সোফিস্টস্ বনাম প্লেটো
প্লেটো কেন সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক?
অনেকে এটার উত্তর অনেকভাবে দিয়েছেন, দেবেন। আমার মত কেউ কেউ এককথায় বলবেন ‘সোফিস্টস্’- দের কারনে। সোফিস্টস হচ্ছে একদল গ্রীক দার্শনিক (অনেকে যাদেরকে দার্শনিক বলতে চান না) যাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল ‘persuasion’ যার যথার্থ বাংলা হতে পারে, ‘সমর্থন অর্জন’। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রিকে তখন চলছে ‘নগর গনতন্ত্র’ যেখানে নগরের পুরুষগন (দাস বাদে) হচ্ছেন ‘সকল ক্ষমতার উৎস’। সোফিস্টরা যেটা টের পেল, তা হচ্ছে, এই গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, যে যতো বেশি ‘persuasive’ সে ততবেশি সফল। সোফিস্টরা বলল, persuasion ই মোদ্দা কথা। এখানে সত্য-মিথ্যা বলে কিছু নাই। সোফিস্টরা রীতিমত তাদের এই তত্ত্ব নিয়ে ব্যবসা খুলে বসলেন। মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের কাছে পাঠ নিতে হত। সক্রেটিস একবার গিয়েছিলেন সোফিস্ট গুরু প্রটাগরাস এর ক্লাসে, দ্বিতীয়বার যেতে পারেননি অনেকগুলো কারনে, যার মধ্যে উচ্চমূল্যও একটি। একবার এক ছাত্র প্রটাগরাস এর পয়সা মেরে দেয়, মানে ক্লাস নিয়ে পয়সা দেয় না। প্রটাগরাস তাকে আদালতে নিয়ে যান, কারন তিনি জানতেন, যদি তিনি জেতেন তাহলেতো পয়সা পাবেনই, হারলেও পয়সা পাবেন। কারন যদি হারেন তাতে প্রমান হবে যে তার ছাত্র শিখেছে কিভাবে persuasive argument এর মাধ্যমে দুর্বল অবস্থানকে সবল করতে হয়, তাই পয়সা তার প্রাপ্য। এটাই হচ্ছে সোফিস্টদের মূলমন্ত্রঃ ‘making a weaker argument the stronger’। সোফিস্টরা জ্ঞানী ছিলেন না তা নয়, কিন্তু তাদের জ্ঞানের উদ্দেশ্য ছিল-ধান্দা। জ্ঞান বেচে নিজের আখের গোছানো। হিপিয়াস নামের একজন সোফিস্ট ছিলেন, যিনি নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন সব বিষয়ে জ্ঞানী হিসাবে। তিনি বলতেন যে তিনি ততক্ষন পর্যন্ত যে কোনও বিষয়ে বক্তব্য রাখতে পারবেন, যতক্ষন পর্যন্ত একজন দর্শকও শুনতে চান।
কিন্তু এই আলোচনায় প্লেটো কেন?
সোফিস্টরা বলত, সত্য বলতে কিছু নাই, সবটাই হচ্ছে ‘persuasion’। প্লেটো বলতেন, সমাজে ন্যায়ের কাঠামো গড়ে ওঠে সত্যের ওপর, যাকে দার্শনিকরা বলেন ‘episteme’। তার মতে, লোক ভুলানো বক্তব্য দেয়ার প্রবনতা সবসময় ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ন্য়। ফলে প্লেটোকে সোফিস্টদের আক্রমনে জর্জরিত হতে হয়েছে, এবং এদের বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করতে হয়েছে। প্লেটোকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে এদের বিরুদ্ধে।
প্লেটো চার চারটি ডায়ালগ লিখেছেন চারজন বিখ্যাত সোফিস্ট কে নিয়ে, যার মধ্যে প্রটাগরাস কে নিয়ে একটি, যিনি ছিলেন সোফিস্টদের গুরু। শুধু তাই নয় প্লেটোর বিখ্যাত ডায়ালগ ‘রিপাবলিক’ এও সোফিস্টরা বাদ যায়নি। প্লেটো তার সারাজীবন এদেরকে সামলা করেছেন, বার বার এদের কাছে ফিরে এসেছেন, কখনও কৌতুকের মাধ্যমে, কখনও যুক্তির মাধ্যমে, আবার কখনও হাতাশা নিয়ে। এদের সাথে যুদ্ধ করতে করতেই প্লেটো পরিনত হয়েছেন। একজন সত্যিকারের মহান দার্শনিক সবচেয়ে বেশি উপকৃত হন একজন কট্টর এবং উস্কানিমুলক প্রতিপক্ষের কাজ থেকে। সে অর্থে প্লেটোকে মহান করেছে সোফিস্টরা। শুধু প্লেটো নন, এরিস্টটলও এদের মোকাবেলা করেছেন অহরাত্রি। তারা এরিস্টটলকে এমন জ্বালিয়েছিল যে এরিস্টটল শেষে একটা বই লিখতে বাধ্য হন, যেখানে তিনি বিস্তারিতভাবে লেখেন কিভাবে একটা সোফিস্ট যুক্তি ধরতে হয়, এবং কিভাবে তার মোকাবেলা করতে হয়।
বাংলাদেশে এখন সোফিস্টদের বাড়বাড়ন্ত।
এখানে সত্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকা খুব মুশকিল। যে দু-একজন হাতেগোনা আছেন, তারা প্রতিনিয়ত জর্জরিত সোফিস্টদের হাতে। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, এই কট্টর সময়ের মোকাবেলা করেই কেউ কেউ ছাড়িয়ে যাবেন সময়ের সীমানা- প্লেটোর মতো।।
নিজের সম্পর্কে লেখক
Work in international organization and live outside Bangladesh