আনন্দ বাজারে চলরে মন (৪)
রাইসু, পার্বতীর নাচ দেখে আপনার তরুণ রবীন্দ্রনাথ মনে হওয়ায় আমি আপত্তি করি নাই। কারন আমরাতো রবীন্দ্রনাথরেই চিনি। লালন বা ভক্তির ধারারে কিভাবে চিনি সেটা গৌতম ঘোষ/সুনীল বাবুর ‘মনের মানুষ’ সিনেমা দেখলেই টের পাওয়া যায়। আমাদের দৌড় অতোটুকুই।
আমি চিনি সেই দাবি করি না, কিন্তু দীর্ঘকাল আমি এই ধারাটারে চেনার চেষ্টায় ব্যয় করেছি বলে নিজের অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে কিছু কথা বলেছিলাম। সবই উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আপনি খুব গোড়ার কিছু প্রশ্ন তুলেছেন, যা নিয়ে সম্ভবত আরও কিছু আলোচনা হতে পারে। তার আগে ‘ওনারে দেইখা তরুণ রবীন্দ্রনাথ মনে হইল’ – আপনার এই মন্তব্য নিয়া দুই একটা কথা।
শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান ও 'আলোকিত' হবার কারণে লালন কিম্বা বাউলদের আমরা অধিকাংশই ঠাকুর পরিবাররের মধ্যস্থতা ছাড়া বুঝি কি? আপনিও পার্বতীকে রবীন্দ্রনাথের নাচ দিয়াই তুলনা দিলেন। অন্য কোন বাউল বা ফকির ফ্যাকড়ার সঙ্গে তুলনা দিলেন না। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কোন বোঝাবুঝির তরিকা আমাদের জানা নাই।
বাউলদের ব্যাপারটা যতোটা না জানার ব্যাপার তার চেয়ে বেশি চর্চার। আমি এই চর্চার দিকটার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পার্বতীর ভিডিওটা শেয়ার করেছিলাম। আপনি ভিডিওটা পার্বতীর পারফরমেন্স আকারে দেখলেন। ফলে আমাদের আলোচনা ভিডিওতে পার্বতীর পারফরমেন্সের বিচারের বেশী আগাইতে পারতেছে না।
রবীন্দ্রনাথ বাউল ফকিরদের নাচ নকল করলেও করতে পারেন, এটা দোষের কিছু না । ঠাকুর এই রকম নেচেছেন কিনা তাও আমি জানি না। তবে ঠাকুরের নাচ যদি পার্বতীর মতো হয় তো হয়তো তিনি বাউল ফকিরদের কাছ থেকে কিছু জিনিস ধার নিছেন। তাতেও অসুবিধা দেখি না।
তথ্য হৈল, রবীন্দনাথ বাউল ফকিরদের জীবনচর্চা করেন নাই। তাতে তিনি ক্ষুদ্র হয়ে যান নাই। কথাটা তোলার কারন হৈল আপনার মন্তব্যে পার্বতীর নাচরে এখনি ‘বৈশ্বিক’ বলতে যা বুঝাচ্ছেন সেটা অনুমান করার চেষ্টা করছি। সেটা কি এই রকম যে পার্বতীর নাচরে যদি তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো লাগে তাহলে সেটা বৈশ্বিকতা প্রাপ্ত হৈল। আপনি এটাই বলছেন, এটা আমার দাবি না। কিন্তু তরুণ রবীন্দ্রনাথ ও পার্বতীর নাচরে একই কাতারে ফেলে দেওয়াতে আপ্নি ঠাকুরের মধ্যস্থতা ছাড়া নিজজ্ঞানে পার্বতী কিম্বা বাংলার আউল বাঊলেরে বুঝতে চান না। এই সন্দেহ আফসোস হৈতেছে। এই আর কি!
গুরু কৃপা করলে এই বিষয়ে আরও অনেক কথা হবে। স্বল্পে শুধু এতোটুকু বলে রাখতে পারি যে ঠাকুরের চুল পার্বতীর মতো বড় হতে পারে, কিন্তু সেখানে জট পড়ে নাই। যে জীবনযাপন চুলে জট পড়াকে প্রশ্রয় দেয় সেটা ঠাকুরের জীবন না। পার্বতীর নাচ আর যাই হোক ঠাকুরের নাচ না।
তারপরও বলি, এগুলোও বাহ্য তর্ক। আপাতত উপেক্ষা করা যায়। আপনি বরং অন্যত্র অনেক দরকারী প্রশ্ন তুলেছেন যার জন্য ধন্যবাদের পাত্র হৈয়া রইলেন। আমি সেই জন্যই এই বিষয় নিয়া কথা বলার তাগিদ বোধ করছি। মনের মধ্যে দোলের ভাবটাও আছে। গুরুর দায় বোধ করেছি। অর্থাৎ কথার দাবি মেটানো দরকার। যতোটা সাধ্যে কুলায়।
... ... ...
প্রশ্ন করেছেন, “আপনি পার্বতীর এই ফিউশনরে কী অর্থে বৈশ্বিক বলতেছেন বা আসলে বলতেছেন না কিনা তা জানলে এই বিষয়ে আরো বলা যাইত”। এর উত্তর তো দিছি বলে মনে হয়। যাই হোক। আবারও বলি, না, আমি বৈশ্বিক বলি নাই। আপনি তো অনেকবারই আমার একটি বাক্যের উদ্ধৃতি দিলেন। বলেছি, বাংলার ভাবান্দোলনের চিহ্ন পরম্পরা ও ব্যাকরণ মেনে যারা ভাবচর্চায় আগ্রহী, কিন্তু যে ভাব শুধু বাংলার ভাবান্দোলন হবে না, বরং তার বৈশিষ্ট্য হবে বৈশ্বিক -- তাদের জন্য পার্বতী খুব তাৎপর্যপূর্ণ। যারা ভাবান্দোলন চর্চা করতে চায়, তারা তো বিশ্ব নামক কোন বিমুর্ত ও নির্বিশেষ জায়গা থেকে শুরু করে না। তাদের চর্চার স্থানকালপাত্র আছে। তারা একটি বিশেষ বা স্থানিক জায়গা থেকেই শুরু করে। কিন্তু তারপরও যদি তারা চায় তাদের চর্চার এমন তাৎপর্য থাকুক যা শুধু বাংলাদেশের ভাব ও বাংলাদেশের চর্চা হবে না, বরং বিশ্বেরই ভাব বা বিশ্বেরই চর্চা হবে, তাহলে পার্বতীর সাধনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। পার্বতীর ভাবচর্চা এখনি বৈশ্বিক -- এই দাবি করি নি।
এ কালে কিভাবে বাংলার ভাবান্দোলনের চিহ্ন পরম্পরা ও ব্যাকরণ মেনে ভাবচর্চা বৈশ্বিক হবে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। এর পেছনেই তো দৌড়াচ্ছি প্রায় সারা জীবন। আমার জন্য এটা খুবই বড় একটি প্রশ্ন। এটা করবার বা করে দেখাবার বিষয়, দাবির ব্যাপার না। পার্বতী এখনও বৈশ্বিক হয়ে যায় নি। কিন্তু আপনার তো কোন অসুবিধা দেখছি না। আপনার কাছে তো পার্বতীর নাচগান এখনই বৈশ্বিক।
থাকনা এখানে, আপাতত। এর আগে যা বলেছি তা আপাতত যথেষ্ট বলেই মনে করি। সময় পেলে এই বিষয়ে ফিরব আবার। এখন অন্য বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলি।
... ... ...
তর্কটা করেছিলাম ‘দক্ষতার অতিরেক মনে হয় ভক্তির অন্তরায়’ – এখান থেকে। কথাটা যে অনুমানের ওপর দাঁড়ানো তাকে প্রশ্ন করবার জন্য। ‘দক্ষতা’, ‘ভক্তি’ ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু নিজের অনুমান আছে, ফলে ধরে নিয়েছেন ভক্তির ধারার মধ্যে বিভাজনটা আপনার অনুমানের মতোই। যেমন ভক্তির জন্য দক্ষতার দরকার নাই, বা লাগলেও অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয়। দ্বিতীয়ত, ‘বিদ্যার সব আর্টে ঢালতে হয় না’ – এর পেছনেও অনুমান আছে। বিদ্যা আর আর্ট বুঝি পরস্পর থেকে আলাদা ব্যাপার। বিদ্যার মধ্যে শিল্পকলা নাই, আর শিল্পের মধ্যে বিদ্যা নাই – ইত্যাদি। এই অনুমান থেকে অনেকে এই বিপজ্জনক সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌঁছান যে ভক্তির ঘরে বুঝি বিদ্যা অবান্তর বা গৌণ। থাকলেও সেটা অতিরিক্ত। ভক্তির ধারার মধ্যে গুরুকে কদমবুচি কিম্বা সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত ছাড়া বুঝি বিদ্যা বা বিদ্যামূলক কিছু নাই। ভক্তি = বিদ্যাহীনতা; দক্ষতা ্তহাকলেও থাকতে পারে, তবে অতিরেক ঘটলা সেটা ভক্তির অন্তরায়। এই অনুমানগুলার কোন ভিত্তি নাই।
পার্বতী তার সব বিদ্যা যদি তার আর্টে ঢেলে দিয়ে থাকে তাহলে তো ভালই। তার মানে তার নাচটা বিদ্যা হয়ে উঠেছে, বিদ্যা ও শিল্পের অভেদ সে তার নাচের মধ্য দিয়া রচনা করতে পেরেছে। খারাপ কি দেখলেন?
আমরা অনেকেই মনে করি শিল্পকলার জন্য বিদ্যা অতিরিক্ত, থাকলেও সেটা ব্যবহার করা উচিত না। অনেক কবিকে দেখি প্রায়ই তারা বলে বেড়ায় বিদ্যা থাকলে সেটা কবিতায় থাকা উচিত না। জীবাননন্দীয় কায়দায় তারা বলে, যদি থাকেও তবে সেটা থাকবে সুন্দরী নারীর কটাক্ষের পেছনে শরীরের শিরা উপশিরার মতো। তারা শিল্পকলা আর বিদ্যাকে আলাদা বলে আগাম অনুমান করে বলেই এই ভাবে বলে।
তবে তর্কটা তুলে খারাপ করেন নাই। কিছু কথা বলি।
তর্কগুলো নদিয়ার ভাবের খুবই গোড়ার তর্ক। চৈতন্য ন্যায়শাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। তর্কে তাঁর প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিতেন অনায়াসে। বিদ্যা কথাটা আমরা আজকাল যে অর্থে ব্যবহার করি সেই অর্থে ‘তর্ক’। ফকির লালন শাহও কম তর্ক রসিক ছিলেন না। তর্ক বলতে আপাতত দুই অর্থে বুঝলে আমাদের আলোচনার জন্য সুবিধা। যেমন: এক. বাগ্মিতা (rhetoric), এবং দুই: বৈয়াকরণিক বিদ্যা বা যাকে ইংরেজিতে ফর্মাল বা প্রপজিশনাল লজিক বলা হয়, গণিতের ভিত্তি আলোচনার জন্য ভাবুকদের মধ্যে যার ডাক পড়ে।
নিমাই, অর্থাৎ চৈতন্য, বিদ্যাচর্চা করতে গিয়েই বুঝলেন, ব্যাকরণ কিম্বা বাগ্মিতা দুটোর একটিও সত্য নির্ণয়ের পথ নয়। কারণ ফর্মাল সিস্টেম সেটাই শুধু পয়দা করতে পারে কাঁচামাল (axiom) হিসাবে যা আপনি শুরুতে ঢোকান বা অনুমান করেন। আর বাগ্মিতা কথার ফুলঝুরি তৈরী করে; এক কথা থেকে হাইপারটেক্সটের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আরেক কথায় রূপ নেয় মাত্র। এই দুই পথ পরিহারের জন্য জীবের একটিই মাত্র আশ্রয়, সেটা নামাশ্রয় বা জিকির। সত্য অরূপ, তাকে তর্কে নির্ণয় করা যায় না, কিন্তু উপলব্ধি করা যায়। সত্য নির্ণয়ের কোন প্রথাসিদ্ধ, বিধিবদ্ধ বা ফর্মাল পথ নাই। তাকে নামের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির সাধনা ছাড়া জীবের অন্য কোন গতি নাই। যদি এতটুকু বুঝতে পারেন তাহলে নদিয়ায় ভাবের যে বিপ্লব ঘটে গিয়েছে তার আঁচ খানিক টের পেতে শুরু করবেন। চৈতন্যের বাগ্মিতা পরিহার কাব্যের আর বিধিবদ্ধ ব্যাকরণ পরিহারের পথ গণিতের দার্শনিক ভিত্তির বিচার বা ফর্মাল সিস্টেমের সীমা নিয়ে পর্যালোচনায় কাজে লাগে। পাশ্চাত্যকে এই জায়গা থেকে বোঝার চেষ্টাটা জরুরী -- একথা আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি। চৈতন্যকে এই জায়গা থেকে বোঝা গেলে ফকির লালন শাহ কেন 'নামাশ্রয়' বা 'জিকির' পরিহার করেছিলেন সেটাও আমরা বুঝব না। ভাবান্দোলনের ধারাবাহিকতা যেমন আছে তেমনি তার ছেদবিন্দুও রয়েছে। ভাবান্দোলনের বিবর্তন বোঝার জন্য যা জরুরী। আপনি তাতে আগ্রহী হবেন না অনুমান করে এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াচ্ছি না।
চৈতন্যের বিপ্লবটা একা একজন ব্যাক্তির বিপ্লব নয়। তাকে সামাজিক-ঐতিহাসিক দিক থেকেও বোঝার দরকার আছে। আসলে সুলতানি আমলে ইসলামের প্রভাবে আমাদের ভাব জগতে একটা বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল। জিকির বা নামাশ্রতয় একটি উদাহরণ। আরও বিস্তর দিক আছে। ফ্রেগে, কারনাপ, হুইতঝেনস্টাইন কিম্বা দেরিদা আসার পরেও সত্য যে বিধিবদ্ধ ভাবে নির্ণয়ের অধীন কোন ব্যাপার নয় পাশ্চাত্য সেটা এখনও পুরাপুরি বুঝে উঠতে পেরেছে কিনা সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহের অবকাশ আছে। তার মানে এই নয় যে লজিক, ন্যায়শাস্ত্র বা বাগ্মিতা আমাদের দরকার নাই, তা নয়; অবস্থাভেদে সব কিছুরই দরকার আছে। কিন্তু সাধনার কাজ হচ্ছে কোঠায় দরকার কোথায় বোঝা সেই হুউঁশটুকু অর্জন করা। সবকিছু যেন সহজ ভাবে আমাদের জীবনচর্চার মধ্য দিয়ে রূপ নিতে পারে যাতে তার পথ সন্ধান করা। যেন তারা আমাদের নানান বৃত্তির মধ্যে বিরাজ করে, একা একজন যেন সকল বৃত্তির সর্দার হয়ে না ওঠে -- সেই দিকে মনোযোগী থাকা। বুদ্ধিই সব কিছু যেন এই মায়ায় আমরা নির্বুদ্ধি না হয়ে যাই।
আমি পার্বতীকে এই জায়গা থেকে উপলব্ধি করেছি, ভালমন্দ বিচার করি নি। একটা সামগ্রিক জায়গা থেকে ওকে বুঝতে চেয়েছি। বিদ্যা, আর্ট, দক্ষতা ইত্যাদি নানান ভাবে ভাগ করে নয়। আসলেই।
আপনার বিচারে পার্বতী পথের কাঁটা হলে, সেটা কোন্ পথ? কার পথ? আপনার? কিসের পথের কথা বলছেন? সেই পথটা কি? বলছেন, “বর্তমানেরই কাঁটা। কণ্টকসম সে বৈশ্বিক পারফর্মেন্স। তা আনুশেহরই হউক কি পার্বতী বাউলেরই হউক”। কার বর্তমান? আপনার সাধনাটা কি? কোথায় পার্বতী আর আনুশেহ কাঁটা হয়ে আপনার চর্চাকে রক্তাক্ত করছে?
তাই বলি ভাবচর্চার ব্যাপারটাকে বাছবিচার বা জ্ঞানতত্ত্বের বিষয় হিসাবে না বুঝে জীবন যাপনের ব্যাপার হিসাবে বোঝার তাগিদ থেকে উপলব্ধি করার ব্যাপারটা ভিন্ন একটা তরিকা। 'দক্ষতা', 'ভক্তি' 'বিদ্যা', আর্ট' ইত্যাদি ধারণা নিয়ে আলোচনা অনেক গোড়ার তর্কে আমাদের নিয়ে যাবে। দরকারি যদিও, তবে আমরা যার যার অনুমান নিয়ে থাকলে পস্পরকে বোঝানো কঠিন হবে। অবশ্য আমি আপনার প্রশ্ন শুনে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার তাগিদ বোধ করছি। সময় পাবো কিনা সেটা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারে।
সতর্ক করেছিলাম আমরা তো সবাই নিজ নিজ অনুমান থেকেই কথা বলি। সেই অনুমানগুলো পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া না করে নিলে মন্তব্যগুলো ভাসমান থেকে যায়। অতএব সামনাসামনি আলোচনাতেই আমার আগ্রহ ছিল বেশী। কিন্তু আপনি আমাকে নিস্তার দিলেন না। লিখতেও আপত্তি নাই। কিন্তু ব্যস্ততার কারনে এখন চাইছিলাম না। এই আর কি! গোড়ার তর্কগুলো আমি দোল থেকে ফিরে আসার পর সময় পেলে তোলা যাবে। অসুবিধা নাই। অর্থাৎ বিদ্যা, শিল্পকলা, দক্ষতা, ভক্তি – ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের অনুমান ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনা।
আপাতত তোলা থাক। গোড়ার তর্ক বাদ দিয়ে উপরি উপরি কিছু বলে এখন আপাতত দায়মুক্তি চাইছি।
দুই
সন্দেহ নাই, আপনার কিছু প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। সব উত্তর দেবার সময় এখন হবে না। আমার ভয় হৈতেছে আপনি ‘বৈশ্বিক’ কথাটার ফাঁদে আটকা পড়ে গেছেন। কী অর্থে বৈশ্বিক কথাটা বোঝা যাইতে পারে, তার উত্তর আগে দিয়েছি। আপনি এতো প্রশ্ন করলেন, কিন্তু নিজে বৈশ্বিক বলতে কি বোঝেন সেটা বললেন না। সেটা বলেন, আলোচনা এগিয়ে যাবে। ভাবান্দোলনেই না হয় থাকেন, কিন্তু তারেই আবার কী অর্থে 'বৈশ্বিক' বলতেছেন? আমি কী অর্থে '‘বৈশ্বিক’ কথাটা নিয়ে ভাবছি, তার কিছু নমুনাও দিয়েছি। বলেছি, যদি পরস্পরকে বুঝাতে না পারি, সেটা চিন্তার কারন হবে। ভাব বাদ দিয়ে পারফরমেন্স অর্থাৎ গান ও নাচ বিচারের মানদণ্ড ব্যবহার করে আপনি ভাবান্দোলনেই থাকেন। অসুবিধা কি? এই খানে আপনার কোন স্টেইক নাই, তাই আপনার অসুবিধা নাই। তবে ভাবের জায়গা থেকে পার্বতীকে বোঝার একটি দায় আমার আছে। আমি ভাবের ঘরের লোক, এই ঘরে কিছু চর্চা আছে, যা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
বলছেন আপনি ‘ভেদে বিশ্বাসী - অভেদের খণ্ড বা অংশ হওয়ায় না’। ‘বিশ্ব ভাবান্দোলনে বাংলার ভাবান্দোলন মিশাইয়া পার্বতীর মত বৈশ্বিক’ হইতে চান না। কিন্তু আমি তো এটা বলি নাই। উল্টাটা বলেছি, পার্বতীতো না মিশাইয়াই বৈশ্বিক হইতে চায়। আধুনিকতা যে জীবনকে মুছে ফেলতে উদ্যত, সে সেইখানে দাঁড়াইয়াই আপনাদের কাছে হাজির হৈতে চায়।। আপনি বিশ্ব বলতে গ্লোব বুঝলে আমি আর আগামু কেমনে? আপনি ভেদে ‘বিশ্বাসী'? তো বিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়াইয়া গেলে তো আলোচনা থামাইয়া দিতে হয়।
যদি ভেদ নিয়াও থাকেন, আমার কোন আপত্তি নাই। সেই ক্ষেত্রে ‘বিশ্ব’ বা ‘বৈশ্বিক’ নামক কোন ধারণা আমদানির দরকার নাই। কারণ সেটা ‘অভেদ’ ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমার কাছে বৈশ্বিক কথাটা কোন পূর্ব নির্মিত ধারণ না। ভেদ কইলেও অভেদের ধারণ আইসা পড়ে। একটাকে বাদ দিয়া অন্যটা নাই। তো কিভাবে তারা পস্পরকে অর্থ দেয় সেটাই আমার বিবেচ্য। সেইটাই আমি আলোচনা করছি বলে মনে হয়। বুঝাইতে না পারলে পরে আরেকবার চেষ্টা করব। এখন ঢাকার বাইরে যাইতেছি।
যদি অবিমিশ্র বাংলার ভাবান্দোলনে থাকতে চান, তাহলে বিশ্বের কথা বলেন কেন? আপনার যুক্তি কি এরকম যে বাংলার ভাবান্দোলন নামক একটা ‘বিশেষ’ আছে। সেটা বিশেষ হইয়াও ‘নির্বিশেষ’, কিম্বা ‘খণ্ড’ হইয়াও ‘সমগ্র’। এলাকার ভূগোল হৈলেও বিশ্বের ভূগোল – ইত্যাদি? এটা কি গ্রহণযোগ্য?
প্রক্রিয়া আকারে দেখাই কি সঙ্গত না? পার্বতীর যে গুরুকুল থেকে শিক্ষা তার সঙ্গে অন্য জিনিস মিশতেছে কিভাবে? তার অর্থ কি? এইসব। আপনি তর্কটা অন্য দিকে নিয়ে গেলেন।
আপনি বিচারে আগ্রহী। মানে আগেই ভালমন্দ বলে দিতে চান। পার্বতী আর আনুশেহরে পথের কাঁটা বলে ঘোষণা করতে চান। আমি চাই না। আপনার হাতে একখানা মানদণ্ড। তা থাকুক, তাতে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু সেটা যখন দারোগার মতো ব্যভার শুরু করেন, আমি ভয় পাইয়া যাই। আমার পদ্ধতি ভিন্ন। আমি মানদণ্ড নিয়া বসি নাই। আমি বুঝতে চাই এই চর্চার অভিমুখ কোনদিকে। তার কী হৈয়া ওঠার সম্ভাবনা। কিম্বা আমার কাছে যতো ভালোই লাগুক, কেন তার আর কোন সম্ভাবনা নাই। এইটা বলার পরে আমি আবার ভাবতে বসি যে আবার কেন কথাটা কইলাম? নিজের মধ্যে কী অনুমান কাজ করতেছে সেটাও পুনর্বিচার করতে বসি। এই আর কী!
ফকির ফ্যাকড়ার সঙ্গে ঘোরাফিরা করলে কাউকে সহজে নাকচ করতে মন চায় না।
বলেছেন, “একতারা, প্রেমজুড়ি বা বিশেষ নাচের মুদ্রা ও পার্বতী সহযোগে যে ভাবান্দোলনের বৈশিষ্ট্য তা হবে বৈশ্বিক, আমি ধারণা করি সেসব ছাড়াই এই ভাবান্দোলন যথেষ্টই বৈশ্বিক”। আমি তো ধারনার মধ্যে থাকতে চাইতেছি না। পার্বতীরে যেমন দেখতেছি তেমনি বুঝতে চাইতেছি।
যুক্তি দিয়েছেন, "ছেউড়িয়ার চিহ্ন পরম্পরার বৈশিষ্ট্যও তো বৈশ্বিকই" বলতে এই চর্চা, চিহ্ন, ভাব বা আন্দোলনরে কেবল আঞ্চলিক বা স্থানিকতায় নির্দিষ্ট কইরা না দেওয়ারে বোঝাইলাম”। স্থানিকতায় নির্দিষ্ট করে দেবার কাজটা তো আমি করছি না, আপনিই তো করছেন। তাই না? কিন্তু স্থানিকতাকে বৈশ্বিকতা বলে কি তার স্থানিকতা মোছা যায়? আপনার হাতে রাবার থাকলেও থাকতে পারে, আমার নাই।
আমি ভাবচর্চার দিক থেকে বলেছি, "বাংলার ভাবান্দোলনের চিহ্ন পরম্পরা ও ব্যাকরণ মেনে যারা ভাবচর্চায় আগ্রহী, কিন্তু যে ভাব শুধু বাংলার ভাবান্দোলন হবে না, বরং তার বৈশিষ্ট্য হবে বৈশ্বিক। তাদের জন্য পার্বতী খুব তাৎপর্যপূর্ণ।"। এই ভাবচর্চা এমন হতে হবে যাতে এটা কোন গুপ্ত সম্প্রদায়ের গুহ্য চর্চা না হয়, যেন তার তাৎপর্য ও গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা পায়। ইত্যাদি। পার্বতীর চর্চা বৈশ্বিক তাতো বলি নি। যারা এই ভাবচর্চাকে বৈশ্বিক ভাব আকারে হাজির ও চর্চা করতে চায় তাদের কথা বলেছি। এই সূত্রেই বৈশ্বিক কথাটা আর কতো ভাবে বোঝা যায় তা নোটে বলেছি।
প্রতিরোধের দিক থেকে কথাটা বুঝলে তর্কটা আপাতত ক্ষান্ত দিতে পারি। তথাকথিত আর্ট, শিল্পকলা বা ভাব জীবন চর্চা থেকে আলাদা কিছু না। জীবন একদিকে আর আর্ট অন্য দিকে হার্ড রিয়েলিটি – এই বিভাজনকে প্রশ্ন করা জরুরী। জীবন একদিকে আর অন্যদিকে আর্টের পারফরমেন্স – এই বিভাজনটা পুজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঘটায়। পার্বতী বা যে কোন সাধকের ধারা চর্চার রাজনৈতিক তাৎপর্য ওখানে যে কোন চিহ্নপরম্পরা ও তার ব্যাকরণ রক্ষা করে নিজেকে বিকশিত করার চর্চা সেই জীবন যাপনের পক্ষেও লড়াই হয়ে ওঠে, যে জীবন যাপঙ্কে পুঁজি নিরন্তর ধ্বংস করে চলেছে। সেই জীবন আমরা যাপন করব কিনা, সেটা ভিন্ন তর্ক। জীবন যাপনের সঙ্গে ভাবের এই বিচ্ছেদ মোচন একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
আপনি বৈশ্বিক বলতে নিজেদের বেচতে চাওয়া বৈশ্বিকতা বোঝান নাই। ঠিক আছে। কিন্তু বলেছেন ‘বাংলার ভাবান্দোলন বা তার গানগুলায় যে আবেদন বা আর্ট হিসাবে বা ভাব হিসাবে এর যে গ্রহণযোগ্যতা -- তা পার্বতীর এই পারফর্মিং আর্টধর্মী নাচগান ছাড়াই বৈশ্বিক’। এটা ঠিক না, কারন বাস্তব তা বলে না। কাউকে বলতে শুনি নাই যে পার্বতীর এই চর্চা বিশ্বের ভাবের জগতে তোল্পাড় তুলেছে। দ্বিতীয়ত ভাব নিয়া এটা বলাও যায় না। কারণ এই ‘ভাব’ তথাকথিত আধুনিকতা ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে, একই সঙ্গে প্রাক পুঁজিতান্ত্রিক জগতকেও। এটা একান্তই ‘স্থানীয়’ – বাংলাদেশী অর্থে নয়, ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ অর্থে। একে বৈশ্বিক করতে হলে বিস্তর কাজ বাকি আছে।
যেখানে এসে আমাদের পার্থক্য ঘটছে, সেটা হৈল আপনি একে পারফর্মিং আর্ট হিসাবে বুঝতেছেন। আমি তো লাইফস্টাইল বাদ দিয়া ভাব বুঝি না। তাই আপনি পার্বতীর নাচের মূদ্রা আর একতারা ছাড়া আর কিছু দেখলেন না। আমি অবশ্য তার চুলের জটাও দেখি। এই লাইফস্টাইল দাবি করে আধুনিকতার পথ নিরানন্দের – আপনাকে তাই আনন্দবাজারে যেতে দাওয়াত দেয়। আপনি যতক্ষণ তা সেই গোড়ার তর্কে না যাবেন, আপনার অন্যান্য প্রশ্ন বাউলদের নাচগান ভাল লাগা মন্দ লাগার তর্কে পথ হারিয়ে ফেলবে।
৩
আপনার সঙ্গে কোন কিছু নিয়া তর্ক করবার মুশকিল হৈল, অনেকেই আবার আপনার ‘কুতর্কের দোকান’-এর ছাত্র। তারা তর্কের জন্য তর্ক করে। আপনিও মাঝে মধ্যে করেন না, তা না এবং প্রতিপক্ষের পরিশ্রম বাড়াইয়া দিয়া আনন্দ পান। এটা সবসময় অনুপকারী না। কিন্তু আমার জন্য এটা পেরেশানি। বোঝা হৈয়া যায়, কারন হাতে সময় কম, আর কিছু লিখতে বসলেই লেখা ছোট থাকতে চায় না। এটা ভাল কি মন্দ জানি না। কারন অনেক গোড়ার অনুমান নিয়া কথা না তুলে উপায় থাকে না। নগদ লাভ হৈল উস্কানির চোটে কিছু নগদ কথা বলা হয়। আপনার সম্মতি আদায়ের চেয়েও ধারণাগুলা নিয়া আলোচনার ফায়দা আমার নিজেরই। কথা চালাইতে চাইলে মনে রাইখেন, অনেকে ব্রাত্য রাইসু হৈতে চায়। তারা ‘কুতর্ক’ কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বোঝে, এবং মনে করে আপনি বুঝি এটা কৈরাই খ্যাতিমান।
এখন দেখেন, আমি কেন আনুশেহকে স্নেহ করি এটাও আমাকে পাবলিকলি জবাবদিহি করতে হচ্ছে। এরপর অন্যদের বলবে আমি ব্রাত্য রাইসুকে কেন পছন্দ করি, আর তার সঙ্গে তর্ক করি, অন্যদের সঙ্গে করি না। এটাও পাবলিকলি আমাকে কৈফিয়ত দেবার দাবি উঠবে। উঠুক। বিনয়ের সঙ্গে মাফ চেয়ে আমি সালাহ উদ্দীন শুভ্রকে আর সরাসরি কিছু বললাম না। তিনি যেন নিজগুণে ক্ষমাঘেন্না করে নেন। দরকারি আলোচনায় কটাক্ষ ভাল লাগে না। আসল কথার খবর নাই, সেমিকোলন নিয়া টানাটানি। বিরক্তিকরও বটে। আমিও চাই না, মূল প্রসঙ্গ অনুসরণ ও বোঝার চেষ্টা না করে কেউ এখানে স্রেফ তর্কের খাতিরে তর্ক করুক। আমার আনুশেহ প্রীতি আর বেগুন প্রীতিতে শুভ্রের খুব অসুবিধা হৈতেছে। কী আর করবরে ভাই। দেশি বেগুন আমার পছন্দের। আর আনুশেহকে আমি গরিব, উপেক্ষিত, অতি সাধারণ বাউলদের সাধুসঙ্গে দেখি। অন্যদের দেখি না। বাউলদের নিয়ে তার মধ্যবিত্তসুলভ সেকুলার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা হতে পারে। সেটা ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু সাধকদের জগতকে সে সাধকদের জগত হিসাবেই বোঝার চেষ্টা করে। তার এই দিকটা আমি সমর্থন না করে পারি না। এখানে সে আমার কাতারে নেমে আসে, তাকে আমি তখন বুঝি ও চিনি।
অন্যদের জন্য বলে রাখা ভাল, আনুশেহকে স্নেহ করি, সেটা দোষ আকারে প্রথমে স্বীকার করে নিয়েছি, এই প্রীতিকে ‘স্নেহদুষ্ট’বলেছি। এই দোষ আমার পক্ষে কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব, তার কারনও কিছু উল্লেখ করেছি। আমি গুরুধরা মানুষ। আনুশেহ গান কেমন গায় সেই বিচার গানবিশারদদের ওপর ছেড়ে দিয়ে বলেছি, সাধকদের গানের মধ্যে ওর দ্রবীভূত হবার একটা চেষ্টা আছে, ভাবচর্চার দিক থেকে যার মূল্য অপরিসীম। সুর বা ভাষার বিচারই এখানে মুখ্য নয়। আনুশেহ যা গাইছে তার দ্বারা সে নিজে প্রভাবিত কিনা, কিম্বা প্রভাবিত হবার প্রক্রিয়াটা সে জারি রাখে কিনা, সেটাই আমার দিক থেকে প্রধান বিবেচ্য। আমার দাবি যে যে সে রাখে। সে খালি গায়ক থাকতে চায় না। সে কারনে শাহনাজ বেলী ওর চেয়ে ভালো লালন গীতি গাইলেও আনুশেহ ভাবচর্চার দিক থেকে অধিক মনোযোগ কাড়ে।
বলেছি, ব্যক্তি হিসাবে ওর লড়াইয়ের দিকটা আমি নিজের কারণেই বুঝি, আনুশেহর একটি গানই ওকে আমার কাছে নিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট ‘তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা’। যেন ওর নিজেরই কথা --সেভাবেই শুনি। ভাল লাগে। কারন এখানে ওর মতো আরও অনেককে আমি স্পর্শ বা উপলব্ধি করতে পারি। ওর সাম্প্রতিক চেষ্টা ‘রাই’ও আমি মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সময়ের অভাবে হয় নি। সরি, ওর প্রতি আমার স্নেহ ভাবচর্চার আগ্রহী হিসাবে পক্ষপাত দুষ্ট হলেও অবারিতই থাকবে। এটাকে ব্যাক্তিগত প্রীতি বলে কটাক্ষ করা একটু বিরক্তিকর বৈকি।
... ... ...
পার্বতীর গান বুঝতে বিটিবেগুনের উদাহরণ কেন? এই কুতর্কের ফেরেও পড়তে হচ্ছে। পাইরেসি বা চুরি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিটিবেগুনের উদাহরণ দিয়ে ‘স্বল্পে’ বোঝাতে চেয়েছিলাম। ‘স্বল্পেতে সব জানিতে হয় ভাব নগরে’ – লালন সাঁইজীর বরাত দিয়েও মাফ পাই নি।
বিটিবেগুনের উদাহরণ কেন? নয়ই বা কেন? বেগুন নিয়া এখন তর্ক চলছে যার সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থার ভবিষ্যৎ জড়িত। দেশি বেগুনের জাত এখানে বিটিবেগুন বানাবার কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশি বেগুনের ওপর এই কারিগরির কারনে একে দেখতে দেশিবেগুনের মতোই লাগে, কিন্তু টেকনলজি মনসান্তো-মাহিকোর। মালিকানাও তাদের। ব্যাক্টেরিয়ার জিন বেগুনে থাকে না, জবরদস্তি ঢোকানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিটিবেগুন বেগুনই। এখন কতোটুকু ব্যাক্টেরিয়া থাকলে এটাকে ব্যাক্টেরিয়া না বৈলা বেগুন বলব, সেই তর্ক তো আছেই।
বিটিবেগুনের উদাহরণ গানের বিচারেও কাজে লাগে। যেমন, লালন বা সাধকদের গান ব্যান্ডে বাজালে সেটা লালনেরই গান বলি আমরা, কিন্তু কতোটা তা সাধনা বা সাধকের গান হয়, আর কত্টা ব্যাণ্ড, কিম্বা কতোটা পশ্চিমা জিনিস – এই তর্কটা গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমার মনে হয়।
এটা বুঝাতে চাই যে কারও গানকেই আমি নাকচ করি না। কিন্তু ভাবের চর্চা আর গানের চর্চা এক জিনিস না। লালনের কথা, সুর ও গায়ন পদ্ধতি তার সাধনার জগতের অধীন, সে জগত মুছে দিয়ে শুধু তার কথা ও সুর ব্যবহার করে তাকে নিছকই ‘লালন সঙ্গীত’বানালেই সেটা লালন সঙ্গীত হয় না। এটাকে ‘চুরি’ বলে। পাইরেসি বলতে এই কথাটাই বলতে চেয়েছি।
ফরিদা পারভিন ব্যাণ্ডের ছেলেমেয়েদের ওপর ক্ষুব্ধ, গায়ক হিসাবে তাঁর নান্দনিক আপত্তি থাকতে পারে। আমি ক্ষুব্ধ না। আমার কারো প্রতিই বিদ্বেষ বা রাগ নাই। সাধনার জগত গানের জগত না এই ভেদবিচার ছাড়া কে কিভাবে গাইল সেই সাঙ্গীতিক বিচার এই জগতে গৌণ। আমার আপত্তি স্পষ্ট। সাধক শুধু কাঁচা মাল – কথা ও সুরের সাপ্লায়ার হবে, আর আমরা সেই কথা ও সুর উৎপত্তির জীবন চর্চা বা জগতকে অনাধুনিক, অসামাজিক, কিম্বা আধাত্মিক জগত বলে উপেক্ষা শুধু নয় ক্রমাগত ধ্বংস করে দেব -- কিন্তু তাদের সাধনার জিনিস চুরি করব -- একে রাজনৈতিক কারণেই আমি বিরোধিতা করি। ইথিওপিয়ার লোকদের বীজ ও খাদ্য ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে ওয়াশিংটনে ইথিওপিয়ান সংস্কৃতি বোঝাবার জন্য ইথিওপিয়ান রেস্টুরেন্ট খোলার মতো ব্যাপার। ওয়াশিংটনে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষের সময় এই রকম বড়লোকদের রেস্তোঁরা দেখেছিলাম বলে উদাহরণ দিলাম। সাধকের জগৎ ধ্বংস করে দিয়ে তাদের গান গাওয়াও সেই রকমেরই ব্যাপার।
সুর ও ভাষা সাধকের টেকনলজি। হাতিয়ার বা বাইরের জিনিস, এই দিক থেকে শরীরও বোধহয়। যাকে ‘আমি’ বলি সে শরীরে থাকে বটে, কিন্তু শরীরকেই তো সে ব্যবহার করে। নানা ভাবে। গলা দিয়ে ভাত খাওয়া বা নিশ্বাস নেবার কথা, কিন্তু তাকে নিজের অন্দর মহলের খবর জানান দেবার জন্য সুর ও ভাষা সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করতে দেখি আমরা। শরীরও তাই। নাচও ভাষা। কিন্ত কে সে? যে কথা বলে – ভাষিক – নিজেই চিহ্ন তৈরী করে, আর নিজেই তা ব্যবহার করে, কিন্তু ধরা দেয় না? (‘কথা কয়রে ধরা দেয় না’ -- লালন)। এই এক রহস্য সাধকের কাছে। ফলে চিহ্ন ব্যবস্থা এবং তার অন্তর্গত ব্যাকরণ এবং তার মধ্য দিয়ে যে ‘রূপের চর্চা’ তাকে ভাবান্দোলনের জায়গা থেকে বোঝা আর গান গাওয়ার প্রকরণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ/অগুরুত্বপূর্ণের বাছবিচার আলাদা। তার পাণ্ডিত্য ভিন্ন। বাংলার ভাবান্দোলনের যদি কোন ‘বিশেষ’ মুহূর্ত থেকে থাকে তাহলে গ্লোবালাইজেশানের এই কালে সেই মুহূর্তকে দৃশ্যমান করে তোলার সাধনা, ভাব বা চিন্তার জগতে নতুন তর্ক তৈরীর চেষ্টাকে বৈশ্বিক বলেছি। এটা প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই সম্ভব। সেই অস্বীকারের মধ্য দিয়ে, যাতে ভাবের চর্চা পুঁজির কাঁচা মালে পরিণত না হয়। ভাবেরই চর্চা হয়ে থাকে। নতুন মানে যে তর্ক বৈশ্বিক পর্যায়ে অনুপস্থিত, কিন্তু বৈশ্বিক পর্যায়ে তাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। যে তর্ক পাশ্চাত্য তুলতে ব্যর্থ তাকে ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের ভাবের শক্তি দৃশ্যমান করা, ইত্যাদি
প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে, টেকনলজির উদাহরণ টানবার দরকারই বা কি? টেকনলজির দিক থেকে গানের বিচারে বসলে নতুন কিছু প্রশ্নের দিকে আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করা সহজ হয়। এটা একটা দরকার। একতারা আর ডুগি তবলা দিয়া গান ও নাচের মধ্য দিয়া বিশুদ্ধতা রক্ষার আবদার আমি করি না। বিশুদ্ধ বাঙালি বা বিশুদ্ধ বাউল ভাব বৈলা কিছু আছে এটা আমি মনে করি না। বিশুদ্ধতার ধারণার মধ্যে বর্ণবাদ কাজ করে, টেকনলজির যুগে পার্বতীর এই ভাবচর্চাকে আমি নিছকই একতারা আর ডুগি তবলা হাতে ঘুরে ঘুরে গান গাওয়া আকারে হাজির করি নাই। ভাবচর্চার একটি বিশেষ ধারা – যা জীবন চর্চা থেকে আলাদা কিছু নয় – কিম্বা যেখানে ব্যক্তির জীবনযাপন ও তার শিল্পচর্চা আলাদা না, আমার আগ্রহ সেই দিকে। একে প্রতিরোধ হিসাবে দেখেছি। কোন অর্থে আগে তা ব্যাখ্যা করেছি।
এভাবে কি আর কেউ গায় না? অবশ্যই। যদি গায়কদের কথা বলে থাকেন তাহলে তারা গায়ক মাত্র। সাধকদের নয়। গানের সাধনা বলে একটা ব্যাপার আছে, মানি। কিন্তু ভাবের সাধনা আর গানের সাধনা সর্বদাএক নয়।
পার্বতীর মতো বাংলাদেশে কেউ থাকলে বৈলেন, ভেবে দেখব অবশ্যই।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।