বাংলার ভাবুকতার ইতিহাস            


“বাংলার ভাবুকতার ইতিহাসের তিনটি মুহূর্ত। প্রথম হচ্ছে ‘তন্ত্র’। এই ধারার শুরু দেহকে সত্য  মেনে। পাশ্চাত্য দর্শন বস্তুজগতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও, বাংলার ভাবুকতার ইতিহাস তন্ত্র থেকে শুরু হয়েছে, কারণ এখানে জগতকে শরীরের দ্বারা উপলব্ধি করা হয়। এটি শরীরকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে গড়ে উঠেছে এবং দেহই এখানকার প্রথম দার্শনিক ভিত্তি। বাংলার ভাবুকতার দ্বিতীয় মুহূর্ত ‘রস’। তন্ত্রের বিকৃতির প্রতিবাদে চৈতন্য এই ধারার প্রবর্তন করেন। তিনি বললেন, আল্লাহ বা ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই বাস করেন, তাই শরীরের ওপর অত্যাচার করা মানে আল্লাহকেই অত্যাচার করা। এরপর আসে বাংলার ভাবের চূড়ান্ত ও তৃতীয় মুহূর্ত : ‘ভাব’। ফকির লালন শাহ এসে বললেন, দেহ ও রস সবই ভালো, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এইভাবে বাংলার ভাবুকতার ইতিহাসের সূত্র ধরিয়ে দেন ফরহাদ মজহার।  চিন্তা পাঠচক্রে ২৫ অক্টোবর ২০২৫ এই শিরোনামে আলোচনা করেন ওস্তাদ ফরহাদ মজহার। অনুলিখন ও সম্পাদনা করেন আরিফ বিল্লাহ।

 

ভাবুকতা বা বাংলার ভাবুকতার ইতিহাসটা একদমই লেখা হয় নাই। এটা লেখা দরকার। আমরা জানিও না, এটা কী। এখন আমরা আলোচনাটা করতে গেলে কিছুটা বিক্ষিপ্ত হবে। কেন? আমরা এটাকে এখনো কোনো বিধিবদ্ধ রূপ দেইনি। বিধিবদ্ধ করবার কাজটা কিন্তু আমার না আসলে। আমি সে হিশাবে একাডেমিক না। যেসব জিনিসগুলা আমাদের এন্টেনায় ধরা পড়ে না, এগুলাকে খুটিয়ে বের করে একত্র করতে হবে। এরপরে সাজানোর কাজটা চলবে। আমি কিছু একটা ধারণা দিয়ে শুরু করি। ছোট ছোট করে বললে আপনাদের কাজে লাগবে। প্রথম ধারণাটা হলো যে, বাংলাদেশে আমরা প্রশ্নটা এভাবে তুলি যে, বাংলাদেশে যদি ভাবচর্চার একটা ইতিহাস শুরু করি, তাহলে আমরা কী করে এটাকে সাজাবো? ইতিহাস একটা সাজানোর ব্যাপার। কী করে সাজাবো? সেক্ষেত্রে আমার প্রস্তাবনাটা এরকম যে, মূলত বাংলাকে আমরা মোটাদাগে তিনটা মুহূর্ত হিশাবে ভাগ করতে পারি। তিনটা মুহূর্ত বা ‘মোমেন্টস’ দার্শনিক দিক থেকে ব্যবহার করলে— ‘মুহূর্ত’ মানে হচ্ছে তিনটা বড় বড় ‘মোমেন্ট’ ঘটে গেছে। মোটাদাগে ভাবলে বুঝতে সুবিধা। 

 

প্রথম মুহূর্ত : তন্ত্র

প্রথম মুহূর্ত আমরা যেটাকে বলতে পারি—আমরা সকলে সেই শব্দ সম্পর্কে পরিচিত, কিন্তু অর্থ বুঝি না—সেটা হলো ‘তন্ত্র’। তন্ত্র মানে কী? ‘তনু’ মানে দেহ আর ‘তন্ত্র’ মানে উপায়। তন্ত্র মানে এটাই। আপনারা এখন ইন্টারনেটে তন্ত্র আকারে যেগুলা দেখেন, ওগুলা যদি বুঝেন, তাহলে আমার কথা বুঝবেন না। পাশ্চাত্যে যখন তারা জগত নিয়ে চিন্তা করত, তখন তারা কী দেখত? তারা জগতকে দেখতেছে সামনে। গাছপালা, পশুপাখি, জগত—বস্তুজগতকে দেখছে। তাদের ভাষায় এটা কী? বস্তুজগতকে সে দেখতেছে। পাশ্চাত্য চিন্তার ইতিহাসটা শুরু হয়েছে বস্তুজগতকে ব্যাখ্যা করার ভেতর দিয়ে। এটাকে বুঝলে আমার কথা বুঝবেন। পশ্চিমে ‘আমি’ জগতকে দেখতেছি। আমার ‘আমি’ সম্পর্কে আমি সচেতন না। আমি এখন যা বাইরে দেখতেছি এটা কিন্তু ‘আমি দেখতেছি’ নাকি? আর কেউ না। ধরেন, ‘ফরহাদ মজহার’ নামে একটা লোক আছে, তাঁকে নাম দিয়েছে ‘ফরহাদ’, সে বাইরের জগতকে দেখতেছে। ‘আমি’ দেখতেছি আমার বাহিরে। আর ‘আমি’ যে দেখতেছি, ও কিন্তু আড়াল হয়ে গিয়েছে। ওকে কিন্তু আমি দেখছি না। ও দেখছে, কিন্তু ওকে আমি দেখছি না। পাশ্চাত্যে ওই জগতটা, বাইরের জগতটা কেন্দ্র করে তাদের দর্শনটা গড়ে উঠেছে। এইজন্য সেখানে বস্তুবাদ গড়ে উঠেছে। যেটাকে আমরা বস্তুবাদ বলি—‘জাগতিক বিষয় নিয়ে বা ইন্দ্রিয় উপলব্ধির বিষয় নিয়ে যেটা আলোচনা করে। ইন্দ্রিয় দ্বারা যেটাকে আমি উপলব্ধি করতে পারি, এই জগৎ নিয়ে আলোচনা। এটাকে বলে ‘বস্তু’। বাংলায় বস্তু শব্দটা এসছে ‘বস্‌’ ধাতু থেকে। বস্‌ থেকে বসা। তাহলে বস্তু মানে কী বুঝায়? যেখানে ‘পরম বসত করে। সামান্য যেখানে বসত করে’। যেমন পাত্র হলো একটা সামান্য শব্দ। নানান রকম ‘পাত্র’ আছে। সেই পাত্র যখন একটা বিশেষে (গ্লাসের দিকে ইঙ্গিত করে) গিয়ে বসে, তখন এটাকে বলে ‘গ্লাস’। পাত্রটা সামান্য মানে ইউনিভার্সাল। সেই সামান্য এই বিশেষে যখন যুক্ত হলো, এই গ্লাসটা একটা বিশেষ, এটা বিশেষ না? তখন এটা হলো গ্লাস। তখন আমরা কীভাবে বলি? ‘গ্লাস একটা পাত্র’। এটা বলতে পারি। তখন এটা ভাষা দেয় আমাকে। গ্লাস একটা পাত্র। তাহলে দেখতে পারছেন সামান্যের সঙ্গে বিশেষের যে সংযোগটা আছে, সেই দিক থেকে বাংলায় ‘বস্তু’ শব্দের যে মানে, আর পাশ্চাত্য ম্যাটেরিয়ালিজমের একই মানে না। ম্যাটেরিয়ালিজমের অনুবাদ আমরা করি বস্তুবাদ, কিন্তু বাংলাতে বস্তুবাদ বলতে ম্যাটেরিয়ালিজম বুঝায় না। ওখানে ম্যাটেরিয়ালিজম বলতে বুঝায় ওইটা, ওই জিনিস যেটা ম্যাটেরিয়াল, ম্যাটার, যেটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। এই যে আমি ধরতে পারি, দেখতে পারি, আমার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, কিন্তু বাংলায় বস্তু হোল, সামান্য যেখানে বাস করে সেটাই বস্তু।

লিংকন : হয়ে উঠার আগে তার যে ব্লু প্রিন্টটা ইউনিভার্সাল...

রোমেল : না, এটা বললে সমস্যা। পাত্র শব্দটা ইউনিভার্সাল। যেকোনো পাত্র হতে পারে। মানে হাজার রকম পাত্র হইতে পারে।  গ্লাস, জগ সবকিছুই পাত্র। কিন্তু গ্লাস বা জগ হচ্ছে, পাত্রের একটা বিশেষ রূপ।

লিংকন : আচ্ছা এবার বুঝছি, মানে পাত্রটা হচ্ছে একটা ধারণা। এটা কোনো বস্তুগত আকার লাভ করে না। যখন বস্তুগত আকার লাভ করে, তখন সেটা বিশেষে পরিণত হয়। 

ফরহাদ মজহার : আপনারা বস্তুকে বস্তুবাদ আকারে অনুবাদ করি, ফলে ভাষার মধ্যে যে দর্শনটা রয়েছে, এটা হারিয়ে ফেলছেন। আপনি বুঝবেন না। এখন আমাকে বুঝাতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ আপনি ওভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তো আপনি এটাকে ম্যাটেরিয়াল বলতেছেন। ম্যাটেরিয়াল মানে যা আপনার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, যে জিনিসগুলাকে আপনি ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করছেন, তারা তাকে বলছে বস্তুবাদ। আমি বলতেছি এটা যখন আপনি অনুবাদ করছেন, তাহলে বস্তু শব্দটার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলছেন। এখানকার দর্শনের যে স্থিতি, এখানকার জ্ঞানের ইতিহাসে বস্তু শব্দটা যেইভাবে গড়ে উঠেছিল, সেটা আপনি এখন আর বুঝেন না। কান্টের বইতে দেখবেন যে সেখানে ‘দেশ’ এবং ‘কাল’ নিয়ে আলোচনা আছে। পাত্র নিয়ে কোনো আলোচনা নাই। ইন্টারেস্টিং। কিন্তু আমরা বাংলাদেশে দেশকালপাত্র একসঙ্গে বলি। হ্যাঁ, পাত্র ফুল দিয়ে উদাহরণ। ফুল বলে কিছু নাই।

রোমেল : ফকিররা ফুলের উদাহরণ দেয়। ধরেন, ফুলকে আপনি যদি কাউকে দেখাতে চান, তাহলে আপনি একটা গোলাপ ফুল দেন বা আপনি একটা জবা ফুল দেন। ঠিক না? এই যখন ফুলকে গোলাপ আকারে যখন আপনি দেখান, তখন এটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। তার মানে এই যে ফুল, এটা ধরেন পরম। সে যখন বিশেষ রূপে হাজির হচ্ছে, গোলাপ কিম্বা জবা আকারে—তখন আপনি এটা বুঝতে পারতেছেন। তখন আসবে। 

ফরহাদ মজহার : আপনি কি আমাকে ফুল দেখাইতে পারবেন? ফুল বলে কিছু নাই। কিছু নাই কিন্তু সে অর্থে। পরম শব্দটার মানে মানে একটু আলাদা। আমি শব্দটকে বলি ‘সামান্য’ বিশেষের জন্য। বাংলা দর্শনটা আমার ভাষার মধ্যে আছে, আমাকে সন্ধান করতে হবে। তাই ফকির লালন যখন বলতেছে, ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা’, তাহলে ‘সামান্য’ কথাটা কিন্তু ওই যে তুচ্ছ অর্থে আমরা ব্যবহার করি, সেই অর্থে থাকছে না। এটার অন্য একটা অর্থ দাঁড়ায়। সামান্য মানে ‘তুচ্ছ’ না, আবার কোনো বৃহৎ একটা জিনিসকে বুঝাতে যেভাবে ইউনিভার্সাল বলি সেরকমও না।

লিংকন : আচ্ছা, আমরা যখন ম্যাথমেটিক্স পড়ছি, সেইখানে সেট থিওরি আছে, একটা সেট হচ্ছে ইউনিভার্সাল, এটা সবকিছু। আরেকটা হচ্ছে কাপ, এটা একেবারে কমন সেট। এইটা কি ওইভাবে চিন্তা করলেন আপনি?

ফরহাদ মজহার : সেট থিওরি দিয়ে এটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। সেট থিওরি ইজ ফাইন। সেট থিওরিতে এটা হতে পারে না। সেট থিওরিতে বলে, একটা সেট আছে যেখানে সবকিছুই তার অন্তর্গত। ওটা না। ঠিক আছে? এটা হলো লিঙ্গুইস্টিক বর্গ আকারে আমরা ব্যবহার করি। কেননা চিন্তা বা ভাব সর্বদা ভাষাগত। দর্শনচর্চা মাত্রই ল্যাঙ্গুয়েজের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। দর্শন মাত্রই ভাষাচর্চার সঙ্গে যুক্ত। আমি এখন প্রথমে বোঝার চেষ্টা করছি, যদি আমি বাংলা ভাবচর্চার ইতিহাসটা লিখি, তখন তো আমাকে আমার নিজের ভাষার মধ্যেই খুঁজতে হবে। আমি যদি বাইরে গিয়ে খুঁজি বাংলা ভাবচর্চার ইতিহাস খুঁজতে পারব না। আমি যদি পাশ্চাত্যের মতো করে খুঁজতে যাই, আমি হারিয়ে ফেলব। এইজন্য পাশ্চাত্য দর্শনের বিপরীতে বাংলার যদি ভাবুকতার ইতিহাস রচনা করতে যাই, আমাদের মোটামুটি এই অনুমান দিয়ে শুরু করলে ভুল হবে না যে এখানে ভাবুকতার ইতিহাসটা শুরু হয়েছে তন্ত্র থেকে। তন্ত্রটা কেন? কারণ তারা মনে করেছে যে, জগতকে আমি উপলব্ধি করি আমার শরীর দ্বারা। আমি যে দেখতেছি, এটা ‘আমি’ দেখতেছি। তাহলে এই আমিটা কে? এটা খোঁজার জন্য তার একটা আকুতি হইছে। তখনই সে শরীর নিয়ে ভাবছে। কেন? কারণ আমার শরীর থেকে ‘আমি’ কি সে আলাদা করতে পারছে না? বলতেছি, আমার ‘আমি’ যদি মারা যাই, আমার শরীরই পড়ে থাকে, আমি কি থাকি? থাকি না। আমার শরীরের মধ্যেই আমিটা বাস করে। তাহলে আমার শরীর থেকে আমিটা আলাদা না। তাহলে বাংলার ইতিহাস থেকে যদি আমি শুরু করতে চাই, তাহলে এটা একদম প্রথম থেকে—এটা শরীরের ইতিহাস থেকে শুরু করে। এইজন্য এটা তন্ত্র। 

তাহলে আমাদের শুরু করতে হবে প্রথমত আমাদের ভাষা থেকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভাষার মধ্যে আছে একটা জনগোষ্ঠীর ভাব। তার ভাষার মধ্যে আছে, তার ভাষার মধ্যে থাকে। ভাষার মধ্যে থাকে বলে যখন সে পয়েট্রি করে, তখন পয়েট্রির মধ্যে এই ফিলোসফির ঝলক দেয়। আপনাকে হঠাৎ করে চমকা দেয়। ফকির লালন সাঁইজি যখন বলে, ‘পাবে সামান্য কি তার দেখা’—এটা দিয়ে কিন্তু তিনি সমস্ত থিওলজিকে এক লাইনে উড়িয়ে দিলেন। কেমন যেন এটাই বলতেছেন, তুমি যে ভাবতেছো, আল্লাহ ডাকো, তো আল্লাহ কি এরকম অনেকগুলো আল্লাহ আছে তার মধ্যে আল্লাহ একটা শব্দ। যেমন শালিক পাখি আছে, টিয়া পাখি আছে, বক পাখি আছে—সবগুলি পাখি। আল্লাহ কি এরকম? অনেকগুলো এরকম দেব-দেবী আছে, তার মধ্যে আল্লাহ একটা। আল্লাহকে এরকম ‘সামান্য’... সামান্য মানে আমরা বলি তুচ্ছ। এটার কোনো অর্থ নাই আসলে। সামান্য মানে তো তুচ্ছ। প্রশ্নটা হচ্ছে, ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা’। দেখেন সামান্য শব্দের মানে যদি আমরা না জানি, তো লালনও বুঝবো না। ‘বেদে নাই তার রূপ রেখা’, ভাষা দিয়েও বোঝা যাবে না। বেদ মানে কিন্তু হিন্দুদের বেদ না। বেদ মানে লেখালেখি, বই। ‘বেদে নাই তার রূপ রেখা’, বেদের দ্বারা, বইয়ের দ্বারা তাকে বোঝা যাবে না, বই পড়ে পাবা না। তো সে কীভাবে আছে? কয়—‘নিরাকার ব্রহ্ম হয় সে’। সে তো নিরাকারে থাকে। কারণ লালন তো সরাসরি ইসলাম দ্বারা ধর্ম প্রভাবিত। ডাইরেক্টলি। ইসলামকে ব্যাখ্যা করতেছে সে। সে নিরাকার ব্রহ্ম। তার তো কোনো রূপ নাই। তারপর ‘সদাই ফেরে অচিন দেশে’—একটা জায়গায় সে ঘুরে বেড়ায়ছে। ‘ফেরে সে একা একা’—সে কিন্তু একা আছে। তো তাকে তুমি ধরবে কেমনে? কোনো পথ নাই। তাকে তুমি বুঝবে কী করে? উনি কথাটা কবিতা আকার হাজির করল। এবার আপনি নিজে বলেন যে, ইসলামে আল্লাহর প্রমাণ হলো যদি আপনি তার সাক্ষ্য দিতে পারেন। এখন বলেন আপনি কি সাক্ষী দিছেন? তাহলে আপনি যদি সাক্ষী দিতে না পারেন, সাক্ষী মানে কী? আপনার উপলব্ধি হইছে কিনা, আল্লাহ তো প্রমাণ করা যাবে না। আল্লাহ আছে কী নাই, এটা প্রমাণ-অযোগ্য, প্রমাণের বাইরে। প্রমাণ মানে যুক্তির মধ্যে ঢুকা। ফলে সে প্রমাণের বাইরে। তাহলে আপনি উপলব্ধি করছেন কিনা, এটা হলো ইম্পর্ট্যান্ট। নিরাকার ব্রহ্ম সে একা, কী করে তুমি তাকে বুঝবা? সে থাকে কী করে? সে বাস করে কোথায়? সে থাকে কিন্তু ধ্যানে। ধ্যান করলে তাকে মহাদেব বলে। তাহলে সেও তো এরকম, সে তো বসে আছে একটা প্রজ্ঞার মধ্যে। প্রজ্ঞার রূপ নিয়ে সে হাজির রয়েছে। তুমি যদি নিজে তাকে চিন্তা করতে না পারো, তাহলে তো তাকে পাবা না। ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা’। এত সোজা না তাকে বোঝা। আল্লাহ আল্লাহ মুখে বলো, কিন্তু আল্লাহ বোঝা এত সহজ না। কেন? কারণ সে তো গায়েব। তাকে ভাষা দ্বারা ধরা যাচ্ছে না। এরকম আরেকটা গানে আছে—‘অনামক অচিনাই বচন বাগেন্দ্রীয় না সম্ভব।’ আল্লাহকে নাম দিলেই তো শেরেকি হয়ে যাচ্ছে। এর পরের লাইন হচ্ছে,

সবে বলে পরম ইষ্টি

কারো না হইলো দৃষ্টি।

বরাতে করিল সৃষ্টি

তাই নিয়ে লেখাজোখা।।

এটা গ্রিক দর্শনের সমালোচনা। তারা এটাকে বলে, Common good বা পরম ইষ্টি। অনেকে আল্লাহকে মনে করে সমস্ত কল্যাণের মূর্তি। সমস্ত কল্যাণটা তাঁর কাছ থেকে আসে। তিনি খালি মঙ্গল দিবেন, ভালো দিবেন—ব্যাপারটা এরকম নয়। আর যারা আল্লাহ আছে কী নেই, সৃষ্টি, সৃষ্টিকর্তা—তারপর সৃষ্টি নিয়ে ব্যাখ্যা করে, এটাকে বলে বরাত দেওয়া। বরাত। স্টিফেন হকিং বলে, পৃথিবীর জন্ম কোত্থেকে হয়েছে? বলে যে বিগ ব্যাং থেকে হয়েছে। আবার যারা ধর্মের কথা বলে, বাইবেল বলেন আর হুজুরদের কথা বলেন, তারা বলে আল্লাহ সৃষ্টি করেছে। তো বিগ ব্যাং আর আল্লাহ তো এক হয়ে গেল। তারা সবাই বরাত দিয়ে ব্যাখ্যা করে। বরাত হচ্ছে, একটা কজ। কারণ দ্বারা তারা ব্যাখ্যা করে। 

কিন্তু কারণটা তো আপনি আবিষ্কার করছেন। আল্লাহ তো এরকম কারো আবিষ্কারের উপর নির্ভর করছে না। এটা খুব ডিফিকাল্ট, খুব ইন্টারেস্টিং। আপনি আল্লাহকে সৃষ্টি করছেন, আল্লাহ সৃষ্টির কারণ। তো সৃষ্টির কারণ দিয়ে আল্লাহকে ব্যাখ্যা করতে গেলে আপনি আল্লাহকে হারায় ফেলবেন। উনি কারণ হওয়ার পরে সৃষ্টি নিজ গতিতে চলতেছে—উনি বানায় দিয়ে চলে গেছেন। এইজন্য বলতেছে, ‘বরাতে দুনিয়া সৃষ্টি তাই নিয়ে লেখাজোখা।’ ধর্মের মধ্যেও বরাত দিয়ে কথা হয়, বিজ্ঞানের মধ্যেও বরাত দিয়ে কথা হয়। দুইটার একটাও আমাকে তাঁর কাছে, তাঁকে উপলব্ধি, তাঁর শাহাদা... তাঁকে আমি যেভাবে উপলব্ধি করব, সেক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করে না। 

নিরাকার ব্রহ্ম হয় সে

সদাই ফেরে অচিন দেশে।

দোসর তার নাইকো পাশে

ফেরে সে একা একা।।

সে তো একা আছে, কিন্তু ‘দুই’ না থাকলে আমি তাকে বুঝবো কী করে। আমার কল্পনায় সে একা হয়ে আছে। সে তো আসলে একাও না, সে দুই। আমি তাঁরে কল্পনাই করি সে একা। এর মানে একা থাকে সে মানুষের মধ্যে, তখন তর্কটা এই জায়গায় চলে আসছে। কারণ তিনি তো আছেন, মানুষের মধ্যেই বিরাজ করেন, কারণ মানুষই তো তাঁকে উপলব্ধি করে। এই যে সাঁইজির কালাম, আল্লাহ কে বুঝে তোমার অপার লীলে? তুমি আপনে আল্লাহ, ডাকো আল্লাহ বলে। তুমি তো মানুষকে দিয়ে আল্লাহ বানাইছো, আর মানুষকে দিয়ে তুমি আল্লাহ নাম বানাইছো। 

রোমেল : আগের পয়েন্টটা সম্ভবত পরিষ্কার হয় নাই। কারণ এবং বরাতের যে আলাপটা, এটা কি পরিষ্কার হইছে?

লিংকন : আমি বলি, আমি যতটুকু বুঝেছি সেটা হচ্ছে দুনিয়াতে রিলেটেড জিনিসগুলো আমরা বুঝি কার্যকারণ দ্বারা, যে এটা কারণ, এটা তার এফেক্ট। কিন্তু আল্লাহ আমরা কার্যকারণের মাধ্যমে বুঝতে পারবো না।

রোমেল : কার্যকারণ একটা ফাঁদ। যেমন ধরেন, জগত সৃষ্টি করেছে কে? বলা হোল তাহলে আল্লাহরে সৃষ্টি করেছে কে? এইটা একটা ফাঁদ।

উদয় হাসান : এভাবে আরেকটা ব্যাপার, আপনি যে টুলস ডিপ্লয় করতেছেন, সেট থিওরি, কার্যকারণ, এগুলা নিজেরাও কিন্তু ওই রিজনের ভিতরে আপনি ফাঁদতে চাইতেছেন। মানে আপনি কিন্তু ওই যুক্তির ঘেরাটোপে পরম ধরতে চাইতেছে। ওটার ভিতরে ওই টুলসগুলা ইউজ করতেছে। আরেকটা পয়েন্ট ফরহাদ ভাই বলতেছিল যে, আমি যখন আমার বাইরে কল্পনা করি আল্লাহকে, মানে যদি এক আল্লাহই থাকে, আমি যখন নিজের থেকে ছিন্ন করে ফেলি আল্লাহকে, আমি তো দুই অনুমান করেছি ইতিমধ্যে। নিজেকে আমি আল্লাহ থেকে আলাদা করে আল্লাহকে ভাবতেছি।

রোমেল ভাই : ফরহাদ ভাই আমাদের আলোচনা করতেছিল যে বাংলার দর্শনের আলোচনা যদি শুরু করতে হয়, তাহলে তন্ত্র থেকে শুরু করা দরকার। তো সেই ক্ষেত্রে ফরহাদ ভাই তন্ত্র থেকে শুরু করতেছিলেন। 

ফরহাদ মজহার : না, আমি শুরু করেছিলাম পাশ্চাত্যের সঙ্গে পার্থক্য থেকে। কারণ এটা পরিষ্কার  থাকা দরকার। এটা ভালোভাবে বুঝা দরকার। প্রথমত আমরা কী করে বর্তমান থাকি? আমরা বর্তমান থাকি দেহধারী হয়ে। আমি কথা বলতে পারি কেননা আমি দেহধারী। তারপরে বাংলা ভাবের জগতের তন্ত্র সম্পর্কে যে সকল ভুল ধারণা, এই কুচিন্তাটা মাথা থেকে বাইর করতে হবে। তাহলে আপনি ধরতে পারবেন। ঠিক আছে? এখানকার বস্তুবাদ বলতে তন্ত্র বুঝায়। মানে দেহসম্পন্ন মানুষ কী করে বর্তমান থাকে? সে কী করে চিন্তা করে? এবং চিন্তার মধ্য দিয়ে সে কী করে নিজেকে আবিষ্কার করে—এটা হোল তার প্রথম দার্শনিক উৎস ভিত্তি। গ্রিক দর্শন এবং একই সঙ্গে অন্যান্য দর্শনের ইতিহাসের মধ্যে এটা নাই। তারা দেহ থেকে শুরু করে না। কিন্তু তন্ত্রের মধ্যে দেহই সত্য। কারণ দেহ থাকাটাই ট্রুথ। আপনার ট্রুথ কিন্তু আপনার শরীর। ফলে দেহকে বাদ দিয়ে সত্যকে অনুসন্ধান করা—এটারর কোনো অর্থ নাই। ফলে এখানকার শুরুই ছিল তন্ত্র। তন্ত্র মনে করেন দেহ মানে শুধুমাত্র আপনার দেহ না। এই জগতও একটা বিশাল দেহমাত্র—‘যাহা ভাণ্ডে তাহাই ব্রহ্মাণ্ড।’ 

মোহাম্মদ রোমেল : পশ্চিমা দর্শনে বেসিক্যালি আমার বাইরে আমি দেখি। বা সেন্সুয়াসলি বুঝতে চাই, ওই জায়গা থেকে শুরু হয়। আর আমাদের এখানে বেসিক্যালি আমি আমার শরীর থেকে শুরু করতেছি।

ফরহাদ মজহার : কেননা আমার শরীরই তো বর্তমান। এটাই সত্য। এই সত্য থেকে সে শুরু করে। এখন দেখেন পাশ্চাত্য আধুনিকতা কোথা থেকে শিফট করলো? পাশ্চাত্য আধুনিকতা কিন্তু বাংলার এটাকে মানবে না। পাশ্চাত্য আধুনিকতা দেকার্তের সময় প্রশ্ন করলো, আমি যে জ্ঞানী, আমার তো জ্ঞান আছে বলে ভাবতেছি। কিন্তু আমার জ্ঞানটা যে নিশ্চিত জ্ঞান, এটা আমি বুঝব কীভাবে? তখন দেকার্ত কী করল? সে বলল যে, আমি যে আছি এবং আমার জ্ঞান যে নিশ্চিত জ্ঞান, এটার একটাই মাত্র প্রমাণ—সেটা কী? এই প্রথম পাশ্চাত্যে দেহ আলাদা হয়ে গেল চিন্তা থেকে। যেমন—আপনি যদি বলেন যে আপনি বাংলাদেশে আছেন। তন্ত্র বলতেছে, তুমি তো আছোই। তোমার প্রমাণ দরকার নাই। তুমি যে আছো, এটার প্রমাণ তুমি নিজেই। তোমার তো কোনো প্রমাণ দরকার নাই। কিন্তু পাশ্চাত্য দেহকে বাদ দিল। দেহকে বাদ দিয়ে সে ভাবলো, আমি একটা ব্যাপারেই নিশ্চিত যে কোনো জগত নাই, কিচ্ছু নাই, দেহ নাই, কিচ্ছু নাই, কিন্তু আমার ‘আমি’—-আমি যে চিন্তা করতেছি, এটা তো আমি বুঝতেছি। অতএব এটাই সত্য। আর বাকিটা সত্য নয়। 

উদয় হাসান : আরেকটা প্রশ্ন—পশ্চিমা দর্শনে তাহলে এই জ্ঞানের নিশ্চয়তা কেন দরকার পড়লো? কেন তার নিশ্চিত হতে হোল? বাংলাদেশ তো নিশ্চিত হইতে চাইতেছে না। ওরা নিশ্চিত হতে চাইলো কেন?

ফরহাদ মজহার : সেটা ভালো একটা প্রশ্ন। পশ্চিমা ইতিহাসে আমরা দেখব যে, এর আগে যখন হেলেনাইজেশন ঘটতেছিলো, যখন এরিস্টটলের ম্যাটাফিজিক্স থেকে তারা এটাকে অনুবাদ করছে, তখন এটা একটা প্রশ্ন আকারে হাজির হয়ে গেছে। তুমি যে কথা বলতেছো, তোমার কথা সত্য না মিথ্যা বুঝবো কী করে? আমি এই বিষয়টা সহজে আপনাদেরকে ধরিয়ে দিতেছি কতগুলো গ্রন্থির মতো। যাতে আপনাদের চিন্তা করতে সুবিধা হয়। আপনি ভাবেন যে পাশ্চাত্যে এই যে চিন্তা বা দর্শন একটা ব্যাপার আকারে হাজির হয়ে গেল। চিন্তা করাটা একটা ফিলোসফি, চিন্তা করাটা একটা আলাদা একটা কাজ। এটা দেকার্তের সময় থেকে শুরু হলো এবং চিন্তা করার মধ্য দিয়ে আমি সত্য জানি—এটাও তৈরি হয়ে গেল। এইখান থেকে দেহ এবং চিন্তাও আলাদা হয়ে গেল।

তাই দেহ কথাটা সঙ্গে পাশ্চাত্যের চিন্তার পার্থক্যটা বুঝে গেল বাংলা ভাবুকতার ধারাটা ধরতে পারবেন। এই বিষয়টা ফান্ডামেন্টাল। কেন দেহ ও চিন্তার এই বিরোধটা এত ইম্পর্ট্যান্ট? দেকার্তের পর থেকে পাশ্চাত্যের মধ্যে কোনো দেহ নেই। সবকিছু সে যুক্তির দ্বারা, প্রমাণের দ্বারা হাজির করতে চেষ্টা করে। তন্ত্র কিন্তু বলতেছে, না, তুমি যে বর্তমান, এটা তো তর্কের বিষয় না। বাংলা দর্শন বলে, তুমি যে বর্তমান, এটা তো তর্কের বিষয় না। তুমি বর্তমানে থাকো। এজন্য ফকিররা বলে, ‘আমরা বর্তমানে বিশ্বাস করি, অনুমানে বিশ্বাস করি না।’ বর্তমান মানে আমরা এখানে সবাই বর্তমান আছি, এটাই সত্য। এর বাইরে আমাদের ধাঁধার মধ্যে থাকার কোনো দরকার নাই। বর্তমানটাই হোল আমাদের দেশে ‘বাস্তবতা’। আমরা যেটাকে বলি বাস্তবতা আর আমাদের যে ভাবের ইতিহাসের কথা আমি বলছি, সেখানে বলে বর্তমান। আমি বর্তমান। কী করে বর্তমানে হলেন? এটা হোল ইম্পর্ট্যান্ট। আমি কী করে আছি? এখন, এই সময়, এটা দর্শনেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিচারের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপরে তন্ত্র কিন্তু একটা পর্যায়ে নানান রকম ধারার মধ্যে বিকশিত হয়। যেমন সহজযান, বজ্রযান, কাশ্মীরি তন্ত্র, বিভিন্ন রকম তন্ত্র। ফলে তন্ত্র একরকম না। বিভিন্ন ধরনের। বাংলাতে তন্ত্রের যে ধারাটা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে, এটাকে আমরা বলি ‘সহজযান’। সহজযান থেকে সহজিয়া। কিন্তু তন্ত্রটার নাম সহজযান। সহজযান বৌদ্ধদের কাছ থেকে এসেছে। সহজযান থেকে আমরা প্রভাবিত হয়েছি। বজ্রযানেরও প্রভাব আছে। তার গোড়ার ইতিহাস কিছুটা আমরা পাই চর্যাপদে। চর্যাপদটার মধ্যে আমরা সহজযানী বৌদ্ধধর্মের একটা ব্যাখ্যা পাই। আমাদের জন্য ইম্পর্ট্যান্ট হোল, বাংলাদেশ দার্শনিক দিক থেকে অত্যন্ত ডেভেলপড ছিল। যদি চিটাগাং হিস্ট্রি ধরি। নাথপন্থার একেবারে গোড়া চিটাগং থেকে। আদিনাথের মন্দির হোল নাথপন্থীদের প্রথম মন্দির। মহাদেব ছিল এখানে পূজ্য। এটা অনেক জটিল। আমরা আজকে এটা নিয়ে আলোচনা করবো না। কিন্তু আমরা ধরে নিব যে, বাংলাদেশের প্রথম যে দার্শনিক ব্যাপার ঘটেছে, সেটা আদিনাথ বা মহাদেব থেকে শুরু। এটাকে বলে নাথপন্থা। এখন ভারতে আদিত্যনাথকে দেখতেছেন না, সেটাও এখান থেকে। তাহলে নাথপন্থার ইতিহাস একটা বিরাট ইতিহাস। আমরা আরেকদিন এই বিভিন্ন ধারা নিয়ে আলোচনা করব। তাহলে নাথপন্থার পরে বৌদ্ধ আসছে। বৌদ্ধ সহজযান এখান থেকে গড়ে উঠেছে। তন্ত্রটা পরবর্তীকালে এত নিন্দিত হয়ে গেল কেন? নিন্দিত হোল এইজন্য যে, আমার যে আমি, সে আমিকে আমি শরীরে খুঁজে পাই। আমার মধ্যে বাস করে। শরীর নিয়ে তান্ত্রিকরা নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে শরীরকে তারা ওই সত্যকে আবিষ্কারের উপায় গণ্য করে। পাশ্চাত্যে চিন্তাটা চিন্তা হয়ে গেল সত্য নির্ণয়ের উপায়। জগতকে আমি কী করে দেখি? কেমন করে দেখি? কেন এরকম ফিল হয়? দুঃখ হয় কেন? কষ্ট হয় কেন? এ সমস্ত কিছু কিন্তু আমাদের এখানে ছিল। যেমন বৌদ্ধ যখন প্রশ্ন করে, মৃত্যু কেন? জড়া হয় কেন? মানুষ মরে কেন? এইসবই শরীরকেন্দ্রিক চিন্তা। বৌদ্ধধর্ম শরীরকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে গড়ে উঠছে। তাহলে আমাদেরও যত বড় বড় দর্শন সবই কিন্তু শরীরকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে গড়ে উঠেছে। এখান থেকে তন্ত্রের বিশাল একটা বিকাশ ঘটেছে। এই তান্ত্রিকরা শরীর সম্পর্কে আমাদের আধুনিক ডাক্তারদের চেয়েও অনেক ভালো বোঝেন। শরীরের শক্তিগুলোকে কী করে জাগিয়ে রাখতে হয়? কী করে চর্চা করতে হয়? শরীরকে যত্ন করতে হয়? আপনি নয়াকৃষিকেও একটা তান্ত্রিক পদ্ধতি বলতে পারেন। কেননা তার উদ্দেশ্যও কিন্তু শরীরে যত্ন করা। নয়াকৃষি কিন্তু তান্ত্রিক পদ্ধতির কন্টিনিউশন। কারণ এর মূল উদ্দেশ্য কিন্তু শরীরের যত্ন। কিন্তু ওই আদিতন্ত্রে যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা হলো শরীরের যত্ন করতে গিয়ে তারা শরীরকে একটা পর্যায় সেন আমলে শরীরকে উপায় বানিয়ে ফেলে। কিসের উপায়? তুরীয়ানন্দের উপায়। এইখান থেকে তার বিকৃতির শুরু। 

লিংকন : তুরীয়ানন্দটা কী ভাই? 

ফরহাদ মজহার : মানুষের জীবনের চূড়ান্ত পাওয়াটা কী? সে আনন্দ লাভ করতে চায়। আনন্দ কী করে পাবেন? শরীর দ্বারা আনন্দ লাভ করবেন। তখন কী করে তারা? তান্ত্রিকরা বহুদিন পর্যন্ত মেয়েদেরকে খুব খারাপভাবে ব্যবহার করত। সেই আমলে মেয়েরা দাস-দাসী, গরু-ছাগলের চাইতেও অধম ছিল। তাদেরকে তারা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করত। সেন আমলে তান্ত্রিকদের একটা ধারা এটাকে একটা চূড়ান্ত ব্যভিচারে পরিণত করে। এর ফলে তন্ত্রের মৌলিক যে দার্শনিক প্রস্তাবনা, এটা আড়াল হয়ে গেছে। আমরা এমন একটা একটা জগতে ঢুকে পড়লাম, সমাজ ঢুকে পড়ল, যাতে সমাজ রক্ষা করা কঠিন হয়ে। সে সময় ইসলাম সমাজে এসে পড়লো। ইসলাম যখন আসে, তখন আরেকটা পরিবর্তন আমরা এই প্রথম লক্ষ্য করলাম। কারণ ইসলাম তার নিজের সঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে আসে। তার দর্শন, কোরআন এটা নিয়ে আসে। ইসলামের আমলে তখন তন্ত্রবিরোধী আরেকটা আন্দোলন শুরু হয়। সেন আমলে তন্ত্রে একটা বিকৃতি এসে পড়ল যে, শরীর হচ্ছে তুরীয়ানন্দের উপায়। অর্থাৎ মানুষের জীবনের পরমার্থই হচ্ছে তুরীয়ানন্দ উপলব্ধি করা। চৈতন্য এসে পরে এটার বিরোধিতা করবে।

 

দ্বিতীয় মুহূর্ত : রস

প্রথমত চৈতন্য একটা সমাজ সংস্কারক ছিল—ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত সরাসরি। যদিও হিন্দুরা এবং মুসলমান, তারা কেউ এটা স্বীকার করবে না। চৈতন্য এসে বলল, এটা তো হতে পারে না। কারণ কী? কারণ আল্লাহ বা ঈশ্বর, তিনি তো আমার মধ্যেই বাস করেন। মানুষের মধ্যে বাস করেন। তো আমি যদি শরীরের ওপর অত্যাচার করি, তাহলে আমি আল্লাহকেই অত্যাচার করি। সহজ কথা। শরীরে যদি খারাপভাবে ব্যবহার করি, আমি কাকে অত্যাচার করি? আমি আল্লাহকেই অত্যাচার করি।

তার যে শিক্ষাটা ছিল, এটাকে বলা হয়—‘অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ, বহিরঙ্গে রাধা।’ তিনি এই ব্যভিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বললেন, আমি একইসঙ্গে নারী এবং পুরুষ। এটার আরেকটা ডিপ ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু এখন সেটা নয়। এটা বুঝতে হলে রাধা-গোবিন্দ নাথের তিন খণ্ডের ‘গৌড়িয় বৈষ্ণব দর্শন’ পড়ে আসতে হবে। কিন্তু এটাই ইম্পর্ট্যান্ট আমাদের বোঝার জন্য, খুব গুরুত্বপূর্ণ—‘অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ, বহিরঙ্গে রাধা।’ আচ্ছা, কৃষ্ণ কথা শুনে আমরা মুসলমানরা খুব অপছন্দ করি। কিন্তু বাংলার কৃষ্ণ কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন, সে কালো। আপনি চিন্তা করেন, একটা কুচকুচে কালোর সঙ্গে প্রেম করতেছে সুন্দরী রাধা। বাঙালির কল্পনা শক্তি দুর্দান্ত। বাংলায় চৈতন্য যখন এটা ব্যাখ্যা করল, এই বলে যে, আমার মধ্যেই ভগবান স্বয়ং বাস করে। তাহলে আমার শরীরের অত্যাচার করব কেন। তাহলে আমি কী করব? তান্ত্রিকরা এই মেয়েদেরকে যে ব্যভিচারটা করলো, এটা এভয়েড করার পথটা কী? দেখবেন তার শিষ্যদের মধ্যে কোনো মেয়ে নাই। তাই সে নিজের স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়াকেও ত্যাগ করল। এটা ভালো না। এটা খুব ইতিবাচক তা না। তাকে ত্যাগ করে চৈতন্য তখন তার সাধনা শুরু করল। সেও কিন্তু আল্লাহকে উপলব্ধি করতে চায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তিনি কোরআনের যে গল্প, সেমিটিক গল্প, সেই গল্প অনুসরণ করেননি। চৈতন্য পুরানের গল্প অনুসরণ করেন। তখন বাংলা পুরানটা ছিল শ্রীমতী রাধারানী প্রেম করতেছে কৃষ্ণের সঙ্গে। রাধারানীর কিন্তু সংসার আছে, স্বামী আছে। তাই এটা একটা পরকীয়া ব্যাপার। কিন্তু মূল ফিলোসফিক্যাল তর্ক ওটা না। ফিলোসফিক্যাল তর্ক হলো এই যে, তখন ইকোনমি তো বৈষয়িক জগত আকারে হাজির ছিল না। বৈষয়িক জগত বলতে পরিবার বুঝাত, জাগতিক জগত মানে পারিবারিক জগত। তাহলে পারিবারিক জগতে আমি বন্দী আছি। এভাবে জগতের বন্ধনে আমি বন্দি। কিন্তু যখন কৃষ্ণের বাঁশি বাজে, যখন ডাক আসে, তখন এই যে প্রেমটা, ঈশ্বরের প্রতি, আল্লাহর প্রতি যে প্রেমটা, এটার একটা অদ্ভুত অনুভূতি আমার মধ্যে তৈরি হয়। এভাবে পুরানের গল্পটা তখন ডমিন্যান্ট ছিল। মানুষ বলে না—ডাকিনী আছে, ননদনি আছে, আমার পাশে শুয়ে। হঠাৎ করে কৃষ্ণের বাঁশি বাজছে। আমি এদেরকে ফাঁকি দিয়া কী করে সাড়া দেব? মানে জাগতিক বিভিন্ন রকম বন্ধনের মধ্যে থেকে আমি কী করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেব? এ কথাটারই সরল প্রকাশ ‘পরকীয়া’। শব্দটা অরজিনালি ফিলোসফিক্যালি কিন্তু খারাপ অর্থ ছিল না। পরকীয়া মানে হচ্ছে, স্বকীয়তায় আমি জগতের সঙ্গে যুক্ত। এটা আমার স্বকীয়। জগতের সঙ্গে আমার বিয়ে হইছে। সেমিটিক রিলিজিনে আপনার বিয়েটা জগতের সঙ্গে হইছে না? আপনি গন্ধম খাইছেন, জগতে পাঠিয়ে দিয়েছে। বিয়েটা জগতের সঙ্গে। প্রকৃতি বলতে এটাই বুঝি। নারী বলতে, হাওয়া বলতে তো এটাই বুঝানো হয়েছে। আপনার বিবাহ হয়েছে জগতের সঙ্গে। আল্লাহর ডাক শুনবেন কেমনে জগতের মধ্যে থেকে? সে তো বাঁশি বাজায়, নাকি? ননদীর সঙ্গে শুয়ে আছি, শাশুড়ির সঙ্গে শুয়ে আছি। রাধিকা জিজ্ঞেস করছে, বাঁশি বাজায় কেরে নদীর পাশে। এই যে সিম্পল ফিলোসফিক্যাল জিনিসটা, এটা বাংলার মানুষের কলিজা নাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাতে বিচ্ছেদ গান সবচাইতে জনপ্রিয়। যদি কেউ গ্রামে যান দেখবেন যে, রাতের শেষ দিকে বিচ্ছেদ গান শুরু হবে। লোকরা বিচ্ছেদ গান শুনে জড়াজড়ি করে কান্নাকাটি করে। তাহলে এই যে বিচ্ছেদ গান সে শুনে এটা দ্বারা কী প্রমাণিত হয়? ব্রাহ্মণের চেয়ে তার ফিলোসফিক্যাল সেন্সিবিলিটি, আধুনিকদের অনেকের চেয়েও অনেক বেশি। সে কিন্তু শ্রীমতী রাধিকার বিচ্ছেদের জন্য কাতর। তার যে বিরহ ব্যথা, আমি সেপারেট জগতে আছি। আমি এই জগতে আসছি কেন? আমি তোমার কাছে ফিরে যাব। চৈতন্যের কৃষ্ণের প্রেমটা একটা ফিলোসফিক্যাল একটা শক্তিশালী ধারা আকারে হাজির হোল। আর তার সবচেয়ে বড় সমর্থক কারা ছিল? ছিল দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী : জীবগোস্বামী এবং সনাতন গোস্বামী। তারা তিন ভাই সুলতানেরই মন্ত্রী ছিল। আর সুলতান নিজেও কিন্তু চৈতন্যের পক্ষে ছিল। কী করে? কারণ চৈতন্য যখন এগুলো বলতেছে, তখন তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লড়াই করছিল শাক্ত ব্রাহ্মণরা, বর্ণবাদী ব্রাহ্মণরা। ওরাই জাত-পাতের নামে দুনিয়ার যত ব্যভিচার করত। তাহলে পরকীয়ার সংজ্ঞাটা কী দাঁড়াতে পারে? আপনি জাগতিক সম্বন্ধ ত্যাগ করার পর, আপনি জাগতিক-ইহলৌকিক যে সম্পর্কে আপনি সবসময় বন্দি থাকেন, তার বাইরে ডাক শুনতে পারা। ঈশ্বরের ডাক শুনতে পারা, আল্লাহর ডাক শুনতে পারা, ধর্মের ডাক শুনতে পারা—এই ক্ষমতার চর্চাটাকে এভাবে হাজির হোল। ফলে এটা পজিটিভ। এটা কাব্যিকভাবে তারা বলতেছে। তাই খুব সহজে এটা ছড়িয়ে পড়ে। আর চৈতন্য নিজে বললেন, তুমি এটা করতে রাধা প্রেম লাগবে। তো সেই রাধা কই? সেটা আমিই, আমি একই সঙ্গে রাধা। আমি একই সঙ্গে কৃষ্ণ। কথাটার সহজ ইসলামী মানে হবে আল্লাহ আমার ভেতরে। আর বাইরে আমি নারী। আর সারা পৃথিবীতে পুরুষ একজন। আমরা সকলেই মেয়ে। নারী-পুরুষ ভেদ নাই। তাই তথাকথিত নারী পুরুষ ভেগচিহ্ন দ্বারা, আমাদেরকে শারীরিক চিহ্ন দ্বারা যে পার্থক্য করা হয়, এটা চৈতন্য মানে না। 

আপনি যদি ছেলে হন, তাহলে ছেলে বলতে আমরা পুরুষ মনে করি। তখন আপনি ধরে নিয়েছেন যে যেহেতু নারী-পুরুষের সম্পর্কটা হয় শুধুমাত্র একটা বায়োলজিক্যাল চিহ্ন দ্বারা। চৈতন্য বলতেছে—না। আপনার বাইরে তো একজন কর্তা আছেন। তিনি কে? তিনি ছেলে না মেয়ে? সেজন্য চৈতন্যের ধারণাটা হলো, যখন আমরা নিজেকে মেয়ে আকারে ভাবি, দাস আকারে ভাবি, দাসী আকারে ভাবি এবং আল্লাহর ইবাদত করি। আমরা কী বলি? দাসত্ব করি। কারণ জগত যখন সৃষ্টি হয়েছে, জগতকে রক্ষার দায়িত্ব কী আপনার না? জগতকে যে রক্ষার দায়িত্ব পালন করে, সে তো আল্লাহর দায়িত্বই পালন করে। নারীর দায়িত্ব। নারীকে নারী রক্ষা করে, নারী জন্ম দেয় এবং সে যে লালন পালন করে, সেই নারীভাবটা থাকে। তাহলে নারীভাবটা যদি আমাদের মধ্যে না থাকে, তাহলে বড় কোনো মহৎ কাজ করতে পারবেন না। নারীভাবটাই হচ্ছে দাস হওয়া, বিনয়ী হওয়া।

এটা আরো পরিষ্কার করি।

প্রথম কথা হচ্ছে, যখন আপনি প্রেমের কথা বলেন, প্রেম মানে তো আপনি কাউকে না কাউকে প্রেম করেন? এবং যখন তাকে ভালোবাসেন, তখন আপনি কী করেন? আপনার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা সমস্ত তার প্রতি সমর্পণ করেন। তাহলে আপনি কি নারী না?

মোহাম্মদ রোমেল : এই ভাবটার মধ্যে পুরুষালি যেই ভাব এইটা নাই। এটার মধ্যে আছে সমর্পিত ভাব। এই কারণে প্রেম মানেই আসলে মেয়েলি ব্যাপার। মেয়েলি কথাটা বলা হচ্ছে বিনয় অর্থে। ধরেন, পুরুষালি বলতে কী বোঝায়? একটু রাগ, হিংস্রতা এসব। আর এর বিপরীতে যে ভাবটা, এটা তো একটা আইডিয়া। 

ফরহাদ মজহার : বাংলার ভাবের ধারার মধ্যে আরো অনেক ধারা রয়েছে। সেখানেও এরকম অনেক চিন্তা পাওয়া যায়। এটা হোল শাক্ত ধারা। শাক্ত কিন্তু নারীবর্জিত। শাক্তরা মা মা করে বটে, কিন্তু তারা মনে করে মেয়েদেরকে দিয়ে সাধনা হয় না। ফলে বাংলায় কেন রাধাকৃষ্ণের ধারাটা প্রবল, আমি এটা ব্যাখ্যা করার জন্য সংক্ষেপে কিছু বিষয় ধরিয়ে দিচ্ছি। পরে আমার লেখা ফলো করলে আরো ভালোভাবে ধরতে পারবেন। 

বাংলায় চৈতন্যের সময় থেকে এই তন্ত্রবিরোধী লড়াইটা শুরু হয়েছে। ওই বিশেষ কনটেক্সটে হিস্টরিক্যালি বুঝতে হবে। তবে চৈতন্যেরটাই একমাত্র সত্য, এরকম কোনো বক্তব্য আমি দিচ্ছি না। তিনি বলতেছেন যে, আমার মনের মধ্যে আল্লাহ আছে এবং আমি একইসঙ্গে মেয়ে, নারী। তিনি মেয়েদের মতো আচরণ করতে। পরবর্তীতে এটার একটা ফিলোসফিক্যাল ব্যাখ্যা কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীশ্রী চৈতন্যচরিতামৃতের রামানন্দ মিলনে পাওয়া যায়। তার ব্যাখ্যাটা কী? রামানন্দেরর সঙ্গে তর্কে চৈতন্য বলতেছে, উনি কেন এরকম করে? রামানন্দকে বলতেছে, আমি তো আল্লাহকে এখনই পেতে চাই। রামানন্দ বলতেছে, পূজা-অর্চনা করো। নামাজ কালাম করো। তখন তিনি বললেন, এহো বাহ্য আগে কহ আর। এগুলো বাইরের জিনিস। এগুলো করতে করতেই তো সব শেষ। কবে পাব ঠিক আছে? আমার জীবদ্দশায় আমি এখনই পেতে চাই। তার এই যে তীব্র কামনা পরমকে পাবার জন্য। যেই পরম গায়েব, যে নাই, যাকে দেখা যায় না, যে অদৃশ্য—এই অদৃশ্যকে পাবার জন্য তার তীব্র আকুতি, এটা তো তার চরিত্রের মধ্যে ছিল। দেখতে সুন্দর ছিল। ছিল প্রচণ্ড আকুতি। এরকম পাগল তো মাঝে মাঝে দেখা যায়। রাস্তাঘাটে ঘোরে, মাজারে গেলে পাবেন। তাদের আকুতি প্রচণ্ড। পরে আবার কী? মরার পরে পাব? না, আমি এখনই চাই, দেখা দাও। একই জিনিস। চৈতন্যও কয়, এহো বাহ্য। এভাবে বলতে বলতে অনেক স্তরে গিয়ে যখন তারা বলল, আচ্ছা, জ্ঞানের দ্বারা পাব? আল্লাহ আছে। বিরাট বিরাট তত্ত্ব। আলেম হবার চেষ্টা করি। না, এটা দ্বারাও পাওয়া যাবে না তাকে–এহো বাহ্য। তারপর সে বলতেছে, জ্ঞানও আছে, ভক্তিও আছে—আমি কী পাব? এই প্রথম তখন উত্তর আসে, এহ হয়, এটা হইতে পারে, নাও হইতে পারে। কিন্তু এটা যথেষ্ট না। যেমন আপনারা এখানে যারা বসছেন, তারা জ্ঞান এবং ভক্তিসহ বসছেন। তাহলে ‘এহ হয়’, এটা হইতে পারে। জ্ঞান এবং ভক্তিসহ। কিন্তু এটাও যথেষ্ট না। আস্লে কী করে তাকে পাবো আমি? তখন এই প্রথম বলতেছে, যদি আমি আল্লাহকে কল্পনা করতে পারি একটা কান্তাপ্রেম আকারে, একটা সুন্দর মধুর রূপ আকারে তাকে কল্পনা করতে পারি, যদি আমি তার সাক্ষ্য হতে পারি, এই মধুর রূপের, মধুর ভাবের সাক্ষী হতে পারি, তাহলে আমি তাকে পাবো। তাহলে যিনি গায়েব, তার একটা মধুর ভাবের চর্চা এখান থেকে এসেছে। এটাকে বলে মাধুর্য ভজনা। মানুষই এই মধুর রূপের কল্পনা করতে পারে। তাহলে মানুষের জীবনের লক্ষ্য হতে পারে কী? ঈশ্বরকে, আল্লাহকে একটা মধুর রূপে কল্পনা করা এবং মাধুর্য ভজনের দিকে যাওয়া। মাধুর্য ভজনটা কী করে সম্ভব হয়? একমাত্র প্রেমের দ্বারা। অপরকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, জীবের প্রতি ভালোবাসার দ্বারা। যে পতিত তাকে উদ্ধারের মধ্য দিয়ে, সমস্ত নৈতিক কাজগুলোকে দৃঢ়ভাবে করার মধ্য দিয়ে। নিঃস্বার্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা কী করতে পারি? আমরা একটা এথিক্যাল এবং অ্যাস্থেটিক—নৈতিক এবং নান্দনিক এ দুটোর মধ্য দিয়ে তাকে পেতে পারি। কিন্তু যুক্তি দ্বারা আমরা কখন তাকে পাব না। কারণ আল্লাহকে ‘আছে’ প্রমাণ করা যায়, আবার ‘নাই’ আকারেও প্রমাণ করা যায়। তাই একমাত্র বলতে পারি যে আমি যে আছি, আমার উপলব্ধির দ্বারা, আমার নিজের বিকাশের দ্বারা, আমার নিজের নৈতিক এবং আমার নান্দনিক যে শক্তি আছে, এর বিকাশের দ্বারাই আমি তাকে উপলব্ধি হতে পারি। এ ছাড়া কোনো সহজ পথ নাই। এটা হচ্ছে চৈতন্যের প্রস্তাবনা। এটার তিনি তখন নাম দিলেন ‘রস’। এখান থেকে রসতত্ত্ব। তিনি তিন রকম রসতত্ত্বের কথা বলছেন—শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য। রস অনেক আছে। তার মধ্যে পাঁচটা রসের কথা বলা হয়। এই পাঁচটা রসের মধ্যে বৈষ্ণবরা বলে, সবচেয়ে উপযুক্ত রস মাধুর্যটি। কিন্তু যেহেতু লালন আরো ইসলামের মধ্যে ছিল, ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ফলে লালন দাবি করতেছে, সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রস যেটা সাধনার জন্য উপযুক্ত, এটা হলো ‘দাস্য’। ইসলাম যেটাকে দাস্য বলে না? আমরা আল্লাহর দাস, আল্লাহর বান্দা। একই কনসেপ্ট। ইসলামে সমাজের জন্য বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য দাস্যভাবটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। ফলে ফকিরিধারার মধ্যে দাস্যভাবটা প্রবল। বৈষ্ণবধারার মধ্যে মাধুর্যটা প্রবল। ফকিররা তাই বলে ‘আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী।’ ফকিররা যখন ভক্তি করে, তখন মাথার মধ্যে কাপড় দিয়ে ঘোমটা দিয়ে ভক্তি দেয়। 

রোমেল : এইজন্য ফকিররা দাস্য গান বেশি গায়। দৈন্য গান হচ্ছে দাস্য গান। দৈন্য দীনতা প্রকাশ করা। আর আমাদের সেকুলার মিডিল ক্লাস সারাক্ষণ জাত গেল জাত গেল গানটা গায়। ওদের মধ্যে কোনো ভক্তি ব্যাপারটা নাই। 

ফরহাদ মজহার : আচ্ছা, এখান থেকে আমরা রসতত্ত্বে এলাম। রসতত্ত্বের অনেক ব্যাখ্যা আছে। এসব ব্যাখ্যার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। ওদের অনুমানের মধ্যেও পার্থক্য আছে। 

 

তৃতীয় মুহূর্ত : ভাব

ফকিররা কিন্তু আবার দাস্যভাবেই শেষ করেনি। দাস্যভাব, ভক্তি-টক্তি সবই ভালো। অসুবিধা নাই। দেহ সত্য, এটা ভালো। তুমি বর্তমানে আছো, দেহধারী, এটাও সত্য। এটা তো তর্কের অধীন না। তোমার মধ্যে দাস্যভাব আছে, এটাও ভালো। কিন্তু এটা যথেষ্ট না। কেন? কারণ তুমি যদি নাই বুঝো, কেন তুমি এগুলো করো, এটা করে কোনো লাভ নাই। এখানে এসে লালন দর্শনে মানে পাশ্চাত্য অর্থে দর্শনের জগতে প্রবেশ করলে— ‘ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙা চরণ পায়।’ ভাব মানে কাল্পনিক কোনো ব্যাপার না... তুমি তো তাকে পেতে চাচ্ছ। খুব ভালো কথা। কিন্তু তুমি এটা পাবা, এই পরস্পরের মধ্য দিয়ে, এই যে আমরা আজকে কথা বলতেছি। এই কথা বলার মধ্য দিয়ে আল্লাহর স্বয়ং হাজির হয়ে যাবেন। তিনি আমাদের মনকে বদলায়। আমাদের সামষ্টিক শক্তি দেয়। এটা একটা বন্ধন তৈরি করে। সে বন্ধনের মধ্যে দিয়ে সমাজ গঠন করাটা সহজ হয়। ‘ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙা চরণ পায়।’  সব ভালো, সব কর, তুমি পূজা অর্চনা যত ইচ্ছা কর। এতে লাভ হবে না। শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভাবের দ্বারা, ভাবুকতার দ্বারা—মানে লালনের কাছে চিন্তার মধ্যেও এই রসকে নিয়ে আসতে হবে। দেহ, রস এবং ‘ভাব’—এই হোল তিনটা মুহূর্ত। এই তিনটা মুহূর্ত বা তিনটা স্তরকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত বা স্তরও বলতে পারেন। 

রোমেল : ফরহাদ ভাই ভাষা তো তাহলে ভাবের বিকল্প হতে পারে। ভাষা দিয়ে ভাবতে হয়।

ফরহাদ মজহার : ভাষার বাইরে ভাব নাই। কিন্তু লালনের একটা কালাম আছে, সেটা এরকম : অনামক অচিনায় বচন

বাগেন্দ্রিয় না সম্ভবে।

কারণ ভাবটা তখন আর ভাষা দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব না। আপনার মধ্যে যে উপলব্ধিটা হয়, আপনার মধ্যে যে শিহরণ হয়, এই শিহরণ তো ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে পারবেন না। 

রোমেল : সেইক্ষেত্রে ‘ভাব দিয়ে পরে ভাব নিলে’ ব্যাপারটা ইম্পসিবল হয়ে যাচ্ছে। ট্রান্সফার করতে পারছে না। 

ফরহাদ মজহার : না, এটা একটু বুঝিয়ে বলি। প্রথমত আপনার মধ্যে যে রসোপলব্ধি, লালন তো এটাকে অস্বীকার করছে না। কেননা রসোপলব্ধি ছাড়া তো আপনার মধ্যে ভাব হবে না। কিন্তু রসোপলব্ধির জায়গায় থাকলে তো আপনার হচ্ছে না। যথেষ্ট না। কেন? কারণ আপনি যদি সেটা প্রকাশ করতে না পারেন, তাহলে কমিউনিটি গড়ে উঠবে না। ফকিররা বলে—

 শক্তিতে উদয়, শক্তিতে সৃজন 

গোষ্ঠভাবে সব চিত্ত আকর্ষণ। 

এই যে আমরা এখানে বসে আছি, ফকির লালনে এটাকে বলেন ‘গোষ্ঠভাব’। গোষ্ঠ মানে একসঙ্গে থাকা। এটাও রসতত্ত্বের মতো। কারণ আমাদের একসঙ্গে থাকতে ভালো লাগে। আমাদের অনেকে আছে যে হয়তো কিছুই বুঝি নাই, কিন্তু থাকতে ভালো লাগে। আছে না এরকম? থাকতে তো পারে। বোঝার দরকারও নাই। এটা হোল গোষ্ঠভাব। তাহলে এই গোষ্ঠভাবটা ইম্পর্ট্যান্ট। গোষ্ঠভাবের ভিত্তিতেই সমাজ গঠিত করা যায়। ফলে এখানে আধুনিক  রাষ্ট্রের কোনো ধারণা নাই। ‘গোষ্ঠ’ ইম্পর্ট্যান্ট। আমাদের সমাজে গোষ্ঠভাব থাকে। আমরা যাকে মুরব্বি বলি, তাঁর কথা শুনি। ওটা গোষ্ঠভাবের কারণে শুনি। ফলে পাশ্চাত্য ল্যাঙ্গুয়েজ, তাদের যে ভাষা, এই ভাষার বাইরে আমাদের ভাষাগুলোকে তৈরি করা, নতুন করে চিন্তা করা, এই চিন্তা করার জন্য বাংলার এই ভাবের ইতিহাসটা আমাদের পড়তে হবে। পড়লে আমরা পাশ্চাত্য দর্শন ক্রিটিক করতে পারব। দেকার্তকে পারব, কান্টকে করতে পারব। ওই ক্রিটিকটা করতে পারলে বাংলায় সত্যিকার অর্থে একটা দার্শনিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। আমরা মনে করিব, এই যে জাতীয়ভাবে লালন উদযাপন করা হোল, এটা এজন্য অত্যন্ত বিরাট একটা ঘটনা। এটা কিন্তু আমরা এত তাড়াতাড়ি বুঝব না। হয়তোবা তরুণরা, আপনারা যারা আগামীতে লিখবেন, আমাদের প্রতি যারা আগ্রহী হচ্ছেন, তারা পাশ্চাত্যকে মোকাবেলা করবে। তাই পাশ্চাত্য পুরোপুরি পড়তে হবে। তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য কোথায়? আমরা এখন যে কথাগুলো বলেছি, এটার মধ্যে আমরা এই জিনিসটা দেখাতে চেয়েছি। এই পুরো ব্যাপারটাকে তিনি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বক্তব্যের সঙ্গে মিলান। তিনি কী বলে গেছেন? তিনি একটা দুর্দান্ত কথা বলে গেছেন। খেয়াল করেছেন? প্রথমত, তিনি এই যে ভাবের কথাটা বললাম, এটাকে  বলেছেন, পারমার্থিক। পারমার্থিক মানে এর মধ্যে আমরা এমন একটা সত্যের আস্বাদন পাই, যেটা পারমার্থিক। পারমার্থিক মানে এটা আমাদেরকে একসঙ্গে থাকতে, একসঙ্গে ভাবতে উৎসাহিত করে। পরস্পরের প্রতি আমাদের বন্ধনকে দৃঢ় করে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাকে আমাদের দৃঢ় করে। তিনি একটা কথা বলছেন, যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্র এখনো টিকে আছে, উনি একজন ভারতীয়, কিন্তু লালনের মাধ্যমে তিনি মনে করেন একটা ‘পারমার্থিক আঞ্চলিকতা’ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এটা খুব বড় একটা ব্যাপার। খালি যদি আঞ্চলিকতা বলেন, এটা হচ্ছে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। পারমার্থিক মানে পুরো উপমহাদেশের সাথে পারমার্থিক সম্পর্ক। কারণ যারা বাংলা ভাষার কথা বলেন, কলকাতা, আসাম, বিহার বা ভারতের যেকোনো জায়গার কথা বলেন, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে একটা পারমার্থিক আঞ্চলিকতার সম্পর্ক। তিনি মডার্ন স্টেটকে সরাসরি অস্বীকার করেননি। এটাকে ধরে নিয়ে, তিনি বলেছেন। কারণ তিনি ভারতীয়। সেকেন্ডলি তিনি আরেকটা কথা বলেছেন, এটা খেয়াল করবেন, তিনি চৈতন্যকে ‘মহাপ্রভু’ বলেছেন।

‘মহাপ্রভু’ বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিনি একজন চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ। তিনি চৈতন্যকে যেভাবে মহাপ্রভু বলেন, ওই ধারাতেই লালনকে তিনি মহাপ্রভু মনে করেছেন। এটা পশ্চিম বাংলায়ও তিনি বলেছেন। তাকে মুসলমান বলে আপনি আর উপেক্ষা করতে পারবেন না। তাকে সমস্ত সাম্প্রদায়িকতা ভেদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে তিনি নতুন বার্তা দিয়েছেন। মহাপ্রভু কথার মানে হোল, যিনি দিব্য যুগ দেখায়। যিনি আমাদেরকে নতুন একটা যুগ দেখায়। তাদেরকে মহাপ্রভু কল্পনা করতে হবে।

আরিফ বিল্লাহ : ‘নতুন একটা যুগ দেখায়’ এটা আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?

ফরহাদ মজহার : মানে নতুনভাবে আমাদের ভাবতে শেখায়। নতুন বিশ্বের সম্ভাবনা দেখায়। নতুনভাবে আমাদের নিজেদের গড়ে তুলবার পথ দেখায়। এই যে আমরা আজকে যখন লালনের গান করি, আমাদেরকে প্রভাবিত করে। আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করছে। নতুনভাবে আমাদেরকে পুনর্গঠিত হবার ক্ষেত্রে যিনি আমাদেরকে পথ দেখান। এইজন্য চৈতন্যও মহাপ্রভু।

লিংকন : ভাই, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী বলতে আমরা যা বুঝি যে, আমরা যে শর্তে একসাথে রাজনৈতিকচর্চা করব, এই কমননেসটা আমাদের মাঝখানে আবিষ্কার করা। একইভাবে যদি আমরা রাষ্ট্রসমূহ কীভাবে আচরণ করবে, তাদের মধ্যে অন্তত কমননেস বা সাধারণ যে জায়গাগুলো আছে, এগুলো আবিষ্কার করতে না পারি, তাহলে এই যে কোলাহল—একজন আরেকজনের ওপর আধিপত্য তৈরি করার চেষ্টা, একজন আরেকজনকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা, ক্ষতি করার চেষ্টা—এগুলো থাকবে। এর বিপরীতে আমরা যদি রাষ্ট্রের বসবাসকারী যে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আছে, তাদের মাঝে যে কমিউনিটিগুলো আছে, এগুলাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি এবং এর ভিত্তিতে আমরা একটা রাষ্ট্রীয়গোষ্ঠী তৈরি করতে পারি আঞ্চলিক শান্তির জন্য—তাহলে এটা কমে যাবে।

লিংকন : প্রথমত আমি বলব যে, রাষ্ট্রের চিন্তা বাদ দেন। একটা কথা মনে রাখবেন, রাষ্ট্র একটা ফিকশন। রাষ্ট্র ইজ ডেথ কেস। রাষ্ট্র দ্বারা মানুষের ভালো কিছু হবে না। রাষ্ট্র কিছু করতে পারে না আমাদের শুধু ক্ষতি করা ছাড়া। এজন্য পারমার্থিক যে সম্বন্ধ, এই পারমার্থিক সম্বন্ধ তৈরিতে রাষ্ট্রটা বিরাট বাধা হয়ে গেছে। মানে গরিবের প্রতি যে দয়া, গরিবের প্রতি দায়িত্ববোধ—এটা তো পারমার্থিক? আপনি শ্রেণী রাজনীতির কথা ধরেন, এটাও তো পারমার্থিক ব্যাপার। তাহলে খালি সাংঘর্ষিক মডেলটা নিলে হবে না। সাংঘর্ষিক মডেলের বাইরেও তো আমাদের বুঝতে হবে যে, হ্যাঁ, গরিবের প্রতি আমার দরদ থাকা দরকার। দায় থাকা দরকার। এটা পারমার্থিক। তাহলে পারমার্থিক আঞ্চলিকতা মানে দিল্লির উচিতভাবে বাংলাদেশের প্রতি ইতিবাচকভাবে কথা বলা। কিন্তু আমরা যদি এই যে এখনকার কিছুটা বিক্ষিপ্ত, কিছুটা অস্পষ্ট চিন্তা—এগুলোকে প্রপারলি হাজির করতে পারি, আমরা খুব দ্রুত শক্তিশালী একটা পলিটিক্যাল জায়গায় চলে যাবো। 

তার মানে আমাদের কী করতে হবে? আমাদের প্রথম কাজটা হচ্ছে এটা বোঝা যে, লালন আমাদের কী সুবিধা দিচ্ছে? প্রথম সুবিধা দিচ্ছে, ইসলামের নামে এইখানে যে অত্যন্ত ডিসট্রাকটিভ একটা ধর্মীয় ধারা গড়ে উঠেছে, যেটা আমাকে ইসলামকে বুঝতে, ইসলামের কাছে পৌঁছাতে আমাকে বাধা দিচ্ছে। ওই ধারাটাকে মোকাবেলা করার জন্য লালন একটা  শক্তিশালী ধারা আকারে এখানে গড়ে উঠছে। লালনের মধ্যে আমি দেখেছি ইসলামের একদমই শরীয়াকেন্দ্রিক চিন্তা যেমন প্রবলভাবে আছে, তেমনি তার মধ্যে একটা বৃহত্তর সার্বজনীন ব্যাপারও আছে। লালন বলে—‘মুখে পড়বে সদাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আইন ভেজিলেন রসুলুল্লাহ।’ তো এই লোকরে আপনি বাদ দিতে পারবেন? 

যেহেতু রাসুল এই আইন দিছে। তো সবসময় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো। এরকম প্রচুর নবীতত্ত্বের গান আছে। আপনারা একদিন সুন্দর করে ব্যবস্থা করেন, গৌড়তত্ত্ব শুনেন, নবীতত্ত্বের গান শুনেন। আপনারা সবাই পাগল হয়ে যাবেন। ওনার আরেকটা গান আছে— 

সবাই বলে নবী নবী, 

নবীকে নিরঞ্জন ভাবি।

দিল ঢুঁড়িলে জানতে পাবি, 

আহমদ নাম কারে বলে। 

যার মর্ম সে যদি না কয়

সাধ্য কার কে জানিতে পায়।

তাইতে আমার দীন দয়াময়

মানুষরূপে ঘোরে ফেরে।। 

রাসুল যদি না বলে দিতো ‘আমি রসুল’ আপনারা কী ওনাকে মানতেন? মানতেন না। লালন সাঁইজি ইসলামের দর্শনের দিক থেকে একটা উলটপালট কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়ে গেছে। আমাদের সে সম্পর্কে কোনো খবরই নাই।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।