পুনর্মুদ্রণঃ সাম্রাজ্যবাদী পানীয় কোক-পেপসি
কোকাকোলা, পেপসিকোলা ও সাম্রাজ্যবাদ
কোকাকোলা ও পেপসিকোলা,দুটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি। বর্তমান বিশ্বে প্রায় সব দেশেই তারা তাদের পণ্যের বাজার বিস্তার করতে পেরেছে। ব্রিটিশরা এখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে প্রায় ৬০ বছর আগে, কিন্তু কোকাকোলা কেম্পানির ব্যবসা চলছে ১২০ বছর ধরে। আমাদের দেশে অবশ্য অনেক পরে এসেছে কোকাকোলা, তাও বাংলাদেশে স্বাধীন হবার আগে, ষাটের দশকেই এসেছে। সবাই খুব মুগ্ধ হয়ে এই পানীয় পান করেন। রেস্টুরেস্ট ব্যবসা, বিয়েশাদী, বড় বড় পার্টি, টুরিজম ইত্যাদি যেন এই কোমল পানীয় ছাড়া ভাবাই যায় না। ফুটবল খেলা, ক্রিকেট খেলা, গানের কনসার্ট সবখানেই এদের অস্তিত্ব রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মিছিল করে, শ্লোগানে গলা শুকিয়ে গেলেও বামপন্থীদেরও কোক ঢক ঢক করে খেতে দেখেছি। সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার কোকাকোলা, পেপসিকোলার চেয়ে আর বেশি কী হতে পারে, যা মানুষের শরীরের রক্তে রক্তে মিশে আছে?
কোকাকোলা, পেপসিকোলাসহ অন্যান্য কোমল পানীয় স্বাস্থ্যের জন্য ভাল কি মন্দ এই নিয়ে কথা হচ্ছে অনেক দিন ধরে। কোকের ধরনের মধ্যেও পার্থক্য এসেছে, এসেছে ডাইট কোক। স্বাস্থ্য সচেতনতা কোক উৎপাদন বন্ধ করেনি, কোকেরই নতুন পণ্যের সৃষ্টি করেছে। কোক পেপসির মধ্যে পানি ছাড়া যেসব উপাদান আছে তার ওপর পরিবেশ সংগঠন সমূহের বেশ কিছু গবেষণা আন্তর্জাতিকভাবেও হয়েছে। তবে সম্প্রতি (আগস্ট ২০০৬) ভারতে যে ঘটনা ঘটেছে তা উপেক্ষা করার মতো নয়। সেটা হচ্ছে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কোকাকোলা এবং তারই প্রতিদ্বন্দী কোম্পানি পেপসিকোলাকে তাদের গোপন ফর্মুলা জানাতে নির্দেশ দিয়েছে। এটা এই কোম্পানির ১২০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ঘটনা। সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ করে জানতে চেয়েছে তাদের পণ্যের মধ্যে কী কী ধরনের রাসায়নিক পদার্থ দেয়া আছে? কারণ সেন্টার ফর সাইন্স এন্ড এনভাইরনমেন্টের তথ্য থেকে জানা গেছে যে কোকাকোলা ও পেপসিকোলা পানীয়তে স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক রয়েছে।
কোকাকোলা কোম্পানির প্রতি তাদের গোপন ফর্মুলা খুলে বলার নির্দেশ কোম্পানি মানবে কি না বলা মুশকিল। আসলে এই ফর্মুলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আটলান্টার একটি ব্যাংকের ভোল্টে রাখা আছে যার বিস্তারিত খবর মাত্র দুজন কর্মকর্তা জানেন, এবং সে কারণে তাদের দুজনের একই প্লেনে করে কোথাও যাওয়াও নিষেধ করা আছে।
সেন্টার ফর সাইন্স এন্ড এনভাইরনমেন্টের ( সিএসই) ১১টি কোকাকোলা ও পেপসিকোলা ব্রান্ড নিয়ে ২০০৩ সালেও গবেষণা করেছিল। তখন তারা দেখে এর মধ্যে কীটনাশকের পরিমাণ অনেক বেশি। এই তথ্য প্রকাশ হবার পর কিছুটা হৈ চৈ হলেও আবার থেমে গিয়েছে। কিন্তু ১২ টি রাজ্যে পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে কোক ও পেপসিকোলায় ৩ থেকে ৫ ধরনের কীটনাশক রয়েছে এবং ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্টান্ডার্ড (বি আই এস) এর নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় পেপসিকোলায় ৩০ গুণ বেশি মাত্রায় কীটনাশক রয়েছে এবং কোকের মধ্যে ২৫ গুণ বেশি মাত্রা পাওয়া গেছে। আগস্ট ৪ তারিখে এই তথ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হলে ভারতের সংসদে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এবার জাতীয় সংসদের সাংসদরা দাবি জানান যে কোকাকোলা ও পেপসিকোলা বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। বলা বাহুল্য এই মার্কিন ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি দুটি এই তথ্য মেনে নেয় নি, তারা দাবি করতে লাগলো যে তারা নাকি আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই চলে। কিন্তু ভারতে পানীয়জলের ওপর এমন কোন নিয়ন্ত্রণ আইন নাই যে তারা কোন নিয়ম মেনে চলছে তা বোঝা যাবে। সিএসই- এর গবেষণার ফলাফলের প্রক্ষিতে দাবি জানানো হয়েছে যে সরকার কোমল পানির নিরাপদ মাত্রায় উপাদান ব্যবহারের নিয়মনীতি প্রণয়ন করুক। সিএসই- এর ২০০৩ সালের গবেষণার ফলাফল জেনে জনসচেতনতার সৃষ্টির কারণে স্কুলগুলোতে কোকাকোলা- পেপসিকোলা বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
সিএসই- এর তথ্যের ভিত্তিতে দিল্লীর অপর একটি সংগঠন, সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন, এই মর্মে মামলা করে যে কোকাকোলা ও পেপসিকোলা কোম্পানিদ্বয় জনসমক্ষে জানাক তাদের পানীয়তে ক্ষতিকর পদার্থ কতটুকু আছে। অতএব সুপ্রিম কোর্ট ওপরের নির্দেশ দেয়।
সুপ্রিম কোর্টর আদেশের পর এই দুই কোম্পানি পরীক্ষা করে কি বলবে তার অপেক্ষা করছেন না ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। মুম্বাইয়ের স্কুলগুলোতে কোমল পানীয় ব্যবহার নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। মধ্য প্রদেশ সরকার, গুজরাট, কেরালা ও পাঞ্জাবে সরকারী অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোকাকোলা ও পেপসি ব্যবহার নিষেধ করে দিয়েছে।
DRINK COCACOLA SUPPORT ISRAEL. BY SUPPORTING AMERICAN PRODUCTS YOU ARE SUPPORTING ISRAEL
যে কোন সচেতন মানুষের কোকাকোলা খাওয়া বাদ দেবার অনেক কারণ আছে। যেমন ডায়াবিটিস হোক কে চায়? যে দেশে কোকাকোলার ফ্যক্টরি আছে সেই দেশের ভুগর্ভের পানির স্তর নামছে নীচে। কোকাকোলা কম্পানি সরকারী দুর্নীতির সহযোগী। শ্রমিক হত্যার আভিযোগ আছে কম্পানির বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বড়ো আভিযোগ হচ্ছে প্যলেস্টাইনের জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলকে কোক-পেপসির সমর্থন। ইসরাইল ১৯৬৭ সালে পুর্ব জেরুজালেম দখল করে নেবার পর মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় পূণ্য স্থানগুলো ইহুদিদের ধর্মস্থানে পরিণত করবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে কোকাকোলা কম্পানি সমর্থন দিয়েছে ও দেয় বলে কম্পানির বিরুদ্ধে অনেক প্রচারণা হয়েছে। এই ছবি-কার্টুনটিতে কিভাবে প্যালেস্টাইনের জনগণের পুণ্যস্থান মসজিদের গম্বুজ বদলে দিচ্ছে তা দেখান হয়েছে।এটা অবশ্য কার্টুন।
কোকাকোলা ও পেপসিকোলা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। গ্রামে গঞ্জে গেলেও কোক পেপসি পাওয়া যায়। জাতিসংঘের দেশ সংখ্যার চেয়েও বেশি দেশে কোকাকোলা পেপসিকোলা বিক্রি হয়। গ্লোবাল ফুড মার্কেট এর হিসাব অনুযায়ী পেপসিকোলা বার্ষিক আয় (২০০৪) ২৯,২৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর কোকাকোলার আয় ২১,৯৬২ মার্কিন ডলার। এতো বড় ব্যবসা সহজে কেউ হাত ছাড়া হোক চাইবে না, তা বুঝাই যাচ্ছে। কোক-পেপসির বিজ্ঞাপন দামী দামী নায়কদের দিয়েই করা হয়, যেমন ভারতের আমীর খান। আকর্ষণীয় অবশ্যই। নেপালের পাহাড়ে লাফ দিয়ে কোক খায়, বহু উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোক-পেপসি খায়। কী শক্তি, কী না আনন্দ!! যেখানে সেখানে কোকাকোলার সাইনবোর্ড দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে সবচেয়ে দুঃখজনক লাগে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টের সাইন বোর্ডেও কোকাকোলা লেখা রয়েছে। হায় রে স্বাধীনতা!! শহরের মানুষ গ্রামে গেলে ডাব না দিয়ে কোক-পেপসি দেয় এই মনে করে যে এটা তাদের সম্মান করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়ার পর গ্রামে কোক- পেপসি বিক্রি বেড়ে যায়, এই দৃশ্য আমরা অহরহ দেখছি। আমাদের দেশে কোক- পেপসির মধ্যে কীটনাশক কি নাই। নিশ্চয় আছে? সে ব্যাপারে খোঁজ নিতে ভোক্তা সংগঠনগুলোর সক্রিয় হওয়া উচিত। সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম কোক-ফান আইল্যান্ড'০৬ বিজয়ীরা থাইল্যান্ডের পাটায়া ঘুরে এসেছে। এটা আবার ছবি সহকারে পত্রিকায় এসেছে। অর্থাৎ কোক তরুণ সমাজের মধ্যে আরো বেশি প্রচার করা হচ্ছে।
সাধারণত কোকাকোলার মতো পানীয় বড়দের চেয়ে বেশি শিশু এবং তরুণরাই পান করে। অনেক মা-বাবা আদর করে পানি না খাইয়ে কোক খাওয়ান। ফ্রিজে ফ্যামিলি সাইজ কোক পেপসির বোতল থাকে, খাও যতো ইচ্ছা কিছুদিন আগে শুনেছি একটি ছেলে মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা গেছে কিডনী নষ্ট হয়ে। এই ছেলে ছয় বছর বয়স থেকে কোকাকোলা ছাড়া পানি খেতো না। ভাত খেয়েও কোকাকোলাই খেত। জানি, প্রশ্ন উঠবে শুধু কোকাকোলা তার মৃত্যুর জন্যে দায়ি হতে পারে কি না। তবে পানি না খেয়ে শুধু কোকাকোলা খাওয়া শরীরে যথেষ্ট ক্ষতি করেছে এই কথা চিকিৎসকরা তাকে বলেই দিয়েছেন।
ভারতে কোকাকোলা নিষেধ করা হচ্ছে, এই নিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে তর্ক- বিতর্ক খুব জমেছে। যেমন এনটিভিতে পর পর দুদিন সিএসই-এর সুনীতা নারায়নসহ পানীয় শিল্পের প্রতিনিধিদের নিয়ে তুমুল বিতর্ক হোল। মনোযোগ দিয়ে দেখলাম, কে কি বলে! জানা গেলো যে কোম্পানি স্বীকার করছে কোকাকোলায় কীটনাশক অবশ্যই আছে, এবং তার পরিমাণ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় আছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মনীতি ও ভারতের নিয়মনীতি এক নয়। এতএব কীটনাশকেরমাত্রাও হয়তো এক নয়। ভারতে এখনো কোমল পানীয়ের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নীতি নেই। তর্ক- বিতর্কের এক পর্যায়ে উপস্থাপক জানতে চাইলেন এরপর কত জন কোক- পেপসি কেনার আগে ভাববেন,৭০% বললো তারা কিনতে গিয়ে ভেবে কিনবেন। অর্থাৎ এই তথ্যের পর কোক- পেপসি নাও কিনতে পারেন। সুস্থ্য থাকতে কে না চায়! অন্যরা বিভ্রান্ত এই বলে যে এখন দুধ, শাক- সব্জি, ফল-মূল সবকিছুতেই কীটনাশক রয়েছে। এমনকি বোতলজাত পানিতেও কীটনাশক রয়েছে। এতএব,শুধু কোক পেপসি কেন সবই তো খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত। বাহ¡ আর যায় কোথায়!! কথা কোক-পেপসি থেকে সরে তর্ক অন্য দিকে চলে গেলো। এই ধরণের বিতর্ক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে না। কারণ অন্য সব কিছুকে কীটনাশক থাকলে সেগুলোও কীটনাশক মুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে, এই কথা জোরের সাথে বলা উচিত তা না বলে বলা হয় তাহলে কোক-পেপসি কি দোষ করলো? অর্থাৎ তোমরা এমনিতেই বিষ খাচ্ছো আরো বিষ খাও!!
শুধু কীটনাশক নয়, কোলা ধরনের পানীয়তে কোকো,ক্যাফিন এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড থাকে, যা শরীরে ক্ষতি করে। শরীরে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেশি হলে এবং অক্সিজেনের তারতম্য হলে মারাত্বক ক্ষতি হতে পারে। কোন কোমল পানীয়তেই পুষ্টিকর কিছূ থাকে না, এর মধ্যে অধিকাংশ (৮০%) পানি, চিনি, এবং স্বাদ বৃদ্ধিকর পদার্থ ইত্যাদি থাকে। ঢেকুর ওঠে বলে বাচ্চারা খেতে আনন্দ পায়। কিন্তু এটাই ক্ষতিকর। কোকাকোলার মধ্যে এসিডিটির পরিমাণ যা আছে তা দাঁত ও হাড়ের জন্যে ক্ষতিকর। এগুলো বহু পুরানো তথ্য। বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য জার্নাল ল্যানসেটের তথ্য অনুযায়ী কোকাকোলা অবিসিটি (মুটিয়ে যাওয়া) এবং ডাইবেটিস বৃদ্ধি করতে পারে। ব্রাজিলের একটি গবেষণায় দেখা গেছে কোকাকোলা ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও ভিটামিন ঘাটতি ঘটাচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোকাকোলার মধ্যে জেনেটিক্যালী মডিফাইড উপাদান রয়েছে বলে এথিক্যাল কনজুমার (২০০০) দাবি করেছে।
পরিবেশের দিক থেকেও কোকাকোলা- পেপসিকোলার ক্ষতির দিক ধরা পড়েছে। যেসব এলাকায় কোকাকোলার কারখানা আছে সেখানে পানির অতি ব্যবহারের ফলে পানি শুকিয়ে আসছে, ফলে মানুষ সাধারণ খাবার পানি পাচ্ছে না। ভারতের কেরালায় কোকাকোলা কারখানার ৩ কি.মি. এলাকার মধ্যে পানি শুকিয়ে গেছে। এর ফলে ২০,০০০ মানুষ সেখান থেকে পানির অভাবে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। দেখা গেছে কোকাকোলা কোম্পানি বোতলজাত করার কাজে যা কর্মসংস্থান করে তার ৫০ গুণ বেশি মানুষ কর্মচ্যুত হয়, বা স্থানচ্যুত হয়। কাজেই কোকাকোলা কোম্পানি কোন অবস্থাতেই কাজের সংস্থান করছে না বরং মানুষ নিজ এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্যের অভিযানে জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল, তাতে বোঝা যায়, স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা যথেষ্ট আছে। কোমল পানীয় কতখানি নিরাপদ এটা বাংলাদেশেও দেখা উচিত কারণ এতে আমাদের শিশু এবং তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যত জড়িয়ে আছে।
কিন্তু কোকাকোলা ও পেপসিকোলা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য ও পরিবেশের বিষয় নয়। এর সাথে খুবই ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে আছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি। বুশ প্রশাসনকে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি অর্থ দিয়ে সাহায্য করে তার মধ্যে পেপসিকোলা চতুর্থ নাম্বারে এবং কোকাকোলা পঞ্চম ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোকে টিকিয়ে রাখতে আর্থিক সহায়তা প্রদানের অভিযোগ রয়েছে এই দুই কোম্পানির বিরুদ্ধে, তার মধ্যে নাইজেরিয়ায় ডিকটেটর জেনারেল আবাচা অন্যতম। কলাম্বিয়া কোকাকোলা ফ্যাক্টরীতে ৮ জন শ্রমিক ইউনিয়ন নেতার হত্যা ও অন্যান্য শ্রমিকের নির্যাতনের ঘটনা বিবিসিতে ২০০৩ সালের ৪ঠা এপ্রিল প্রচারিত হয়েছে।
কোকাকোলা কোম্পানি সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে তাদের বেআইনী কাজে সহায়তা গ্রহণ করে এবং মিডিয়াকে টাকা দিয়ে কিংবা অন্যান্য প্রভাব খাটিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লেখা বন্ধ করবার অভিযোগও আছে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রডকাস্টিং করপোরেশন ভারতের ববি রামাকান্ত যখন বানারসিতে কোকাকোলা কোম্পানির সামনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নিয়ে প্রতিবেদন করছিলেন তখন তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছিল যেন তিনি কোম্পনির নামটি উচ্চারণ না করেন। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা কোক এবং পেপসির মধ্যে অতিরিক্ত চিনি দেয়ার কারণে স্বাস্থ্যের ক্ষতির যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে তার জন্যে তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। যখন যা কাজে লাগে তাই এই সাম্রজ্যবাদী কোম্পানিগুলো ব্যবহার করে।
ইরাক যুদ্ধের কারণে আমরা Weapons of Mass Destruction (WMD)এর কথা শুনেছি। যদিও ইরাক তার কোনই অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি তবুও সেখানে ২০০৩ সাল থেকে যুদ্ধ চলছে, দিনের পর দিন বোমা মেরে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হয়েছে, সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। গণতন্ত্র সেখানে যায় নি এখনও, কিন্তু ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসেই কোকাকোলা কোম্পানির কর্মকর্তারা বাগদাদে কোমল পানীয় বিক্রেতাদের সভা করেছেন, সেখানে কোকাকোলা চলে গেছে। কারণ তাদের উপস্থিতি এখন সেখানে খুবই জোরদার করা দরকার। কোকাকোলা কোম্পানির কোকেইন ভিত্তিক পানীয় বিশ্বে Weapons of Mass Addiction (WMA) নামে পরিচিত, যা ১৯২৯ সালেই শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। আসলে কোকাকোলার ব্যাপক বাজার চলছে কারণ এই পানীয় আসক্তি সৃষ্টি করতে সক্ষম বলেই। তাহলে অন্যান্য মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে এতো আইন থাকলে কোকাকোলা, পেপসিকোলার বিরুদ্ধে মাদকাশক্তির অভিযোগ আনা হয় না কেন?
তরুণদের মধ্যে কোক- পেপসির বাজার পাকাপোক্ত করার জন্যে তারা Pizza Hut, Taco Bell, Kentucky Fried Chicken-এর সাথে জোট বাঁধে। অন্যদিকে তারা খুব দ্রুত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও ঢুকে পড়ে। যেমন রাশিয়াতে ১৯৭২ সালে, উত্তর কোরিয়াতে ২০০০ সালে। চীনে পুঁজিবাদের গন্ধ আসার আগেই কোকাকোলা গিয়ে সেখানে তরুণদের মাথা খারাপ করে দেয়। ফিলিপাইনে গরিব মানুষ খেতে পারুক না পারুক কোকাকোলা কোম্পানি তাদের এজেন্টদের টার্গেট বেঁধে দেয় কোকাকোলা বিক্রির জন্যে। ওরা অবশ্য জনসংখ্যার বেশি হলে খুশিই হয়, কারণ যতো বেশি কম বয়সী মানুষ থাকবে ততই কোক- পেপসি বিক্রি হবে।
[ এই লেখাটি পাক্ষিক চিন্তা পত্রিকার 'সাম্রাজ্যবাদঃ যুদ্ধ ও বাণিজ্য' সংখ্যায় (বছর ১৪, সংখ্যা ২; কার্তিক ১৪১৩/নভেম্বর) প্রকাশিত হয়েছিল। ]