- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
শ্রাবণের পঁচিশ তারিখ। ঘড়িতে রাত সাড়ে নয়টা ছুঁই ছুঁই করতে করতে পাঁককোলা আনন্দধামে পৌঁছলাম। এই ধাম হচ্ছে লালন ফকিরের ঘর। এই ঘরের গুরু ফকির লবান শাহ। মাস কয়েক আগে সাঁইজি দেহ রেখেছেন। যথাক্রমে লালন সাঁই, ভোলা শাহ থেকে কোকিল শাহ হয়ে লবান শাহ ছিলেন। এখন গুরুমাই হলেন জ্যোতিধামের আলো। তাঁকে ক্ষণিক দেখলাম। অনুষ্ঠানের আয়োজক বুড়িমা সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। ভেবেছিলাম বয়স্ক কেউ। পরে দেখলাম সদা হাসি খুশি সেবাঅন্ত প্রাণ একজন মানুষ। বয়স একদম কম। তিনি ফরহাদ মজহারের পরমাত্মা বোন। এই বুড়িমাই আয়োজন করেছেন ‘মনসার পুরাণ’।
ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছিলাম ভোর ছয়টায়। যাত্রায় এর মাঝে বিরতি দিলাম দুইবার। টাঙ্গাইলের রিদয়পুর এবং ঈশ্বরদীর আরশিনগর নয়াকৃষি বিদ্যাঘরে। আমরা মোট সাতজন। আমি ছাড়া আর আছেন ফরহাদ মজহার, ফরিদা আখতার, সীমা দাস সীমু, রজব আলী ও সামিউল। আর ছিলেন ড্রাইভার আয়ুব আলী। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা পেরিয়ে প্রায় পনের কিলোমিটার ভেতরে পাঁককোলায় অবস্থিত ওই আনন্দধাম। দুইপাশে ঘন পাট ক্ষেত। কোথাও কোথাও চোখের সীমানা আটকে দেয়। কোথাওবা পাট কেটে ফেলা খালি মাঠ। রাস্তার পাশে সুন্দর করে বেঁধে রাখা পাট খড়ি। সবচেয়ে খারাপ লাগল এই শ্রাবণের শেষদিনেও মাঠগুলো শুকনা। বর্ষার জলের চিহ্ন নাই। পাট জাগ দিতে না পেরে কৃষকরা মুশকিলে আছেন।
আমাদের এগিয়ে নিতে ফটকে এলেন ফকির শামসুল আলম। বিশাল শরীরের মানুষ একজন, অথচ পুরা চেহারা জুড়ে শিশুর কোমলতা আর সতেজতা। যেকোন আগন্তুককে সহজে গ্রহণ করে নিতে পারেন, যেন অনেক দিনের চিনপরিচয়। পরে দেখলাম গুরুমা--বুড়িমা কিম্বা রওশন ফকির, সবার ব্যবহারেই সেই শিশুসুলভ আমন্ত্রণ। মানুষে ভক্তির গুণ হবে হয়ত। যেহেতু মানুষের বাইরে এই সাধকদের আর কোন গুরু নাই, জীবিত মানুষই তাদের জীবন সাধনার গুরু, মানুষের ভজনাই শুধু তারা করেন, ফলে ‘জয় গুরু’ বলে তারা ভাব বিনিময় শুরু করেন। যে শহুরে মধ্যবিত্ত লালন সাঁইকে বাউল মনে করে, সেই মধ্যবিত্ত তরুণদের দেখেছি বন্ধুজনের সাথে দেখা হলে ‘জয় গুরু’ বলে সম্ভাষণ করতে। তবে সবসময়ই তাদের সুরে একধরনের তাচ্ছিল্য আর অবমাননা থাকে। এক ধরনের পুলকও থাকে তার মধ্যে। মনে হয় টিভিতে টারজান সিরিজ দেখে সে ‘আফ্রিকান জংলী’দের কোন সম্ভাষণ রীতি শিখে ফেলেছে, আর সেভাবে সম্ভাষণ করে সে নতুন পুলক অনুভব করছে। কিন্তু আনন্দধামের সাধক মানুষগুলার চেহারায় তাকিয়ে আর মুখে ‘জয় গুরু’ শুনে মনে হল, তাঁর সামনে মানুষ হিশাবে সাক্ষাৎ গুরু হাজির, শুধু সে মানুষেরই ভজনা তাঁরা করেন।
ওই রাতে ধামের আগাপাশতলা পরিস্কার আন্দাজ করতে পারছিলাম না। ওর মধ্যেই দুই হাত একসাথে করে ভক্তি বিনিময় করলেন আরেকজন, আবদুল কাদের--মনসা পুরাণের মূল গায়েন। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই পালা পরিবেশন করছে তাঁর দল। শরীরে চিকন-চাকন আর রঙে শ্যামলা মানুষ এই আবদুল কাদের। প্রথম দেখায় কোন বিশেষ ব্যাপার নজরে পড়ার মত নাই তার মধ্যে। কিন্তু তার অভিনয় যখন দেখলাম, তখন মুগ্ধ হলাম। এই পালা পরিচালকের পুরাটাই বিশেষ, সাধারণত্ব বলতে কিছু নাই। তাঁর ওস্তাদের নাম নোয়াজ আলী। কাদের পেশাদার অভিনেতা নন, ধামের পাশেই একটা কারখানায় কাজ করেন, শ্রমিক। পালার দিনগুলাতে ছুটি নেন। আর পুরা পালা দেখাতে তার সময় লাগে তিন দিন তিন রাত। এই পালা আবার সাত খণ্ডের। কিন্তু আমাদের হাতে সময় বেশি নাই। তাই তিনি বেহুলা লখিন্দর-পালা থেকে শুরু করবেন বলে জানালেন।
এই পালার আয়োজনে বাড়তি কিছু থাকে না। কাদের জানালেন, এর জন্য আলাদা করে মঞ্চ বাঁধার কোন নিয়ম নাই। একটা সামিয়ানা খাটিয়ে তার মাঝামাঝি জায়গায় পাটি পেতে গায়ক দল বসেন। হারমোনিয়াম, ঢোল, তবলা ও বাঁশি এইসব বাদ্যযন্ত্র--ইদানিং সাউন্ডবক্স থাকে। ধামের বিশাল বট গাছের নিচে সামিয়ানা টানানো হল। রাত বারোটায় শুরু হল মনসার পুরাণ। আবদুল কাদের ভক্তি জানিয়ে মুরুব্বীদের অনুমতি চাইলেন প্রথমে। এরপর ধুপ জ্বালানো হল। ধুপ জ্বালিয়ে যিনি চারদিক গন্ধে ডুবালেন তিনিও একইভাবে ভক্তি দেখালেন। প্রথমে তিনটা দেশাত্মকবোধক গানের সুর তোলা হল বাদ্যযন্ত্রে। বুঝা গেল এইসব যন্ত্রে তাদের দখল ভালো। তবলায় ছিলেন মইর উদ্দিন আর হারমোনিয়ামে আকীম উদ্দিন। এরপর দৌড়ে এসে ঢুকলেন তিনজন অভিনেত্রী। আসলে তারা পুরুষ। চরিত্রের দরকারে নারী সাজ নিয়েছেন। পালা শুরু হল বন্দনা দিয়ে। সরস্বতী, মনসা, শিব সহ অনেকের বন্দনা করা হল প্রায় মিনিট দশেক। পাশাপাশি নাচও।
নারী চরিত্রে অভিনয় করছিলেন--মিজানুর, ইযারুল ও নূরুজ্জামান। মুখে রঙ মেখে, শাড়ী পরে সেজেছিলেন। মনসা, সনকা ও কালনাগিনী--তিনটা চরিত্রেই তারা অদল বদল করে অভিনয় করেছেন। করুণরসের যে আর্তি মিজানুর ছড়ান, সে আর্তি দর্শককে দখল করেই পরে থামে। তিনি বাউল মিজান নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। চৌদ্দ বছর ধরে এই পালায় অভিনয় করছেন। পড়া লেখা জানেন না তিনি। কিন্তু মনসার পুরাণ পুরা মুখস্ত। তার স্ত্রী লেখাপড়া জানেন। স্ত্রী তাকে মনসার
পুরাণ পড়ে শোনান। তার কাছে কালিপদ দাসের মনসার পুরাণ বই আছে। কোন প্রম্পটারের বালাই নাই। মুখস্ত থেকেই মুহূর্তেই যেকোন চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। তিনি জানালেন, এই কাজ ছাড়া আর কিছু করতে পারেন না। মিজানুর অবশ্য এই দলের অভিনেতা না। অন্য দলে অভিনয় করেন। এখানে পরিচালক কাদেরের অনুরোধে কাজ করছেন। অভিনয় কার কাছে শিখেছেন জানতে চাইলে বললেন, তার একজন ওস্তাদ ছিল। যিনি মারা গেছেন। নাম বললেন না। বললেন, ওস্তাদ থাকতে হয়। ওস্তাদ ছাড়া কিছুই হয় না। তাই তিনি এখন একজনকে ওস্তাদ সাজিয়ে রেখেছেন। ওস্তাদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই দলের হারমোনিয়াম বাজনাদার আকিম উদ্দিন বলেন, ওস্তাদ ছাড়া কিছুই হয় না। তিনি আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, শিক্ষক আর ওস্তাদ এক জিনিস না। অবাক হলাম! শিক্ষা আর দীক্ষার ফারাক এক কথায়ই স্পষ্ট করে দিলেন আকিম উদ্দিন। মনসা মঙ্গল সম্পর্কে মিজানুর বলেন, এটা পুরাণ। এখন কলিযুগ। কলিযুগ হলেও সেই পৌরাণিক ছাপ এখনো রয়ে গেছে। মনসা মঙ্গলের কোন বিষয়টাকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে দেখেন, জানতে চাইলে জানালেন, গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মনসার পূজা পাওয়ার বাসনা। মনসার জন্ম পাতালে, ঠিক কাছে, কিন্তু এর মানে এটা না যে, সে সারা জীবন নীচু হয়ে থাকবে। তারও অধিকার আছে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার। পূজা পাওয়ার। বললাম, আপনি তো মুসলমান, এমন পূজা ভক্তি-বন্দনা করেন কিভাবে? মুসলমানিত্বের সাথে এই নিয়া দিলের মধ্যে বিরোধ লাগে না? মিজানুর বললেন, জন্ম আমার মুসলমান পরিবারে। ইসলামি আচার পালন করি কখনো কখনো। কিন্তু মুসলমান হলে এখানে সমস্যা নাই। তার মতে, তিনি যেহেতু মনসার পালায় অভিনয় করছেন। কাজেই সেটাতে মিশে যেতে হবে। যদি মনসা বা সরস্বতীর বন্দনা না করেন তবে তাতে মিশে যাওয়া সম্ভব হবে না। ভক্তি না করলে তো অভিনয়ই হবে না। অন্যদিকে আরেক অভিনেতা সত্যিই মুশকিলে আছেন। তবে মুসলমানির সমস্যা না। গানজনিত সমস্যা। অভিনেতা ইযারুল। তিনি যদিও নাচ জানেন কিন্তু গান জানেন না। এটা তার জন্য বিশাল মুশকিল। ইযারুল বললেন, গান গাইতে না জানলে এইসব পালায় অভিনয় করা মুশকিলের। তাই তিনি নাচেন। মাঝে মাঝে মনসার সখি নেতা চরিত্রে দুই একটা সংলাপ করেন। আরেক অভিনেতা নূরুজ্জামান কখনো বেহুলা কখনো সনকা চরিত্রে অভিনয় করেন।
সনকা আর চাঁদ সওদাগরের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হল পালা। এরপর বিশ্বকর্মারূপী আবদুল কাদের দর্শকের সামনে আসেন। তিনি লখিন্দর চরিত্রেও অভিনয় করেন। মজার বিষয় হল; বিশ্বকর্মা মর্যাদার দিক হতে চাঁদ সওদাগরের অনেক ওপরের হলেও এখানে বিশ্বকর্মা চরিত্রটা অনেকটা কৌতুক করে পরিবেশন করা হল। হাস্য কৌতুক লাফ ঝাঁপ ভালোই উপভোগ করেছেন দর্শকরা। পালাটা দেখতে দেখতে মনে হল তত্ত্বের চেয়ে পরিবেশনার এদিকটাতেই ঝোঁক বেশিরভাগ দর্শকের। বিনোদনের জায়গা থেকে এটা বেশ উঁচুদরের পরিবেশনা। ফলে প্রচলিত কাহিনীর বাইরের নানা অনুষঙ্গ জুড়ে দিতে পরিচালকের কৃপণতা নাই। মনসা মঙ্গলের কাহিনী ও পালার একটা নিজস্ব ছক আছে। লালনের ভাবচর্চার সাথে মনসা মঙ্গলের আত্মীয়তা খুঁজে পেতে হঠাৎ করে অনেকের কষ্ট হতে পারে। কিন্তু একটা জায়গা লালনের ভাব, সর্বোপরি নদীয়ার ভাবের সাথে এই আখ্যান খুব মেলে। লালনের ধারা নদীয়া অঞ্চলে চৈতন্যের সিলসিলা। সে ধারায় শ্রীকৃষ্ণ আর রাধার ভাব গুরুত্বপূর্ণ। সে গুরুত্বের সাথে শিব ও পার্বতীর কাহিনীও যুক্ত। এটা আর্যদের রুদ্র ও প্রজাপতির কাহিনী থেকে একদম আলাদা। শিব পার্বতীর যুগল আখ্যানের মনসা মঙ্গলের গুরুত্ব লালনের ভাবসাধকদের কাছে, নদীয়ার ভাবুকদের কাছে। এই দিকটা ছাড়া সবমিলিয়ে ভাবগতভাবে মনসার কাহিনী বা পালার সাথে লালনের ভাব বা দর্শন কোনভাবেই যুক্ত না। দ্বিতীয় স্ত্রী কৈকেয়ীর কথা শুনে দশরথ তার ছেলে রাম সহ রামের স্ত্রী সীতা ও আরেক ছেলে লক্ষণকে বনবাসে দেন। দশরথ তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে এই অভিশাপ দেন যে, পরজন্মে তার ছেলে তাকে ছেড়ে যাবে। অপর জন্মে তিনি হলেন নিমাই বা গৌরাঙ্গ বা চৈতন্যদেবের মা। চৈতন্যদেব একসময় গৃহত্যাগী হন।
পালায় বিশ্বকর্মা বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বানানো শুরু করেন। পালার এখানটায় একটা সমস্যা হচ্ছিল। অন্তত আমার মত ‘শিক্ষিত’ দর্শকদের নিশ্চিতভাবেই সমস্যা হচ্ছিল। কখনো বলা হচ্ছিল লোহার বাসরঘর, কখনো কাচের বাসরঘর। আমরা সবসময় শুনে আসছিলাম লোহার বাসরঘর। পালার ওই পর্ব শেষে পরদিন শিক্ষা এবং অশিক্ষার কথা হচ্ছিল দলের গায়েনদের ওস্তাদ মইর উদ্দিনের সাথে। তিনি বললেন, আমরা অশিক্ষিত লোক। পড়ালেখা জানি না। কিন্তু আমাদের ভুল কম। আমরা যদি কোন কথায় ভুল করি তবে সেটাকে পরের কথায় ঠিক করে নিতে পারি। কিন্তু যারা শিক্ষিত লোক, তারা যদি কোথাও ভুল লেখেন, তবে তা যুগের পর যুগ সঠিক জেনে লোকে বিশ্বাস করতে পারে। কারণ লিখিত রূপের আলাদা মান্যতা আছে। যতদিন না আরেকজন জ্ঞানী মানুষ ভুলটা ধরে না দেন ততদিন সেটা চলতে থাকে।
চাঁদ সওদাগর চরিত্রে আশরাফুল আলম আহসান অভিনয় করেছেন। সওদাগর মনসার পূজা দেবেন না। কারণ তিনি শিবের ভক্ত। ফলে তাঁর ছয় ছেলেকে কালিদহ নদীতে ডুবিয়ে মারে। লখিন্দরের যদি বিয়ে হয় তবে বাসর ঘরে সাপের কামড়ে মারা যাবে বলে শাপ দেয়। কিন্তু লখিন্দরের জন্য একটু সুযোগ আছে বেঁচে যাওয়ার। লখিন্দরকে বাঁচানো যাবে যদি মনসার পূজা দেয়া হয়। কিন্তু চাঁদ সওদাগর রাজি হন না। তিনি কাঁদতে থাকা সনকাকে পরামর্শ দেন ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করার। বেহুলা-লখিন্দর বাসর রাত জেগে কাটাবে। তাই তারা পাশা খেলে সময় কাটায়। তারা ধর্মরাজকে বিচারক হিশাবে আমন্ত্রণ জানায়। দুহাতে মশাল নিয়ে মঞ্চে আসেন ধর্মরাজ। এসেই হুংকার ছাড়েন ধর্মরাজ, কে তাকে ডেকেছে? ধর্মরাজের চরিত্রে ছিলেন গায়েন মাহমুদ খোদা বক্স। দলগতভাবে তিনি হলেন দলপতি বা ম্যানেজার। আবদুল কাদের জানান, দলে এইরকম প্রবীণ থাকলে তাকে সম্মান জানাতে হয়। জানা গেল, স্টিল বা ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়ার শখ আছে খোদা বক্স গায়েনের। তার কথায়, টেলিভিশনে নিজেকে দেখার মধ্যে বিশেষ আনন্দ আছে। তিনি ‘সাংবাদিক’এর উপস্থিত থাকার কথা শুনে খুশি হলেন। ব্যাটারি ঠিকমত কাজ না করায় প্রায় ঘণ্টা খানেক পালা বন্ধ ছিল। শেষমেশ রাত আড়াইটার দিকে ‘আজকের মত সমাপ্তি’ ঘোষণা হল। পরদিন সকালে বাকিটুকু আবার শুরু হবে।
প্রচণ্ড ক্লান্তি, ঘুমাতে গেলাম আনন্দধামের খোলা চত্বরে অনেকে, একসাথে। সারাদিনের গাড়ি ভ্রমণের ক্লান্তি আর ধামের প্রতি ঔৎসুক্যের কারণে ঘুম নামছিল না চোখে। বসে বসে পালার অভিনেতা ও গায়েনদের খাওয়া দেখতে লাগলাম। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা চলছিল খুব। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, তারা সবাই একটা রেখার নিচে বাস করেন। দারিদ্র্য রেখা। গরিব মানুষ সবাই। তারা আধুনিক সমাজের নাগালের বাইরে মনসা পুরাণকে তাদের জীবন যাপনের অংশ করে নিয়েছেন। এটাকে তারা ঐশ্বর্যের মতো ধরে রেখেছেন, যা বাংলার ভাবের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুম আসতে শুরু করল। অমাবস্যার রাত। ধারেকাছে হারিকেন জ্বলছিল একটা। বাকিটা আঁধার। কে যেন জোরে বড় হাতপাখায় বাতাস করছিল আশেপাশে।
ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে ফরহাদ ভাই ডেকে তুললেন। ধুর! সবার আগে শুয়ে উঠলাম কি না সবার পরে। সমবেত গলায় গোষ্ঠ গানের আওয়াজ পেলাম। রাতে যা দেখতে পাই নাই, দিনের আলোয় ধামের সবটা পরিস্কার দেখতে পেলাম। চত্বর জুড়ে বিশাল লিচু গাছ। সবগুলো ঘর সাদা রঙের। ধামের সাধুগুরুদের সবার পোশাকও সাদা। লালনের গোষ্ঠ গান মোট আটটা কি নয়টা বলে আমি জানি। সাধুরা ভোরে এই গানগুলা গেয়ে দিন শুরু করেন। রাখাল বালক কৃষ্ণকে নিয়া বাঁধা হয়েছে এই গোষ্ঠ গান। বাদ্য বাজনা সামান্যই, দোতারা আর খোল করতালের বাজনার চেয়ে চড়া আর ভারী গলা গায়ক সাধুদের। গান আমার কাছে তাদের মত করে জীবন-সাধনার অংশ না। হয়ত তা-ই গানের প্রাণশক্তি অনুধাবনের চেষ্টা বিফলে গেল।
সকালে পালা আবার শুরু করার আগে মঞ্চের একপাশে চারটা কলাগাছ পোতা হল। তারপর গাছের চারদিকে একটা সাদা কাপড় জড়ানো হল। তার ভেতরে রাখা হল অষ্ট নাগের জন্য ভোগসহ পূজার নানা উপকরণ। একটা ডালায় আটটা কচু পাতার ওপর চাল, কলা, খই ও দুধ মেখে অষ্ট নাগের ভোগ তৈরি করা হল। একটা কলসিতে পাঁচটি পাতার একটি ডাল রাখা হল। কলসিতে সিঁদুর দিয়ে সাপের প্রতীক আঁকা হল। আরেকটি ডালায় ধান, দূর্বা ঘাস, আটটা বেল পাতা, কলা, ঘট-পট, ফুল, আয়না, চিরুনি, গামছা, দুইটা মঙ্গল প্রদীপ দিয়ে সাজানো হল। ঘট পটে মনসার চিহ্ন দেয়া হল। চিহ্ন দেয়া হয় সরিষার তেলে সিঁদুর মাখিয়ে। এরপর নানা জনে মঙ্গল প্রদীপ এবং পাঁচটা মোম বাতি জ্বালালেন। তারপর গুরুমা, বুড়ি এবং আবদুল কাদের মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে এতে ভক্তি দিলেন। অভিনয় শিল্পীদের কেউ কেউ একই কাজ করলেন। অষ্টনাগ নিয়ে নানান ব্রতকথা আছে। যেগুলো নারীদের মাঝে বেশি প্রচলিত। মানতের সাথে সম্পর্কিত। মানত সম্পর্কে মইর উদ্দিন বলেন, মানত করে মনসা পুরাণের আয়োজন করলে মানত পূরণ হয়। তিনি এর সাক্ষী।
এরপর বন্দনা গীত ও নাচ দিয়ে পালা আবার শুরু হল। এর আগের রাতে দেখেছিলাম ঢোঁড়া সাপ আর শঙ্খ সাপ কিভাবে মনসাকে ফাঁকি দেয়। ঢোঁড়া আর শঙ্খের কৌতুকপূর্ণ অভিনয় দেখান মইর উদ্দিন ও আলেক। এই মইর উদ্দিন আর গায়েন মইর উদ্দিন এক ব্যক্তি না। ঢোঁড়া আর শঙ্খকে দিয়ে কাজ না হওয়ায় লখিন্দরকে কামড় দেয়ার জন্য মনসা ডেকে পাঠালেন কালনাগিনীকে। কালনাগিনী জানাল, সে নিজে তো মা। তার দুইটা সন্তান আছে। তার পক্ষে অন্য মাকে সন্তান হারা করা সম্ভব না। এই জায়গায় সংলাপ আর গানের কাজ খুব মর্মস্পর্শী। সর্পদেবী মনসার অনুনয়ে শেষ পর্যন্ত কালনাগিনী রাজি হয়। কিন্তু এরপরও কামড় না দেয়ার ছল খোঁজে। কেনই বা অকারণে কামড় দেবে। সে দ্বিধায় ভোগে কোথায় কামড় দেবে। হাতে না পায়ে, মুখে না পেটে। সে কামড় দেবার উসিলা তালাশ করে। শেষমেশ মশার কামড়ে লখিন্দর নড়ে উঠলে কালনাগিনীর গায়ে পা লাগে। সেই মশা আবার মনসার পাঠানো। প্রায় পনের মিনিট ধরে চলতে থাকল কালনাগিনীর দংশন নৃত্য। দংশন নৃত্য দেখা হল। কিন্তু পুরা পালা দেখা হল না। আমাদের তাড়া ছিল। এতটুকুতেই শেষতক ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হল। আন্তরিকতার সাথে আনন্দধামের বাসিন্দারা বিদায় জানালেন। আনন্দধামের আনন্দ সাথে নিয়ে চলছিলাম। আর ভাবছিলাম ছোট্ট একটুকরো জায়গায় কি চমৎকার কাজ। এই কাহিনী সবার জানা। অথচ একের পর এক সংলাপ আর গান দিয়ে কি চমৎকার টান টান পরিবেশনা। উঠতেই মন চায় না। ভুল হলে কতো সহজে শুধরে নেয়। আফসোস থাকল, বেহুলা কি করে সাতটি ঘাট পার হয়, সেটা দেখা হল না। শুনেছি প্রতিটি ঘাটের আলাদা আলাদা তাৎপর্য আছে। বেহুলা তার ভেলা নিয়ে উজানের দিকে যাত্রা শুরু করে। উজান মানে যেখানে জন্ম। প্রকৃতিতে কি করে মানুষের জন্ম হয়। আবদুল কাদের আক্ষেপ করে বলছিলেন, এখনকার ছেলেরা মনসার পুরাণের চেয়ে আধুনিক নাচ-গান বেশি পছন্দ করে। ভাবলাম, শিগগির পুরা পালা দেখতে আবার আসতে হবে।
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)