বাম দিকে বেদ, ডান দিকে কোরান?
ইত্তেফাকের রিপোর্টে দেখলাম ছেউঁড়িয়ার অনুষ্ঠানে "একতারা হাতে সবাই গেয়ে ওঠেন 'ডানে বেদ, বামে কোরআন, মাঝখানে ফকিরের বয়ান, যার হবে সেই দিব্যজ্ঞান, সেহি দেখতে পায়'। লালনের এ রকম গান আছে আমার জানা নাই। জীবনে অজানা অনেক কিছুই থাকতে পারে। তবে নদিয়ার ফকিরেরা বাম দিকে বেদ আর ডানদিকে কোরান রেখে মাঝখানে আছেন -- এই তত্ত্ব বড়োই অ-লালনীয় ও অসম্ভব তত্ত্ব মনে হচ্ছে। দুনিয়ায় হিন্দু আর মুসলমান ছাড়া আরও মেলা ধর্ম সম্প্রদায় আছে। তারা ফকিরদের কোনদিকে আছে? ডানে না বামে?
লালনের নামে মেলা গানের প্রচার আছে। তাকে সেকুলার বানাবার চেষ্টাও নতুন কিছু না। যেমন,
'এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে...।
সুধীর চক্রবর্তী বহু বছর আগেই লালনের নামে এই ধরণের 'চমকপ্রদ' গান সম্পর্কে বলেছিলেন, 'গানটির মর্মবাণী খুব প্রাণস্পর্শী ও আধুনিক, কিন্তু কোন ভাবেই যে এই গান লালনের রচিত নয় তা সুনিশ্চিত'। (দেখুন, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৯২) তারপরও বাংলাদেশের সেকুলাররা তাদের স্বপ্নকে লালনের মধ্য দিয়ে প্রচার করে থাকেন।
তর্কটা সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়া না, জাতিবাদি, গণতান্ত্রিক বা আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রকল্প লালনের প্রকল্প নয়। সেটা অন্যত্র করা যাবে। জাত, পাত, শ্রেণি ও লিঙ্গভেদের কারণে মানুষের ইতিহাসের যে-পর্যায়টা অনিবার্য ভাবেই আত্ম-পরিচয়ের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক হিংসা ও নিজের বাইরে অন্যদের 'অপর' গণ্য করে এবং তাকে 'নির্মূল' করার মধ্য দিয়ে নিজেকে চরিতার্থ করতে চায়, ফকির লালন শাহ কিম্বা নদিয়ার ভাবের সঙ্গে তার কোনই সম্পর্ক নাই। সেই পর্যায় দ্রুত অতিক্রম করে যাবার ক্ষেত্রে লালন কারো কাছে প্রেরণা হতেই পারেন। কিন্তু সেটা নদিয়ার ভাবের খুবই বাইরের দিক। সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার স্বাভাবিক প্রকাশ মাত্র। তার আন্তরিক দিক যেন এতে আড়াল না হয়ে যায় তার জন্যই কথাটা তুলে রাখছি।
যাঁরা নদিয়ার ভাব বোঝার জন্য বিস্তর নিষ্ঠা ও শ্রম ব্যয় করছেন তাদের ভ্রমণ আরও অনেক দীর্ঘ ও গভীর।
'সামান্যে কি তার মর্ম জানা যায়?
হৃদকমলে ভাব দাঁড়ালে অজান খবর তারই হয়...'
এবার নবপ্প্রাণ আখড়াবাড়ির বিষয়ও তাই ছিল।
হৃদকমলে যদি 'ভাব' না দাঁড়ায় তো সবই বাহ্য। সবই কার্নিভাল, সবই বাজার।
http://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDNfMTlfMTRfMV8yXzFfMTE2ODc1
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।