দিল্লির নয়া কূটনীতি: টিপাইমুখের বদলে ট্রানজিট?

মূল: মামুন নেসার বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অনেক অমীমাসিংত বিষয় থাকলেও এসেছে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু। এ ইস্যু কয়েক মাস ধরে মিডিয়া আর রাজনীতি উভয় মাঠই দখল করে রেখেছে। অথচ গত কয়েক বছরে দু’দেশের এজেন্ডায় একবারেই মুখ্য ছিল না বিষয়টি। প্রণব মুখার্জির ফেব্রুয়ারির ঢাকা সফরের সময়েও আলোচনায় ছিল না এটি। এছাড়া টিপাইমুখ নিয়ে ভারতের হঠাৎ আক্রমণাত্মক কূটনীতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার একের পর এক উত্তেজক মন্তব্যের মাধ্যমে এর বিরোধিতাকে উসকে দিচ্ছেন। আর এ কারণেই টিপাইমুখ ইস্যু জিইয়ে রেখে ট্রানজিট বা সন্ত্রাসবাদ দমন নিয়ে ভারত বিশেষ কোন কূটনৈতিক সুবিধা পেতে চাইতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র। কারণ টিপাইমুখ নিয়ে বাংলাদেশে যত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, ততখানি ভারত অগ্রসর হয়নি বলেই মনে করছে ওই সূত্র। ভারতের বিদেশ সচিব শিবশঙ্কর মেনন যখন মার্চের শুরুতে ঝটিকা সফরে ঢাকা আসেন, ঠিক তার আগে একটি মহল টিপাইমুখ প্রসঙ্গটি নিয়ে আসে। জকিগঞ্জের স্থানীয় সূত্রে পাওয়া একটি রিপোর্ট নিয়েই টিপাইমুখ ইস্যু মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, সীমান্ত থেকে এক কিলোমিটার দূরে ভারত প্রস্তাবিত এ বাঁধের কাজ শুরু করে দিয়েছে। রিপোর্টটি দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তুললে এর কয়েকদিনের ভেতরে ঢাকা সফরে আসা ভারতের বিদেশ সচিবকে প্রো-অ্যাকটিভ মিডিয়া প্রশ্নটি করতে ছাড়েনি। বিদেশ সচিব প্রশ্নটির জবাব দেন এভাবে, ভারত বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না। তিনি টিপাইমুখ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনেরও প্রস্তাব করে বসেন। তবে পরিদর্শনের প্রস্তাব নিয়ে ঢাকার তরফে কোন চাপ ছিল না। সেগুনবাগিচার কূটনীতিকরা ওই প্রস্তাবে অনেকটাই অবাক হয়েছিলেন। একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এর আগে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন টিপাইমুখে ভারত নির্মাণকাজ শুরু করেছে এমন কোন তথ্য নেই বলে জানিয়েছিলেন। তার সে বক্তব্য আমলেই নেয়া হয়নি। তিনি এ সম্পর্কে ভারতের কাছে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে বললেও তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। শিবশঙ্কর বাংলাদেশের বিভেদ আর অনৈক্যের দুই শিবিরের রাজনীতির মাঠে আসল বলটা ঠেলে দিলেন যেন। বিডিআর বিদ্রোহ ইস্যুকে ছাপিয়ে জায়গা করে নিলো টিপাইমুখ। শুরু হয়ে গেল সরকারি দলের সাফাই গাওয়া আর দেশের প্রায় সকল মহলের বিরোধিতা। কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে হঠাৎ এ রকম ডামাডোলের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই হিসেবে এ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ অথচ নবীন নীতি-নির্ধারকরাও বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দেননি। সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলে প্রাথমিক ধারণা ছিল, বিষয়টি ইস্যুহীন বিরোধী দলের মাঠ গরম করার দুর্বল চেষ্টা মাত্র। পানিসম্পদ মন্ত্রীর তরফে কয়েকটি অবাঞ্ছিত মন্তব্যকে ঘিরে মাঠ গরম হয়েছিল, তবে সরকারেরই কয়েক মন্ত্রীর তীব্র বিরোধিতায় তা আবার স্তিমিতও হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট একটি কূটনৈতিক সূত্রের পর্যবেক্ষণ হলো, ভারতের পক্ষ থেকেও এ ইস্যু নিয়ে মাঠ গরমের কূটনৈতিক চেষ্টা শুরু হয় তখন থেকেই। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীও এ সময় টিপাইমুখ নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন। ট্রানজিট যার আওতায়, সেই ইস্যু কানেকটিভিটি নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি টিপাইমুখ নিয়ে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করেন যা টিপাইমুখকে দু’দেশের মধ্যেকার সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত করে। এ পরিণত হয় জাতীয় ইস্যুতে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন নিশ্চুপ ছিলেন, এর প্রতিবাদ কেন করেননি সারা দেশেই শুরু হয়ে যায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন। পিনাকের প্রত্যাহার, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ওইদিন ভারতীয় হাইকমিশনারের বিষয়ের বাইরের বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো বটেই, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও অবাক হয়েছিলেন। ট্রানজিটের মতো বিশাল ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে টিপাইমুখ নিয়ে ভারতের হঠাৎ আগ্রহ বিচার-বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন তারা। কারণ, তখন পর্যন্ত কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য হলো, টিপাইমুখ নিয়ে ভারতের প্রস্তুতি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তিন রাজ্যের সংযোগস্থলে এ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ওইসব রাজ্যেই কম বিরোধিতা নেই। এক কূটনীতিক জানান, বাংলাদেশে বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতার কারণে এ প্রকল্পকে অনেক বেশি ফুলিয়ে- ফাঁপিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে। ২৫০ করে ছয়টি ইউনিটের মাধ্যমে মোট ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হলেও তাদের পাওয়া তথ্য মতে বরাক নদীর স্রোত হিসাব করে কখনই একসঙ্গে দু’টি ইউনিটের বেশি চালানো সম্ভব হবে না। ওই হিসাবে ভারত কখনই একসঙ্গে ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। তাছাড়া প্রকল্পের ব্যয় সম্পর্কেও অতিরিক্ত বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বলা হলেও প্রকৃত পক্ষে এটি চার হাজার কোটি টাকার বেশি নয়। কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য মতে, ভারতের এ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে ন্যূনতম ১২ বছর সময় লাগবে। নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার করপোরেশন (নিপকো) এ নিয়ে মণিপুর রাজ্য সরকারের সঙ্গে এক দশকের চেষ্টায় সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ সই করতে পারলেও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেও আরও কয়েকটি উদ্বেগ কাজ করছে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার পাশাপাশি প্রায় ১৫ হাজার লোককে সরিয়ে নেয়া ও তাদের পুনর্বাসন নিয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে আবারও কেন্দ্রবিরোধী ক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার ভয়টা কম নয়। একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মতে, ভারত টিপাইমুখ নিয়ে প্রকৃত পক্ষেই আগ্রহী হলে এ মুহূর্তে আক্রমণাত্মক কূটনীতি বেছে নিতো না। পিনাক রঞ্জনের মতো ঝানু কূটনীতিক কেন্দ্রের ইঙ্গিত ছাড়া মাঠ গরমের কূটনীতিতে নেমেছেন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বাংলাদেশে টিপাইমুখ বিরোধিতা নিয়ে চরম রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি করাও নয়া দিল্লির চাণক্য নীতির অংশ বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। এতে এক ঢিলে দুই পাখ মারার মতো এক কৌশল হাসিল করতে পারে ভারত। টিপাইমুখ প্রকল্প বাতিল করলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো খুশি হবে। অন্যদিকে অন্য ইস্যু ছাড় আদায় করা যাবে বাংলাদেশ থেকে। এ মাসের শেষে সংসদীয় দল, আগস্টের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর নয়া দিল্লি সফরের কথা রয়েছে। আর এসব হাইপ্রোফাইল সফরে বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে টিপাইমুখকে অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে তুলতে হবে, এ প্রকল্প বাতিল করতে বলতে হলে ভারতকে এর বিপরীতে কিছু দিতে হবে সেটাই কূটনীতির রীতি। একাধিক কূটনৈতিক সূত্রের বিশ্লেষণ হলো, বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে ঢাকা-নয়া দিল্লি শীর্ষ বৈঠকে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত করার ঘোষণা আসাটা অস্বাভাবিক নয়। বর্তমান সরকারকে বিব্রত করার কোন ইচ্ছা এ মুহূর্তে নয়া দিল্লির কাম্য হবে না। এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে এর বিপরীতে ভারতের আকাঙ্খিত ট্রানজিটের অংশবিশেষ (আশুগঞ্জে পোর্ট অব কলসহ আশুগঞ্জ-আগরতলা রেললাইন) বা উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া-পরেশ বড়ুয়াকে চাইতে পারে ভারত। তবে টিপাইমুখের বদলে বাংলাদেশ বাধ্য হয়ে ছাড় দিয়ে ফেলতে পারে অন্য কোন ইস্যুতে এটাই আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকদের।


নিজের সম্পর্কে লেখক

I am a ordinary person. A peaceful world is my dream



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।