জ্বালানি সংকট: প্রথম অংশ


সারা বিশ্বব্যাপী এখন লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে জ্বালানীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। একটু রয়েসয়ে এই বিষয়কে ঘিরে ক্রমাগত তীব্রতর হওয়া সংঘাতের প্রকৃতিকে আবছা রেখে যাকে সাধারণত জ্বালানী নিরাপত্তা বলে হরহামেশা উল্লেখ করা হয়। রাজনীতিক, সামরিক বা অর্থনীতিক যে দিক থেকেই দেখি না কেন, আজকের দুনিয়ায় যে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ বা কৌশল প্রণয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে প্রত্যেকের পর্যাপ্ত জ্বালানী সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রকাশ্যে অবতীর্ণ হচ্ছে স্বভাবতই সামরিক ও অর্থনীতিক দিক থেকে পরাক্রমশালী দেশসমূহ। কিন্তু পরিপেক্ষিতটি আগের চাইতে এখন অনেকটাই ভিন্ন। পুরাতন পরাশক্তির সাথে উদিয়মান অর্থনীতিকশক্তিও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

গত একদশকে, যে কয়টি যুগান্তকারী মোড়বদলের সূচনা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইওরোপ ও আমেরিকার বাইরে সামনের সারির অর্থনীতিকশক্তি হিশেবে এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কয়েকটা দেশের আর্বিভাব পাকাপোক্ত হয়ে যাওয়া। বিশেষত, চীন ভারত ব্রাজিলের মতো দেশসমূহের ক্রমবর্ধমান বিপুলায়তনের অর্থনীতি বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার পুরোনো চেহারাই পাল্টে দিচ্ছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে নতুন সম্পর্ক ও সমীকরণ। শক্তির ভারসাম্য। আর এর প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে জ্বালানী নির্ভর অর্থনীতিক উন্নয়ন মডেল। এখন পর্যন্ত সীমিত প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত অনবায়নযোগ্য জ্বালানিই এক্ষেত্রে এখনও প্রধান নির্ভরতা। ফলে, এর উপর কর্তৃত্ব ও দখল কায়েমের নির্বিকল্প অনিবার্যতা অর্থনীতিক পরিমন্ডলের চিরাচরিত প্রতিযোগিতামূলক রসদ প্রাপ্তির গন্ডি ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। যে কারণে জ্বালানি এখন খোলাখুলি জাতীয় নিরাপত্তা তথা প্রতিরক্ষা নীতির অংশীভূত।

এই বিরূপ বাস্তবতা, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ বা উঠতি অর্থনীতির জন্য যা আরো মারাত্মক প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। একদিকে চলমান শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সচল রাখার জন্য বর্তমান চাহিদার পরিপূরণে ত্বরিত ব্যবস্থা; অন্য দিকে আগামী দিনের সম্ভাব্য চাহিদা নিরুপন করে সদূর প্রসারী লক্ষ্যের আলোকে বিচক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন--উভয় ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর পিছিয়ে। নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য একটি সুসমন্বিত জাতীয় জ্বালানি নীতিমালা দরকার। একই সাথে থাকা দরকার জাতীয়-স্বক্ষমতা বৃদ্ধির দিকনির্দেশনা ও আগামী দিনের কঠিন প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কর্মপরিকল্পনা।

বিপদের মধ্যে সেই কাজটি তো পড়েই আছে পরন্তু, অবকাঠামো উন্নয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিই অপরিকল্পিত, এলোমেলো এবং সকীর্ণ ও কায়েমী স্বার্থের পাঁকচক্রে বারবার আটকা পড়েছে; এখন রীতিমতো বেহাল দশায় উপনিত করেছে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে। এক বিপর্যস্ত ও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা। আমরা এই সংকটের মূল্যায়ন ও উত্তরণের নীতিগত কৌশল ঘিরে একটি ধারাবাহিক আলোচনার আয়োজন করেছি। এখানে তার প্রথম ভাগ। সম্পাদকীয়

 

প্রথম পর্ব

বিদ্যুত উৎপাদন ক্রমাগত কমছে : সর্বকালের তীব্র সংকট আসন্ন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে জ্বালানি চাহিদা বেড়েছে। উৎপাদনশীল খাতের পাশাপাশি আর্থিকখাতে গতিসঞ্চার ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতা সচল রাখতে দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে গড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট। অথচ সেখানে গড় উৎপাদন ৪ হাজার মেগাওয়াট। কাজেই মোট গড় ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার মেগাওয়াট। কাজেই শিল্প খাতে বা গৃহস্থালি খাতে লোডশেডিং অনিবার্য হয়ে আছে। এবং উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বহু বছরের পুরনো হওয়ার কারণে এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কমেছে, কমছে। এসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে প্রায় সময় কোনো না কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি লেগেই থাকে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পায়, এমনকি কোনো কোনো কেন্দ্রে উৎপাদন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। তখন লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরো বেড়ে যায় এবং শিল্প উৎপাদন, বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে, জনজীবনে অসহনীয় বিপর্যয় নেমে আসে। বিদ্যুতের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল দেশের বিকাশমান শিল্পখাত ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামনির্ভর জনজীবনের এই সময়ে এমনতরো বিদ্যুত সংকটের চেয়ে জরুরি জাতীয় ইস্যু আর কি থাকতে পারে। তারওপর, ক্রমাগত এই সংকট তীব্র হচেছ। পুরনো উৎপাদনকেন্দ্রগুলো ক্রমাগত অক্ষম হয়ে যাওয়া এবং নতুন কেন্দ্র স্থাপিত না হওয়ার যোগফলে।

 

ঝুঁকিতে বিনিয়োগ ও অর্থনীতি

বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থমকে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে যে সম্ভাবনা আছে, সেটা অর্জিত হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগও হচ্ছে না। যেসব শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালু আছে সেগুলোও তার পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। অপ্রতুল জ্বালানি সরবরাহের কারণে শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন প্রায় ৫০ ভাগ কমে গেছে। বিনিয়োগের চিত্র খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে নভেম্বরে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে আগের বছরের তুলনায় ৪৮ শতাংশ। সমস্যার সমাধান না হলে বিনিয়োগ নিসন্দেহে আরো কমবে। শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অনেক নতুন কারখানা চালু করা যাচ্ছে না। ঢাকা বা দেশের অন্যান্য স্থানের আরো খারাপ অবস্থা। বিনিয়োগ বোর্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছিল ৫০ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ বছর তা নেমে এসেছে ২৫ কোটি ৯০ লাখ ডলারে।

বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে জিডিপি’র প্রায় ২ শতাংশের মতো ক্ষতি হচ্ছে। এটা এখনও প্রযোজ্য। অর্থাৎ চলতি জিডিপি’র হিসাবে এটা প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার মতো। বর্তমানে বাংলাদেশ ৬ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) অর্জন করছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সমস্যা না থাকলে এটা ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। বিদ্যুৎ ও গ্যাস ঘাটতির জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশের ক্ষতি হচ্ছে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য উৎপাদনে ক্ষতি বছরে ৩ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা। আর গ্যাসের জন্য এ ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। মোট প্রত্যক্ষ ক্ষতি ৬ হাজার ৯শ’ কোটি টাকা। এর বাইরে পরোক্ষ ক্ষতি হচ্ছে প্রত্যক্ষ ক্ষতির প্রায় আড়াই গুণ। এ হিসাবে এ অংক দাঁড়ায় ১৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও অন্য সরকারি সংস্থাগুলো থেকে জানা যায়, শিল্প-কারখানা খাতে বিদ্যুতের মোট চাহিদা প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু বাসাবাড়ি ও শিল্প-কারখানাসহ সব ধরনের গ্রাহককে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৭শ’ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বেশিরভাগ শিল্প-কারখানাই প্রতিদিন বেশ কয়েক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে পড়ছে। অন্যদিকে পেট্রোবাংলার সূত্রমতে, বর্তমানে শিল্প খাতে (ক্যাপটিভ পাওয়ারসহ) গ্যাসের সরবরাহ দৈনিক ১শ’ কোটি ঘনফুটের মতো। অথচ শিল্প-কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাহিদা এর চেয়ে অনেক বেশি।

 

বিগত জোট সরকারের পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ খাতের চিত্র

বিএনপির নেতৃত্বে বিগত চারদলীয় জোট সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে গত পাঁচ বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন খাতে। বিতরণ ও সঞ্চালনের ওই পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অপ্রয়োজনীয় ও পরিকল্পনার বাইরে। অপ্রয়োজনীয় খাতটি তৈরি করে খরচ দেখানো হয়েছিল। একটি মাত্র বিদ্যুত কেন্দ্র যেটি টঙ্গিতে স্থাপন করা হয়েছিল সেই ৮০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র স্থাপনেও বিপুল পরিমাণ টাকা লুটপাট হয়েছে। নিম্নমানের কাজ ও দুর্বল মেশিনপত্রের কারণে কেন্দ্রটি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনের মাত্র ৬ ঘণ্টা পর বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রটি গত এক বছরে ৮১ বার বন্ধ হয়েছে এবং এখনও বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পুরো জোট আমলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মানোন্নয়ন ও মেরামত বাবদ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। মূলত কাজের কাজ কিছুই করা হয় নি। খুলনা শিকলবাহা কেন্দ্রটি মেরামতের নামে কয়েক বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত খুলনা ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তিন কিস্তিতে ৪৪৭ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। খুলনা ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩শ’ কোটি টাকার মেরামত কাজ হয়েছে। শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২৪ কোটি টাকা খরচ করে দুই দফা মানোন্নয়ন করা হলেও উৎপাদন ১ মেগাওয়াটও বাড়ে নি। বরং ১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হয়ে জোট সরকার গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে অতিরিক্ত ১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। রাজধানীতে ডেসার বিদ্যুৎ উপসঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার সংস্কার প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, কনডাক্টর, সাবস্টেশন, খুটিসহ সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ ও পুনর্বাসনের জন্য ২৪০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেও এই খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৫৯ কোটি ৩৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। শুধু একটি খাতে অননুমোদিত অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে ২৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অন্য একটি খাতে ৪৮ কোটি টাকার কাজে ব্যয় দেখানো হয় ৭৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৩৫০টি ট্রান্সফরমার ক্রয়ের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল রিসপনসিভ ও সর্বনিম্ন দরদাতাসহ দরপত্রে অংশগ্রহণকারী সব সরবরাহকারীর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদনক্রমে ১ হাজার ৩৫০টি ট্রান্সফরমার সরবরাহের কার্যাদেশ বণ্টন করা হয়, যা প্রতিযোগিতামূলক দর প্রাপ্তির জন্য সহায়ক ছিল না। ট্রান্সফরমার সংরক্ষণ খাতে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকার স্থলে ৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা খরচ করা হয়। দুর্নীতির কারণে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতাধীন কাপাই ঘাটের ইজারা বাবদ ১ কোটি ৩২ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে পিডিবি। এছাড়া পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের ১২টি প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে প্রায় ২৭৩ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের ৮৮টি উপজেলায় এই প্রকল্পের কাজ ছিল। রাজশাহী, রংপুর, যশোর, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে প্রকল্পটির অধীনে বিদ্যুতের লাইন নির্মাণ, লাইন নবায়ন, বিদ্যুতের খুটি, ট্রান্সফরমার স্থাপন, অফিস ভবন ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন নির্মাণে এই টাকা লোপাট করা হয়েছে। পিডিবি’র আওতায় ১ হাজার ৩১১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রায় ১শ’ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যন্ত্রপাতি ক্রয়, প্রশাসনিক ব্যয় ও ভৌত অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে বেআইনিভাবে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে এই দুর্নীতি করা হয়। নির্মিত প্রকল্পটির প্রাথমিক প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৫৪৮ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে ওই প্রকল্প সম্প্রসারণ করে ১ হাজার ৩১১ কোটি টাকার ব্যয় পুননির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পে ৪৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫ হাজার ৫৬৪ মেট্রিক টন যন্ত্রপাতি ও মালামাল আমদানির অনুমতি থাকলেও বিদ্যুৎ বিভাগ ৪৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬ হাজার ৩২১ মেট্রিক টন যন্ত্রপাতি আমদানি করে। বাড়তি ৭৫৭ মেট্রিক টন যন্ত্রপাতি আমদানির কোনো অনুমতি ছিল না। ফেঞ্চুগঞ্জ ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পে টেন্ডার মূল্যায়নে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সিরাজগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে না দিয়ে বেশি দাম দিয়ে একটি বিদেশী কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। বাঘাবাড়ি ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পটি টেনে বড় করে লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্বে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া এই প্রকল্পটির সিংহভাগ কাজ ২০০১ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল। অক্টোবরে ক্ষমতায় এসে চারদলীয় জোট সরকার প্রকল্পটি টেনে বড় করে। এর মাধ্যমে কমপক্ষে ৭০ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে । ১৯৯৯ সালে ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নেয়া প্রকল্পের সিংহভাগ কাজ শেষ হয়ে যায় ২০০১ সালে। জোট সরকার ক্ষমতায় এসে বুস্টার (গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) নির্মাণের নামে প্রকল্প সংশোধন করে সরকারি কোষাগার থেকে আরও ১০০ কোটি টাকা বেশি তোলা হয়। গ্যাস বুস্টার নির্মাণে খরচ করা হয় মাত্র ৩২ কোটি টাকা। বিদ্যুতের গ্রাহক বিল আদায়ে ডেসার ২ হাজার কোটি টাকার কোনো হিশাব নেই। জোট সরকারের শেষ দিকে বিদ্যুৎ বিতরণ প্রকল্পের জন্য ২ হাজার কোটি টাকাসহ মোট ১৬টি প্রকল্পের জন্য ২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা খরচের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ১০ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ৩৩৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিতরণ কার্যক্রম স¤প্রসারণের জন্য ১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এছাড়া ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয় সংবলিত ডেভেলপমেন্ট অব নিউ ১৩২/৩৩ কেভি এন্ড ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশন আন্ডার ডেসা প্রকল্প। ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন সঞ্চালন লাইন প্রকল্প, ২৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনা ঘাট/আমিনবাজার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প, ৪০০ কোটি টাকার প্ল্যানিং এন্ড এক্সপান্ডিং ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম ইন গুলশান প্রকল্প অন্যতম।

জোট সরকার বিদ্যুতের মোট উৎপাদন বাড়াতে কেন ব্যর্থ হলো, এ সম্পর্কে সাবেক বিদ্যুত সচিব আ. ন. হ আখতার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন-প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবেই তখন বিদ্যুতের মোট উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয় নি। তবে জোট সরকারের আমলে টেন্ডার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ভাড়া ও ক্ষুদ্র বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে গত এক বছরে জাতীয় গ্রিডে নতুন ৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত যুক্ত হয়েছে। তাছাড়া জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পূর্বে যেসব প্রজেক্টগুলো আর্থিকভাবে চুড়ান্ত করে গেছে তার বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পরবর্তীতে চালিয়ে নেয়া হয় নি।

 

বর্তমান সরকারের প্রথম বছর : কোনো কাজই হয় নি

যদিও বিগত সরকারের মতোই কেন্দ্রগুলোর মানোন্নয়ন ও মেরামত খাতে খরচের কমতি ছিল না কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে কোনো ধরনের অগ্রগতি ছাড়া কেটে গেলো বর্তমান সরকারের প্রথম বছরটি। গত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুত উৎপাদন নিয়মিতভাবে ৫০০০ মেগাওয়াটে, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭০০০ মেগাওয়াটে ও ২০২১ সালের মধ্যে ২০০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করবে। এ লক্ষ্যে মেয়াদের শুরুর দিকে এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিল সরকার। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রাথমিক উদ্যোগেরও কোনো আলামত নাই। ওদিকে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ৫ দিন আগে অর্থাত ২০০৮ সালের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর সান্ধ্য পিক আওয়ারে বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ৩৮৮২ মেগাওয়াট। আর এক বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে সান্ধ্যকালীন পিক আওয়ারে বিদ্যুত উৎপাদিত নেমেছে ৩৬৯০ মেগাওয়াটে। মহাজোট সরকারের বছরপূর্তির দিন গত ৫ জানুয়ারি পিক আওয়ারে বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৫৬৩ মেগাওয়াট। এ চিত্র পাওয়া গেছে বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুত উৎপাদন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে। অর্থাৎ দায়িত্ব নেয়ার পর কাগুজে পরিকল্পনা এবং কিছু দরপত্র আহবান করতেই সরকারের একবছর লেগেছে।

হাস্যকর বিষয় হচ্ছে বিদ্যুত উৎপাদনে এই অধোগতির চিত্র নিয়েও সরকার এ খাতে সাফল্য দাবি করছে। বলা হচ্ছে, এক বছরে জাতীয় গ্রিডে নতুন বিদ্যুত যুক্ত হয়েছে ৪শ’ মেগাওয়াট। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, বিগত সরকার আমলে গৃহীত দরপত্র এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ভাড়া ও ক্ষুদ্র বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে এক বছরে জাতীয় গ্রিডে ৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত যুক্ত হয়েছে। বিগত সরকারদুটোর কাজের ওই ফসলটুকু সহই বর্তমানে উৎপাদন নেমে এসেছে গড়ে ৩৬শ’ থেকে ৩৭শ’ মেগাওয়াটে। অর্থাৎ এক বছর আগের তুলনায় প্রকৃত উৎপাদন কমেছে ৫শ’ থেকে ৬শ’ মেগাওয়াট।

সবমিলিয়ে এক বছরে পরিকল্পনা ও মহাপরিকল্পনার ফুলঝুরি ছড়ালেও বিদ্যুত খাতে বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করার ঘোষাণা দিয়ে ব্যয়বহুল তেলচালিত ৮টি ভাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ১০টি পিকিং প্লান্টের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ৫৩০ মেগাওয়াটের ৮টি তেলচালিত ভাড়া কেন্দ্রের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের শেষ তারিখ ছিল ২৯ নভেম্বর। এর ৫টি মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পেলেও চুক্তি হয় নি এখনও। কবে চুক্তি হবে তাও সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। ১০টি পিকিং প্লান্ট স্থাপনের টেন্ডার প্রক্রিয়ার অগ্রগতিও মন্থর। ফলে আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুত সঙ্কট সর্বকালের ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

(চলবে)


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।