দের প্রকৃত অর্থই হলো যুদ্ধ বা সশস্ত্র বিদ্রোহ করা, যা শুধুমাত্র নবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে শারীরিক বিদ্রোহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এটি কেবলমাত্র সেইসব ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য, যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে লিপ্ত হয় এবং সাধারণ মানুষের জান-মালের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

আব্বাসি আধুনিক রাষ্ট্রবিরোধী বাকপরাধের শাস্তি নির্ধারণে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক আয়াত ব্যবহার করছেন। আব্বাসি কৌশলে মৌখিক অপরাধকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায় নিয়ে গিয়েছেন, যাতে এর জন্য মৃত্যুদণ্ড বৈধ করা যায়। এটি একটি প্রাচীন কৌশল। এই ধরনের কৌশল রাজকীয় শাসকরা তাদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ রাখতে ব্যবহার করত। আব্বাসি ইসলামের মহৎ উপলব্ধি নিজ ব্যক্তিস্বার্থ ও আত্মম্ভরিতার মাধ্যমে ভূলণ্ঠিত করছেন।

গ. নবী (সা.)-এর জীবনাচার: ক্ষমার দৃষ্টান্ত

নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনাচার প্রমাণ করে যে ক্ষমার পথই ইসলামের মর্যাদা রক্ষার প্রকৃত উপায়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বহু অপমান, নির্যাতন ও বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন, তবে সর্বদা ক্ষমা, সহিষ্ণুতা ও দাওয়াতের মাধ্যমে এর জবাব দিয়েছেন।

মক্কা বিজয়ের পর নবী (সা.) তাঁর চরম শত্রুদেরও ক্ষমা করে দেন। যারা প্রকাশ্যে তাঁকে অপমান করেছিল, যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই (মুনাফিকদের নেতা) ও হাববার ইবনে আসওয়াদ, তাদের কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি। নবী (সা.) ঘোষণা করেন: ‘আজ তোমাদের প্রতি কোনো প্রতিশোধ নেই, তোমাদের ক্ষমা করা হলো। যাও, তোমরা সবাই মুক্ত’ (সিরাত ইবনে হিশাম, ৪/৫৬)।

অন্যদিকে, কাব ইবনে আশরাফ ও আবু রাফি-এর মতো যে অল্প কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছিল, তারা কেবল ধর্মদ্রোহী ছিল না; বরং তারা রাজনৈতিক ও সামরিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবীকে (সা.) হত্যার চেষ্টা করেছিল এবং ইসলামি উম্মাহর জন্য হুমকি স্বরূপ ছিল। সুতরাং, নবীজির মর্যাদা রক্ষার প্রকৃত উপায় ক্ষমা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, হত্যাকাণ্ড উসকে দেওয়া ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা নয়।

কিন্তু নবীজির মৃত্যুর পর ইসলামের প্রাথমিক যুগে ধর্মত্যাগ (মুরতাদ হওয়া) শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় ইস্যু ছিল না। এটি ইসলাম গ্রহণকারী জনগোষ্ঠির প্রতিরক্ষা ও রাজনৈতিক বিদ্রোহ হিসাবেও বিবেচিত হতো। তাই রাজকীয় বা রাজা কিম্বা শাসক কর্তৃক প্রদত্ত শাস্তির অংশ হিসাবে কার্যকর করা হতো।

ইসলামের প্রথম দিকের সমাজে ধর্ম ও রাজনীতি পৃথক ছিল না। ইসলাম কেবল একটি ধর্ম ছিলো না, এটি একইসাথে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ছিল। নবী মুহাম্মদ (সা.) যখন মদিনায় নিজের রাজনৈতিক শাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, তখন মুসলিম উম্মাহ একটি রাজনৈতিক সত্তা হয়ে ওঠে। ফলে ধর্মত্যাগ বা ইসলাম ত্যাগ করা কেবল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হিসাবে দেখা হতো না। এটি সকল মুসলিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য হতো।

নবী মুহাম্মদের (সা.) মৃত্যুর পর যখন কিছু গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল, তখন প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) রিদ্দাহ যুদ্ধ (অর্থাৎ, “মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”) পরিচালনা করেন।

এসব যুদ্ধ মূলত হজরত আবু বকর (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমনের জন্য পরিচালিত হয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে সেটাই। অর্থাৎ ধর্মত্যাগ তখন মুসলিম জনগোষ্ঠির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সমতুল্য ছিল। তাই, ধর্মত্যাগ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো।

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব সমাজে গোত্র ছিল ব্যক্তির একমাত্র পরিচয় এবং গোত্রের প্রতি আনুগত্য ছিল অবশ্য পালনীয়। গোত্রত্যাগ বা বিশ্বাসঘাতকতা গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামে উম্মাহর প্রতি আনুগত্যের ধারণার বিকাশ ঘটে। 

ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিম রাজ্যগুলো অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ছিল। ফলে ধর্মত্যাগ করে শত্রুদের সাথে যোগ দেওয়া রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ বিবেচিত হতো। তাই, ধর্মত্যাগ কেবল ধর্মীয় বিষয় হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 

খলিফাগণ, ধর্মীয় নেতা হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রপ্রধানও ছিলেন। তাঁরা সমাজের ঐক্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় কঠোর শাস্তির বিধান প্রবর্তন করেন, যার মধ্যে ধর্মত্যাগের শাস্তিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যার ফলে পারস্য জয়ের পরপরই ‘জিন্দিকের শাস্তি’ রাষ্ট্রদ্রোহের সাজা হিসাবে অপরিবর্তনীয় দণ্ড আকারে কার্যকর হতে শুরু করে। বিশেষত হিজাজ এবং খেলাফত শাসিত অঞ্চলগুলোতে এর ফলে বিদ্রোহ দমন করা খুব সহজ হয়ে যায়। খলিফা ও রাজন্যবর্গের অখণ্ড কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা সুরক্ষিত রাখতে ইসলামের বহু বিধি-বিধান মাত্রাভেদে অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। রিদ্দার শাস্তি যার মধ্যে অন্যতম।

সুতরাং, মুরতাদের শাস্তি বিষয়ে আব্বাসির বক্তব্য আসলে প্রাচীন শাসকদের বিভিন্ন প্রয়োজনে গড়ে ওঠা দমননীতিরই প্রতিফলন। তিনি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছেন, যা জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইসলামকে পুরাতন রাজন্যবর্গের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার মধ্যে তার রাজতন্ত্রের প্রতি অনুরাগও স্পষ্ট। আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রের মানবিক ও নাগরিক মূল্যবোধ তিনি ধারণ করেন না। 

ফলে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, আব্বাসি ইসলামের নামে প্রাচীন রাজতন্ত্রের ভাবধারা প্রচার করছেন। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশকে অস্থির ও অস্থিতিশীল করে তুলবে। 

হানাফি ফিকহে তাওবা ও শাস্তির বিতর্ক: বাজাজ্জি থেকে শামি 

এনায়েতুল্লাহ আব্বাসি যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ার প্রথাগত ইসলামি ধারার অনুসারী, তাই তার বক্তব্যটি দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সমাজে সর্বাধিক প্রচলিত হানাফি মাজহাবের আলোকে বিচার করা অপরিহার্য। হানাফি ফিকহ ধর্মদ্রোহের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে তুলনামূলকভাবে সহনশীল ও ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে।

ক. আল-বাজ্জাজির বিভ্রান্তি এবং হানাফি ফিকহের অবস্থান

ইসলামের প্রথম যুগের হানাফি ফকিহগণ, বিশেষত ইমাম আবু হানিফা, স্পষ্টভাবে বলেছেন যে ধর্মদ্রোহী বা নবী অবমাননাকারী যদি অনুতপ্ত হয় এবং ক্ষমা চায়, তবে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া যাবে না। ইমাম আবু হানিফা আরও বিধান দিয়েছেন যে নারী মুরতাদকে হত্যা করা হবে না, বরং তাকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে।

তবে ১৫ শতকের ইসলামি পণ্ডিত আল-বাজ্জাজি ভুলভাবে হানাফি মাজহাবের অবস্থান উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি দাবি করেন: “রাসূলকে গালি দিলে তার শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড এবং এর জন্য কোনো ক্ষমা নেই। এক্ষেত্রে কারো দ্বিমত করার সুযোগ নেই...” । এই বক্তব্য পরবর্তীতে ফতোয়া হিসাবে প্রচার লাভ করে।

আল-বাজ্জাজি মূলত হানাফি মাজহাবের একটি দুর্বল মতকে বর্ণনা করেছিলেন। যা হানাফি মাজহাবের মূলধারার কোনো রেওয়ায়েতে পাওয়া যায় না। এ থেকে বোঝা যায়, তার বর্ণিত এই মতটি মূলত তখনকার রাজনৈতিক চাপ বা অন্য মাজহাবের (হাম্বলি/মালিকি) প্রভাব থেকে জন্ম নিয়েছিল ।

খ. ইমাম ইবনে আবিদিন শামির খণ্ডন

আল-বাজ্জাজির এই মতবাদটি ইমাম ইবনে আবিদিন শামি (মৃত্যু ১৮৩৬ খ্রি.), যিনি ফিকহে হানাফির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ, তার ফতুয়ায়ে শামি গ্রন্থে কঠোরভাবে খণ্ডন করেন ।

ইমাম শামি উল্লেখ করেন যে বাজাজ্জি কীভাবে দাবি করতে পারেন যে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই, যেখানে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেয়ীর মতো মুজতাহিদদের মধ্যে স্পষ্ট মতভেদ রয়েছে। শামি স্পষ্ট করেন যে বাজাজ্জি এই কঠোর মতের প্রমাণের জন্য ইবনে তাইমিয়ার (হাম্বলি মাযহাবের পণ্ডিত) লেখা আস-সারিম আল-মাসলুল কিতাবের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

ইমাম শামি আবু ইউসুফের (কিতাবুল খারাজ) উদ্ধৃতি দিয়ে নিশ্চিত করেন যে, কোনো মুসলিম ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে গালি দিলে, যদি সে তাওবা করে, তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে। শামি উপসংহার টানেন যে, হানাফিদের মাজহাব হলো শাফেয়ী মাযহাবের মতোই—তাদের তাওবা গ্রহণ করা হবে। আর এই তাওবা কবুল হওয়ার অর্থ হলো, দুনিয়াতে তাকে হত্যার হাত থেকে বাঁচানো। এটি প্রমাণ করে যে আব্বাসি যে মৃত্যুদণ্ডের দাবি করছেন, তা হানাফি ফিকহের মূল বা সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য অবস্থান নয়।

গ. হদ এবং সিয়াসাহ এর মধ্যে পার্থক্য

ফিকহের ক্ষেত্রে শাস্তি দুই প্রকার: হদ (কোরআন-সুন্নাহ দ্বারা নির্ধারিত শাস্তি) এবং সিয়াসাহ বা তা'যির (রাষ্ট্রীয় বা বিচারিক বিচক্ষণতা দ্বারা নির্ধারিত শাস্তি)।

হানাফি ও শাফিয়ি মাযহাব মতে: ধর্মদ্রোহীর হত্যা তাওবার আগ পর্যন্ত হদ। যদি সে আন্তরিকভাবে তাওবা করে, তবে হদ বাতিল হয়ে যায়, এবং তাকে হত্যা করা আবশ্যক নয়। তবে, যদি ব্যক্তিটি ভয়ানক খবিস প্রকৃতির হয় এবং বারবার কটূক্তি করে তাওবাকে একটি কৌশল হিসাবে ব্যবহার করে বলে প্রতীয়মান হয়, তবে রাষ্ট্রীয় বিচক্ষণতা (সিয়াসাহ) প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা যেতে পারে, কিন্তু সেটা হদ হিসাবে নয়।

আব্বাসীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে হত্যার দাবি হদ বা সিয়াসাহ—কোনোটিরই অধীনে পড়ে না। ইসলামে বিচারিক ক্ষমতা কেবলমাত্র রাষ্ট্র ও আদালতের হাতে ন্যস্ত। আব্বাসি বিচারিক কর্তৃত্ব ছাড়াই ব্যক্তিগত রক্তপাত দাবি করছেন, যা নৈরাজ্য সৃষ্টি ছাড়া অন্য কিছু নয়।

মতাদর্শিক বিপদ: আব্বাসির ‘খারিজি’ প্রবণতা এবং তাকফিরের বিস্তার

এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর বক্তব্য ধর্মতাত্ত্বিকভাবে ভুল ও অনির্ভরযোগ্য ব্যাখ্য ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই প্রবণতা ইসলামের ইতিহাসে পরিচিত একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যাদেরকে চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রাঃ এর সময় থেকে খারেজি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

ক. আব্বাসির বক্তব্য ও খারিজি মতবাদ

খারিজি মতবাদের বৈশিষ্ট্য হোল গুনাহের কারণে মুসলমানদের কাফের ঘোষণা করা, এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে বৈধ মনে করা। আব্বাসীর বক্তব্য সরাসরি এই মতাদর্শকে প্রতিফলিত করে।

প্রথমত, আব্বাসি রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থা অস্বীকার করে নিজ হাতে হত্যার দাবি করেছেন। যা সরাসরি আইনের শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির উসকানি দেয়। দ্বিতীয়ত, তিনি তার অনুসারীদের এই উসকানির মাধ্যমে বাংলাদেশের কবি, লেখক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য লেলিয়ে দিয়েছেন।

ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ বিধান অনুযায়ী মুসলমানদের পরস্পরের রক্ত হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়” (সহীহ বুখারী, ৬৬৫৯)। আব্বাসির মতবাদক খারিজি মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ এবং খোদ ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসাবে গণ্য হতে পারে।

খ. তাকফির (কাফের ঘোষণা) এবং সহিংসতা

আধুনিক কালে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর (যেমন আল-কায়েদা, আইসিস-সংযুক্ত) কার্যক্রম তাকফির বা খারিজি মতবাদের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয় । তাকফিরিরা মনে করে, যে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ইসলামের তাদের ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তারা অবৈধ এবং মুরতাদ। আব্বাসি  তার বক্তব্য এই তাকফিরি রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ আকারে ব্যবহার করেছেন।

তিনি কেবল বুদ্ধিজীবীদের কাফের বা ‘নাস্তিক’ ঘোষণা করেননি। তিনি পরোক্ষভাবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার অপসারণকে অবৈধ হিসাবে হাজির করেছেন। তিনি বলেছেন যে সরকার নাস্তিকদের প্রশ্রয় দিলে অধ্যাপক ইউনূসকে দেশ ছাড়তে হবে। এটি তাকফির আল-হুক্কাম (শাসককে কাফের ঘোষণা) এর প্রাথমিক ধাপ। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য উসকানি এবং একইসাথে সরকারকে চাপ ও হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে আব্বাসি তার অনুসারীদের জন্য ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ বা সরকারবিরোধী সহিংসতা বৈধ করছেন। এই কৌশল বাংলাদেশে একটি সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী মতাদর্শের জন্ম দিতে পারে।

গ. জাভেদ আহমদ গামেদি এবং আধুনিক ইসলামি চিন্তাবিদদের দৃষ্টিকোণ

এনায়েতুল্লাহ আব্বাসির মধ্যযুগীয় কঠোরতার বিপরীতে আধুনিক ইসলামি চিন্তাবিদরা, যেমন জাভেদ আহমদ গামেদি, ধর্মদ্রোহের শাস্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সহনশীলতার পথ দেখিয়েছেন। গামেদি দাবি করেন যে, ইসলামী শরীয়তে ধর্মত্যাগ (apostasy) এবং নবী (সা.)-এর অবমাননার (blasphemy) জন্য নির্দিষ্ট কোনো শাস্তি নির্ধারিত নেই, বরং এগুলো ইজতিহাদের (বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ) বিষয়। রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী ও বিচারকগণ সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করতে পারে। তিনি মনে করেন যে, কোরআন ও হাদিসে কোথাও ধর্মদ্রোহের জন্য বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের কথা নেই, এবং শাস্তি কেবল সশস্ত্র বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলার জন্য প্রযোজ্য। 

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন: হত্যার প্ররোচনা এবং সন্ত্রাস

এনায়েতুল্লাহ আব্বাসির বক্তব্য বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য মারাত্মক অপরাধ, যা হত্যার প্ররোচনা ও সন্ত্রাসের উসকানি হিসাবে গণ্য হতে পারে। তিনি রাষ্ট্রের বিচারিক ক্ষমতা অস্বীকার করে নিজ হাতে শাস্তি কার্যকরের দাবি করে আইনের শাসনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন।

ক. দণ্ডবিধির আওতায় অপরাধের বিবরণ (Penal Code, 1860)

আব্বাসীর বক্তব্য দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারা লঙ্ঘন করে:

  • ধারা ৩০২ (খুন): আব্বাসির নির্দেশ অনুসারে যদি কোনো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তবে নির্দেশদাতা হিসাবে তিনি খুনের অপরাধে অভিযুক্ত হবেন। এই ধারার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

  • ধারা ১০৯ (প্ররোচনা): যদি কেউ কাউকে হত্যা করার জন্য উসকানি দেয়, নির্দেশ দেয় বা সাহায্য করে এবং হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তাহলে সে খুনের জন্য দায়ী হিসাবে গণ্য হবে। শাস্তি খুনের শাস্তির সমান (৩০২ ধারার অধীনে)। আব্বাসি সরাসরি ফরহাদ মজহার ও অন্যদের ‘কল্লা কেটে দেওয়ার’ নির্দেশ দিয়েছেন।

  • ধারা ১১৫ (হত্যার প্ররোচনা এবং অপরাধ সংঘটিত না হওয়া): যদি আব্বাসির নির্দেশ সত্ত্বেও হত্যা সংঘটিত না হয়, তবুও তার নির্দেশ বা ঘোষণা অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড এবং জরিমানা।

  • ধারা ৫০৫ (জনসাধারণের মধ্যে শত্রুতা উস্কে দেওয়া): আব্বাসীর জনসম্মুখে হত্যার ঘোষণা জনসাধারণকে সহিংসতার দিকে উসকে দেয়। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং শত্রুতা তৈরি হয়। এটি দণ্ডনীয় অপরাধ, যার শাস্তি সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড ও জরিমানা ।

খ. সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর অধীনে উসকানি

আব্বাসির বক্তব্য কেবলমাত্র ফৌজদারি অপরাধ নয়, এটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনেও বিচার্য। তার ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ এবং ‘কল্লা কেটে দেওয়ার’ ঘোষণা সরাসরি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের উদ্দেশ্যকে নির্দেশ করে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ (Anti-Terrorism Act, 2009) এর ধারা ১৭(গ) অনুযায়ী, কোনো সংগঠন যদি সন্ত্রাসী কার্য সংঘটনে সাহায্য করে বা উৎসাহ প্রদান করে, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেহেতু আব্বাসি সুনির্দিষ্টভাবে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন এবং নির্দিষ্টসংখ্যক নাগরিকদের হত্যার মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, তাই এই আইনের অধীনে তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়া প্রয়োজন। এই আইনের আওতায় শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। আব্বাসীর হুমকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মব জাস্টিস (গণপিটুনি) উসকে দিয়ে সমাজের ঐক্য ও স্থিতিশীলতার জন্য চরম হুমকি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞায়ও তা স্বীকার করা হয়েছে।

জাতীয় নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব

এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর উগ্রবাদী ঘোষণা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ক. অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার হুমকি

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ এমনিতেই একটি সংবেদনশীল অবস্থায় রয়েছে। আব্বাসীর হত্যার ঘোষণা বাংলাদেশে প্রচণ্ড অস্থিতিশীলতা ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। তার এই কার্যক্রম দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সরাসরি হুমকিস্বরূপ।

এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক শূন্যতা ও বিচারহীনতার সুযোগ নিয়ে তার অনুসারীদেরকে রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ও বিচারবহির্ভূণ্ডেত হত্যাকাণ্ডের দিকে চালিত করছেন। বাংলাদেশের আইন যদি এই ধরনের প্রকাশ্য হত্যার প্ররোচনার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তবে তা দেশে ‘মব জাস্টিস’ (Mob Justice) সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করবে। এর ফলে, বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চরম ঝুঁকিতে পড়বে, যা চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রের কাঠামোকে ভেঙে দেবে।

খ. আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নষ্ট হবে

আব্বাসীর উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন করবে। এই ধরনের ঘোষণা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি উগ্রপন্থী রাষ্ট্র বা ‘সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্য’ হিসাবে চিত্রিত করার সুযোগ তৈরি করে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর (US State Department) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর (যেমন আল-কায়েদা-অধিভুক্ত আনসার আল-ইসলাম বা আইএসআইএস-অধিভুক্ত নিও-জেএমবি) কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে। তারা ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছে যে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো অনলাইনে নিয়োগ ও তহবিল সংগ্রহ বাড়িয়েছে। আব্বাসীর প্রকাশ্যে হত্যার ঘোষণা এবং ‘সশস্ত্র বিপ্লবের’ ডাক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের এই উদ্বেগকে তীব্রতর করবে। এই ধরনের উগ্রবাদ উসকে দেওয়া ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ইসলামবিরোধী প্রচারণাকে বৈধতা দেয় এবং ইসলামের শত্রুদের হাত শক্তিশালী করে। এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সহায়তাকে প্রভাবিত করতে পারে।

গ. পাকিস্তানের প্রেক্ষাপট থেকে শিক্ষা

পাকিস্তানের ধর্মদ্রোহ আইনের অপব্যবহার থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়া উচিত। পাকিস্তানে ধর্মদ্রোহ আইন (২৯৫-সি ধারা) প্রণয়নের পর থেকে এর অপব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ব্যক্তিগত প্রতিশোধ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দমন (যেমন খ্রিস্টান ও আহমদিয়া সম্প্রদায়) এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সালমান তাসির (পাঞ্জাবের গভর্নর) এবং শাহবাজ ভাট্টির মতো নেতারা এই আইনের অপব্যবহার রোধের পক্ষে কথা বলার কারণে খুন হয়েছেন।

আব্বাসি যখন নির্বিচারে ‘নিজ হাতে’ হত্যা কার্যকরের দাবি করেন, তখন তিনি পাকিস্তানে প্রচলিত ধর্মদ্রোহ আইনের অপব্যবহারের মডেলটি বাংলাদেশে নির্বিচারে বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। এই মডেল সমাজে চরম অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। অতএব বাংলাদেশে যদি রাষ্ট্রীয় আইন উপেক্ষা করে এই ধরনের উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তবে তা পাকিস্তানের মতোই সহিংস গণপিটুনি ও নৈরাজ্যের পথ খুলে দেবে।
 

দলিল : 

১. আল কোরআন

২. সিহাহ সিত্তাহ

৩. তাফসিরের কিতাবসমূহ

৪. হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার আলাদ দু্ররিল মুখতার (ফতুয়ায়ে শামি, পরিচ্ছেদ : হতাশাক্রান্ত ব্যক্তির ঈমান ব্যাতিত তার তওবা কবুল হবার সুযোগ), ইবনে আবেদিন শামি, ১৯৬৬, দারুল ফিকর, বৈরুত

৫. G. S. Hodgson, Marshall. The Venture of Islam, The Classical Age of Islam,The University of Chicago Press, Chicago, ISBN: Vol. 1,0-226-34683-8 (paper)

৬. Kadri, Sadakat. Heaven on earth a journey through shari'a law from the Deserts of Ancient Arabia to the Streets of the Modern Muslim World. 1st American ed, New York, 2012, Farrar, Straus and Giroux

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।