পদ্ধতি বিষয়ক আলোচনা
চিন্তা পাঠচক্রের ‘বিষয়বিদ্যা’ নিয়ে পাঠচক্রের দ্বিতীয় পর্বে যারা অংশগ্রহণ করছেন তাঁদের জন্য সজ্ঞান, সচেতন ও যুক্তিপরম্পরার শৃংখলা মেনে চিন্তার পদ্ধতি কেমন হতে পারে তার নমুনা বোঝার জন্য রনে দেকার্তে’র চিন্তার পদ্ধতি সংক্রান্ত পুস্তিকাটির ( Discourse de la Methode) কথা বলেছিলাম। লোকনাথ ভট্টাচার্য মূল ফরাসী ভাষা থেকে বইটি অনুবাদ করেছেন। ওরিরেন্ট লংম্যান থেকে প্রকাশিত পুস্তিকাটি আমার কাছে ছিল, কিন্তু বাসস্থান বদলে কারনে এলোমেলো হয়ে আছি। আজ বাংলাদেশের ‘অবসর’ প্রকাশনী থেকে বইটির পুনর্মূদ্রণ হাতে পেলাম। অনুরোধ করব পাঠচক্রে যারা আরও মনোযোগী হতে চান, তারা বইটি সংগ্রহ করবেন এবং দ্রুত পড়ে ফেলবেন। এ বইটি এডমুন্ড হুসার্লের ‘কার্তেসিয়ান মেডিটেশান’ বইটি অনুসরণ করতে আমাদের খুবই কাজে লাগবে।
দেকার্তের এই বইটি সাহিত্য কর্ম হিসাবেও বিখ্যাত। তাঁর সময় দর্শন চর্চার ভাষা ছিল ল্যাটিন। যে ভাষা সাধারণ মানুষ বুঝতো না। কিন্তু এই বই তিনি তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও ল্যাটিন জানেওয়ালা অভিজাত শ্রেণির জন্য লেখেন নি। লিখেছিলেন নিজের মাতৃভাষায়। নিজের মাতৃভাষায় চিন্তা করতে সক্ষম যে কোন মানুষই তাঁর এই পুস্তিকা পড়ে আনন্দ পেয়েছেন। একই সঙ্গে দর্শনের জমি ও ভূগোল দুটোই দেকার্তে আমূল বদলে দিয়েছেন।
বিষয়বিদ্যা নিয়ে যে নোটগুলো ইতোমধ্যে আমরা পেশ করেছি সেখানে আমাদের পরিশ্রমের প্রধান একটি দিক হচ্ছে মাতৃভাষায় চিন্তা বা দর্শন চর্চা করতে শিখা। পরিভাষা নিয়ে আমরাও নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি। নতুন দর্শন ও ভাবচর্চা একই সঙ্গে নতুন ভাষা নির্মাণের দুরূহ কাজটা না সেরে কদম বাড়াতে পারে না।
দর্শন মাত্রই সাহিত্য, সাহিত্যের সঙ্গে দর্শনের এখানে একটা যোগসূত্র আছে। সাহিত্যের একটি প্রধান কাজ নতুন ভাষা তৈয়ারি, নতুন বাচনভঙ্গী বানানো ইত্যাদি। কিন্তু সাহিত্য মানেই দর্শন নয়, সাহিত্যের সেটা হবার কোন দরকার নাই। অন্যদিকে মানুষ চিন্তা করতে পারে, এটা আমরা জানি বা বিশ্বাস করি; কিন্তু কথা বললেই, বা লিখলেই সেটা দর্শনের দিক থেকে ‘চিন্তা করা’ (ক্রিয়া পদে) হয়ে যায় না। দর্শনের একটা পুরানা দাবি হচ্ছে তার নিজের একটা রূপ আছে, সেই রূপের সঙ্গে দার্শনিক-সাহিত্যের সঙ্গতি থাকতে হবে। দর্শন মানেই সাহিত্য – কিন্তু সাহিত্য মানেই দর্শন বা চিন্তার সক্রিয় রূপ নয়। এ কথাগুলো নিয়ে আমরা আরও ভাবতে পারি। কোন একটি পাঠচক্রে আরও আলোচনা করতে পারি।
কথাটা ওপরে যতো সরল মনে হয়, আসলে কিন্তু অতো সরল নয়। মার্টিন হেইডেগারকে একবার বলতে হয়েছে, “চিন্তা করা বলতে কী বোঝায় সেটা আমরা টের পাই যখন আমরা নিজেরা চিন্তা করবার চেষ্টা করি। আর এই চেষ্টাকে যদি সফল করতে হয় তাহলে চিন্তা করা শিখবার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে” (What is called Thinkingf?)।
থতমত খাবার মতো দাবি। আমরা ধরে নিতে পারি না যে আমরা চিন্তা করতে পারি। চিন্তা করাটা শিখতে হয়। এটা শেখার জিনিস। মানুষ চিন্তা করতে পারে, এটা একটা সম্ভাবনা। কিন্তু চিন্তা করতে না শিখলে চিন্তা করা যায় না।
ঠিক যেমন, মানুষ সাঁতার কাটতে পারে। কিন্তু সাঁতার না শিখলে সে সাঁতার দিতে পারে না।
তাহলে চিন্তা করা শেখার ব্যাপার, চিন্তা করবার স্বভাব মানুষের মধ্যে থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষ চিন্তা করে। তো এই কথা বলার পর হেইডেগার আরেকটি তাজ্জব কথা বললেন: ব্যাপারটা টের পাবার পর “যখনই আমরা এই ধরণের শেখার মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত করি তো তখন মেনে নেই যে আমরা এখনও চিন্তা করতে সক্ষম না” (একই বই)। যারা মজা পেতে চান তারা বইটি সংগ্রহ করে পড়তে পারেন।
কিন্তু হেইডেগার বোঝার আগে পাশ্চাত্য দর্শনের আরও অনেক মহারথীর চিন্তার সঙ্গে আমাদের আরও ঘনিষ্ঠ পরিচয় দরকার। রনে দেকার্তে (31 March 1596 – 11 February 1650) যেমন। দেকার্তের মধ্যস্থতায় আমরা এডমুন্ড হুসার্ল’-এর ‘দেকার্তীয় ধ্যানের স্বরূপ: বিষয়বিদ্যার ভূমিকা (Cartesian Meditation: An Introduction to Phenomeology) পড়তে পারি। বৃহস্পতিবার পাঠচক্রে সবাইকে আমন্ত্রণ।
নিজের সম্পর্কে লেখক
কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।