'হৃদয়পুর' নাকি 'রিদয়পুর'
ফরহাদ ভাই, বানান ভুল হয়েছে বোধহয়, ‘হৃদয়পুর’ হবে, ‘রিদয়পুর’ না, ঠিক না?
আমি ঘাড় ফিরিয়ে মুখটা চেনার চেষ্টা করি। সকালের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল, আকাশে তখনও মেঘ। ‘রিদয়পুর’। এটা রয়েছে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজিলা, পাথরাইল ইউনিয়ন, বিষ্ণুপুর গ্রামে। আমরা বলি বিদ্যাঘর। রিদয়পুর বিদ্যাঘর নিরক্ষরদের বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্র।
মনে হোল ব্যাখ্যাটা দেওয়া দরকার।
‘রিদয় বলে ছেলেটা নামেই হৃদয়, দয়ামায়া একটুও ছিল না’ – এই বাক্যটি যাদের মুখস্থ তারা জানেন ‘হৃদয়পুর’ না হয়ে ‘রিদয়পুর হয় কেন। অনেকে অবশ্য ‘বুড়োআংলা’র নামই শোনেনি। ফলে তারা তো জিজ্ঞাসা করবেই, আচ্ছা ‘রিদয়পুর কেন? বানানটাতো হবে ‘হৃদয়পুর’। ‘বুড়ো আংলার এই সূচনা বাক্যেই বোমাটা ফাটে। বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের ভাগ্য প্রসন্ন, যদি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছবি না এঁকে সাহিত্য করতেন তাহলে বাংলা সাহিত্যের ঠাকুর হওয়া রবির জন্য দুঃসাধ্য ছিল।
অক্ষরকেন্দ্রিক শিক্ষাকে রিদয়পুর বিদ্যাঘরে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করা হয় না, কিন্তু সেটাই বিদ্যাচর্চার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম এই কুসংস্কার এখানে নাই। গ্রন্থই শেষ কথা সেটা কেউ এখানে বিশ্বাসও করে না। যেমন প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, কৃষি, লোকায়তিক জ্ঞান ইত্যাদি শুধু বই পড়ে জানা ও রপ্ত করা অসম্ভব, চর্চা তো দূরের কথা। বাইরের জগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক চর্চার মধ্য দিয়ে যে বিদ্যা মুখস্থ ও মৌখিক তার জমাখরচের হিসাব সামাজিক স্মৃতির মধ্যে; কোন নোটবুক, লিখিত ম্যানুয়েল বা দলিলদস্তাবেজে তাদের ধরা যায় না । রিদয়পুর নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের সেই লৌকিক বিদ্যাচর্চার জায়গা।
নয়াকৃষি রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার এবং মাটির তলা থেকে পানি তুলে পরিবেশ ধ্বংসে বিশ্বাস করে না। প্রাণ, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র রক্ষা ও বিকাশ তার লক্ষ্য। প্রকৃতির সুপ্ত প্রাণশক্তির উন্মেষ ঘটিয়ে আবাদি ও অনাবাদি উভয় প্রকার ফসলের ফলন বাড়ায় নয়াকৃষি; দেখায় যে সার ও বিষ ছাড়াও অধিক ফলন সম্ভব। নবপ্রাণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করে নয়াকৃষি। বাংলার সাধক ও ভাবুকদের নিয়ে নবপ্রাণের কাজ – বিশেষত ফকির লালন শাহ ও নদিয়ার ভাবচর্চার ধারা যারা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
অবণ ঠাকুরের বর্ণনা: “তখন শীত গিয়ে গরম পড়তে আরম্ভ হয়েছে। গাছে-গাছে আমের বোল আর কাঁচা-আমের গুটি ধরেছে, পানাপুকুরের চারধার আমরুলীশাকের সবুজ পাতায় ছেয়ে গিয়েছে; আলের ধারে-ধারে নতুন দুর্বো, আকন্দফুল সবে দেখা দিয়েছে; দূরে শাল-পিয়ালের তেঁতুল-তমালের বনে নতুন পাটা লেগেছে, আর দেখতে দেখতে সমস্ত বন যেন পুরন্ত বাড়ন্ত হয়ে উঠেছে; রোদ পাতায়-পাতায় কাচা-সোনার রঙ ধরিয়ে দিয়েছে; কুয়াশা আর মেঘ সরে গিয়ে মনে হচ্ছে যেন নীল আকাশের কপাট হঠাৎ খুলে গেছে আর আলো আর বাতাস ছুটে বেরিয়ে এসেছে – বাইরে! রিদয়ের কুলুপ-দেওয়া ঘরেও আজ দরমার ঝাঁপগুলো ফাঁক দিয়ে রোদ উঁকি দিচ্ছে, বাতাস সরু সুরে বাঁশি দিয়ে ঢুকছে। রিদয় কিন্তু এসব দেখছে না, শুনছেও না। সে চুপটি করে নষ্টামির ফন্দি আঁটছে। কিন্তু গর্ত ফেলে ইঁদুর যে আজ নতুন বসন্তে শুকনো পাতায় ছাওয়া বাদামতলায় রোদ পোহাতে বেরিয়ে গেছে, বেরাল-ছানাটা কাঁঠালতলায় কাঠবেরালির সঙ্গে ভাব করতে দৌড়েছে, গোয়াল ঘরের কপলে গাই তার নেয়াল বাছুরটাকে নিয়ে ল্যাজ তুলে ঢেঁকির মতো লাফাতে-লাফাতে মাঠের দিকে দৌড় দিলে, ঘুলঘুলি দিয়ে সেটা হৃদয় স্পষ্ট দেখলে”।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা একটি ছবি
আমাদের জেনারেশানে সাহিত্য চর্চা করতে আসার আগে আমরা এইসব পড়ি। আর সেই মোক্ষ প্রচারে আমাদের সীমাহীন আনন্দ যে অবণীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্য রবীন্দ্রনাথের চেয়ে শতগুণ ভালো। যা রটাতাম, তার সর্বাংশে মিথ্যাও না। আপনি ‘বুড়ো আংলা’ পড়ে রায়টি দিন। তো যখন পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র নিয়ে কাজ করতে নামলাম তখন এইসকল বিষয়ে বুড়ো আংলায় অবণ ঠাকুরের বর্ণনায় এইসকল ছবি মাথা ভারি করে রাখত।
বুড়ো আংলায় গণেশ এক চরিত্র বটে। অবনেন্দ্র গণেশ ঠাকুরের মুখ দিয়ে যে কবিতা বলিয়ে ছেড়েছে সেটা ছিল আমার প্রিয়। শুঁড়ে-দাঁতে জাল কেটে গণেশ বলছে:
মার-মার ঘের-ঘার হান-হান হাঁকিছে,
হুপ-হাপ দুপ-দাপ আশ-পাশ ঝাঁকিছে!
অট্ট-অট্ট ঘট্ট-ঘট্ট ঘোর হাস লাগিছে,
হুম-হাম খুম-খাম ভীম শব্দ ভাষিছে!
ঊর্ধ্ব বাহু যেন রাহু চন্দ্র সূর্য পাড়িছে,
লম্ফ-ঝম্প ভূমিকম্প নাগ-দন্ত লাড়িছে!
পাদ-ঘায় ঠায়-ঠায় জোড়া লাথি ছুটিছে,
খন্ড খন্ড লন্ড ভন্ড বিস্ফুলিঙ্গ উঠিছে!
হুল-থুল কুল-কুল ব্রহ্মডিম্ব ফুটিছে,
ভস্মশেষ হৈল দেশ রেণু রেণু উড়িছে!
আজ এতোটুকুই।
রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডা ২০১৪ হয়েছে রিদয়পুরে। আশা করি ভবিষ্যতে আরও হবে। সবার জন্য এর নাম ‘রিদয়পুর’ হোল কেন সেটা খানিক ব্যখ্যা করলাম।
“রিদয় বলে ছেলেটা নামেই হৃদয়, দয়ামায়া একটুও ছিল না। পাখির বাসায় ইঁদুর, গরুর গোয়ালে বোলতা, ইঁদুরের গর্তে জল, বোলতার বাসায় ছুঁচোবাজি, কাকের ছানা ধরে তার নাকে তার দিয়ে নথ পরিয়ে দেওয়া, কুকুর-ছানা বেরাল-ছানার ল্যাজে কাঁকড়া ধরিয়ে দেওয়া, ঘুমন্ত গুরুমহাশয়ের টিকিতে বিচুটি লাগিয়ে আসা, বাবার চাদরে চোরকাঁটা বিঁধিয়ে রাখা, মায়ের ভাঁড়ার-ঘরে আমসির হাঁড়িতে আরশোলা ভরে দেওয়া – এমনি নানা উৎপাতে সে মানুষ। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সবাইকে এমন জ্বালাতন করেছিল যে কেউ তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না।...”। ইত্যাদি।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।