আনন্দবাজারে চলরে মন (২)
পার্বতী বাউলের নাচগান ভালোই লাগল। কিন্তু দক্ষতার অতিরেক মনে হয় ভক্তির অন্তরায়। ওনারে দেইখা তরুণ রবীন্দ্রনাথ মনে হইল। আমি বলতে চাই, বিদ্যার সব আর্টে ঢালতে হয় না। উনি ঢালতেছেন। - ব্রাত্য রাইসু
ব্রাত্য রাইসু। এই নিরানন্দ সময়ে আপনাকে ভাল লাগাতে পারা কম কথা না। 'কিন্তু দক্ষতার অতিরেক মনে হয় ভক্তির অন্তরায়' -- আমি ঠিক বুঝি নাই। আমি তাঁর নাচে বা গাওনে 'দক্ষতা' বিশেষ দেখি নাই। তবে ভক্তি দেখছি। এটা আমি মোটামোটি চিনি বলে সাহসের সঙ্গে কিছুটা দাবি করতে পারি, কারন এঁদের সঙ্গে জীবনের বড় একটি অংশ ব্যয় করেছি, এখনও করি। ভাবচর্চার ব্যাপারটাকে জ্ঞানতত্ত্বের বিষয় হিসাবে না বুঝে জীবন যাপনের ব্যাপার হিসাবে বোঝার তাগিদ থেকে করি। 'দক্ষতা', 'ভক্তি' ছাড়াও 'বিদ্যা', আর্ট' ইত্যাদি ধারণা নিয়ে আলোচনা অনেক গোড়ার তর্কে নিয়ে যাবে। দরকারি যদিও, এখানে করা কঠিন হবে। সামনাসামনি হবে নে একদিন। আমরা তো সবাই নিজ নিজ অনুমান থেকেই কথা বলি। তাই সেই অনুমানগুলো পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া না করে নিলে মন্তব্যগুলো ভাসমান থেকে যায়।
এই মন্তব্যগুলো করছি সামনে লালন সাঁইজীর দোল পূর্ণিমার কথা মনে রেখে। পদটি যতদূর জানি হাওড়ে গোঁসাইয়ের। তাঁকে আমরা কতোটা জানি সন্দেহ আছে, সেটা জানান দেওয়াও একটা মতলব ছিল। 'আনন্দবাজার' বাংলার ভাবচর্চার গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। দোলের ভাবের সঙ্গে এর অন্তরঙ্গতা আছে। কিন্তু এই 'বাজার' তো বাইরে বাজার নয়, বাইরে বাজার বসিয়ে এই আনন্দে যাওয়া যাবে না। আর আনন্দবাজারে যাওয়াও তো বাইরের যাওয়া নয়, নিজের ভেতরে নিজে প্রবেশের চেষ্টা। এটা কথা, গান, শরীর আর রাঢ় অঞ্চলের ধারা মেনে পায়ে নুপুর বেঁধে ঘুরে ঘরে নাচার আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে কতোটা ব্যাক্ত করা সম্ভব সেই দিকে নজর পড়ুক, এটা চেয়েছি। তার মানে পার্বতীকে বুঝতে হলে এই সকল বাউল নামক ডিসকার্সিভ ট্রাডিশান সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা থাকা দরকার। ডিস্কার্সিভ ট্রাডিশান ধারণাটা ফুকোর, একটি চিহ্নব্যবস্থা তার নিজের নির্মাণের ইতিহাস আর ব্যাকরণের মধ্যে যেভাবে নতুন বাক্য বা বয়ান হাজির করে -- এই অর্থে। স্বল্পে বোঝাবার জন্য এখানে ফুকো ধার নিলাম। কারণ, 'স্বল্পেতে সব বুঝিতে হয় ভাবনগরে' (ফকির লালন শাহ)। যদি এই নাচকে বাংলার ভাবচর্চার একটি বাক্য হিসাবে বিচার করি তাহলে কিভাবে বুঝলে আমরা আনন্দবাজারে প্রবেশের টিকিট পেতে পারি সেই প্রশ্ন উঠলে বুঝতাম আমরা'রসিকের দরবারে' আছি। থাকলে আমরা অনেকদূর যেতে পারতাম। কিন্তু মন্তব্যগুলো দেখুন!! কী আর করি!
বাংলাদেশে দোল উৎসবকে আমরা গ্রামীন ব্যাংক, বাংলা লিংকের কার্নিভাল আর বাজারি প্রচারে পর্যবসিত করেছি। এবারও তাই হবে। বেগুনের মধ্যে মনসান্টো আর মাহিকোর প্রপাইটরি টেকনলজি ঢুকে পড়া আর লালনের দোল উৎসবে গ্রামীন, বাংলা লিংক ইত্যাদি কম্পানি ঢুকে পড়া একই কথা।
তারপরও অবশ্য আমরা বাঙালিয়ানার বড়াই করে যাবো! কি বলেন?
... ... ...।
চিহ্ন পরম্পরা বা চর্চা পরম্পরাr (discursive tradition) রক্ষার অর্থ স্রেফ লোকায়ত ঐতিহ্য ধরে রাখা নয়, ছেঁঊড়িয়ায় নদিয়ার ভাবের ক্ষয় ঘটেছে, ঠিক, কিন্তু তাকে মিউজিয়ামের মতো ধরে রাখা যাবে না, বা বাউলদের পক্ষে দাঁড়িয়েও কোন কাজ হবে না, সামাজিক দায় পালন হবে হয়তো। চিহ্ন পরম্পরা ধরে রাখার অর্থ কোন একটি এলাকা/ইতিহাসের মধ্যে উৎপন্ন চিহ্নব্যবস্থার ব্যাকরণের মধ্যে থেকে একই সঙ্গে বাইরের বিদ্যা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, আর্ট, দক্ষতা ইত্যাদি রপ্ত করা। আপনার 'দক্ষতার অতিরেক' সেই দিক থেকে নেতিবাচক নয়। পার্বতী যা চর্চা করছে সেটা রাঢ়ের বাউলদের চর্চা মাত্র নয়, শ্রেণিগত দিক থেকেও পার্বতী ঐ স্তরের নয়। এ কারনে তাকে জানা বোঝাটা ইন্টারেস্টিং হতে পারে।
বাংলার ভাবান্দোলনের চিহ্ন পরম্পরা ও ব্যাকরণ মেনে যারা ভাবচর্চায় আগ্রহী, কিন্তু যে ভাব শুধু বাংলার ভাবান্দোলন হবে না, বরং তার বৈশিষ্ট্য হবে বৈশ্বিক। তাদের জন্য পার্বতী খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তাকে উপেক্ষা করার উপায় নাই।
পার্বতী বাউলের মুখেই কিছু কথা শোনা যাকঃ
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।