'সহিত' থেকে 'সাহিত্য' ?

‘প্রতিপক্ষ’ সাহিত্য বোঝাতে বাংলায় ‘সহিত’ থেকে সাহিত্য এই ব্যুৎপত্তির তাৎপর্য কবুল করে। সেটা প্রমাণ করবার জন্য তারা নূরুল আলম আতিক, মোহাম্মদ আজম আর মাহবুব মোর্শেদকে রিদয়পুর বিদ্যাঘরে তাদের সাহিত্য আড্ডায় হাজির করে। তিনজন তিন ভাবে তঁদের কাজের ক্ষেত্রের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলেন। আমি সকলের কথা ‘সহিত’ থেকে সাহিত্য এই সূত্রে বোঝার চেষ্টা করেছি। তাঁদের পরিবেশনা সম্পর্কে দ্রুত কিছু সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করে রাখতে চাইছি। যাতে পরে আরও বিস্তারিত লিখতে পারি। প্রথমে নূরুল আলম আতিকের উপস্থাপনা নিয়ে।

আতিক যখন 'সিনেমার নিজস্ব ভাষার খোঁজে' নিয়ে কথা বলছিলেন তখনই আমার মনে সিনেমা ব্যাপারটা আসলে কী এই প্রশ্নটা জেগেছিল তীব্র ভাবে। সেটা কি সাহিত্য? নাকি অন্য কিছু?

এ প্রশ্ন আমার কাছে নতুন তা নয়। আতিক কথা বলছিলেন কম, কিন্তু দারুন কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখাচ্ছিলেন। তাঁর কথা থেকে তাঁর সিনেমা ভাবনা যেমন বুঝেছি, তেমনি ‘সিনেমার ভাষা’ বলতে আতিক ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন সেটা মাল্টিমিডিয়ায় দেখানো ক্লিপগুলো দেখে আরও পরিচ্ছন ভাবে ধারণা করতে পেরেছি বলে মনে হয়। নতুন ভাবে ভাবনার উসকানিও বোধ করেছি।

এখন আমি মোটামুটি নিশ্চিন্তে দাবি করতে পারি যে সিনেমা ‘সাহিত্য’ অবশ্যই – সেও সকলের ‘সহিত’ সম্পর্ক চর্চার, যাপন করবার এবং প্রয়োজনে নতুন করে নির্মান করবারই ব্যাপার। এই সকলের মধ্যে আপন পর সকলেই আছে। বলা অনাবশ্যক যে মুখের ভাষার সঙ্গে ছাপাখানার মুদ্রিত অক্ষরের মাধ্যমে সাহিত্য চর্চার যেমন ফারাক আছে তেমনি সিনেমার ভাষায় সাহিত্য চর্চারও ভিন্নতা আছে। প্রতিটি ভাষারই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য আছে। চিত্রকলাকেও বাদ দেই কেন? কিম্বা নাটক? যদি ‘সহিত’ থেকে সাহিত্য হয় তো যে কোন ভাষাতেই সাহিত্য হতে পারে। সবই সাহিত্য। সাহিত্য মানে কোন না ভাষায় বা মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা। অন্যদিকে সাহিত্য নামক ধারণার সঙ্গে মাধ্যমের কোন সম্পর্ক নাই। উভয়ের সম্পর্কে বিযুক্তি এ কালে জরুরী, কারন বই বা লেখালিখিকেই নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই ভাগ মানুষ ‘সাহিত্য’ গণ্য করেন। তাঁদের অনুমান সাহিত্য একটি বিশেষ মাধ্যমের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। সেটা হোল ছাপাখানা। ক্যামেরার মতোই যা আরেকটি টেকনলজি মাত্র। আমার দাবি, ‘সাহিত্যওয়ালাদের হাত থেকে ‘সাহিত্য’ কথাটা কেড়ে নেওয়া দরকার, নইলে বাংলায় ‘সাহিত্য’ কথাটির দুর্দান্ত গরিমা এ কালে কায়েম করা যাবে না।

atiq

নূরুল আলম আতিক

তো প্রতিপক্ষ নূরুল আলম আতিককে দিয়ে তাদের রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডা শুরু করে এই ঘোষণাটাই বোধ হয় দিতে চেয়েছে যে সিনেমা সাহিত্যচর্চারই অন্তর্গত, কিন্তু যারা এই সাহিত্য চর্চা করেন তাঁদের সিনেমার ভাষায় কথা বলতে জানতে হবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সিনেমার ভাষায় কথোপকথন রপ্ত করা। যে গল্প বা বক্তব্য বই লিখে বা মঞ্চে অভিনয় করে বলা যায় সেটা সিনেমার ভাষায় বলবার কোন মানে হয় না। যদি এটা মানি তো একই সঙ্গে কবুল করতে হয় আমরা তো অল্প কয়েকজন ব্যাতিক্রম ছাড়া আসলে সিনেমা বানানো এখনও রপ্তই করি নি। 'ডুবসাঁতার' দেখার সময় থেকে নুরুল আলম আতিক সেই দিক থেকে আমার তুমুল আগ্রহের মানুষ ।

সিনেমাকে আমরা এখনও মঞ্চে অভিনীত যাত্রা বা নাটক ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করা বুঝে থাকি। তাকেই সিনেমা বলে চালিয়ে দিতে চাইছি। কিম্বা যেন হুমায়ুন আহমদের উপন্যাস পড়ছি সেলুলয়েডে। সেটা হোক, আপত্তি করি না। কিন্তু সিনেমা তো দরকার। তার জন্য সিনেমার ভাষা পুরাপুরি রপ্ত করা দরকার। যারা সিনেমা বানাবে তারা যেমন রপ্ত করবে তেমনি সেই ভাষা বোঝে এমন দর্শক তৈয়ারি না হলে সিনেমা হবে না। সিনেমার ভাষাটা কেমন সেটাই আতিক তাঁর কথা ও ক্লিপ দিয়ে বুঝিয়েছেন আমাদের। রিদয়পুরে।

পুরা সময় মনে হচ্ছিল শুধু সিনেমা নিয়েই বড়সড় আড্ডা ও কর্মশালা হওয়া দরকার। যতো দ্রুত সম্ভব। যাতে বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য চর্চা কথাটার মানে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক এই দুই অর্থেই আমরা রপ্ত করতে পারি। আমাদের প্রচুর ছবি বানানেওয়ালা দরকার। ছবি বানাবো এই স্বপ্ন নিয়ে দামি দামি ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চেয়েও ছবি বানানো ভাল কাজ। কে বলেছেন? আমি বললাম এখন। এটা আমাদের বুঝতে হবে যে সিনেমার ভাষা না বুঝলে বাংলাদেশে সিনেমা হবে না। তাই না? আশা করি প্রতিপক্ষের আয়োজকেরা আমার অনুরোধটা আমলে নেবেন।

আমি ক্লিপগুলো নূরুল আলম আতিকের কাছ থেকে নিয়েছি, আরও অনেকবার দেখব, এবং নিজের অনুভূতি বা উপলব্ধির কথা সুযোগ মতো সবাইকে জানাবো। তাঁকে ধন্যবাদ তাঁর বহু পরিশ্রমের সংগ্রহ তিনি শেয়ার করেছেন। এই ভাষাটা আমি নিজেও বুঝতে চাই যাতে সিনেমা পড়তে পারি ও বুঝতে পারি।

সিনেমার ভাষা নিয়ে বিস্তর বইপত্র দেখেছি। কিছু পড়েছি। অধিকাংশ লেখালিখি তত্ত্ববাগীশতায় পাত্থর মনে হয়। অথচ আতিকের প্রেজেন্টেশান দেখে ও শুনে আমার মনে হয়েছে সিনেমার তত্ত্ব নিয়ে কয়েক হাজার বই পড়ার অভিজ্ঞতা হোল আমার। সিনেমা নিয়ে লিখবার ইচ্ছা জাগছে। এর আগে সিনেমা নিয়ে লিখার ইচ্ছা থাকলেও দুই একটি বিচ্ছিন্ন লেখা ছাড়া লিখবার তাগিদ বোধ করিনি বিশেষ। নিজে ছবি বানান বাংলাদেশের এমন একজন প্রতিভাবান মানুষের সঙ্গে দীর্ঘসময় সঙ্গ করারা সুযোগ পেয়ে এখন খুব উৎসাহিত বোধ করছি। নিজের সংগ্রহে রাখা সিনেমার ক্লিপ রিদয়পুর সাহিত্য আড্ডায় নূরুল আলম যেভাবে হাজির করলেন ও ফাঁকে ফাঁকে কথা জুড়ে দিলেন, তাতে আমি নিশ্চিত আমার মতো আরও অনেকে উৎসাহিত হয়েছেন।

দারুন কাটল দুইদিন। ধন্যবাদ সবাইকে যারা রিদয়পুরে গিয়েছিলেন। আর যারা যেতে পারেন নি, কিন্তু উৎসাহিত করেছেন প্রচুর, তাঁদেরকেও।


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।