জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা বনাম জ্ঞানের নিশ্চয়তা

আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর। সাম্প্রতিক বিষয়াদি নিয়ে কথাবার্তা আর ‘বিষয়বিদ্যা’ কে কতোটা পড়েছি তা ঝালিয়ে নেবার দিন। ঠিক পাঁচটায়, স্যার সৈয়দ রোডে নারী গ্রন্থ প্রবর্তনায়। ৬/৮ স্যার সৈয়দ রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

রনে দেকার্তের ‘পদ্ধতি বিষয়ক জটিলতা’ চোখ বুলিয়ে এলে ভাল। গত বৃহস্পতিবারে আমরা একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আলাপ করছিলাম। সেই প্রশ্নের সূত্র ধরে আমরা দেকার্তে (১৯৫৬ -১৬৫০) থেকে কান্ট (১৭৭৪ -১৮০৪), কান্ট থেকে হেগেল (১৭৭০ - ১৮৩১) এবং হেগেলের পরে মার্কস (১৮১৮ -১৮৮৩) এবং পাশাপাশি ব্রেনতানো (১৮৩৮ - ১৯১৭) ও এডমুন্ড হুসার্লের (১৮৫৯ -১৯৩৮) হাত ধরে দর্শন পাশ্চাত্যে কিভাবে ‘বিষয়বিদ্যা’ হয়ে উঠল তা দ্বিতীয়পর্বের পাঠচক্রে যারা নতুন এসেছেন তাদের জন্য আলোচনা করেছি। একসময় জগতকে জানা ও জগতে আমাদের কর্তব্য কী, ইত্যাদি বিষয় জানা আলাদা কোন ব্যাপার ছিল না। জ্ঞানচর্চা ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন – এভাবে বিভক্ত ছিল না। সবই জানার বিষয় ছিল। দর্শন বলতে সাধারন ভাবে আলাদা কিছু বোঝালেই সেটা ছিল স্রেফ জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা। জ্ঞানের কথা শুনতে ভাল লাগে। সবই দর্শন। ফিলসফি।

এখন জ্ঞান নানান বিষয়ে বিভক্ত। ভাগাভাগি, বিভক্তি ও একটিকে অপরটির বিরুদ্ধে প্রতিস্থাপনের অভ্যাসের ফলে এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এখন আমাদের কাছে অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন। বিষয়ের দিক থেকে তাদের পার্থক্য এবং বিষয় বিচারের পদ্ধতিগত ফারাক বোঝাও এখন রীতিমতো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। আমরা ‘বিষয়বিদ্যা’ পড়ছি চিন্তার দিক থেকে এই সকল বিষয় সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন হবার জন্য।


Nasrin

ঝরাপাতা/ নাসরিন বেগম।


গত বৃহস্পতিবারে বলেছিলাম, জানা মানেই যুক্তিসর্বস্ব নিশ্চিত জ্ঞান, জানাজানির ব্যাপারটা এরকম আধুনিক যুক্তিসর্বস্ব নিশ্চয়জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সেটা বোঝাবার জন্য একটি প্রশ্ন ধরে আলোচনা করেছিলাম যাতে আমরা বুঝতে পারি স্রেফ একটি প্রশ্ন মানুষের ইতিহাসকে কিভাবে বদলে দিতে পারে। এটা বুঝলে জগতের সঙ্গে আমাদের নিত্যদিনের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার সম্পর্ক তো স্রেফ যুক্তির না – একালে যুক্তি ও বুদ্ধির সর্দারিকে প্রশ্ন করা কেন জরুরী হয়ে পড়েছে সেটা আমরা বুঝব।

প্রশ্নটি হোল, ‘আমরা যে জানি তা আমরা কি করে জানি’? খুব কঠিন প্রশ্ন কি? আসলেই তো, আমরা যখন বলি আমরা জানি তখন আমরা কিভাবে নিশ্চিত বা নিঃসংশয় হই যে আমরা আসলেই সেটা জানি। এই প্রশ্ন মনে রাখলে আমরা বুঝব কেন রনে দেকার্তে আধুনিক মন তৈয়ারি ও পাশ্চাত্য সভ্যতার গোড়ার অনুমানগুলোর পত্তন ঘটিয়েছিলেন। এক সময় ফিলসফি বা দর্শন বলতে বোঝাতো 'জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা'। সেটা বদলে গেল ‘জ্ঞানের নিশ্চয়তা’র দাবিতে। আমরা যা জানি তা যে নিশ্চিত ভাবেই জানি সেটা প্রমাণ করাই জ্ঞানচর্চার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠল। যা নিশ্চিত ভাবে জানি না, বা যা নিশ্চিত ভাবে যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয় সেই উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা খারিজ হয়ে গেলো। মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূতি, উপলব্ধি, বা জগতের সঙ্গে অব্যবহিত জাগতিক সম্পর্ক বিচারের একমাত্র ছাঁকুনি হয়ে উঠল বুদ্ধি। তার তলার ফুটা দিয়ে যা ঝরে গেল মানুষের জ্ঞানের জগতে তার আর কোন মুল্য রইল না। বিষয়বিদ্যা এই পরিস্থিতির অবসান ঘটনোর বাসনা নিয়ে হাজির হয়।

আমরা যে জানি বা মানুষের পক্ষে আদৌ কিছু জানা সম্ভব তার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে জ্ঞানের নিশ্চয়তা প্রমাণের দিকে যাত্রা শুরু হয়। নিশ্চয়জ্ঞান সম্ভব কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রনে দেকার্তে একমাত্র ‘আমি’ বা চিন্তাশীল মনই নিশ্চিত ভাবে আছে – এই অনুমান থেকে শুরু করেছিলেন। আর এটা করতে গিয়ে তিনি জগতকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেললেন। একদিকে ‘আমি’ – যে নিজেকে নিশ্চিত ‘আছে’ বলে জানে আর তার বাইরে ‘আমি’র জগত – কখনও সে জগত চিন্তার বিষয়, কখনও স্রেফ ভোগের, ব্যবহারের; কখনও কল্পনার -- কাব্য ও শিল্পচর্চা ইত্যাদির। রনে দেকার্তে জগতকে মানুষ ও প্রকৃতি এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেললেন। কিম্বা একদিকে ভাব বা ভাবজগত আর অন্যদিকে বস্তু বা বস্তুজগত। এখান থেকেই ‘কার্তেসিয়ান ডুয়ালিজম’ বা দেকার্তীয় ফারাকগিরির উৎপত্তি। চিন্তাকে পরিচ্ছন্ন ও সুশৃংখল ভাবে পরিচালনার জন্য দেকার্তে অনুপ্রেরণা হলেও মূলত এই ফারাকগিরি ও বিভাজনের বিরুদ্ধেই ‘বিষয়বিদ্যা’ দাঁড়ায়।

দেকার্তে যে ঠিক বলেন নি এটা আমরা অনুমান করতে পারি। কারন বুঝি, মন বা মনের ভাব তো আর শরীরের বাইরে থাকে না। একটি উদাহরণ দিয়ে বলি।

আমরা যখন কোন শারিরীক দক্ষতা অর্জন করতে শিখি তখন মন সেখানে আর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে না। কোন বস্তু, বিষয় বা পরিস্থিতিকে সরাসরি যেভাবে আমরা অভিজ্ঞতায় প্রত্যক্ষ ভাবে উপলব্ধি করি আর মোকাবিলা করা শিখি তার মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতে একই বস্তু, বিষয় বা পরিস্থিতিকে কিভাবে মোকাবিলা করব তা ঠিক হয়। দক্ষতা বাড়ে। তার মানে বিশেষ বিশেষ দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ধরণ বদলে যায়। অর্থাৎ বিমূর্ত চিরায়ত ‘আমি’ নামক কিছু অনুমান করা যেমন মুশকিলের, তেমনি তার বাইরে বিমূর্ত চিরায়ত একটা জগত আছে সেটা অনুমান করাও সমান বিভ্রান্তির। জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা ও মোকাবিলার মধ্য দিয়ে ‘আমি’ ও জগত উভয়েই বদলে যায়। এই ‘আমি’ জ্ঞানকর্তা হতে পারে, জগত যার কাছে শুধু জ্ঞানের বিষয় মাত্র। কিম্বা শিল্পী, কবি, বিজ্ঞানী, ইত্যাদি।

অন্যদিকে শরীর বাদ দিয়ে ‘আমি’ বা মন নামক কোন কিছুর বিমুর্ত অনুমানও অর্থহীন, যদি না ‘আমি’, ‘মন’ ইত্যাদি বলতে আমরা সুনির্দিষ্ট ভাবে কী বোঝাই সেটা পরিষ্কার করি। কারন আমি ও আমার শরীর একসঙ্গেই কাজ করে নইলে কোন কিছুতে দক্ষতা অর্জন অসম্ভব। ‘মন’ নামক ব্যাপারের কারবারকেও অতএব নিছকই মানসিক ব্যাপারে পর্যবসিত করা ঠিক না। শরীরের ব্যাপারও স্রেফ শারিরীক না।

দিল হইতে দুই উঠে গেলে বিষয়বিদ্যার দিকে যাত্রা শুরু সহজ হয়।

আরও কথা হবে। আজ।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪, বৃহস্পতিবার

 

 

 


নিজের সম্পর্কে লেখক

কবিতা লেখার চেষ্টা করি, লেখালিখি করি। কৃষিকাজ ভাল লাগে। দর্শন, কবিতা, কল্পনা ও সংকল্পের সঙ্গে গায়ের ঘাম ও শ্রম কৃষি কাজে প্রকৃতির সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে থাকে বলে মানুষ ও প্রকৃতির ভেদ এই মেহনতে লুপ্ত হয় বলে মনে হয়। অভেদ আস্বাদনের স্বাদটা ভুলতে চাই না।



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।