বিশ্বাস ব্যবস্থায় আস্থা অনাস্থার তর্ক কিম্বা আমি ধর্মে বিশ্বাস করি কিনা

আশেকজনার নাই পারাপার থাকে না তার যাওয়া আসা

দিল হইতে 'দুই' উঠে যাবে, হবে রে মাশুকের নেশা

...

...

দিলে 'দুই' করেছে দখল

'দুই' নিয়ে বাঁধল গণ্ডগোল

 জহর বসে বাজায় বগল

           জ্ঞানের নয়ন নয় খোলাসা।।

(জহরদ্দি শাহ -- নদিয়ার ভাবচর্চার প্রধান পাঁচ ঘরের মধ্যে চৌধুরির ঘর একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ঘর' (school) হিসাবে স্বীকৃত। জহরদ্দি শাহের গান সেই ঘরের অন্তর্গত। এই ঘরের তত্ত্বকথা না জানলে নদিয়ার ভাব বোঝা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। উদ্ধৃতি জহরদ্দির একটি গান থেকে নিয়েছি। )

ফেইসবুকে আমার এক বন্ধু আমাকে অত্যন্ত আন্তরিক ও সরল ভাবে প্রশ্ন করেছেন আমি কোন ‘বিশ্বাস ব্যবস্থা’য় আস্থা রাখি কিনা। আমার অনুমান এই প্রশ্ন তাঁর একার নয়। হতে পারে আরও অনেকের। আমি এখানে সরল ভাবে যথাসাধ্য তার উত্তর দেবার চেষ্টা করেছি। আমাকে গ্রহণ বা বর্জনের জন্য অন্যদেরও কাজে লাগতে পারে।

১. প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কোন 'বিশ্বাস ব্যবস্থা' (belief system) মানি কিনা? সরল জায়গা থেকেই এই প্রশ্ন । এর উত্তর দেবার আগে ব্যাখ্যা দরকার নাস্তিক হোক কিম্বা আস্তিক -- কোন মানুষের পক্ষে কোন না কোন 'বিশ্বাস ব্যবস্থা'য় আস্থা ছাড়া দৈনন্দিন চলাফেরা বা সমাজে বাস করা সম্ভব কিনা। অনেকে আল্লায় বিশ্বাস করেন না, যুক্তি দিয়ে আল্লার অস্তিত্ব এমন ভাবে নাকচ করেন যাতে মনে হয় আল্লা বুঝি গাছ, পাথর, লোহা, লক্কড়ের মতো দেশকালপাত্রের অধীন বস্তু মাত্র। আল্লা ‘নাই’ হয়ে যায়। যে সকল আস্তিক বা বিশ্বাসী খেয়ে না খেয়ে আল্লাকে ‘আছে’ প্রমাণ করতে গিয়ে তাকে দেশকালপাত্রের অধীন সত্তায় পরিণত করেন তারাও নাস্তিক্যবাদীদের পদ্ধতি অনুসরণ করেন, অথচ নিজেদের আস্তিক দাবি করেন। যা ‘গায়েব’ বা যা নিরন্তর গরহাজির বা অনুপস্থিত তাকে এবাদত ছাড়া জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবে বোঝার চেষ্টা আহাম্মকি ছাড়া কিছু না। উপলব্ধি বা তার ‘সাক্ষী’ হওয়া তো অনেক দূরের কথা। এটা আমার পথ না। এই প্রকার ‘আস্তিক’ বা ‘নাস্তিক’ কেউই আমার ভাবচর্চা বা এবাদতের সঙ্গী নন। যুক্তিকেই যারা সত্য নির্ণয়ে একমাত্র গ্রাহ্য মনে করেন, তারা উভয়েই আল্লার জায়গায় যুক্তিকে প্রতিস্থাপন করেন -- এই হচ্ছে তফাৎ। যুক্তিবাদিতা জ্ঞানতত্ত্বের চূড়ায় পৌঁছালেও যুক্তিবাদিতা আরেকটি বিশ্বাস ব্যবস্থা মাত্র। আর, জ্ঞানতত্ত্বই যে সত্য নির্ণয়ের সদর রাস্তা না, সেটা ভাবুকেরা বহু আগেই দেখিয়ে গিয়েছেন। আস্তিকতা/নাস্তিকতা কিম্বা বিশ্বাস/অবিশ্বাস পুরানা বেহুদা তর্ক। এইসব ছেলেমানুষী ত্যাগ না করলে প্রজ্ঞার নয়ন খোলাসা হয় না।

২. জগতে একদিকে ধর্ম আর অন্যদিকে সেকুলারিজম -- এই রকম কোন বিভাজন নাই। প্রাইভেট/পাবলিক ভাগও আধুনিকতার সমস্যা, আমার নয়। আমার ভেতর আর বাহির একই প্রকার, আমার অন্তরের বিশ্বাস আর বাইরের জীবনের সঙ্গে প্রভেদ নাই। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে থেকে বিচ্ছিন্ন ‘ব্যক্তিগত জীবন’ নামক কোন বিভ্রান্তিতে আমি থাকি না। যারা নিজেদের 'সেকুলার' দাবি করে ও ধর্মকে প্রাইভেট ব্যাপার মনে করে তারা আদতে একটি 'বিশ্বাস ব্যবস্থা'য় আস্থা স্থাপন করে। ধর্ম যেমন একটি মতাদর্শ, তেমনি সেকুলারিজমও একটি মতাদর্শ -- আরেকটি বিশ্বাস ব্যবস্থা।

৩. যারা মনে করেন ধর্ম শুধু পরকালের জন্য, প্রচলিত কোন ধর্ম বিশ্বাসই সেটা একাট্টা দাবি করে না, এই রকম একাট্টা দাবির কোন নজির কোন ধর্মেই নাই। তবে ইহলোক মিথ্যা পরলোকই সত্য এই চিন্তার আধিপত্য নতুন কিছু নয়। এর পেছনে যে পলায়নবাদিতা কাজ করে সেটা ধর্মের মধ্যে যতোটা তার চেয়ে অনেক বেশী প্রকট আধুনিক কালে। আধুনিকতায়। বর্তমানকে নিয়তি বা অনিবার্য বলে মেনে নেওয়া আর জালিম ব্যবস্থাকে জালিম জেনেও তাকে সহ্য করবার সংস্কৃতি আধুনিককালেই প্রকট।

৪. বর্তমানের ইহলৌকিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাধান আগামি দিনে ‘সমাজতন্ত্র’ কায়েম হলে নিরসন হয়ে যাবে এটাও পরলোকবাদী ধর্মীয় চিন্তার অধিক কিছু নয়। ‘এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে’ – ধার্মিক হোক বা নাহোক এই প্রকার বিমূর্ত আগামির প্রচার পরলোকবাদী চিন্তার সারকথা। অন্যদিকে আধুনিক কালেই আমরা দেখি একদল পরকালের মুক্তির জন্য কিছু ইহকালীন বিধিবিধান ও আচার পালনকে ‘ধর্ম’ বলে আর তার পালটা আরেক পক্ষকে দেখি, ধর্ম বিশ্বাসজাত আচার আচরণ বা বিধিবিধানকে নাকচ করে দিয়ে ইহলৌকিক ধর্ম পালনকেই আরাধ্য গণ্য করে। যা আসলে জীবের ভোগী জীবন পালনের অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারে না। ভোগবিলাসী জীবনই যে কারনে ইহলৌকিকতার পরমার্থ হয়ে ওঠে। এরা পরিবেশ, প্রকৃতিসহ সকল প্রাণের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।

৫. ইহকাল/পরকালের বিভাজন নিয়ে ধর্মপ্রাণ সাধকদের ঘোর আপত্তি আছে।

“এপারে দুনিয়া ওপারে দ্বীন

আশেকজনা না করে ভিন

হয়েছে মাশুকের অধীন

ভিন্ন নাই এক রতিমাশা” (জহরদ্দি শাহ)

যে আসলেই আল্লার আশেকান হয়েছে, আল্লার প্রেমে মশগুল সে তো ইহকাল পরকাল ভেদ করে না। সেতো মাশুকের অধীন, তার দাস বা বান্দা হয়েই সে 'আছে'; তার আবার ইহকাল কি পরকালই বা কি? যে তার প্রেমিকের অধীনস্থ তার সঙ্গে তার মাশুকের এক রতি ভেদও নাই।

আমার বিশ্বাস ব্যবস্থায় ইহকাল পরকাল ভেদ নাই।

৬. অন্যদিক থেকে দেখুন, যারা ধর্মে বিশ্বাস করেন তাদের দৈনন্দিন সামাজিক জীবনের প্রায় পুরাটাই সেকুলার চর্চার মধ্যেই কাটে। সবজি বা মাছের বাজারে, চাকুরির ক্ষেত্রে, ইহলৌকিক বিষয় মোকাবিলা ও সমাধান তারা সবসময় ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে করে না । বিশেষ বিশেষ ধর্ম বিশ্বাস বহির্ভূত নানান সামাজিক, লোকায়তিক, সাংস্কৃতিক বিধিবিধান মান্য করেই মানুষ সমাজে বা ইহলোকে বাস করে।

৭. প্রচলিত কোন ধর্ম বিশ্বাস বা বিশ্বাস ব্যবস্থার চর্চা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে অসম্ভবও বটে। এই এক সমাজ যেখানে মানুষ পুঁজির 'এজেন্ট' হয়েই এই ব্যবস্থার মধ্যে বেঁচে থাকে বা বেঁচে থাকতে বাধ্য। সেটা পুঁজিপতি হয়ে হোক, কিম্বা হোক শ্রমিক বা বেতনভুক পুঁজির ব্যবস্থাপক হয়ে। অতএব মুখে যে যতো বড় বড় কথাই বলুক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে সকলে পুঁজির ধর্মই পালন করে। পুঁজি সর্বব্যাপী এক সামাজিক সম্পর্ক, এই সম্পর্কের বাইরে অবস্থান এ কালে আর সম্ভব না।

৮. এ কালে শুধু পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিরোধিতা ও তার রূপান্তরের জন্য লড়াই করতে গিয়েই বিপ্লবী কর্তাসত্তা হিসাবে এই ব্যবস্থার বাইরে আসবার সম্ভাবনা তৈয়ার হতে পারে এবং হয়ও। সে সম্ভাবনা কোন চেনা ধর্মের ডাকনামে হোক কি নতুন কোন মতাদর্শের ডাকে তাতে কিছুই আসে যায় না। সেই সম্ভাবনা তৈরির নতুন মতাদর্শ বা নতুন বিশ্বাস ব্যবস্থা নির্মানের ক্ষেত্রে মানুষ প্রচলিত ধর্ম বা বিভিন্ন দর্শন ও মতাদর্শ থেকে রসদ, অনুপ্রেরণা বা চিন্তা ও তৎপরতার সূত্র খুঁজে নেবে। নেবেই। কারন এটাই মানুষের ধর্ম। জালিম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে মনুষ্য ধর্মের এই সামাজিক-ঐতিহাসিক রূপটা আমি আন্তরিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করি। তার পক্ষে দাঁড়াই।

৯. সত্য জেনেও লুকানোকে বলে কুফরি। এ কালে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের বিদ্রোহই ধর্ম। ধর্ম হোক কি সেকুলার হোক -- এই সত্য জেনেও যেসকল মতাদর্শ তা লুকায় তারা কুফরি করে মাত্র। জন্মসূত্রে নিজেকে মুসলমান দাবি করা সহজ, কিন্তু কুফরি কাটিয়ে ওঠা কঠিন। অন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা হয়তো অন্য ভাবে বলা যাবে। মূল কথা হোল।, এ কালে পুঁজিতান্ত্রিক শৃংখলের কথা বাদ দিয়ে মানুষের শৃংখল ভাঙ্গা বা মুক্তির কথা বলা মিথ্যার বেসাতি ছাড়া কিছুই না।

১০. যারা কুফরিতে আক্রান্ত তারা আরেকটি সত্য লুকায়। সেই সত্য হোল স্রেফ বন্ধনের জন্য বন্ধন মানুষ মানে না, সেটা ধর্মীয় বিধি বিধান বা আধুনিক আইনকানুন যাই হোক। মানুষ প্রেমের বন্ধনের অধীন হতে চায়, তাই মাশুকের দাসত্ব মানে। প্রেমের আহবানেই মানুষ পরমের দাসত্ব কামনা করে। যে সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রেম নাই, জীবে দয়া নাই, প্রেমের তাগিদে মানুষসহ সকল প্রাণের সুরক্ষার ব্যবস্থা নাই সেই সমাজ বা রাষ্ট্র টেঁকে নি। আগামিতেও টিকবে না। নির্দয় সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অনিবার্য। আজ হোক, কাল হোক তার ক্ষয় হবেই। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার ক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু নতুন নির্মানের আগে অনেক প্রশ্নের উত্তর দরকার। কিন্তু সঠিক প্রশ্ন তোলা এবং উত্তর দেবার জন্য আমরা সক্ষম কিনা সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। যেমন দয়া বা অপরের প্রতি প্রেমকে কিভাবে সমাজ নির্মাণের ভিত্তি করে তোলা যায়, একালে এটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন। এর উত্তর এখনও জানা নাই। অথচ এটাই এ কালের বৈপ্লবিক রাজনীতির প্রধান বা কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। যার অভাবে অতীতের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

১১. প্রেমের তাগিদেই মানুষ আল্লার বান্দা হতে চায়, পুঁজির দাস বা পুঁজির বান্দা হতে চায় না। কারন পরমই আরাধ্য বা উপাস্য। আর একালে ‘প্রেম’ বা ‘আশেকানি’র কথা নতুন ভাবে প্রচার না করে এবং জালিমের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের কথা বাদ দিয়ে কোন ধর্ম বিশ্বাস বা কোন প্রকার বিশ্বাস ব্যবস্থার কথা বলা জুলুম ছাড়া আর কিছুই না।

যদি আমাকে আমার ‘বিশ্বাস’ দিয়ে বা কোন প্রকার বিশ্বাস ব্যবস্থার দ্বারা বিচার করতে চান, তাহলে এভাবে বিচার করতে পারেন। গ্রহণ বা পরিত্যাগ সর্বাংশে আপনারই অধিকার।

আসুন জালিমের বিরুদ্ধে লড়ি। এটাই এখনকার কর্তব্য। এখনকার ধর্ম।


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।