আল জাওয়াহিরি: বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও ভৌমিকের ‘গাড়ী বোমা’ প্রস্তুতি
এক
আলজাওয়াহিরি কথিত ভিডিও বার্তা নিয়ে প্রপাগান্ডা চলছে। কিন্তু দেশি বা বিদেশি কেউই নিশ্চিত করে এখনও বলতে পারছে না, এই ভিডিও বার্তা আসলে কার। যারা খবরটি ছেপেছে তারা সবাই খবরের সোর্স পরীক্ষা না করে এবং খবরটা কোন ক্রসচেক না করেই ছেপে দিয়েছে। খবরের কোন সত্যতা নাই জেনেশুনেই খবরটি ছেপে নিজ নিজ পক্ষে প্রপাগান্ডা চালিয়ে গিয়েছে। মুল গলদটা এখানেই। বলা বাহুল্য, এই সময় মিথ্যা হোক বা সত্য, এই ধরণের প্রপাগান্ডার মুল্য আছে; মিডিয়ার পছন্দ ও অনুসরণ করা রাজনীতির লাইনের জন্য ফায়দা তোলারও এটা ভাল রাস্তা -এই বিবেচনাও কাজ করেছে। । ফায়দা তোলার বিবেচনা এতই প্রবলভাবে অনেককে তাড়া করেছেচ যে এ ধরনের সংবেদনশীল বার্তা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য, এমনকি আদৌ ছাপার যোগ্য নিউজ কিনা সেই হুঁশও সবার লোপ পেয়েছে। কাণ্ডজ্ঞান সবাইকে ত্যাগ করেছে মনে হয়।
কথিত এই ভিডিও বার্তার উৎস অবিশ্বাস্য এক ওয়েব সাইট, যাকে বিশ্বাস করা সাংবাদিকতার দিক থেকে চূড়ান্ত বোকামী বললে কম বলা হবে। সে যাক। কয়েকদিন আগে ইনকিলাব পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে নির্ভরশীল ও বিশ্বাসযোগ্য না হবার পরেও তারা একটি খবর ছেপেছে যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সংবেদনশীল। এই ধরনের নিউজ ছাপানোর অভিযোগকে কেন্দ্র করে পত্রিকা বন্ধ, সাংবাদিক ও সম্পাদনা বিভাগের দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের গ্রেফতার, জেল, পত্রিকা অফিস মালামাল জব্দ ইত্যাদি সবকিছুরই মুখোমুখি হতে হয়েছিল পত্রিকাটিকে। আল জাওহিরির বার্তাটি প্রসঙ্গে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই জানিয়েছে কথিত বার্তাটা জেনুইন কি না সে সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নয়, অর্থাৎ সরকার নিজেই ভাবছে এটা একটা বানানো প্রপাগান্ডা ও গুজব। সে হিসাবে এমন অবিশ্বাসযোগ্য ও অনিশ্চিত কথিত ভিডিও বার্তা নিয়ে বিডিনিউজ, ডেইলি ষ্টার, প্রথম আলোর মত পত্রিকা কেন নিউজ করল? ইনকিলাব যে সকল অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল ঠিক সেই একই যুক্তিতে একই অভিযোগ এসব পত্রিকার বিরুদ্ধেও তোলা উচিত। কিন্তু সরকারের কোন একশন আমরা দেখিনি। সরকার নিজেও জানে তথ্য ও প্রযুক্তি আইন অনুসারে আল জাওয়াহিরির খবর যেভাবে বিডিনিউজ, ডেইলি স্টার, প্রথম আলো ইত্যাদি পত্রিকাগুলো ছেপেছে তা ‘অপরাধ’। তার পরেও এইসব পত্রিকার প্রপাগান্ডা থেকে ফায়দা আদায় করতে চেয়েছে। প্রপাগাণ্ডার মুল্য সরকারের পক্ষেই যায়।
বলে রাখা দরকার আমরা তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের বিপক্ষে এবং মনে করি তা বাতিল করা উচিত। হীনতা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ তাড়িত এই সংবাদপত্রগুলোর উস্কানিমূলক হীন সাংবাদিকতাকে নিন্দা ও প্রতিবাদ করি। কিন্তু কারো ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন আমরা চাই না। কিন্তু এই পত্রিকাগুলিরই উস্কানির কারনে এই আইনে আজ মাহমুদুর রহমান কারাগারে; আদিলুর রহমান খানকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে, জামিনে বেরিয়ে এসেও ক্রমাগত তাকে ও মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’কে হয়রানি করা হচ্ছে। আইনের এই বিষম বা বৈষম্যমূলক প্রয়োগ অন্যায় ও অসাংবিধানিক। গণমাধ্যমগুলোও এই দায়ে দায়ী।
দৈনিক ডেইলি স্টার পত্রিকায় তাজ হাশমির লেখাটিও আমাদের নজরে এসেছে (Zawahiri asks for an Intifada in Bangladesh?)। তিনি চাইছেন সত্য হোক মিথ্যা হোক আল জাওয়াহিরির কণ্ঠস্বর দাবি করে প্রচারিত বার্তাটি আমলে নেওয়া হোক। তিনি নিশ্চিত নন এই বার্তাটি আল জাওয়াহিরির। তবে দাবি করেছেন, যারা তার গলা, স্বরের বৈশিষ্ট্য এবং ভারি গলার মিশরীয় উচ্চারণ সম্পর্কে পরিচিত তারা ‘প্রায় নিশ্চিত’ (almost certain) এটা আল জাওয়াহিরির। তিনি নিজে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নন, কিম্বা নিজেকে তিনি জাওহারিরির গলা চেনেন তেমন মানুষ বলে ডেইলি স্টারের লেখায় দাবি করেন নি। কিম্বা এমন কোন বিশেষজ্ঞের বরাতও ডেইলি স্টারের লেখায় দেন নি, যাতে তাঁর সাক্ষ্য আমরা আমলে নিয়ে এই অডিও বার্তাটি আল জাওয়াহিরির বলে দাবি করতে পারি। তবে এর আগে ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখে বিডিনিউ৪ ২৪-এ তিনি ভিন্ন কথা বলেছেন (দেখুন, "Its Him") । নিজেকে বিশেষজ্ঞ দাবি করে এই বার্তাটি আল জাওয়াহিরির বলেই সাক্ষী দিয়েছেন। বিভ্রান্তি নিরসনের চেয়েও তিনি আরও বিভ্রান্তি তৈরী করেছেন।
তাঁর লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জামায়াতে ইসলামির রাজনীতি আর আল কায়েদার রাজনীতিকে আমরা যেন সমার্থক গণ্য না করি, এই ধরণের প্রাচীন ও ফালতু প্রচার থেকে বিরত থাকা দরকার। এগুলো বিপজ্জনক প্রপাগাণ্ডা। ইসলামপন্থী রাজনীতির বিভিন্ন ধারার মধ্যে পার্থক্য টানবার মতো কাণ্ডজ্ঞান আমাদের ইতোমধ্যেই হয়ে যাওয়া উচিত। তাঁর এই হুঁশিয়ারিতে আমরা কোন আপত্তি দেখি না। কোন ইসলামপন্থী দল কে কথায় কথায় নিষিদ্ধ করবার দাবিও চরম অদূরদর্শিতার পরিচয়। বাংলাদেশে এরকম কিছু করা হলে তা স্থিতিশীলতার সহায়ক হবে না। এতোটুকু আমরা তাঁর সঙ্গে সায় দিতে প্রস্তুত। তবে তিনি মিশর, সিরিয়া, গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংকের নজির টেনে দাবি করেছেন এতে তারা আণ্ডারগ্রাঊন্ডে গিয়ে আল কায়িদায় যোগ দেয় – এটা অতি সরলীকরণ। বিদ্যমান অসম বিশ্বব্যবস্থা এবং কাঠামোগত সন্ত্রাস শুধু ইসলামপন্থিরা নয়, মাওবাদিসহ আরও অনেক রাজনৈতিক দল সামরিক ভাবে মোকাবিলার কথা বলে এবং লড়ে। ইতিহাসে এগুলো নতুন কিছু নয়। তবে পাশ্চাত্যের লিবারেল রাজনীতি বিধিবদ্ধ সংবিধান ও গণতান্ত্রিক নিয়ম নীতির মধ্যে যে কারুরই রাজনীতি করবার অধিকার সুরক্ষার জন্য এই যুক্তি দিয়ে থাকে। ইসলামী আন্দোলনের প্রতি সাম্প্রতিক মার্কিন নীতিও এই যুক্তিতে কোন ইসলামি দলকে নিষিদ্ধ করবার বিপক্ষে। এই মার্কিন নীতির আলোকেই মজিনা তার ভারত সফরে গিয়ে দিল্লীতে বোঝাতে গিয়েছিলেন কেন বিএনপিসহ আঠারো দলীয় জোটকে লিবারেল স্পেস দেয়া দরকার, বিরোধী রাজনীতিকে কেন নির্বাচনে আসার জায়গা করে দেয়া জরুরী; এর ব্যত্যয় হলে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক সীমা ছেড়ে সশস্ত্রতার লাইনে ইসলামি আন্দোলনকে ঠেলে দেবার বিপদ আহবান করা হবে। ভারত এর জবাবে পালটা মজিনার বিরুদ্ধে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যের মত কথা বলছেন বলে প্রচারণা চালিয়েছিল। তাজ হাশমি তাঁর দৈনিক ডেইলি স্টারের লেখায় মার্কিন নীতিরই প্রতিধ্বনি করছেন। এতেও আমরা কোন অসুবিধা দেখি না। তাঁর নিজেরই সন্দেহ থাকা বক্তব্যের পর আবার এই অডিও বার্তা আল জাওয়াহিরিরই এটা ‘প্রায় নিশ্চিত’ – এটা অতিরিক্ত দাবি বলেই আমরা মনে করি।
আবার তাঁর এই দাবি কিভাবে অতি দ্রুত বিকৃত করে ব্যবহৃত হতে পারে এ ব্যাপারে তাঁর কোন ধারণা আছে বলে মনে হয় না। আজ ২২ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে মশিউর রহমান লিখেছেন,
“আল-কায়েদার নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির নামে ইন্টারনেটে প্রচারিত অডিও বার্তাটি সত্যিই জাওয়াহিরির বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনারত বাংলাদেশি নিরাপত্তা বিশ্লেষক তাজ হাশমি। গতকাল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি দাবি করেছেন, জাওয়াহিরির কণ্ঠস্বর তিনি চেনেন, তাঁর মিসরীয় উচ্চারণে বলা আরবি ভাষার বক্তৃতাটি তিনি ‘প্রায় নিশ্চিত’ভাবে শনাক্ত করতে পেরেছেন”।
দৈনিক প্রথম আলোর এই ধরণের প্রচার নিয়ে আমরা আলাদা লিখব। তবে তাজ হাশমি দৈনিক প্রথম আলোর লেখা পড়ে এবার নিজেই বিচার করে দেখতে পারেন তিনি আল জাওয়াহিরির কণ্ঠস্বর চেনা বিশেষজ্ঞ ও 'নিরাপত্তা বিশ্লেষক' হতে চান কিনা। ক্যারিয়ার হিসাবে এটা খুব খারাপ হবে না।
দুই
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক নিয়মিত তাঁর কলাম লিখে চলেছেন। দিল্লীকে বাংলাদেশে সম্ভাব্য সব ধরনের হস্তক্ষেপ করার উস্কানি নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এবার কথিত এই ভিডিও বার্তা নিয়ে এক প্রপাগান্ডামুলক কলাম লিখেছেন হিন্দুস্থান টাইমসে গত ১৮ ফ্রেবুয়ারি তারিখে (Bangladesh war crimes and the possibility of global terror)
ভৌমিক প্রথম প্যারাতেই লেখা শুরু করেছেন, “A video-message of al Qaeda’s present chief Ayman Al-Zawahiri” – এভাবে। পুরা লিখায় তিনি কোথাও কোন বিন্দুমাত্র সন্দেহ রাখেন নি যে এই খবর সত্যি নয়; এই ধরণের খবরের জন্মসুত্র অনিশ্চিত হতে পারে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকার পরেও তিনি সেটা আন্দাজ করতে পারেন নি, সেটা অবিশ্বাস্যই মনে হয়। এরপরেও তিনি নিশ্চিত এটা আল জাওহিরির বক্তব্য। এখন তিনি দিল্লী ও ঢাকাকে তার কায়দায় হেদায়েত করতে শুরু করেছেন।
অথচ বাংলাদেশের অনেকের মতোই তিনিও ফলো করেন নাই যে এই গুজব, যাকে খবর বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা এবারই প্রথম নয়। একই প্রসঙ্গে একই গুজব বাংলাদেশের অন্য এক কর্ণার থেকে ছাড়া হয়েছিল গত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩, ‘বাংলাদেশকে আল কায়েদার হুঁশিয়ারি’ এই শিরোনামে। তখনই এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছিল। বোঝা গেল, ভৌমিকের প্রপাগান্ডাসর্বস্ব উস্কানিমূলক কলাম লেখায় গুজবের মুল্য অপরিসীম। তিনি তবু নতুন করে তাঁর গুজব ছড়াতে এই অবিশ্বাস্য ও জন্ম-উৎসবিহীন খবর নিয়ে নতুন প্রচারে ব্যস্ত হবার জন্য এই লেখা সাজিয়েছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট নিয়ে তাঁর মজার বয়ানটা এরকম:
জামাত-বিএনপির শয়ে শয়ে কর্মীরা সহিংসতার (on charges of violence) অভিযোগে কারাগারে বন্দি আর হাসিনা পুলিশ বাহিনী দিয়ে নিয়ত সঠিক রেখে ঠেঙিয়ে পিটিয়েandled the challenge by determined police action) সব্বাইকে ঠান্ডা করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তার দলীয় কর্মিবাহিনী দিয়ে (asking her party activists to take the fight to the streets) রাস্তায় মারধোর খুনাখুনিকরে বিরোধীদের মোকাবোলা করেছে। এই হোল ভৌমিকের বয়ানের মূল কথা। বলা বাহুল্য আগাপাছ না ভেবে খুনাখুনির মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার এই প্রকার সাময়িক বিজয়ে ভৌমিকের সমর্থন,খুশি ও প্রভূত উল্লাস মোটেও লুকানো ছাপানো নাই।
কিন্তু তাজ্জবের কথা হল, ভৌমিকই আমাদের সাক্ষ্য দিয়ে জানাচ্ছেন আল জাওয়াহিরি বক্তব্য দিলেও আলকায়েদার রাজনীতি আর জামাতের রাজনীতি এক নয়। গত এক বছরের আন্দোলনে জামাতের রাজনীতি ও তৎপরতা আর আল জাওয়াহিরির রাজনীতি যে এক ছিল না তা চিহ্নিত করে সত্যি সত্যিই মৌলিক কিছু পার্থক্য দেখিয়েছেন তিনি । লিখেছেন:
“But by lashing out at Western-style democracy championed in Bangladesh and pitching for Sharia rule, Al-Zawahiri may end up raising hackles in the West, specially the United States. Because so far the Jamaat and its fraternal groups have fought a street war to uphold the very democracy that Al-Zawahiri is so critical of. But for Hasina and her party, the threat of intensified terror, of petrol bombs being replaced by car bombs, is a frightening prospect. The power of terror did reflect in the low turnout during the polls. If the Islamists manage to stage a few daring car bombings that kill a few hundred like in Iraq, Bangladesh will be looking at a whole new challenge of global terror coming to the country through home-grown Islamists who may lack a popular support base but have enough real and virtual networks to bleed the country and those who run it.”
উপরের ইংরাজি কথন নিজ দায়িত্বে ভাবানুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়ঃ
কথিত ভিডিওবার্তাটা সত্যিই আল জাওয়াহিরির এটা ধরে নিয়ে ভৌমিক লিখছেন, বাংলাদেশে পশ্চিমা-স্টাইলের গণতন্ত্রকে তুলাধুনা করে আর শরিয়া আইনের পক্ষে ঢাকঢাল পিটিয়ে আল জাওয়াহিরি হয়ত পশ্চিমাদের, বিশেষ করে আমেরিকার্শ্বাসকষ্ট তুলতে পেরেছেন। যদিও জামাত ও তার ভাইবেরাদর গ্রুপগুলো কিন্তু ঐ গণতন্ত্রকে রক্ষার (street war to uphold the very democracy) জন্যই রাস্তায় লড়ছে। সেই গণতন্ত্র – চোখের বিষের মত যার বিরুদ্ধে আল জাওয়াহিরি উচ্চকিত। কিন্তু হাসিনা ও তাঁর দলের জন্য সন্ত্রাস হয়ে উঠতে পারে সেটা এই হুমকি যে এখনকার পেট্রলবোমা বদলে গিয়ে যদি আবার গাড়িবোমা হয়ে যায়। সন্ত্রাসের ক্ষমতা কেমন তা দেখা গিয়েছিল গত নির্বাচনে খুবই কম ভোটারের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। ইসলামিষ্টরা যদি কিছু সাহসী গাড়িবোমা সংঘটিত করতে পারে যাতে ইরাকের মত বাংলাদেশের কয়েকশ লোক মারা যায় তবে সেটা সামগ্রিকভাবে গ্লোবাল সন্ত্রাসের নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিবে। এটা বাংলাদেশে আসতে পারে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা ইসলামিস্টদের দ্বারা, যাদের জনপ্রিয় সমর্থনের ভিত্তি না থাকতে পারে; কিন্তু এদের বাংলাদেশের এবং এই দেশটিকে যারা চালায় তাদের রক্তক্ষরণ ঘটাবার মত সত্যিকার ও অদৃশ্য যথেষ্ট নেটওয়ার্ক আছে ”।
তিন
ভৌমিকের লেখার তাৎপর্য কি?
প্রথমতঃ জামাত গণতন্ত্রের জন্য রাস্তায় লড়ছে, আর আল জাওয়াহিরি ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য...
প্রথম দুলাইনে ভৌমিক জামাত ও তার বন্ধুদের রীতিমত সাফাই সার্টিফিকেট দিচ্ছেন যে জামাত “গণতন্ত্রের জন্য রাস্তায় লড়ছে”। তার মানে জামাত ও তার বন্ধুরা অন্তত কোন ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য লড়ছেন না এটা তিনি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছেন। অর্থাৎ ইসলামি রাজনীতি মানেই তা কোন ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য লড়া বলে ধরে নেয়া ঠিক না। কিম্বা এদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টহান সম্প্রদায় যেমন তাদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থ নিয়ে সঙ্গত কারনেই উদ্বিগ্ন হয়, মুসলাম্নরাও সঙ্গত ভাবে তাদের স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করতে পারে, আন্দোলন সংরাম করতে পারে। সেটাকে ইসমালি রাষ্ট্র কায়েম করারা আন্দোলন ভাবাও ঠিক নয়। জামাতের ইসলামি রাজনীতিও সেটা করছে না। কথা সত্য। তবে ভৌমিকের চোখে এটা ধরা পড়েছে এবং সেটা তিনি স্বীকার করছেন, সেটাই তার এই কলামের বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক। তার মানে জামাত ও তার বন্ধুরা (ধরা যাক হেফাজত) কোন ইসলামি রাষ্টের জন্য রাস্তায় লড়ছে না – ভৌমিকের কথার পেছনের এই আগাম অনুমান থেকেই এটা আমরা পাচ্ছি। জামাত ইসলামি রাষ্ট্র চায় আওয়ামি লীগ ও হাসিনার এমন প্রপাগান্ডা ভৌমিক তাহলে অস্বীকার করছেন।
দ্বিতীয়ত শেখ হাসিনা ও তার দল জামাতে ইসলামিকে ‘সন্ত্রাসী’ বলেই প্রচারনা চালায়। অন্তত এই ডিমেও ভৌমিক তা দিতে চাইছেন না। জামাতের রাজনীতির সাথে আল জাওয়াহিরির রাজনীতির সত্যি সত্যিই মৌলিক ফারাক আছে। এতে কোন সন্দেহ নাই। হেফাজতে ইসলামের রাজনীতিও ধর্ম চর্চার স্বাধীনতার দাবি; ধর্ম প্রাণ মানুষের ইমান আকিদা বিশ্বাসের মর্যাদার দাবি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই দাবি এই সব। জামাতে ইসলামির মধ্যে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম গণতন্ত্রের ফারাকটা সুবীর ভৌমিকের দেখা, উল্লেখ করা ও মেনে নেওয়া মন্দ না। খারাপ কি?
দ্বিতীয়তঃ ভায়োলেন্স আর টেররের ফারাক
এরপর সুবীর ভৌমিক ইরাকের মত গাড়িবোমার ভয় দেখাচ্ছেন, হয়েছে বলেন নাই, হতে পারে এমন অনুমানকে “হুমকি” হিশাবে প্রচার করছেন। লক্ষ্য করার বিষয়, এর আগে বাস্তব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সময় তিনি ব্যবহার করেছিলেন violence শব্দটা, “টেরর” ব্যবহার করেন নাই। বলেছিলেন, “জামাত-বিএনপির শয়ে শয়ে কর্মীরা সহিংসতার (on charges of violence) অভিযোগে কারাগারে আছেন”। এবার যা এখনও ঘটে নাই তবে ঘটতে পারে এমন অনুমান করছেন – তা বলতে গিয়ে এবার শব্দ ব্যবহার করছেন “টেরর” (intensified terror)। টেরর ধারণা ব্যাখ্যা করতে সম্ভাব্য সেই ঘটনাকে বলছেন, “ইরাকের মত গাড়িবোমায় কয়েকশ লোকের মৃত্যু হতে পারে”। অতএব সারকথায়, জামাত ও তার বন্ধুরা এখনও সন্ত্রাস শুরু করে নাই। কেবল ভায়োলেন্স বা সহিংসতা করছে – এই সঠিক সাক্ষ্য তিনি দিচ্ছেন। আর “এটা সন্ত্রাস হয়ে উঠতে পারে” এই ভয় দেখাচ্ছেন। সেটা কেন? হাসিনার পুলিশ ও ছাত্রলীগকে অস্ত্র হাতে নামিয়ে দেয়াটাকে ন্যায্যতা দেবার জন্য।
এর আরেকটি অর্থ হতে পারে। বাংলাদেশকে দিল্লী যদি যুদ্ধক্ষেত্র বানাতে চায়, তাহলে ইসলামিস্টদের হয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সুনির্দিষ্ট কী কাজটি করতে হবে, তিনি তা বাতলিয়ে দিচ্ছেন। সেটা গাড়ি বোমা ফুটিয়ে দেওয়া। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় রাখার এটা একটা উপায় হতে পারে। তখন আল কায়েদা মোকাবিলার জন্য আমরা যেন শেখ হাসিনাকেই একমাত্র ত্রাতা বলে জড়িয়ে ধরি। দিল্লীর জন্য ভাল প্রস্তাব।
তৃতীয়তঃ ঘরে (স্থানীয়ভাবে) গড়ে উঠা ইসলামিষ্ট
মুল শব্দটা তিনি ব্যবহার করেছেন, “home-grown Islamists”। অর্থাৎ আল জাওয়াহিরি বা আল কায়েদার সাথে যুক্ত না, হোম-গ্রোন। গ্লোবাল ইসলামি কোন ধারা নয়, স্থানীয় ধারা। তাঁর শব্দ বেছে নেয়াটা দারুন তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি স্বীকার করছেন, এটা “সন্ত্রাসী” নয়, কারণ সন্ত্রাসী বা টেররিজম ধারণা বুঝাতে পশ্চিমা বয়ান বরাদ্দ রেখেছে আল জাওয়াহিরি বা আলকায়েদার ধারার জন্য। সার কথায় আন্দোলনে এখন যেসব ইসলামি ধারা তারা যেহেতু কেউই আল জাওয়াহিরি বা আলকায়েদার ধারা নয় এবং এটা ভৌমিক নিজেই অজান্তে স্বীকার করে ফেলেছেন। তবু জবরদস্তি এবং কৌশল হিসাবে বাংলাদেশে তাদের সকলকে “সন্ত্রাসী” চিহ্নে চিহ্নিত করতে হবে। এই অসততা করতে তার বাধেনি। নিঃসন্দেহে এটাও দিল্লীর একটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নইলে প্রপাগান্ডা জমবে না।
চতুর্থতঃ সন্ত্রাসের ক্ষমতা কত তা বুঝা যায় কম ভোটার উপস্থিতিতে
এবারও তিনি অসততায় ধরা খেয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে যা হয়েছে তাকে তিনি আগে্ কিন্তু জামাতের “ভায়োলেন্স” বলেছেন। তাই যদি হয় তবে কম ভোটারের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি সন্ত্রাসের ক্ষমতা (The power of terror) – এই শব্দ ব্যবহার করেন কি করে? বড় জোর তিনি বলতে পারেন ভায়লেন্সের ক্ষমতা। বাংলাদেশের নিরস্ত্র গণ-আন্দোলনে এর আগে বহুবার সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচন বর্জনের কর্মসুচি আমরা দেখেছে। সেখানে যে মাত্রার “ভায়োলেন্স” আমরা আওয়ামি লীগকে করতে দেখেছি তাতে এখনকার ভায়োলেন্স চরিত্র ও মাত্রার দিক থেকে মোটেও আগের চরিত্র ও মাত্রা অতিক্রম করে নি। আন্দোলনের ব্যাপ্তি, বিস্তৃতি ও বিশেষ ভাবে জনগণের অংশগ্রহনের ফলে পরিমান বা সংখ্যার দিক থেকে অধিক মনে হয়েছে। বাংলাদেশে যেমন তেমনি ভারতেও এই মাত্রার ভায়োলেন্সের উদাহরণ রাজনৈতিক কালচারে রয়েছে। ফলে বাস্তবেই এটা গণ-আন্দোলনের (মাস লাইন, সশস্ত্র মাওবাদী ধরনের নয়) সঙ্গে চলে এমন মাত্রার ভায়োলেন্স। তাহলে সারকথা হল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক গণআন্দোলন এখনও “সন্ত্রাস” হয়ে উঠে নাই। আর এরা আল জাওয়াহিরি বা আলকায়েদার ধারার সঙ্গে যুক্তও নয়। এবং তা ইরাকে গাড়িবোমায় কয়েকশ লোক মারার মত সন্ত্রাস তো নয়ই।
শুধু তাই নয় যেখানে দিল্লীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যের যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ চলছে মাওবাদীদের – তুলনায় গণতন্ত্রহীন বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন এমন কোন মাত্রায় যায় নি যা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে সুবীর ভৌমিক এবং তাঁর মুরব্বি দিল্লী সেটা চায় কিনা। বাংলাদেশের প্রতি দিল্লীর নীতি এবং সুবীর ভৌমিকদের নিরন্তর চেষ্টা তো মনে হচ্ছে সেই দিকে নিয়ে যেতেই সচেষ্ট।
পঞ্চমতঃ তাহলে কেন ভৌমিক জামাত ও তার বন্ধুদের রাজনীতিকে অজান্তে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন?
এর মূল কারণ ভৌমিক এখানে ‘মেরা ভারত মহান হায়’ এমন জাতীয়তাবাদি। লক্ষ্য করলে দেখব তিনি লেখার প্রসঙ্গে প্রবেশ করেছেন কথিত আল জাওয়াহিরির তথাকথিত ভিডিওবার্তায় ভারতকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেটা কাটান দিতে গিয়ে। কারণ তথাকথিত ভিডিওবার্তা বলছে, “present (হাসিনা) government is an Indian puppet,” যেটা তিনি উঠিয়ে এনেছেন। এই কথা ভৌমিকের গায়ে খুব লেগেছে। তিনি এটা নাকচ করতে গিয়েছেন। এটাই তার লেখার ফোকাস। তাই বলতে চাইছেন যেন; ওহে আল জাওয়াহিরি, জামাত তোমার রাজনীতি করে না। তোমার রাজনীতির কোন প্রভাব নাই বাংলাদেশে। তুমি এত নীচ বা তুচ্ছ। এভাবে কথিত আল জাওয়াহিরিকে তুচ্ছ দেখাতে গিয়ে কখন যে অজান্তে কিছু সত্যি কথা তিনি স্বীকার করে ফেলেছেন, তা খেয়াল রাখতে পারেন নাই।
ভারসাম্যহীন ও স্ববিরোধী হলেও ভৌমিক অনেক ইঙ্গিতই দিলেন। বাংলাদেশে গাড়ি বোমার মতো ঘটনা ঘটলে তাঁকে আবার স্মরণ করবার কারণ ঘটবে, তাতে কোন সন্দেহ নাই। বাংলাদেশে তিনি কি চাইছেন এতোটুকু বুঝতে পারলে আমরা আরও সাবধান ও সতর্ক হতে পারব।
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।