'চিন্তা পাঠচক্র'র আলোচনা- ১৫জানুয়ারি
১৫ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখ ‘চিন্তা পাঠচক্রে’তালাল আসাদের ‘কনস্ক্রিপ্টস অফ ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশন’ এর উপর আলোচনা হয়। আলোচনা শুরু করেন খন্দকার রাকীব। আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে তুলে দেয়া হল।
রাকীব- ‘কনসক্রিপ্ট’ শব্দটা আমরা সবাই জানি। একটা রাষ্ট্রে যখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, সেনাবাহিনী তখন জোর করে সৈন্যদলে লোক অন্তর্ভুক্ত করে। এটাকে কনস্ক্রিপশন বলে। আপনারা জানেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা পৃথিবীর ৮৪ শতাংশ জায়গা দখল করে উপনিবেশ কায়েম করেছে। দখল করা মানুষগুলো ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশনকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এর একটা এনথ্রোপোলোজিকাল স্টাডি করেছেন তালাল আসাদ। তিনি শুরু করেছেন ‘স্টানলি ডায়মন্ড’ নামের একজন বিখ্যাত লেখকের উক্তি দিয়ে। তিনি ‘একালচারেশন’ শব্দটির উল্লেখ করলেন। একালচারেশন মানে হচ্ছে অন্যান্য সংস্কৃতির উপাদান নিজেদের মধ্যে ঢুকানো। ডায়মন্ডের বক্তব্য হচ্ছে, একালচারেশনটা সব সময় একটা বিজয়ের মাধ্যমে হয়েছে। যে সমস্ত সভ্যতা অন্যান্য সভ্যতাকে জয় করছে, তারা আগের যে কালচার ছিল সেটাকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সেখানকার সোশাল ইকোনমিক কালচারগুলোকে ঐতিহাসিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে আগের জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলেছে। সেখানকার ইনডিজেনাস লোকজন ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশনকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ডায়মন্ড বলছেন এটা ভলেন্টিয়ারিলি হয় নাই, এটা হয়েছে কনস্ক্রিপ্ট। তালাল বলেন- আজকের সভ্যতার কারণে আগের সভ্যতাকে কোন কোন ক্ষেত্রে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, আবার কোনগুলাকে রিমেইড করা হইছে। এক্ষেত্রে পশ্চিমারা কেউ কেউ বলতে চাচ্ছেন যে, সামাজিকভাবে সবাই এক রকম হয়ে যাচ্ছে। যে সমস্ত নন ইউরোপিয়ান সোসাইটি ছিল তাদের আইডেনটিকাল যে অথেনসিটি এটা আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কিছু কিছু এনথ্রোপোলজিস্ট বক্তব্য দিচ্ছেন যে, কালচার কখনো হারায় না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে- কালচার নতুন নতুন করে আবিষ্কার হয়। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার যে, আপনি যত সম্ভাবনার কথা বলেন, যত আবিষ্কারের কথা বলেন, সেখানে একটা নতুন শর্ত তৈরি হয়, যে শর্তের মাধ্যমে আপনাকে এই কালচারেশনে বাধ্য করা হয়। তালাল আসাদ স্বীকার করছেন যে, অন্যান্য কালচার নতুন নতুন করে আবিষ্কার হচ্ছে। কিন্তু যাই হচ্ছে এটা আলটিমেট ইউরোপের বিজয়ের ফলে কমন একটা ওয়ার্ল্ডের মধ্যে একত্র হয়ে যাচ্ছে।
মুসতাইন জহির- এখানে একটা জিনিস মিস করেছেন। সেটা হল আমরা দুনিয়া বলতে দ্য ওয়ার্ল্ড; দ্য কনসেপ্ট অফ ওয়ার্ল্ড ইটসেল্প ইমার্জড আফটার দ্য কনকোয়েস্ট অফ এমেরিকা। এটা নিয়ে উনি একটা রেফারেন্স দিয়েছেন। কনকোয়েস্ট শব্দটার সাথে আপনারা পরিচিত। আধুনিক জগত তৈরি করার প্রক্রিয়ার একটা প্রধান অংশ হল উপনিবেশ তৈরি করা। নিউ ওয়ার্ল্ড যে কারণে বলা হত, নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করা। ফলে সরাসরি এটা কলোনি তৈরি করার সাথে জড়িত।
রাকীব- যে শর্তের অধীনে আপনাকে জবরদস্তির মধ্যে নিয়ে আসছে,সে শর্ত ব্যাখ্যা করতে তিনি দুইটা জিনিস বলছেন। একটা হচ্ছে পশ্চিমা পুঁজিবাদী এন্টারপ্রাইজ যারা আমাদের দেশে ঢুকে আমাদের অর্থনীতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে তাদের অর্থনীতিকে এখানে হাজির করছে। আর দ্বিতীয়ত, তারা একটা কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করছে। যার ফলে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে তাদের আলাদা ফিচার তৈরি করছে। এ অঞ্চলে যে মৌলিক সংস্কৃতি ছিল সেগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এখানকার কালচারকে পশ্চিমাদের অধীনে নিয়ে এসেছে। তালাল ব্যাখ্যা করেছেন যে, এরপর তারা যে রাষ্ট্র তৈরি করল, তার মাধ্যমে একটা নতুন পলিটিকাল ইকোনমি নিয়ে আসল। তারা দুটো জিনিস খুব জমকালো-ভাবে নিয়ে এসেছে। একটা হচ্ছে ‘মেটেরিয়াল ওয়েলথ-সম্পদ বৃদ্ধিকরণ’ আর একটা ‘সোশাল ইমপ্রুভমেন্ট’ যেটাকে নাম দিয়েছে প্রগ্রেস।
মুসতাইন জহির- এতক্ষণ পর্যন্ত আসাদ অন্য আলোচনাগুলোর একটি সামারি করেছে। পশ্চিমারা কলোনি তৈরি হওয়ার পরে যে ধরনের সমস্যা, যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, এগুলোর যে প্রচলিত ব্যাখ্যা আছে তার একটা সারসংক্ষেপ করে আলোচনাটা করেছে। আসাদ মূলত আলোচনা করতে চাচ্ছেন যে, আধুনিক রাষ্ট্রের বিশেষত্বটা কি? এবং কিভাবে আধুনিক রাষ্ট্র তৈরি হল? তার মধ্যে বৈশিষ্ট্যসুচক পার্থক্যটা তৈরি হল গভর্নেন্স এজ এ ডিসটিঙ্কটিভলি মডার্ন মেথড সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
রাকীব- ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী, এই সময়ে মডার্ন স্টেটের উত্থান। এর আগে স্টেটের ধারনা একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল। ব্যক্তি ছিলেন সভরেইন। যারা নাগরিক তারা ছিল সাবজেক্ট অফ পাওয়ার। কিন্তু সেখান থেকে আস্তে আস্তে এটা ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রের আকার নিয়ে ফেলল। স্টেট আসার পরে দেখা গেল যে, শাসকের জায়গাটা রাষ্ট্র নিয়ে নিয়েছে। আগে যখন রাজার শাসন ছিল, তখন আইনটা সর্বক্ষেত্রে সব কিছু ছিল না; কিন্তু স্টেট হওয়ার পরে সকল নাগরিককে সে একটা আইনের অধীন করে ফেলল। আসাদ এটাকে প্রবলেমেটিক হিসেবে দেখিয়েছেন।
মুসতাইন জহির-এই আর্টিকেলের সেন্ট্রাল জায়গাটা এখানে। আসাদ দেখাতে চাচ্ছেন যে, আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যে নতুন কি বিশেষত্ব তৈরি হল। এবং রাষ্ট্র ধারনার সাথে আগের যে শাসন ব্যবস্থা, শাসক এবং শাসিতের যে সম্পর্ক ছিল এর মধ্যে দিয়ে একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। আগে আইন এবং শাসক এক ছিলেন। তিনি অন্যদের জন্য কমান্ড বা ল দিতেন, অন্যরা এর অধীনস্থ ছিল। আইন যার কাছ থেকে আসত তিনি হচ্ছেন শাসক। আর এই আইনের অধীনস্থ যারা ছিল তারা হল সাবজেক্ট বা প্রজা। এখানে আইনটা হল আনুগত্য, অধীনস্থটা নিশ্চিত করার উপায়। এবং আইন তখন আরেকটা উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হত। তা হল ইনসাফ বা ন্যায্যতা সরবরাহ করার লক্ষ্যে। এই জাস্টিসের ধারনা হল আবার দুটো ধারনা। একটা হল ন্যাচারাল-ল, যাকে আমরা ন্যাচারাল জাস্টিস বলি। আরেকটা হল ডিভাইন যা স্বয়ং ঈশ্বর, আল্লা, খোদা; তিনিই হলেন ক্রাইটেরিয়া। তিনি হলেন জাস্টিস বা ইনসাফের প্রতিভূ। যে রাজা সে ঐ ইনসাফের অধীনস্থ থেকেই শাসক হিসেবে অন্যের জন্য ইনসাফটা নিশ্চিত করবে এবং তারা তার অনুগত থাকবে। এই ছিল সম্পর্কের জায়গাটা। এখানে আইনটা তাকে একটা ইনসাফ সরবরাহ করবে। মডার্ন স্টেটের কনসেপ্টের মধ্যে সভরেইনিটির একটা কনসেপ্ট আছে। এর আগে ত্রয়োদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত যিনি আইন দেবেন তিনি ছিলেন সভরেইন। সভরেইন একটা মানে হল যিনি আইনের ঊর্ধ্বে থাকেন এবং যার কাছ থেকে আইন আসে। পরবর্তীতে আইনের এ সম্পর্কটা পাল্টে জনগণ সার্বভৌম হল; একজন ব্যক্তি নন। ফলে প্রত্যেকে এখানে সার্বভৌম। কারণ আইনটা এখন তার কাছ থেকে আসবে। এখান থেকেই সার্বভৌম ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রে ট্রান্সফার হয়েছে। সভরেনিটির ধারনার মধ্যে একটা পারসোনিফিকেশন আছে; এটা সবসময় একজন ব্যক্তিকে কল্পনা করে। সেখান থেকে ব্যক্তি নির্বিশেষে একটা রাষ্ট্র হয়ে উঠছে। গুরুত্বপূর্ণ হল- আগে শাসক ছিল, সমাজ ছিল, বিভিন্ন বর্গ ছিল, কিন্তু সমস্ত কিছুর উপর ব্যক্তির প্রাধান্য তৈরি হয়েছে, এমন ব্যাপার ছিল না। রাষ্ট্র এখন এই যে নাগরিক তার সামগ্রিক জীবনের উপরে প্রাধান্য বিস্তারকারী প্রতিষ্ঠান আকারে গড়ে উঠছে। এবং এখানে ব্যক্তি নিজেকে আইনি সত্তা হিসেবে তৈরি করছে। আধুনিক রাষ্ট্রের আগে মানুষ আইনি সত্তা আকারে ছিল না। আধুনিক রাষ্ট্রে অবশ্যই নিজেকে আইনি সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এখানে নিজেকে আইনি সত্তা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র গঠন করা হয়। এবং রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ কতৃত্বকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধরা হয়।
রাকীব- এরপর আইন একটা পলিটিকাল স্ট্রাটেজি হয়ে গেল। এবং আইন নতুনভাবে যে বয়ানগুলো দিল, মানুষ তা মানতে বাধ্য হয়ে গেল। এরপর অনেকগুলো স্টেট তৈরি হল, যারা হয় জনগণের ব্যাপারে ব্যর্থ নয় উগ্র। তালাল দেখাচ্ছেন, আগে প্রি মডার্ন স্টেটের শাসক সার্বভৌম ছিলেন, তার অধীনে সবার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু নতুন আধুনিক রাষ্ট্রে সবাইকে সিটিজেন বলা হল। সবাইকে সমান অধিকার দেয়া হল। তাদেরকে একটা আইনি কাঠামোয় নিয়ে আসা হল। পশ্চিমা সমাজে যেভাবে আইন তৈরি হয়, আমাদের মত রাষ্ট্রে সেরকমভাবে তৈরি করা হল না। আমাদের এখানে আইনগুলোকে জোর করে গঠন করা হল। আইন গঠন করতে গিয়ে একটা প্রবলেম দেখা গেল এখানে যে বিলিভ ছিল সেগুলোকে চেঞ্জ না করে, শাসকরা এখানে পশ্চিমের আইন জোর করে জনগণের বিরুদ্ধে তৈরি করতে লাগল। উদাহরণ হিসেবে তিনি তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক, ইয়েমেনের মার্কসিস্ট আন্দোলনের উল্লেখ করেছেন। এ স্টেটগুলো পশ্চিমের ডমিনেন্ট স্টেটগুলোর চাইতে লেস পাওয়ারফুল ছিল।
এরপর তালাল আসাদ বলছেন যে, বর্তমানে যে মডার্ন ওয়ার্ল্ড আছে এর মধ্যে ডমিনেন্ট পলিটিকাল পাওয়ার এটা নিউ পসিবিলিটিজ তৈরি করতেছে। আগেকার যে বিলিভগুলো ছিল সেগুলোকে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধ্বংস করে দিচ্ছে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুনর্গঠন করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুনর্গঠন, আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধ্বংস, এগুলো নিয়ে তিনি কার্ল মার্ক্সের একটা উদ্ধৃতি দিলেন। মার্ক্স বলেন- ইন্ডিয়াতে ব্রিটিশদের দুইটা নীতি ছিল। একটা হচ্ছে ডেসট্রাকটিভ আরেকটা হচ্ছে রিজেনারেটিং। ইন্ডিয়ান সোসাইটির আগেকার যত বিশ্বাস-কালচারাল প্র্যাকটিস ছিল, সব সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে, এবং ওয়েস্টার্ন সোসাইটিকে সে জায়গায় তারা রিজেনারেট করেছে। মার্ক্স দেখালেন যে, ইন্ডিয়াতে এর আগে অনেকেই আক্রমণ করেছে; আক্রমণ করলেও এরা এখানকার যে সোসাইটি তার সাথে মিশে গেছে। নিজেদের কালচারকে তারা এখানে চাপিয়ে দেয়নি। কিন্তু ব্রিটিশরাই প্রথম, যারা এ জিনিসগুলোকে সমূলে ধ্বংস করে দিছে।
তালাল আসাদ একটা প্রশ্ন করছেন, এই যে মডার্ন ক্যাপিটিলাজিম ইন্ডিয়াতে আসল এর আগে এখানকার সোসাইটি কি অপরিবর্তনীয় ছিল? মার্কস তখন বলছে যে, ব্রিটিশরা এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের একটি আগের চেয়ে একটি উন্নত অবস্থা তৈরি করে দিয়েছে। স্যার ফিড জেমস বলছেন যে, ব্রিটিশরা যে নতুন আইন করে আগের জিনিসগুলো বাতিল করে দিয়েছে, এগুলো ভিত্তিহীন ছিল না। তিনি বলছেন, ব্রিটিশরা এখানকার মানুষদের আগের চাইতে একটা উন্নত অবস্থা তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু স্টুয়ার্ড মিল তার সাথে দ্বিমত করছেন। মিল ফিড জেমসরা এখানকার মানুষদেরকে বেটার পজিশন দেয়ার যে বক্তব্য দিচ্ছেন, সেখানে মানুষ অংশগ্রহণ করছে কিনা এই প্রশ্ন তুলেছেন। এখানকার মানুষদের যে উন্নয়ন হবে এটা তাদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য তারা স্বৈরতন্ত্রিক ক্ষমতার ব্যবহার করছেন।
তালাল আসাদ বলছেন যে, ফিড জেমসের যে বক্তব্য এই বক্তব্যকে ফেলে দেয়া যাবে না। আবার এই সিদ্ধান্তেও উপনীত হওয়া যাবে না যে, ব্রিটিশদের কারণে মানুষজনের মধ্যে একটা পরিবর্তন হয় নাই। এই যে নতুন ব্রিটিশ সিস্টেমের মধ্যে মানুষজন নতুন করে শিক্ষা নিল নেয়ার পরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ন্যাশানিলিস্ট মুভমেন্টগুলা হয়েছে এগুলা ব্রিটিশরা যে কাঠামো দিছে ঐ কাঠামোর ভিতর রয়ে গেছে। তিনি বলেন, ইন্ডিয়ান কংগ্রেস যে সেকুলার, ডেমোক্রেটিক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটের কথা বলে এগুলো ব্রিটিশরা যে নতুন বয়ান দিছে সেগুলার আল্টিমেট ফসল। ব্রিটিশরা যা করল এইগুলো ক্রুয়েলিটি, ইনজাস্টিসের মাধ্যমে আমাদের উপর নির্যাতন করছে, করে তাদের যে বয়ানগুলো ছিল তা জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর তিনি বলেন, নন ইউরোপিয়ানদের মধ্যে প্রগ্রেসের ধারণাটা যেভাবে আস্তে আস্তে জন্ম হয়েছে, তা তারা এডমিনিস্ট্রেশন এবং লিগাল ডিসকোর্সের মধ্যে ইন্সক্রাইব করেই আমাদের মধ্যে ছড়িয়েছে। তিনি এখানে দেখিয়েছেন, পশ্চিম কিভাবে আমাদের ভিতরে ঢুকে গেছে। তিনি শরিয়া ল’র কথা নিয়ে এসেছেন। পশ্চিমারা প্রথমে বিভিন্ন আইন করে আস্তে আস্তে আমাদের এখানকার কমার্শিয়াল, পেনাল, প্রসিডিউরাল ল গুলোকে চেঞ্জ করছে। এরপর তারা আস্তে করে শরিয়া’ ল তৈরি করল। শরিয়া ল তৈরি করার পর তাদের বিরুদ্ধে অনেক কনজারবেটিভ ফোর্স দাঁড়িয়েছে, যারা পশ্চিমের আইনগুলোর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু এখানে ব্রিটিশরা যে গোষ্ঠীটা তৈরি করল তারা বিভিন্ন রেশনালিস্ট বক্তব্য দিয়ে কনসার্বেটিভদের বিরুদ্ধে বয়ান তৈরি করল। তালাল আসাদ এবার দেখালেন, তারা যে শরিয়া ল করল এটাকে মডার্ন আইনের মধ্যে নিয়ে আসল। এখানে ল বা জাস্টিসের যে সিস্টেম ছিল, প্রথমে তারা পেনাল কোড, প্রসিডিউর এগুলোকে চেঞ্জ করল করে শরিয়ার বেসিক জিনিসগুলাকে ফ্যামিলি ল বা প্রাইভেট ল হিসাবে নিয়ে আসল। আগে আমরা দেখতাম মুসলিমরা একটা পুরুষ চারটা বিয়ে করতে পারত। সে যখন তখন একটা নারীকে তালাক দিতে পারত। কিন্তু নতুন শরিয়া ল’তে এসে সে নারীদের অধিকারকে বাড়াই দেয় নাই। আবার পুরুষের যে অধিকার ছিল এটাকে সে খর্ব করে দিয়েছে। এটাও আসলে পশ্চিমা মরালিটির বয়ান এখানে এনে চাপিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমা সমাজে ফ্যামিলিকে লিগাল ইউনিট হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এটাকে মরালিই দেখা হয়। এক্ষেত্রে তিনি আবার চাইল্ড মেরেজের বয়ানটা দিছেন। পশ্চিম এখানে কয়েকটা জিনিস তৈরি করলচাইল্ড মেরেজের অথরিটি যারা তারা শিশুদের উপর নিজেদের সেক্সুয়াল পাওয়ারটা এপ্লাই করে। বড়রা যাতে ছোট ছোট মেয়েদেরকে বিয়ে করতে না পারে এজন্য তারা এজ অফ কনসেন্ট তৈরি করল ষোল বছর। এটা তো হইল না সাতচল্লিশ বছরের পুরুষও ষোল বছরের মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। আবার একজন বার বছরের ছেলে বার বছরের মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেছে না। তাহলে এখানে অনেক বেশি চাইল্ডহুডের সাথে সেক্সুয়ালিটির প্রশ্ন। সেক্সুয়ালিটি করার অধিকার আছে এডাল্টদের। কেন এডাল্ট অন্যরা না এটা হচ্ছে ইউরোপে একটা আন্দোলনের ফসল। ইউরোপে যারা প্রস্টিটিউশন বিরোধী আন্দোলন করছে, ওয়ার্কিং পিপলের মধ্যে বিভিন্ন প্রবলেম দেখা দিছে। এ প্রবলেমের একটা ফসল হিসেবে তারা এই আইনগুলো করছে। এ সবগুলো আইন পশ্চিম আমাদের এখানে এনে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। এর ফলে যে প্রবলেম দেখা দিছে এ জিনিসগুলোকে তালাল আসাদ প্রবলেমেটাইজ করছে। তার আলটিমেট বক্তব্য হচ্ছে এখানকার যে মডার্ন স্টেট এই স্টেটের মধ্যে যে আইনগুলো হয়েছে এই আইনগুলো হচ্ছে জোর করে চাপাই দেয়া এবং তথাকথিত প্রগ্রেসের কথা বলে ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশনের মধ্যে আমাদের জোর করে ঢুকাই দেয়া হচ্ছে।
মুসতাইন জহির-আপনার আলোচনাটা ঠিক আছে, কিন্তু আপনার সাথে আমার বোঝার পদ্ধতি একটু আলাদা। আসাদের ‘এনথ্রোপোলজি এন্ড কলোনিয়াল এনকাউন্টার’ বইয়ের যে তর্কটার সাথে আমরা পরিচিত আছি; সেটা হল, এনথ্রোপোলজিস্টরা বিভিন্ন সময়ে সরকারি কর্মকর্তা হয়ে কিংবা একাডেমিক হিসেবে বিভিন্ন উপনিবেশে গিয়েছেন। তারা সেখানে গিয়ে নানা রকমের তথ্যানুসন্ধান করেছেন, নানা রকমের গবেষণা করেছেন এবং এনথ্রোপলজিকাল বয়ান রচনা করেছেন। যেগুলো সাম্রাজ্য বিস্তারে তাদের অনেক সাহায্য করেছে। এই অভিযোগটার মধ্যে দিয়ে মূলত তাদের বিরুদ্ধে নৈতিক একটা অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে। আসাদ বলেছেন আমি মোটেই এটা নিয়ে আগ্রহী না। এবং এটা নিয়ে যে নৈতিক দোষারোপ করা, তাতে আমি আগ্রহী না। আমার অনুসন্ধানের বিষয় হল, খোদ এনথ্রোপলজি কিভাবে ইউরোপ ও নন-ইউরোপ ভাগ করে, এবং নন-ইউরোপের সমাজ সম্পর্কে একটা ধারনা নির্মাণ করে। এবং সে ধারনার আলোকে একটা সমাজকে ব্যাখ্যা করে তার সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট বয়ান তৈরি করে। কেন এরকম করে ভাবার শর্ত তৈরি হল এবং পাশ্চিমারা এভাবে দেখার কারণগুলো কি। এটাই তালালের যে কোন আলোচনার প্রধান জায়গা। তালাল ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে কারো বিরুদ্ধে চার্জ আনছে না। তালাল দেখাতে চাচ্ছেন, কি ধরনের নতুন ধারনা নতুন জ্ঞান নতুন প্রতিষ্ঠান এবং নতুন বয়ান তৈরি হয়েছে; যে বয়ানগুলোর মধ্যে দিয়ে ইউরোপ তার সভ্যতার প্রকল্পটাকে জারি রাখছে। তাদের সিভালাইজেশের জাস্টিফিকেশনটা হল নৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। যেমন এখানে সতীদাহ প্রথা ছিল, এটা একটা ‘ইমমোরাল’ ‘আনএকসেপ্টবল’, ‘আনসিভিলাইজড’। এখান থেকে সে আপনাকে মুক্ত করল এবং আপনাকে হিউমেনাইজ করল। আসাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল, ঘোষিতভাবে ইউরোপ বলেছে যে সভ্যতার আগের পর্বে অনাধুনিক যেসব সমাজ আছে, তাদের বাধ্য করতে হবে, ভলেনটারিলি হবে না। কারণ এই জীবন যাপনের মধ্যে তারা এতটাই দ্রবীভূত যে, তারা সহজে পালটাবে না। যেমন, সে সতীদাহ প্রথা পালটাবে না; এটা সে বিশ্বাস করে। ফলে এটাকে জোর করে ধ্বংস করতে হবে, এবং সেখানে সভ্য ব্যবস্থার আনয়ন করতে হবে। আনয়ন করার ক্ষেত্রে তারা নতুন আইন করেছে, নতুন প্রতিষ্ঠান করেছে, নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এটাকে একটা বৈপ্লবিক কাজ হিসাবে ধরে নিয়েছে। তারা সম্পূর্ণ ভিন্নতর একটা মূল্যবোধ প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে আগের জীবন যাপন প্রণালী, আচার সংস্কৃতি সব সমূলে উৎপাটন করতে হয়েছে। ফলে এটা একটা কোয়ার্সিভ প্রসেস। এটা হচ্ছে উপর থেকে আসা বিপ্লব। এটার একটা মোরাল জাস্টিফিকেশন হচ্ছে আপনার মোরাল এডবান্সমেন্ট হচ্ছে। এই এডবান্সমেন্ট ও ইমপ্রুভমেন্টটা অন্য কোনভাবে করা যাবে না। এটা তাদের দাবি ছিল। এটা করার কর্তব্যটা সে বোধ করেছে। তার ইম্পেরিয়াল কলোনিয়াল প্রজেক্টটার পেছনে এই যুক্তি রয়েছে। এটা করতে গিয়ে সে একটা এক্সিসটিং কন্ডিশন অফ লাইফ নন ইউরোপিয়ান লাইফকে ডেসট্রই করেছে। এটাই তালাল আসাদ বলেছেন টোটাল অলটারেশনকন্ডিশন অফ লাইফ। এটাকে একটাকে ডিসাবেল করে একটাকে এনাবেল করে। কি ডিসাবেল করে? চাইলেও আপনি আপনার মত আপনার জীবন যাপনের যে ধরন, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ রয়েছে তা নিশ্চিত করতে পারবেন না। সে একটা মডার্ন সিস্টেমের কন্ডিশন এনাবেল করেছে। এটা যে তারা শুধু নন ইউরোপের ক্ষেত্রে করেছে তা না, এটা ইউরোপের ক্ষেত্রেও করেছে। তালাল আসাদ সেকেন্ড যে আলোচনাটা করেছে, তা নট ইউনিক টূ দ্যা নন ওয়েস্টার্ন সোসাইটি। তা ইউরোপেই ঘটেছে। ইউরোপের এই ঘটনাগুলো যখন নন ইউরোপিয়ান সোসাইটিতে আমদানি করেছে তখন সেটা কিভাবে এটা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তার ব্যাখ্যা করার জন্য তালাল ফ্যামিলি ল, চাইল্ড মেরেজ, চাইল্ড সেক্সুয়ালিটির জায়গাগুলো আলোচনা করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার আগে মানুষ নিজেকে লিগাল এজেন্ট আকারে ভাবত না। এখন তার জীবনের সমস্ত কিছু একটা লিগাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে, একটা আইনি পরিসরের মধ্যে দিয়েই তৈরি করতে হয়। এই যে লিগালাইজেশন এটার একটা এম্পেরিকাল পার্ট নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইসলামিক শরীয়াকে তারা যখন ডিফাইন করেছে তখন মেরেজ, ফ্যামিলি এই জিনিসগুলার মধ্যে করেছে। এখানে সে খুব ইন্টারেস্টিং একটা কন্ট্রাডিকশন দেখাচ্ছে। যদিও সে মোরাল এডভান্সমেন্টের কথা বলছে দেখা গেছে সে যখন শরীয়ার মধ্যে কোডিফাই করেছে পারিবারিক এবং মেরেজ ল এখানে সে তালাকের বন্দোবস্ত আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসছে। এটাকে সো টাপ করে ফেলছে। একজন মানুষের বিয়ে মুসলিম যে রিলেজিয়াস প্রিন্সিপাল এটা সো ইজি ছিল। বিভিন্ন মাজহাবে মেয়েদের তালাক দেয়ার অধিকার স্বীকার করা হত না, এখন সেটা স্বীকার করা হয়েছে কিন্তু অনুমতি চাইতে হবে। অন্যদিকে পুরুষ কিন্তু অনুমতি ছাড়াই করতে পারে। তার একটা আইনি প্রা-ধিকার আছে। ফলে সে মোরাল এডভান্সমেন্টের কাজটা করে এখন আসাদ বলেছে এটা কেন করেছে? তার কারণটা পার্টিকুলার কনসেপ্ট অফ ফ্যামিলি ইন ক্রিস্টানিয়াটি এন্ড ইউরোপ-এর সাথে সম্পর্ক আছে। কারণ সে ফ্যামিলিকে মনে করে অটোনোমাস ফেয়ার এবং ফান্ডামেন্টাল মোরাল ইউনিট অফ সোসাইটি। এই ধারনার আলোকে এখানে মুসলিম ফ্যামিলির যে লিগাল ডেফিনেশন হয়েছে সরাসরি এর দ্বারা প্রভাবিত। মুল কথা হল আগে আইনের সম্পর্ক জীবন যাপনের সর্বক্ষেত্রে সর্বব্যাপী ছিল না। রাষ্ট্রের অধীনস্থ সমস্ত ব্যক্তির জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে আইনি মাধ্যমে রাষ্ট্র যে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত কিছুর যে আইন কেন্দ্রিক সংজ্ঞায়ন নির্মাণের মধ্যে দিয়ে এটাকে পরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন, এটা একদমই আধুনিক বৈশিষ্ট্য। যেমন সে যখন একটা মেরেজ ল করে সে শুধু এখানে বয়স নির্ধারণ করে তা না, এটা দৃশ্যত মনে হতে পারে বুঝি বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের একটা জিনিস করছে। এখানে সে ডিফাইন করে চাইল্ডহুড কি, সেক্সুইয়ালিটি কি এবং রিওরিয়েন্ট করে। এই যে মডার্ন সেন্সসিভিলিটিটা কিভাবে তৈরি হয় এবং সোশাল বিহেভিয়ারকে কিভাবে নতুন ভাবে তৈরি করে। এবং এটার সাথে ইনসেস্টের ধারনা কিভাবে লিগালি ইমপ্লিমেন্ট হইছে। আপনি সবিস্তার ইন্সেস একটা এনভায়রনমেন্ট তৈরি হইছে না? এই যে বয়স, যৌনতা, শিশু সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে এটাই সে দেখাইতে চাইছে