বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না


আমরা নিত্যদিন পৃথিবীকে সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসতে দেখি; সূর্য পূব আকাশে ওঠে, আর বিকালে পশ্চিমে ডুবে যায়। হ্যাঁ, ‘ডুবে’ যায়। বিকালে সুর্যের কি ঘটে তার অভিজ্ঞতাটা কোন কিছু পানিতে ডুবে যাবার মত। লাল হয়ে আছে সন্ধ্যার আকাশ, আর দিগন্ত রেখার নীচে ডুবে যাচ্ছে সূর্য ! ডুবে যাওয়া কথাটা সূর্য সম্পর্কে খাটে কিনা তর্ক হতে পারে। কিন্তু অভিজ্ঞতার জগতে ‘ডোবা’ বা ‘ডুবে যাওয়া’ নামক একটা ব্যাপার আছে যাকে বিকালে পশ্চিমাকাশে সূর্যের নিষ্ক্রান্ত হবার ঘটনাকে উপলব্ধি ও ব্যক্ত করতে ব্যবহার হয়; আমরা ব্যবহার করি।

বিজ্ঞান বলে, এটা ঠিক না। সূর্য 'ডোবে' না। আমরা পশ্চিমের কোন দেশে গেলে দেখব সূর্য ডোবে নি। আরও দূরে গেলে দেখব সূর্য সবে পূবাকাশ থেকে উদিত হচ্ছে। উড়োজাহাজে যারা নানান দেশে ভ্রমণ করেন তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা হয় যে অনেক সময় প্লেনের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য চলছে, ঘড়িতে জানান দিচ্ছে বাংলাদেশে রাত, কিন্তু উড়াল জাহাজের জানালা খুললে রোদ। এই এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা!

কিন্তু একটা সময় ছিল মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে এতো সহজে যেতে পারত না। এমন মানুষ বাংলাদেশে এখনও সম্ভবত পাওয়া যাবে যারা নিজের গ্রাম থেকে বাইরের কোন এলাকায় যায় নি। সূর্য না, বরং পৃথিবীটাই সূর্যের চারদিকে ঘোরে -- বিজ্ঞানের এই সত্য আধুনিক মানুষের দাপট, আধিপত্য ও সাফল্যের কারনে সিধা সরল সাধারণ মানুষ মেনে নেয়। সূর্যসহ গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে শরীর ও জীবনের সম্পর্কজাত অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে মানুষের জীবনে গৌণ হয়ে পড়ে। খাদ্যাভ্যাস, চাষাবাদের পদ্ধতি, প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিসহ সবকিছুতেই পরিবর্তন আসে। একটা সময় ছিল প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে নিজেকে বিলীন রাখার মধ্যে মানুষের পরমার্থ খোঁজা হত, সেই ভারকেন্দ্র চ্যূত হয়ে মানুষের সংকল্প হয়ে উঠেছে প্রকৃতিকে জয় করা, প্রকৃতির ওপর মানুষের দখলদারি কায়েম করা। ফলে  প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণ বৈচিত্রের ভহয়াবগ বিনাশ ঘটেছে। বিনাশ সত্ত্বেও প্রকৃতির ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম তথাকথিত আধুনিকতা'র পরমার্থ হয়ে উঠল। অর্থাৎ আধুনিক হওয়া মানে প্রকৃতিকে 'জয়' করা, মানুষ্যের ভোগ্য বিষয়ে পর্যবসিত করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় সূর্য নিত্যদিন পূবে ওঠা আর পশ্চিমে গমন করা বন্ধ করে না। অন্তত আজ দুই হাজার পনেরো সালে মার্চ মাসের ছয় তারিখেও সূর্য পূবেই উ্ঠেছে, এবং পশ্চিমের দিকে চলেছে তার রথ। জীবনের সত্য আর বিজ্ঞানের সত্যের মধ্যে একটা বিশাল ফারাক রয়েছে, যা কখনই পূরণ হয় নি। হাবারও নয়। কিন্তু বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্করা দাবি করে এই ফারাক মানা যাবে না, আমাদের দৈনন্দিনের উপলব্ধি বাদ দিতে হবে। যে উপলব্ধি আমার নিত্যদিনের জগত ও বেঁচে থাকা তার সত্য আমামদের অস্বিকার করতে হবে। আমাদের শুধু বিজ্ঞানমনস্কই হতে হবে।

মানুষ তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেখে বিজ্ঞানের বই যাই বলুক সূর্যমামা পূব থেকে পশ্চিমে যাওয়া ত্যাগ তো করল না। সে সন্দিহান হয়ে পড়ে। তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিজ্ঞানের দাবি মেলে না। এই অসঙ্গতি অনেকের সারা জীবন থেকে যায়। সূর্য ডোবে, রাত আসে। যেসকল শিক্ষিত মানুষ বিজ্ঞানের কথা বলে তারাও প্রাচীন অভিজ্ঞতাকে ত্যাগ করার কথা বলে না। সূর্য ডুবুক না ডুবুক যে প্রাচীন সূর্য নিত্যদিন পশ্চিমাকাশে ডোবে তার জন্য লেখা শিক্ষিত ও সভ্য মানুষ মধুর রবীন্দ্র সঙ্গীতও গায়: পাখি এলো ফিরে, তরী এলো তীরে...। ইত্যাদি। সেই নদী নাই, সেই তরী নাই, সেইসকল পাখিও প্রায় বিলুপ্ত – কিন্তু বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতার বাইরে আমাদের নিত্যদিনের যে অভিজ্ঞতার সত্য তার শক্তি এতো প্রবল যে এই ধরণের গান কাষ্ঠবৎ বিজ্ঞানিকেও আপ্লূত করে। কারণ মানুষ বিচিত্র! যে কারণে শ্রীরামকৃষ্ণ যখন হুঁশে থাকতেন তখন বলতেন, মানুষ কি কম গা! কিন্তু রামকৃষ্ণ? ধ্যুৎ। আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে।

বিজ্ঞানীও সূর্য ডোবে না, জানেন, কিন্তু রাতে জেগে থাকেন না, বিছানায় ঠিকই ঘুমাতে যান, অবশ্য ইনসমনিয়া থাকলে ভিন্ন কথা। বিজ্ঞানির দিনের পরিকল্পনা সকালের সূর্য মেপে, ঘড়ি ধরেই চলে। রাতদিনের অভিজ্ঞতার যে দৈনন্দিন সত্য তার রেজিস্টার আলাদা, বিজ্ঞানের হিসাব ভিন্ন। বিজ্ঞানের দাবির কারণে মানুষের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানীর জীবন থেকে উবে যায় না। সেটা পুরামাত্রায় হাজির থাকে। মানুষ– রক্তমাংসের তৈয়ারি, আর ভাগ্য ভালো যে মানুষের সারপদার্থ শুধু বুদ্ধি বা বিজ্ঞানভাবনা নয়। মানুষের মধ্যে বুদ্ধির কুঠুরি যেমন আছে, তেমনি আছে আরও সাত কুঠুরি ও নয় দরোজা; বুদ্ধি নিয়ে আট কোঠা। আক্ষরিক ভাবে কথাগুলো বোঝার দরকার নাই, এর চিন্তাশীল ইঙ্গিতটুকু অসামান্য। অর্থাৎ মানুষ একটা মাত্র কুঠুরি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে না, বাঁচেও না। মানুষের রয়েছে বুদ্ধির অতীত বিষয় নিয়ে ভাববার, কল্পনা করবার, বাস্তব/অবাস্তব নানান আকাংখা জপবার এবং অন্যদের মধ্যে তা সঞ্চারিত করাবার অসাধারণ ক্ষমতা। যারা নদিয়ার ভাবের সঙ্গে পরিচিত তারা ফকির লালন শাহের ‘আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা/ মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা/ তার ওপরে সদর কোঠা আয়না মহল তায়/ কমনে আসে যায়...! -- এই গানটি এখন মানুষ ভজনা করার কর্তব্য পালনের আনন্দে গাইতে পারেন। মানুষ ভজনা মানে মানুষকে নতুন করে আবিষ্কার ও উপলব্ধির সম্ভাবনা।  মানুষ বিচিত্র ও বিপুল। যুক্তি, বুদ্ধি, বিজ্ঞান চেতনা মানুষের প্রতিভার একটি দিক মাত্র, কিন্তু মানুষের কল্পনা, কল্পজগত, আনন্দ, বেদনাসহ  নিত্যদিনের উপলব্ধির  সত্য বিবিধ ও বিচিত্র। একে অস্বীকার করে বিজ্ঞানই চরম সত্য এই দাবিদারগণ 'বিজ্ঞানবাদি' নামে পরিচিত। বিজ্ঞানবাদিরা সূর্য ডোবে আর সূর্য ডোবে না -- এই দুইয়ের ফারাক করতে অক্ষম।

আধুনিক মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হচ্ছে সে তার মিথ বা পুরাণকে হত্যা করেছে। এবং নিত্যদিন নিজেকেই নিজে সে শহিদ করে চলেছে, নিজেই সে জানে না। রক্তে তার শরীর ভিজে যায়। কিশোর কালে নোয়াখালির মতো একটি মফস্বল শহরে পুরাণের দেবতা সূর্যের যে কাহিনী শুনেছি আজও কল্পনায় তা ভেসে উঠলে এক বিশাল জগত সামনে এসে দাঁড়ায়। ভালো লাগত ভাবতে যে সূর্যের চুল আর হাত তরল সোনা দিয়ে তৈয়ারি। তাই তাঁর আলো থেকে সোনা ঠিকরে পড়ে। সূর্য দেবতা, কিন্তু তিনিই একমাত্র দেবতা যিনি প্রত্যহ মানুষের চোখের সামনে দেখা দিয়ে থাকেন এবং তিনি দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে জগৎ উদ্ভাসিত হয়। তিনি রবিবারের অধিকর্তা, শিবের স্বরূপ ও বিষ্ণুভক্তদের নারায়ন। তিনি ইন্দ্রের কিম্বা মতান্তরে কশ্যপ ও অদিতির পুত্র। তাঁর সঙ্গিনী বা বউ চার জন: সরন্যু, রাজ্ঞী, ছায়া এবং প্রভা। তিনি তার সাত ঘোড়ার রথে করে প্রতিদিন আকাশ দিয়ে ছুটে বেড়ান এবং সন্ধ্যাবেলায় স্বর্গে ফিরে আসেন। এই হোল পৃথিবীতে দিন রাত্রির কারন।

কিছু কি আসে যায় এটা বিজ্ঞানের সত্য কিনা? ঠিক আছে, বিজ্ঞান থেকে জানলাম সূর্য হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১০৯ গুন বড়। হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম ভর্তি এক গ্যাসের বিশাল ফুটবল যার তাপমাত্রা প্রায় ৫০০০ ডিগ্রি সে.।এই নক্ষত্রটিকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী ২৯.৭৮৩/সে. গতিতে ঘুরছে। জানলাম, এবং মানলামও। অসুবিধা তো নাই। কিন্তু পুরান, কল্পনা ও সংকল্পের ভূমিকা আর কোন কিছুকে জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবে জানার ভূমিকা তো এক নয়।

বিজ্ঞান যদি তার নিজের জগতে বিরাজ করে তাহলে এখানে কোন দ্বন্দ্ব তৈরির কারণ ঘটে না। কিন্তু বিজ্ঞান যদি বলে পুরান বা মানুষের মিথ বা কল্পনার জগত স্রেফ কুসংস্কার, সূর্যের আবার ঘোড়া কি? তার আবার চার সঙ্গিনী কোথা থেকে? তার আবার রথ কিসের? ছাড়ো এই সকল অবৈজ্ঞানিক চিন্তা। মানুষের প্রগতি মানে মিথ, কল্পনা ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি। যদি বিজ্ঞান দাবি করে আমাদের কল্পনা ও চিন্তাশক্তি বাদ দিয়ে শুধু বিজ্ঞানকেই বিশ্বাস করতে হবে, আর কিছুকে না। তারপর বিজ্ঞান দিন আর রাত্রি কেন হয় তার বৈজ্ঞানিক কারন ব্যাখ্যা করল। এমন ভাবে ব্যাখ্যা করল যেন আমাদের মাথা ধোলাই হয়ে পারফেক্ট বৈজ্ঞানিক মস্তিষ্কে পরিণত হয়; আমরা চিরকালের জন্য সূর্যের সোনার রথ দেখা ভুলে গেলাম। ভয়ে এইসব গল্প কাউকে বলবারই আর সাহস পেলাম না। তখন সেটা হয় এক অবিশ্বাস্য কিন্তু নিগূঢ় হত্যাযজ্ঞ। খুন। নীরব কিন্তু ভয়ংকর। কতো সহজে আমাদের কৈশোর বিজ্ঞানের হাতে নিহত হয়েছে। কতো কিশোর কিশোরী বিজ্ঞানের নামে শহিদ হচ্ছে প্রতিদিন কে তার খবর রাখে? তারপর সমাজে যখন এই হতাহতের ঘটনা ভিন্ন এক ব্যাধি হিসাবে ধরা পড়ে ততোদিনে দেরি হয়ে যায়। আমাদের তখন ধনি গরিবের বৈষম্যের ওপর গড়ে ওঠা সমাজ সামাল দিতে হয়, কারন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ণয়ের বিধি  -- হোক তা প্রেম, নীতিনৈতিকতা বা রাজনীতি --  বিজ্ঞান বাতলে দিতে পারে না। আমাদের  সামাল দিতে হয় যুদ্ধ, বিগ্রহ, নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ার, নাগাসাকি ও হিরোশিমা। শুধু পলিটিকাল ইকনমি ব্যাখ্যা করতে পারে না কেন বিজ্ঞানের বিপুল সম্ভাবনা মারণাস্ত্র তৈয়ারি ও সৃষ্টির ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে নিজের মহিমা খুঁজে পায়। পুরো সৃষ্টিকে ধ্বংস করবার ক্ষমতা অর্জন করে মানুষ, কিন্তু সে আর নিজের সৃষ্টির রহস্য বুঝতে পারে না, সৃষ্টির অর্থও ভুলে যায়। মানুষ আর মানুষ থাকে না। দানবে পরিণত হয়।

বিজ্ঞানের এই সন্ত্রাস ভয়ানক। বিজ্ঞানের সম্ভাবনা বা অর্জন এখানে তর্কের বিষয় নয়। অবশ্যই বিজ্ঞান মানবেতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এই সন্ত্রাস বিজ্ঞানের সম্ভাবনা বা অর্জনের কারনে ঘটে না। জ্ঞানচর্চা মানুষের বিভিন্ন প্রতিভার একটি দিক। বরং সন্ত্রাস ঘটে বিজ্ঞানবাদিতার কারনে। বিজ্ঞানবাদিতা একটি মতাদর্শ। এই মতাদর্শ দাবি করে আমাদের অন্য কোন বৃত্তির দরকার নাই। সত্য নির্ণয়ের একটাই মানদণ্ড সেটা হচ্ছে যুক্তি বা বিজ্ঞান। শুধু বিজ্ঞান অতএব আমাদের চিন্তা ও চেতনা অধিকার করে রাখুক। আমাদের সমাজ, নীতিনৈতিকতা, রাষ্ট্রনীতি সব শুধু বিজ্ঞান দ্বারা ঠিক হোক।

বিজ্ঞানবাদিতার নানান রূপ আছে। রূপ ভেদে তার ক্ষতির মাত্রাও ভিন্ন। তার কারণেই এই বিপদ ঘটে। বিজ্ঞানের প্রধান চরিত্র হচ্ছে প্রত্যক্ষ অন্বেষণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যকে জানা। তার ডমেইন বা সীমানা চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট। কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা হচ্ছে এমন এক ব্যাধি যা মানুষের সকল বৃত্তিকে নির্বিচারে বিজ্ঞানের অধিকারে ও দখলে নিয়ে আসতে চায়। যেমন আল্লাহ্‌ বা ঈশ্বর আছেন কি নাই সেটাও বিজ্ঞানবাদীরা তাদের ল্যাবরটরিতে পরীক্ষা করে প্রমাণ করতে চায়। যখন পায় না। তখন নাই বলে ফতোয়া দেয়। যা বিজ্ঞানের অধীনস্থ করা সম্ভব না, তাকে অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, পশ্চাতপদতা, ইত্যাদি বলে বাতিল করে দেয়। মানুষের অপরাপর বৃত্তি – যাকে গণিত, ফর্মাল সিস্টেম কিম্বা কোন ল্যাবরেটরির পরীক্ষানিরীক্ষার অধীনস্থ করা যায় না, সম্ভবও নয়, তাকে জ্ঞানে কিম্বা অজ্ঞানে বিজ্ঞানবাদিতা নষ্ট করে। আমাদের কল্পনাশক্তি ক্ষয়ে যায়, যান্ত্রিক বা বিধিবদ্ধ চিন্তার বাইরে সৃষ্টিশীল চিন্তার চর্চা রুগ্ন হয়ে পড়ে। আমরা কল্পনা করতে ভুলে যাই। আমরা অপরের প্রতি আগ্রহান্বিত হবার মাধুর্য্য যাপন করতে শিখি না। আমরা যান্ত্রিক বিধিবিধানের বাইরে আর ভবিষ্যৎ দেখি না। সব কিছুই গণিত ও যন্ত্রের নিয়মে চলে। জগৎ গণিত আর ল্যাবরেটরিতে ভরে যায়।

মানুষ নিজের এই রক্তপাত দীর্ঘকাল ধরেই দেখছে, কিন্তু ফিরে আসছে আবার নিজের পূর্ণতার আস্বাদনের তাগিদে। না, বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে নয়, কিন্তু বিজ্ঞানসর্বস্ব আর অতিশয় বুদ্ধিমান হবার ভুল শুধরে। এই কারণে সেই বুদ্ধিকেই একালে ‘মুক্তবুদ্ধি’ বলা হয় যে বুদ্ধি নিজের সীমা বুদ্ধিসর্বস্বতার বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে। বিজ্ঞানবাদিতা পরিহার করা এবং যুক্তি ও বিজ্ঞানের সীমা সম্পর্কে হুঁশে থাকাটাই মুক্তবুদ্ধির চর্চা। সীমা অতিক্রমকারিরা সংঘর্ষ ও অশান্তির জন্ম দেয়। এরা খামাখা ঝগড়া ফ্যাসাদ বাঁধায়। এবং বিজ্ঞানচিন্তাকে বিতর্কিত করে তোলে।

মানুষকে একটা খোপের মধ্যে পুরে ফেলা অজ্ঞতা তো বটেই বরং চরম একটি কুসংস্কার ও অতিশয় বদ্ধ চিন্তার ফল যা এই আধুনিক কালে রীতিমতো অসুখ হিসাবে দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রজাতি হিসাবে মানুষের ধ্বংসের কারণও হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি ও মানুষের সমূহ অর্জনের জন্য এই ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে মানুষ গত শতক থেকেই সচেতন হতে শুরু করেছে। একালে পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষার আন্দোলন প্রধানত এই উপলব্ধি থেকেই গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা একালে বিজ্ঞান, দর্শন ও রাজনীতি মানুষের এই তিন শাখার জন্যই অতি আবশ্যিক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান এখন আরও নিবিড় ভাবে পর্যালোচনার অধীন, কারণ একালের বিজ্ঞান নির্দোষ চর্চা নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কর্পোরেট স্বার্থ, বহুজাতিক কম্পানির মুনাফা, যুদ্ধ কৌশল এবং প্রযুক্তি। বিজ্ঞানের সঙ্গে বহুজাতিক কর্পোরেশান ও দুনিয়ার মারণাস্ত্র ইন্ড্রাস্টিগুলো একাকার হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানমনস্ক হওয়াটা এককালে গৌরবের ছিল, এখন সেটা গালিতে পরিণত হচ্ছে। তার মানে এই নয় আমরা যুক্তির ব্যবহার ছেড়ে দেব, বিজ্ঞানচর্চা বন্ধ করে দেব। না, মোটেও তা নয়। কিন্তু প্রতিটি বৃত্তির সম্ভাবনা নিয়ে আমরা যেমন উদ্দীপ্ত থাকব, একই সঙ্গে তাদের সীমা সম্পর্কেও হুঁশিয়ার থাকতে হবে।

এটাও একালে দর্শনের কাছে অনেক পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে যে মানুষের চিন্তাশীলতার অর্থ যুক্তিবাদিতা নয়। যুক্তি দিয়ে বড়জোর ফর্মাল সিস্টেম গড়া যায়। সেই সিস্টেম আমরা শুরুতে যে সকল এক্সিয়ম সরবরাহ করি সেই সরবরাহ অনুযায়ী পদ্ধতির ফল হিসাবে সিদ্ধান্ত তৈয়ার করতে পারে। কিন্তু সিস্টেম নিজে সেই এক্সিয়ম ঠিক নাকি বেঠিক সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কুর্ট গোডেলের (১৯০৬ – ১৯৭৮) ইনকমপ্লিটনেস থিওরম গত শতকের ত্রিশ দশকে আবিষ্কৃত হবার পর যুক্তি, গণিত ও বুদ্ধির সীমা বিজ্ঞানের নিজেরও জানা হয়ে গিয়েছে। এতে বিজ্ঞান ছোট হয়ে যায় নি। কিন্তু বিজ্ঞান যা না, নিজেকে সেভাবে হাজির করবার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অস্বস্তি বেড়েছে। বিজ্ঞানের যে অহংকার উনবিংশ ও বিংশ শতকে মহামারীর মতো দেখা গিয়েছিল বিশ শতকের শেষের দিকে বিজ্ঞানের সেই অহংকারের তেজ কমতে শুরু করে। বিজ্ঞান নিজেই উপলব্ধি ও বুঝতে শুরু করে বিজ্ঞান সার্বভৌম সত্য প্রকাশক নয়। আর ‘সত্য’ নিজেও এমন একটি ধারণা যা এখনও দর্শনে তর্কাধীন। নিজেই বিজ্ঞান উপলব্ধি করতে শিখেছে যে দেশকালের অধীন ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানের কারবার, হোক তা দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক, চার কিম্বা তারও অধিক। কিন্তু তার বাইরেও জগত আছে, তার বাইরেও বিষয় আছে, মানুষ যে সকল বিষয়ে ভাবতে সক্ষম। বিজ্ঞান যেখানে যায় না বা যেতে পারে না, কিন্তু মানুষের কল্পনা ও চিন্তার শক্তি সেখানে যেতে পারে; মানুষ দেশকালে সীমিত হয়েও অসীমকে তার চিন্তা, ভাব, কল্পনা ও সংকল্পের বিষয়ে পরিণত করতে পারে। নইলে শিল্প সাহিত্য থাকে না, দর্শনের সমুদ্র শুকিয়ে যায় এবং নতুন জগতের কল্পনায় বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাবার জন্য বিপ্লবও অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে সত্য নির্ণয়ের পদ্ধতি বিজ্ঞানের অজানা সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করার দাবি সত্যিকারের বিজ্ঞানীরা এখন আর করেন না। কিন্তু পৃথিবীতে সবসময়ই আহাম্মকেরা ছিল এবং তাদের সংখ্যাও কম নয় যারা বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দিয়ে নিজেকে সবজান্তাবিশারদ বলে দাবি করে। বিজ্ঞানী হওয়া একসময় অভিজাত ব্যাপার ছিল, সন্দেহ নাই। এখনও বিজ্ঞানের কীর্তির প্রতাপ অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানমনস্কতাই মানুষের পরমার্থ নয়। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ হোক কিম্বা ইন্দ্রিয়াতীত – মানুষের চিন্তায় উদ্ভূত বিষয়ের সত্যতা পর্যালোচনার পদ্ধতি আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এক নয় – এই কাণ্ডজ্ঞান যতোই স্পষ্ট হয়ে উঠছে মানুষ বিজ্ঞানের ভাল দিককে যেমন শনাক্ত করতে পারছে তেমনি তার মন্দ দিককেও। যে আভিজাত্যের অহংকারে বিজ্ঞান একদা ধরাকে সরা জ্ঞান করতো সেই আভিজাত্য তার ভেঙেছে অনেক আগেই। কারন সমাজ, সংস্কৃতি, নীতিনৈতিকতা ও রাষ্ট্রের প্রশ্ন মীমাংসায় বিজ্ঞান বিশেষ উপকারি হতে পারে না। সহায়ক হওয়াটা বিজ্ঞানের বিনয়ী হওয়ার ওপর নির্ভর করে। সত্যে বিজ্ঞানের এখতিয়ার একচেটিয়া নয়। সত্যের দাবি আর আভিজাত্যের দাবি যতদিন একাকার ছিল, বিজ্ঞানের একচেটিয়া আধিপত্যও মানুষ মেনে নিয়েছে। যখন মানুষ বুঝেছে সেই দাবি আদতে আভিজাত্যের, সামাজিক কিম্বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিজ্ঞানের ক্ষমতা প্রদর্শনের – তখন সত্যের দরবারে বিজ্ঞানের স্থান রাজার আসনে নয়, অমাত্যের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে সাব্যস্ত হয়েছে। যারা এই সত্যটুকু টের পেয়েছেন তাঁরাই মুক্তবুদ্ধির মানুষ। তাঁদের মন উন্মুক্ত। তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের সহজ উপলব্ধির অর্থ সহজেই বুঝবেন: ‘মানুষ কি কম গা!

বিজ্ঞান চাই, কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না। বুদ্ধি চাই, কিন্তু বুদ্ধিসর্বস্বতা নয়, কারণ অতি বুদ্ধি আমাদের বুদ্ধিমান নয়, আহাম্মকে পরিণত করে।

অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি কথাটা বোধ হয় এ কারণেই আমরা বলি।

২২ ফাল্গুন, ১৪২১/ ৬ মার্চ, ২০১৫, শ্যামলী।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।